27-09-2020, 02:33 PM
সপ্তদশ পর্ব (#03)
ধৃতিমানের আব্দার শুনে প্রথমে রাগ হয় দেবশ্রীর। এতরাতে এইরকম এক আব্দার, চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সংযত কণ্ঠে জবাব দেয় দেবশ্রী, “অনেক রাত হয়ে গেছে, আপনি ড্রিঙ্ক করেছেন। তাড়াতাড়ি শুতে যান, কাল সকালে আমাদের অনেক কাজ আছে।”
ধৃতিমান, “আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, একটা ছোটো পেগ নেব, আমি একটা ছোটো পেগ নিয়েছি, বেশি খাইনি।”
দেবশ্রী, “ভালো, শুনে খুশি হলাম যে আপনি আমার কথা রেখেছেন।”
ধৃতিমান, “আপনার কণ্ঠ স্বর বড় মধুর ম্যাডাম, আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।”
দেবশ্রীর ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ, বলুন কি বলতে চান।”
ধৃতিমানের গলা হটাত ধরে আসে, “অনেক দিন কারুর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারিনি, তাই আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। বুকে বড় পাপবোধ জেগে উঠেছে, ম্যাডাম। সেই বেদনা ঢাকতে আমি ড্রিঙ্ক নিয়ে বসেছিলাম, আর আপনার কথা মনে পরে গেল।”
কথাটা শুনে দেবশ্রীর সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই অশ্রু সিক্ত কণ্ঠের পেছনের ধৃতিমানকে জানার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। দেবশ্রী জিজ্ঞেস করে, “আপনার কি হয়েছে?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় ধৃতিমান, “বড় কষ্ট, আমি বড় অপরাধী, ম্যাডাম।”
ধৃতিমানের কণ্ঠ স্বর শুনে দেবশ্রী বিচলিত হয়ে ওঠে, “সত্যি বলুনত আপনার কি হয়েছে? আপনি কোথায়?”
ধৃতিমান, “আমি বারে বসে আছি। একটা পেগ নিয়েছি, কিন্তু কিছুতেই শেষ করতে পারছি না।”
ধৃতিমানের গলার স্বরে বেদনা। বহু মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছে দেবশ্রী, কার কণ্ঠস্বর কি বলতে চাইছে সেটা ভালো ভাবেই জানে। ধৃতিমানের কণ্ঠে পাপবোধ ছলকে পড়ছে, কারন জানতে উন্মুখ হয়ে ওঠে দেবশ্রী। তাড়াতাড়ি একটা মাক্সি ছেড়ে, জিন্স আর শার্ট পরে হোটেলের বারে ঢোকে। রাত অনেক হয়ে গেছে, হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে এক অজানা আশঙ্কায়। বারের এক কোনায় দুই মহিলার সাথে একজন লোক বসে। অন্য কোনায় একা ধৃতিমান এক গ্লাস স্কচ নিয়ে চুপচাপ বসে। দেবশ্রীকে দেখে ধৃতিমান উঠে দাঁড়ায়। দেবশ্রী ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওই দুই চোখ কিছু বলতে চাইছে দেবশ্রীকে। সামনের সোফার উপরে দেবশ্রীকে বসতে অনুরোধ করে ধৃতিমান। টেবিলের উপরে একটা ছোটো মেয়ের হাসিখুশি ছবি।
ধৃতিমান ম্লান হেসে গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে, “আমি স্বপ্নে ভাবিনি আপনি সত্যি আসবেন।”
দেবশ্রী এইরকম ভাবে আসার কারন, নিজেই ঠিক করে জানেনা। দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে আপনার? এত রাতে আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে হটাত আমার কথা কেন মনে পড়ল?”
টেবিলের উপরে থেকে দেবশ্রী ছবিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে দেখে। হাসি হাসি মুখ, বড় মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে, মেয়েটার নাক, থুতনি ধৃতিমানের মতন। দেবশ্রীর হাতের ছবি দেখিয়ে ধৃতিমান বলে, “আপনার হাতের ছবিটা আমার একমাত্র কন্যের, মল্লিকা দেবনাথ।”
এক অজানা আশঙ্কায় দেবশ্রীর হৃদয় ধুক করে ওঠে। ধৃতিমান বলে, “দিল্লিতে ডিপিএস এ ক্লাস এইটে পড়ে। দুই বছর পরে কলেজ ফাইনাল দেবে।”
বড় একটা পাথর বুকের উপরে থেকে সরে যায়, দেবশ্রীর। ধৃতিমান বলে, “জানেন ম্যাডাম, মলির চেহারা, মলির চোখ দুটি ওর মায়ের কথা আমাকে বারেবারে মনে করিয়ে দেয়।”
দেবশ্রী একবার ভাবে ধৃতিমানের স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করবে। ধৃতিমান, “আপনি হয়ত লক্ষ্য করেছিলেন যে আমি মুম্বাই থাকাকালীন খুব চুপচাপ ছিলাম।”
দেবশ্রী মাথা নাড়ায় “হ্যাঁ, করেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করব, কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থা দেখে ঠিক জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি আর।”
ধৃতিমান, “আজকে আপনাকে একটা মনের কথা বলব, আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারিনি আমি।”
দেবশ্রী একবার ছবির দিকে তাকায়, আরেকবার ধৃতিমানের মুখের দিকে তাকায়। দেবশ্রী জিজ্ঞেস করে, “আপনার স্ত্রী কোথায়?”
ধৃতিমান চোখের কোল মুছে বলে, “সব বলছি ম্যাডাম। মুম্বাই আমার ভালোবাসার শহর, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়ার শহর। আমি মুম্বাইয়ের ছেলে, ছোটবেলা থেকে ওইখানে বড় হয়েছি, বিচে খেলেছি, গনপতি বাপ্পা মউরা করে মাথায় গনপতি নিয়ে বিসর্জন দিয়েছি। কলেজে পড়ার সময়ে এক মারাঠি সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়, তার নাম কল্পনা পাটেকর। কলেজ শেষে আমি মাস্টারস করি মার্কেটিঙে, ও ছিল একাউন্টসে। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেল, আমাদের বিয়ে হল না। একটু ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি তবে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলাম। ব্রেকআপের কারন আর কিছু না, আমি নাকি একটু ন্যাকাপনা ছেলে, আমার মধ্যে নাকি পুরুষত্ব নেই। দুইজন শেষ পর্যন্ত দুইজনের পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমান দেখতে মোটামুটি, বয়সের ভারে একটু ভুঁড়ি হয়ে গেছে দেবশ্রীর চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা কিন্তু পুরুষত্ব বিহীন একেবারে বলা চলে না। ওর কথাবার্তা ওর চালচলন আদবকায়দা বেশ রুচিসম্পন্ন। বেশি খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না দেবশ্রীর।
ধৃতিমান, “পড়াশুনা শেষে চাকরি পেলাম। বাবা আমার জন্য মেয়ে বাঙালি মেয়ে দেখলেন, তার নাম রেনুকা, বেহালায় বাড়ি। ষোলো বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে রেনুকা চাকরি করতে চায়, আমি বাধা দিলাম না। আমার স্ত্রী রেনু, বড্ড ভালো মেয়ে, খুব ভালবাসত আমাকে। পুরাতন সব ব্যাথা মন থেকে মুছে গিয়েছিল আমার। মার্কেটিঙের কাজ, মাঝে মাঝেই বাইরে থাকতাম কাজের জন্য। প্রথম দুই বছর বিশেষ কিছু পদন্নোতি ঘটল না, পরের বছর আমি বেশি করে কাজে মন দিলাম আর বাড়ির বাইরে থাকতাম। তবে যেটুকু সময়ে বাড়িতে বা মুম্বাই অফিসে থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্ত্রীর সাথে কাটাতে। রোজ অফিস ফেরত ওকে আমি ওর অফিস থেকে তুলে নিতাম, কোনদিন বিচের ধারে ঘোরা, কোনদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফেরা। মোটামুটি ভালো মন্দ মিলিয়ে সুন্দর ছিল আমাদের দুই জনের সংসার।”
“বিয়ের তিন বছর পরে ঘর আলো করে আমার লক্ষ্মীর জন্ম। মল্লিকা নাম দিলাম সেই ছোট্ট ফুটফুটে মুক্তোর বিন্দুকে। মলির জন্মের পরে পরিবার বাড়ল, কাজ বাড়ল। আমার বাড়িতে থাকা কমে গেল। রেনুকা চাকরি ছেড়ে দিল মেয়েকে দেখার জন্য। আমি বাড়ির বাইরে থাকতে লাগলাম কাজের জন্য। মাথায় ভর করল উপরে ওঠার, টাকা প্রতিপত্তি নামযশ কেনার। আমার সাথে যারা পাস করেছিল তাদের গাড়ি হয়ে গেছে, কেউ কেউ ফ্লাট কিনেছে। আমরা দুই কামরার একটা ফ্লাটে থাকতাম, ভালোবাসার ফ্লাট ছোটো হয়ে গেল আমার কাছে।”
কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে ধৃতিমানের, সেই সাথে দেবশ্রী একবার ছবিতে মল্লিকার হাসিহাসি চেহারা দেখে আর ধৃতিমানকে দেখে। ধৃতিমান, দেবশ্রীর দিকে একটা ছবি এগিয়ে দেয়। এক সুন্দরী মহিলা কোলে একটা ছোটো মেয়ে। দুইজনে কোন এক সমুদ্র সৈকতে সাগর জলের মধ্যে শুয়ে।
ধৃতিমান বলে, “আমার স্ত্রীর আর মেয়ের শেষ ফটো। ঠিক দশ বছর আগে, এক শীতের ছুটিতে আমরা গোয়া ঘুরতে যাই। সময় বিশেষ পেতাম না, তাই বেশ কয়েক দিনের ছুটি নিলাম। মলি তখন সবে আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, মাম্মা, পাপ্পা। শুনতে বড় মিষ্টি লাগত।”
দেবশ্রীর মনে পরে যায় দেবায়নের কথা, কলেজ ফাইনাল পরীক্ষার সময় পর্যন্ত খাইয়ে দিতে হত ছেলেকে। নিজে হাতে কিছুতেই খাবে না সে ছেলে। রাতের বেলা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ত দেবায়ন, কোনদিন বাড়ির কাজ সারতে একটু দেরি হয়ে গেলে কান্নাকাটি বাধিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলত। সব কাজ ছেড়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আবার রান্না ঘর পরিষ্কার, এঠো বাসন গুলো সকালের কাজের লোকের জন্য জড় করে রাখা ইত্যাদি কাজ করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরা।
