26-09-2020, 08:34 PM
অনেকক্ষণ পরে আদি সুভাষের দিকে চোয়াল চেপে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি কে তাহলে? তোমার কোন...”
সুভাষ মাথা নেড়ে গম্ভির কণ্ঠে উত্তর দেয়, “না। তোর মাকে তখন খুব ভালবাসতাম...” একটু থেমে নিচু গলায় বলে, “এখন বাসি তবে আমরা সবাই অনেক বদলে গেছি।”
অতিন্দ্রের কাছে কাজ করার সময়ে সুভাষ ওর কাজের জায়গার পাশে একটা ছোট ঘরে বাসা বেঁধেছিল। একটাই ঘর, একটা তক্তপোষ, কিন্তু সেইসব ভাবার সময় ওর কাছে ছিল না। ওর মন পড়েছিল দুর অন্ডালে ওর প্রেয়সী ঋতুপর্ণার কাছে। তবে সুভাষ প্রতি শনি রবিবার অন্ডাল যেত, কোনোদিন দুর থেকেই ঋতুপর্ণাকে দেখে মন ভরিয়ে নিত কখন দেখা পর্যন্ত হত না। অন্যপাশে ঋতুপর্ণা এক প্রকার নিদ্রাহীন হয়েই দিন কাটাচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুধু মাত্র চোখের দেখা ছাড়া ওদের মাঝে কোন কথাবার্তার অবকাশ ছিল না।
সুভাষ একদিন ওর পালানোর পরিকল্পনা অনিলকে জানায়। অনিল উদ্বেগ প্রকাশ করে ওকে সাবধান করে দেয়। বিদ্যুৎ বাবুর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারন ঋতুপর্ণাকে একা বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হত না। সুভাষ ভাবে ওকে সোজা কলেজ থেকে নিয়ে পালাতে হবে তাছাড়া ওর কাছে আর কোন রাস্তা নেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন সুভাষ ঋতুপর্ণার কলেজের বাইরে অপেক্ষা করেছিল। ঋতুপর্ণা কলেজ থেকে বের হতেই সুভাষ ওদের গাড়ির চাকার নীচে কয়েকটা পেরেক রেখে দেয়। গাড়ি চলা মাত্রই চাকার মধ্যে পেরেক ঢুকে হাওয়া বেড়িয়ে যায়। ড্রাইভার যখন গাড়ির চাকা ঠিক করতে ব্যাস্ত ততক্ষণে সুভাষ ঋতুপর্ণার হাতের মধ্যে একটা চিঠি গুঁজে দেয়। চিঠিতে লেখা ছিল যে পরেরদিন সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কলেজ থেকেই পালাবে। সারা রাত সুভাষ ঘুমাতে পারেনি। অন্যদিকে আসন্ন টানটান উত্তেজনায় ঋতুপর্ণা দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পরেরদিন ওর স্বাধীনতা দিবস, বাবা মায়ের তৈরি সোনার খাঁচা ছেড়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতন এই নীল আকাশের নীচে উড়ে যেতে পারবে। সকাল সকাল কলেজের ব্যাগের মধ্যে বেশ কিছু জামা কাপড়, নিজের জমানো কিছু টাকা আর পরনের কিছু গয়না নিয়ে ঋতুপর্ণা প্রতিদিনের মতন কলেজে বেড়িয়ে পরে। সুভাষ আর অনিল একটা গাড়ি নিয়ে ওদের কলেজের অদুরে অপেক্ষা করেছিল। ঋতুপর্ণাকে দেখে সুভাষ ইশারায় জিজ্ঞেস করে সব তৈরি কি না। উত্তরে ঋতুপর্ণা লাফিয়ে উঠে মুচকি হেসে ইশারায় জানিয়ে দেয় কলেজে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। যথারীতি, গাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঋতুপর্ণা কলেজ থেকে পালায়। সুভাষ নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য নকল গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে '. সেজে যায় আর ঋতুপর্ণাকে একটা * দিয়ে দেয়। অনিলের গাড়িতে ওরা সোজা রেল স্টেসান চলে আসে। সেইখান থেকে ট্রেন ধরে সোজা কোলকাতা। আসার সময়ে অনিলের হাত ধরে সুভাষ ধন্যবাদ জানায়। অনিল ওদের জানিয়ে দেয়, যে এই খবর বিদ্যুৎ বাবুর কানে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাবে। ততক্ষণে ওরা কোলকাতা পৌঁছে যাবে।
সুভাষ আর ঋতুপর্ণা বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা কোলকাতা চলে আসে। ওদের একমাত্র ভয় যদি ঋতুপর্ণার বাবা ওদের ধরতে পারে তাহলে সুভাষের জেল হয়ে যাবে কারন তখন ঋতুপর্ণা আইন সম্মত ভাবে বিয়ের বয়স হয়নি। সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কালিঘাট মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নেয়। তারপরে শুরু হয় ওদের জীবন যুদ্ধ। একমাত্র অনিল জানত কোলকাতায় সুভাষ কোথায় থাকে। তবে ওদের নিরাপত্তার খাতিরে অনিল কোনোদিন কাউকে ওদের ঠিকানা দেয়নি। ঋতুপর্ণার বাবা, বিদ্যুৎ বাবু হন্যে হয়ে মেয়ের খোঁজ করেছিলেন। পুলিস লোক লাগিয়েছিলেন সবার পেছনে কিন্তু কেউই ঋতুপর্ণা আর সুভাষের খোঁজ দিতে পারেনি। রাগে দুঃখে বিদ্যুৎ বাবু মেয়েকে ত্যাজ্য করে দিয়েছিলেন। এই খবর ওরা অনিলের কাছ থেকে পরে পেয়েছিল। ঋতুপর্ণার দুঃখ হয়েছিল বটে, ভেবেছিল ওর বাবা হয়ত ভবিষ্যতে ওদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বাবু নাকি মেয়ের শেষ কৃত্য করেছিলেন।
দুই বছরে সুভাষ, অতিন্দ্রের কাছে কাজ করে। প্রথম প্রথম ঋতুপর্ণার বাড়িতে একা থাকতে খুব কষ্ট হত। কথা বলার কেউ ছিল না, বাড়ি থেকে বের হতে পারত না পাছে কারুর নজরে চলে আসে আর ওর বাবার কানে কথা পৌঁছে যায়। ধনী বাড়ির রাজকন্যে ঋতুপর্ণা, সুভাষের ছোট বাড়িটাকে নিজের খেলা ঘরের মতন করে সাজিয়ে তুলেছিল। দুই বছর পরে একদিন সুভাষ নিজেই একটা ফটো শুট করে। সেই খুশিতে ওরা সেই রাতে মিলিত হয় আর ঋতুপর্ণা সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। নিজেদের সেই সময়ে খাওয়া পরার ঠিক ছিল না তাই প্রথমে ওর এই সন্তানকে এই পৃথিবীতে আনতে চায়নি। কিন্তু যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেই বাড়ির কত্রি ঋতুপর্ণাকে বুঝিয়ে বলেছিল যে প্রথম সন্তান ভালোবাসার উদাহরন তাকে কখন নষ্ট করতে নেই। তাই সুভাষ আর ঋতুপর্ণা ঠিক করে যে ওদের যত কষ্ট হোক এই সন্তানকে ওরা পৃথিবীতে আনবে।
