28-09-2020, 12:31 AM
অষ্টদশ পর্ব (#02)
দেরাদুনের পরে দেবায়ন আবার জেগে যায়। দেরাদুনের পরে গাড়ি আঁকাবাঁকা পথে পাহাড় চড়তে শুরু করে দেয়। ভোরের আলোয় ছোটো ছোটো সবুজে ঢাকা পাহাড় দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে দেবায়ন। মায়ের সাথে কোন এক ছোটো বেলায় একবার গ্যাংটক বেড়াতে গিয়েছিল, সেইসব মনে নেই। দেবশ্রী জেগে যায়, দেবায়নের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে পাহাড়। মায়ের নরম হাতের স্পর্শে দেবায়নের চমক ভাঙ্গে। হেসে জানায় পাহাড় ঘুরতে বেশ ভালো লাগছে। অনুপমা তখন দেবশ্রী কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। দেবশ্রী অনুপমার মুখের উপরে ঝুঁকে কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দেয়। সকাল ছ’টার সবাই মুসৌরি পৌঁছে যায়।
হোটেল রেসিডেন্সি ম্যানর মুসউরির শহরের রাস্তার ডান দিকে একটা ছোটো পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। রিসেপ্সানের লোক জানিয়ে দেয় সকালের ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি আর রাতের বুফের সাথে আলাকারটে ডিনারের ব্যাবস্থা আছে। দুটি কামরা দেবশ্রীর নামে আগে থেকে বুক করা ছিল। দেবায়নের জন্য একটা কামরা আর অন্য কামরায় দেবশ্রী আর অনুপমা থাকবে। সেই শুনে অনুপমার মুখের হাসি চলে যায়। দেবশ্রীর কড়া চাহনির সামনে কিছু বলতে পারে না দেবায়ন। অগত্যা অনুপমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর “মামনি”র সাথে রুমে চলে যায়। দেবশ্রী বলে দেয় যে স্নান সেরে তৈরি হয়ে ওরা ব্রেকফাস্ট করতে নিচে রেস্তোরাঁতে দেখা করবে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফেলে দেবায়ন, সারারাতের যাত্রার পরে স্নান সেরে দেবায়নের বেশ ভালো লাগে। মায়ের উপরে একটু রাগ হয়, অনুপমাকে মা নিজের রুমে রেখে দিয়েছে। বেড়াতে আসার আগে থেকে দুই জনের কত পরিকল্পনা ছিল, হোটেলের সাদা বিছানার উপরে সারারাত ধরে ভালোবাসার খেলা খেলবে, বাথরুমে বাথটবে দুইজনে গা ভাসিয়ে স্নান করবে। মায়ের কড়া নজরে সেটা সম্ভবপর হতে পারবে না। স্নান সেরে একটা জামা কাপড় পরে তৈরি দেবায়ন। দেবায়নের রুমে একটু পরে অনুপমা ঢোকে। অনুপমার দিকে তাকিয়ে দেবায়ন হাঁ হয়ে যায়। পরনে ছোটো সাদা রঙের জিন্সের হাফ প্যান্ট আর ছোটো হাতার হাল্কা গোলাপি টপ দেহের সাথে এঁটে বসে। দুই মসৃণ থাই, সম্পূর্ণ অনাবৃত, চকচক করছে পায়ের গুলি। চোখের কোণে একটু কাজল, মাথার চুল একটা পনি টেল করে বাঁধা। গজ দাঁতের মিষ্টি হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দেবায়নের দিকে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন দেখাচ্ছে? দেবায়ন অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে ছোটো একটা প্রেমঘন চুম্বন একে দেয়। অনুপমা দেবায়নের গলা জড়িয়ে সেই ভালোবাসার চুম্বন গভীর করে নেয়।
অনুপমা দেবায়নকে বলে, “ইসস মামনি আমাদের একসাথে থাকতে দেবে না।”
দেবায়ন, “দাঁড়াও না কিছু একটা করে ম্যানেজ করা যাবে। তুমি আর আমি পাশাপাশি রুমে এমনি এমনি কি করে ঘুমাব বলত।”
অনুপমা হেসে দেবায়নের বুকের উপরে মাথা পেতে বলে, “তোমাকে ছাড়া এই কয়দিন কি ভাবে ঘুমিয়েছি আমি জানি।”
দেবায়ন, “কেন রোজ রাতে ফোন করে জ্বালাতন করতে, তারপরে ঘুমাতে না?”
অনুপমা, “কি করে ঘুম পায় বলো দেখি? তুমি আমার অভ্যাস সাতদিনে বদলে দিয়ে চলে গেলে যে?”
দেবায়ন, “আচ্ছা বাবা। দেখা যাক মায়ের চোখের আড়াল করে কিছু করা যায় কি না।”
অনুপমা, “জানো মামনি বলছিল এই ট্রিপ নাকি মামনির অফিস পে করছে।”
দেবায়ন, “মা যে বলল এল.টি.এ নিয়েছে?”
অনুপমা, “হ্যাঁ এল.টি.এ নিয়েছে। মামনি কিছু একটা বলতে গিয়ে একটু ভাবুক হয়ে গেল, থেমে গেল। আমার মনে হয় যে মামনি আমাদের কিছু একটা কথা বলার জন্য এখানে ডেকেছে।”
দেবায়ন, “কেন মনে হল তোমার?”