ধৃতিমান বলে চলে, “ট্রেনে যেতে বলেছিল রেনুকা, আমি নতুন গাড়ি কিনেছিলাম তখন। গাড়ি করে আমরা গোয়া ঘুরতে গেলাম। পাঁচদিন খুব জমিয়ে ছুটি কাটালাম। রেনুকা সাঁতার জানে, সমুদ্রকে ভয় করে না। মেয়েকে পিঠে বেঁধে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পরে সে এক উদ্দাম খুসি। শেষদিন, গোয়ায় এক ব্যাস্ত বাজারে আমি আর রেনুকা কিছু কেনাকাটা করছিলাম, মলি আমার কোলে ছিল। রঙ্গিন চুড়ি, স্টোল ইত্যাদি দেখতে দেখতে রেনুকা এগিয়ে যায়, ভিড়ে হারিয়ে যায়। সেই সময়ে হটাত আমার চোখ পরে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার দিকে। বড় চেনা মনে হল মহিলাকে, কাছে এগিয়ে যেতেই চিনতে অসুবিধে হল না আমার পুরাতন প্রেমিকা, কল্পনাকে। আমাকে দেখে চমকে গেল কল্পনা, জিজ্ঞেস করল আমার কথা। আমি বললাম যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, কোলে মলিকে দেখিয়ে পরিচয় দিলাম আমার মেয়ে। নিজের কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখি রেনুকা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে চলে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার একটা কার্ড বের করে কল্পনার হাতে গুঁজে চলে গেলাম। রেনুকা আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাচলাম, কল্পনাকে অন্তত দেখেনি রেনুকা। দেখলে কি হত জানতাম না। হোটেলে ফিরে এলাম, বিকেলের দিকে কল্পনার ফোন এল। আমাকে বলল যে আমার সাথে মুম্বাই ফিরে দেখা করতে চায়। আমি কারন জিজ্ঞেস করাতে জানাল কিছু ব্যাক্তিগত কারনে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর বিয়ে হয়েছে কি না। উত্তরে জানায় যে স্বামীর সাথে কিছু দ্বন্দের ফলে বছর দুয়েক ধরে আলাদা থাকে। ডিভোর্স হয়নি ওদের মধ্যে। রেনুকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম অদুরে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজছে। রেনুকার হাসি মুখ আমাকে চুম্বকের মতন টেনে নিল। আমি কল্পনাকে বললাম যে মুম্বাই ফিরে ওর সাথে আমি দেখা করব। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করে উঠল পুরানো প্রেমের কাঁটা, কল্পনার কথা জানতে বড় ইচ্ছে হল। শেষ বিকেল, গোয়ায় রেনুকাকে জড়িয়ে ধরে আমরা আড়াই জনে সূর্যাস্ত দেখলাম।”
“বিকেলবেলা গোয়া থেকে রওনা দিলাম মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পাশে রেনুকা মলিকে কোলে নিয়ে বসে। মলি রেনুকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। রেনুকা মলিকে পেছনের সিটের উপরে বিছানা করে বেল্ট দিয়ে আড়াআড়ি বেঁধে দিল সিটের সাথে। আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য গল্প করতে শুরু করে রেনুকা। একটু খানি ক্লান্তি বোধ করলে বিস্কুট খাইয়ে দেয় অথবা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল মুখের কাছে ধরে। রেনুকা আমাকে বলেছিল যদি আমার গাড়ি চালাতে কষ্ট হয় তাহলে রাতে কোথায় একটা হোটেল দেখে থেকে যেতে। আমি হেসে বললাম যে ওর মতন সুন্দরী পাশে বসে থাকলে ঘুম কেন যম পর্যন্ত আমার পাশে আসতে পারবে না। গল্প করতে করতে এক সময়ে রেনুকার চোখ বুজে এল। আমি আর ওকে জাগালাম না। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে পেছন মলির দিকে তাকিয়ে দেখি, পাশে বসে রেনুকা ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম, রেনুকার দিকে ঝুঁকে ওর গায়ের সুবাস বুকে টেনে নিলাম। ভাগ্য বিধাতা সেখানেই বাধ সাধল, ওর গায়ের গন্ধে আমি পাগল হয়ে গেলাম, চোখে লাগল ঘুমের আবেশ।”
“সকাল হয় হয়, আমরা মুম্বাইয়ের খুব কাছে, ঠিক খোপোলি পেরিয়েছি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে গেল আমার, হটাত সাত বছর আগের কল্পনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি পুরানো প্রেমের স্বপ্নে ভেসে গেলাম। গাড়ি নিয়ে সোজা ধাক্কা রাস্তার পাশে একটা লাইট পোস্টে। গাড়ির সামনেটা দুমড়ে মুচরে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি, রেনুকা সামনের কাঁচ ভেঙ্গে অর্ধেক শরীর গাড়ির বাইরে, মাথাটা বনেটের উপরে। আমার পা আটকে গেছিল ব্রেক প্যাডেলে, স্টিয়ারিং বুকের বেঁধে আমাকে গেঁথে দিয়েছিল সিটের সাথে। কোনোরকমে জ্ঞান হারাবার আগে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, মলির কিছু হয়নি, সিটের সাথে বাধা থাকার ফলে শুধু মাত্র সিট থেকে নিচে পরে কান্নাকাটি করছে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হস্পিটালের বেডে শুয়ে। অফিসের লোকজন বাড়ির লোকজন সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমি চোখ খুলে রেনুকার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বলতে চায় না আমার স্ত্রীর কথা, সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যাস্ত। আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে সান্ত্বনা দেবার কারন। সবাইকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে রেনুকার নাম ধরে ডাক দিলাম, কেউ উত্তর দিল না। একদিন গেল, দুই দিন গেল, তিনদিন গেল, রেনুকার দেখা নেই। আমার থমথমে চেহারায় স্বাশুরি মলিকে কোলে নিয়ে চুপ করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। আমি আমার শালাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর দিদির কথা। শালা একটু মাথা নাড়াল, আমার মেয়েকে আমার কোলে তুলে দিল। আমি চেঁচিয়ে বললাম একবার আমি রেনুকাকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে গেল মর্গে, আমি দেখলাম আমার সুন্দরী ভালোবাসার পাত্রী রেনুকাকে। সাদা চাদরে ঢাকা, মাথায় ঘাড়ে ব্যান্ডেজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে রেনুকার কি হয়েছে। আমার শালা আমাকে জানাল যে, মাথা ভেঙ্গে প্রচুর কাঁচ মাথায় ঢুকে যাওয়ার ফলে সেই খানেই আমার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। আমি নির্বাক, আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করল এক্সিডেন্ট কি করে হল, আমি নির্বাক। রেনুকা আমাকে বারবার বলেছিল ঘুম পেলে রাতে কোথাও থেকে যেতে, আমি থাকিনি ওর কথা শুনিনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই মনে পরে যেত যে আমার ভুলের জন্য আমার মেয়ে মাতৃহীনা।”
“আমি মুম্বাইয়ের চাকরি ছেড়ে বাইরে চলে গেলাম। আমার শ্বাশুরি আমার মেয়েকে নিয়ে কোলকাতায় চলে গেল। একবছর নিজের থেকে দুরে পালিয়ে থাকলাম, দেশের বাইরে চলে গেলাম। মাঝে মাঝেই আমার মা আমার শ্বাশুরি আমাকে ফোন করত। মলির আধো আধো কথা আমাকে বড় টানত। আমি ফিরে এলাম দেশে, কিন্তু মুম্বাইয়ে আর ফিরে গেলাম না। এই দিল্লীতে চাকরি নিলাম, কিন্তু মেয়ের সামনে যাবার মতন সাহস ছিল না আমার। দুই বছর পরে আমার শ্বাশুরি আমাকে বললেন যে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করতে। আমার মা বাবা আমকে মুম্বাই ফিরে যেতে বলল, আমি রেনুকাকে ছাড়া আর মুম্বাই ফিরে যেতে পারলাম না। বড় ভালবাসত আমাকে আমার স্ত্রী, ওকে ছাড়া মুম্বাই কেন এই পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আর কোনদিন কল্পনার সাথে দেখা করিনি, যদিও কল্পনা বেশ কয়েক বার ফোন করেছিল যখন আমি হসপিটালে ছিলাম। আমি উত্তর দেই নি। তারপরে আর কোনদিন ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনি আমি। একদিন আমার মা আর আমার শ্বাশুরি মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে চলে এল। রেনুকা চলে যাওয়ার দুই বছর পরে মেয়ের মুখ দেখে কেঁদে ফেললাম, বেঁচে থাকার একটা রস খুঁজে পেলাম। সেই থেকে মেয়ে আমার কাছে। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখলেই মনে হয় আমি ওর মায়ের খুনি। সেই রাতের ঘুম, সেই রাতের আমার পুরানো হারানো প্রেমিকার স্বপ্ন আমার বাস্তবের স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে।”
দেবশ্রী স্তব্দ হয়ে যায় ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমানের হাত ধরে দেবশ্রী প্রবোধ দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে, “ধৃতিমান দশ বছর আগে যা ঘটেছিল সেটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। আপনার দোষ একটাই আপনি স্ত্রীর কথা শোনেনি। মিস্টার দেবনাথ, আপনি খুনি নন। মানুষের জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আসে, মানুষকে সেই সব ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এগিয়ে চলতে হয়। জীবন একজনের চলে যাওয়াতে থেমে যায়না, মিস্টার দেবনাথ। নিজেকে এই রকম ভাবে কষ্ট না দিয়ে নিজের জীবন খুঁজে নিন পুনরায়।”
সপ্তদশ পর্ব (#04)