বাড়িতে তখন কাজের লোক ছিল না, ঋতুপর্ণাকে দেখার কেউ ছিল না। সুভাষ যত সম্ভব ঋতুপর্ণাকে খুশি রাখার চেষ্টা করত কিন্তু কাজের চাপে সুভাষ সব সময়ে ঋতুপর্ণার কাছে থাকতে পারত না। ঘরের কাজ ঋতুপর্ণা একাই করত। যে মেয়ে কোনোদিন এক গেলাস জল গড়িয়ে খায়নি বিয়ের পরে সেই মেয়ে রান্না করা থেকে, ঘর গোছান থেকে সব করতে শুরু করে দিয়েছিল। গৃহ কত্রি মানা করা স্বত্তেও ঋতুপর্ণা কাজ করত।
একদিন বিকেলে ঋতুপর্ণার তলপেটে খুব ব্যাথা ওঠে। তখন সুভাষ বাড়িতে ছিল না। ঋতুপর্ণা একা একাই ডাক্তার দেখাতে যায়। ইউ এস জি করার পরে ধরা পরে যে ওর গর্ভাশয় বাকি পাঁচজন মহিলার চেয়ে একটু দুর্বল। ওইদিকে তখন ঋতুপর্ণা গর্ভধারণের ছয় মাস হয়ে গেছে। রাতে সুভাষ বাড়িতে এলে ঋতুপর্ণা সব ঘটনা খুলে বলে। এই পাঁচ ছয় মাসে সুভাষ একা একা ফটো শুট করে বেশ টাকা কামিয়ে ফেলে। কিন্তু টাকা বেশি খরচ হয়ে যাবে ভেবে ঋতুপর্ণা আর কাজের লোক রাখেনি।
সামনে পুজো, ঋতুপর্ণা বেশ খুশি। ঠিক পুজোর পরেই ঋতুপর্ণার ঘর আলো করে সন্তান আসবে। সুভাষ রোজদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে কিন্তু কাজের চাপে মাঝে মাঝেই ওর দেরি হয়ে যায়। সুভাষ ওর দেখা শুনার ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করেনি। বারেবারে ওকে বলত একটা কাজের লোক রাখার জন্য কিন্তু জেদি ঋতুপর্ণা টাকা খরচের ভয়ে কিছুতেই কাজের লোক রাখেনি।
বর্ষা শেষ, তাও আকাশে মাঝে মাঝেই কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। এমনি একদিনে সুভাষ তখন ফটো শুটে বেশ ব্যাস্ত। একসময়ে ওর স্টুডিওর একজন এসে ওকে খবর দেয় যে এক মহিলা ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সুভাষ স্টুডিওর নীচে গিয়ে অনিতাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে অনিতা ওর খোঁজ করে এই কোলকাতা চলে আসবে। অনিতার চেহারায় সেই জৌলুস নেই, চোখের কোনে কালিমা, পোশাকের ঠিক নেই। পেটের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে অনিতাও অন্তসত্তা।
সুভাষ অনিতাকে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার। তুমি এইখানে?”
অনিতা কি বলবে বুঝে পায় না। দুইহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে অনিতা, “আমি পাপী, বড় পাপ করেছি।”
সুভাষ কিছু না বুঝে ওকে জিজ্ঞেস করে, “মানে? মেজদা কোথায়?”
অনিতা কান্না থামিয়ে বলে, “তোমার মেজদার কথা আর বলো না। মুরোদ নেই এক পয়সার কি করা যাবে।”
সুভাষ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এই বাচ্চা কার?”
অনিতা উত্তর দেয়, “তোমার বন্ধু অনিলের।” মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে সুভাষ।
শেষ পর্যন্ত অনিল অনিতার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অনিতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ কাহিনী খুলে জানায়। সুভাষের মেজদা অনিতাকে যৌন সুখ দিতে পারত না সেই সুযোগে অনিল আর অনিতার মাঝে এক অবৈধ যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনিল শুধু চেয়েছিল অনিতার দেহ ভোগ করতে। যখন অনিল জানতে পারল যে অনিতা অন্তস্বত্তা তখন অনিল ওকে ছেড়ে পালিয়ে চলে যায়। বহুদিন ধরেই অনিতা ওর স্বামীর সাথে যৌন সংসর্গ করেনি তাই সুভাষের মেজদা বুঝে যায় যে এই সন্তান ওর নয়। অনিতাকে দুশ্চরিত্র বলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অনিতা নিজের বাড়িতে যেতে পারেনি কারন ওর বাবা মা এই খবর জানতে পেরে মেয়েকে নষ্টা বলে ধরে নেয়। এক বান্ধবীর বাড়িতে এত দিন ছিল অনিতা কিন্তু সেই বান্ধবীর বাড়িতেও কিছুদিন আগে সুভাষের মেজদা চড়াও হয়ে ওকে গালিগালাজ করে। অগত্যা অনিতা আর কিছু বুঝতে না পেরে কোলকাতা চলে আসে সুভাষের কাছে। সুভাষ জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে অনিল অনেক আগে একবার অনিতাকে সুভাষের ঠিকানা জানিয়েছিল। নিরুপায় অনিতা সেই ঠিকানা খুঁজে অনিতা সুভাষের দ্বারস্ত হয়।
অনিতা সুভাষের হাত ধরে কাতর মিনতি করে, “দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য কর। আমার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন। আমার কাছে টাকা পয়সা কিছুই নেই। বাচ্চা হয়ে গেলেই আমি চলে যাবো।”
ঋতুপর্ণা অনিতার সম্বন্ধে কিছুই জানত না, কি বলে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবে সেই চিন্তা ভাবনা করে। যখন অনিতার কাছে শুনল যে অনিতার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন তখন সুভাষ ঠিক করে যে ওকে একটা হসপিটালে ভর্তি করাই ভালো। সাত পাঁচ ভেবে সুভাষ অনিতাকে একটা হসপিটালে ভর্তি করে দেয়। ওর হাতে হসপিটাল খরচের কিছু টাকা দিয়ে আর বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে আসে। সেদিন রাতে সুভাষের বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ঋতুপর্ণা খুব চিন্তিত হয়ে পরে সুভাষের দেরি দেখে। সারাদিন একা একা কাটিয়ে ওর মাঝে মাঝে মনে হয় যে এই স্বাধীনতার চেয়ে ওর সোনার খাঁচা বেশি ভালো ছিল কিন্তু এই কথা কোনোদিন ঋতুপর্ণা সুভাষকে জানতে দেয়নি। এর কয়েকদিন পরে অনিতা একটা ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করে। বাচ্চাটা নর্মাল ডেলিভারি হয়।
অনিতা বাচ্চাটাকে কোলে করে সুভাষ কে বলে, “তুমি আমার জন্য অনেক করলে। আমি কি করে তোমার এই ঋণ শোধ করব জানি না।”
সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “এর পরে তুমি কোথায় যাবে? কি করবে?”
