28-09-2020, 01:36 PM
উনবিংশ পর্ব (#04)
দেবশ্রী, ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তা একটু বেড়ে গেছে।”
অনুপমা, “দিল্লীর কথা কি হল? তুমি কি ভেবেছ?”
ম্লান হেসে দেবশ্রী উত্তর দেয়, “তোরা যখন দিল্লী যাবি না তাহলে আমি গিয়ে কি করব? তাই আর সেই নিয়ে ভাবছি না। দেখি আরো কয়েক মাস এমনিতে আমি মিস্টার ঠাকুরকে একটু হিন্ট দিয়েছি যে আমার দিল্লী আসা হবে না। তাই মনে হয় আমার কাজ বেড়ে গেছে। কোলকাতা অফিসের সাথে সাথে অন্য অফিসের কাজ গুলো আমার ঘাড়ে ধিরে ধিরে এসে পড়ছে।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” দেবশ্রী জিজ্ঞাসু চাহনি নিয়ে অনুপমার দিকে তাকায়, অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি, মিস্টার দেবনাথ অথবা মল্লিকা তোমাকে ফোন করে?”
প্রশ্ন শুনে দমে যায় দেবশ্রী, মুসউরি ভ্রমণের পরে বেশ কয়েক মাস খুব ফোনে কথা হত ধৃতিমানের সাথে। গত কয়েক সপ্তাহে সেই ফোনের কথা একটু কমে আসে। অনুপমার দিকে ম্লান হেসে বলে, “হ্যাঁ, কথা হয়, কিন্তু তুই কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
অনুপমা হেসে বলে, “না এমনি জিজ্ঞেস করছি। মিস্টার দেবনাথ কিছু বলেছে তোমাকে, কোলকাতা আসছে কি ওরা?”
হেসে ফেলে দেবশ্রী, “তোর মামনিকে কি এই বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চাস? তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”
অনুপম হেসে দেয়, “না সেটা নয় মামনি, তবে তুমি বড্ড একা। আমি জানি অনেক কিছু তাই বলছিলাম। তুমি একবার মিস্টার দেবনাথ কে বলে দেখতে পারো কোলকাতায় আসার কথা। দেখো না কি বলে?”
দেবশ্রী, “আমার বলা কি সব? ওর একটা মেয়ে আছে না, মল্লিকার ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই নাকি?”
অনুপমা বলে, “হ্যাঁ তা আছে বৈকি। তুমি কি করবে কিছু ভাবলে?”
দেবশ্রী হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “মেয়ে আমার অনেক বড় হয়ে গেছে। ছাড় অইসব আলোচনা, চল শুয়ে পরি।”
অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে আব্দারের সুরে বলে, “মামনি প্লিস একটু দেবায়নের কাছে যাবো?”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “একদম দুষ্টুমি নয়। কাল সকাল সকাল ওঠা আছে, তোদের কলেজ আর আমার অফিস আছে।”
পরেরদিন কলেজে পৌঁছান মাত্র, পরাশর দেবায়নকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে যে পায়ের ধুলো দিতে। বাবা মায়ের কথা শুনে আর জারিনার বাড়ির কথা শুনে একপ্রকার দুই জনে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। জারিনা ভেঙ্গে পড়েছে, চাইলেও দেখা করতে পারছে না পরাশরের সাথে। দেবায়নের মায়ের কথা শুনে একটা আশার ক্ষীণ আলো এই ঘন অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। পরাশর বলে যে দেবায়নের মা বলেছেন কোন ভাবে নাম পরিচয় না জানিয়ে জারিনার সাথে পরাশরের মায়ের সাক্ষাৎ করাতে হবে। জারিনাকে দেখে এক মেয়ে হিসাবে পছন্দ হয়ে গেলে তারপরে পরাশরের মায়ের মন গলানো সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু কি ভাবে সেটা সম্ভব হবে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না পরাশর। অনুপমা বলে যে একটা উপায় করে দেবে যাতে পরাশরের মায়ের সাথে জারিনা সাক্ষাৎ হয়। পরাশর, অনুপমাকে বলে যদি ওদের পরিবার রাজি হয়ে যায় জারিনা আর পরাশরের সম্পর্কে, তাহলে সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে অনুপমা আর দেবায়নের কাছে। অনুপমা হেসে বলে, কাজের সময় যেন পাশে থাকে তাহলেই হবে। পরাশর বলে যে পি.জি হসপিটালে গিয়ে দেবায়নের মায়ের সাথে জারিনার বাবার পরিচয় করিয়ে দেবে। দেবায়ন, পরাশরের কানেকানে মজা করে জানায় যে জারিনার সাথে প্রথম রাত দেবায়ন কাটাতে চায়। সেই কথা শুনে পরাশর মারতে ছোটে দেবায়নকে।
একদিন শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনার কলেজ যায় জারিনার সাথে দেখা করতে। ওদের দেখে জারিনা অবাক হয়ে যায়। অনুপমা আর শ্রেয়াকে দুঃখের কথা জানায় জারিনা। পরাশরের সাথে শুধু ফোনেই কথা হয়, মাঝে মাঝে কলেজের অছিলায় দুই একবার দেখা করেছে, কিন্তু ভয় ভয়, ওদের একসাথে কেউ দেখে জারিনার বাড়িতে যদি বলে দেয় তাহলে ওর আব্বাজান বকাবকি করতে পারে। অনুপমা ওকে শান্ত করে বলে যে পরাশরের বাড়িতে যেতে হবে। সেই শুনে জারিনা যেন আকাশ থেকে পরে, জারিনা জিজ্ঞেস করে কি ভাবে পরাশরের বাড়িতে যাবে। জারিনা জানে পরাশরের মায়ের মতিগতি, এক ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ। অনুপমা হেসে বলে যে ওরা সব বন্ধু বান্ধবীরা পরাশরের বাড়িতে যাচ্ছে, পরাশরের মায়ের হাতের পায়েস খাবার জন্য। সেই আছিলায় জারিনাকে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। ওদের বাড়িতে যাবার পরে সবাইকে বন্ধু হিসাবে পরিচয় দেওয়া হবে, কারুর নাম ঠিক জানানো হবে না। জারিনাকে কিছু করে পরাশরের মাকে হাত করতে হবে, রান্না ঘরের কাজে, বাড়ির কাজে সাহায্য করে কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরাশরের মায়ের মন জয় করতে হবে। সব পরিকল্পনা শুনে জারিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনাকে সাহস জুগিয়ে বলে যদি পরাশরকে বিয়ে করতে হয় আর পরাশরকে যদি ভালোবাসে তাহলে অনেক কিছু করতে হবে। জারিনা রাজি হয়ে যায় পরাশরের বাড়িতে যাবার জন্য, মুখে হাসি টেনে বলে সব কিছু করতে রাজি এমনকি পরাশরের সাথে জাহান্নুমে যেতে রাজি।
কলেজের বাইরে দেবায়ন, ধিমান আর পরাশর দাঁড়িয়ে ছিল। জারিনাকে নিয়ে বের হবার পরে ছয়জনে পরাশরের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সারা রাস্তা জারিনা পরাশরের হাত ছারেনা এক মুহূর্তের জন্য। দুইজনের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়তে থাকে। পরাশর আগে থেকে ওর মাকে জানিয়ে রেখেছিল যে কলেজের কয়েকজন বন্ধু ওর বাড়িতে দুপুর বেলা আসবে। সেই মতন পরাশরের মা সব বন্ধুদের জন্য পায়েস বানিয়ে রেখেছিল।
বাড়িতে ঢোকার আগে, জারিনাকে জড়িয়ে ধরে পরাশর। জারিনা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ওর মা অপমানিত করে তাড়িয়ে দেবে না তো? দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের দিকে চাওয়াচায়ি করে। অনুপমা বলে যে কেউ এখুনি নিজেদের পরিচয় দেবে না, শুধু কলেজের বন্ধু বান্ধবী বলে পরিচয় দেবে সবাই, কারুর নাম এখুনি বলবে না পরাশরের মায়ের কাছে। পরিকল্পনা মতন পরাশরের বাড়িতে ঢোকে সবাই। পরাশরের মা সবাইকে বসার ঘরে বসতে বলে। জারিনা, অনুপমা আর শ্রেয়ার মাঝখানে চুপচাপ বসে থাকে। অনুপমা জারিনাকে ঠেলে বলে যে ঘরের কাজে পরাশরের মাকে সাহায্য করতে। জারিনার ছোটো বুকে বাজতে শুরু করে যুদ্ধের দামামা। একবার সবার দিকে তাকিয়ে নেয়। পরাশর পারলে লুকিয়ে যায় কোথাও, ওর মা একবার জানতে পারলে কেটে ফেলবে জারিনা আর পরাশরকে। জারিনা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে পরাশরের মা ওদের জন্য খাবার প্লেটে সাজাচ্ছিলেন। জারিনাকে আসতে দেখে পরাশরের মা একটু হাসেন। জারিনা প্লেটের মধ্যে সবকিছু সাজাতে সাহায্য করে, সেই সাথে পরাশরের মায়ের সাথে গল্প করে মন ভুলানোর জন্য। প্লেটে খাবার সাজিয়ে বসার ঘরে আসে পরাশরের মা আর জারিনা। জারিনার কান লাল হয়ে গেছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আশঙ্কায় ওর বুকের খাঁচা ফেটে পড়ার যোগাড়। বসার ঘরে সবাইকে খাবার দেবার পরে পরাশরের মা চলে যান।