ধৃতিমান সামনে দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে বলে, “অনেক চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। গত দশ বছরে অনেকের কাছে গেছি, অনেকেই আমার সাথী হয়েছে, কিন্তু কাউকে মনে ধরাতে পারলাম না।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের আচরনে। ধৃতিমানের চোখে দেবশ্রীর প্রতি প্রেমের জল দেখে দেবশ্রীর মন বিচলিত হয়ে ওঠে। দেবশ্রী শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে, “আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, খুব তাড়াতাড়ি আপনার জীবনে এক সাথী আসবে। সে মল্লিকাকেও নিজের মতন করে বুকে টেনে নেবে।”
ধৃতিমান, দেবশ্রীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, “দেবশ্রী, তোমাকে প্রথম দিন দেখেই কেন জানিনা ভালো লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল যে তুমি সেই মহিলা যে আমার মনের কষ্ট বুঝতে পারবে।”
“আপনি” থেকে “তুমি” চলে এল ধৃতিমানের ঠোঁটে, “ম্যাডাম” হয়ে গেল “দেবশ্রী”।
দেবশ্রীর সারা শরীরে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যায় ধৃতিমানের উষ্ণ হাতের পরশে। দেবশ্রী শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে, “তুমি ঘুমাতে যাও, ধৃতিমান। নিজের রুমে যাও, কাল সকালে দেখা হবে।”
ধৃতিমান, দেবশ্রীর হাত না ছাড়িয়ে বলে, “জানো দেবশ্রী, তোমার এই অসামান্য সুন্দরী মমতাময়ী রুপের টানে তোমার কাছে চলে এসেছি।”
দেবশ্রী ভেবে পায় না উত্তর, উষ্ণ হাতের পরশ আর ধৃতিমানের ব্যাথা ওকে অনেক নরম করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ধৃতিমান, তুমি নেশার ঘোরে আছো। বিশ্রাম নাও সকালে এই নিয়ে কথা বলব।”
ধৃতিমান, “এতটা মদ আমি খাইনি দেবশ্রী যে আমি কি বলছি সেটা জানি না। তোমাকে দেখে, তোমার আচরন দেখে বড় ভালো লেগেছে বলেই বলছি।”
দেবশ্রীর চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু টলমল করে ওঠে, ধরা গলায় বলে, “ধৃতিমান, কেন এই রকম আচরন করছ? তুমি আমার অতীত জানো না, আমার একটা বড় ছেলে আছে, কলেজে পরে। এই মত অবস্থায় আমি ঠিক তোমাকে…”
কি বলবে ভেবে পায় না দেবশ্রী। ধৃতিমানের কাহিনী শুনে মন গলে গেছে ঠিক কিন্তু এক নতুন বন্ধনে নিজেকে জড়াতে চায় না।
ধৃতিমান সোফা ছাড়িয়ে দেবশ্রীর হাত ধরে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। লজ্জিত দেবশ্রী মৃদু আলোয় আলোকিত বারের চারপাশে দেখে। কারুর নজর ওদের দিকে বিশেষ নেই, অন্য কোনায় যে লোকটা দুই মেয়েকে নিয়ে বসেছিল তারা নিজেদের নিয়ে অতি ব্যাস্ত। ধৃতিমানের আচরনে, হ্রদয়ের কাছে হার মেনে যায় দেবশ্রী। ধৃতিমান দেবশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি সত্যি বল, কেন তাহলে আমার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে এখানে চলে এলে? তুমি যথাযথ কারন আমাকে বল, আমি তোমাকে আর উত্যক্ত করব না।”
দেবশ্রী ধৃতিমানের টানে এখানে এসেছিল, কিন্তু সেই কথা মুখে আনতে লজ্জা বোধ করে। ঠোঁট চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “তোমার গলার আওয়াজ শুনে মনে হল তুমি খুব যন্ত্রণায় ভুগছ। আমার কাজ সবার যন্ত্রণা লাঘব করার, তাই তোমার কথা শুনতে তোমার কাছে এসেছি।”
ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ম্লান হেসে বলে, “ওঃ তাহলে এই কথা। নিজেকে এক ঋজু কঠিন চেহারা পেছনে বন্ধ করে রাখতে চাও। বেশ খুব ভালো কথা। হ্যাঁ, তোমাকে বলে কি লাভ। ঠিক আছে আমি নিজের রুমে যাচ্ছি।”
ধৃতিমান পা বাড়ায় বেড়িয়ে যাবার জন্যে। নির্বাক দেবশ্রী শত চিন্তা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সোফার ওপরে। বারের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাত বাড়ায়।
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের আচরনে, মাথা দুলিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে বলে, “তুমি কিছুতেই শুনবে না তাই না।”
ধৃতিমান হেসে বলে, “রুম পর্যন্ত একসাথে পাশাপাশি হাঁটতে আশা করি আপত্তি নেই?”
দেবশ্রী হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি সত্যি পাগল ধৃতিমান।”
লিফটে উঠে ধৃতিমান দেবশ্রীর কানেকানে বলে, “জানো দেবশ্রী, আজ তোমাকে সব কথা জানিয়ে মনে বড় শান্তি হয়েছে। দশ বছর পরে বুক টা যেন বেশ খালি খালি মনে হচ্ছে।”
দেবশ্রী হেসে বলে, “যাক তাহলে আমি কিছু কাজে আসতে পারলাম তোমার। এবারে আশা করি ভালো ঘুম আসবে।”
ধৃতিমান ম্লান হেসে বলে, “তা আসবে বৈকি।” দুইজনে চুপ।
করিডোরের এক কোনায় দেবশ্রীর কামরা, অন্য কোনায় ধৃতিমানের কামরা। করিডোর দিয়ে হাঁটার সময়ে ধৃতিমানের কামরা আগে পরে। ধৃতিমান নিজের কামরার দরজা খুলে দাঁড়ায়। দেবশ্রী এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে হাসে।
ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, “একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না ত?”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে মাথা দুলিয়ে বলে, “মনে করার মতন কথা হলে মনে করব বৈকি।”
ধৃতিমান, “রোজদিন একনয় বিজনেস সুট, না হয় শাড়ি পরো। আজকে জিন্সে দারুন দেখাচ্ছে তোমাকে, জানো।”
দেবশ্রী লাজুক হেসে বলে, “হ্যাঁ অনেক হয়েছে ধৃতিমান। এবারে রুমে ঢুকে পরো, কাল থেকে অনেক কাজ।”
ধৃতিমান, “তোমার শুধু কাজ আর কাজ, তাছাড়া কিছু জানো তুমি? নিজের জন্য কোনদিন কোন সময় রাখো তুমি?”
দেবশ্রী, “হ্যাঁ নিজের জন্য সময় আছে আমার। কি হবে তোমার জেনে সেই সময়ের কথা?”
ধৃতিমান, “বা রে, আমি নিজের কথা জানালাম, আর যে আমার কথা গুলি শুনলো তাকে একবার জানবো না?”
দেবশ্রী নিজের কামরার দিকে এগিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার কথা তোমার জেনে লাভ নেই ধৃতিমান। আমার অনেক কাজ বাকি, আমি ঘুমাতে গেলাম।”
ধৃতিমান, “ওকে গুড নাইট।”
দেবশ্রী নিজের কামরায় ঢুকে যায়। সোজা বাথরুমে ঢুকে জিন্স ছেড়ে স্লিপ গলিয়ে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। চোখে ঘুম আসে না কিছুতেই। চোখ বন্ধ করলে ধৃতিমানের মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। অভুক্ত হৃদয় আকুলিবিকুলি করে একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য, একটু ভালোবাসা, একটু প্রেম। এতদিন যাদের সাথে মিশেছিল দেবশ্রী তাদের থেকে অন্য ধরনের মানুষ, ধৃতিমান। ধৃতিমানের চোখে লিপ্সার আগুনের চেয়ে বেশি ছিল প্রেমের জল। ওর দুই গভীর চোখ, গাড় কণ্ঠস্বর কানের মধ্যে বেজে ওঠে, “তোমাকে জিন্সে আজকে দারুন দেখাচ্ছে।”
নিজের জন্য সত্যি কি সময় দিতে নেই, হৃদয়ের দোরগোড়ায় নিজে থেকে এসে কেউ কড়া নাড়ছে তাও দেবশ্রী কিসের জন্য পিছিয়ে? সায়ন্তন ওর জীবন থেকে অনেকদিন আগেই মুছে গেছে, দেবায়নের মুখ চেয়ে নিজের যৌবনের শেষ সীমানায় উপস্থিত। তৃষ্ণার্ত দেবশ্রী কাতর হয়ে পরে একটু ভালোবাসার ছোঁয়া, একটু প্রেমের পরশের আশায়। জানেনা এই সম্পর্ক ওকে কোথায় নিয়ে যাবে। দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়, চঞ্চল হয়ে ওঠে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না চঞ্চল মন। শেষ পর্যন্ত সময়ের হাতে নিজেকে সঁপে একসময়ে ঘুমের কোলে ঢলে পরে ক্লান্ত দেবশ্রী।
সকাল সকাল স্নান সেরে কাজের জন্য তৈরি হয়ে যায় দেবশ্রী। মনীষাকে ডেকে নিয়ে নিচে নেমে আসে প্রাতরাশ সারার কন্য। প্রাতরাশের টেবিলে দেখা হয় ধৃতিমানের সাথে। ধৃতিমান হেসে চেয়ার টেনে এগিয়ে দেয় দেবশ্রীর জন্য। টেবিলে সামনা সামনি বসে পরে ধৃতিমান, পাশে মনীষা।
ধৃতিমান জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঘুম হয়েছে?”
দেবশ্রী, “না হবার কারন?”
ধৃতিমান, “না তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে রাতে ঘুম হবে না।”
দেবশ্রী, “বড্ড মানুষের চেহারা পড়তে পারো দেখছি। কোথায় শিখলে এতসব?”
ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে নিচু কণ্ঠে বলে, “তোমার সাথে থেকে থেকে শিখে গেছি।”
দেবশ্রীর চোখে লাগে নতুন প্রেমের লাজুক হাসি। ঠোঁট চেপে মিষ্টি হেসে বলে, “অনেক তাড়াতাড়ি অনেক কিছু শিখে গেছ তাহলে।”
ধৃতিমান, “শিখতে আর দিলে কই। কিছু শেখানর আগেই নাকচ করে দিলে আমাকে।”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে ঠোঁট চেপে হেসে বলে, “একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, ধৃতিমান।”
ধৃতিমান, “ওকে ওকে, আর না। আর কিছু বলব না। তা আজকের প্লান কি? কয়জন আছে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য।”
দেবশ্রী মনীষাকে জিজ্ঞেস করে জানিয়ে দেয়, “তোমার জন্য দশ জন আছে।”
ধৃতিমান, “যদি তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি তাহলে সিনেমা দেখতে যাবে আমার সাথে?”
