28-09-2020, 09:21 AM
উনবিংশ পর্ব (#01)
মুসৌরি ভ্রমণের পরের রবিবার, সকাল থেকে দেবশ্রী খুব ব্যাস্ত। কাজের লোক দিয়ে সব ঘর আগের দিন পরিষ্কার করে রেখেছিল। দেবায়ন নিজের ঘর নিজেই পরিষ্কার করে। দেবশ্রীর চিন্তা, মিস্টার সেন আর পারমিতা অনেক বড়োলোক, ওদের এই ছোটো বাড়িতে কি ভাবে মানিয়ে নেবে। গ্রীষ্মকাল বাড়িতে এ.সি লাগানোর মতন শখ কোনদিন হয়নি ওর। বারেবারে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে মিস্টার সেনের গরম লাগলে কি করা যাবে? দেবায়ন আসস্থ করে জানিয়ে দেয় অইসব অবান্তর ভাবনা চিন্তা দূর করে দিতে। দেবায়ন, মায়ের সাথে কাজে সাহায্য করে। দেবায়ন বারবার বলে যে মিস্টার সেন অথবা পারমিতা, ওদের বাড়িতে এসে কোন রকম অসুবিধেতে পড়বে না। দেবশ্রীর মন তাও মানে না। দুপুরের জন্য, মাটন বিরিয়ানি সেই সাথে কষা মাংস। রাধাবল্লভি, ছোলার ডাল, ইত্যাদি বেশ কয়েক প্রকার ব্যাঞ্জন তৈরি করা হয়ে গেছে।
দুপুর বেলায় অনুপমা, বাড়ির সবাইকে নিয়ে পৌঁছে যায় দেবায়নের বাড়িতে। দুই পরিবারের মিলনে বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে। গরমে ঘেমে যান মিস্টার সেন, সেই দেখে দেবশ্রী একটু ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পরে। পারমিতা হেসে জানিয়ে দেয় একদিন ঘামিয়ে গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। দুপুরে খাবার সময়ে দেবশ্রী, মিস্টার সেনকে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। অনুপমা আর দেবায়ন প্রমাদ গোনে, হয়ত দেবশ্রী মিস্টার সেনকে সব কিছু বলে দেবে। দেবশ্রী আর মিস্টার সেন একসাথে দেবায়নের দিকে তাকায়, দুইজনের চোখে ভিন্ন প্রশ্ন। দেবায়ন হালকা মাথা দুলিয়ে, “না” বলে। উত্তর একটা, কিন্তু ভিন্ন প্রশ্নের ভিন্ন অর্থ বহন করে সেই মাথা নাড়া। মিস্টার সেন দেবশ্রীকে বলেন, এই তথ্য প্রযুক্তির সময়ে সব ছেলে মেয়েদের কম্পিউটার শেখা একটু জরুরি। কোন শিক্ষা ফেলা যাবে না, ভবিষ্যতে কোন না কোন ভাবে কাজে লেগে যাবে। দ্বায়িতজ্ঞান পূর্ণ অভিবাবকদের মতন মিস্টার সেন আর দেবশ্রী, দেবায়ন আর অনুপমাকে কম্পিউটার শেখার জন্য অনুমতি দেয়। অনুপমা খাওয়ার পরে দেবশ্রীকে অনুরোধ করে যে ওদের ফার্মের প্লানের কথা এখুনি যেন ওর বাবাকে না জানায়। বুদ্ধিমতী দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ওদের আই.টি ফার্মের কথা মিস্টার সেনের সাথে আলোচনা করবে।
গ্রীষ্মের ছুটির মাঝে একদিন দেবায়ন আর অনুপমা, পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা কম্পিউটার সংস্থায় যায় খোঁজ খবর নিতে। এক বছরের ফাস্ট ট্রাক কোর্স, তাড়াতাড়ি সব শেখানর জন্য একটু পয়সা বেশি লাগবে সেই সাথে জানিয়ে দেয় যে সময় একটু বেশি দিতে হবে। দুটো সেমেস্টারে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার কথা শুনে দেবায়ন একটু ইতস্তত করে, মাকে ফোনে জানায় টাকার কথা। দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যত টাকা লাগে তার জন্য তৈরি। দেবায়ন আর অনুপমা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে। শনিবার আর রবিবার সারাদিন ক্লাস, সেই সাথে সপ্তাহে দুই দিন, মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার বিকেলে দুই ঘন্টার ক্লাস। একদিকে কলেজের ফাইনাল ইয়ার, সেইসাথে কম্পিউটার ক্লাস। দেবায়ন আর অনুপমা বুঝতে পারে সামনের দিন গুলো ওদের নিঃশ্বাস ফেলার মতন সময় থাকবে না। কম্পিউটার সংস্থা থেকে বেড়িয়ে দেবায়ন আর অনুপমা, ফ্লুরিস কাফেতে বসে।
অনুপমা কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ গো, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, এইসব আমরা পারব ত? মানে কলেজ আর কম্পিউটার একসাথে।”
এক প্রশ্ন দেবায়নের মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু অনুপমাকে আসস্থ করে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সব পারবো। তুমি কলেজের পড়াশুনাতে মন দাও আর আমি কম্পিউটার ক্লাসে।”
অনুপমা, “মানে, তুমি কি কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে দেবে নাকি? গ্রাজুয়েশান না করলে মামনি কিন্তু তোমাকে আস্ত রাখবে না।”
দেবায়ন হেসে বলে, “না রে পাগলি মেয়ে। আমি বলছিলাম, তুমি আমাকে কলেজের নোটস দিয়ে হেল্প করবে আর আমি তোমাকে কম্পিউটার শিখিয়ে দেব। পড়াশুনা বন্টন করে নেব আমাদের মাঝে।”
অনুপমা, “দেখ পুচ্চুসোনা, আমার কম্পিউটার না শিখলেও চলবে। আমি ত শুধু তোমার সাথে কাটাব বলে জয়েন করেছি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো, এই কম্পিউটার কিন্তু পরে করলেও চলবে। গ্রাজুয়েশানটা একটু ঠিক করে করে নাও।”
দেবায়ন, “উফফফ বাবা, সেই জন্য বলছি, তুমি ফিসিক্স পড় আর বাকি আমার ওপরে ছেড়ে দাও।”
অনুপমা, “তোমার মাথার মধ্যে কি ঘুরছে একটু পরিষ্কার করে আমাকে জানাবে?”