অনুপমা, “সকালে কারুর একজনের ফোন এসেছিল। মামনিকে কথা বলতে শুনলাম। মামনি ফোনে সেই ব্যাক্তিকে বলছিল যে রাস্তায় কোন অসুবিধে হয়নি আর হোটেল ঠিক মতন পেয়ে গেছে। আমার মনে মামনির বসের ফোন ছিল সেটা। মামনি সেই ব্যাক্তিকে অনেক ধন্যবাদ জানায়।”
দেবায়ন, “আচ্ছা চলো দেখি রেস্তরাঁয়, ব্রেকফাস্ট করার পরে তোমার মামনির প্লান কি? কোথায় যাবে না হোটেলে থাকবে?”
অনুপমা আর দেবায়ন বেড়িয়ে পরে রুম থেকে। দেবশ্রী স্নান সেরে অনুপমার জেদের বশে একটা নীল রঙের জিন্স আর আকাশি নীল রঙের শার্ট পরে। মাকে জিন্সে দেখে দেবায়ন স্থম্ভিত, কোলকাতায় মাকে বিজনেস সুটে দেখেছে কিন্তু জিন্সে মা যেন আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছে। খাবার টেবিলে বসে দেবায়ন দেবশ্রীকে মজা করে বলে যে মাকে ভারী সুন্দরী দেখাচ্ছে। দেবশ্রী ছেলের মুখে নিজের রুপের কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে যায়।
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে দেবশ্রীকে, “আজকের প্লান কি? ব্রেকফাস্টের পরে কি কোথাও যাবো আমরা?”
দেবশ্রী, “ঠিক জানি না, তোর মতন আমিও প্রথম বার এখানে এসেছি। অনুকে জিজ্ঞেস কর অনেক বার এসেছে।”
অনুপমা, “মামনি আজকে ধনোলটি চলো, একদম পাহাড়ের মাঝে ছোটো একটা জায়গা খুব সুন্দর। অইখান থেকে হিমালয়ের অনেক বরফ ঢাকা পাহাড় দেখা যায়। খুব ভালো লাগবে। আমরা একবার শীতকালে এসেছিলাম আর কোনোরকমে ধনোলটি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে সেবারে খুব বরফ পড়েছিল, আমি আর ভাই সেই বরফে খুব খেলা করেছিলাম।”
দেবশ্রী, “ঠিক আছে সেখানে যাওয়া যাবে, তুই এখন সব। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো।”
দেবায়ন একটু খানি থেমে মাকে বলে, “মা আমার একটা আব্দার আছে।”
দেবশ্রী, “কি আব্দার?”
দেবায়ন, “মা আমি একটা বাইক কিনব।”
দেবশ্রী খাওয়া থামিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাইক কেন? এই বললি যে কম্পিউটার করতে হবে, সেখানে টাকা লাগবে না?”
দেবায়ন চুপ করে যায়। দেবশ্রী ছেলের শুকনো মুখ দেখে হেসে বলে, “ঠিক আছে বাবা, তবে এত তাড়াতাড়ি কিনে দিতে পারব না। তুই আগে তোর কম্পিউটার কোর্স শুরু কর তারপরে পুজোর আগে দেখি টাকা যোগাড় করে তোকে বাইক কিনে দেব।”
দেবায়ন অনুপমার দিকে চোখ টিপে জিজ্ঞেস করে যে ওদের আই.টি কোম্পানি তৈরির কথা কি এখুনি শুরু করবে না পরে। অনুপমা ইশারায় জানায় যে পরে সময় হলে সেই নিয়ে কথা বলবে, সেই সব আলোচনা করার অনেক সময় আছে।
দেবশ্রী আড় চোখে রেস্তোরাঁর একপাশে কাউকে দেখে চুপ করে যায়। কিছু পরে খাওয়া থামিয়ে দেবশ্রী বলে, “তোদের সাথে আমার একটা বিশেষ কথা আছে।”
অনুপমা আর দেবায়ন পরস্পরের দিকে তাকায়। অনুপমা আগেই অনুধাবন করেছিল ব্যাপারটা, কিন্তু জানত না কি সেই ব্যাপার। দেবশ্রী বলে, “আমার এই ট্রিপ আসলে কোম্পানি পে করছে। আমার ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা কোলকাতা ফিরে যাবার ইচ্ছে ছিল। চিফ রিক্রুটার হিসাবে আমার হাতে একটা বাজেট দেওয়া হয়। সেই বাজেটের থেকে প্রায় সতের লাখ টাকার মতন বেঁচে যায়। সেই দেখে কোম্পানির সি.ই.ও, মিস্টার ব্রিজেশ ত্রিপাঠি আর আমার বস, মিস্টার হেমন্ত ঠাকুর, এই ট্রিপ আমাকে উপহার দিয়েছে।”
দেবায়ন বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “বাপরে তুমি তাহলে পুরোদস্তুর পেশাদারী মহিলা হয়ে গেছ।”
দেবশ্রী হেসে বলে, “হ্যাঁ তা হয়ে গেছি অনেকটা, সেটা যে আমার কাজ রে।”
অনুপমা, “আর কি করলে এই পনেরো দিনে? কোথাও বেড়াতে যাওনই তুমি? কারুর সাথে পরিচয় হল না এই ট্রিপে?”