দেবশ্রী চোখ বড়বড় করে বলে, “ধৃতি, তুমি একা নও এখানে। আমাকে সবার শেষে বের হতে হয়, সবার রিপোর্ট, সবার জন্য অফার লেটার তৈরি করা। স্যালারি স্ট্রাকচার তৈরি করা, অনেক কাজ থাকে আমার। তুমি ইন্টারভিউ নিয়ে খালাস, পরের কাজ আমাকে করতে হয়। তুমি বাকিদের নিয়ে চলে যেও, আমার অনেক কাজ থাকে।”
ধৃতিমান, “প্লিস দেবশ্রী, আচ্ছা আজকে না হয় হল না। কাল পুনেতে শেষ দিন, কাল বেশি লোক থাকবে না। কাল যাওয়া যেতে পারে একটা সিনেমা দেখতে।”
দেবশ্রী, “আরে বাবা, আমি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখিনি প্রায় দশ বারো বছর হয়ে গেল। ওই সব আর পোষায় না আমার। আর কাল বিকেলে ব্যাঙ্গালরের ফ্লাইট, কাল হবেই না। তুমি একদম পাগল, ধৃতি।”
সারাদিন কেটে যায় কাজে। ইন্টারভিউয়ের পরে দেবশ্রী খুব ব্যাস্ত হয়ে পরে, সবার অফার লেটার, সালারি স্লিপ তৈরি করা। সব মিলিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করা। মিস্টার ব্রিজেশ একটা ধরা বাঁধা বাজেট ওকে দিয়েছে, সেই অনুযায়ী ওকে কাজ করতে হয়। একটা স্যালারি স্লাব আছে কিন্তু মাঝে মাঝে সেই স্যালারি স্লাব থেকে বেড়িয়ে কাজ করতে হয়। কারুর অভিজ্ঞতা বেশি, কারুর জ্ঞান বেশি। সেইসব নিয়ে আশিস, পার্থ বাকিদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়।
ধৃতিমান আলোচনায় অংশগ্রহন করে কিন্তু বারেবারে ঘড়ির দিকে তাকায়। দেবশ্রী ধৃতিমানের ইঙ্গিত বুঝেও হেসে উপেক্ষা করে। আলোচনা পর্ব শেষ হয়ে যাবার পরে ধৃতিমান দেবশ্রীকে অনুরোধ করে সিনেমা দেখার জন্য। দেবশ্রী হেসে জানিয়ে দেয় যে সিনেমা দেখতে নারাজ তবে দুইজনে একান্তে কোথাও ডিনার করতে রাজি। ধৃতিমান খুশিতে ফেটে পরে, সেই সাথে দেবশ্রীর হৃদয়ে নতুন প্রেমের সারা জেগে ওঠে। ধৃতিমান জানায় যে এমজি রোডের মোড়ে একটা ভালো চাইনিজ রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে যেতে পারে। দেবশ্রী জানায় ওর চাইনিজ খাবারে আপত্তি নেই। হোটেলে ফিরে নিজের কামরায় গিয়ে স্নান সেরে ফেলে দেবশ্রী। মনে মনে গুনগুন গান গায়, অনেক অনেক দিন পরে ওর হৃদয় বড় উৎফুল্ল। বেশি শাড়ি আনেনি, তবে একটা হালকা গোলাপি শাড়ি এনেছিল এমনি পড়ার জন্য। সেটা পরে, সাজার বিশেষ কিছু নেই। কোনদিন সাজে না দেবশ্রী, কিন্তু সেইদিন সাজতে বড় ইচ্ছে করল। কাজল, নেলপলিশ কিছুই সঙ্গে নেই দেখে নিজেই হেসে ফেলে। সাধারন সাজে সজ্জিত হয়ে ধৃতিমানের মোবাইলে ফোন করে দেবশ্রী।
ধৃতিমান হেসে উত্তর দেয়, “তোমরা মেয়েরা সাজতে বড় দেরি কর। আমি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে তোমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে।”
দেবশ্রী সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেখে ধৃতিমান দাঁড়িয়ে, জিজ্ঞেস করে, “নক করলে না কেন?”
ধৃতিমান, “বাপরে, তোমার রুমে নক করব আর ভেতর থেকে যদি দেবশ্রীর বদলে একটা আগুন ছোঁড়া ড্রাগন বেড়িয়ে আস্ত তাহলে?”
দেবশ্রী কপট অভিমান দেখিয়ে বলে, “আচ্ছা, তাহলে আমাকে ড্রাগন বলে মনে হয়েছে তোমার। তাহলে আর ড্রাগনের সাথে ডিনার করে কি হবে। কাউকে ফোনে ডেকে নাও, তার সাথে ডিনারে যাও।”
ধৃতিমান মাথা নিচু করে হেসে বলে, “ওকে বাবা মাফ করে দাও।” দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে কানেকানে বলে, “তোমার গায়ের রঙের সাথে এই গোলাপি শাড়ি দারুন মানিয়েছে। তবে কি জানো, জিন্স পড়লে আরো ভালো লাগতো।”
দেবশ্রীর মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। কামরা থেকে বেড়িয়ে এপাশ অপাশ দেখে, ওদের এক সাথে কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হতে পারে। ধৃতিমান দেবশ্রীর উদ্বেগ বুঝতে পেরে বলে, “আমি আগে হোটেল থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছি। নিচে একটা ট্যাক্সি নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি একটু পরে বের হও কেমন।”
ধৃতিমান চলে যাবার পরে দেবশ্রীর মন আষাঢ়ের ময়ুরের মতন নেচে ওঠে। অনেকদিন পরে বুকের মাঝে এক শীতল হিমেল হাওয়ার পরশ অনুভব করে মন খুশিতে ভরে যায়। দশ মিনিট যেন ওর কাছে দশ বছরের মতন মনে হয়। ধির পায়ে নিচে নেমে হোটেল থেকে বেড়িয়ে আসে। ধৃতিমান ট্যাক্সি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ট্যাক্সিতে উঠে ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত ধরে, এবারে আর দেবশ্রী নিজের হাত ছারায় না, ধৃতিমানের হাতের উষ্ণ পরশ হাতে মাখিয়ে নেয়।
ট্যাক্সির নিভৃতে ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি সত্যি আমার পাশে বসে আছো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
বিশ্বাস দেবশ্রীর নিজের হচ্ছে না, ওর পা যেন মাটিতে নেই, আকাশে উড়ছে ধৃতিমানের ছোঁয়া পেয়ে। দেবশ্রী মিষ্টি গলায় বলে, “কি করলে তোমার বিশ্বাস হবে? চিমটি কাটব নাকি?”
ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে গাল এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলে, “চিমটি খেলে মনে হয় না স্বপ্ন ভাঙ্গবে, তার চেয়ে অন্য কিছু দাও।”
দেবশ্রী লজ্জা পেয়ে যায়, হাত চেপে আলতো চাটি মেরে বলে, “ট্যাক্সির মধ্যে দুষ্টুমি করবে না একদম।”
হোটেল থেকে বেশি সময় লাগে না চাইনিজ রেস্তোরাঁ পৌঁছাতে। রেস্তোরাঁতে বসে ধৃতিমান দেবশ্রীর মুখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। দেবশ্রীর বয়স যেন কুড়ি বছর কমে যায়, ধৃতিমানের চাহনি যেন ওকে গলিয়ে দেবে। ধৃতিমান দেবশ্রীকে তার ছেলের ব্যাপারে, তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। দেবশ্রী খেতেখেতে হেসে জানায়, ওর জীবন প্রবাহ অতি সাধারন, জীবন প্রবাহে কোন চাঞ্চল্য নেই, কোন তরঙ্গ নেই। অনেক আগে রঙ ভরাতে চেয়েছিল এই সাদা কালো জীবনে কিন্তু সেটাও করে উঠতে পারল না। বর্তমানে শুধু দেবায়নকে নিয়ে চিন্তা। ওর বর্তমান পরিধি ছেলের চিন্তায় শুরু হয় আর সেখানেই শেষ। সেই সাথে জানায় অনুপমার কথা। সব শুনে ধৃতিমান হেসে বলে যে দেবশ্রী বেশ আধুনিক মানসিকতা নয়ে থাকে। দেবশ্রী বলে, মানসিকতা আধুনিক নয়, মানসিকতা সময়ের সাথে একটু উদার করে নিয়েছে। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের নিজেদের কিছু গন্ডি চলে আসে। সেই গন্ডি টুকু ছেলে মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।
ডিনারের পরে ওরা হোটেলে ফিরে আসে একসাথে। দ্বিধাবোধ জড়তা অনেক কমে যায় দেবশ্রীর মধ্যে, ধৃতিমানের পাশে হাঁটতে ওর আর খারাপ লাগে না। হোটেলে ঢুকতেই পার্থের সাথে দেখা, পার্থ জিজ্ঞেস করাতে দেবশ্রী উত্তর দেয় যে ডিনারে বেড়িয়েছিল একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁতে। লিফটে চেপে নিজেদের তলায় এসে ধৃতিমান নিজের কামরার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে।
দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “কিছু বলবে?”
ধৃতিমান, “না মানে, কিছু না। আমি ভেবেছিলাম তুমি একা, আমি একা একটু গল্প করলে কেমন হত।”
ধৃতিমানের চোখের ভাষা পড়ে নেয় দেবশ্রী, ঠোঁটে লাজুক হাসি মাখিয়ে বলে, “গুড নাইট ধৃতিমান, কাল গল্প করব। এখানের কাজের পরে কাল ব্যাঙ্গালোর যাবার আছে, আমার ব্যাগ গোছান বাকি।”
ধৃতিমান দুই পা দেবশ্রীর দিকে এগিয়ে আসে, দেবশ্রীর বুকের মাঝে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তুলে নেয়। দেবশ্রী শ্বাস বন্ধ করে ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুই পায়ে কেউ যেন পেরেক দিয়ে মেঝের সাথে গেঁথে দিয়েছে। সামনে পা বাড়াতে অক্ষম পিছিয়ে যেতে অক্ষম। ধৃতিমানের জ্বলন্ত চোখের ভাষা দেবশ্রীকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
ধৃতিমানের আব্দার শুনে প্রথমে রাগ হয় দেবশ্রীর। এতরাতে এইরকম এক আব্দার, চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সংযত কণ্ঠে জবাব দেয় দেবশ্রী, “অনেক রাত হয়ে গেছে, আপনি ড্রিঙ্ক করেছেন। তাড়াতাড়ি শুতে যান, কাল সকালে আমাদের অনেক কাজ আছে।”
ধৃতিমান, “আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, একটা ছোটো পেগ নেব, আমি একটা ছোটো পেগ নিয়েছি, বেশি খাইনি।”
দেবশ্রী, “ভালো, শুনে খুশি হলাম যে আপনি আমার কথা রেখেছেন।”
ধৃতিমান, “আপনার কণ্ঠ স্বর বড় মধুর ম্যাডাম, আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।”
দেবশ্রীর ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ, বলুন কি বলতে চান।”
ধৃতিমানের গলা হটাত ধরে আসে, “অনেক দিন কারুর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারিনি, তাই আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। বুকে বড় পাপবোধ জেগে উঠেছে, ম্যাডাম। সেই বেদনা ঢাকতে আমি ড্রিঙ্ক নিয়ে বসেছিলাম, আর আপনার কথা মনে পরে গেল।”
কথাটা শুনে দেবশ্রীর সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই অশ্রু সিক্ত কণ্ঠের পেছনের ধৃতিমানকে জানার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। দেবশ্রী জিজ্ঞেস করে, “আপনার কি হয়েছে?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় ধৃতিমান, “বড় কষ্ট, আমি বড় অপরাধী, ম্যাডাম।”
ধৃতিমানের কণ্ঠ স্বর শুনে দেবশ্রী বিচলিত হয়ে ওঠে, “সত্যি বলুনত আপনার কি হয়েছে? আপনি কোথায়?”