অনুপমা জারিনাকে ঠেলে পরাশরের মায়ের পিছু নিতে বলে। জারিনা একবার উপরের দিকে তাকিয়ে আরেকবার পরাশরের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। বসার ঘরে সবাই নিস্তব্ধ, কারুর মুখে কোন কথা নেই, আসন্ন আশঙ্কায় সবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। কিছু পরে ভেতর থেকে হাসির কলতান শোনা যায়, জারিনা বেশ গল্পে মশগুল হয়ে গেছে পরাশরের মায়ের সাথে। বেশ কিছু পরে পরাশরের মা জারিনাকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকায়। সবাই চুপ। পরাশরের মা বলেন যে বেশ ভালো পরিকল্পনা করেছে জারিনার সাথে সাক্ষাৎ করানোর। সেই সাথে পরাশরের মা জানান যে জারিনাকে তার পছন্দ আছে কিন্তু ওর জেঠু আর বাবাকে মানাতে একটু কষ্ট হবে। জারিনা হবু স্বাশুরিকে জড়িয়ে ধরে বলে যে যদি ওদের সম্পর্কের সুস্থ সুরাহা না হয় তাহলে গঙ্গায় ডুবে মরবে দুইজনে। পরাশরের মা হেসে ফেলে জারিনার কথা শুনে, সেই সাথে জানিয়ে দেন যে কিছু একটা ব্যাবস্থা করা যাবে তবে ওনার একার পক্ষে সম্ভব নয় ওর বাবাকে বোঝানো। দেবায়ন জানায় যে ওর মা সেই কাজে সাহায্য করবে। পরাশরের বাড়ির সবাইকে একদিন নেমতন্ন করবে দেবায়ন সেই সময়ে দেবায়নের মা চেষ্টা করবেন পরাশরের বাবার সাথে কথা বলতে। পরাশরের মা, জারিনার গলায় একটা সোনার হার পড়িয়ে দেয়। জারিনার চোখে জল চলে আসে সেই সাথে পরাশরের মায়ের চোখে জল চলে আসে। পরাশরের মা, পরাশরকে বলে যে ওদের জন্য আরো একদিন নেমন্তন্ন রইল সেদিন ওর হবু বউমা রান্না করবে। সে যা রান্না করবে তাই পরাশরের মা ওর জেঠুকে আর বাবাকে রাতে খেতে দেবে। জারিনা বলে যে রান্না করতে সে এখুনি প্রস্তুত।
বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে পরাশরের বাড়ি থেকে সবাই বেড়িয়ে আসে। যাবার আগে অনুপমা আর দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে নেমন্তন্নের কথা। দেবায়ন জানায় যে মায়ের সাথে কথা বলে একটা দিন ধার্য করে ওদের সবাইকে ডাকা হবে। দেবায়ন জানায় না যে সেদিন জারিনার বাড়ির লোক কেও নেমন্তন্ন করা হবে। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই জারিনা, অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে ট্যাক্সির মধ্যে। জারিনা আর পরাশর খুব খুশি, একটা বাধা কাটল, বাকি বাধা কি করে কাটবে সেই চিন্তায়। দেবায়ন জানায় সময়ের সাথে সাথে বাকি বাধা ধিরে ধিরে লুপ্ত হয়ে যাবে।
পরাশর এর মাঝে একদিন দেবায়নের মাকে পি.জি হসপিটালে নিয়ে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দেবশ্রী, জারিনার বাবা, ডক্টর মিসবাউল আন্সারির সাথে কথা বলেন পরাশর আর জারিনার সম্পর্কের ব্যাপারে। ডক্টর আন্সারি দেবশ্রীর কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে যান। তিনি জানিয়ে দেন যে হসপিটালে এই সব আলোচনা করা ঠিক নয়। দেবশ্রী বলেন নিরুপায় হয়ে হাতপাতালে আসতে হয়েছে যেহেতু দেবশ্রী ডক্টর আন্সারিকে চেনে না তাই। ডক্টর আন্সারি হেসে প্রতি উত্তরে দেবশ্রীকে নিজেদের বাড়িতে ডাকেন একদিন। হাস্পাতাল থেকে বেড়িয়ে দেবশ্রী পরাশরকে বলে, কথা বলে দেখবে কত টা কি করা যায়। দেবশ্রী পরাশরকে আসস্থ সুরে বলে পড়াশুনায় মন দিতে, বিয়ে শাদির জন্য এখন একটা বছর হাতে সময় আছে। তাড়াহুড়োতে কোন কিছুর সুস্থ সুরাহা হবে না।
দেবায়ন আর পরাশরকে নিয়ে একদিন বিকেলে ডক্টর আন্সারির বাড়িতে যান দেবশ্রী। ডক্টর আন্সারি নিজের চেম্বারে সেদিন বেশ ব্যাস্ত ছিলেন। জারিনাকে দেখে দেবশ্রীর বেশ ভালো লাগে, সেই সাথে জারিনার মা, নাজমার সাথে কথাবার্তা হয়। নাজমা বলেন যে প্রথম দিন থেকেই পরাশর আর জারিনার ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল। তবে মেয়ের মুখে সব শুনে মায়ের মন শেষ পর্যন্ত গলে যায়। তার ভয় এই গোস্টি নিয়ে, এই গোসটির মাথারা এই শাদী নিকাহর বিরুদ্ধে যাবেন। ওইদিকে জারিনা বেঁকে বসে আছে, পরাশরকে বিয়ে না করতে পারলে গঙ্গায় ডুব দেবে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না নাজমা। দেবশ্রী, জারিনাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলে আর যেন আত্মহত্যার কথা মুখে আনে না। ডক্টর আন্সারি কাজের ফাঁকে উপরে এসে দেবশ্রী আর বাকিদের সাথে দেখা করে যান। ডক্টর আন্সারি কি করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়েকে খুব ভালবাসেন তবে এই গস্টি দ্বন্দের মাঝে পরে এক ঘরে হয়ত হতে হবে। ডক্টর আন্সারি বলেন পরাশর যদি ধর্মান্তরিত হয় তাহলে দুই জনের সম্পর্কের একটা সুরাহা হতে পারে। দেবশ্রী চিন্তিত, ওইদিকে নাজমা কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। জারিনার চোখ ছলছল। দেবশ্রী বিশেষ কথা না বাড়িয়ে সপরিবারে নিজের বাড়িতে একদিন রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করেন। দেবায়ন, পরাশর সবাই বেশ চিন্তিত, দেবশ্রী ওদের আস্বাস দিয়ে বলে যে কিছু একটা উপায় তিনি বের করবেন। ডক্টর আন্সারি জানিয়ে দেন যে পরাশরের বাড়ির সাথে দেখা করতে চান, দেবশ্রী জানিয়ে দেন যে সময় মতন সব ঠিক করে দেবেন।
বর্ষা কাল কেটে গেছে, মুসউরি থেকে বেড়িয়ে আসার পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। আকাশে থোকা থোকা পোজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়ায়। কলেজের সাথে সাথে দেবায়ন আর অনুপমার কম্পিউটার ক্লাস পুরোদমে চলে। এর মাঝে এক রবিবার, দেবায়ন পরাশরের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির লোককে রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করে আসে।
সকাল বেলাতেই অনুপমা দেবায়নের বাড়ি পৌঁছে যায় দেবায়নের মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য। পরাশর আর জারিনা বারেবারে অনুপমাকে ফোনে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলে। বারেবারে জিজ্ঞেস করে কোন অঘটন ঘটাবে কি না। পরাশর বেশ ভয়ে ভয়ে আছে, ওর বাবা গম্ভির প্রকৃতির মানুষ। পরাশরের মা একবার ওর বাবাকে বলতে চেষ্টা করেছিল জারিনার ব্যাপারে কিন্তু তিনি শুনতে নারাজ।
বিকেলে জারিনার সাথে, জারিনার মা বাবা দেবায়নের বাড়িতে পৌঁছে যায়। ওদের আসার কিছু পরেই পরাশরের বাবা মা পৌঁছে যায়। জারিনা একটা সুন্দর সাদা রঙের সালোয়ার পরে এসেছিল। দেবায়নের মা সবাইকে বসার ঘরে বসিয়ে গল্প করতে শুরু করেন। পরাশরের বাবা সুরঞ্জন বাবু, দেবায়নের মাকে এই নিমন্ত্রনের কারন জিজ্ঞেস করে। ডক্টর আন্সারিকে দেখে তার বুঝতে বিশেষ দেরি হয় না এই নিমন্ত্রনের আসল কারন। সুরঞ্জন বাবু কিঞ্চিত রেগে পরাশরের মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে দেখে। পরাশর দাঁত পিষে শ্বাস রুদ্ধ করে দেবায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। জারিনা শক্ত করে অনুপমার হাত ধরে ওদের অদুরে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী দুই বাড়ির অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
দেবশ্রী বলেন, “পরাশর আর জারিনা, ওদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে আপনাদের কাছে।”
পরাশরের মা, রঞ্জিকা, দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে সব বুঝতে পেরে যায়। নাজমা একবার পরাশরের দিকে তাকায়, অন্যদিকে রঞ্জিকা তার হবু বউমা, জারিনার দিকে তাকায়। পরাশর আর জারিনা, শ্বাস রুদ্ধ করে আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে গেছে।
ডক্টর মিসবাহুল দেবশ্রীর উত্তরে বলেন, “দেখুন দিদি, আপনি জানেন যে দুই ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিবাহ আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই আমি আপনাকে একটা উপায় বলেছিলাম যে যদি পরাশর ওর ধর্ম বদলে নেয় তাহলে এই নিকাহর ব্যাপারে আমার কোন অসুবিধে নেই।”
সুরঞ্জন বাবু চোয়াল শক্ত করে একবার পরাশরের দিকে একবার পরাশরের মায়ের দিকে তাকিয়ে হিম শীতল কণ্ঠে বলে, “তোমরা সব কিছু জানতে তাই তো? এই বিবাহ কিছুতেই সম্ভব নয়।”
ডক্টর মিসবাহুলের দিকে না তাকিয়ে উত্তরে বলেন, “কেন আমার ছেলে ধর্মান্তরিত হবে? এই বিয়েতে আমার মত নেই, এই সম্পর্ক হতে পারে না।”
পরাশরের মা প্রমাদ গুনে পরাশরের বাবাকে চুপ করতে বলে। দেবশ্রী শীতল কণ্ঠে বলেন, “কেন এই বিবাহ সম্ভব নয়? জারিনা কি দেখতে খারাপ? জারিনার কি কোন দোষ আছে? জারিনা পড়াশুনায় ভালো, কমার্স নিয়ে একটা বড় কলেজে পড়ছে। ভালো শিক্ষিত বাড়ির মেয়ে। ওর দাদা, দুর্গাপুর আর.ই কলেজে মেকানিকাল নিয়ে পড়ছে। এমত অবস্থায় আপনার আপত্তি কোথায়?”