দেবায়ন একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “তোমাকে কতবার এক কথা বলতে হয় একটু বলত? আমরা কলেজের পরে একটা আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলব ব্যাস আবার কি।”
অনুপমা দেবায়নের হাত ধরে মিনতির সুরে বলে, “সোনা, বড্ড ভয় করছে।”
দেবায়ন, “কম্পিউটার শিখছি বলে ভয় করছে? কেমন মেয়ে তুমি?”
অনুপমা, “না সোনা, সেটা নিয়ে ভয় নয়। জানিনা, তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব বড় একটা ঝড় আসবে।”
দেবায়ন অনুপমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে প্রেয়সীর চোখ দুটি ছলছল করছে, কাঁধের উপরে হাত রেখে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে, “কি হল তোমার?”
অনুপমা, “আচ্ছা পুচ্চু, এই কম্পিউটার শিখে তুমি কোন চাকরি করতে পারো না?”
দেবায়ন অবাক হয়ে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত এই প্রশ্ন কেন? নিজের বাবাকে অবিশ্বাস করছ তুমি?”
অনুপমার মনে ঠিক সেই কথাই জেগেছিল, প্রানের মানুষ যে অলীক স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে গেছে সেটা দেখে একটু আহত হলেও সেটা লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলে, “না মানে কিছু না। মানে আমরা পারবো ত এই সব করতে?”
কথা ঘুরিয়ে দেয় বুদ্ধিমতী অনুপমা, “আগামী সপ্তাহে কলেজ শুরু। কলেজে এবারে অনেক জোড়া পাখী দেখব। পরাশর জারিনা নতুন প্রেমে বিভোর, ওইদিকে আমাদের সেই পার্টিতে সঙ্গীতা আর মিচকে প্রবাল জুটি বেঁধে নিল। আচ্ছা একটা কথা বল, পরাশর আর জারিনা, ওদের সম্পর্কের কি হবে? না মানে আমার ত মনে হয় না দুইজনের বাড়ির কেউ মেনে নেবে। দুইটি ভিন্ন ধর্মের ছেলে মেয়ের সম্পর্ক। সমাজের চোখে খুব বড় ব্যাপার। ওদের পরিবার ওদের মেনে নেবে কি?”
দেবায়ন হেসে বলে, “চেষ্টা করতে দোষ কি? এই দেখ না, মানুষ আগে পাখী দেখে শুধু উড়ার স্বপ্ন দেখত। কেউ যদি এগিয়ে না এসে ডানা না লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকত তাহলে কি আজ প্লেন বলে কিছু হত? কাউকে ত পথ দেখাতে হয়, প্রেম কি আর ধর্ম, জাত পাত মানে? মানলে কি আর তুমি আর আমি এই জায়গায় বসে কফি খেতাম।” বলেই দেবায়ন অনুপমার গালে একটা ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “ধুত, তুমি না একদম শয়তান। এত লোকের মাঝে একি করলে? এটা কি লন্ডন নাকি?”
দেবায়ন হেসে বলে, “কাউকে একটা শুরু করতে হয়।”
অনুপমা, “এটা ভারতবর্ষ পুচ্চু। আরও এক হাজার বছর ধরে বয়ে যাবে এই গঙ্গার জল, কিন্তু এখানের মানুষের মনের বিচারধারা বদলাবে না পুচ্চু। এরা শিবলিঙ্গ পুজ করবে, ফুল বেল পাতা চড়াবে, দুধ মধু ঢালবে। কিন্তু সেই লিঙ্গ আর যোনির আসল অর্থ বুঝেও না বোঝার ভান করে পরে থাকবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা খাজুরাহ, কোনারক দেখতে যাবে কিন্তু যৌনতা নিয়ে, যৌন শিক্ষা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে লজ্জা পাবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা নারীহত্যা করতে পিছপা হবে না, নারীদের উপরে অত্যাচার করতে পিছপা হবে না, কিন্তু মা কালী, মা দুর্গার পুজোতে লাখ লাখ টাকা চাদা দেবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা ভালোবাসার সন্মান দিতে জানে না কিন্তু রাধা গোবিন্দর পুজোতে নেচে কুদে বেড়াবে, এই হল আমাদের দেশ।”
দেবায়ন হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত দার্শনিক হয়ে উঠলে? ছাড়ো এসব কথা, মিমি সুন্দরীর কি খবর?”
