28-09-2020, 12:43 AM
অষ্টদশ পর্ব (#03)
দেবায়ন আর অনুপমাকে দেখে দেবশ্রী হেসে বলে, “কি রে তোদের বেড়ান হল?”
দেবায়ন মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
দেবশ্রী পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এতদুর এসে একজনকে খুঁজে পেলাম। আমাদের দিল্লী অফিসের মারকেটিংয়ের ম্যানেজার, মিস্টার ধৃতিমান দেবনাথ।”
মেয়েটির পরিচয়ে বলে, “এই হল, ধৃতিমানের কন্যে, মিস মল্লিকা দেবনাথ। দিল্লীতে ডি.পি.এস ক্লাস এইটে পড়ছে।”
দেবায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় ধৃতিমান, “গ্লাড টুঁ মিট ইউ।”
অনুপমার দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায়।
ধৃতিমানের দেখা পেয়ে দেবশ্রীর মুখের ভাবব্যাক্তি বদলে যায়, বিষণ্ণ চিন্তিত চেহারায় এক অনাবিল খুশির আলোক ছটা বিচ্ছুরিত হয়। মল্লিকার সাথে দেবশ্রী বেশ মিশে গেছে। অনুপমার শ্যেন দৃষ্টি ধৃতিমানের চেহারা নিরীক্ষণ করে। বয়স তেমন কিছু বেশি নয়, কথাবার্তা মার্জিত, তবে চেহারার ভাবব্যাক্তি ঠিক অনুপমার পছন্দ হয় না। বারেবারে ওর মামনির শরীরের দিকে কেমন এক আড় চোখে তাকিয়ে দেখে।
দেবশ্রী বলে, “আমাদের হোটেলে উঠেছেন, গতকাল রাতে মেয়েকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছেন।”
ধৃতিমান দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “ম্যাডামের সাথে কথা হচ্ছিল তোমাদের নিয়ে। তুমি ফাইনাল ইয়ারে তাই না?”
দেবায়ন, “হ্যাঁ।”
ধৃতিমান, “কেমন লাগছে মুসৌউরি?”
দেবায়ন, “এই সকালে এখানে পৌঁছেছি, এখন শহর ঘুরে দেখা হয়নি। তবে ভিড় দেখে মনে হল বেড়ানোর চেয়ে হোটেলে থাকা ভালো। লোকজন, কেঁচোর কিলবিল করছে।”
ধৃতিমান হেসে উত্তর দেয়, “ছুটির মরশুমে এইরকম হবেই।”
অনুপমা দেবায়নের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে, আলতো করে দেবায়নের বাহুতে একটা ছোটো চিমটি কাটে। দেবায়ন অনুপমার দিকে তাকাতেই অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, এবারে চলো মুসউরি ফিরে একটু শপিং করা যাক।”
দেবশ্রী ধৃতিমানের দিকে হেসে বলে, “এক হোটেলে যখন আছি তাহলে সেখানে দেখা হবে। আর হ্যাঁ, কথাবার্তা কিছুই হয়নি এখন, পরে জানাবো। জানিনা একটু ভয় ভয় করছে।”
মল্লিকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমার জন্য কি কিনব?”
মল্লিকা হেসে জানায়, “আবার প্রেসেন্ট দেবেন?”
দেবশ্রী একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অনুপমা আর দেবায়ন মুখ চাওয়াচায়ি করে, বুঝতে পারে যে ওর মায়ের সাথে মল্লিকার পরিচয় এই সুদুর মুসৌরিতে এসে হয়নি, এখানে আসার আগে মল্লিকা দেবায়নের মাকে চেনে।
ধৃতিমান, দেবশ্রীকে বলে, “আমি উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।”
দেবায়নের দিকে ফিরে বলে, “ডিনার আমার তরফ থেকে, কেমন?”
দেবায়ন হাত মিলিয়ে জানায়, “ঠিক আছে।”
গাড়িতে চড়ে দেবায়নেরা মুসৌরির উদ্দশ্যে রওনা দেয়। গাড়ি ছাড়তেই কিছু পরে পেছনে ধৃতিমানের গাড়ি দেখা যায়। ঘণ্টা দুই পরে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে বিকেলের দিকে দেবায়নেরা মুসউরি পৌঁছে যায়। দেবায়ন জানিয়ে দেয় যে শপিঙ্গে ওর ইচ্ছে নেই, ও হোটেলে ফিরে যেতে চায়। ম্যাল রোডে দেবশ্রী আর অনুপমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি দেবায়নকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেয়। হোটেলে পৌঁছানর পরে গাড়ি ছেড়ে দেয় দেবায়ন। হোটেলে ঢুকে একা একা কিছুক্ষণ নিজের কামরায় বসে টিভি দেখে, তারপরে বারে চলে যায়। একটা বিয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে অনুপমার কথা ভাবে। খুব বড়লোকের মেয়ে অনুপমা সেন, রুপের ডালি সাজিয়ে ওর কোলে এসে পড়েছে তবে এই সুন্দরীর মনের আশা পূরণ করতে হলে ওকে অনুপমার বাবার কথা মেনে কোম্পানি খুলতে হবে। নিজের একটা আই.টি কোম্পানির স্বপ্ন বুকের মধ্যে একে নেয় দেবায়ন। সময় কেটে যায় কতক্ষনে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারে না। একহাতে বিয়ারের বোতল অন্য আঙ্গুলে সিগারেট জ্বালিয়ে চোখের সামনে অনুপমার মিষ্টি মুখের স্বপ্ন দেখে।
দেবায়ন সম্বিৎ ফিরে পায় ধৃতিমানের কণ্ঠস্বর শুনে, “একা একা বসে যে? ম্যাডাম কি শপিং করতে গেছেন?”
ধৃতিমান ওর পাশে একটা হুইস্কির গ্লাস নিয়ে বসে পরে।
ধৃতিমানকে দেখে দেবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হাতের সিগারেট নিভিয়ে দিয়ে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মা আর অনুপমা একটু ম্যাল রোডে শপিং করতে গেছে। মেয়েদের শপিং করতে যাওয়া মানে একশোটা দেখবে তারপরে একটা নেবে তাই আমি আর যাইনি। আপনার মেয়ে কোথায়?”
ধৃতিমান হেসে বলে, “তা ঠিক বলেছ। মল্লিকা রুমে বসে টিভি দেখছে, আমি ভাবলাম একটু বারে যাই আর দেখো তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল, বেশ ভালোই হল।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “আপনি মেয়েকে নিয়ে একা বেড়াতে এসেছেন, ফ্যামিলি কোথায়?”