পরিচয়ের কথা শুনে দেবশ্রী্র গাল লাল হয়ে ওঠে, অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দেয়, “অফিসের লোকের সাথে পরিচয় আর অফিসের কাজ নিয়েই ব্যাস্ত ছিলাম এই কয়দিন।”
ঘাড় ঘুরিয়ে দুরে বসে টেবিলে এক ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখে দেবশ্রী। অনুপমা আর দেবায়নের সেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। ওদের টেবিলের অদুরে এক টেবিলে একটা ছোটো মেয়ের সাথে এক ভদ্রলোক বসে, দেখেই বোঝা যায় যে বাবা তার মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। দেবশ্রী চিন্তায় পরে যায়, এখুনি কি দিল্লীর চাকরির কথা বলা ঠিক হবে না রাতে খাবারের সময়ে বলবে। আগে বেড়িয়ে নেওয়া ঠিক, দিল্লীর কথা শোনার পরে হয়ত অনুপমা আর দেবায়নের মন খারাপ হয়ে যাবে।
দেবশ্রী খাওয়া সেরে অনুপমাকে বলে, “চল রে, বেড়িয়ে পরি। কোথায় নিয়ে যাবি বলছিলি তুই।”
ব্রেকফাস্ট সেরে তিনজনে গড়ি নিয়ে ধনোলটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হোটেলে থেকে বেড়িয়ে মুসউরি শহরে পৌঁছাতেই মনে হল যেন জন সমুদ্রের কবলে পড়েছে। কলেজ কলেজে গ্রীস্মকালের ছুটি, সবাই ঘুরতে বেড়িয়েছে সুন্দর শহর মুসৌরি। দেশের ভিন্ন প্রান্তের লোক সমাগম, তার মাঝে কিছু বিদেশি পর্যটকের দেখা মেলে। মুসৌরির ম্যাল রোড ছাড়িয়ে, ভিড় ভর্তি এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ি আঁকা বাঁকা পথে আবার পাহাড় চড়তে শুরু করে দেয়। এক জায়গায় ড্রাইভার গাড়ি দার করিয়ে রাস্তা জিজ্ঞেস করে নেয়, তারপরে আবার গাড়ি চলতে শুরু করে। ড্রাইভার বেশ পটু, মুসউরি থেকে ধনোলটি যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যাবে বলে জানায়। আঁকা বাঁকা পথের একপাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে গভীর খাদ। সবুজ বিশাল বিশাল গাছে ভরা পাহাড়। দূর উত্তর দিকে দিগন্তে দেখা যায় বরফে ঢাকা হিমালয় পর্বতমালা, সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ শৃঙ্গ সমুহ। খালি রাস্তা, সামনে পেছনে খুব কম গাড়ি, তবে একটা গাড়ি সেই মুসউরি থেকে ওদের অনুসরণ করছে। পেছনের সিটে অনুপমা বসে ওদের সেই পর্বত শৃঙ্গের গল্প করে আর ছোটোবেলায় একবার এসেছিল এই ধনোলটি সেই গল্প করে। দুপুর নাগাদ দেবায়নেরা ধনোলটি পৌঁছে যায়। পেছনের গাড়ি কিছু পরে এসে ওদের গাড়ির কাছে থামে। সেই গাড়ি থেকে একা এক ভদ্রলোক ক্যামেরা হাতে নেমে জায়গার শোভা দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। খুব ছোটো জায়গা, কয়েকটা দোকান আর কয়েকটা ছোটো হোটেল ছাড়া কিছু নেই। সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ দূর পর্বতশৃঙ্গের শোভা দেখে। মায়ের অলক্ষ্যে অনুপমাকে একটু নিবিড় করে আদর করার ইচ্ছে জাগে। দেবায়ন আর অনুপমা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেবশ্রীকে ছাড়িয়ে বেশ দুরে এগিয়ে যায়। প্রেয়সীকে একটু এক পেয়ে, দেবায়ন দুই বাহু মেলে জড়িয়ে ধরে অনুপমাকে।
অনুপমা দেবায়নের চোখের উপরে চোখ রেখে গভীর আলিঙ্গনে গলা জড়িয়ে বলে, “তোমার জন্য এই জায়গা নতুন লাগছে জানো।”
দেবায়ন অনুপমার কোমল দেহ নিজের সাথে মিলিয়ে নিয়ে গালে চুমু একে বলে, “তোমার গজ দাঁতের হাসি বড় মিষ্টি। জায়গার কথা জানিনা, তবে তোমাকে পাশে পেলে যেখানে খুশি যেতে রাজি।”
চুলের মধ্যে নাক গুঁজে প্রেয়সীর গায়ের মিষ্টি সুবাস বুকে ভরিয়ে নেয়।
অনুপমা, “আচ্ছা আমরা হানিমুনে কোথায় যাবো?”
দেবায়ন হেসে বলে, “এই তো হানিমুন হয়ে যাচ্ছে আবার কোথায় যাবো।”
অনুপমা দেবায়নের বুকে ছোটো কিল মেরে বলে, “ধুর বাবা বলো না কোথায় নিয়ে যাবে? এখানে হানিমুন কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। মামনি মনে হয় না, আমাকে তোমার কাছে একা ছারবে। আমাদের হানিমুন মাঠে মারা গেল।”
দেবায়ন, “কোথায় যেতে চাও তুমি?”