অনুপমা ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “ধুর বাবা, পাশে বৌ বসে তাও স্বাশুরির দিকে নজর। একে নিয়ে আর পারা গেল না।”
দেবায়ন অনুপমা গাল টিপে বলে, “আচ্ছা না হয় ওর কথা না জিজ্ঞেস করলাম, একবার আমার পায়েল সুন্দরীর কথা শুনি।”
অনুপমা, “পায়েল ভালো আছে, প্রত্যেকদিন কথা হয় ফোনে। ওর বাবা বাড়ি ফিরে এসেছে তাই বিকেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া এক প্রকার বন্ধ। কলজে খুললে আবার ওর দেখা পাবে।”
দেবায়ন অনুপমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায়। সেখানে পারমিতার সাথে দেখা। আজকাল পারমিতা মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। দেবায়নকে বাড়িতে দেখে পারমিতা বেশ খুশি, অনেকদিন পরে দেবায়নের সাথে দেখা। অনুপমা, মায়ের চেহারার লালিমা দেখে বুঝে যায় মায়ের মনের অভিব্যাক্তি, মনে মনে হেসে ফেলে। পারমিতা দেবায়নকে বলে আজকাল আর ওর দিকে নজর দিচ্ছে না। দেবায়ন হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে নিশ্চয় দেবে, বর্তমানে দেবায়নের মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক কাজের ভার। পারমিতা হাসে, অনুপমার গাল টিপে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নকে কেড়ে নেবে না। অনুপমা, মাকে জড়িয়ে ধরে জানিয়ে দেয় সেই বিশ্বাস টুকু দেবায়ন আর মায়ের উপরে আছে।
কলেজ শুরু হয়ে যায় এক সপ্তাহের মধ্যে। সেই সাথে শুরু হয়ে যায় কম্পিউটার ক্লাস। কম্পিউটার ক্লাসে বেশি ছাত্র ছাত্রী নেই, বিকেলে যাদের সাথে ক্লাস করে অনুপমা আর দেবায়ন, তারা সকলেই কর্মরত মানুষ, কাজের তাগিদায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি শিখতে এসেছে। ক্লাসের ম্যাডাম, মিস সুপর্ণা চ্যাটারজি বেশ ভালো মহিলা, কম ছাত্র ছাত্রী থাকায় তার পড়ানোর বেশ সুবিধা। কম বয়সি শিক্ষিকা দেখে দেবায়নের অতি পুরাতন স্বভাব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্লাসে মাঝে মাঝেই সুপর্ণাকে অবান্তর প্রশ্নে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলে, আর অনুপমা পাশে বসে বকে মেরে চুপ করিয়ে রাখে। ম্যাডামের পেছনে লাগতে পিছপা হয় না দেবায়ন।
প্রতিদিন সকালে পায়েল, অনুপমার বাড়িতে আসে সালোয়ার পরে, অনুপমার বাড়িতে ড্রেস বদলে, স্কার্ট টপ অথবা ছোটো জিন্স ফ্রিল শার্ট পরে দুই বান্ধবি গাড়ি নিয়ে কলেজে বেড়িয়ে পরে। কলজে খোলার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে পায়েলের চেহারায় এক খুশির ছোঁয়া ভেসে ওঠে। অনুপমা সেই হাসি সেই আনন্দের আলোক ছটা দেখে বুঝে যায় পায়েলের জীবনে এক নতুন ব্যাক্তির আগমন ঘটেছে। কলেজের পথে একদিন পায়েল জানায় যে একটা ছেলের সাথে ওর দেখা হয়েছে। অনুপমা সেই ছেলেটার সম্বন্ধে জানতে চাইলে পায়েল বলে যে ওর পিসতুতো দাদার এক বন্ধু, ডালহৌসিতে একটা অফিসে চাকরি করে। প্রেম প্রীতি পর্যন্ত কথা এখন যায়নি তবে ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে পায়েলের। অনুপমা মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, তাহলে অঙ্কনের সাথে পায়েলের কোন সম্পর্ক নেই। অনুপমা জানতে চায় ছেলেটার সাথে কবে দেখা করাবে। পায়েল মিচকি হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ছেলেটার সাথে দেখা করাবে। ছেলেটার নাম জানতে চাইলে জানায় যে অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, বাড়ি নৈহাটি।
অনুপমা কলেজে এসে দেবায়নকে পায়েলের কথা জানায়। দেবায়ন পায়েলকে উত্যক্ত করার জন্য বলে শেষ পর্যন্ত কি হাত ছাড়া হয়ে গেল? পায়েলকে সেই রাতের কথা মনে করিয়ে দেয় মজা করে। সঙ্গম সম্ভোগের সময়ে কামাবেগে পায়েল বলেছিল যে দেবায়নের জন্য ওর শরীর অবারিত দ্বার। পায়েলের গালের রঙ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। অনুপমা, পায়েলকে জড়িয়ে ধরে কানেকানে বলে যে কথা না রাখলে কিন্তু দেবায়ন একদিন ওকে ধরে নিয়ে জোর করে সঙ্গম করবে। অনুপমা কথায় পায়েল শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়। অনুপমা হেসে জানিয়ে দেয় যে ওরা মজা করতে চাইছিল।
গরমের ছুটির শুরুতে, দেবায়নের বাড়ির একরাতের পার্টি সব বন্ধু বান্ধবীদের মাঝে এক নতুন যোগসুত্র স্থাপন করে দেয়। সঙ্গীতা, ছোটো স্কার্ট, হাতা বিহীন টপ ছেড়ে সালোয়ার কামিজ অথবা লম্বা স্কার্ট পড়তে শুরু করে দিয়েছে। প্রবালের চোখ দেখলে বোঝা যায় দুই বছর আগেকার সেই প্রবাল এখন সঙ্গীতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রেয়া, সঙ্গীতা, পায়েল আর অনুপমার বন্ধুত্ত আগে থেকেই বেশ ঘন ছিল, সেই এক রাতের পরে ওদের বন্ধুত্ত যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে। প্রবাল আগে কারুর সাথে বিশেষ কথা বলত না, ওর মুখে কথা ফুটেছে। ধিমান আর পরাশর আগে দেবায়নকে একটু অন্য নজরে দেখত কারন ওদের নজর অনুপমার দিকে ছিল, কিন্তু নিজেদের বান্ধবী পেয়ে যাওয়ার পরে আর সেই রাতের পার্টির পরে সবার মনের দ্বার যেন খুলে গেছে। ওদের ক্লাস একটু ছন্ন ছাড়া ছিল আগে, গ্রীষ্মের ছুটির পরে সবার রঙ সবার চালচলন পালটে যায়, দেখে মনে হয় যেন এক হাতের পাঁচ আঙুল সবাই, একটা আঙ্গুলে ব্যাথা পেলে সম্পূর্ণ হাত যেন ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে।