ধৃতিমান ম্লান হেসে বলে, “ফ্যামিলি বলতে এক ওই মেয়ে, মল্লিকা। এই অফিসের কাজে খুব ব্যাস্ত থাকি ছুটি পাওয়া যায় না। ওর গরমের ছুটি তাই ভাবলাম একটু ঘুরে বেড়িয়ে আসি।”
দেবায়ন বুঝতে পারল যে ভদ্রলোক ইচ্ছে করে নিজের স্ত্রীর কথা এড়িয়ে গেছেন, দুটি কারন হতে পারে এড়িয়ে যাবার, এক এই ভদ্রলোক ডিভোর্সি দ্বিতীয়, স্ত্রী হয়ত গত হয়েছেন। দুইজনের মাঝে কথাবার্তা গল্প গুজব শুরু হয়। দেবায়ন জানতে পারে যে মায়ের নাম শুধু মাত্র কোলকাতা অফিসে সীমিত নেই, দিল্লীর হেড অফিস থেকে শুরু করে বম্বে, পুনে সবাই মাকে চেনে। মায়ের গর্বে ছেলের বুক ফুলে ওঠে। দেবশ্রীর সাথে ধৃতিমান এই রিক্রুট্মেন্ট টুরে গিয়েছিল সেখানেই পরিচয়। ধৃতিমান, দেবায়নকে ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন উত্তরে বলে কলেজ শেষে কোন আই.টি কম্পনি জয়েন করতে চায় আর সেই জন্য কোলকাতা ফিরে একটা কম্পিউটার কোর্স করবে। ধৃতিমান জানায় যে ওদের কোম্পানির দিল্লী অফিসে কিছু আই.টি ফিল্ডে লোক দরকার পরে সেখানে ইচ্ছে করলে জয়েন করতে পারে। দেবায়ন জানায় কোলকাতা থেকে বাইরে যেতে চায় না। দেবায়নের কথা শুনে একটু দমে যায় ধৃতিমান। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে কোলকাতায় তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে বিশেষ কোন বড় কোম্পানি নেই, ইচ্ছে করলে দিল্লীতে এসে চাকরি করতে পারে। দেবায়ন ওর আসল পরিকল্পনা একজন বাইরের লোকের কাছে জানাতে অনিচ্ছুক তাই বিজ্ঞের মতন মাথা নাড়িয়ে বলে যে ছোটো খাটো যা চাকরি পাবে তাতেই সে খুশি তবে কোলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে নারাজ। ধৃতিমানের সাথে তর্কে যেতে নারাজ দেবায়ন। নিজের জন্মভুমি ছেড়ে দূর দেশে থাকা, নিজের ভালোবাসার দেশ ছেড়ে অচিন পুরে সোনার খাঁচায় বন্দি জীবনে নারাজ দেবায়ন।
শপিং থেকে ফিরে দেবশ্রী দেবায়নকে ফোন করে রুমে ডাকে। দেবায়ন আর অনুপমার জন্য ভারী জ্যাকেট কেনে দেবশ্রী, নিজের জন্য বেশ কয়েকটা স্টোল আর শাল। পারমিতার জন্য একটা শাল আর মিস্টার সেনের জন্য একটা দামী শার্ট কেনে। অঙ্কনের জন্য একটা চামড়ার জ্যাকেট কেনা হয়। অনুপমা শপিং গল্পে মত্ত, এইখানে এই দেখছে ওই খানের ওইটা ভালো এই নিয়ে বউমা আর হবু স্বাশুরির মাঝে গল্প শুরু হয়। গল্পে আবার রাত বেড়ে ওঠে, দেবশ্রী আর অনুপমা একে একে জামা কাপড় বদলে রাতের খাবারের কথা বলে। রেস্তোরাঁর দিকে যাওয়ার সময়ে অনুপমা দেবায়নেকে মুখ ভার করে জানায় অনেক চেষ্টা করেও ওর মামনি ওকে দেবায়নের সাথে এক রুমে রাত কাটাতে বারন করেছে। দেবায়ন কিঞ্চিত দুঃখিত হয়ে যায়, কোলকাতা থেকে দুই জনে অনেক স্বপ্ন বুকে করে এনেছিল, নিরবে নিভৃতে একসাথে রাত কাটাবে। অনেকদিন অনুপমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি দেবায়ন। অনুপমা মৃদু হেসে জানিয়ে দেয় যে ওর মামনিকে আবার একবার অনুরোধ করে দেখবে।
রেস্তোরাঁতে ধৃতিমান আর মল্লিকার সাথে দেখা। আগে থেকে একটা পাঁচজনের টেবিল বুক করে রেখেছিল ধৃতিমান। অনুপমা বারেবারে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে তার ভাব্ব্যাক্তি নিরীক্ষণে ব্যাস্ত। দেবশ্রী আর ধৃতিমান সামনা সামনি বসে আর দেবায়ন আর অনুপমা সামনা সামনি বসে। দেবশ্রীর পাশে বসে মল্লিকা, বারেবারে দেবশ্রীর মুখের দিকে তাকায় আর ফিকফিক করে হেসে ফেলে। খাওয়ার সময়ে ধৃতিমান, অনুপমা আর দেবশ্রীর উদ্দশ্যে জিজ্ঞেস করে শপিঙ্গের কথা। মল্লিকা কিঞ্চিত মুখ ভার করে অভমানি কণ্ঠে বলে যে ওকে কেন শপিঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দেবশ্রী হেসে বলে যে পরেরদিন ওদের সাথে শপিঙ্গে নিয়ে যাবে। মল্লিকা বেশ খুশি। দেবশ্রী, ধৃতিমানের প্রশ্নের উত্তরে হেসে বলে, ছুটির মরশুমে মুসউরির মতন নামকরা জায়গায় ভিড় হবেই। সব দোকানে অনেক ভিড়, রাস্তায় পা ফেলার জায়গা নেই, রেস্তোরাঁ আর হোটেল গুলোতে লোকজন মনে হয় উপচে পড়ছে আর জিনিস পত্রের দাম তেমন কিছু কম নয়। ধৃতিমান জানায় যে দেবায়নের সাথে বারে দেখা হয়েছিল। দেবশ্রী ছেলের দিকে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বারে কি করছিল। মায়ের শ্যেন চাহনির সামনে মাথা নিচু করে উত্তর দেয় যে একা একা ভালো লাগছিল না তাই একটু বারে বসে বিয়ার নিয়েছিল। অনুপমা মাঝে মাঝে কথোপকথনে যোগদান করে। অনুপমা ওর মামনিকে আসস্থ করে বলে বেড়াতে এসে এই টুকু ছাড় ছেলে মেয়েদের দেওয়া উচিত। দেবশ্রী মৃদু হেসে বলে ছাড় সে দিয়ে দিয়েছে তাই বলে যেন সেই স্বাধীনতার অপমান না করে। অনুপমা বুঝে যায় ওর মামনি কি বিষয়ে বলতে চাইছে।
ধৃতিমান বলে, “ম্যাডাম, তোমার ছেলে বেশ বুদ্ধিমান।”
দেবশ্রী একটু হেসে বলে, “জানি না মাথায় কি আছে।”
অনুপমা দেবায়নকে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “কি গো তুমি বুদ্ধিমান নাকি? জানতাম না ত?”
ধৃতিমান, “আমি জিজ্ঞেস করছিলাম যে কলেজের পরে কি করতে চায়।”
দেবশ্রী একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার ধৃতিমানের দিকে তাকায়। ধৃতিমান বলে, “আজকাল তথ্য প্রযুক্তির বাজার, জেনে খুশি হলাম যে তোমার ছেলে আই.টি জয়েন করতে চায়, খুব ভালো।”
দেবশ্রী দেবায়নের দিকে তাকাতেই দেবায়ন উত্তরে বলে, “হ্যাঁ, মানে কথাবার্তা হচ্ছিল সেইরকম, কিছু।”
ধৃতিমান বলে, “আমি ওকে বলছিলাম যে আমাদের দিল্লীর অফিসে আই.টি ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে, সেখানে লোকের প্রয়োজন থাকে।”
দেবশ্রী খাওয়া থামিয়ে ধৃতিমানের উদ্দশ্যে বলে, “এই সব কথা হয়েছে?”
ধৃতিমান দেবশ্রীর বলার ধরন না বুঝে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মানে আমি ওকে বলছিলাম যে দিল্লীতে অনেক আই.টি কোম্পানি আছে, আর আমাদের অফিসে লোকের দরকার পরে। কিন্তু তোমার ছেলে কোলকাতা ছাড়তে চায় না, কোলকাতা সম্বন্ধে বেশ ইমোশানাল।”
ধৃতিমানের এহেন আচরনে দেবশ্রী একটু ক্ষুদ্ধ হয়ে যায়, চোদ্দ দিনের একজনের সাথে থেকে তার প্রেম প্রীতি অন্তত বাইশ বছরের স্নেহ মমতাকে ভাসিয়ে দিতে পারে না। ধৃতিমানের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে চিবিয়ে শীতল কণ্ঠে দেবশ্রী বলে, “ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া আমি পছন্দ করিনা, ধৃতিমান।”
মায়ের হিম শীতল কণ্ঠস্বরের পেছনের কারন বুঝে উঠতে পারে না দেবায়ন, কারন খুঁজতে অনুপমার দিকে তাকায়। অনুপমা ভুরু কুঁচকে ইশারায় জানিয়ে দেয় যে ওর মামনির হটাত করে এইরকম কণ্ঠের উত্তরের কারন ওর অজানা।
ধৃতিমান সহজে অনুধাবন করে দেবশ্রীর মনের কথা, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “না মানে আমরা শুধু আলোচনা করছিলাম ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে।”
দেবশ্রী ক্রোধ সংবরণ করে কথা ঘুরিয়ে অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তুই আগে মুসউরি এসেছিলি তা আর কোথায় ঘুরছিস? কাল আমাদের কি প্রোগ্রাম হবে?”