দেবশ্রীর উত্তরে ডক্টর মিসবাহুল বলেন, “দেখুন দিদি, আমি বিশেষ কোন তর্কে যেতে চাই না। আমি জানি পরাশর কি করেছে না করেছে। আপনার সাথে আমার এই নিয়ে কথা হয়ে গেছে। আমার এই একটা শর্ত যে পরাশরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে, তবেই আমি আমার মেয়ের নিকাহ ওর সাথে দেব।”
উনবিংশ পর্ব (#05)
সুরঞ্জন বাবু গম্ভির কণ্ঠে বলেন, “ছেলে ধর্মান্তরিত হলে আমি ওকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেব। ওই রকম ছেলে আমার চাই না।”
পরাশর রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দেবশ্রী পরাশরকে শান্ত করে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “রাগের বশে কিছু করে বসলে সেটা সমস্যার সুরাহা হয় না, বরং এক নতুন সমস্যা তৈরি হয়। আমার কথা একটু শুনুন, তারপরে নিজেদের কথা বলবেন।”
ডক্টর মিসবাহুল বিচক্ষণ ব্যাক্তি তিনি চুপ করে থাকেন। সুরঞ্জন বাবু, দেবশ্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনার এতে কি আসে যায়? ছেলে আমার, ও কাকে বিয়ে করবে না করবে সেটা আমরা ভেবে দেখব। পরাশর আমাদের বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে ওর একটা কর্তব্য আছে কি নেই বাড়ির প্রতি।”
রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপ করেছিলেন, কিন্তু সুরঞ্জন বাবুর এহেন মন্ত্যবে আহত হয়ে রাগত কণ্ঠে ধমকে ওঠেন, “প্লিস একটু মাথা ঠাণ্ডা করে কথা শোনো। এমন ভাবে রেগে গেলে কোন কিছুর সুরাহা হয় না।”
সুরঞ্জন বাবু চুপ করে যান।
দেবশ্রী ম্লান হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আমার এখানে কোন স্বার্থ নেই। আমার ছেলের বন্ধু হিসাবে, পরাশর আমার কাছে এসেছিল, ওদের ভালোবাসা দেখে আমার মনে হল এদের একটা সুস্থ সুরাহা করা উচিত। নাহলে দুটি প্রান হয়ত হারিয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে। অন্তিমে কেউ সুখী হবে না।”
ডক্টর মিসবাহুল অবাক হয়ে বলেন, “আপনি নিঃস্বার্থে এদের জন্য করছেন?”
দেবশ্রী হেসে বলে, “না না, আজকাল কেউ কি আর নিঃস্বার্থে কাজ করে। আপনার মেয়ে সুরঞ্জন বাবুর বউমা হলে, ঈদে ওর হাতের বিরিয়ানি খেতে পারবো, পায়া, মটন কোর্মা কত কিছু খেতে পারবো। সেই স্বার্থে আমি এই কাজে নেমেছি।”
দেবশ্রীর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে শুধু মাত্র সুরঞ্জন বাবু ছাড়া। দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি একজন সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার, আপনি শিক্ষিত আপনি একটা কারন আমাকে দেন কেন জারিনা আপনার বাড়ির বউমা হতে পারবে না।”
সুরঞ্জন বাবু নিচু কণ্ঠে বলেন, “না মানে, বুঝতেই পারছেন কেন এই সম্পর্কে আমার অমত।”
দেবশ্রী, “ছেলে মেয়ে ভিন্ন ধর্মের সেই নিয়ে আপনার অমত। আপনি * , ডক্টর মিসবাহুল '., এই জন্য অমত।”
সুরঞ্জন বাবু মৃদু মাথা নাড়ান। দেবশ্রী বলে, “আমি ভগবান মানি, তবে ধর্মের নামে এই আচার ব্যবহার মানি না। আমি ধর্ম অথবা ভগবান একটু ভিন্ন ভাবে মানি, সময় আমাকে তাই শিখিয়েছে। আমি আপনাদের দুইজনকে আঘাত করতে চাই না, তবু বলি। এই ধর্ম আর তাঁর আচার ব্যাবহার মানুষের তৈরি, ভগবানের নয়। ভগবান গাছ পালা, নদী নালা, পশু পাখী মানুষ তৈরি করেছিলেন। তাই পৃথিবীর সব জায়গার গাছ পালা, নদী নালা, মানুষ এক রকমের দেখতে। সব জায়গার মানুষের একটা নাক, দুটো চোখ, দুটি হাত, দুটি পা। সবাই মুখ দিয়ে খায়, চোখ দিয়ে দেখে। একটা ছোটো বাচ্চা যখন জন্ম গ্রহন করে তখন সে জানে না তার ধর্ম কি। তার মুখ থেকে প্রথম শব্দ বের হয় কান্নার আওয়াজ, অ্যাঁ। সেই “অ্যাঁ” কান্নার আওয়াজ অনেকটা “মা” ডাকের মতন শোনায়। তাই “মা” ডাক পৃথিবীর সব ভাষাতেই এক। সেটা আলাস্কার কোন প্রত্যন্ত জায়গায় হোক, অথবা ইংল্যান্ডের রানীর বাড়ি হোক, অথবা চিনের দেয়ালের পেছনে হোক অথবা ভারতের কোন শহরে। মাকে সব বাচ্চা মা বলেই ডাকে। সেই ডাক তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না, তেমনি ভালোবাসা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, সেটা বুকের ভেতর থেকে আসে। মানুষ যত বড় হয়, তারা নিজের সুবিধার্থে, পারিপার্শ্বিক ভৌগলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ভাষা, ধর্ম আচার ব্যাবহার, জীবন শৈলী ইত্যাদি গঠন করে।”
দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, “ধরুন আপনার এক্সিডেন্ট হল, আপনাকে নিয়ে হাস্পাতালে যাওয়া হল। সেখানে আপনার রক্ত চাই, তখন কি আপনি জিজ্ঞেস করবেন রক্তদাতার নাম?”
সুরঞ্জন বাবু মাথা নাড়িয়ে বলেন “না”
দেবশ্রী বলেন, “আপনার শরীরে হয়ত ভিন্ন ধর্মীর রক্ত দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে তোলা হল, সেখানে আপনার আপত্তি থাকবে না। আপনি কোনদিন রেস্তোরাঁতে খেতে যান না? সেখানে কোনদিন জিজ্ঞেস করেছেন যে শেফের ধর্ম কি? রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার আপনার ভালো লাগবে। যখন একটা জীবন অপারেশান থিয়েটারে ছটফট করে তখন এই সব কথা মাথায় আসে না। শুধু একটু ভালোবাসার সময়ে আপনাদের মাথায় আসে জাত পাত, ধর্ম বিদ্বেষ, উঁচু নিচু, বড়োলোক গরিব। এই সব জাত পাত ধর্ম বিদ্বেষ সব কিছু মানুষের মনের তৈরি। এই দুইজনের জন্য এই সব একটু দুরে রাখতে পারবো না আমরা?”
সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল চুপ। ঘরের বাকি সদস্য চুপ করে দেবশ্রীর কথা শুনে যায়। জারিনা অনুপমার হাত ধরে পাথর হয়ে গেছে। অনুপমার কানেকানে বলে যে এত কথা কেউ কোনদিন ওর আব্বাজানের সামনে বলতে সাহস পায়নি। অনুপমা জানিয়ে দেয় যে ওর মামনি অন্য ধাতুর তৈরি মানুষ, যত কঠিন লোহা হোক না কেন, তাদের হৃদয় গলাতে তিনি সক্ষম।
দেবশ্রী, ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি একজন নামকরা ডক্টর। আপনি যখন একজনের চিকিৎসা করেন, তখন তার রোগ চিকিৎসা করেন না তাকে নাম দেখে চিকিৎসা করেন। আমি আর্টসের ছাত্রী ছিলাম, বিজ্ঞান পড়িনি তবে আমি ছোটবেলা থেকে ছেলেকে পড়াতে পড়াতে একটু বিজ্ঞান শিখে ফেলি আর তাই দিয়ে বিচার করেছিলাম এই মহামহিম শক্তি কে। বোঝার চেষ্টা করেছি আসল ভগবানকে। আমার মধ্যে, একটা গাছের মধ্যে, একটা কুকুরের মধ্যে, একটা মাছের মধ্যে বহিরাঙ্গের অনেক তফাত কিন্তু ধর্মে বলে ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান। আমি ও বলি ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান, কিন্তু একটু অন্য ভাবে মানি। আমরা সবাই অনু পরমানু দিয়ে গঠিত। সবার দেহে সেই প্রোটন নিউট্রন এলেক্ট্রন আছে। সেই এটমের মধ্যে যে শক্তি সেই ভগবান। অমান্য করতে পারেন?”