ধৃতিমান, “আমি বারে বসে আছি। একটা পেগ নিয়েছি, কিন্তু কিছুতেই শেষ করতে পারছি না।”
ধৃতিমানের গলার স্বরে বেদনা। বহু মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছে দেবশ্রী, কার কণ্ঠস্বর কি বলতে চাইছে সেটা ভালো ভাবেই জানে। ধৃতিমানের কণ্ঠে পাপবোধ ছলকে পড়ছে, কারন জানতে উন্মুখ হয়ে ওঠে দেবশ্রী। তাড়াতাড়ি একটা মাক্সি ছেড়ে, জিন্স আর শার্ট পরে হোটেলের বারে ঢোকে। রাত অনেক হয়ে গেছে, হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে এক অজানা আশঙ্কায়। বারের এক কোনায় দুই মহিলার সাথে একজন লোক বসে। অন্য কোনায় একা ধৃতিমান এক গ্লাস স্কচ নিয়ে চুপচাপ বসে। দেবশ্রীকে দেখে ধৃতিমান উঠে দাঁড়ায়। দেবশ্রী ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওই দুই চোখ কিছু বলতে চাইছে দেবশ্রীকে। সামনের সোফার উপরে দেবশ্রীকে বসতে অনুরোধ করে ধৃতিমান। টেবিলের উপরে একটা ছোটো মেয়ের হাসিখুশি ছবি।
ধৃতিমান ম্লান হেসে গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলে, “আমি স্বপ্নে ভাবিনি আপনি সত্যি আসবেন।”
দেবশ্রী এইরকম ভাবে আসার কারন, নিজেই ঠিক করে জানেনা। দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে আপনার? এত রাতে আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে হটাত আমার কথা কেন মনে পড়ল?”
টেবিলের উপরে থেকে দেবশ্রী ছবিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে দেখে। হাসি হাসি মুখ, বড় মিষ্টি দেখতে মেয়েটাকে, মেয়েটার নাক, থুতনি ধৃতিমানের মতন। দেবশ্রীর হাতের ছবি দেখিয়ে ধৃতিমান বলে, “আপনার হাতের ছবিটা আমার একমাত্র কন্যের, মল্লিকা দেবনাথ।”
এক অজানা আশঙ্কায় দেবশ্রীর হৃদয় ধুক করে ওঠে। ধৃতিমান বলে, “দিল্লিতে ডিপিএস এ ক্লাস এইটে পড়ে। দুই বছর পরে কলেজ ফাইনাল দেবে।”
বড় একটা পাথর বুকের উপরে থেকে সরে যায়, দেবশ্রীর। ধৃতিমান বলে, “জানেন ম্যাডাম, মলির চেহারা, মলির চোখ দুটি ওর মায়ের কথা আমাকে বারেবারে মনে করিয়ে দেয়।”
দেবশ্রী একবার ভাবে ধৃতিমানের স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করবে। ধৃতিমান, “আপনি হয়ত লক্ষ্য করেছিলেন যে আমি মুম্বাই থাকাকালীন খুব চুপচাপ ছিলাম।”
দেবশ্রী মাথা নাড়ায় “হ্যাঁ, করেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করব, কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থা দেখে ঠিক জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি আর।”
ধৃতিমান, “আজকে আপনাকে একটা মনের কথা বলব, আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে পারিনি আমি।”
দেবশ্রী একবার ছবির দিকে তাকায়, আরেকবার ধৃতিমানের মুখের দিকে তাকায়। দেবশ্রী জিজ্ঞেস করে, “আপনার স্ত্রী কোথায়?”
ধৃতিমান চোখের কোল মুছে বলে, “সব বলছি ম্যাডাম। মুম্বাই আমার ভালোবাসার শহর, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়ার শহর। আমি মুম্বাইয়ের ছেলে, ছোটবেলা থেকে ওইখানে বড় হয়েছি, বিচে খেলেছি, গনপতি বাপ্পা মউরা করে মাথায় গনপতি নিয়ে বিসর্জন দিয়েছি। কলেজে পড়ার সময়ে এক মারাঠি সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার দেখা হয়, তার নাম কল্পনা পাটেকর। কলেজ শেষে আমি মাস্টারস করি মার্কেটিঙে, ও ছিল একাউন্টসে। আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গেল, আমাদের বিয়ে হল না। একটু ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি তবে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলাম। ব্রেকআপের কারন আর কিছু না, আমি নাকি একটু ন্যাকাপনা ছেলে, আমার মধ্যে নাকি পুরুষত্ব নেই। দুইজন শেষ পর্যন্ত দুইজনের পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমান দেখতে মোটামুটি, বয়সের ভারে একটু ভুঁড়ি হয়ে গেছে দেবশ্রীর চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা কিন্তু পুরুষত্ব বিহীন একেবারে বলা চলে না। ওর কথাবার্তা ওর চালচলন আদবকায়দা বেশ রুচিসম্পন্ন। বেশি খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না দেবশ্রীর।
ধৃতিমান, “পড়াশুনা শেষে চাকরি পেলাম। বাবা আমার জন্য মেয়ে বাঙালি মেয়ে দেখলেন, তার নাম রেনুকা, বেহালায় বাড়ি। ষোলো বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে রেনুকা চাকরি করতে চায়, আমি বাধা দিলাম না। আমার স্ত্রী রেনু, বড্ড ভালো মেয়ে, খুব ভালবাসত আমাকে। পুরাতন সব ব্যাথা মন থেকে মুছে গিয়েছিল আমার। মার্কেটিঙের কাজ, মাঝে মাঝেই বাইরে থাকতাম কাজের জন্য। প্রথম দুই বছর বিশেষ কিছু পদন্নোতি ঘটল না, পরের বছর আমি বেশি করে কাজে মন দিলাম আর বাড়ির বাইরে থাকতাম। তবে যেটুকু সময়ে বাড়িতে বা মুম্বাই অফিসে থাকতাম, চেষ্টা করতাম স্ত্রীর সাথে কাটাতে। রোজ অফিস ফেরত ওকে আমি ওর অফিস থেকে তুলে নিতাম, কোনদিন বিচের ধারে ঘোরা, কোনদিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফেরা। মোটামুটি ভালো মন্দ মিলিয়ে সুন্দর ছিল আমাদের দুই জনের সংসার।”
“বিয়ের তিন বছর পরে ঘর আলো করে আমার লক্ষ্মীর জন্ম। মল্লিকা নাম দিলাম সেই ছোট্ট ফুটফুটে মুক্তোর বিন্দুকে। মলির জন্মের পরে পরিবার বাড়ল, কাজ বাড়ল। আমার বাড়িতে থাকা কমে গেল। রেনুকা চাকরি ছেড়ে দিল মেয়েকে দেখার জন্য। আমি বাড়ির বাইরে থাকতে লাগলাম কাজের জন্য। মাথায় ভর করল উপরে ওঠার, টাকা প্রতিপত্তি নামযশ কেনার। আমার সাথে যারা পাস করেছিল তাদের গাড়ি হয়ে গেছে, কেউ কেউ ফ্লাট কিনেছে। আমরা দুই কামরার একটা ফ্লাটে থাকতাম, ভালোবাসার ফ্লাট ছোটো হয়ে গেল আমার কাছে।”
কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে ধৃতিমানের, সেই সাথে দেবশ্রী একবার ছবিতে মল্লিকার হাসিহাসি চেহারা দেখে আর ধৃতিমানকে দেখে। ধৃতিমান, দেবশ্রীর দিকে একটা ছবি এগিয়ে দেয়। এক সুন্দরী মহিলা কোলে একটা ছোটো মেয়ে। দুইজনে কোন এক সমুদ্র সৈকতে সাগর জলের মধ্যে শুয়ে।
ধৃতিমান বলে, “আমার স্ত্রীর আর মেয়ের শেষ ফটো। ঠিক দশ বছর আগে, এক শীতের ছুটিতে আমরা গোয়া ঘুরতে যাই। সময় বিশেষ পেতাম না, তাই বেশ কয়েক দিনের ছুটি নিলাম। মলি তখন সবে আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, মাম্মা, পাপ্পা। শুনতে বড় মিষ্টি লাগত।”
দেবশ্রীর মনে পরে যায় দেবায়নের কথা, কলেজ ফাইনাল পরীক্ষার সময় পর্যন্ত খাইয়ে দিতে হত ছেলেকে। নিজে হাতে কিছুতেই খাবে না সে ছেলে। রাতের বেলা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ত দেবায়ন, কোনদিন বাড়ির কাজ সারতে একটু দেরি হয়ে গেলে কান্নাকাটি বাধিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলত। সব কাজ ছেড়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আবার রান্না ঘর পরিষ্কার, এঠো বাসন গুলো সকালের কাজের লোকের জন্য জড় করে রাখা ইত্যাদি কাজ করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরা।