অনুপমা, “এখানে বেশ কয়েকটা ঝরনা আছে, কেম্পটি ফলস নামকরা, আরো ছোটো ছোটো ঝরনা আছে। তারপরে ম্যাল রোডের শেষে একটা রোপঅয়ে আছে, কাল আমরা সেই সব জায়গায় ঘুরতে যাবো।”
দেবশ্রী দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই এত চুপচাপ কেন? মায়ের হাতের রান্না এত খারাপ যে হোটেলের রান্না থেকে মাথা উঠাতে পারছিস না?”
দেবায়ন হেসে বলে, “না মা, সেটা নয়।”
দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি দিল্লী কবে ফিরছ?”
ধৃতিমান এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না, ওর ধারনা ছিল দেবশ্রীর সান্নিধ্যে হয়ত দুটি রাত নিভৃতে কাটাতে পারবে। কিন্তু দেবশ্রীর ভাবমূর্তি দেখে সেই সাহস যোগাতে অক্ষম হয় ধৃতিমান, “না মানে, দিন দুয়েক পরে ফিরব।”
দেবশ্রী থালা থেকে মাথা না উঠিয়ে বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে। পরে তোমার সাথে তাহলে কথা হবে।”
মল্লিকার দিকে তাকিয়ে বলে, “আগামী কাল আমরা ঘুরতে যাবো, তখন তোমাকে নিয়ে যাবো।”
মল্লিকা হেসে বলে, “বাপির সাথে থাকলে বেড়ান যাবে না। আমি সকাল বেলায় তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডি হয়ে থাকব।”
খাওয়া শেষে দেবশ্রী ধৃতিমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, অনুপমা আর দেবায়নকে নিয়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায়। দেবশ্রী দেবায়নকে বলে ওর সাথে কিছু কথা বলতে চায়। অনুপমা জিজ্ঞেস করাতে বলে দেবায়ন একা নয় অনুপমার সাথে কিছু কথা আছে। দেবায়ন জানায় যে জামাকাপড় বদলে কিছুক্ষণের মধ্যে দেবশ্রীর রুমে চলে আসবে। দেবায়ন বেশ ভাবনায় পরে যায় মা কি কথা বলতে চায় সেই নিয়ে। জামাকাপড় বদলে মায়ের রুমে ঢুকে দেখে, মা টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসে, হাতে একটা সাদা খাম। মায়ের পাশের সোফার উপরে বসে অনুপমা। দেবায়ন অনুপমাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি কারন, অনুপমা জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের অপেক্ষা করা হচ্ছিল।
অষ্টদশ পর্ব (#04)
খাওয়া শেষে দেবশ্রী ধৃতিমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, অনুপমা আর দেবায়নকে নিয়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায়। দেবশ্রী দেবায়নকে বলে ওর সাথে কিছু কথা বলতে চায়। অনুপমা জিজ্ঞেস করাতে বলে দেবায়ন একা নয় অনুপমার সাথে কিছু কথা আছে। দেবায়ন জানায় যে জামাকাপড় বদলে কিছুক্ষণের মধ্যে দেবশ্রীর রুমে চলে আসবে। দেবায়ন বেশ ভাবনায় পরে যায় মা কি কথা বলতে চায় সেই নিয়ে। জামাকাপড় বদলে মায়ের রুমে ঢুকে দেখে, মা টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসে, হাতে একটা সাদা খাম। মায়ের পাশের সোফার উপরে বসে অনুপমা। দেবায়ন অনুপমাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি কারন, অনুপমা জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের অপেক্ষা করা হচ্ছিল।
দেবশ্রী দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কম্পিউটার কোর্স করতে চাস, ভালো কথা, তার টাকা আমি যোগাড় করে দেব। তারপরে কোলকাতায় কি তেমন কোন ভালো আই.টি কোম্পানি আছে যেখানে তুই মনের মতন কাজ পাবি?”
দেবায়ন আর অনুপমা মুখ চাওয়াচায়ি করে। একটা কিছু অনুধাবন করেছিল অনুপমা, কিন্তু সেটা ওদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
দেবায়ন একবার অনুপমার দিকে তাকিয়ে মাকে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিছু কোম্পানি আছে কোলকাতায় যেখানে চাকরি পেতে পারি। আর আজকাল সল্টলেকে অনেক নতুন নতুন আই.টি কোম্পানি খুলছে।”
দেবশ্রী, “দ্যাখ, তুই আর অনুপমা, দুইজনেই এখন আমার সম্বল।” অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার মেয়ে নেই।”
অনুপমা দেবশ্রী জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, “মামনি আমি তোমার মেয়ে নয়?”
দেবশ্রী অনুপমার গালে হাত বুলিয়ে স্নেহ ভরা কণ্ঠে বলে, “না তুই আমার মেয়ে নয়। মেয়েরা বাবা মায়েদের দায়িত্ব। তুই আমার বাড়ির সন্মান, আমার বউমা, আমার ভবিষ্যৎ তুই।” অনুপমা জড়িয়ে ধরে দেবশ্রীকে। দেবশ্রী অনুপমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “সব মায়ের মতন আমি চাই আমার ছেলে ভালো থাকুক, ভালো চাকরি করুক। আমি যে কষ্টে ওকে মানুষ করেছি, সেই কষ্ট যেন তোদের পোহাতে না হয়।”
দেবায়ন মায়ের পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?”
দেবশ্রী খানিকক্ষণ চুপ থাকার পরে হাতের খাম দেবায়নের হাতে ধরিয়ে বলে, “আমি একটা চাকরির অফার পেয়েছি। দিল্লীতে আমার হেডঅফিসে ডি.জি.এম এইচ.আর পোস্টের, মাইনে কোলকাতার চেয়ে দ্বিগুন। আমার সি.ই.ও সেই সাথে আমাকে জানিয়েছে যে দিল্লীতে এলে তোকে এখানের বড় কোম্পানিতে চাকরি করিয়ে দেবে অথবা আমাদের কোম্পানিতে তোর চাকরি হয়ে যাবে।”
অনুপমা আর দেবায়নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে, ভালোবাসার দেশ, ভালোবাসার শহর কোলকাতা ছেড়ে অচিনপুরি দিল্লীতে চলে আসবে? ভাবতে পারছে না অনুপমা, দেবায়নকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই চোখের কোণে জল ছলকে আসে। অনুপমা ধরা গলায় বলে, “তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? এই বলার জন্য আমাদের ডেকে নিয়ে এলে।”
দেবশ্রী অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “না মা, আমি জানি তুই কি ভাবছিস। তোর ভালোবাসা যদি এত গভীর হয় তাহলে তোর ভয় কোথায়? আমি এখুনি দিল্লীতে ট্রান্সফার নিচ্ছি না মা। তোদের কলেজ শেষ হবে তারপরে দিল্লীতে ট্রান্সফার নেব। দেবায়নের চাকরি হয়ে গেলেই আমি তোদের দুইজনের বিয়ে দিয়ে দেব।”
দেবায়ন মায়ের হাত ধরে বলে, “তোমার কোলকাতা, তোমার বাড়ি। সব ছেড়ে তুমি দিল্লীতে আসতে চাও?”
দেবশ্রী, “বাড়ি ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হবে জানি। বাড়ির এক একটা ইট আমার বুকের জল করা রক্ত দিয়ে গাঁথা। কিন্তু তুই যদি কোলকাতায় চাকরি না পাস তাহলে যেখানে তোর চাকরি হবে সেখানে আমাকে যেতে হবে। সেই ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
দেবায়ন অবাক চোখে মাকে প্রশ্ন করে, “তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছ মানে? তুমি অফার নিয়েছ?”
দেবশ্রী ম্লান হেসে বলে, “না, চরম সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোদের সাথে কথা বলা দরকার তাই তোদের এখানে ডাকা।”
দেবায়ন মায়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “মা আমাদের কিছু বলার আছে তোমাকে। এই কয়দিনে আমরা দুইজনে অনেক কিছু ভেবেছি আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে।”
দেবশ্রী, “কি?”