ডক্টর মিসবাহুল মাথা নিচু করে বসে থাকেন। দেবশ্রী বলেন, “সেই শক্তি কিন্তু এই * , '., শিখ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ তৈরি করেনি, করেছি আমরা কারন আমাদের মাথায় একটা ঘিলু বলে বস্তু আছে। আমরা ভাবনা চিন্তা করতে পারি আর তাই সকলকে হাতের মুঠিতে রাখার জন্য ভগবানের দোহাই দিয়ে একসময় তৈরি হয় এই ধরম। আমার বলার বক্তব্য এই টুকু, যে সামান্য একটা মানুষের তৈরি নিয়মের বাধা নিয়ে কেন দুই ছোটো ছেলে মেয়েকে আলাদা করে দেওয়া? তাতে কি ওরা সুখী হতে পারবে? একবার চেয়ে দেখুন ওদের চোখের দিকে তারপরে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবেন।”
ডক্টর আনসারি পরাশরের দিকে তাকায় আর সুরঞ্জন বাবু জারিনার দিকে তাকায়। দুই ছেলে মেয়ের চোখে জল, ছলছল থমথমে চেহারায় দুইজনে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী বলে, “তবে হ্যাঁ, আমি যখন বাড়িতে ডেকেছি ডিনারের জন্য তখন যেন না খেয়ে চলে যাওয়া না হয়।”
সুরঞ্জন বাবু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “এত কথা আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ বলেনি। আপনার সাথে যুক্তি তর্কে দার্শনিক তথ্যে পেরে ওঠা বড় কষ্টকর। আপনার বক্তব্য গভীর অর্থ বহন করে যা খন্ডন করা অসম্ভব। তবে আমাকে একটু ভাবতে সময় দেন।”
দেবশ্রী হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবছেন? খাবার কথা না কবে বিয়ে দেবেন সেটার কথা?”
ডক্টর মিসবাহুল হেসে ফেলেন, “আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা বড় মুশকিল। কিন্তু সমাজ, আত্মীয় সজ্জনেরা কি বলবে?”
দেবশ্রী বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, “আপনারা কি ছেলে মেয়েদের শুকনো মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? সত্যি কথা বলতে লোকেরা কি বলবে, আত্মীয় সজ্জনেরা কি বলবে সেই নিয়ে বড় মাথা ঘামাই। যাদের সুখ দুঃখে আমাদের দাঁড়ানো উচিত তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের কথা শুনতে ব্যাস্ত হয়ে যাই যারা হয়ত আমাদের খেয়ে আমাদের পেছনে নিন্দা করে বেড়ায়। আপনাদের কিছু হলে আপনার ছেলে বউমা, মেয়ে জামাই এসে দাঁড়াবে। দেবায়নকে নিয়ে আমি যখন অথৈ জলে পড়েছিলাম, তখন আমার কোন আত্মীয় আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। আপনার দুই জনে একবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনাদের কোন আত্মীয় আপনাদের পেছনে আপনাদের নিন্দা করে নি?”
নির্বাক সুরঞ্জন বাবু, নির্বাক ডক্টর মিসবাহুল। দেবশ্রী হেসে বলেন অনুপমার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে আমার বউমা। সমাজ কে কি বলল না বলল তাতে আমার আসে যায় না। তবে ওই দুষ্টু মেয়েটার মুখের হাসির জন্য আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত।”
সুরঞ্জন বাবু দেবশ্রীকে বললেন, “দিদি, সব বুঝলাম। আপনি যে যুক্তি দেখিয়েছেন সব মেনে নিলাম। আমাদের পরিবারের কথা একটু বলি আপনাকে। আমাদের যৌথ পরিবার, আমার দাদার দুই মেয়ে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে বছর আটেক আগে তার এক ছেলে এক মেয়ে। আর আমার ওই একটা ছেলে, পরাশর বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে বউমা হবে বাড়ির বড় বউমা। ভবিষ্যতে তার কাঁধে সবাইকে পরিচালনা করার ভার আসবে। তাই আমি…”
কথা শেষ করতে দেয় না দেবশ্রী কারন তার অজানা নয়, তাই বললেন, “আমি সব জানি, পরাশর আমাকে সব কিছু বলেছে। দেখুন, আমি বলছি না আজকেই জারিনাকে আপনার বউমা করে নিয়ে যেতে। আপনি আপনার দাদাকে বুঝিয়ে বলুন, সময়ের সাথে সাথে মানুষের মতি গতি, মানুষের চিন্তা ধারা বদলায়। আশা করি আপনি সেই চেষ্টা করবেন। আর আসল কথা, বউমা কেমন লেগেছে সেটা আগে বলুন।”
নাজমা আর রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, কোন কথা না বলে শুধু দেবশ্রীর কথা শুনে গেছে। নাজমা বললেন, “জানেন দিদি, প্রথম যেদিন পরাশর মাথা ফাটিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল, সেদিন আমি মেয়ের মুখ দেখে বুঝে গেছিলাম, ওই ফাটা মাথার কারন।”
নাজমার কথা শুনে পরাশরের কান লাল হয়ে যায়, জারিনা পারলে অনুপমার পেছনে লুকিয়ে যায়।
সেই শুনে হেসে ফেললেন রঞ্জিকা, “আমার বাড়িতে দেবায়ন আর অনুপমা, জারিনাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি ওকে দেখে। তারপরে যখন দেখলাম যে ফুটফুটে মেয়েটা রান্না ঘরে এসে আমাকে সাহায্য করছে তখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। বড় মিষ্টি মেয়ে। এত পাকা যে আমাকে বলে চোখে কাজল পড়লে নাকি আমার চোখ দুটি বড় বড় দেখাবে।”
রঞ্জিকা জারিনার দিকে দেখে হেসে ফেলে। জারিনা লজ্জায় অনুপমার পেছনে মুখ লুকায়। রঞ্জিকা সুরঞ্জন বাবুকে বললেন, “দেখো, সত্যি বলছি, বাড়িতে এই সব নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব। আমার আর কাকলির কথা কেউ শোনে না। দেবশ্রীদি’র মতন যুক্তি দিয়ে বুঝাতে আমি পারতাম না। আমি জানিনা তোমার কি মত, তবে বউমা আমার ভারী মিষ্টি।”
ডক্টর মিসবাহুল বললেন, “আমার একটু সময় চাই, মানে আমাদের পরিবার আরো গোঁড়া। সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা, সবাইকে মানিয়ে ওঠা খুব দুষ্কর দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমি যা ভেবে এসেছিলাম, সেই ভাবনা চিন্তা যুক্তি তক্ক আপনার দর্শন শাস্ত্রের কাছে নগন্য। আমি কোনদিন এই ভাবে ধর্মকে, ভগবানকে দেখিনি। আজকে আপনার কথা শুনে মনে হল আমরা কেন, পৃথিবীর সবাই যদি আপনার মতন চোখ খুলে একটু দেখতে পারত তাহলে পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠত। সত্যি বলতে আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, এই প্রথম পরাজয়ে আমি দুঃখিত নেই। কিন্তু বুঝতেই পারছেন।”
সুরঞ্জন বাবু সমস্বরে বলেন, “একই অবস্থা আমার পরিবারের। দুঃসাধ্য তবে আপনার কথা শুনে মনে হল অসম্ভব কিছুই নয়।”
দেবশ্রী, “আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনাদের দুইজনের পারিবারিক সমস্যার কথা। অনেক সময় আছে, জারিনার কলেজ শেষ হতে আরো তিন বছর বাকি। পরাশরের কলেজ শেষ হতে এক বছর বাকি। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়, আপনার সেই চেষ্টা করুন।”
ডক্টর মিসবাহুল মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “দুই জনের পড়াশুনা শেষ হোক আগে তারপরে ব্যাবস্থা করব।”
সুরঞ্জন বাবু বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “এস্ট্রে নিশ্চয় আপনার বাড়িতে পাওয়া যাবে না?”
দেবশ্রী হেসে ফেলে, “আমি সিগারেট খাই নাকি?”
দেবায়ন তাড়াতাড়ি একটা কাপে একটু জল নিয়ে টি টেবিলে রাখে। সুরঞ্জন বাবু একটা সিগারেট বের করে ডক্টর মিসবাহুলের দিকে এগিয়ে দেয়। ডক্টর মিসবাহুল হেসে বলেন যে একটাই ধরাতে, জারিনা জন্মাবার পরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবে বেয়াই মশাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করা কঠিন। নাজমা, ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাতে বারন করে। সুরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, আর রাগ কেন এবারে হয়ত দুই বেয়াই মিলে সিগারেট খেয়ে মনের গ্লানি দূর করবে।
রঞ্জিকা হেসে বলেন, “দিদি, আপনার ওই এটম, নিউট্রন শুনে আমার পেটের ইলেক্ট্রন কামড় দিচ্ছে। আমি আমার বেয়ানকে নিয়ে রান্না ঘরে চললাম। আপনি যা ভালো বুঝবেন সেটা করুন।”
পরাশরের মায়ের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। এতক্ষণ বাড়িতে যেন ছোটো একটা ঝড় বয়ে গেল। দেবশ্রীর সামনে বসে ছোটো দুই সোফায় ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলেন। দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরকে কাছে ডেকে সবাইকে প্রনাম করতে বলেন। জারিনা আর পরাশর, সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল কে প্রনাম করার পরে দেবশ্রীকে প্রনাম করে।
রঞ্জিকা পরাশরকে বলে, “দিদিকে একদম সাষ্টাঙ্গ প্রনাম করিস, নাহলে এই যাত্রায় কিছু সম্ভব হতো না।”
দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরের মাথা চুম্বন করে আশীর্বাদ করেন। জারিনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। পরাশর দেবায়নকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন। চারপাশের বদ্ধ আবাহাওয়ায় একটা খুশির আমেজ। বসার ঘরের দেয়ালে দেবায়নের বাবা, সায়ন্তনের একটা বড় ছবি ঝুলান। দেবশ্রী একবার সেই ছবির দিকে জল ভরা চোখে তাকায়। তারপরে দেবশ্রী ছেলে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, তোরা সন্তুষ্ট? চার জনে দৌড়ে এসে দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে।
দেবশ্রী, ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তা একটু বেড়ে গেছে।”
অনুপমা, “দিল্লীর কথা কি হল? তুমি কি ভেবেছ?”