ধৃতিমান বলে চলে, “ট্রেনে যেতে বলেছিল রেনুকা, আমি নতুন গাড়ি কিনেছিলাম তখন। গাড়ি করে আমরা গোয়া ঘুরতে গেলাম। পাঁচদিন খুব জমিয়ে ছুটি কাটালাম। রেনুকা সাঁতার জানে, সমুদ্রকে ভয় করে না। মেয়েকে পিঠে বেঁধে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পরে সে এক উদ্দাম খুসি। শেষদিন, গোয়ায় এক ব্যাস্ত বাজারে আমি আর রেনুকা কিছু কেনাকাটা করছিলাম, মলি আমার কোলে ছিল। রঙ্গিন চুড়ি, স্টোল ইত্যাদি দেখতে দেখতে রেনুকা এগিয়ে যায়, ভিড়ে হারিয়ে যায়। সেই সময়ে হটাত আমার চোখ পরে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার দিকে। বড় চেনা মনে হল মহিলাকে, কাছে এগিয়ে যেতেই চিনতে অসুবিধে হল না আমার পুরাতন প্রেমিকা, কল্পনাকে। আমাকে দেখে চমকে গেল কল্পনা, জিজ্ঞেস করল আমার কথা। আমি বললাম যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, কোলে মলিকে দেখিয়ে পরিচয় দিলাম আমার মেয়ে। নিজের কথা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখি রেনুকা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে চলে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার একটা কার্ড বের করে কল্পনার হাতে গুঁজে চলে গেলাম। রেনুকা আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাচলাম, কল্পনাকে অন্তত দেখেনি রেনুকা। দেখলে কি হত জানতাম না। হোটেলে ফিরে এলাম, বিকেলের দিকে কল্পনার ফোন এল। আমাকে বলল যে আমার সাথে মুম্বাই ফিরে দেখা করতে চায়। আমি কারন জিজ্ঞেস করাতে জানাল কিছু ব্যাক্তিগত কারনে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর বিয়ে হয়েছে কি না। উত্তরে জানায় যে স্বামীর সাথে কিছু দ্বন্দের ফলে বছর দুয়েক ধরে আলাদা থাকে। ডিভোর্স হয়নি ওদের মধ্যে। রেনুকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম অদুরে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজছে। রেনুকার হাসি মুখ আমাকে চুম্বকের মতন টেনে নিল। আমি কল্পনাকে বললাম যে মুম্বাই ফিরে ওর সাথে আমি দেখা করব। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করে উঠল পুরানো প্রেমের কাঁটা, কল্পনার কথা জানতে বড় ইচ্ছে হল। শেষ বিকেল, গোয়ায় রেনুকাকে জড়িয়ে ধরে আমরা আড়াই জনে সূর্যাস্ত দেখলাম।”
“বিকেলবেলা গোয়া থেকে রওনা দিলাম মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে। আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পাশে রেনুকা মলিকে কোলে নিয়ে বসে। মলি রেনুকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। রেনুকা মলিকে পেছনের সিটের উপরে বিছানা করে বেল্ট দিয়ে আড়াআড়ি বেঁধে দিল সিটের সাথে। আমাকে জাগিয়ে রাখার জন্য গল্প করতে শুরু করে রেনুকা। একটু খানি ক্লান্তি বোধ করলে বিস্কুট খাইয়ে দেয় অথবা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল মুখের কাছে ধরে। রেনুকা আমাকে বলেছিল যদি আমার গাড়ি চালাতে কষ্ট হয় তাহলে রাতে কোথায় একটা হোটেল দেখে থেকে যেতে। আমি হেসে বললাম যে ওর মতন সুন্দরী পাশে বসে থাকলে ঘুম কেন যম পর্যন্ত আমার পাশে আসতে পারবে না। গল্প করতে করতে এক সময়ে রেনুকার চোখ বুজে এল। আমি আর ওকে জাগালাম না। গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে পেছন মলির দিকে তাকিয়ে দেখি, পাশে বসে রেনুকা ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম, রেনুকার দিকে ঝুঁকে ওর গায়ের সুবাস বুকে টেনে নিলাম। ভাগ্য বিধাতা সেখানেই বাধ সাধল, ওর গায়ের গন্ধে আমি পাগল হয়ে গেলাম, চোখে লাগল ঘুমের আবেশ।”
“সকাল হয় হয়, আমরা মুম্বাইয়ের খুব কাছে, ঠিক খোপোলি পেরিয়েছি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে গেল আমার, হটাত সাত বছর আগের কল্পনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি পুরানো প্রেমের স্বপ্নে ভেসে গেলাম। গাড়ি নিয়ে সোজা ধাক্কা রাস্তার পাশে একটা লাইট পোস্টে। গাড়ির সামনেটা দুমড়ে মুচরে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি, রেনুকা সামনের কাঁচ ভেঙ্গে অর্ধেক শরীর গাড়ির বাইরে, মাথাটা বনেটের উপরে। আমার পা আটকে গেছিল ব্রেক প্যাডেলে, স্টিয়ারিং বুকের বেঁধে আমাকে গেঁথে দিয়েছিল সিটের সাথে। কোনোরকমে জ্ঞান হারাবার আগে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, মলির কিছু হয়নি, সিটের সাথে বাধা থাকার ফলে শুধু মাত্র সিট থেকে নিচে পরে কান্নাকাটি করছে। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হস্পিটালের বেডে শুয়ে। অফিসের লোকজন বাড়ির লোকজন সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমি চোখ খুলে রেনুকার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কেউ বলতে চায় না আমার স্ত্রীর কথা, সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যাস্ত। আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে সান্ত্বনা দেবার কারন। সবাইকে ছাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে রেনুকার নাম ধরে ডাক দিলাম, কেউ উত্তর দিল না। একদিন গেল, দুই দিন গেল, তিনদিন গেল, রেনুকার দেখা নেই। আমার থমথমে চেহারায় স্বাশুরি মলিকে কোলে নিয়ে চুপ করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। আমি আমার শালাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর দিদির কথা। শালা একটু মাথা নাড়াল, আমার মেয়েকে আমার কোলে তুলে দিল। আমি চেঁচিয়ে বললাম একবার আমি রেনুকাকে দেখতে চাই। আমাকে নিয়ে গেল মর্গে, আমি দেখলাম আমার সুন্দরী ভালোবাসার পাত্রী রেনুকাকে। সাদা চাদরে ঢাকা, মাথায় ঘাড়ে ব্যান্ডেজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে রেনুকার কি হয়েছে। আমার শালা আমাকে জানাল যে, মাথা ভেঙ্গে প্রচুর কাঁচ মাথায় ঢুকে যাওয়ার ফলে সেই খানেই আমার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। আমি নির্বাক, আমি স্তব্দ হয়ে গেলাম। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করল এক্সিডেন্ট কি করে হল, আমি নির্বাক। রেনুকা আমাকে বারবার বলেছিল ঘুম পেলে রাতে কোথাও থেকে যেতে, আমি থাকিনি ওর কথা শুনিনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই মনে পরে যেত যে আমার ভুলের জন্য আমার মেয়ে মাতৃহীনা।”
“আমি মুম্বাইয়ের চাকরি ছেড়ে বাইরে চলে গেলাম। আমার শ্বাশুরি আমার মেয়েকে নিয়ে কোলকাতায় চলে গেল। একবছর নিজের থেকে দুরে পালিয়ে থাকলাম, দেশের বাইরে চলে গেলাম। মাঝে মাঝেই আমার মা আমার শ্বাশুরি আমাকে ফোন করত। মলির আধো আধো কথা আমাকে বড় টানত। আমি ফিরে এলাম দেশে, কিন্তু মুম্বাইয়ে আর ফিরে গেলাম না। এই দিল্লীতে চাকরি নিলাম, কিন্তু মেয়ের সামনে যাবার মতন সাহস ছিল না আমার। দুই বছর পরে আমার শ্বাশুরি আমাকে বললেন যে মেয়েকে কলেজে ভর্তি করতে। আমার মা বাবা আমকে মুম্বাই ফিরে যেতে বলল, আমি রেনুকাকে ছাড়া আর মুম্বাই ফিরে যেতে পারলাম না। বড় ভালবাসত আমাকে আমার স্ত্রী, ওকে ছাড়া মুম্বাই কেন এই পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি আর কোনদিন কল্পনার সাথে দেখা করিনি, যদিও কল্পনা বেশ কয়েক বার ফোন করেছিল যখন আমি হসপিটালে ছিলাম। আমি উত্তর দেই নি। তারপরে আর কোনদিন ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনি আমি। একদিন আমার মা আর আমার শ্বাশুরি মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে চলে এল। রেনুকা চলে যাওয়ার দুই বছর পরে মেয়ের মুখ দেখে কেঁদে ফেললাম, বেঁচে থাকার একটা রস খুঁজে পেলাম। সেই থেকে মেয়ে আমার কাছে। কিন্তু মেয়ের মুখ দেখলেই মনে হয় আমি ওর মায়ের খুনি। সেই রাতের ঘুম, সেই রাতের আমার পুরানো হারানো প্রেমিকার স্বপ্ন আমার বাস্তবের স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে।”
দেবশ্রী স্তব্দ হয়ে যায় ধৃতিমানের কথা শুনে। ধৃতিমানের হাত ধরে দেবশ্রী প্রবোধ দিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে, “ধৃতিমান দশ বছর আগে যা ঘটেছিল সেটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। আপনার দোষ একটাই আপনি স্ত্রীর কথা শোনেনি। মিস্টার দেবনাথ, আপনি খুনি নন। মানুষের জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত আসে, মানুষকে সেই সব ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এগিয়ে চলতে হয়। জীবন একজনের চলে যাওয়াতে থেমে যায়না, মিস্টার দেবনাথ। নিজেকে এই রকম ভাবে কষ্ট না দিয়ে নিজের জীবন খুঁজে নিন পুনরায়।”
সপ্তদশ পর্ব (#04)
ধৃতিমান সামনে দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে বলে, “অনেক চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। গত দশ বছরে অনেকের কাছে গেছি, অনেকেই আমার সাথী হয়েছে, কিন্তু কাউকে মনে ধরাতে পারলাম না।”
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের আচরনে। ধৃতিমানের চোখে দেবশ্রীর প্রতি প্রেমের জল দেখে দেবশ্রীর মন বিচলিত হয়ে ওঠে। দেবশ্রী শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে, “আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, খুব তাড়াতাড়ি আপনার জীবনে এক সাথী আসবে। সে মল্লিকাকেও নিজের মতন করে বুকে টেনে নেবে।”