অনিতা সুভাষকে বলে, “আমি যে বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম তার একজন জানাশোনা লোক মুম্বাইয়ে থাকে। আমাকে একটা কাজ পাইয়ে দেবে বলেছে। আমি ওইখানে চলে যাবো।”
সুভাষ কি বলবে ভেবে পায় না। এক সময়ে দুর থেকেই অনিতার রূপ দেখে প্রেমে পরে গিয়েছিল। সেই অতীতের কথা মনে পড়তেই সুভাষের মনে কিঞ্চিত ঘৃণা ভাব জেগে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ওর সব থেকে ভালো বন্ধু ওর সাথে প্রতারনা করল। শুধু মাত্র অনিতার কথা ভেবেই ওকে সাহায্য করেছিল নচেত কোনোদিন অনিতাকে সাহায্য করত না। দুইদিন পরে স্টুডিও থেকে হসপিটালে গিয়ে সুভাষ জানতে পারে যে অনিতা বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিয়েই চলে গেছে। সুভাষ এই খবর পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। এক এক করে সবাই ওর সাথে প্রতারনা করে চলেছে। একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে সুভাষ কোথায় যাবে কি করবে কিছুই ভেবে পায় না। শেষ পর্যন্ত সুভাষ হসপিটালের মেট্রন কে অনুরোধ করে কয়েকদিনের জন্য বাচ্চাটাকে কাছে রাখতে এবং সুভাষ ওই বাচ্চার একটা ব্যাবস্থা করবে। কিন্তু কি ব্যাবস্থা করবে সেটা তখন সুভাষ জানে না। অনিতার সন্তানকে এইভাবে অনাথালয়ে দিয়ে দিতে সুভাষের মন কিছুতেই মানছিল না কিন্তু ওই দিকে ঋতুপর্ণাকে এই সব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
সেই রাতে ঋতুপর্ণার পেটে ভীষণ ব্যাথা শুরু হয়। সেই রাতেই ঋতুপর্ণাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারেরা জানায় যে বারন করা স্বত্তেও ঋতুপর্ণা নিজের শরীরের প্রতি নজর দেয়নি। বাড়ির কাজ করে গেছে যার ফলে ওর ভ্রুন গর্ভাশয়ের অনেক নিচের দিকে নেমে এসেছে। সারা রাত ঋতুপর্ণা ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে, শরীর বেঁকে যায়। ভোর রাতের দিকে ঋতুপর্ণা অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তারেরা তৎক্ষণাৎ অপারেশান করে কিন্তু ঋতুপর্ণার বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব হয়না। সুভাষ খুব ভালবাসত ঋতুপর্ণাকে, আর ঋতুপর্ণা বেশ খুশি ছিল এই মা হওয়া নিয়ে। বাচ্চা মারা যাওয়াতে সুভাষ একটু দুঃখ পেয়েছিল বটে তবে ওর ভয় ছিল যদি ঋতুপর্ণা এই খবর জানতে পারে তাহলে খুব ভেঙ্গে পরবে। এই দুই বছরে ঋতুপর্ণাকে খুশি রাখার সব প্রচেষ্টা করেছে বটে কিন্তু মন থেকে জানত যে ঋতুপর্ণাকে সেই স্বাধীনতার সুখের ছোঁয়া দিতে পারেনি। ঋতুপর্ণা এই সন্তানের মধ্যেই দিয়েই সেই স্বাধীনতার সুখ স্বাধীনতার আনন্দ খুঁজে পেতে চেয়েছিল। সুভাষের মাথায় তখন একটা বুদ্ধি খেলে যায়। অনিতার সন্তানকে হাস্পাতাল থেকে ঋতুপর্ণার বাচ্চার স্থানে রেখে দেয়। সেই কচি শিশুকে কোলে করে ঋতুপর্ণা কেঁদে ফেলে।
সুভাষ ওর কপালে চুমু খেয়ে হেসে বলে, “এইবারে তুমি মা হয়ে গেলে।”
ঋতুপর্ণা ছোট্ট শিশুটিকে কোলে করে ওর কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুশি?”
সুভাষ স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ খুব খুশি। তুমি আমার কাছে আছো এর চেয়ে বেশি আর কি।”
ঋতুপর্ণা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাদের জীবনে এক সূর্যের মতন আলো নিয়ে এসেছে। এর নাম কি রাখা যায় বলত?”
সুভাষ হেসে বলে, “তোমার ছেলে তুমি বলো।”
কচি শিশুটির গালে চুমু খেয়ে ঋতুপর্ণা ওর নামকরণ করে, “আমার দুষ্টু আদি। আদিত্য সান্যাল।”
আদি নির্বাক হয়ে সুভাষের কাছে নিজের জন্ম ব্রিতান্ত শুনে স্তব্দ হয়ে যায়। সব কিছু শোনার পরে আদি সুভাষ কে জিজ্ঞেস করে, “তার মানে মা জানে না যে আমি...”
সুভাষ মাথা নাড়ায়, “না, তোর মা জানে না। কোনোদিন জানতে দেইনি যে তুই ওর সন্তান নস।”
আদি কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না। আই সি ইউর সাদা বিছানায় নির্জীবের মতন শায়িত ঋতুপর্ণাকে নিস্পলক চোখে দেখে। ওর চোখের কোল ভরে আসে। সুভাষের দিকে তাকিয়ে নিজের গলা শুকিয়ে যায়।
গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটাকে কোন রকমের আটকে বলে, “আর তাই তুমি আমাকে এত ভালবাসতে।”
সুভাষ মাথা দোলায়, “তুই কি কোন অর্থে আমার ছেলে নস? আমি কি তোকে ঋতুর কোলে তুলে দিয়ে কোন ভুল করেছি? কোনোদিন কি তুই বলতে পারিস যে তোকে ভালোবাসি নি?”
কেঁদে ফেলে আদি, “না পাপা। শুধু জন্ম দিলেই বাবা মায়ের অধিকার জন্মায় না। পশুরাও সন্তানের জন্ম দেয়। এইখানেই পশুদের চেয়ে মানুষ আলাদা। তারা ভালবাসতে জানে, বড় করতে জানে, মায়া মমতা দিয়ে মানুষ করে তোলে। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি, মায়ের আঁচলের তলায় ঘুমিয়েছি। সেই মাকে কি করে ফেলে দেব পাপা। কে আমাকে জন্ম দিয়েছে সেটা না হয় নাই জানাতে। কিন্তু এর পরে আমি যে মাকে আর দূরে করে রাখতে পারবো না। তুমি আর মা আর সত্যিকারের বাবা মা। পাপা। কিন্তু পাপা...”