ম্লান হেসে দেবশ্রী উত্তর দেয়, “তোরা যখন দিল্লী যাবি না তাহলে আমি গিয়ে কি করব? তাই আর সেই নিয়ে ভাবছি না। দেখি আরো কয়েক মাস এমনিতে আমি মিস্টার ঠাকুরকে একটু হিন্ট দিয়েছি যে আমার দিল্লী আসা হবে না। তাই মনে হয় আমার কাজ বেড়ে গেছে। কোলকাতা অফিসের সাথে সাথে অন্য অফিসের কাজ গুলো আমার ঘাড়ে ধিরে ধিরে এসে পড়ছে।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” দেবশ্রী জিজ্ঞাসু চাহনি নিয়ে অনুপমার দিকে তাকায়, অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “মামনি, মিস্টার দেবনাথ অথবা মল্লিকা তোমাকে ফোন করে?”
প্রশ্ন শুনে দমে যায় দেবশ্রী, মুসউরি ভ্রমণের পরে বেশ কয়েক মাস খুব ফোনে কথা হত ধৃতিমানের সাথে। গত কয়েক সপ্তাহে সেই ফোনের কথা একটু কমে আসে। অনুপমার দিকে ম্লান হেসে বলে, “হ্যাঁ, কথা হয়, কিন্তু তুই কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
অনুপমা হেসে বলে, “না এমনি জিজ্ঞেস করছি। মিস্টার দেবনাথ কিছু বলেছে তোমাকে, কোলকাতা আসছে কি ওরা?”
হেসে ফেলে দেবশ্রী, “তোর মামনিকে কি এই বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চাস? তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?”
অনুপম হেসে দেয়, “না সেটা নয় মামনি, তবে তুমি বড্ড একা। আমি জানি অনেক কিছু তাই বলছিলাম। তুমি একবার মিস্টার দেবনাথ কে বলে দেখতে পারো কোলকাতায় আসার কথা। দেখো না কি বলে?”
দেবশ্রী, “আমার বলা কি সব? ওর একটা মেয়ে আছে না, মল্লিকার ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই নাকি?”
অনুপমা বলে, “হ্যাঁ তা আছে বৈকি। তুমি কি করবে কিছু ভাবলে?”
দেবশ্রী হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “মেয়ে আমার অনেক বড় হয়ে গেছে। ছাড় অইসব আলোচনা, চল শুয়ে পরি।”
অনুপমা দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে আব্দারের সুরে বলে, “মামনি প্লিস একটু দেবায়নের কাছে যাবো?”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “একদম দুষ্টুমি নয়। কাল সকাল সকাল ওঠা আছে, তোদের কলেজ আর আমার অফিস আছে।”
পরেরদিন কলেজে পৌঁছান মাত্র, পরাশর দেবায়নকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে যে পায়ের ধুলো দিতে। বাবা মায়ের কথা শুনে আর জারিনার বাড়ির কথা শুনে একপ্রকার দুই জনে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। জারিনা ভেঙ্গে পড়েছে, চাইলেও দেখা করতে পারছে না পরাশরের সাথে। দেবায়নের মায়ের কথা শুনে একটা আশার ক্ষীণ আলো এই ঘন অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে। পরাশর বলে যে দেবায়নের মা বলেছেন কোন ভাবে নাম পরিচয় না জানিয়ে জারিনার সাথে পরাশরের মায়ের সাক্ষাৎ করাতে হবে। জারিনাকে দেখে এক মেয়ে হিসাবে পছন্দ হয়ে গেলে তারপরে পরাশরের মায়ের মন গলানো সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু কি ভাবে সেটা সম্ভব হবে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না পরাশর। অনুপমা বলে যে একটা উপায় করে দেবে যাতে পরাশরের মায়ের সাথে জারিনা সাক্ষাৎ হয়। পরাশর, অনুপমাকে বলে যদি ওদের পরিবার রাজি হয়ে যায় জারিনা আর পরাশরের সম্পর্কে, তাহলে সারা জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে অনুপমা আর দেবায়নের কাছে। অনুপমা হেসে বলে, কাজের সময় যেন পাশে থাকে তাহলেই হবে। পরাশর বলে যে পি.জি হসপিটালে গিয়ে দেবায়নের মায়ের সাথে জারিনার বাবার পরিচয় করিয়ে দেবে। দেবায়ন, পরাশরের কানেকানে মজা করে জানায় যে জারিনার সাথে প্রথম রাত দেবায়ন কাটাতে চায়। সেই কথা শুনে পরাশর মারতে ছোটে দেবায়নকে।
একদিন শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনার কলেজ যায় জারিনার সাথে দেখা করতে। ওদের দেখে জারিনা অবাক হয়ে যায়। অনুপমা আর শ্রেয়াকে দুঃখের কথা জানায় জারিনা। পরাশরের সাথে শুধু ফোনেই কথা হয়, মাঝে মাঝে কলেজের অছিলায় দুই একবার দেখা করেছে, কিন্তু ভয় ভয়, ওদের একসাথে কেউ দেখে জারিনার বাড়িতে যদি বলে দেয় তাহলে ওর আব্বাজান বকাবকি করতে পারে। অনুপমা ওকে শান্ত করে বলে যে পরাশরের বাড়িতে যেতে হবে। সেই শুনে জারিনা যেন আকাশ থেকে পরে, জারিনা জিজ্ঞেস করে কি ভাবে পরাশরের বাড়িতে যাবে। জারিনা জানে পরাশরের মায়ের মতিগতি, এক ভিন্ন ধর্মের মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ। অনুপমা হেসে বলে যে ওরা সব বন্ধু বান্ধবীরা পরাশরের বাড়িতে যাচ্ছে, পরাশরের মায়ের হাতের পায়েস খাবার জন্য। সেই আছিলায় জারিনাকে ওদের সাথে নিয়ে যাবে। ওদের বাড়িতে যাবার পরে সবাইকে বন্ধু হিসাবে পরিচয় দেওয়া হবে, কারুর নাম ঠিক জানানো হবে না। জারিনাকে কিছু করে পরাশরের মাকে হাত করতে হবে, রান্না ঘরের কাজে, বাড়ির কাজে সাহায্য করে কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরাশরের মায়ের মন জয় করতে হবে। সব পরিকল্পনা শুনে জারিনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। শ্রেয়া আর অনুপমা, জারিনাকে সাহস জুগিয়ে বলে যদি পরাশরকে বিয়ে করতে হয় আর পরাশরকে যদি ভালোবাসে তাহলে অনেক কিছু করতে হবে। জারিনা রাজি হয়ে যায় পরাশরের বাড়িতে যাবার জন্য, মুখে হাসি টেনে বলে সব কিছু করতে রাজি এমনকি পরাশরের সাথে জাহান্নুমে যেতে রাজি।
কলেজের বাইরে দেবায়ন, ধিমান আর পরাশর দাঁড়িয়ে ছিল। জারিনাকে নিয়ে বের হবার পরে ছয়জনে পরাশরের বাড়ির দিকে রওনা দেয়। সারা রাস্তা জারিনা পরাশরের হাত ছারেনা এক মুহূর্তের জন্য। দুইজনের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়তে থাকে। পরাশর আগে থেকে ওর মাকে জানিয়ে রেখেছিল যে কলেজের কয়েকজন বন্ধু ওর বাড়িতে দুপুর বেলা আসবে। সেই মতন পরাশরের মা সব বন্ধুদের জন্য পায়েস বানিয়ে রেখেছিল।
বাড়িতে ঢোকার আগে, জারিনাকে জড়িয়ে ধরে পরাশর। জারিনা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ওর মা অপমানিত করে তাড়িয়ে দেবে না তো? দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের দিকে চাওয়াচায়ি করে। অনুপমা বলে যে কেউ এখুনি নিজেদের পরিচয় দেবে না, শুধু কলেজের বন্ধু বান্ধবী বলে পরিচয় দেবে সবাই, কারুর নাম এখুনি বলবে না পরাশরের মায়ের কাছে। পরিকল্পনা মতন পরাশরের বাড়িতে ঢোকে সবাই। পরাশরের মা সবাইকে বসার ঘরে বসতে বলে। জারিনা, অনুপমা আর শ্রেয়ার মাঝখানে চুপচাপ বসে থাকে। অনুপমা জারিনাকে ঠেলে বলে যে ঘরের কাজে পরাশরের মাকে সাহায্য করতে। জারিনার ছোটো বুকে বাজতে শুরু করে যুদ্ধের দামামা। একবার সবার দিকে তাকিয়ে নেয়। পরাশর পারলে লুকিয়ে যায় কোথাও, ওর মা একবার জানতে পারলে কেটে ফেলবে জারিনা আর পরাশরকে। জারিনা রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে পরাশরের মা ওদের জন্য খাবার প্লেটে সাজাচ্ছিলেন। জারিনাকে আসতে দেখে পরাশরের মা একটু হাসেন। জারিনা প্লেটের মধ্যে সবকিছু সাজাতে সাহায্য করে, সেই সাথে পরাশরের মায়ের সাথে গল্প করে মন ভুলানোর জন্য। প্লেটে খাবার সাজিয়ে বসার ঘরে আসে পরাশরের মা আর জারিনা। জারিনার কান লাল হয়ে গেছে, মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে আশঙ্কায় ওর বুকের খাঁচা ফেটে পড়ার যোগাড়। বসার ঘরে সবাইকে খাবার দেবার পরে পরাশরের মা চলে যান।