একদিন লাঞ্চের পরে কোন ক্লাস ছিল না, সব বন্ধু বান্ধবীরা ফ্লুরিস কাফেতে চলে আসে আড্ডা মারতে। শ্রেয়া একবার অনুরোধ করেছিল রূপককে ডাকার জন্য, সবাই চেঁচিয়ে ওঠে যে বাইরের কাউকে ডাকা যাবে না। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া আর ধিমান চুপচাপ বসে পরে। গল্প চলাকালীন পায়েল কিছু পরে বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। অনুপমা আর সবাই কারন জিজ্ঞেস করাতে পায়েল জানায় যে তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে ওর বাবা বকা দেবেন। পায়েলের বাবার সম্বন্ধে শ্রেয়া আর অনুপমা ভালো ভাবে জানে। পায়েল চলে যাবার জন্য প্রস্তুত, অনুপমা একবার মাথা উঠিয়ে আশেপাশে চোখ বুলায়। সাধারণত অনুপমা সাথে থাকলে পায়েল ওর সাথেই বাড়ি ফেরে, কারন পায়েলকে ওর বাড়িতে নেমে জামা কাপড় বদলে বাড়ি ফিরতে হয়। পায়েলের আচরনে অনুপমার মনে একটু সন্দেহ হয়, অনুপমা জোর করে জিজ্ঞেস করে পায়েলের বাড়ি ফেরার আসল কারন। এমন সময়ে পায়েলের মোবাইলে ফোন আসে। সবাই বুঝে যায় যে পায়েল কারুর সাথে দেখা করতে চলেছে। সব বান্ধবীরা পায়েলকে চেপে ধরে ওর মনের মানুষের কথা জিজ্ঞেস করে। চাপাচাপির ফলে শেষ পর্যন্ত পায়েল, সেই ব্যাক্তিকে জানিয়ে দেয় যে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছে তাই সেদিন আর দেখা করতে পারবে না। গল্পের মোড় ঘুরে যায় সবার প্রেম কাহিনীর দিকে। অনুপমা পায়েলকে তার প্রেম কাহিনী শোনানোর জন্য চেপে ধরে।
পায়েল মুখে লাজুক হাসি নিয়ে বলতে শুরু করে, “তোরা যখন মুসউরি বেড়াতে গেলি তার মাঝে একদিন আমি পিসির বাড়ি, নৈহাটি বেড়াতে গেছিলাম।”
সঙ্গে সঙ্গে সবার প্রশ্ন ছেঁকে ধরে অনুপমা আর দেবায়নকে, “এই কি রে তোরা কবে মুসউরি বেড়াতে গেছিলি? একা একা, তোদের সাহস কম নয় ত?”
দেবায়ন আর অনুপমা ফিকফিক করে হেসে ফেলে। পায়েল উত্তর দেয় অনুপমার হয়ে, “ওরে ছাগল, দেবায়নের মায়ের সাথে ওরা বেড়াতে গিয়েছিল। বিয়ের আগেই মেয়ে স্বাশুরিকে হাত করে নিয়েছে। দেবায়নের মা, বউমা বলতে একেবারে অজ্ঞান, পারলে কাল ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আর ওইদিকে দেবায়নকে আর বলিস না, কাকু কাকিমা পারলে দেবায়নকে মাথায় করে রাখে। বর্তমানে দুই বাড়ির এমন সম্পর্ক, বুঝলি কিছু।”
অনুপমা একপ্রকার দেবায়নের কোলে শুয়ে ছিল, সেখান থেকে উঠে পায়েলের মাথায় চাটি মেরে জিজ্ঞেস করে, “ধুর শালা, তুই তোর গল্প বল না শুনি।”
পায়েল, “আমার গল্প বিশেষ কিছু না। পিসির বাড়ি নৈহাটি গেলাম সেখানে পিসতুত দাদার এক বন্ধুর সাথে দেখা হল। নাম অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, ডালহৌসিতে একটা এক্সপোর্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে তবে এই মাত্র কথা। দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কয়েক বার, ভালো ছেলে, তবে প্রপোস করেনি এখন। যেদিন প্রোপস করবে তারপরের দিন তোদের জানিয়ে দেব।”
পায়েলের মুখে নাম শুনে সঙ্গীতা একটু ভাবনায় পরে যায়, পায়েলকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটা নৈহাটির কোথায় থাকে। পায়েল জানায়, যে নৈহাটির মীরা বাগানে ওদের বাড়ি। পায়েল কারন জিজ্ঞেস করে সঙ্গীতাকে।
সঙ্গীতা জানায়, “আমার মামা বাড়ি মীরা বাগানে, আমি ছেলেটাকে ভালো ভাবে না হলেও একটু চিনি। ছেলেটা একটু বকাটে আছে, তুই শুধু একটু সাবধানে থাকিস। পুজোতে মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে অনেক বার দেখেছি প্যান্ডেলে বসে শালা ঝারি মারছে। প্রবলেম শালা ঝারি মারা নিয়ে নয়, তবে ওর আচার ব্যাবহার আমার ঠিক মনে হয় নি। কেমন ইতর ছোটলোকের নজর ওর। ও ডালহৌসিতে চাকরি করে কি না জানিনা।”
পায়েলের সাথে দিনে চার পাঁচের আলাপ, “কই না ত আমার সেইরকম কিছু মনে হল না ওকে দেখে? পিসতুতো দাদার ভালো বন্ধু, দেখতে শুনতে ভালো, বেশ পয়সা ওয়ালা বাড়ির ছেলে। ওদের নাকি বেশ বড় ব্যাবসা আছে স্টেসানের কাছে।”
সঙ্গীতা ম্লান হেসে বলে, “জানিনা ভাই, তবে একটু বাজিয়ে নিস। ফাটা ঢোল কিনে ফেললে কিন্তু সারা জীবন সেটা কাঁধে বইতে হবে।”
সঙ্গীতার কথা শুনে সবাই পায়েলের দিকে তাকিয়ে সাবধান করে দেয়। পায়েল জানিয়ে দেয় যে একবার ভালো ভাবে জেনে বুঝে নেবে তারপরে না হয় ভালোবাসা প্রেমের কথা চিন্তা করে দেখবে।