দেবায়ন, “আমরা কম্পিউটার শিখতে চাই একটা কারনে। কলেজের পরে দুইজনে মিলে একটা ছোটো আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলতে চাই কোলকাতায়।”
দেবশ্রী ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি? তুই কি ভাবছিস? একটা সফটওয়্যার কোম্পানি খোলা এত সহজ? কি জানিস তুই এই সফটওয়্যার, এই কম্পিউটার নিয়ে? এক বছরে তোদের এমন কি হাতি ঘোড়া শিখিয়ে দেবে যে তোরা কোম্পানি খুলতে চাস? একটা কোম্পানি খুলতে কত মাথা ব্যাথা সেটা জানিস? ব্যাবসার কি জানিস তুই?”
অনুপমা, “মামনি, শ্রেয়ার বন্ধু রূপক, যাদবপুরে আই.টি তে বি.টেক করছে। ওর সাথে মিলে আমরা এই কোম্পানি খুলতে চাই।”
দেবশ্রী মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যায় অনুপমার কথা শুনে, “মানে আমাকে না জানিয়ে এই সব ভাবনা চিন্তা করা হয়ে গেছে তোদের?”
অনুপমা, “না মামনি, আমরা এখন পর্যন্ত কাউকে এই কথা জানাই নি। রূপক অথবা শ্রেয়া কারুর সাথে এই বিষয়ে কোন কথা হয় নি। শুধু তোমাকে জানালাম আমাদের পরিকল্পনার কথা। তোমার মতামত না পেলে, তোমার আশীর্বাদ না পেলে আমরা কিছুই করতে পারব না, মামনি।”
দেবশ্রী, “আচ্ছা একটা কথা বল, যত ছোটো কোম্পানি হোক না কেন সেটা শুরু করতে অনেক টাকা লাগে। কোথা দিয়ে আসবে এত টাকা? আমি অত বড়োলোক নই যে একটা কোম্পানি তৈরি করার মতন টাকা আমার কাছে থাকবে। জমি কিনেছি দেবায়নের বাবার জীবনবিমা আর ওর বড় মামার দেওয়া টাকা দিয়ে। বাড়ি করতে আমাকে এল.আই.সি থেকে লোণ নিতে হয়েছে। মাসের শেষে আমার হাতে এমন কিছু বাঁচে না যে তোদের আমি তোদের টাকা দিতে পারব।”
দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে, সময় এসেছে মাকে সব কথা খুলে বলার। অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, সময় মতন টাকার যোগাড় আমরা ঠিক করে নেব।”
দেবশ্রী, “পারমিতা, মিস্টার সেন তোদের এই পরিকল্পনার কথা জানেন?”
অনুপমা মাথা নাড়িয়ে উত্তরে জানায়, “হ্যাঁ, বাবা সব জানে। বাবা, মায়ের মত আছে এই ব্যাপারে। আসলে আমার বাবা ওকে এই আই.টি কোম্পানি খুলতে বুদ্ধি দিয়েছেন।”
অনুপমার কথা শুনে দেবশ্রীর কান গরম হয়ে যায়। দেবশ্রী বুঝতে পারেন যে ছেলে নিশ্চয় মিস্টার সেনের সাথে কথা বলে এই টাকার ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু ছেলের মুখ থেকে সত্য শুনতে চায়, “পরকল্পনা বেশ গভীর ভাবে ভাবা হয়েছে মনে হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় টাকার কথা ভাবা হয়েছে। কোথা থেকে টাকা যোগাড় হবে?”
দেবায়ন, “মা, প্লিস আমাদের কথা শুনে রেগে যেও না। আমাদের পুরো পরিকল্পনার কথা আগে শোনো, বিচার কর, তারপরে বল আমরা ভুল কি করছি। আমি আর অনুপমা, রূপকের সাথে মিলে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করতে চাই। সেই বুদ্ধি আমাকে সোমেশ কাকু দিয়েছেন আর সেই সাথে বলেছেন যে কোম্পানির তৈরির যত টাকা লাগে তিনি আমাদের দেবেন।”
দেবশ্রীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ছেলের কথা শুনে, হিম শীতল ঠাণ্ডা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “তোর বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি অনেকের কাছে হাত পেতেছিলাম কেউ বিশেষ সাহায্য করেনি। তারপরে তোকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছি যাতে তোকে কারুর কাছে হাত না পাততে হয় আর তুই কি না নিজের আত্মসন্মান টুকু ডুবিয়ে মিস্টার সেনের কাছে টাকা চাইলি?”
মাথা নিচু করে বসে থাকে দেবায়ন। অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “না মামনি তুমি ভুল বুঝছো। আমাদের কথা একটু ভালো করে শোন।”
দেবশ্রী অনুপমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর কি শোনাতে চাস তুই?”
অনুপমা বুঝতে পারে যে ওর মামনি রেগে গেছে, দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছে। আসস্থ কণ্ঠে মামনিকে বলে, “মামনি, চাকরির চেয়ে একটা ছোটো ফার্ম খুলতে দোষ কি? দেবায়নের স্বপ্ন একটা নিজের ফার্ম হবে।”
দেবশ্রী, “ওটা দেবায়নের স্বপ্ন না তোর স্বপ্ন?”
মায়ের কথার উত্তরে দেবায়ন বলে, “মা, চাকরি করতে করতে কিছু বছর পরে আমি একটা নিজের ফার্ম খুলতে চেষ্টা করতাম ঠিক। ওটা আমার স্বপ্ন ছিল বলতে পারো। অনু এই ব্যাপারে আমাকে কোনদিন কিছু বলেনি। অনু বরাবর আমার চাহিদাকে সন্মান দিয়েছে, মা।”
দেবশ্রী অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, তুই কি বলতে চাইছিস শুনি?”
অনুপমা ওর মামনির হাত দুটি ধরে বলে, “মামনি, প্লিস আমাদের ভুল বুঝ না। আমার স্বপ্ন শুধু তোমার কাছে থাকার। আমার কথা একটু শোনো মামনি। সফটওয়্যার ফার্ম তৈরি করতে গেলে একটা ফাইনেন্সিয়ারের দরকার পড়ত, সেখানে আমার বাবা আমাদের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চায়। তোমার কাছে টাকা থাকলে তুমি দেবায়ন কে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে না? সেখানে বাবা যদি আমাদের সাহায্য করে তাহলে ক্ষতি কোথায়? তুমি টাকা দিলে ঠিক আর আমার বাবা আমাকে টাকা দিলে সেটা ভুল? এটা কেমন মামনি?”
দেবায়ন মুখ তুলে অনুপমার দিকে তাকায়। দেবশ্রী দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধান বানী শোনায়, “ভুল নয় সেটা সত্যি। তবে একটা কথা মনে রাখিস। এই সম্পদ প্রতিপত্তির সিঁড়ি চড়তে চড়তে, কোনদিন ফেলে আসা ধাপ গুলো যেন ভুলে যাস না। এমন যেন না হয়, যে একদিন তুই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর তোর সামনের জন তোকে প্রশ্ন করল, তুমি কি ঠিক করেছ দেবায়ন? আর সেইসময়ে তোর কাছে সেই উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই।”
দেবায়ন মায়ের হাত ধরে আসস্থ করে বলে, “না মা, আমি কথা দিচ্ছি, এমন কিছু আমরা করব না যাতে আমি নিজের সামনে দাঁড়াতে অথবা তোমার সামনে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে যাই।”
দেবশ্রী অনুপমাকে বলে, “কোলকাতায় ফিরে আমি একবার মিস্টার সেন আর পারমিতার সাথে দেখা করতে চাই।”
বুক দুরুদুরু করে ওঠে দেবায়নের। মিস্টার সেন বারেবারে বারন করেছিল, কাউকে যেন খোলসা করে বিশেষ কথা না জানায়। কিন্তু দেবশ্রীর কাছে লুকাতে পারল না অনুপমা অথবা দেবায়ন, মমতার তীব্র বন্ধনে মনের কথা খুলে বলতে হল। অনুপমা প্রমাদ গোনে, বাবার সাথে মামনি দেখা করলে বাবা ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, দেবশ্রীকে আসস্থ করে বলে, “মামনি এখন অনেক সময় বাকি আছে। প্লিস মামনি, এখুনি এইসব নিয়ে আমরা কোন ভাবনাচিন্তা করছি না। আগে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাক তারপরে না হয় তুমি মায়ের সাথে বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে।”
দেবায়ন আর অনুপমাকে দেখে দেবশ্রী হেসে বলে, “কি রে তোদের বেড়ান হল?”