ধৃতিমান, দেবশ্রীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, “দেবশ্রী, তোমাকে প্রথম দিন দেখেই কেন জানিনা ভালো লেগে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল যে তুমি সেই মহিলা যে আমার মনের কষ্ট বুঝতে পারবে।”
“আপনি” থেকে “তুমি” চলে এল ধৃতিমানের ঠোঁটে, “ম্যাডাম” হয়ে গেল “দেবশ্রী”।
দেবশ্রীর সারা শরীরে এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যায় ধৃতিমানের উষ্ণ হাতের পরশে। দেবশ্রী শান্ত শীতল কণ্ঠে বলে, “তুমি ঘুমাতে যাও, ধৃতিমান। নিজের রুমে যাও, কাল সকালে দেখা হবে।”
ধৃতিমান, দেবশ্রীর হাত না ছাড়িয়ে বলে, “জানো দেবশ্রী, তোমার এই অসামান্য সুন্দরী মমতাময়ী রুপের টানে তোমার কাছে চলে এসেছি।”
দেবশ্রী ভেবে পায় না উত্তর, উষ্ণ হাতের পরশ আর ধৃতিমানের ব্যাথা ওকে অনেক নরম করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ধৃতিমান, তুমি নেশার ঘোরে আছো। বিশ্রাম নাও সকালে এই নিয়ে কথা বলব।”
ধৃতিমান, “এতটা মদ আমি খাইনি দেবশ্রী যে আমি কি বলছি সেটা জানি না। তোমাকে দেখে, তোমার আচরন দেখে বড় ভালো লেগেছে বলেই বলছি।”
দেবশ্রীর চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু টলমল করে ওঠে, ধরা গলায় বলে, “ধৃতিমান, কেন এই রকম আচরন করছ? তুমি আমার অতীত জানো না, আমার একটা বড় ছেলে আছে, কলেজে পরে। এই মত অবস্থায় আমি ঠিক তোমাকে…”
কি বলবে ভেবে পায় না দেবশ্রী। ধৃতিমানের কাহিনী শুনে মন গলে গেছে ঠিক কিন্তু এক নতুন বন্ধনে নিজেকে জড়াতে চায় না।
ধৃতিমান সোফা ছাড়িয়ে দেবশ্রীর হাত ধরে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে। লজ্জিত দেবশ্রী মৃদু আলোয় আলোকিত বারের চারপাশে দেখে। কারুর নজর ওদের দিকে বিশেষ নেই, অন্য কোনায় যে লোকটা দুই মেয়েকে নিয়ে বসেছিল তারা নিজেদের নিয়ে অতি ব্যাস্ত। ধৃতিমানের আচরনে, হ্রদয়ের কাছে হার মেনে যায় দেবশ্রী। ধৃতিমান দেবশ্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি সত্যি বল, কেন তাহলে আমার ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি করে এখানে চলে এলে? তুমি যথাযথ কারন আমাকে বল, আমি তোমাকে আর উত্যক্ত করব না।”
দেবশ্রী ধৃতিমানের টানে এখানে এসেছিল, কিন্তু সেই কথা মুখে আনতে লজ্জা বোধ করে। ঠোঁট চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “তোমার গলার আওয়াজ শুনে মনে হল তুমি খুব যন্ত্রণায় ভুগছ। আমার কাজ সবার যন্ত্রণা লাঘব করার, তাই তোমার কথা শুনতে তোমার কাছে এসেছি।”
ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ম্লান হেসে বলে, “ওঃ তাহলে এই কথা। নিজেকে এক ঋজু কঠিন চেহারা পেছনে বন্ধ করে রাখতে চাও। বেশ খুব ভালো কথা। হ্যাঁ, তোমাকে বলে কি লাভ। ঠিক আছে আমি নিজের রুমে যাচ্ছি।”
ধৃতিমান পা বাড়ায় বেড়িয়ে যাবার জন্যে। নির্বাক দেবশ্রী শত চিন্তা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সোফার ওপরে। বারের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাত বাড়ায়।
দেবশ্রী হেসে ফেলে ধৃতিমানের আচরনে, মাথা দুলিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে বলে, “তুমি কিছুতেই শুনবে না তাই না।”
ধৃতিমান হেসে বলে, “রুম পর্যন্ত একসাথে পাশাপাশি হাঁটতে আশা করি আপত্তি নেই?”
দেবশ্রী হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি সত্যি পাগল ধৃতিমান।”
লিফটে উঠে ধৃতিমান দেবশ্রীর কানেকানে বলে, “জানো দেবশ্রী, আজ তোমাকে সব কথা জানিয়ে মনে বড় শান্তি হয়েছে। দশ বছর পরে বুক টা যেন বেশ খালি খালি মনে হচ্ছে।”
দেবশ্রী হেসে বলে, “যাক তাহলে আমি কিছু কাজে আসতে পারলাম তোমার। এবারে আশা করি ভালো ঘুম আসবে।”
ধৃতিমান ম্লান হেসে বলে, “তা আসবে বৈকি।” দুইজনে চুপ।
করিডোরের এক কোনায় দেবশ্রীর কামরা, অন্য কোনায় ধৃতিমানের কামরা। করিডোর দিয়ে হাঁটার সময়ে ধৃতিমানের কামরা আগে পরে। ধৃতিমান নিজের কামরার দরজা খুলে দাঁড়ায়। দেবশ্রী এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে হাসে।
ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, “একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না ত?”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে মাথা দুলিয়ে বলে, “মনে করার মতন কথা হলে মনে করব বৈকি।”
ধৃতিমান, “রোজদিন একনয় বিজনেস সুট, না হয় শাড়ি পরো। আজকে জিন্সে দারুন দেখাচ্ছে তোমাকে, জানো।”
দেবশ্রী লাজুক হেসে বলে, “হ্যাঁ অনেক হয়েছে ধৃতিমান। এবারে রুমে ঢুকে পরো, কাল থেকে অনেক কাজ।”
ধৃতিমান, “তোমার শুধু কাজ আর কাজ, তাছাড়া কিছু জানো তুমি? নিজের জন্য কোনদিন কোন সময় রাখো তুমি?”
দেবশ্রী, “হ্যাঁ নিজের জন্য সময় আছে আমার। কি হবে তোমার জেনে সেই সময়ের কথা?”
ধৃতিমান, “বা রে, আমি নিজের কথা জানালাম, আর যে আমার কথা গুলি শুনলো তাকে একবার জানবো না?”
দেবশ্রী নিজের কামরার দিকে এগিয়ে নিজের রুমের দরজা খুলে ধৃতিমানের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার কথা তোমার জেনে লাভ নেই ধৃতিমান। আমার অনেক কাজ বাকি, আমি ঘুমাতে গেলাম।”
ধৃতিমান, “ওকে গুড নাইট।”
দেবশ্রী নিজের কামরায় ঢুকে যায়। সোজা বাথরুমে ঢুকে জিন্স ছেড়ে স্লিপ গলিয়ে আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পরে। চোখে ঘুম আসে না কিছুতেই। চোখ বন্ধ করলে ধৃতিমানের মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। অভুক্ত হৃদয় আকুলিবিকুলি করে একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য, একটু ভালোবাসা, একটু প্রেম। এতদিন যাদের সাথে মিশেছিল দেবশ্রী তাদের থেকে অন্য ধরনের মানুষ, ধৃতিমান। ধৃতিমানের চোখে লিপ্সার আগুনের চেয়ে বেশি ছিল প্রেমের জল। ওর দুই গভীর চোখ, গাড় কণ্ঠস্বর কানের মধ্যে বেজে ওঠে, “তোমাকে জিন্সে আজকে দারুন দেখাচ্ছে।”
নিজের জন্য সত্যি কি সময় দিতে নেই, হৃদয়ের দোরগোড়ায় নিজে থেকে এসে কেউ কড়া নাড়ছে তাও দেবশ্রী কিসের জন্য পিছিয়ে? সায়ন্তন ওর জীবন থেকে অনেকদিন আগেই মুছে গেছে, দেবায়নের মুখ চেয়ে নিজের যৌবনের শেষ সীমানায় উপস্থিত। তৃষ্ণার্ত দেবশ্রী কাতর হয়ে পরে একটু ভালোবাসার ছোঁয়া, একটু প্রেমের পরশের আশায়। জানেনা এই সম্পর্ক ওকে কোথায় নিয়ে যাবে। দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়, চঞ্চল হয়ে ওঠে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না চঞ্চল মন। শেষ পর্যন্ত সময়ের হাতে নিজেকে সঁপে একসময়ে ঘুমের কোলে ঢলে পরে ক্লান্ত দেবশ্রী।
সকাল সকাল স্নান সেরে কাজের জন্য তৈরি হয়ে যায় দেবশ্রী। মনীষাকে ডেকে নিয়ে নিচে নেমে আসে প্রাতরাশ সারার কন্য। প্রাতরাশের টেবিলে দেখা হয় ধৃতিমানের সাথে। ধৃতিমান হেসে চেয়ার টেনে এগিয়ে দেয় দেবশ্রীর জন্য। টেবিলে সামনা সামনি বসে পরে ধৃতিমান, পাশে মনীষা।
ধৃতিমান জিজ্ঞেস করে, “রাতে ঘুম হয়েছে?”
দেবশ্রী, “না হবার কারন?”
ধৃতিমান, “না তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যে রাতে ঘুম হবে না।”
দেবশ্রী, “বড্ড মানুষের চেহারা পড়তে পারো দেখছি। কোথায় শিখলে এতসব?”
ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে নিচু কণ্ঠে বলে, “তোমার সাথে থেকে থেকে শিখে গেছি।”
দেবশ্রীর চোখে লাগে নতুন প্রেমের লাজুক হাসি। ঠোঁট চেপে মিষ্টি হেসে বলে, “অনেক তাড়াতাড়ি অনেক কিছু শিখে গেছ তাহলে।”
ধৃতিমান, “শিখতে আর দিলে কই। কিছু শেখানর আগেই নাকচ করে দিলে আমাকে।”
দেবশ্রী ভুরু কুঁচকে ঠোঁট চেপে হেসে বলে, “একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, ধৃতিমান।”
ধৃতিমান, “ওকে ওকে, আর না। আর কিছু বলব না। তা আজকের প্লান কি? কয়জন আছে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য।”
দেবশ্রী মনীষাকে জিজ্ঞেস করে জানিয়ে দেয়, “তোমার জন্য দশ জন আছে।”
ধৃতিমান, “যদি তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি তাহলে সিনেমা দেখতে যাবে আমার সাথে?”