সুভাষ মাথা নত করে বলে, “হ্যাঁ আমি জানি এর পরে তুই জিজ্ঞেস করবি যে আমি যখন তোর মাকে এতই ভালবাসতাম তাহলে ছেড়ে কেন গেলাম।”
আদি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “দেখো পাপা, সেই বিষয় আমি আর জানতে চাই না। তবে মা তোমাকে দেখে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছে। আমার সব থেকে বড় কষ্ট যে মা আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না আবার তোমাকে দেখতে পারছে না। কি করব, পাপা? আমার যে আর কেউ নেই, পাপা।”
সুভাষ ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “এই ভাবে বলিস না যে তোর কেউ নেই। আমি সর্বদা তোর পেছনে আছি।”
আদি চোখের জল মুছে বলে, “কিন্তু পাপা। আই সি ইউতে শুয়ে যে মা, সেই মা কিন্তু আগের মতন নেই। চোখ খোলার পরে মায়ের মানসিক অবস্থা কোনদিকে যাবে সেটা সঠিক জানা নেই। পাপা, আমার মনে হয় এইবারে তোমাকে আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের মতন চলে যাওয়া উচিত। আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু...”
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুভাষ। কালো মেঘ কাটিয়ে সকালের সূর্য পূর্ব দিক থেকে উদিয়মান। আদি আর সুভাষ পাশাপাশি হেঁটে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে আসে। সুভাষ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে এয় আর নিজে একটা সিগারেট জ্বালায়। বার সামনে সিগারেট ধরাবে সেটা আদির পক্ষে আশাতীত। এতদিন যে সন্মানে দেখে এসছিল সেই সন্মান কখন এক ধাক্কায় ভেঙ্গে দিতে পারে না। নিজের বাবা না হোক কিন্তু ভালোবাসায় কোনোদিন সুভাষ কার্পণ্য করেনি।
সুভাষ মুচকি হেসে ছেলেকে বলে, “ছেলের কাঁধ যখন বাবার কাঁধ ছেড়ে উপরে উঠে যায় তখন ছেলে বাবার বন্ধু হয়।”
আদি তাও সিগারেট না নিয়ে সুভাষকে বলে, “সেটা আলাদা কথা পাপা কিন্তু আমি তোমার সামনে সিগারেট খেতে পারবো না।”
সুভাষ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে, “আমি তোর মা আর ছেলের জীবনে কোনোদিন আসব না, কথা দিলাম। চিরদিনের মতন চলে যাবো। আমি জানি এই কথা না বললেও তুই করবি। তাও বলছি, তুই তোর মাকে দেখিস। আমি ঋতুকে অনেক কিছু দিতে পারিনি হয়ত তুই ওর সেই অপূর্ণ চাহিদা গুলো পূরণ করতে সক্ষম হবি। আমি চেয়েছিলাম তুই আমার মতন ফটোগ্রাফার হ। কিন্তু ঋতুর জেদের বশে যেমন তুই ইঞ্জিনিয়ারিঙে ঢুকেছিস ঠিক তেমনি ওর কথা রাখিস।”
আদি মাথা দোলায়, “তুমি আর মা, আমার সব। তবে সত্যি বলছি, যত বড় হয়েছি আর যখন বুঝতে পেরেছিলাম যে বাবা মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তখন তোমার প্রতি আমার একটু ঘৃণা বোধ জেগেছিল। কিন্তু আজ সেটা সত্যি সব ধুয়ে মুছে গেছে। আমি কথা দিলাম, মাকে আমি দেখব। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি মাকে আগলে রাখব। কিন্তু পাপা, মা যে আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না। আমি কি করব?”
সুভাষ আদির কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “উপর ওয়ালা যখন একটা রাস্তা বন্ধ করে দেয় তখন অন্য একটা রাস্তা খুলে দেয়। আমার মনে হয় এখন ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ রাখা সব থেকে বড় জরুরি। ঋতুর স্মৃতি দশ বছির পিছিয়ে গেছে। ওর হৃদয়ের গভীরে আমার বিস্বাসঘাতকতা এখন তরতাজা। ওর মন থেকে আমাকে মুছে ফেলতে চেষ্টা কর। তুই তোর মায়ের সাথে ছেলে হিসাবে নয় এক বন্ধুর মতন করে মেলা মেশা শুরু কর। আমার মনে হয় যদি ও আমাকে ভুলে যেতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে ওর স্মৃতি শক্তি হয়ত ফিরে আসবে। এটা আমার ধারনা তবে একবার কোন মনবিদ বিশেষজ্ঞ কে দেখিয়ে নিস।” আদি চুপচাপ ওর বাবার কথা মন দিয়ে শোনে। সুভাষ ওকে বলে, “আমি মুম্বাই ফিরে তোর একাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেব। আমার মনে হয় ঋতুকে এখুনি কলেজে জয়েন না করতে দেওয়াটা ভালো। তার ওপরে তোর পড়ার খরচ, গাড়ির লোন ইত্যাদি আছে। আশা করি ততদিনে তুই একটা চাকরি পেয়ে যাবি।”
আদি বাবার হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানায়, “পাপা, তুমি সত্যি আমার পাপা।”
ম্লান হাসে সুভাষ, “জানিনা রে সত্যি জানিনা। একবার ভেবেছিলাম দশ বছরে তোর মায়ের মনে পরিবর্তন আসবে। তোর কলেজের কনভোকেশানে আমি আসব। তোর মায়ের সাথে দেখা হবে। কত কিছু ভেবেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আমরা আজ এই হসপিটালে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক সেই দশ বছর আগের মতন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।” খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সুভাষ। পুব আকাশে নতুন সূর্য ঝলমল করছে। আদির সাথে শেষবারের মতন হাত মিলিয়ে বলে, “আমি আসি রে আদি।” গলাটা ধরে আসে সুভাষের।
আদির গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে, “পাপা...” ছলছল চোখে বাবার হাত চেপে ধরে। এই হয়ত শেষ বারের মতন বাবার দেখা পাবে।
এরপরে মাকে নিয়েই ওর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। জানে না ওর মা কখন ওকে নিজের ছেলে বলে চিনতে পারবে কি না। দুই চোখ ভরে আসে জলে। যার কোলে মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাত, যার হাতের ছোঁয়ায় ওর সকাল হত, যার গায়ের গন্ধ ওকে পাগল করে দিত সেই মমতাময়ী নারী আজ ওকে ভুলে গেছে। আশে পাশে কেউ নেই। সেই ঝলমলে ভোরের আলোয় আদি চারদিকে অন্ধকার দেখে। বাবা বেড়িয়ে যেতেই দুর দিগন্ত রেখায় এক ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে ওঠে। বাবা বলে গেছে মায়ের সাথে একজন বন্ধুর মতন ব্যাবহার করতে। কতটা সক্ষম হবে আদি ওর মাকে ফিরিয়ে আনতে? আর যদি কোনোদিন ওর মা ওকে চিনতে না পারে তাহলে কি হবে?