অনুপমা, “হানিমুনে সঞ্চয়িতাদির বাড়ি। আমার মাসির মেয়ে সঞ্চয়িতা, ইংল্যান্ডে, মারগেট শহরে থাকে। তিন বছর আগে ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম। উফফফ কি দারুন জায়গায় বাড়ি জানো, একদম সমুদ্রের তীরে।”
দেবায়ন চুপ করে মিষ্টি হাসি মাখানো অনুপমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিস্টার সেনের কথা মনে পরে যায়, অনুপমার বাবা বলেছিলেন যে মেয়ে যদি কখন লন্ডন যেতে চায় তাহলে কি চাকরির পয়সায় মেয়েকে লন্ডন নিয়ে যেতে পারবে দেবায়ন। দেবায়ন কোনদিন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বের হয়নি, মায়ের অফিসের দৌলতে সুদুর মুসউরি বেড়াতে এসেছে। নিবিড় আলিঙ্গন পাশে বদ্ধ কোমল প্রেয়সীর দেহপল্লব, আদুরে কণ্ঠে অনুপমা আবার বলে, “নিয়ে যাবে আমাকে? দারুন জায়গা, নীলচে সবুজ সমুদ্রের পাশে খুব ছোটো সাজানো শহর।”
দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ সোনা তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।”
মাথার মধ্যে ঘোরপ্যাঁচ খেয়ে যায় মিস্টার সেনের কথা, নিজের কোম্পানি যদি দাঁড় করাতে না পারে তাহলে প্রেয়সীর স্বপ্ন পূরণ করতে অক্ষম হবে দেবায়ন।
অনুপমা দেবায়নের চোখে চোখ রেখে বলে, “ধুর বোকা ছেলে, আমি তোমার সাথে মজা করছিলাম। আমি তোমার চোখ পড়তে জানি পুচ্চু। তুমি নিজেকে যত চেননা, তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে চিনি, বুঝেছ। আমি মারগেট যাবো না, তুমি আমাকে যদি আউট্রামের স্কুপে বসিয়ে আইসক্রিম খাইয়ে বল যে আমাদের হানিমুন হয়ে গেছে, তাতেই আমার হানিমুন হয়ে যাবে। তুমি এত কেন ভাবছ যে আমার বাবা আমাকে যেখানে নিয়ে গেছে সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে? আমার বাবার কাছে পয়সা ছিল, ছেলে মেয়ের জন্য সময় আর ভালোবাসা ছিল না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি পুচ্চুসোনা, তোমার বুকের মাঝে থাকলেই আমার হানিমুনের সাধ পূরণ হয়ে যাবে।”
অনুপমার কথা শুনে দেবায়ন উত্তরের ভাষা হারিয়ে প্রেয়সীকে জড়িয়ে মাটি থেকে উঠিয়ে দেয়। অনুপমা দেবায়নের গলা জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে গভীর চুম্বন একে দেয়। ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়ার পরশ দুই প্রেমঘন নর নারীকে একত্রিত করে দেয়, সময় থমকে দাঁড়ায় দুই মিলনেচ্ছুক হৃদয়ের চারপাশে।
কোলে তুলে দেবায়ন অনুপমাকে বলে, “না পুচ্চি সোনা, তুমি বলেছ যখন আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। আমি দেখি আমাদের এই কোম্পানির ব্যাপারে মায়ের সাথে কথা বলে।”
অনুপমা, “পুচ্চু, অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। আমাদের আগে কম্পিউটার কোর্স করতে হবে, তারপরে মামনির সাথে কথা বলতে হবে। কম্পিউটার কোর্স করতে মামনির যখন কোন বাধা নেই তাহলে আশা করি আমাদের আই.টি কোম্পানির স্বপ্নেও মামনি বাধা দেবে না।”
দেবায়ন, “ঠিক জানিনা পুচ্চি। তবে মায়ের মনের মধ্যে কিছু একটা আছে বলে মনে হয়। মাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
অনুপমা, “হ্যাঁ, মামনি মাঝে মাঝে কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে, চোখ ভাসা ভাসা হয়ে জাচ্ছে। আমি খেয়াল করেছি আজ সকালে খাবার সময়ে। চল দেখা যাক মামনি একা একা কি করছে আবার।”
দেবায়ন আর অনুপমা দুরে দাঁড়িয়ে থাকা দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে। দূর থেকে দেবশ্রীকে নীল রঙের জিন্সে দেখে অনুপমা দেবায়নকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “মামনিকে জিন্সে দারুন দেখাচ্ছে। আবার পাশে এক ভদ্রলোক দেখছি মনে হচ্ছে? চলো দেখা যাক।”
দেবায়ন আর অনুপমা এগিয়ে আসে দেবশ্রী যেখানে দাঁড়িয়েছিল। পাশের ভদ্রলোককে দেখে দেবায়নের মনে পরে যে এই ভদ্রলোক হোটেলে ছিলেন, সকালে রেস্তোরাঁতে দেখতে পেয়েছিল দেবায়ন। অদুরে দাঁড়িয়ে ছোটো ফুটফুটে একটা মেয়ে, বয়স খুব বেশি নয় তবে সুন্দরী, দেখে মনে হল যেন কলেজে পড়ে।