দেবায়ন মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
দেবশ্রী পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “এতদুর এসে একজনকে খুঁজে পেলাম। আমাদের দিল্লী অফিসের মারকেটিংয়ের ম্যানেজার, মিস্টার ধৃতিমান দেবনাথ।”
মেয়েটির পরিচয়ে বলে, “এই হল, ধৃতিমানের কন্যে, মিস মল্লিকা দেবনাথ। দিল্লীতে ডি.পি.এস ক্লাস এইটে পড়ছে।”
দেবায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায় ধৃতিমান, “গ্লাড টুঁ মিট ইউ।”
অনুপমার দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায়।
ধৃতিমানের দেখা পেয়ে দেবশ্রীর মুখের ভাবব্যাক্তি বদলে যায়, বিষণ্ণ চিন্তিত চেহারায় এক অনাবিল খুশির আলোক ছটা বিচ্ছুরিত হয়। মল্লিকার সাথে দেবশ্রী বেশ মিশে গেছে। অনুপমার শ্যেন দৃষ্টি ধৃতিমানের চেহারা নিরীক্ষণ করে। বয়স তেমন কিছু বেশি নয়, কথাবার্তা মার্জিত, তবে চেহারার ভাবব্যাক্তি ঠিক অনুপমার পছন্দ হয় না। বারেবারে ওর মামনির শরীরের দিকে কেমন এক আড় চোখে তাকিয়ে দেখে।
দেবশ্রী বলে, “আমাদের হোটেলে উঠেছেন, গতকাল রাতে মেয়েকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছেন।”
ধৃতিমান দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “ম্যাডামের সাথে কথা হচ্ছিল তোমাদের নিয়ে। তুমি ফাইনাল ইয়ারে তাই না?”
দেবায়ন, “হ্যাঁ।”
ধৃতিমান, “কেমন লাগছে মুসৌউরি?”
দেবায়ন, “এই সকালে এখানে পৌঁছেছি, এখন শহর ঘুরে দেখা হয়নি। তবে ভিড় দেখে মনে হল বেড়ানোর চেয়ে হোটেলে থাকা ভালো। লোকজন, কেঁচোর কিলবিল করছে।”
ধৃতিমান হেসে উত্তর দেয়, “ছুটির মরশুমে এইরকম হবেই।”
অনুপমা দেবায়নের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে, আলতো করে দেবায়নের বাহুতে একটা ছোটো চিমটি কাটে। দেবায়ন অনুপমার দিকে তাকাতেই অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, এবারে চলো মুসউরি ফিরে একটু শপিং করা যাক।”
দেবশ্রী ধৃতিমানের দিকে হেসে বলে, “এক হোটেলে যখন আছি তাহলে সেখানে দেখা হবে। আর হ্যাঁ, কথাবার্তা কিছুই হয়নি এখন, পরে জানাবো। জানিনা একটু ভয় ভয় করছে।”
মল্লিকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমার জন্য কি কিনব?”
মল্লিকা হেসে জানায়, “আবার প্রেসেন্ট দেবেন?”
দেবশ্রী একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। অনুপমা আর দেবায়ন মুখ চাওয়াচায়ি করে, বুঝতে পারে যে ওর মায়ের সাথে মল্লিকার পরিচয় এই সুদুর মুসৌরিতে এসে হয়নি, এখানে আসার আগে মল্লিকা দেবায়নের মাকে চেনে।
ধৃতিমান, দেবশ্রীকে বলে, “আমি উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।”
দেবায়নের দিকে ফিরে বলে, “ডিনার আমার তরফ থেকে, কেমন?”
দেবায়ন হাত মিলিয়ে জানায়, “ঠিক আছে।”
গাড়িতে চড়ে দেবায়নেরা মুসৌরির উদ্দশ্যে রওনা দেয়। গাড়ি ছাড়তেই কিছু পরে পেছনে ধৃতিমানের গাড়ি দেখা যায়। ঘণ্টা দুই পরে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে বিকেলের দিকে দেবায়নেরা মুসউরি পৌঁছে যায়। দেবায়ন জানিয়ে দেয় যে শপিঙ্গে ওর ইচ্ছে নেই, ও হোটেলে ফিরে যেতে চায়। ম্যাল রোডে দেবশ্রী আর অনুপমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি দেবায়নকে নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেয়। হোটেলে পৌঁছানর পরে গাড়ি ছেড়ে দেয় দেবায়ন। হোটেলে ঢুকে একা একা কিছুক্ষণ নিজের কামরায় বসে টিভি দেখে, তারপরে বারে চলে যায়। একটা বিয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে অনুপমার কথা ভাবে। খুব বড়লোকের মেয়ে অনুপমা সেন, রুপের ডালি সাজিয়ে ওর কোলে এসে পড়েছে তবে এই সুন্দরীর মনের আশা পূরণ করতে হলে ওকে অনুপমার বাবার কথা মেনে কোম্পানি খুলতে হবে। নিজের একটা আই.টি কোম্পানির স্বপ্ন বুকের মধ্যে একে নেয় দেবায়ন। সময় কেটে যায় কতক্ষনে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারে না। একহাতে বিয়ারের বোতল অন্য আঙ্গুলে সিগারেট জ্বালিয়ে চোখের সামনে অনুপমার মিষ্টি মুখের স্বপ্ন দেখে।
দেবায়ন সম্বিৎ ফিরে পায় ধৃতিমানের কণ্ঠস্বর শুনে, “একা একা বসে যে? ম্যাডাম কি শপিং করতে গেছেন?”
ধৃতিমান ওর পাশে একটা হুইস্কির গ্লাস নিয়ে বসে পরে।
ধৃতিমানকে দেখে দেবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হাতের সিগারেট নিভিয়ে দিয়ে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মা আর অনুপমা একটু ম্যাল রোডে শপিং করতে গেছে। মেয়েদের শপিং করতে যাওয়া মানে একশোটা দেখবে তারপরে একটা নেবে তাই আমি আর যাইনি। আপনার মেয়ে কোথায়?”
ধৃতিমান হেসে বলে, “তা ঠিক বলেছ। মল্লিকা রুমে বসে টিভি দেখছে, আমি ভাবলাম একটু বারে যাই আর দেখো তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল, বেশ ভালোই হল।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “আপনি মেয়েকে নিয়ে একা বেড়াতে এসেছেন, ফ্যামিলি কোথায়?”