দেবশ্রী চোখ বড়বড় করে বলে, “ধৃতি, তুমি একা নও এখানে। আমাকে সবার শেষে বের হতে হয়, সবার রিপোর্ট, সবার জন্য অফার লেটার তৈরি করা। স্যালারি স্ট্রাকচার তৈরি করা, অনেক কাজ থাকে আমার। তুমি ইন্টারভিউ নিয়ে খালাস, পরের কাজ আমাকে করতে হয়। তুমি বাকিদের নিয়ে চলে যেও, আমার অনেক কাজ থাকে।”
ধৃতিমান, “প্লিস দেবশ্রী, আচ্ছা আজকে না হয় হল না। কাল পুনেতে শেষ দিন, কাল বেশি লোক থাকবে না। কাল যাওয়া যেতে পারে একটা সিনেমা দেখতে।”
দেবশ্রী, “আরে বাবা, আমি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখিনি প্রায় দশ বারো বছর হয়ে গেল। ওই সব আর পোষায় না আমার। আর কাল বিকেলে ব্যাঙ্গালরের ফ্লাইট, কাল হবেই না। তুমি একদম পাগল, ধৃতি।”
সারাদিন কেটে যায় কাজে। ইন্টারভিউয়ের পরে দেবশ্রী খুব ব্যাস্ত হয়ে পরে, সবার অফার লেটার, সালারি স্লিপ তৈরি করা। সব মিলিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করা। মিস্টার ব্রিজেশ একটা ধরা বাঁধা বাজেট ওকে দিয়েছে, সেই অনুযায়ী ওকে কাজ করতে হয়। একটা স্যালারি স্লাব আছে কিন্তু মাঝে মাঝে সেই স্যালারি স্লাব থেকে বেড়িয়ে কাজ করতে হয়। কারুর অভিজ্ঞতা বেশি, কারুর জ্ঞান বেশি। সেইসব নিয়ে আশিস, পার্থ বাকিদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়।
ধৃতিমান আলোচনায় অংশগ্রহন করে কিন্তু বারেবারে ঘড়ির দিকে তাকায়। দেবশ্রী ধৃতিমানের ইঙ্গিত বুঝেও হেসে উপেক্ষা করে। আলোচনা পর্ব শেষ হয়ে যাবার পরে ধৃতিমান দেবশ্রীকে অনুরোধ করে সিনেমা দেখার জন্য। দেবশ্রী হেসে জানিয়ে দেয় যে সিনেমা দেখতে নারাজ তবে দুইজনে একান্তে কোথাও ডিনার করতে রাজি। ধৃতিমান খুশিতে ফেটে পরে, সেই সাথে দেবশ্রীর হৃদয়ে নতুন প্রেমের সারা জেগে ওঠে। ধৃতিমান জানায় যে এমজি রোডের মোড়ে একটা ভালো চাইনিজ রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে যেতে পারে। দেবশ্রী জানায় ওর চাইনিজ খাবারে আপত্তি নেই। হোটেলে ফিরে নিজের কামরায় গিয়ে স্নান সেরে ফেলে দেবশ্রী। মনে মনে গুনগুন গান গায়, অনেক অনেক দিন পরে ওর হৃদয় বড় উৎফুল্ল। বেশি শাড়ি আনেনি, তবে একটা হালকা গোলাপি শাড়ি এনেছিল এমনি পড়ার জন্য। সেটা পরে, সাজার বিশেষ কিছু নেই। কোনদিন সাজে না দেবশ্রী, কিন্তু সেইদিন সাজতে বড় ইচ্ছে করল। কাজল, নেলপলিশ কিছুই সঙ্গে নেই দেখে নিজেই হেসে ফেলে। সাধারন সাজে সজ্জিত হয়ে ধৃতিমানের মোবাইলে ফোন করে দেবশ্রী।
ধৃতিমান হেসে উত্তর দেয়, “তোমরা মেয়েরা সাজতে বড় দেরি কর। আমি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে তোমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে।”
দেবশ্রী সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেখে ধৃতিমান দাঁড়িয়ে, জিজ্ঞেস করে, “নক করলে না কেন?”
ধৃতিমান, “বাপরে, তোমার রুমে নক করব আর ভেতর থেকে যদি দেবশ্রীর বদলে একটা আগুন ছোঁড়া ড্রাগন বেড়িয়ে আস্ত তাহলে?”
দেবশ্রী কপট অভিমান দেখিয়ে বলে, “আচ্ছা, তাহলে আমাকে ড্রাগন বলে মনে হয়েছে তোমার। তাহলে আর ড্রাগনের সাথে ডিনার করে কি হবে। কাউকে ফোনে ডেকে নাও, তার সাথে ডিনারে যাও।”
ধৃতিমান মাথা নিচু করে হেসে বলে, “ওকে বাবা মাফ করে দাও।” দেবশ্রীর দিকে ঝুঁকে কানেকানে বলে, “তোমার গায়ের রঙের সাথে এই গোলাপি শাড়ি দারুন মানিয়েছে। তবে কি জানো, জিন্স পড়লে আরো ভালো লাগতো।”
দেবশ্রীর মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। কামরা থেকে বেড়িয়ে এপাশ অপাশ দেখে, ওদের এক সাথে কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হতে পারে। ধৃতিমান দেবশ্রীর উদ্বেগ বুঝতে পেরে বলে, “আমি আগে হোটেল থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছি। নিচে একটা ট্যাক্সি নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি একটু পরে বের হও কেমন।”
ধৃতিমান চলে যাবার পরে দেবশ্রীর মন আষাঢ়ের ময়ুরের মতন নেচে ওঠে। অনেকদিন পরে বুকের মাঝে এক শীতল হিমেল হাওয়ার পরশ অনুভব করে মন খুশিতে ভরে যায়। দশ মিনিট যেন ওর কাছে দশ বছরের মতন মনে হয়। ধির পায়ে নিচে নেমে হোটেল থেকে বেড়িয়ে আসে। ধৃতিমান ট্যাক্সি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। ট্যাক্সিতে উঠে ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত ধরে, এবারে আর দেবশ্রী নিজের হাত ছারায় না, ধৃতিমানের হাতের উষ্ণ পরশ হাতে মাখিয়ে নেয়।
ট্যাক্সির নিভৃতে ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি সত্যি আমার পাশে বসে আছো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
বিশ্বাস দেবশ্রীর নিজের হচ্ছে না, ওর পা যেন মাটিতে নেই, আকাশে উড়ছে ধৃতিমানের ছোঁয়া পেয়ে। দেবশ্রী মিষ্টি গলায় বলে, “কি করলে তোমার বিশ্বাস হবে? চিমটি কাটব নাকি?”
ধৃতিমান দেবশ্রীর দিকে গাল এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলে, “চিমটি খেলে মনে হয় না স্বপ্ন ভাঙ্গবে, তার চেয়ে অন্য কিছু দাও।”
দেবশ্রী লজ্জা পেয়ে যায়, হাত চেপে আলতো চাটি মেরে বলে, “ট্যাক্সির মধ্যে দুষ্টুমি করবে না একদম।”
হোটেল থেকে বেশি সময় লাগে না চাইনিজ রেস্তোরাঁ পৌঁছাতে। রেস্তোরাঁতে বসে ধৃতিমান দেবশ্রীর মুখের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। দেবশ্রীর বয়স যেন কুড়ি বছর কমে যায়, ধৃতিমানের চাহনি যেন ওকে গলিয়ে দেবে। ধৃতিমান দেবশ্রীকে তার ছেলের ব্যাপারে, তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। দেবশ্রী খেতেখেতে হেসে জানায়, ওর জীবন প্রবাহ অতি সাধারন, জীবন প্রবাহে কোন চাঞ্চল্য নেই, কোন তরঙ্গ নেই। অনেক আগে রঙ ভরাতে চেয়েছিল এই সাদা কালো জীবনে কিন্তু সেটাও করে উঠতে পারল না। বর্তমানে শুধু দেবায়নকে নিয়ে চিন্তা। ওর বর্তমান পরিধি ছেলের চিন্তায় শুরু হয় আর সেখানেই শেষ। সেই সাথে জানায় অনুপমার কথা। সব শুনে ধৃতিমান হেসে বলে যে দেবশ্রী বেশ আধুনিক মানসিকতা নয়ে থাকে। দেবশ্রী বলে, মানসিকতা আধুনিক নয়, মানসিকতা সময়ের সাথে একটু উদার করে নিয়েছে। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের নিজেদের কিছু গন্ডি চলে আসে। সেই গন্ডি টুকু ছেলে মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া উচিত।
ডিনারের পরে ওরা হোটেলে ফিরে আসে একসাথে। দ্বিধাবোধ জড়তা অনেক কমে যায় দেবশ্রীর মধ্যে, ধৃতিমানের পাশে হাঁটতে ওর আর খারাপ লাগে না। হোটেলে ঢুকতেই পার্থের সাথে দেখা, পার্থ জিজ্ঞেস করাতে দেবশ্রী উত্তর দেয় যে ডিনারে বেড়িয়েছিল একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁতে। লিফটে চেপে নিজেদের তলায় এসে ধৃতিমান নিজের কামরার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে।
দেবশ্রী ধৃতিমানকে জিজ্ঞেস করে, “কিছু বলবে?”
ধৃতিমান, “না মানে, কিছু না। আমি ভেবেছিলাম তুমি একা, আমি একা একটু গল্প করলে কেমন হত।”
ধৃতিমানের চোখের ভাষা পড়ে নেয় দেবশ্রী, ঠোঁটে লাজুক হাসি মাখিয়ে বলে, “গুড নাইট ধৃতিমান, কাল গল্প করব। এখানের কাজের পরে কাল ব্যাঙ্গালোর যাবার আছে, আমার ব্যাগ গোছান বাকি।”
ধৃতিমান দুই পা দেবশ্রীর দিকে এগিয়ে আসে, দেবশ্রীর বুকের মাঝে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। ধৃতিমান দেবশ্রীর হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তুলে নেয়। দেবশ্রী শ্বাস বন্ধ করে ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুই পায়ে কেউ যেন পেরেক দিয়ে মেঝের সাথে গেঁথে দিয়েছে। সামনে পা বাড়াতে অক্ষম পিছিয়ে যেতে অক্ষম। ধৃতিমানের জ্বলন্ত চোখের ভাষা দেবশ্রীকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।