দেরাদুনের পরে দেবায়ন আবার জেগে যায়। দেরাদুনের পরে গাড়ি আঁকাবাঁকা পথে পাহাড় চড়তে শুরু করে দেয়। ভোরের আলোয় ছোটো ছোটো সবুজে ঢাকা পাহাড় দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে দেবায়ন। মায়ের সাথে কোন এক ছোটো বেলায় একবার গ্যাংটক বেড়াতে গিয়েছিল, সেইসব মনে নেই। দেবশ্রী জেগে যায়, দেবায়নের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে পাহাড়। মায়ের নরম হাতের স্পর্শে দেবায়নের চমক ভাঙ্গে। হেসে জানায় পাহাড় ঘুরতে বেশ ভালো লাগছে। অনুপমা তখন দেবশ্রী কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। দেবশ্রী অনুপমার মুখের উপরে ঝুঁকে কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দেয়। সকাল ছ’টার সবাই মুসৌরি পৌঁছে যায়।
হোটেল রেসিডেন্সি ম্যানর মুসউরির শহরের রাস্তার ডান দিকে একটা ছোটো পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। রিসেপ্সানের লোক জানিয়ে দেয় সকালের ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি আর রাতের বুফের সাথে আলাকারটে ডিনারের ব্যাবস্থা আছে। দুটি কামরা দেবশ্রীর নামে আগে থেকে বুক করা ছিল। দেবায়নের জন্য একটা কামরা আর অন্য কামরায় দেবশ্রী আর অনুপমা থাকবে। সেই শুনে অনুপমার মুখের হাসি চলে যায়। দেবশ্রীর কড়া চাহনির সামনে কিছু বলতে পারে না দেবায়ন। অগত্যা অনুপমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর “মামনি”র সাথে রুমে চলে যায়। দেবশ্রী বলে দেয় যে স্নান সেরে তৈরি হয়ে ওরা ব্রেকফাস্ট করতে নিচে রেস্তোরাঁতে দেখা করবে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ফেলে দেবায়ন, সারারাতের যাত্রার পরে স্নান সেরে দেবায়নের বেশ ভালো লাগে। মায়ের উপরে একটু রাগ হয়, অনুপমাকে মা নিজের রুমে রেখে দিয়েছে। বেড়াতে আসার আগে থেকে দুই জনের কত পরিকল্পনা ছিল, হোটেলের সাদা বিছানার উপরে সারারাত ধরে ভালোবাসার খেলা খেলবে, বাথরুমে বাথটবে দুইজনে গা ভাসিয়ে স্নান করবে। মায়ের কড়া নজরে সেটা সম্ভবপর হতে পারবে না। স্নান সেরে একটা জামা কাপড় পরে তৈরি দেবায়ন। দেবায়নের রুমে একটু পরে অনুপমা ঢোকে। অনুপমার দিকে তাকিয়ে দেবায়ন হাঁ হয়ে যায়। পরনে ছোটো সাদা রঙের জিন্সের হাফ প্যান্ট আর ছোটো হাতার হাল্কা গোলাপি টপ দেহের সাথে এঁটে বসে। দুই মসৃণ থাই, সম্পূর্ণ অনাবৃত, চকচক করছে পায়ের গুলি। চোখের কোণে একটু কাজল, মাথার চুল একটা পনি টেল করে বাঁধা। গজ দাঁতের মিষ্টি হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে দেবায়নের দিকে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন দেখাচ্ছে? দেবায়ন অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে ছোটো একটা প্রেমঘন চুম্বন একে দেয়। অনুপমা দেবায়নের গলা জড়িয়ে সেই ভালোবাসার চুম্বন গভীর করে নেয়।
অনুপমা দেবায়নকে বলে, “ইসস মামনি আমাদের একসাথে থাকতে দেবে না।”
দেবায়ন, “দাঁড়াও না কিছু একটা করে ম্যানেজ করা যাবে। তুমি আর আমি পাশাপাশি রুমে এমনি এমনি কি করে ঘুমাব বলত।”
অনুপমা হেসে দেবায়নের বুকের উপরে মাথা পেতে বলে, “তোমাকে ছাড়া এই কয়দিন কি ভাবে ঘুমিয়েছি আমি জানি।”
দেবায়ন, “কেন রোজ রাতে ফোন করে জ্বালাতন করতে, তারপরে ঘুমাতে না?”
অনুপমা, “কি করে ঘুম পায় বলো দেখি? তুমি আমার অভ্যাস সাতদিনে বদলে দিয়ে চলে গেলে যে?”
দেবায়ন, “আচ্ছা বাবা। দেখা যাক মায়ের চোখের আড়াল করে কিছু করা যায় কি না।”
অনুপমা, “জানো মামনি বলছিল এই ট্রিপ নাকি মামনির অফিস পে করছে।”
দেবায়ন, “মা যে বলল এল.টি.এ নিয়েছে?”
অনুপমা, “হ্যাঁ এল.টি.এ নিয়েছে। মামনি কিছু একটা বলতে গিয়ে একটু ভাবুক হয়ে গেল, থেমে গেল। আমার মনে হয় যে মামনি আমাদের কিছু একটা কথা বলার জন্য এখানে ডেকেছে।”
দেবায়ন, “কেন মনে হল তোমার?”