মুসৌরি ভ্রমণের পরের রবিবার, সকাল থেকে দেবশ্রী খুব ব্যাস্ত। কাজের লোক দিয়ে সব ঘর আগের দিন পরিষ্কার করে রেখেছিল। দেবায়ন নিজের ঘর নিজেই পরিষ্কার করে। দেবশ্রীর চিন্তা, মিস্টার সেন আর পারমিতা অনেক বড়োলোক, ওদের এই ছোটো বাড়িতে কি ভাবে মানিয়ে নেবে। গ্রীষ্মকাল বাড়িতে এ.সি লাগানোর মতন শখ কোনদিন হয়নি ওর। বারেবারে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে মিস্টার সেনের গরম লাগলে কি করা যাবে? দেবায়ন আসস্থ করে জানিয়ে দেয় অইসব অবান্তর ভাবনা চিন্তা দূর করে দিতে। দেবায়ন, মায়ের সাথে কাজে সাহায্য করে। দেবায়ন বারবার বলে যে মিস্টার সেন অথবা পারমিতা, ওদের বাড়িতে এসে কোন রকম অসুবিধেতে পড়বে না। দেবশ্রীর মন তাও মানে না। দুপুরের জন্য, মাটন বিরিয়ানি সেই সাথে কষা মাংস। রাধাবল্লভি, ছোলার ডাল, ইত্যাদি বেশ কয়েক প্রকার ব্যাঞ্জন তৈরি করা হয়ে গেছে।
দুপুর বেলায় অনুপমা, বাড়ির সবাইকে নিয়ে পৌঁছে যায় দেবায়নের বাড়িতে। দুই পরিবারের মিলনে বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে। গরমে ঘেমে যান মিস্টার সেন, সেই দেখে দেবশ্রী একটু ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পরে। পারমিতা হেসে জানিয়ে দেয় একদিন ঘামিয়ে গেলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। দুপুরে খাবার সময়ে দেবশ্রী, মিস্টার সেনকে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। অনুপমা আর দেবায়ন প্রমাদ গোনে, হয়ত দেবশ্রী মিস্টার সেনকে সব কিছু বলে দেবে। দেবশ্রী আর মিস্টার সেন একসাথে দেবায়নের দিকে তাকায়, দুইজনের চোখে ভিন্ন প্রশ্ন। দেবায়ন হালকা মাথা দুলিয়ে, “না” বলে। উত্তর একটা, কিন্তু ভিন্ন প্রশ্নের ভিন্ন অর্থ বহন করে সেই মাথা নাড়া। মিস্টার সেন দেবশ্রীকে বলেন, এই তথ্য প্রযুক্তির সময়ে সব ছেলে মেয়েদের কম্পিউটার শেখা একটু জরুরি। কোন শিক্ষা ফেলা যাবে না, ভবিষ্যতে কোন না কোন ভাবে কাজে লেগে যাবে। দ্বায়িতজ্ঞান পূর্ণ অভিবাবকদের মতন মিস্টার সেন আর দেবশ্রী, দেবায়ন আর অনুপমাকে কম্পিউটার শেখার জন্য অনুমতি দেয়। অনুপমা খাওয়ার পরে দেবশ্রীকে অনুরোধ করে যে ওদের ফার্মের প্লানের কথা এখুনি যেন ওর বাবাকে না জানায়। বুদ্ধিমতী দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ওদের আই.টি ফার্মের কথা মিস্টার সেনের সাথে আলোচনা করবে।
গ্রীষ্মের ছুটির মাঝে একদিন দেবায়ন আর অনুপমা, পার্ক স্ট্রিটের একটা নামকরা কম্পিউটার সংস্থায় যায় খোঁজ খবর নিতে। এক বছরের ফাস্ট ট্রাক কোর্স, তাড়াতাড়ি সব শেখানর জন্য একটু পয়সা বেশি লাগবে সেই সাথে জানিয়ে দেয় যে সময় একটু বেশি দিতে হবে। দুটো সেমেস্টারে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার কথা শুনে দেবায়ন একটু ইতস্তত করে, মাকে ফোনে জানায় টাকার কথা। দেবশ্রী জানিয়ে দেয় যত টাকা লাগে তার জন্য তৈরি। দেবায়ন আর অনুপমা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে। শনিবার আর রবিবার সারাদিন ক্লাস, সেই সাথে সপ্তাহে দুই দিন, মঙ্গলবার আর বৃহস্পতিবার বিকেলে দুই ঘন্টার ক্লাস। একদিকে কলেজের ফাইনাল ইয়ার, সেইসাথে কম্পিউটার ক্লাস। দেবায়ন আর অনুপমা বুঝতে পারে সামনের দিন গুলো ওদের নিঃশ্বাস ফেলার মতন সময় থাকবে না। কম্পিউটার সংস্থা থেকে বেড়িয়ে দেবায়ন আর অনুপমা, ফ্লুরিস কাফেতে বসে।
অনুপমা কফির কাপে চুমুক দিয়ে দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ গো, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, এইসব আমরা পারব ত? মানে কলেজ আর কম্পিউটার একসাথে।”
এক প্রশ্ন দেবায়নের মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু অনুপমাকে আসস্থ করে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সব পারবো। তুমি কলেজের পড়াশুনাতে মন দাও আর আমি কম্পিউটার ক্লাসে।”
অনুপমা, “মানে, তুমি কি কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে দেবে নাকি? গ্রাজুয়েশান না করলে মামনি কিন্তু তোমাকে আস্ত রাখবে না।”
দেবায়ন হেসে বলে, “না রে পাগলি মেয়ে। আমি বলছিলাম, তুমি আমাকে কলেজের নোটস দিয়ে হেল্প করবে আর আমি তোমাকে কম্পিউটার শিখিয়ে দেব। পড়াশুনা বন্টন করে নেব আমাদের মাঝে।”
অনুপমা, “দেখ পুচ্চুসোনা, আমার কম্পিউটার না শিখলেও চলবে। আমি ত শুধু তোমার সাথে কাটাব বলে জয়েন করেছি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো, এই কম্পিউটার কিন্তু পরে করলেও চলবে। গ্রাজুয়েশানটা একটু ঠিক করে করে নাও।”
দেবায়ন, “উফফফ বাবা, সেই জন্য বলছি, তুমি ফিসিক্স পড় আর বাকি আমার ওপরে ছেড়ে দাও।”
অনুপমা, “তোমার মাথার মধ্যে কি ঘুরছে একটু পরিষ্কার করে আমাকে জানাবে?”