অনুপমা জারিনাকে ঠেলে পরাশরের মায়ের পিছু নিতে বলে। জারিনা একবার উপরের দিকে তাকিয়ে আরেকবার পরাশরের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। বসার ঘরে সবাই নিস্তব্ধ, কারুর মুখে কোন কথা নেই, আসন্ন আশঙ্কায় সবার বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। কিছু পরে ভেতর থেকে হাসির কলতান শোনা যায়, জারিনা বেশ গল্পে মশগুল হয়ে গেছে পরাশরের মায়ের সাথে। বেশ কিছু পরে পরাশরের মা জারিনাকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকায়। সবাই চুপ। পরাশরের মা বলেন যে বেশ ভালো পরিকল্পনা করেছে জারিনার সাথে সাক্ষাৎ করানোর। সেই সাথে পরাশরের মা জানান যে জারিনাকে তার পছন্দ আছে কিন্তু ওর জেঠু আর বাবাকে মানাতে একটু কষ্ট হবে। জারিনা হবু স্বাশুরিকে জড়িয়ে ধরে বলে যে যদি ওদের সম্পর্কের সুস্থ সুরাহা না হয় তাহলে গঙ্গায় ডুবে মরবে দুইজনে। পরাশরের মা হেসে ফেলে জারিনার কথা শুনে, সেই সাথে জানিয়ে দেন যে কিছু একটা ব্যাবস্থা করা যাবে তবে ওনার একার পক্ষে সম্ভব নয় ওর বাবাকে বোঝানো। দেবায়ন জানায় যে ওর মা সেই কাজে সাহায্য করবে। পরাশরের বাড়ির সবাইকে একদিন নেমতন্ন করবে দেবায়ন সেই সময়ে দেবায়নের মা চেষ্টা করবেন পরাশরের বাবার সাথে কথা বলতে। পরাশরের মা, জারিনার গলায় একটা সোনার হার পড়িয়ে দেয়। জারিনার চোখে জল চলে আসে সেই সাথে পরাশরের মায়ের চোখে জল চলে আসে। পরাশরের মা, পরাশরকে বলে যে ওদের জন্য আরো একদিন নেমন্তন্ন রইল সেদিন ওর হবু বউমা রান্না করবে। সে যা রান্না করবে তাই পরাশরের মা ওর জেঠুকে আর বাবাকে রাতে খেতে দেবে। জারিনা বলে যে রান্না করতে সে এখুনি প্রস্তুত।
বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে পরাশরের বাড়ি থেকে সবাই বেড়িয়ে আসে। যাবার আগে অনুপমা আর দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে নেমন্তন্নের কথা। দেবায়ন জানায় যে মায়ের সাথে কথা বলে একটা দিন ধার্য করে ওদের সবাইকে ডাকা হবে। দেবায়ন জানায় না যে সেদিন জারিনার বাড়ির লোক কেও নেমন্তন্ন করা হবে। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই জারিনা, অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে ট্যাক্সির মধ্যে। জারিনা আর পরাশর খুব খুশি, একটা বাধা কাটল, বাকি বাধা কি করে কাটবে সেই চিন্তায়। দেবায়ন জানায় সময়ের সাথে সাথে বাকি বাধা ধিরে ধিরে লুপ্ত হয়ে যাবে।
পরাশর এর মাঝে একদিন দেবায়নের মাকে পি.জি হসপিটালে নিয়ে জারিনার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দেবশ্রী, জারিনার বাবা, ডক্টর মিসবাউল আন্সারির সাথে কথা বলেন পরাশর আর জারিনার সম্পর্কের ব্যাপারে। ডক্টর আন্সারি দেবশ্রীর কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে যান। তিনি জানিয়ে দেন যে হসপিটালে এই সব আলোচনা করা ঠিক নয়। দেবশ্রী বলেন নিরুপায় হয়ে হাতপাতালে আসতে হয়েছে যেহেতু দেবশ্রী ডক্টর আন্সারিকে চেনে না তাই। ডক্টর আন্সারি হেসে প্রতি উত্তরে দেবশ্রীকে নিজেদের বাড়িতে ডাকেন একদিন। হাস্পাতাল থেকে বেড়িয়ে দেবশ্রী পরাশরকে বলে, কথা বলে দেখবে কত টা কি করা যায়। দেবশ্রী পরাশরকে আসস্থ সুরে বলে পড়াশুনায় মন দিতে, বিয়ে শাদির জন্য এখন একটা বছর হাতে সময় আছে। তাড়াহুড়োতে কোন কিছুর সুস্থ সুরাহা হবে না।
দেবায়ন আর পরাশরকে নিয়ে একদিন বিকেলে ডক্টর আন্সারির বাড়িতে যান দেবশ্রী। ডক্টর আন্সারি নিজের চেম্বারে সেদিন বেশ ব্যাস্ত ছিলেন। জারিনাকে দেখে দেবশ্রীর বেশ ভালো লাগে, সেই সাথে জারিনার মা, নাজমার সাথে কথাবার্তা হয়। নাজমা বলেন যে প্রথম দিন থেকেই পরাশর আর জারিনার ব্যাপারে তার সন্দেহ ছিল। তবে মেয়ের মুখে সব শুনে মায়ের মন শেষ পর্যন্ত গলে যায়। তার ভয় এই গোস্টি নিয়ে, এই গোসটির মাথারা এই শাদী নিকাহর বিরুদ্ধে যাবেন। ওইদিকে জারিনা বেঁকে বসে আছে, পরাশরকে বিয়ে না করতে পারলে গঙ্গায় ডুব দেবে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না নাজমা। দেবশ্রী, জারিনাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলে আর যেন আত্মহত্যার কথা মুখে আনে না। ডক্টর আন্সারি কাজের ফাঁকে উপরে এসে দেবশ্রী আর বাকিদের সাথে দেখা করে যান। ডক্টর আন্সারি কি করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়েকে খুব ভালবাসেন তবে এই গস্টি দ্বন্দের মাঝে পরে এক ঘরে হয়ত হতে হবে। ডক্টর আন্সারি বলেন পরাশর যদি ধর্মান্তরিত হয় তাহলে দুই জনের সম্পর্কের একটা সুরাহা হতে পারে। দেবশ্রী চিন্তিত, ওইদিকে নাজমা কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। জারিনার চোখ ছলছল। দেবশ্রী বিশেষ কথা না বাড়িয়ে সপরিবারে নিজের বাড়িতে একদিন রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করেন। দেবায়ন, পরাশর সবাই বেশ চিন্তিত, দেবশ্রী ওদের আস্বাস দিয়ে বলে যে কিছু একটা উপায় তিনি বের করবেন। ডক্টর আন্সারি জানিয়ে দেন যে পরাশরের বাড়ির সাথে দেখা করতে চান, দেবশ্রী জানিয়ে দেন যে সময় মতন সব ঠিক করে দেবেন।
বর্ষা কাল কেটে গেছে, মুসউরি থেকে বেড়িয়ে আসার পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। আকাশে থোকা থোকা পোজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়ায়। কলেজের সাথে সাথে দেবায়ন আর অনুপমার কম্পিউটার ক্লাস পুরোদমে চলে। এর মাঝে এক রবিবার, দেবায়ন পরাশরের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির লোককে রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করে আসে।
সকাল বেলাতেই অনুপমা দেবায়নের বাড়ি পৌঁছে যায় দেবায়নের মায়ের কাজে সাহায্য করার জন্য। পরাশর আর জারিনা বারেবারে অনুপমাকে ফোনে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলে। বারেবারে জিজ্ঞেস করে কোন অঘটন ঘটাবে কি না। পরাশর বেশ ভয়ে ভয়ে আছে, ওর বাবা গম্ভির প্রকৃতির মানুষ। পরাশরের মা একবার ওর বাবাকে বলতে চেষ্টা করেছিল জারিনার ব্যাপারে কিন্তু তিনি শুনতে নারাজ।
বিকেলে জারিনার সাথে, জারিনার মা বাবা দেবায়নের বাড়িতে পৌঁছে যায়। ওদের আসার কিছু পরেই পরাশরের বাবা মা পৌঁছে যায়। জারিনা একটা সুন্দর সাদা রঙের সালোয়ার পরে এসেছিল। দেবায়নের মা সবাইকে বসার ঘরে বসিয়ে গল্প করতে শুরু করেন। পরাশরের বাবা সুরঞ্জন বাবু, দেবায়নের মাকে এই নিমন্ত্রনের কারন জিজ্ঞেস করে। ডক্টর আন্সারিকে দেখে তার বুঝতে বিশেষ দেরি হয় না এই নিমন্ত্রনের আসল কারন। সুরঞ্জন বাবু কিঞ্চিত রেগে পরাশরের মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে দেখে। পরাশর দাঁত পিষে শ্বাস রুদ্ধ করে দেবায়নের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। জারিনা শক্ত করে অনুপমার হাত ধরে ওদের অদুরে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী দুই বাড়ির অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
দেবশ্রী বলেন, “পরাশর আর জারিনা, ওদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে আপনাদের কাছে।”
পরাশরের মা, রঞ্জিকা, দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে সব বুঝতে পেরে যায়। নাজমা একবার পরাশরের দিকে তাকায়, অন্যদিকে রঞ্জিকা তার হবু বউমা, জারিনার দিকে তাকায়। পরাশর আর জারিনা, শ্বাস রুদ্ধ করে আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে গেছে।
ডক্টর মিসবাহুল দেবশ্রীর উত্তরে বলেন, “দেখুন দিদি, আপনি জানেন যে দুই ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিবাহ আমাদের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। তাই আমি আপনাকে একটা উপায় বলেছিলাম যে যদি পরাশর ওর ধর্ম বদলে নেয় তাহলে এই নিকাহর ব্যাপারে আমার কোন অসুবিধে নেই।”
সুরঞ্জন বাবু চোয়াল শক্ত করে একবার পরাশরের দিকে একবার পরাশরের মায়ের দিকে তাকিয়ে হিম শীতল কণ্ঠে বলে, “তোমরা সব কিছু জানতে তাই তো? এই বিবাহ কিছুতেই সম্ভব নয়।”
ডক্টর মিসবাহুলের দিকে না তাকিয়ে উত্তরে বলেন, “কেন আমার ছেলে ধর্মান্তরিত হবে? এই বিয়েতে আমার মত নেই, এই সম্পর্ক হতে পারে না।”
পরাশরের মা প্রমাদ গুনে পরাশরের বাবাকে চুপ করতে বলে। দেবশ্রী শীতল কণ্ঠে বলেন, “কেন এই বিবাহ সম্ভব নয়? জারিনা কি দেখতে খারাপ? জারিনার কি কোন দোষ আছে? জারিনা পড়াশুনায় ভালো, কমার্স নিয়ে একটা বড় কলেজে পড়ছে। ভালো শিক্ষিত বাড়ির মেয়ে। ওর দাদা, দুর্গাপুর আর.ই কলেজে মেকানিকাল নিয়ে পড়ছে। এমত অবস্থায় আপনার আপত্তি কোথায়?”