অনুপমা, “সকালে কারুর একজনের ফোন এসেছিল। মামনিকে কথা বলতে শুনলাম। মামনি ফোনে সেই ব্যাক্তিকে বলছিল যে রাস্তায় কোন অসুবিধে হয়নি আর হোটেল ঠিক মতন পেয়ে গেছে। আমার মনে মামনির বসের ফোন ছিল সেটা। মামনি সেই ব্যাক্তিকে অনেক ধন্যবাদ জানায়।”
দেবায়ন, “আচ্ছা চলো দেখি রেস্তরাঁয়, ব্রেকফাস্ট করার পরে তোমার মামনির প্লান কি? কোথায় যাবে না হোটেলে থাকবে?”
অনুপমা আর দেবায়ন বেড়িয়ে পরে রুম থেকে। দেবশ্রী স্নান সেরে অনুপমার জেদের বশে একটা নীল রঙের জিন্স আর আকাশি নীল রঙের শার্ট পরে। মাকে জিন্সে দেখে দেবায়ন স্থম্ভিত, কোলকাতায় মাকে বিজনেস সুটে দেখেছে কিন্তু জিন্সে মা যেন আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছে। খাবার টেবিলে বসে দেবায়ন দেবশ্রীকে মজা করে বলে যে মাকে ভারী সুন্দরী দেখাচ্ছে। দেবশ্রী ছেলের মুখে নিজের রুপের কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে যায়।
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে দেবশ্রীকে, “আজকের প্লান কি? ব্রেকফাস্টের পরে কি কোথাও যাবো আমরা?”
দেবশ্রী, “ঠিক জানি না, তোর মতন আমিও প্রথম বার এখানে এসেছি। অনুকে জিজ্ঞেস কর অনেক বার এসেছে।”
অনুপমা, “মামনি আজকে ধনোলটি চলো, একদম পাহাড়ের মাঝে ছোটো একটা জায়গা খুব সুন্দর। অইখান থেকে হিমালয়ের অনেক বরফ ঢাকা পাহাড় দেখা যায়। খুব ভালো লাগবে। আমরা একবার শীতকালে এসেছিলাম আর কোনোরকমে ধনোলটি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে সেবারে খুব বরফ পড়েছিল, আমি আর ভাই সেই বরফে খুব খেলা করেছিলাম।”
দেবশ্রী, “ঠিক আছে সেখানে যাওয়া যাবে, তুই এখন সব। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবো।”
দেবায়ন একটু খানি থেমে মাকে বলে, “মা আমার একটা আব্দার আছে।”
দেবশ্রী, “কি আব্দার?”
দেবায়ন, “মা আমি একটা বাইক কিনব।”
দেবশ্রী খাওয়া থামিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাইক কেন? এই বললি যে কম্পিউটার করতে হবে, সেখানে টাকা লাগবে না?”
দেবায়ন চুপ করে যায়। দেবশ্রী ছেলের শুকনো মুখ দেখে হেসে বলে, “ঠিক আছে বাবা, তবে এত তাড়াতাড়ি কিনে দিতে পারব না। তুই আগে তোর কম্পিউটার কোর্স শুরু কর তারপরে পুজোর আগে দেখি টাকা যোগাড় করে তোকে বাইক কিনে দেব।”
দেবায়ন অনুপমার দিকে চোখ টিপে জিজ্ঞেস করে যে ওদের আই.টি কোম্পানি তৈরির কথা কি এখুনি শুরু করবে না পরে। অনুপমা ইশারায় জানায় যে পরে সময় হলে সেই নিয়ে কথা বলবে, সেই সব আলোচনা করার অনেক সময় আছে।
দেবশ্রী আড় চোখে রেস্তোরাঁর একপাশে কাউকে দেখে চুপ করে যায়। কিছু পরে খাওয়া থামিয়ে দেবশ্রী বলে, “তোদের সাথে আমার একটা বিশেষ কথা আছে।”
অনুপমা আর দেবায়ন পরস্পরের দিকে তাকায়। অনুপমা আগেই অনুধাবন করেছিল ব্যাপারটা, কিন্তু জানত না কি সেই ব্যাপার। দেবশ্রী বলে, “আমার এই ট্রিপ আসলে কোম্পানি পে করছে। আমার ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা কোলকাতা ফিরে যাবার ইচ্ছে ছিল। চিফ রিক্রুটার হিসাবে আমার হাতে একটা বাজেট দেওয়া হয়। সেই বাজেটের থেকে প্রায় সতের লাখ টাকার মতন বেঁচে যায়। সেই দেখে কোম্পানির সি.ই.ও, মিস্টার ব্রিজেশ ত্রিপাঠি আর আমার বস, মিস্টার হেমন্ত ঠাকুর, এই ট্রিপ আমাকে উপহার দিয়েছে।”
দেবায়ন বড় বড় চোখ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “বাপরে তুমি তাহলে পুরোদস্তুর পেশাদারী মহিলা হয়ে গেছ।”
দেবশ্রী হেসে বলে, “হ্যাঁ তা হয়ে গেছি অনেকটা, সেটা যে আমার কাজ রে।”
অনুপমা, “আর কি করলে এই পনেরো দিনে? কোথাও বেড়াতে যাওনই তুমি? কারুর সাথে পরিচয় হল না এই ট্রিপে?”