দেবায়ন একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “তোমাকে কতবার এক কথা বলতে হয় একটু বলত? আমরা কলেজের পরে একটা আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলব ব্যাস আবার কি।”
অনুপমা দেবায়নের হাত ধরে মিনতির সুরে বলে, “সোনা, বড্ড ভয় করছে।”
দেবায়ন, “কম্পিউটার শিখছি বলে ভয় করছে? কেমন মেয়ে তুমি?”
অনুপমা, “না সোনা, সেটা নিয়ে ভয় নয়। জানিনা, তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব বড় একটা ঝড় আসবে।”
দেবায়ন অনুপমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে প্রেয়সীর চোখ দুটি ছলছল করছে, কাঁধের উপরে হাত রেখে কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে, “কি হল তোমার?”
অনুপমা, “আচ্ছা পুচ্চু, এই কম্পিউটার শিখে তুমি কোন চাকরি করতে পারো না?”
দেবায়ন অবাক হয়ে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত এই প্রশ্ন কেন? নিজের বাবাকে অবিশ্বাস করছ তুমি?”
অনুপমার মনে ঠিক সেই কথাই জেগেছিল, প্রানের মানুষ যে অলীক স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে গেছে সেটা দেখে একটু আহত হলেও সেটা লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলে, “না মানে কিছু না। মানে আমরা পারবো ত এই সব করতে?”
কথা ঘুরিয়ে দেয় বুদ্ধিমতী অনুপমা, “আগামী সপ্তাহে কলেজ শুরু। কলেজে এবারে অনেক জোড়া পাখী দেখব। পরাশর জারিনা নতুন প্রেমে বিভোর, ওইদিকে আমাদের সেই পার্টিতে সঙ্গীতা আর মিচকে প্রবাল জুটি বেঁধে নিল। আচ্ছা একটা কথা বল, পরাশর আর জারিনা, ওদের সম্পর্কের কি হবে? না মানে আমার ত মনে হয় না দুইজনের বাড়ির কেউ মেনে নেবে। দুইটি ভিন্ন ধর্মের ছেলে মেয়ের সম্পর্ক। সমাজের চোখে খুব বড় ব্যাপার। ওদের পরিবার ওদের মেনে নেবে কি?”
দেবায়ন হেসে বলে, “চেষ্টা করতে দোষ কি? এই দেখ না, মানুষ আগে পাখী দেখে শুধু উড়ার স্বপ্ন দেখত। কেউ যদি এগিয়ে না এসে ডানা না লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকত তাহলে কি আজ প্লেন বলে কিছু হত? কাউকে ত পথ দেখাতে হয়, প্রেম কি আর ধর্ম, জাত পাত মানে? মানলে কি আর তুমি আর আমি এই জায়গায় বসে কফি খেতাম।” বলেই দেবায়ন অনুপমার গালে একটা ছোটো চুমু খেয়ে নেয়।
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “ধুত, তুমি না একদম শয়তান। এত লোকের মাঝে একি করলে? এটা কি লন্ডন নাকি?”
দেবায়ন হেসে বলে, “কাউকে একটা শুরু করতে হয়।”
অনুপমা, “এটা ভারতবর্ষ পুচ্চু। আরও এক হাজার বছর ধরে বয়ে যাবে এই গঙ্গার জল, কিন্তু এখানের মানুষের মনের বিচারধারা বদলাবে না পুচ্চু। এরা শিবলিঙ্গ পুজ করবে, ফুল বেল পাতা চড়াবে, দুধ মধু ঢালবে। কিন্তু সেই লিঙ্গ আর যোনির আসল অর্থ বুঝেও না বোঝার ভান করে পরে থাকবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা খাজুরাহ, কোনারক দেখতে যাবে কিন্তু যৌনতা নিয়ে, যৌন শিক্ষা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে লজ্জা পাবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা নারীহত্যা করতে পিছপা হবে না, নারীদের উপরে অত্যাচার করতে পিছপা হবে না, কিন্তু মা কালী, মা দুর্গার পুজোতে লাখ লাখ টাকা চাদা দেবে, এই হল আমাদের দেশ। এরা ভালোবাসার সন্মান দিতে জানে না কিন্তু রাধা গোবিন্দর পুজোতে নেচে কুদে বেড়াবে, এই হল আমাদের দেশ।”
দেবায়ন হেসে ফেলে অনুপমার কথা শুনে, “হটাত দার্শনিক হয়ে উঠলে? ছাড়ো এসব কথা, মিমি সুন্দরীর কি খবর?”