ধৃতিমান ম্লান হেসে বলে, “ফ্যামিলি বলতে এক ওই মেয়ে, মল্লিকা। এই অফিসের কাজে খুব ব্যাস্ত থাকি ছুটি পাওয়া যায় না। ওর গরমের ছুটি তাই ভাবলাম একটু ঘুরে বেড়িয়ে আসি।”
দেবায়ন বুঝতে পারল যে ভদ্রলোক ইচ্ছে করে নিজের স্ত্রীর কথা এড়িয়ে গেছেন, দুটি কারন হতে পারে এড়িয়ে যাবার, এক এই ভদ্রলোক ডিভোর্সি দ্বিতীয়, স্ত্রী হয়ত গত হয়েছেন। দুইজনের মাঝে কথাবার্তা গল্প গুজব শুরু হয়। দেবায়ন জানতে পারে যে মায়ের নাম শুধু মাত্র কোলকাতা অফিসে সীমিত নেই, দিল্লীর হেড অফিস থেকে শুরু করে বম্বে, পুনে সবাই মাকে চেনে। মায়ের গর্বে ছেলের বুক ফুলে ওঠে। দেবশ্রীর সাথে ধৃতিমান এই রিক্রুট্মেন্ট টুরে গিয়েছিল সেখানেই পরিচয়। ধৃতিমান, দেবায়নকে ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন উত্তরে বলে কলেজ শেষে কোন আই.টি কম্পনি জয়েন করতে চায় আর সেই জন্য কোলকাতা ফিরে একটা কম্পিউটার কোর্স করবে। ধৃতিমান জানায় যে ওদের কোম্পানির দিল্লী অফিসে কিছু আই.টি ফিল্ডে লোক দরকার পরে সেখানে ইচ্ছে করলে জয়েন করতে পারে। দেবায়ন জানায় কোলকাতা থেকে বাইরে যেতে চায় না। দেবায়নের কথা শুনে একটু দমে যায় ধৃতিমান। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে কোলকাতায় তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে বিশেষ কোন বড় কোম্পানি নেই, ইচ্ছে করলে দিল্লীতে এসে চাকরি করতে পারে। দেবায়ন ওর আসল পরিকল্পনা একজন বাইরের লোকের কাছে জানাতে অনিচ্ছুক তাই বিজ্ঞের মতন মাথা নাড়িয়ে বলে যে ছোটো খাটো যা চাকরি পাবে তাতেই সে খুশি তবে কোলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে নারাজ। ধৃতিমানের সাথে তর্কে যেতে নারাজ দেবায়ন। নিজের জন্মভুমি ছেড়ে দূর দেশে থাকা, নিজের ভালোবাসার দেশ ছেড়ে অচিন পুরে সোনার খাঁচায় বন্দি জীবনে নারাজ দেবায়ন।
শপিং থেকে ফিরে দেবশ্রী দেবায়নকে ফোন করে রুমে ডাকে। দেবায়ন আর অনুপমার জন্য ভারী জ্যাকেট কেনে দেবশ্রী, নিজের জন্য বেশ কয়েকটা স্টোল আর শাল। পারমিতার জন্য একটা শাল আর মিস্টার সেনের জন্য একটা দামী শার্ট কেনে। অঙ্কনের জন্য একটা চামড়ার জ্যাকেট কেনা হয়। অনুপমা শপিং গল্পে মত্ত, এইখানে এই দেখছে ওই খানের ওইটা ভালো এই নিয়ে বউমা আর হবু স্বাশুরির মাঝে গল্প শুরু হয়। গল্পে আবার রাত বেড়ে ওঠে, দেবশ্রী আর অনুপমা একে একে জামা কাপড় বদলে রাতের খাবারের কথা বলে। রেস্তোরাঁর দিকে যাওয়ার সময়ে অনুপমা দেবায়নেকে মুখ ভার করে জানায় অনেক চেষ্টা করেও ওর মামনি ওকে দেবায়নের সাথে এক রুমে রাত কাটাতে বারন করেছে। দেবায়ন কিঞ্চিত দুঃখিত হয়ে যায়, কোলকাতা থেকে দুই জনে অনেক স্বপ্ন বুকে করে এনেছিল, নিরবে নিভৃতে একসাথে রাত কাটাবে। অনেকদিন অনুপমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি দেবায়ন। অনুপমা মৃদু হেসে জানিয়ে দেয় যে ওর মামনিকে আবার একবার অনুরোধ করে দেখবে।
রেস্তোরাঁতে ধৃতিমান আর মল্লিকার সাথে দেখা। আগে থেকে একটা পাঁচজনের টেবিল বুক করে রেখেছিল ধৃতিমান। অনুপমা বারেবারে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে তার ভাব্ব্যাক্তি নিরীক্ষণে ব্যাস্ত। দেবশ্রী আর ধৃতিমান সামনা সামনি বসে আর দেবায়ন আর অনুপমা সামনা সামনি বসে। দেবশ্রীর পাশে বসে মল্লিকা, বারেবারে দেবশ্রীর মুখের দিকে তাকায় আর ফিকফিক করে হেসে ফেলে। খাওয়ার সময়ে ধৃতিমান, অনুপমা আর দেবশ্রীর উদ্দশ্যে জিজ্ঞেস করে শপিঙ্গের কথা। মল্লিকা কিঞ্চিত মুখ ভার করে অভমানি কণ্ঠে বলে যে ওকে কেন শপিঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দেবশ্রী হেসে বলে যে পরেরদিন ওদের সাথে শপিঙ্গে নিয়ে যাবে। মল্লিকা বেশ খুশি। দেবশ্রী, ধৃতিমানের প্রশ্নের উত্তরে হেসে বলে, ছুটির মরশুমে মুসউরির মতন নামকরা জায়গায় ভিড় হবেই। সব দোকানে অনেক ভিড়, রাস্তায় পা ফেলার জায়গা নেই, রেস্তোরাঁ আর হোটেল গুলোতে লোকজন মনে হয় উপচে পড়ছে আর জিনিস পত্রের দাম তেমন কিছু কম নয়। ধৃতিমান জানায় যে দেবায়নের সাথে বারে দেখা হয়েছিল। দেবশ্রী ছেলের দিকে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে বারে কি করছিল। মায়ের শ্যেন চাহনির সামনে মাথা নিচু করে উত্তর দেয় যে একা একা ভালো লাগছিল না তাই একটু বারে বসে বিয়ার নিয়েছিল। অনুপমা মাঝে মাঝে কথোপকথনে যোগদান করে। অনুপমা ওর মামনিকে আসস্থ করে বলে বেড়াতে এসে এই টুকু ছাড় ছেলে মেয়েদের দেওয়া উচিত। দেবশ্রী মৃদু হেসে বলে ছাড় সে দিয়ে দিয়েছে তাই বলে যেন সেই স্বাধীনতার অপমান না করে। অনুপমা বুঝে যায় ওর মামনি কি বিষয়ে বলতে চাইছে।
ধৃতিমান বলে, “ম্যাডাম, তোমার ছেলে বেশ বুদ্ধিমান।”
দেবশ্রী একটু হেসে বলে, “জানি না মাথায় কি আছে।”
অনুপমা দেবায়নকে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “কি গো তুমি বুদ্ধিমান নাকি? জানতাম না ত?”
ধৃতিমান, “আমি জিজ্ঞেস করছিলাম যে কলেজের পরে কি করতে চায়।”
দেবশ্রী একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার ধৃতিমানের দিকে তাকায়। ধৃতিমান বলে, “আজকাল তথ্য প্রযুক্তির বাজার, জেনে খুশি হলাম যে তোমার ছেলে আই.টি জয়েন করতে চায়, খুব ভালো।”
দেবশ্রী দেবায়নের দিকে তাকাতেই দেবায়ন উত্তরে বলে, “হ্যাঁ, মানে কথাবার্তা হচ্ছিল সেইরকম, কিছু।”
ধৃতিমান বলে, “আমি ওকে বলছিলাম যে আমাদের দিল্লীর অফিসে আই.টি ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে, সেখানে লোকের প্রয়োজন থাকে।”
দেবশ্রী খাওয়া থামিয়ে ধৃতিমানের উদ্দশ্যে বলে, “এই সব কথা হয়েছে?”
ধৃতিমান দেবশ্রীর বলার ধরন না বুঝে হেসে বলে, “হ্যাঁ, মানে আমি ওকে বলছিলাম যে দিল্লীতে অনেক আই.টি কোম্পানি আছে, আর আমাদের অফিসে লোকের দরকার পরে। কিন্তু তোমার ছেলে কোলকাতা ছাড়তে চায় না, কোলকাতা সম্বন্ধে বেশ ইমোশানাল।”
ধৃতিমানের এহেন আচরনে দেবশ্রী একটু ক্ষুদ্ধ হয়ে যায়, চোদ্দ দিনের একজনের সাথে থেকে তার প্রেম প্রীতি অন্তত বাইশ বছরের স্নেহ মমতাকে ভাসিয়ে দিতে পারে না। ধৃতিমানের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে চিবিয়ে শীতল কণ্ঠে দেবশ্রী বলে, “ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া আমি পছন্দ করিনা, ধৃতিমান।”
মায়ের হিম শীতল কণ্ঠস্বরের পেছনের কারন বুঝে উঠতে পারে না দেবায়ন, কারন খুঁজতে অনুপমার দিকে তাকায়। অনুপমা ভুরু কুঁচকে ইশারায় জানিয়ে দেয় যে ওর মামনির হটাত করে এইরকম কণ্ঠের উত্তরের কারন ওর অজানা।
ধৃতিমান সহজে অনুধাবন করে দেবশ্রীর মনের কথা, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “না মানে আমরা শুধু আলোচনা করছিলাম ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে।”
দেবশ্রী ক্রোধ সংবরণ করে কথা ঘুরিয়ে অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তুই আগে মুসউরি এসেছিলি তা আর কোথায় ঘুরছিস? কাল আমাদের কি প্রোগ্রাম হবে?”