পরিচয়ের কথা শুনে দেবশ্রী্র গাল লাল হয়ে ওঠে, অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দেয়, “অফিসের লোকের সাথে পরিচয় আর অফিসের কাজ নিয়েই ব্যাস্ত ছিলাম এই কয়দিন।”
ঘাড় ঘুরিয়ে দুরে বসে টেবিলে এক ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখে দেবশ্রী। অনুপমা আর দেবায়নের সেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। ওদের টেবিলের অদুরে এক টেবিলে একটা ছোটো মেয়ের সাথে এক ভদ্রলোক বসে, দেখেই বোঝা যায় যে বাবা তার মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে। দেবশ্রী চিন্তায় পরে যায়, এখুনি কি দিল্লীর চাকরির কথা বলা ঠিক হবে না রাতে খাবারের সময়ে বলবে। আগে বেড়িয়ে নেওয়া ঠিক, দিল্লীর কথা শোনার পরে হয়ত অনুপমা আর দেবায়নের মন খারাপ হয়ে যাবে।
দেবশ্রী খাওয়া সেরে অনুপমাকে বলে, “চল রে, বেড়িয়ে পরি। কোথায় নিয়ে যাবি বলছিলি তুই।”
ব্রেকফাস্ট সেরে তিনজনে গড়ি নিয়ে ধনোলটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হোটেলে থেকে বেড়িয়ে মুসউরি শহরে পৌঁছাতেই মনে হল যেন জন সমুদ্রের কবলে পড়েছে। কলেজ কলেজে গ্রীস্মকালের ছুটি, সবাই ঘুরতে বেড়িয়েছে সুন্দর শহর মুসৌরি। দেশের ভিন্ন প্রান্তের লোক সমাগম, তার মাঝে কিছু বিদেশি পর্যটকের দেখা মেলে। মুসৌরির ম্যাল রোড ছাড়িয়ে, ভিড় ভর্তি এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ি আঁকা বাঁকা পথে আবার পাহাড় চড়তে শুরু করে দেয়। এক জায়গায় ড্রাইভার গাড়ি দার করিয়ে রাস্তা জিজ্ঞেস করে নেয়, তারপরে আবার গাড়ি চলতে শুরু করে। ড্রাইভার বেশ পটু, মুসউরি থেকে ধনোলটি যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যাবে বলে জানায়। আঁকা বাঁকা পথের একপাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে গভীর খাদ। সবুজ বিশাল বিশাল গাছে ভরা পাহাড়। দূর উত্তর দিকে দিগন্তে দেখা যায় বরফে ঢাকা হিমালয় পর্বতমালা, সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ শৃঙ্গ সমুহ। খালি রাস্তা, সামনে পেছনে খুব কম গাড়ি, তবে একটা গাড়ি সেই মুসউরি থেকে ওদের অনুসরণ করছে। পেছনের সিটে অনুপমা বসে ওদের সেই পর্বত শৃঙ্গের গল্প করে আর ছোটোবেলায় একবার এসেছিল এই ধনোলটি সেই গল্প করে। দুপুর নাগাদ দেবায়নেরা ধনোলটি পৌঁছে যায়। পেছনের গাড়ি কিছু পরে এসে ওদের গাড়ির কাছে থামে। সেই গাড়ি থেকে একা এক ভদ্রলোক ক্যামেরা হাতে নেমে জায়গার শোভা দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। খুব ছোটো জায়গা, কয়েকটা দোকান আর কয়েকটা ছোটো হোটেল ছাড়া কিছু নেই। সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ দূর পর্বতশৃঙ্গের শোভা দেখে। মায়ের অলক্ষ্যে অনুপমাকে একটু নিবিড় করে আদর করার ইচ্ছে জাগে। দেবায়ন আর অনুপমা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেবশ্রীকে ছাড়িয়ে বেশ দুরে এগিয়ে যায়। প্রেয়সীকে একটু এক পেয়ে, দেবায়ন দুই বাহু মেলে জড়িয়ে ধরে অনুপমাকে।
অনুপমা দেবায়নের চোখের উপরে চোখ রেখে গভীর আলিঙ্গনে গলা জড়িয়ে বলে, “তোমার জন্য এই জায়গা নতুন লাগছে জানো।”
দেবায়ন অনুপমার কোমল দেহ নিজের সাথে মিলিয়ে নিয়ে গালে চুমু একে বলে, “তোমার গজ দাঁতের হাসি বড় মিষ্টি। জায়গার কথা জানিনা, তবে তোমাকে পাশে পেলে যেখানে খুশি যেতে রাজি।”
চুলের মধ্যে নাক গুঁজে প্রেয়সীর গায়ের মিষ্টি সুবাস বুকে ভরিয়ে নেয়।
অনুপমা, “আচ্ছা আমরা হানিমুনে কোথায় যাবো?”
দেবায়ন হেসে বলে, “এই তো হানিমুন হয়ে যাচ্ছে আবার কোথায় যাবো।”
অনুপমা দেবায়নের বুকে ছোটো কিল মেরে বলে, “ধুর বাবা বলো না কোথায় নিয়ে যাবে? এখানে হানিমুন কিছু হবে বলে আমার মনে হয় না। মামনি মনে হয় না, আমাকে তোমার কাছে একা ছারবে। আমাদের হানিমুন মাঠে মারা গেল।”
দেবায়ন, “কোথায় যেতে চাও তুমি?”