সুভাষ মাথা নেড়ে গম্ভির কণ্ঠে উত্তর দেয়, “না। তোর মাকে তখন খুব ভালবাসতাম...” একটু থেমে নিচু গলায় বলে, “এখন বাসি তবে আমরা সবাই অনেক বদলে গেছি।”
অতিন্দ্রের কাছে কাজ করার সময়ে সুভাষ ওর কাজের জায়গার পাশে একটা ছোট ঘরে বাসা বেঁধেছিল। একটাই ঘর, একটা তক্তপোষ, কিন্তু সেইসব ভাবার সময় ওর কাছে ছিল না। ওর মন পড়েছিল দুর অন্ডালে ওর প্রেয়সী ঋতুপর্ণার কাছে। তবে সুভাষ প্রতি শনি রবিবার অন্ডাল যেত, কোনোদিন দুর থেকেই ঋতুপর্ণাকে দেখে মন ভরিয়ে নিত কখন দেখা পর্যন্ত হত না। অন্যপাশে ঋতুপর্ণা এক প্রকার নিদ্রাহীন হয়েই দিন কাটাচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুধু মাত্র চোখের দেখা ছাড়া ওদের মাঝে কোন কথাবার্তার অবকাশ ছিল না।
সুভাষ একদিন ওর পালানোর পরিকল্পনা অনিলকে জানায়। অনিল উদ্বেগ প্রকাশ করে ওকে সাবধান করে দেয়। বিদ্যুৎ বাবুর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারন ঋতুপর্ণাকে একা বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হত না। সুভাষ ভাবে ওকে সোজা কলেজ থেকে নিয়ে পালাতে হবে তাছাড়া ওর কাছে আর কোন রাস্তা নেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন সুভাষ ঋতুপর্ণার কলেজের বাইরে অপেক্ষা করেছিল। ঋতুপর্ণা কলেজ থেকে বের হতেই সুভাষ ওদের গাড়ির চাকার নীচে কয়েকটা পেরেক রেখে দেয়। গাড়ি চলা মাত্রই চাকার মধ্যে পেরেক ঢুকে হাওয়া বেড়িয়ে যায়। ড্রাইভার যখন গাড়ির চাকা ঠিক করতে ব্যাস্ত ততক্ষণে সুভাষ ঋতুপর্ণার হাতের মধ্যে একটা চিঠি গুঁজে দেয়। চিঠিতে লেখা ছিল যে পরেরদিন সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কলেজ থেকেই পালাবে। সারা রাত সুভাষ ঘুমাতে পারেনি। অন্যদিকে আসন্ন টানটান উত্তেজনায় ঋতুপর্ণা দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পরেরদিন ওর স্বাধীনতা দিবস, বাবা মায়ের তৈরি সোনার খাঁচা ছেড়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতন এই নীল আকাশের নীচে উড়ে যেতে পারবে। সকাল সকাল কলেজের ব্যাগের মধ্যে বেশ কিছু জামা কাপড়, নিজের জমানো কিছু টাকা আর পরনের কিছু গয়না নিয়ে ঋতুপর্ণা প্রতিদিনের মতন কলেজে বেড়িয়ে পরে। সুভাষ আর অনিল একটা গাড়ি নিয়ে ওদের কলেজের অদুরে অপেক্ষা করেছিল। ঋতুপর্ণাকে দেখে সুভাষ ইশারায় জিজ্ঞেস করে সব তৈরি কি না। উত্তরে ঋতুপর্ণা লাফিয়ে উঠে মুচকি হেসে ইশারায় জানিয়ে দেয় কলেজে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। যথারীতি, গাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঋতুপর্ণা কলেজ থেকে পালায়। সুভাষ নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য নকল গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে '. সেজে যায় আর ঋতুপর্ণাকে একটা * দিয়ে দেয়। অনিলের গাড়িতে ওরা সোজা রেল স্টেসান চলে আসে। সেইখান থেকে ট্রেন ধরে সোজা কোলকাতা। আসার সময়ে অনিলের হাত ধরে সুভাষ ধন্যবাদ জানায়। অনিল ওদের জানিয়ে দেয়, যে এই খবর বিদ্যুৎ বাবুর কানে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যাবে। ততক্ষণে ওরা কোলকাতা পৌঁছে যাবে।
সুভাষ আর ঋতুপর্ণা বাড়ি থেকে পালিয়ে সোজা কোলকাতা চলে আসে। ওদের একমাত্র ভয় যদি ঋতুপর্ণার বাবা ওদের ধরতে পারে তাহলে সুভাষের জেল হয়ে যাবে কারন তখন ঋতুপর্ণা আইন সম্মত ভাবে বিয়ের বয়স হয়নি। সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কালিঘাট মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নেয়। তারপরে শুরু হয় ওদের জীবন যুদ্ধ। একমাত্র অনিল জানত কোলকাতায় সুভাষ কোথায় থাকে। তবে ওদের নিরাপত্তার খাতিরে অনিল কোনোদিন কাউকে ওদের ঠিকানা দেয়নি। ঋতুপর্ণার বাবা, বিদ্যুৎ বাবু হন্যে হয়ে মেয়ের খোঁজ করেছিলেন। পুলিস লোক লাগিয়েছিলেন সবার পেছনে কিন্তু কেউই ঋতুপর্ণা আর সুভাষের খোঁজ দিতে পারেনি। রাগে দুঃখে বিদ্যুৎ বাবু মেয়েকে ত্যাজ্য করে দিয়েছিলেন। এই খবর ওরা অনিলের কাছ থেকে পরে পেয়েছিল। ঋতুপর্ণার দুঃখ হয়েছিল বটে, ভেবেছিল ওর বাবা হয়ত ভবিষ্যতে ওদের ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বাবু নাকি মেয়ের শেষ কৃত্য করেছিলেন।
দুই বছরে সুভাষ, অতিন্দ্রের কাছে কাজ করে। প্রথম প্রথম ঋতুপর্ণার বাড়িতে একা থাকতে খুব কষ্ট হত। কথা বলার কেউ ছিল না, বাড়ি থেকে বের হতে পারত না পাছে কারুর নজরে চলে আসে আর ওর বাবার কানে কথা পৌঁছে যায়। ধনী বাড়ির রাজকন্যে ঋতুপর্ণা, সুভাষের ছোট বাড়িটাকে নিজের খেলা ঘরের মতন করে সাজিয়ে তুলেছিল। দুই বছর পরে একদিন সুভাষ নিজেই একটা ফটো শুট করে। সেই খুশিতে ওরা সেই রাতে মিলিত হয় আর ঋতুপর্ণা সন্তানসম্ভবা হয়ে যায়। নিজেদের সেই সময়ে খাওয়া পরার ঠিক ছিল না তাই প্রথমে ওর এই সন্তানকে এই পৃথিবীতে আনতে চায়নি। কিন্তু যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেই বাড়ির কত্রি ঋতুপর্ণাকে বুঝিয়ে বলেছিল যে প্রথম সন্তান ভালোবাসার উদাহরন তাকে কখন নষ্ট করতে নেই। তাই সুভাষ আর ঋতুপর্ণা ঠিক করে যে ওদের যত কষ্ট হোক এই সন্তানকে ওরা পৃথিবীতে আনবে।