অনুপমা ভুরু কুঁচকে হেসে বলে, “ধুর বাবা, পাশে বৌ বসে তাও স্বাশুরির দিকে নজর। একে নিয়ে আর পারা গেল না।”
দেবায়ন অনুপমা গাল টিপে বলে, “আচ্ছা না হয় ওর কথা না জিজ্ঞেস করলাম, একবার আমার পায়েল সুন্দরীর কথা শুনি।”
অনুপমা, “পায়েল ভালো আছে, প্রত্যেকদিন কথা হয় ফোনে। ওর বাবা বাড়ি ফিরে এসেছে তাই বিকেলে বাড়ি থেকে বের হওয়া এক প্রকার বন্ধ। কলজে খুললে আবার ওর দেখা পাবে।”
দেবায়ন অনুপমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায়। সেখানে পারমিতার সাথে দেখা। আজকাল পারমিতা মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে। দেবায়নকে বাড়িতে দেখে পারমিতা বেশ খুশি, অনেকদিন পরে দেবায়নের সাথে দেখা। অনুপমা, মায়ের চেহারার লালিমা দেখে বুঝে যায় মায়ের মনের অভিব্যাক্তি, মনে মনে হেসে ফেলে। পারমিতা দেবায়নকে বলে আজকাল আর ওর দিকে নজর দিচ্ছে না। দেবায়ন হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে নিশ্চয় দেবে, বর্তমানে দেবায়নের মাথায় অনেক চিন্তা, অনেক কাজের ভার। পারমিতা হাসে, অনুপমার গাল টিপে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নকে কেড়ে নেবে না। অনুপমা, মাকে জড়িয়ে ধরে জানিয়ে দেয় সেই বিশ্বাস টুকু দেবায়ন আর মায়ের উপরে আছে।
কলেজ শুরু হয়ে যায় এক সপ্তাহের মধ্যে। সেই সাথে শুরু হয়ে যায় কম্পিউটার ক্লাস। কম্পিউটার ক্লাসে বেশি ছাত্র ছাত্রী নেই, বিকেলে যাদের সাথে ক্লাস করে অনুপমা আর দেবায়ন, তারা সকলেই কর্মরত মানুষ, কাজের তাগিদায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি শিখতে এসেছে। ক্লাসের ম্যাডাম, মিস সুপর্ণা চ্যাটারজি বেশ ভালো মহিলা, কম ছাত্র ছাত্রী থাকায় তার পড়ানোর বেশ সুবিধা। কম বয়সি শিক্ষিকা দেখে দেবায়নের অতি পুরাতন স্বভাব মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ক্লাসে মাঝে মাঝেই সুপর্ণাকে অবান্তর প্রশ্নে ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলে, আর অনুপমা পাশে বসে বকে মেরে চুপ করিয়ে রাখে। ম্যাডামের পেছনে লাগতে পিছপা হয় না দেবায়ন।
প্রতিদিন সকালে পায়েল, অনুপমার বাড়িতে আসে সালোয়ার পরে, অনুপমার বাড়িতে ড্রেস বদলে, স্কার্ট টপ অথবা ছোটো জিন্স ফ্রিল শার্ট পরে দুই বান্ধবি গাড়ি নিয়ে কলেজে বেড়িয়ে পরে। কলজে খোলার বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে পায়েলের চেহারায় এক খুশির ছোঁয়া ভেসে ওঠে। অনুপমা সেই হাসি সেই আনন্দের আলোক ছটা দেখে বুঝে যায় পায়েলের জীবনে এক নতুন ব্যাক্তির আগমন ঘটেছে। কলেজের পথে একদিন পায়েল জানায় যে একটা ছেলের সাথে ওর দেখা হয়েছে। অনুপমা সেই ছেলেটার সম্বন্ধে জানতে চাইলে পায়েল বলে যে ওর পিসতুতো দাদার এক বন্ধু, ডালহৌসিতে একটা অফিসে চাকরি করে। প্রেম প্রীতি পর্যন্ত কথা এখন যায়নি তবে ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগেছে পায়েলের। অনুপমা মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, তাহলে অঙ্কনের সাথে পায়েলের কোন সম্পর্ক নেই। অনুপমা জানতে চায় ছেলেটার সাথে কবে দেখা করাবে। পায়েল মিচকি হেসে জানিয়ে দেয় যে সময় হলে ছেলেটার সাথে দেখা করাবে। ছেলেটার নাম জানতে চাইলে জানায় যে অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, বাড়ি নৈহাটি।
অনুপমা কলেজে এসে দেবায়নকে পায়েলের কথা জানায়। দেবায়ন পায়েলকে উত্যক্ত করার জন্য বলে শেষ পর্যন্ত কি হাত ছাড়া হয়ে গেল? পায়েলকে সেই রাতের কথা মনে করিয়ে দেয় মজা করে। সঙ্গম সম্ভোগের সময়ে কামাবেগে পায়েল বলেছিল যে দেবায়নের জন্য ওর শরীর অবারিত দ্বার। পায়েলের গালের রঙ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। অনুপমা, পায়েলকে জড়িয়ে ধরে কানেকানে বলে যে কথা না রাখলে কিন্তু দেবায়ন একদিন ওকে ধরে নিয়ে জোর করে সঙ্গম করবে। অনুপমা কথায় পায়েল শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়। অনুপমা হেসে জানিয়ে দেয় যে ওরা মজা করতে চাইছিল।
গরমের ছুটির শুরুতে, দেবায়নের বাড়ির একরাতের পার্টি সব বন্ধু বান্ধবীদের মাঝে এক নতুন যোগসুত্র স্থাপন করে দেয়। সঙ্গীতা, ছোটো স্কার্ট, হাতা বিহীন টপ ছেড়ে সালোয়ার কামিজ অথবা লম্বা স্কার্ট পড়তে শুরু করে দিয়েছে। প্রবালের চোখ দেখলে বোঝা যায় দুই বছর আগেকার সেই প্রবাল এখন সঙ্গীতার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। শ্রেয়া, সঙ্গীতা, পায়েল আর অনুপমার বন্ধুত্ত আগে থেকেই বেশ ঘন ছিল, সেই এক রাতের পরে ওদের বন্ধুত্ত যেন আরো গভীর হয়ে উঠেছে। প্রবাল আগে কারুর সাথে বিশেষ কথা বলত না, ওর মুখে কথা ফুটেছে। ধিমান আর পরাশর আগে দেবায়নকে একটু অন্য নজরে দেখত কারন ওদের নজর অনুপমার দিকে ছিল, কিন্তু নিজেদের বান্ধবী পেয়ে যাওয়ার পরে আর সেই রাতের পার্টির পরে সবার মনের দ্বার যেন খুলে গেছে। ওদের ক্লাস একটু ছন্ন ছাড়া ছিল আগে, গ্রীষ্মের ছুটির পরে সবার রঙ সবার চালচলন পালটে যায়, দেখে মনে হয় যেন এক হাতের পাঁচ আঙুল সবাই, একটা আঙ্গুলে ব্যাথা পেলে সম্পূর্ণ হাত যেন ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে।