অনুপমা, “হানিমুনে সঞ্চয়িতাদির বাড়ি। আমার মাসির মেয়ে সঞ্চয়িতা, ইংল্যান্ডে, মারগেট শহরে থাকে। তিন বছর আগে ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম। উফফফ কি দারুন জায়গায় বাড়ি জানো, একদম সমুদ্রের তীরে।”
দেবায়ন চুপ করে মিষ্টি হাসি মাখানো অনুপমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিস্টার সেনের কথা মনে পরে যায়, অনুপমার বাবা বলেছিলেন যে মেয়ে যদি কখন লন্ডন যেতে চায় তাহলে কি চাকরির পয়সায় মেয়েকে লন্ডন নিয়ে যেতে পারবে দেবায়ন। দেবায়ন কোনদিন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বের হয়নি, মায়ের অফিসের দৌলতে সুদুর মুসউরি বেড়াতে এসেছে। নিবিড় আলিঙ্গন পাশে বদ্ধ কোমল প্রেয়সীর দেহপল্লব, আদুরে কণ্ঠে অনুপমা আবার বলে, “নিয়ে যাবে আমাকে? দারুন জায়গা, নীলচে সবুজ সমুদ্রের পাশে খুব ছোটো সাজানো শহর।”
দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে বলে, “হ্যাঁ সোনা তুমি যেখানে যেতে চাইবে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।”
মাথার মধ্যে ঘোরপ্যাঁচ খেয়ে যায় মিস্টার সেনের কথা, নিজের কোম্পানি যদি দাঁড় করাতে না পারে তাহলে প্রেয়সীর স্বপ্ন পূরণ করতে অক্ষম হবে দেবায়ন।
অনুপমা দেবায়নের চোখে চোখ রেখে বলে, “ধুর বোকা ছেলে, আমি তোমার সাথে মজা করছিলাম। আমি তোমার চোখ পড়তে জানি পুচ্চু। তুমি নিজেকে যত চেননা, তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে চিনি, বুঝেছ। আমি মারগেট যাবো না, তুমি আমাকে যদি আউট্রামের স্কুপে বসিয়ে আইসক্রিম খাইয়ে বল যে আমাদের হানিমুন হয়ে গেছে, তাতেই আমার হানিমুন হয়ে যাবে। তুমি এত কেন ভাবছ যে আমার বাবা আমাকে যেখানে নিয়ে গেছে সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে হবে? আমার বাবার কাছে পয়সা ছিল, ছেলে মেয়ের জন্য সময় আর ভালোবাসা ছিল না। আমি যে তোমাকে ভালোবাসি পুচ্চুসোনা, তোমার বুকের মাঝে থাকলেই আমার হানিমুনের সাধ পূরণ হয়ে যাবে।”
অনুপমার কথা শুনে দেবায়ন উত্তরের ভাষা হারিয়ে প্রেয়সীকে জড়িয়ে মাটি থেকে উঠিয়ে দেয়। অনুপমা দেবায়নের গলা জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে গভীর চুম্বন একে দেয়। ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়ার পরশ দুই প্রেমঘন নর নারীকে একত্রিত করে দেয়, সময় থমকে দাঁড়ায় দুই মিলনেচ্ছুক হৃদয়ের চারপাশে।
কোলে তুলে দেবায়ন অনুপমাকে বলে, “না পুচ্চি সোনা, তুমি বলেছ যখন আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। আমি দেখি আমাদের এই কোম্পানির ব্যাপারে মায়ের সাথে কথা বলে।”
অনুপমা, “পুচ্চু, অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। আমাদের আগে কম্পিউটার কোর্স করতে হবে, তারপরে মামনির সাথে কথা বলতে হবে। কম্পিউটার কোর্স করতে মামনির যখন কোন বাধা নেই তাহলে আশা করি আমাদের আই.টি কোম্পানির স্বপ্নেও মামনি বাধা দেবে না।”
দেবায়ন, “ঠিক জানিনা পুচ্চি। তবে মায়ের মনের মধ্যে কিছু একটা আছে বলে মনে হয়। মাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
অনুপমা, “হ্যাঁ, মামনি মাঝে মাঝে কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে, চোখ ভাসা ভাসা হয়ে জাচ্ছে। আমি খেয়াল করেছি আজ সকালে খাবার সময়ে। চল দেখা যাক মামনি একা একা কি করছে আবার।”
দেবায়ন আর অনুপমা দুরে দাঁড়িয়ে থাকা দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখে। দূর থেকে দেবশ্রীকে নীল রঙের জিন্সে দেখে অনুপমা দেবায়নকে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “মামনিকে জিন্সে দারুন দেখাচ্ছে। আবার পাশে এক ভদ্রলোক দেখছি মনে হচ্ছে? চলো দেখা যাক।”
দেবায়ন আর অনুপমা এগিয়ে আসে দেবশ্রী যেখানে দাঁড়িয়েছিল। পাশের ভদ্রলোককে দেখে দেবায়নের মনে পরে যে এই ভদ্রলোক হোটেলে ছিলেন, সকালে রেস্তোরাঁতে দেখতে পেয়েছিল দেবায়ন। অদুরে দাঁড়িয়ে ছোটো ফুটফুটে একটা মেয়ে, বয়স খুব বেশি নয় তবে সুন্দরী, দেখে মনে হল যেন কলেজে পড়ে।