বাড়িতে তখন কাজের লোক ছিল না, ঋতুপর্ণাকে দেখার কেউ ছিল না। সুভাষ যত সম্ভব ঋতুপর্ণাকে খুশি রাখার চেষ্টা করত কিন্তু কাজের চাপে সুভাষ সব সময়ে ঋতুপর্ণার কাছে থাকতে পারত না। ঘরের কাজ ঋতুপর্ণা একাই করত। যে মেয়ে কোনোদিন এক গেলাস জল গড়িয়ে খায়নি বিয়ের পরে সেই মেয়ে রান্না করা থেকে, ঘর গোছান থেকে সব করতে শুরু করে দিয়েছিল। গৃহ কত্রি মানা করা স্বত্তেও ঋতুপর্ণা কাজ করত।
একদিন বিকেলে ঋতুপর্ণার তলপেটে খুব ব্যাথা ওঠে। তখন সুভাষ বাড়িতে ছিল না। ঋতুপর্ণা একা একাই ডাক্তার দেখাতে যায়। ইউ এস জি করার পরে ধরা পরে যে ওর গর্ভাশয় বাকি পাঁচজন মহিলার চেয়ে একটু দুর্বল। ওইদিকে তখন ঋতুপর্ণা গর্ভধারণের ছয় মাস হয়ে গেছে। রাতে সুভাষ বাড়িতে এলে ঋতুপর্ণা সব ঘটনা খুলে বলে। এই পাঁচ ছয় মাসে সুভাষ একা একা ফটো শুট করে বেশ টাকা কামিয়ে ফেলে। কিন্তু টাকা বেশি খরচ হয়ে যাবে ভেবে ঋতুপর্ণা আর কাজের লোক রাখেনি।
সামনে পুজো, ঋতুপর্ণা বেশ খুশি। ঠিক পুজোর পরেই ঋতুপর্ণার ঘর আলো করে সন্তান আসবে। সুভাষ রোজদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে কিন্তু কাজের চাপে মাঝে মাঝেই ওর দেরি হয়ে যায়। সুভাষ ওর দেখা শুনার ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করেনি। বারেবারে ওকে বলত একটা কাজের লোক রাখার জন্য কিন্তু জেদি ঋতুপর্ণা টাকা খরচের ভয়ে কিছুতেই কাজের লোক রাখেনি।
বর্ষা শেষ, তাও আকাশে মাঝে মাঝেই কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। এমনি একদিনে সুভাষ তখন ফটো শুটে বেশ ব্যাস্ত। একসময়ে ওর স্টুডিওর একজন এসে ওকে খবর দেয় যে এক মহিলা ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সুভাষ স্টুডিওর নীচে গিয়ে অনিতাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে অনিতা ওর খোঁজ করে এই কোলকাতা চলে আসবে। অনিতার চেহারায় সেই জৌলুস নেই, চোখের কোনে কালিমা, পোশাকের ঠিক নেই। পেটের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে অনিতাও অন্তসত্তা।
সুভাষ অনিতাকে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার। তুমি এইখানে?”
অনিতা কি বলবে বুঝে পায় না। দুইহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে অনিতা, “আমি পাপী, বড় পাপ করেছি।”
সুভাষ কিছু না বুঝে ওকে জিজ্ঞেস করে, “মানে? মেজদা কোথায়?”
অনিতা কান্না থামিয়ে বলে, “তোমার মেজদার কথা আর বলো না। মুরোদ নেই এক পয়সার কি করা যাবে।”
সুভাষ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এই বাচ্চা কার?”
অনিতা উত্তর দেয়, “তোমার বন্ধু অনিলের।” মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে সুভাষ।
শেষ পর্যন্ত অনিল অনিতার সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অনিতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ কাহিনী খুলে জানায়। সুভাষের মেজদা অনিতাকে যৌন সুখ দিতে পারত না সেই সুযোগে অনিল আর অনিতার মাঝে এক অবৈধ যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনিল শুধু চেয়েছিল অনিতার দেহ ভোগ করতে। যখন অনিল জানতে পারল যে অনিতা অন্তস্বত্তা তখন অনিল ওকে ছেড়ে পালিয়ে চলে যায়। বহুদিন ধরেই অনিতা ওর স্বামীর সাথে যৌন সংসর্গ করেনি তাই সুভাষের মেজদা বুঝে যায় যে এই সন্তান ওর নয়। অনিতাকে দুশ্চরিত্র বলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অনিতা নিজের বাড়িতে যেতে পারেনি কারন ওর বাবা মা এই খবর জানতে পেরে মেয়েকে নষ্টা বলে ধরে নেয়। এক বান্ধবীর বাড়িতে এত দিন ছিল অনিতা কিন্তু সেই বান্ধবীর বাড়িতেও কিছুদিন আগে সুভাষের মেজদা চড়াও হয়ে ওকে গালিগালাজ করে। অগত্যা অনিতা আর কিছু বুঝতে না পেরে কোলকাতা চলে আসে সুভাষের কাছে। সুভাষ জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারে অনিল অনেক আগে একবার অনিতাকে সুভাষের ঠিকানা জানিয়েছিল। নিরুপায় অনিতা সেই ঠিকানা খুঁজে অনিতা সুভাষের দ্বারস্ত হয়।
অনিতা সুভাষের হাত ধরে কাতর মিনতি করে, “দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য কর। আমার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন। আমার কাছে টাকা পয়সা কিছুই নেই। বাচ্চা হয়ে গেলেই আমি চলে যাবো।”
ঋতুপর্ণা অনিতার সম্বন্ধে কিছুই জানত না, কি বলে ওকে বাড়ি নিয়ে যাবে সেই চিন্তা ভাবনা করে। যখন অনিতার কাছে শুনল যে অনিতার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন তখন সুভাষ ঠিক করে যে ওকে একটা হসপিটালে ভর্তি করাই ভালো। সাত পাঁচ ভেবে সুভাষ অনিতাকে একটা হসপিটালে ভর্তি করে দেয়। ওর হাতে হসপিটাল খরচের কিছু টাকা দিয়ে আর বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে আসে। সেদিন রাতে সুভাষের বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হয়ে যায়। ঋতুপর্ণা খুব চিন্তিত হয়ে পরে সুভাষের দেরি দেখে। সারাদিন একা একা কাটিয়ে ওর মাঝে মাঝে মনে হয় যে এই স্বাধীনতার চেয়ে ওর সোনার খাঁচা বেশি ভালো ছিল কিন্তু এই কথা কোনোদিন ঋতুপর্ণা সুভাষকে জানতে দেয়নি। এর কয়েকদিন পরে অনিতা একটা ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করে। বাচ্চাটা নর্মাল ডেলিভারি হয়।
অনিতা বাচ্চাটাকে কোলে করে সুভাষ কে বলে, “তুমি আমার জন্য অনেক করলে। আমি কি করে তোমার এই ঋণ শোধ করব জানি না।”
সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “এর পরে তুমি কোথায় যাবে? কি করবে?”