দেবশ্রীর উত্তরে ডক্টর মিসবাহুল বলেন, “দেখুন দিদি, আমি বিশেষ কোন তর্কে যেতে চাই না। আমি জানি পরাশর কি করেছে না করেছে। আপনার সাথে আমার এই নিয়ে কথা হয়ে গেছে। আমার এই একটা শর্ত যে পরাশরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে, তবেই আমি আমার মেয়ের নিকাহ ওর সাথে দেব।”
উনবিংশ পর্ব (#05)
সুরঞ্জন বাবু গম্ভির কণ্ঠে বলেন, “ছেলে ধর্মান্তরিত হলে আমি ওকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেব। ওই রকম ছেলে আমার চাই না।”
পরাশর রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, দেবশ্রী পরাশরকে শান্ত করে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলেন, “রাগের বশে কিছু করে বসলে সেটা সমস্যার সুরাহা হয় না, বরং এক নতুন সমস্যা তৈরি হয়। আমার কথা একটু শুনুন, তারপরে নিজেদের কথা বলবেন।”
ডক্টর মিসবাহুল বিচক্ষণ ব্যাক্তি তিনি চুপ করে থাকেন। সুরঞ্জন বাবু, দেবশ্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনার এতে কি আসে যায়? ছেলে আমার, ও কাকে বিয়ে করবে না করবে সেটা আমরা ভেবে দেখব। পরাশর আমাদের বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে ওর একটা কর্তব্য আছে কি নেই বাড়ির প্রতি।”
রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপ করেছিলেন, কিন্তু সুরঞ্জন বাবুর এহেন মন্ত্যবে আহত হয়ে রাগত কণ্ঠে ধমকে ওঠেন, “প্লিস একটু মাথা ঠাণ্ডা করে কথা শোনো। এমন ভাবে রেগে গেলে কোন কিছুর সুরাহা হয় না।”
সুরঞ্জন বাবু চুপ করে যান।
দেবশ্রী ম্লান হেসে বলেন, “হ্যাঁ, আমার এখানে কোন স্বার্থ নেই। আমার ছেলের বন্ধু হিসাবে, পরাশর আমার কাছে এসেছিল, ওদের ভালোবাসা দেখে আমার মনে হল এদের একটা সুস্থ সুরাহা করা উচিত। নাহলে দুটি প্রান হয়ত হারিয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে। অন্তিমে কেউ সুখী হবে না।”
ডক্টর মিসবাহুল অবাক হয়ে বলেন, “আপনি নিঃস্বার্থে এদের জন্য করছেন?”
দেবশ্রী হেসে বলে, “না না, আজকাল কেউ কি আর নিঃস্বার্থে কাজ করে। আপনার মেয়ে সুরঞ্জন বাবুর বউমা হলে, ঈদে ওর হাতের বিরিয়ানি খেতে পারবো, পায়া, মটন কোর্মা কত কিছু খেতে পারবো। সেই স্বার্থে আমি এই কাজে নেমেছি।”
দেবশ্রীর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে শুধু মাত্র সুরঞ্জন বাবু ছাড়া। দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনি একজন সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার, আপনি শিক্ষিত আপনি একটা কারন আমাকে দেন কেন জারিনা আপনার বাড়ির বউমা হতে পারবে না।”
সুরঞ্জন বাবু নিচু কণ্ঠে বলেন, “না মানে, বুঝতেই পারছেন কেন এই সম্পর্কে আমার অমত।”
দেবশ্রী, “ছেলে মেয়ে ভিন্ন ধর্মের সেই নিয়ে আপনার অমত। আপনি * , ডক্টর মিসবাহুল '., এই জন্য অমত।”
সুরঞ্জন বাবু মৃদু মাথা নাড়ান। দেবশ্রী বলে, “আমি ভগবান মানি, তবে ধর্মের নামে এই আচার ব্যবহার মানি না। আমি ধর্ম অথবা ভগবান একটু ভিন্ন ভাবে মানি, সময় আমাকে তাই শিখিয়েছে। আমি আপনাদের দুইজনকে আঘাত করতে চাই না, তবু বলি। এই ধর্ম আর তাঁর আচার ব্যাবহার মানুষের তৈরি, ভগবানের নয়। ভগবান গাছ পালা, নদী নালা, পশু পাখী মানুষ তৈরি করেছিলেন। তাই পৃথিবীর সব জায়গার গাছ পালা, নদী নালা, মানুষ এক রকমের দেখতে। সব জায়গার মানুষের একটা নাক, দুটো চোখ, দুটি হাত, দুটি পা। সবাই মুখ দিয়ে খায়, চোখ দিয়ে দেখে। একটা ছোটো বাচ্চা যখন জন্ম গ্রহন করে তখন সে জানে না তার ধর্ম কি। তার মুখ থেকে প্রথম শব্দ বের হয় কান্নার আওয়াজ, অ্যাঁ। সেই “অ্যাঁ” কান্নার আওয়াজ অনেকটা “মা” ডাকের মতন শোনায়। তাই “মা” ডাক পৃথিবীর সব ভাষাতেই এক। সেটা আলাস্কার কোন প্রত্যন্ত জায়গায় হোক, অথবা ইংল্যান্ডের রানীর বাড়ি হোক, অথবা চিনের দেয়ালের পেছনে হোক অথবা ভারতের কোন শহরে। মাকে সব বাচ্চা মা বলেই ডাকে। সেই ডাক তাদের শিখিয়ে দিতে হয় না, তেমনি ভালোবাসা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, সেটা বুকের ভেতর থেকে আসে। মানুষ যত বড় হয়, তারা নিজের সুবিধার্থে, পারিপার্শ্বিক ভৌগলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ভাষা, ধর্ম আচার ব্যাবহার, জীবন শৈলী ইত্যাদি গঠন করে।”
দেবশ্রী সুরঞ্জন বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, “ধরুন আপনার এক্সিডেন্ট হল, আপনাকে নিয়ে হাস্পাতালে যাওয়া হল। সেখানে আপনার রক্ত চাই, তখন কি আপনি জিজ্ঞেস করবেন রক্তদাতার নাম?”
সুরঞ্জন বাবু মাথা নাড়িয়ে বলেন “না”
দেবশ্রী বলেন, “আপনার শরীরে হয়ত ভিন্ন ধর্মীর রক্ত দিয়ে আপনাকে বাঁচিয়ে তোলা হল, সেখানে আপনার আপত্তি থাকবে না। আপনি কোনদিন রেস্তোরাঁতে খেতে যান না? সেখানে কোনদিন জিজ্ঞেস করেছেন যে শেফের ধর্ম কি? রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার আপনার ভালো লাগবে। যখন একটা জীবন অপারেশান থিয়েটারে ছটফট করে তখন এই সব কথা মাথায় আসে না। শুধু একটু ভালোবাসার সময়ে আপনাদের মাথায় আসে জাত পাত, ধর্ম বিদ্বেষ, উঁচু নিচু, বড়োলোক গরিব। এই সব জাত পাত ধর্ম বিদ্বেষ সব কিছু মানুষের মনের তৈরি। এই দুইজনের জন্য এই সব একটু দুরে রাখতে পারবো না আমরা?”
সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল চুপ। ঘরের বাকি সদস্য চুপ করে দেবশ্রীর কথা শুনে যায়। জারিনা অনুপমার হাত ধরে পাথর হয়ে গেছে। অনুপমার কানেকানে বলে যে এত কথা কেউ কোনদিন ওর আব্বাজানের সামনে বলতে সাহস পায়নি। অনুপমা জানিয়ে দেয় যে ওর মামনি অন্য ধাতুর তৈরি মানুষ, যত কঠিন লোহা হোক না কেন, তাদের হৃদয় গলাতে তিনি সক্ষম।
দেবশ্রী, ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি একজন নামকরা ডক্টর। আপনি যখন একজনের চিকিৎসা করেন, তখন তার রোগ চিকিৎসা করেন না তাকে নাম দেখে চিকিৎসা করেন। আমি আর্টসের ছাত্রী ছিলাম, বিজ্ঞান পড়িনি তবে আমি ছোটবেলা থেকে ছেলেকে পড়াতে পড়াতে একটু বিজ্ঞান শিখে ফেলি আর তাই দিয়ে বিচার করেছিলাম এই মহামহিম শক্তি কে। বোঝার চেষ্টা করেছি আসল ভগবানকে। আমার মধ্যে, একটা গাছের মধ্যে, একটা কুকুরের মধ্যে, একটা মাছের মধ্যে বহিরাঙ্গের অনেক তফাত কিন্তু ধর্মে বলে ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান। আমি ও বলি ভগবান সর্বত্র বিদ্যমান, কিন্তু একটু অন্য ভাবে মানি। আমরা সবাই অনু পরমানু দিয়ে গঠিত। সবার দেহে সেই প্রোটন নিউট্রন এলেক্ট্রন আছে। সেই এটমের মধ্যে যে শক্তি সেই ভগবান। অমান্য করতে পারেন?”