একদিন লাঞ্চের পরে কোন ক্লাস ছিল না, সব বন্ধু বান্ধবীরা ফ্লুরিস কাফেতে চলে আসে আড্ডা মারতে। শ্রেয়া একবার অনুরোধ করেছিল রূপককে ডাকার জন্য, সবাই চেঁচিয়ে ওঠে যে বাইরের কাউকে ডাকা যাবে না। শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া আর ধিমান চুপচাপ বসে পরে। গল্প চলাকালীন পায়েল কিছু পরে বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। অনুপমা আর সবাই কারন জিজ্ঞেস করাতে পায়েল জানায় যে তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে ওর বাবা বকা দেবেন। পায়েলের বাবার সম্বন্ধে শ্রেয়া আর অনুপমা ভালো ভাবে জানে। পায়েল চলে যাবার জন্য প্রস্তুত, অনুপমা একবার মাথা উঠিয়ে আশেপাশে চোখ বুলায়। সাধারণত অনুপমা সাথে থাকলে পায়েল ওর সাথেই বাড়ি ফেরে, কারন পায়েলকে ওর বাড়িতে নেমে জামা কাপড় বদলে বাড়ি ফিরতে হয়। পায়েলের আচরনে অনুপমার মনে একটু সন্দেহ হয়, অনুপমা জোর করে জিজ্ঞেস করে পায়েলের বাড়ি ফেরার আসল কারন। এমন সময়ে পায়েলের মোবাইলে ফোন আসে। সবাই বুঝে যায় যে পায়েল কারুর সাথে দেখা করতে চলেছে। সব বান্ধবীরা পায়েলকে চেপে ধরে ওর মনের মানুষের কথা জিজ্ঞেস করে। চাপাচাপির ফলে শেষ পর্যন্ত পায়েল, সেই ব্যাক্তিকে জানিয়ে দেয় যে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছে তাই সেদিন আর দেখা করতে পারবে না। গল্পের মোড় ঘুরে যায় সবার প্রেম কাহিনীর দিকে। অনুপমা পায়েলকে তার প্রেম কাহিনী শোনানোর জন্য চেপে ধরে।
পায়েল মুখে লাজুক হাসি নিয়ে বলতে শুরু করে, “তোরা যখন মুসউরি বেড়াতে গেলি তার মাঝে একদিন আমি পিসির বাড়ি, নৈহাটি বেড়াতে গেছিলাম।”
সঙ্গে সঙ্গে সবার প্রশ্ন ছেঁকে ধরে অনুপমা আর দেবায়নকে, “এই কি রে তোরা কবে মুসউরি বেড়াতে গেছিলি? একা একা, তোদের সাহস কম নয় ত?”
দেবায়ন আর অনুপমা ফিকফিক করে হেসে ফেলে। পায়েল উত্তর দেয় অনুপমার হয়ে, “ওরে ছাগল, দেবায়নের মায়ের সাথে ওরা বেড়াতে গিয়েছিল। বিয়ের আগেই মেয়ে স্বাশুরিকে হাত করে নিয়েছে। দেবায়নের মা, বউমা বলতে একেবারে অজ্ঞান, পারলে কাল ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আর ওইদিকে দেবায়নকে আর বলিস না, কাকু কাকিমা পারলে দেবায়নকে মাথায় করে রাখে। বর্তমানে দুই বাড়ির এমন সম্পর্ক, বুঝলি কিছু।”
অনুপমা একপ্রকার দেবায়নের কোলে শুয়ে ছিল, সেখান থেকে উঠে পায়েলের মাথায় চাটি মেরে জিজ্ঞেস করে, “ধুর শালা, তুই তোর গল্প বল না শুনি।”
পায়েল, “আমার গল্প বিশেষ কিছু না। পিসির বাড়ি নৈহাটি গেলাম সেখানে পিসতুত দাদার এক বন্ধুর সাথে দেখা হল। নাম অগ্নিহোত্রী বিশ্বাস, ডালহৌসিতে একটা এক্সপোর্ট কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে তবে এই মাত্র কথা। দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে কয়েক বার, ভালো ছেলে, তবে প্রপোস করেনি এখন। যেদিন প্রোপস করবে তারপরের দিন তোদের জানিয়ে দেব।”
পায়েলের মুখে নাম শুনে সঙ্গীতা একটু ভাবনায় পরে যায়, পায়েলকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটা নৈহাটির কোথায় থাকে। পায়েল জানায়, যে নৈহাটির মীরা বাগানে ওদের বাড়ি। পায়েল কারন জিজ্ঞেস করে সঙ্গীতাকে।
সঙ্গীতা জানায়, “আমার মামা বাড়ি মীরা বাগানে, আমি ছেলেটাকে ভালো ভাবে না হলেও একটু চিনি। ছেলেটা একটু বকাটে আছে, তুই শুধু একটু সাবধানে থাকিস। পুজোতে মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে অনেক বার দেখেছি প্যান্ডেলে বসে শালা ঝারি মারছে। প্রবলেম শালা ঝারি মারা নিয়ে নয়, তবে ওর আচার ব্যাবহার আমার ঠিক মনে হয় নি। কেমন ইতর ছোটলোকের নজর ওর। ও ডালহৌসিতে চাকরি করে কি না জানিনা।”
পায়েলের সাথে দিনে চার পাঁচের আলাপ, “কই না ত আমার সেইরকম কিছু মনে হল না ওকে দেখে? পিসতুতো দাদার ভালো বন্ধু, দেখতে শুনতে ভালো, বেশ পয়সা ওয়ালা বাড়ির ছেলে। ওদের নাকি বেশ বড় ব্যাবসা আছে স্টেসানের কাছে।”
সঙ্গীতা ম্লান হেসে বলে, “জানিনা ভাই, তবে একটু বাজিয়ে নিস। ফাটা ঢোল কিনে ফেললে কিন্তু সারা জীবন সেটা কাঁধে বইতে হবে।”
সঙ্গীতার কথা শুনে সবাই পায়েলের দিকে তাকিয়ে সাবধান করে দেয়। পায়েল জানিয়ে দেয় যে একবার ভালো ভাবে জেনে বুঝে নেবে তারপরে না হয় ভালোবাসা প্রেমের কথা চিন্তা করে দেখবে।