অনিতা সুভাষকে বলে, “আমি যে বান্ধবীর বাড়িতে ছিলাম তার একজন জানাশোনা লোক মুম্বাইয়ে থাকে। আমাকে একটা কাজ পাইয়ে দেবে বলেছে। আমি ওইখানে চলে যাবো।”
সুভাষ কি বলবে ভেবে পায় না। এক সময়ে দুর থেকেই অনিতার রূপ দেখে প্রেমে পরে গিয়েছিল। সেই অতীতের কথা মনে পড়তেই সুভাষের মনে কিঞ্চিত ঘৃণা ভাব জেগে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ওর সব থেকে ভালো বন্ধু ওর সাথে প্রতারনা করল। শুধু মাত্র অনিতার কথা ভেবেই ওকে সাহায্য করেছিল নচেত কোনোদিন অনিতাকে সাহায্য করত না। দুইদিন পরে স্টুডিও থেকে হসপিটালে গিয়ে সুভাষ জানতে পারে যে অনিতা বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিয়েই চলে গেছে। সুভাষ এই খবর পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। এক এক করে সবাই ওর সাথে প্রতারনা করে চলেছে। একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে সুভাষ কোথায় যাবে কি করবে কিছুই ভেবে পায় না। শেষ পর্যন্ত সুভাষ হসপিটালের মেট্রন কে অনুরোধ করে কয়েকদিনের জন্য বাচ্চাটাকে কাছে রাখতে এবং সুভাষ ওই বাচ্চার একটা ব্যাবস্থা করবে। কিন্তু কি ব্যাবস্থা করবে সেটা তখন সুভাষ জানে না। অনিতার সন্তানকে এইভাবে অনাথালয়ে দিয়ে দিতে সুভাষের মন কিছুতেই মানছিল না কিন্তু ওই দিকে ঋতুপর্ণাকে এই সব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
সেই রাতে ঋতুপর্ণার পেটে ভীষণ ব্যাথা শুরু হয়। সেই রাতেই ঋতুপর্ণাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তারেরা জানায় যে বারন করা স্বত্তেও ঋতুপর্ণা নিজের শরীরের প্রতি নজর দেয়নি। বাড়ির কাজ করে গেছে যার ফলে ওর ভ্রুন গর্ভাশয়ের অনেক নিচের দিকে নেমে এসেছে। সারা রাত ঋতুপর্ণা ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে, শরীর বেঁকে যায়। ভোর রাতের দিকে ঋতুপর্ণা অজ্ঞান হয়ে যায়। ডাক্তারেরা তৎক্ষণাৎ অপারেশান করে কিন্তু ঋতুপর্ণার বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব হয়না। সুভাষ খুব ভালবাসত ঋতুপর্ণাকে, আর ঋতুপর্ণা বেশ খুশি ছিল এই মা হওয়া নিয়ে। বাচ্চা মারা যাওয়াতে সুভাষ একটু দুঃখ পেয়েছিল বটে তবে ওর ভয় ছিল যদি ঋতুপর্ণা এই খবর জানতে পারে তাহলে খুব ভেঙ্গে পরবে। এই দুই বছরে ঋতুপর্ণাকে খুশি রাখার সব প্রচেষ্টা করেছে বটে কিন্তু মন থেকে জানত যে ঋতুপর্ণাকে সেই স্বাধীনতার সুখের ছোঁয়া দিতে পারেনি। ঋতুপর্ণা এই সন্তানের মধ্যেই দিয়েই সেই স্বাধীনতার সুখ স্বাধীনতার আনন্দ খুঁজে পেতে চেয়েছিল। সুভাষের মাথায় তখন একটা বুদ্ধি খেলে যায়। অনিতার সন্তানকে হাস্পাতাল থেকে ঋতুপর্ণার বাচ্চার স্থানে রেখে দেয়। সেই কচি শিশুকে কোলে করে ঋতুপর্ণা কেঁদে ফেলে।
সুভাষ ওর কপালে চুমু খেয়ে হেসে বলে, “এইবারে তুমি মা হয়ে গেলে।”
ঋতুপর্ণা ছোট্ট শিশুটিকে কোলে করে ওর কপালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুশি?”
সুভাষ স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ খুব খুশি। তুমি আমার কাছে আছো এর চেয়ে বেশি আর কি।”
ঋতুপর্ণা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাদের জীবনে এক সূর্যের মতন আলো নিয়ে এসেছে। এর নাম কি রাখা যায় বলত?”
সুভাষ হেসে বলে, “তোমার ছেলে তুমি বলো।”
কচি শিশুটির গালে চুমু খেয়ে ঋতুপর্ণা ওর নামকরণ করে, “আমার দুষ্টু আদি। আদিত্য সান্যাল।”
আদি নির্বাক হয়ে সুভাষের কাছে নিজের জন্ম ব্রিতান্ত শুনে স্তব্দ হয়ে যায়। সব কিছু শোনার পরে আদি সুভাষ কে জিজ্ঞেস করে, “তার মানে মা জানে না যে আমি...”
সুভাষ মাথা নাড়ায়, “না, তোর মা জানে না। কোনোদিন জানতে দেইনি যে তুই ওর সন্তান নস।”
আদি কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না। আই সি ইউর সাদা বিছানায় নির্জীবের মতন শায়িত ঋতুপর্ণাকে নিস্পলক চোখে দেখে। ওর চোখের কোল ভরে আসে। সুভাষের দিকে তাকিয়ে নিজের গলা শুকিয়ে যায়।
গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটাকে কোন রকমের আটকে বলে, “আর তাই তুমি আমাকে এত ভালবাসতে।”
সুভাষ মাথা দোলায়, “তুই কি কোন অর্থে আমার ছেলে নস? আমি কি তোকে ঋতুর কোলে তুলে দিয়ে কোন ভুল করেছি? কোনোদিন কি তুই বলতে পারিস যে তোকে ভালোবাসি নি?”
কেঁদে ফেলে আদি, “না পাপা। শুধু জন্ম দিলেই বাবা মায়ের অধিকার জন্মায় না। পশুরাও সন্তানের জন্ম দেয়। এইখানেই পশুদের চেয়ে মানুষ আলাদা। তারা ভালবাসতে জানে, বড় করতে জানে, মায়া মমতা দিয়ে মানুষ করে তোলে। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছি, মায়ের আঁচলের তলায় ঘুমিয়েছি। সেই মাকে কি করে ফেলে দেব পাপা। কে আমাকে জন্ম দিয়েছে সেটা না হয় নাই জানাতে। কিন্তু এর পরে আমি যে মাকে আর দূরে করে রাখতে পারবো না। তুমি আর মা আর সত্যিকারের বাবা মা। পাপা। কিন্তু পাপা...”