অনুপমা, “এখানে বেশ কয়েকটা ঝরনা আছে, কেম্পটি ফলস নামকরা, আরো ছোটো ছোটো ঝরনা আছে। তারপরে ম্যাল রোডের শেষে একটা রোপঅয়ে আছে, কাল আমরা সেই সব জায়গায় ঘুরতে যাবো।”
দেবশ্রী দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই এত চুপচাপ কেন? মায়ের হাতের রান্না এত খারাপ যে হোটেলের রান্না থেকে মাথা উঠাতে পারছিস না?”
দেবায়ন হেসে বলে, “না মা, সেটা নয়।”
দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি দিল্লী কবে ফিরছ?”
ধৃতিমান এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না, ওর ধারনা ছিল দেবশ্রীর সান্নিধ্যে হয়ত দুটি রাত নিভৃতে কাটাতে পারবে। কিন্তু দেবশ্রীর ভাবমূর্তি দেখে সেই সাহস যোগাতে অক্ষম হয় ধৃতিমান, “না মানে, দিন দুয়েক পরে ফিরব।”
দেবশ্রী থালা থেকে মাথা না উঠিয়ে বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে। পরে তোমার সাথে তাহলে কথা হবে।”
মল্লিকার দিকে তাকিয়ে বলে, “আগামী কাল আমরা ঘুরতে যাবো, তখন তোমাকে নিয়ে যাবো।”
মল্লিকা হেসে বলে, “বাপির সাথে থাকলে বেড়ান যাবে না। আমি সকাল বেলায় তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডি হয়ে থাকব।”
খাওয়া শেষে দেবশ্রী ধৃতিমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, অনুপমা আর দেবায়নকে নিয়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায়। দেবশ্রী দেবায়নকে বলে ওর সাথে কিছু কথা বলতে চায়। অনুপমা জিজ্ঞেস করাতে বলে দেবায়ন একা নয় অনুপমার সাথে কিছু কথা আছে। দেবায়ন জানায় যে জামাকাপড় বদলে কিছুক্ষণের মধ্যে দেবশ্রীর রুমে চলে আসবে। দেবায়ন বেশ ভাবনায় পরে যায় মা কি কথা বলতে চায় সেই নিয়ে। জামাকাপড় বদলে মায়ের রুমে ঢুকে দেখে, মা টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসে, হাতে একটা সাদা খাম। মায়ের পাশের সোফার উপরে বসে অনুপমা। দেবায়ন অনুপমাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি কারন, অনুপমা জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের অপেক্ষা করা হচ্ছিল।
অষ্টদশ পর্ব (#04)
খাওয়া শেষে দেবশ্রী ধৃতিমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, অনুপমা আর দেবায়নকে নিয়ে নিজের কামরার দিকে পা বাড়ায়। দেবশ্রী দেবায়নকে বলে ওর সাথে কিছু কথা বলতে চায়। অনুপমা জিজ্ঞেস করাতে বলে দেবায়ন একা নয় অনুপমার সাথে কিছু কথা আছে। দেবায়ন জানায় যে জামাকাপড় বদলে কিছুক্ষণের মধ্যে দেবশ্রীর রুমে চলে আসবে। দেবায়ন বেশ ভাবনায় পরে যায় মা কি কথা বলতে চায় সেই নিয়ে। জামাকাপড় বদলে মায়ের রুমে ঢুকে দেখে, মা টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে বসে, হাতে একটা সাদা খাম। মায়ের পাশের সোফার উপরে বসে অনুপমা। দেবায়ন অনুপমাকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি কারন, অনুপমা জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের অপেক্ষা করা হচ্ছিল।
দেবশ্রী দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কম্পিউটার কোর্স করতে চাস, ভালো কথা, তার টাকা আমি যোগাড় করে দেব। তারপরে কোলকাতায় কি তেমন কোন ভালো আই.টি কোম্পানি আছে যেখানে তুই মনের মতন কাজ পাবি?”
দেবায়ন আর অনুপমা মুখ চাওয়াচায়ি করে। একটা কিছু অনুধাবন করেছিল অনুপমা, কিন্তু সেটা ওদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে হবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
দেবায়ন একবার অনুপমার দিকে তাকিয়ে মাকে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কিছু কোম্পানি আছে কোলকাতায় যেখানে চাকরি পেতে পারি। আর আজকাল সল্টলেকে অনেক নতুন নতুন আই.টি কোম্পানি খুলছে।”
দেবশ্রী, “দ্যাখ, তুই আর অনুপমা, দুইজনেই এখন আমার সম্বল।” অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার মেয়ে নেই।”
অনুপমা দেবশ্রী জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে, “মামনি আমি তোমার মেয়ে নয়?”
দেবশ্রী অনুপমার গালে হাত বুলিয়ে স্নেহ ভরা কণ্ঠে বলে, “না তুই আমার মেয়ে নয়। মেয়েরা বাবা মায়েদের দায়িত্ব। তুই আমার বাড়ির সন্মান, আমার বউমা, আমার ভবিষ্যৎ তুই।” অনুপমা জড়িয়ে ধরে দেবশ্রীকে। দেবশ্রী অনুপমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “সব মায়ের মতন আমি চাই আমার ছেলে ভালো থাকুক, ভালো চাকরি করুক। আমি যে কষ্টে ওকে মানুষ করেছি, সেই কষ্ট যেন তোদের পোহাতে না হয়।”
দেবায়ন মায়ের পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?”
দেবশ্রী খানিকক্ষণ চুপ থাকার পরে হাতের খাম দেবায়নের হাতে ধরিয়ে বলে, “আমি একটা চাকরির অফার পেয়েছি। দিল্লীতে আমার হেডঅফিসে ডি.জি.এম এইচ.আর পোস্টের, মাইনে কোলকাতার চেয়ে দ্বিগুন। আমার সি.ই.ও সেই সাথে আমাকে জানিয়েছে যে দিল্লীতে এলে তোকে এখানের বড় কোম্পানিতে চাকরি করিয়ে দেবে অথবা আমাদের কোম্পানিতে তোর চাকরি হয়ে যাবে।”
অনুপমা আর দেবায়নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে, ভালোবাসার দেশ, ভালোবাসার শহর কোলকাতা ছেড়ে অচিনপুরি দিল্লীতে চলে আসবে? ভাবতে পারছে না অনুপমা, দেবায়নকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই চোখের কোণে জল ছলকে আসে। অনুপমা ধরা গলায় বলে, “তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? এই বলার জন্য আমাদের ডেকে নিয়ে এলে।”
দেবশ্রী অনুপমার দিকে তাকিয়ে বলে, “না মা, আমি জানি তুই কি ভাবছিস। তোর ভালোবাসা যদি এত গভীর হয় তাহলে তোর ভয় কোথায়? আমি এখুনি দিল্লীতে ট্রান্সফার নিচ্ছি না মা। তোদের কলেজ শেষ হবে তারপরে দিল্লীতে ট্রান্সফার নেব। দেবায়নের চাকরি হয়ে গেলেই আমি তোদের দুইজনের বিয়ে দিয়ে দেব।”
দেবায়ন মায়ের হাত ধরে বলে, “তোমার কোলকাতা, তোমার বাড়ি। সব ছেড়ে তুমি দিল্লীতে আসতে চাও?”
দেবশ্রী, “বাড়ি ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হবে জানি। বাড়ির এক একটা ইট আমার বুকের জল করা রক্ত দিয়ে গাঁথা। কিন্তু তুই যদি কোলকাতায় চাকরি না পাস তাহলে যেখানে তোর চাকরি হবে সেখানে আমাকে যেতে হবে। সেই ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
দেবায়ন অবাক চোখে মাকে প্রশ্ন করে, “তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছ মানে? তুমি অফার নিয়েছ?”
দেবশ্রী ম্লান হেসে বলে, “না, চরম সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোদের সাথে কথা বলা দরকার তাই তোদের এখানে ডাকা।”
দেবায়ন মায়ের হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “মা আমাদের কিছু বলার আছে তোমাকে। এই কয়দিনে আমরা দুইজনে অনেক কিছু ভেবেছি আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে।”
দেবশ্রী, “কি?”