ডক্টর মিসবাহুল মাথা নিচু করে বসে থাকেন। দেবশ্রী বলেন, “সেই শক্তি কিন্তু এই * , '., শিখ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ তৈরি করেনি, করেছি আমরা কারন আমাদের মাথায় একটা ঘিলু বলে বস্তু আছে। আমরা ভাবনা চিন্তা করতে পারি আর তাই সকলকে হাতের মুঠিতে রাখার জন্য ভগবানের দোহাই দিয়ে একসময় তৈরি হয় এই ধরম। আমার বলার বক্তব্য এই টুকু, যে সামান্য একটা মানুষের তৈরি নিয়মের বাধা নিয়ে কেন দুই ছোটো ছেলে মেয়েকে আলাদা করে দেওয়া? তাতে কি ওরা সুখী হতে পারবে? একবার চেয়ে দেখুন ওদের চোখের দিকে তারপরে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবেন।”
ডক্টর আনসারি পরাশরের দিকে তাকায় আর সুরঞ্জন বাবু জারিনার দিকে তাকায়। দুই ছেলে মেয়ের চোখে জল, ছলছল থমথমে চেহারায় দুইজনে দাঁড়িয়ে। দেবশ্রী বলে, “তবে হ্যাঁ, আমি যখন বাড়িতে ডেকেছি ডিনারের জন্য তখন যেন না খেয়ে চলে যাওয়া না হয়।”
সুরঞ্জন বাবু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “এত কথা আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ বলেনি। আপনার সাথে যুক্তি তর্কে দার্শনিক তথ্যে পেরে ওঠা বড় কষ্টকর। আপনার বক্তব্য গভীর অর্থ বহন করে যা খন্ডন করা অসম্ভব। তবে আমাকে একটু ভাবতে সময় দেন।”
দেবশ্রী হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবছেন? খাবার কথা না কবে বিয়ে দেবেন সেটার কথা?”
ডক্টর মিসবাহুল হেসে ফেলেন, “আপনার সাথে কথায় পেরে ওঠা বড় মুশকিল। কিন্তু সমাজ, আত্মীয় সজ্জনেরা কি বলবে?”
দেবশ্রী বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, “আপনারা কি ছেলে মেয়েদের শুকনো মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন? সত্যি কথা বলতে লোকেরা কি বলবে, আত্মীয় সজ্জনেরা কি বলবে সেই নিয়ে বড় মাথা ঘামাই। যাদের সুখ দুঃখে আমাদের দাঁড়ানো উচিত তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাদের কথা শুনতে ব্যাস্ত হয়ে যাই যারা হয়ত আমাদের খেয়ে আমাদের পেছনে নিন্দা করে বেড়ায়। আপনাদের কিছু হলে আপনার ছেলে বউমা, মেয়ে জামাই এসে দাঁড়াবে। দেবায়নকে নিয়ে আমি যখন অথৈ জলে পড়েছিলাম, তখন আমার কোন আত্মীয় আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি। আপনার দুই জনে একবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনাদের কোন আত্মীয় আপনাদের পেছনে আপনাদের নিন্দা করে নি?”
নির্বাক সুরঞ্জন বাবু, নির্বাক ডক্টর মিসবাহুল। দেবশ্রী হেসে বলেন অনুপমার দিকে দেখিয়ে বলে, “ওই যে আমার বউমা। সমাজ কে কি বলল না বলল তাতে আমার আসে যায় না। তবে ওই দুষ্টু মেয়েটার মুখের হাসির জন্য আমি সব কিছু করতে প্রস্তুত।”
সুরঞ্জন বাবু দেবশ্রীকে বললেন, “দিদি, সব বুঝলাম। আপনি যে যুক্তি দেখিয়েছেন সব মেনে নিলাম। আমাদের পরিবারের কথা একটু বলি আপনাকে। আমাদের যৌথ পরিবার, আমার দাদার দুই মেয়ে, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে বছর আটেক আগে তার এক ছেলে এক মেয়ে। আর আমার ওই একটা ছেলে, পরাশর বাড়ির বড় ছেলে। সেই হিসাবে বউমা হবে বাড়ির বড় বউমা। ভবিষ্যতে তার কাঁধে সবাইকে পরিচালনা করার ভার আসবে। তাই আমি…”
কথা শেষ করতে দেয় না দেবশ্রী কারন তার অজানা নয়, তাই বললেন, “আমি সব জানি, পরাশর আমাকে সব কিছু বলেছে। দেখুন, আমি বলছি না আজকেই জারিনাকে আপনার বউমা করে নিয়ে যেতে। আপনি আপনার দাদাকে বুঝিয়ে বলুন, সময়ের সাথে সাথে মানুষের মতি গতি, মানুষের চিন্তা ধারা বদলায়। আশা করি আপনি সেই চেষ্টা করবেন। আর আসল কথা, বউমা কেমন লেগেছে সেটা আগে বলুন।”
নাজমা আর রঞ্জিকা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন, কোন কথা না বলে শুধু দেবশ্রীর কথা শুনে গেছে। নাজমা বললেন, “জানেন দিদি, প্রথম যেদিন পরাশর মাথা ফাটিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল, সেদিন আমি মেয়ের মুখ দেখে বুঝে গেছিলাম, ওই ফাটা মাথার কারন।”
নাজমার কথা শুনে পরাশরের কান লাল হয়ে যায়, জারিনা পারলে অনুপমার পেছনে লুকিয়ে যায়।
সেই শুনে হেসে ফেললেন রঞ্জিকা, “আমার বাড়িতে দেবায়ন আর অনুপমা, জারিনাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল। আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি ওকে দেখে। তারপরে যখন দেখলাম যে ফুটফুটে মেয়েটা রান্না ঘরে এসে আমাকে সাহায্য করছে তখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। বড় মিষ্টি মেয়ে। এত পাকা যে আমাকে বলে চোখে কাজল পড়লে নাকি আমার চোখ দুটি বড় বড় দেখাবে।”
রঞ্জিকা জারিনার দিকে দেখে হেসে ফেলে। জারিনা লজ্জায় অনুপমার পেছনে মুখ লুকায়। রঞ্জিকা সুরঞ্জন বাবুকে বললেন, “দেখো, সত্যি বলছি, বাড়িতে এই সব নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব। আমার আর কাকলির কথা কেউ শোনে না। দেবশ্রীদি’র মতন যুক্তি দিয়ে বুঝাতে আমি পারতাম না। আমি জানিনা তোমার কি মত, তবে বউমা আমার ভারী মিষ্টি।”
ডক্টর মিসবাহুল বললেন, “আমার একটু সময় চাই, মানে আমাদের পরিবার আরো গোঁড়া। সবাইকে বুঝিয়ে ওঠা, সবাইকে মানিয়ে ওঠা খুব দুষ্কর দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমি যা ভেবে এসেছিলাম, সেই ভাবনা চিন্তা যুক্তি তক্ক আপনার দর্শন শাস্ত্রের কাছে নগন্য। আমি কোনদিন এই ভাবে ধর্মকে, ভগবানকে দেখিনি। আজকে আপনার কথা শুনে মনে হল আমরা কেন, পৃথিবীর সবাই যদি আপনার মতন চোখ খুলে একটু দেখতে পারত তাহলে পৃথিবী অনেক সুন্দর হয়ে উঠত। সত্যি বলতে আপনি আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, এই প্রথম পরাজয়ে আমি দুঃখিত নেই। কিন্তু বুঝতেই পারছেন।”
সুরঞ্জন বাবু সমস্বরে বলেন, “একই অবস্থা আমার পরিবারের। দুঃসাধ্য তবে আপনার কথা শুনে মনে হল অসম্ভব কিছুই নয়।”
দেবশ্রী, “আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনাদের দুইজনের পারিবারিক সমস্যার কথা। অনেক সময় আছে, জারিনার কলেজ শেষ হতে আরো তিন বছর বাকি। পরাশরের কলেজ শেষ হতে এক বছর বাকি। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়, আপনার সেই চেষ্টা করুন।”
ডক্টর মিসবাহুল মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেন, “দুই জনের পড়াশুনা শেষ হোক আগে তারপরে ব্যাবস্থা করব।”
সুরঞ্জন বাবু বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেন, “এস্ট্রে নিশ্চয় আপনার বাড়িতে পাওয়া যাবে না?”
দেবশ্রী হেসে ফেলে, “আমি সিগারেট খাই নাকি?”
দেবায়ন তাড়াতাড়ি একটা কাপে একটু জল নিয়ে টি টেবিলে রাখে। সুরঞ্জন বাবু একটা সিগারেট বের করে ডক্টর মিসবাহুলের দিকে এগিয়ে দেয়। ডক্টর মিসবাহুল হেসে বলেন যে একটাই ধরাতে, জারিনা জন্মাবার পরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন, তবে বেয়াই মশাইয়ের অনুরোধ উপেক্ষা করা কঠিন। নাজমা, ডক্টর মিসবাহুলের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরাতে বারন করে। সুরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, আর রাগ কেন এবারে হয়ত দুই বেয়াই মিলে সিগারেট খেয়ে মনের গ্লানি দূর করবে।
রঞ্জিকা হেসে বলেন, “দিদি, আপনার ওই এটম, নিউট্রন শুনে আমার পেটের ইলেক্ট্রন কামড় দিচ্ছে। আমি আমার বেয়ানকে নিয়ে রান্না ঘরে চললাম। আপনি যা ভালো বুঝবেন সেটা করুন।”
পরাশরের মায়ের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। এতক্ষণ বাড়িতে যেন ছোটো একটা ঝড় বয়ে গেল। দেবশ্রীর সামনে বসে ছোটো দুই সোফায় ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলেন। দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরকে কাছে ডেকে সবাইকে প্রনাম করতে বলেন। জারিনা আর পরাশর, সুরঞ্জন বাবু আর ডক্টর মিসবাহুল কে প্রনাম করার পরে দেবশ্রীকে প্রনাম করে।
রঞ্জিকা পরাশরকে বলে, “দিদিকে একদম সাষ্টাঙ্গ প্রনাম করিস, নাহলে এই যাত্রায় কিছু সম্ভব হতো না।”
দেবশ্রী, জারিনা আর পরাশরের মাথা চুম্বন করে আশীর্বাদ করেন। জারিনার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। পরাশর দেবায়নকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। ডক্টর মিসবাহুল আর সুরঞ্জন বাবু নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেন। চারপাশের বদ্ধ আবাহাওয়ায় একটা খুশির আমেজ। বসার ঘরের দেয়ালে দেবায়নের বাবা, সায়ন্তনের একটা বড় ছবি ঝুলান। দেবশ্রী একবার সেই ছবির দিকে জল ভরা চোখে তাকায়। তারপরে দেবশ্রী ছেলে মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, তোরা সন্তুষ্ট? চার জনে দৌড়ে এসে দেবশ্রীকে জড়িয়ে ধরে।