সুভাষ মাথা নত করে বলে, “হ্যাঁ আমি জানি এর পরে তুই জিজ্ঞেস করবি যে আমি যখন তোর মাকে এতই ভালবাসতাম তাহলে ছেড়ে কেন গেলাম।”
আদি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে, “দেখো পাপা, সেই বিষয় আমি আর জানতে চাই না। তবে মা তোমাকে দেখে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছে। আমার সব থেকে বড় কষ্ট যে মা আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না আবার তোমাকে দেখতে পারছে না। কি করব, পাপা? আমার যে আর কেউ নেই, পাপা।”
সুভাষ ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “এই ভাবে বলিস না যে তোর কেউ নেই। আমি সর্বদা তোর পেছনে আছি।”
আদি চোখের জল মুছে বলে, “কিন্তু পাপা। আই সি ইউতে শুয়ে যে মা, সেই মা কিন্তু আগের মতন নেই। চোখ খোলার পরে মায়ের মানসিক অবস্থা কোনদিকে যাবে সেটা সঠিক জানা নেই। পাপা, আমার মনে হয় এইবারে তোমাকে আমাদের জীবন থেকে চিরদিনের মতন চলে যাওয়া উচিত। আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু...”
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুভাষ। কালো মেঘ কাটিয়ে সকালের সূর্য পূর্ব দিক থেকে উদিয়মান। আদি আর সুভাষ পাশাপাশি হেঁটে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে আসে। সুভাষ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ছেলের দিকে এগিয়ে এয় আর নিজে একটা সিগারেট জ্বালায়। বার সামনে সিগারেট ধরাবে সেটা আদির পক্ষে আশাতীত। এতদিন যে সন্মানে দেখে এসছিল সেই সন্মান কখন এক ধাক্কায় ভেঙ্গে দিতে পারে না। নিজের বাবা না হোক কিন্তু ভালোবাসায় কোনোদিন সুভাষ কার্পণ্য করেনি।
সুভাষ মুচকি হেসে ছেলেকে বলে, “ছেলের কাঁধ যখন বাবার কাঁধ ছেড়ে উপরে উঠে যায় তখন ছেলে বাবার বন্ধু হয়।”
আদি তাও সিগারেট না নিয়ে সুভাষকে বলে, “সেটা আলাদা কথা পাপা কিন্তু আমি তোমার সামনে সিগারেট খেতে পারবো না।”
সুভাষ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে, “আমি তোর মা আর ছেলের জীবনে কোনোদিন আসব না, কথা দিলাম। চিরদিনের মতন চলে যাবো। আমি জানি এই কথা না বললেও তুই করবি। তাও বলছি, তুই তোর মাকে দেখিস। আমি ঋতুকে অনেক কিছু দিতে পারিনি হয়ত তুই ওর সেই অপূর্ণ চাহিদা গুলো পূরণ করতে সক্ষম হবি। আমি চেয়েছিলাম তুই আমার মতন ফটোগ্রাফার হ। কিন্তু ঋতুর জেদের বশে যেমন তুই ইঞ্জিনিয়ারিঙে ঢুকেছিস ঠিক তেমনি ওর কথা রাখিস।”
আদি মাথা দোলায়, “তুমি আর মা, আমার সব। তবে সত্যি বলছি, যত বড় হয়েছি আর যখন বুঝতে পেরেছিলাম যে বাবা মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে তখন তোমার প্রতি আমার একটু ঘৃণা বোধ জেগেছিল। কিন্তু আজ সেটা সত্যি সব ধুয়ে মুছে গেছে। আমি কথা দিলাম, মাকে আমি দেখব। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি মাকে আগলে রাখব। কিন্তু পাপা, মা যে আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারছে না। আমি কি করব?”
সুভাষ আদির কাঁধে হাত দিয়ে বলে, “উপর ওয়ালা যখন একটা রাস্তা বন্ধ করে দেয় তখন অন্য একটা রাস্তা খুলে দেয়। আমার মনে হয় এখন ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ রাখা সব থেকে বড় জরুরি। ঋতুর স্মৃতি দশ বছির পিছিয়ে গেছে। ওর হৃদয়ের গভীরে আমার বিস্বাসঘাতকতা এখন তরতাজা। ওর মন থেকে আমাকে মুছে ফেলতে চেষ্টা কর। তুই তোর মায়ের সাথে ছেলে হিসাবে নয় এক বন্ধুর মতন করে মেলা মেশা শুরু কর। আমার মনে হয় যদি ও আমাকে ভুলে যেতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে ওর স্মৃতি শক্তি হয়ত ফিরে আসবে। এটা আমার ধারনা তবে একবার কোন মনবিদ বিশেষজ্ঞ কে দেখিয়ে নিস।” আদি চুপচাপ ওর বাবার কথা মন দিয়ে শোনে। সুভাষ ওকে বলে, “আমি মুম্বাই ফিরে তোর একাউন্টে পাঁচ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেব। আমার মনে হয় ঋতুকে এখুনি কলেজে জয়েন না করতে দেওয়াটা ভালো। তার ওপরে তোর পড়ার খরচ, গাড়ির লোন ইত্যাদি আছে। আশা করি ততদিনে তুই একটা চাকরি পেয়ে যাবি।”
আদি বাবার হাত ধরে কৃতজ্ঞতা জানায়, “পাপা, তুমি সত্যি আমার পাপা।”
ম্লান হাসে সুভাষ, “জানিনা রে সত্যি জানিনা। একবার ভেবেছিলাম দশ বছরে তোর মায়ের মনে পরিবর্তন আসবে। তোর কলেজের কনভোকেশানে আমি আসব। তোর মায়ের সাথে দেখা হবে। কত কিছু ভেবেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আমরা আজ এই হসপিটালে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক সেই দশ বছর আগের মতন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।” খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সুভাষ। পুব আকাশে নতুন সূর্য ঝলমল করছে। আদির সাথে শেষবারের মতন হাত মিলিয়ে বলে, “আমি আসি রে আদি।” গলাটা ধরে আসে সুভাষের।
আদির গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে, “পাপা...” ছলছল চোখে বাবার হাত চেপে ধরে। এই হয়ত শেষ বারের মতন বাবার দেখা পাবে।
এরপরে মাকে নিয়েই ওর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। জানে না ওর মা কখন ওকে নিজের ছেলে বলে চিনতে পারবে কি না। দুই চোখ ভরে আসে জলে। যার কোলে মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাত, যার হাতের ছোঁয়ায় ওর সকাল হত, যার গায়ের গন্ধ ওকে পাগল করে দিত সেই মমতাময়ী নারী আজ ওকে ভুলে গেছে। আশে পাশে কেউ নেই। সেই ঝলমলে ভোরের আলোয় আদি চারদিকে অন্ধকার দেখে। বাবা বেড়িয়ে যেতেই দুর দিগন্ত রেখায় এক ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে ওঠে। বাবা বলে গেছে মায়ের সাথে একজন বন্ধুর মতন ব্যাবহার করতে। কতটা সক্ষম হবে আদি ওর মাকে ফিরিয়ে আনতে? আর যদি কোনোদিন ওর মা ওকে চিনতে না পারে তাহলে কি হবে?