দেবায়ন, “আমরা কম্পিউটার শিখতে চাই একটা কারনে। কলেজের পরে দুইজনে মিলে একটা ছোটো আই.টি সফটওয়্যার ফার্ম খুলতে চাই কোলকাতায়।”
দেবশ্রী ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি? তুই কি ভাবছিস? একটা সফটওয়্যার কোম্পানি খোলা এত সহজ? কি জানিস তুই এই সফটওয়্যার, এই কম্পিউটার নিয়ে? এক বছরে তোদের এমন কি হাতি ঘোড়া শিখিয়ে দেবে যে তোরা কোম্পানি খুলতে চাস? একটা কোম্পানি খুলতে কত মাথা ব্যাথা সেটা জানিস? ব্যাবসার কি জানিস তুই?”
অনুপমা, “মামনি, শ্রেয়ার বন্ধু রূপক, যাদবপুরে আই.টি তে বি.টেক করছে। ওর সাথে মিলে আমরা এই কোম্পানি খুলতে চাই।”
দেবশ্রী মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে যায় অনুপমার কথা শুনে, “মানে আমাকে না জানিয়ে এই সব ভাবনা চিন্তা করা হয়ে গেছে তোদের?”
অনুপমা, “না মামনি, আমরা এখন পর্যন্ত কাউকে এই কথা জানাই নি। রূপক অথবা শ্রেয়া কারুর সাথে এই বিষয়ে কোন কথা হয় নি। শুধু তোমাকে জানালাম আমাদের পরিকল্পনার কথা। তোমার মতামত না পেলে, তোমার আশীর্বাদ না পেলে আমরা কিছুই করতে পারব না, মামনি।”
দেবশ্রী, “আচ্ছা একটা কথা বল, যত ছোটো কোম্পানি হোক না কেন সেটা শুরু করতে অনেক টাকা লাগে। কোথা দিয়ে আসবে এত টাকা? আমি অত বড়োলোক নই যে একটা কোম্পানি তৈরি করার মতন টাকা আমার কাছে থাকবে। জমি কিনেছি দেবায়নের বাবার জীবনবিমা আর ওর বড় মামার দেওয়া টাকা দিয়ে। বাড়ি করতে আমাকে এল.আই.সি থেকে লোণ নিতে হয়েছে। মাসের শেষে আমার হাতে এমন কিছু বাঁচে না যে তোদের আমি তোদের টাকা দিতে পারব।”
দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে, সময় এসেছে মাকে সব কথা খুলে বলার। অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “মামনি, সময় মতন টাকার যোগাড় আমরা ঠিক করে নেব।”
দেবশ্রী, “পারমিতা, মিস্টার সেন তোদের এই পরিকল্পনার কথা জানেন?”
অনুপমা মাথা নাড়িয়ে উত্তরে জানায়, “হ্যাঁ, বাবা সব জানে। বাবা, মায়ের মত আছে এই ব্যাপারে। আসলে আমার বাবা ওকে এই আই.টি কোম্পানি খুলতে বুদ্ধি দিয়েছেন।”
অনুপমার কথা শুনে দেবশ্রীর কান গরম হয়ে যায়। দেবশ্রী বুঝতে পারেন যে ছেলে নিশ্চয় মিস্টার সেনের সাথে কথা বলে এই টাকার ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু ছেলের মুখ থেকে সত্য শুনতে চায়, “পরকল্পনা বেশ গভীর ভাবে ভাবা হয়েছে মনে হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় টাকার কথা ভাবা হয়েছে। কোথা থেকে টাকা যোগাড় হবে?”
দেবায়ন, “মা, প্লিস আমাদের কথা শুনে রেগে যেও না। আমাদের পুরো পরিকল্পনার কথা আগে শোনো, বিচার কর, তারপরে বল আমরা ভুল কি করছি। আমি আর অনুপমা, রূপকের সাথে মিলে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করতে চাই। সেই বুদ্ধি আমাকে সোমেশ কাকু দিয়েছেন আর সেই সাথে বলেছেন যে কোম্পানির তৈরির যত টাকা লাগে তিনি আমাদের দেবেন।”
দেবশ্রীর চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ছেলের কথা শুনে, হিম শীতল ঠাণ্ডা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “তোর বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি অনেকের কাছে হাত পেতেছিলাম কেউ বিশেষ সাহায্য করেনি। তারপরে তোকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছি যাতে তোকে কারুর কাছে হাত না পাততে হয় আর তুই কি না নিজের আত্মসন্মান টুকু ডুবিয়ে মিস্টার সেনের কাছে টাকা চাইলি?”
মাথা নিচু করে বসে থাকে দেবায়ন। অনুপমা দেবশ্রীকে বলে, “না মামনি তুমি ভুল বুঝছো। আমাদের কথা একটু ভালো করে শোন।”
দেবশ্রী অনুপমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আর কি শোনাতে চাস তুই?”
অনুপমা বুঝতে পারে যে ওর মামনি রেগে গেছে, দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছে। আসস্থ কণ্ঠে মামনিকে বলে, “মামনি, চাকরির চেয়ে একটা ছোটো ফার্ম খুলতে দোষ কি? দেবায়নের স্বপ্ন একটা নিজের ফার্ম হবে।”
দেবশ্রী, “ওটা দেবায়নের স্বপ্ন না তোর স্বপ্ন?”
মায়ের কথার উত্তরে দেবায়ন বলে, “মা, চাকরি করতে করতে কিছু বছর পরে আমি একটা নিজের ফার্ম খুলতে চেষ্টা করতাম ঠিক। ওটা আমার স্বপ্ন ছিল বলতে পারো। অনু এই ব্যাপারে আমাকে কোনদিন কিছু বলেনি। অনু বরাবর আমার চাহিদাকে সন্মান দিয়েছে, মা।”
দেবশ্রী অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, তুই কি বলতে চাইছিস শুনি?”
অনুপমা ওর মামনির হাত দুটি ধরে বলে, “মামনি, প্লিস আমাদের ভুল বুঝ না। আমার স্বপ্ন শুধু তোমার কাছে থাকার। আমার কথা একটু শোনো মামনি। সফটওয়্যার ফার্ম তৈরি করতে গেলে একটা ফাইনেন্সিয়ারের দরকার পড়ত, সেখানে আমার বাবা আমাদের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চায়। তোমার কাছে টাকা থাকলে তুমি দেবায়ন কে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে না? সেখানে বাবা যদি আমাদের সাহায্য করে তাহলে ক্ষতি কোথায়? তুমি টাকা দিলে ঠিক আর আমার বাবা আমাকে টাকা দিলে সেটা ভুল? এটা কেমন মামনি?”
দেবায়ন মুখ তুলে অনুপমার দিকে তাকায়। দেবশ্রী দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধান বানী শোনায়, “ভুল নয় সেটা সত্যি। তবে একটা কথা মনে রাখিস। এই সম্পদ প্রতিপত্তির সিঁড়ি চড়তে চড়তে, কোনদিন ফেলে আসা ধাপ গুলো যেন ভুলে যাস না। এমন যেন না হয়, যে একদিন তুই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আর তোর সামনের জন তোকে প্রশ্ন করল, তুমি কি ঠিক করেছ দেবায়ন? আর সেইসময়ে তোর কাছে সেই উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই।”
দেবায়ন মায়ের হাত ধরে আসস্থ করে বলে, “না মা, আমি কথা দিচ্ছি, এমন কিছু আমরা করব না যাতে আমি নিজের সামনে দাঁড়াতে অথবা তোমার সামনে দাঁড়াতে অক্ষম হয়ে যাই।”
দেবশ্রী অনুপমাকে বলে, “কোলকাতায় ফিরে আমি একবার মিস্টার সেন আর পারমিতার সাথে দেখা করতে চাই।”
বুক দুরুদুরু করে ওঠে দেবায়নের। মিস্টার সেন বারেবারে বারন করেছিল, কাউকে যেন খোলসা করে বিশেষ কথা না জানায়। কিন্তু দেবশ্রীর কাছে লুকাতে পারল না অনুপমা অথবা দেবায়ন, মমতার তীব্র বন্ধনে মনের কথা খুলে বলতে হল। অনুপমা প্রমাদ গোনে, বাবার সাথে মামনি দেখা করলে বাবা ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, দেবশ্রীকে আসস্থ করে বলে, “মামনি এখন অনেক সময় বাকি আছে। প্লিস মামনি, এখুনি এইসব নিয়ে আমরা কোন ভাবনাচিন্তা করছি না। আগে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাক তারপরে না হয় তুমি মায়ের সাথে বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে।”