26-09-2020, 08:32 PM
আদির এই সব শুনতে একদম ভালো লাগছিল না। ওর মনে শুধু একটা প্রশ্ন, দশ বছর আগে এমন কি ঘটেছিল যার জন্য পাপা আর মা আলাদা পথ বেছে নিয়েছিল। আদি সুভাষকে জিজ্ঞেস করে, “পাপা, তোমার আর মায়ের বিয়ে হয়েছিল তাই আমি এসেছি। তাই না? তোমার এই গল্প শুনে আমি কি করব?”
সুভাষ ম্লান হেসে বলে, “দরকার না থাকলে কেন বলতে যাবো বল। একটু তোর পাপার কথাও শোন, না হলে কি করে বুঝবি।”
আদি চেয়ারে বসে বলে, “আচ্ছা বলো আমি শুনছি।”
সুভাষ আবার শুরু করে তার কাহিনী। এইবারে সুভাষ বেশ কয়েক মাস এগিয়ে যায়। এর মাঝে এক বিবাহ অনুষ্ঠানে সুভাষের সাথে ঋতুপর্ণার দেখা হয়েছিল তবে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। সেই অনুষ্ঠানে সুভাষ চুপচাপ ফটো তোলার দিকে মনোনিবেশ করে। একা একা এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে ফটো তুলতে ব্যাস্ত হয়ে যায় সুভাষ।
বড় যাত্রী যাওয়ার আগে সুভাষ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়ায় ঋতুপর্ণা। মিষ্টি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে খানিক অভিমান ভরা গলায় বলে, “সেদিন আলু কাবলি খাওয়ালে না কেন?”
সুভাষের কানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে। সুভাষ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “তোর পরীক্ষার দেরি হয়ে যেত তাই।” আসলে সেদিন সুভাষের পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা পড়েছিল। দুই টাকার আলু কাবলি কিনলে সারাদিনে ওর আর বিড়ি খাওয়ার পয়সা হত না।
চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে ঋতুপর্ণা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তাই নাকি। এত চিন্তা এই মেয়েটার জন্য?”
সুভাষ কি বলবে ভেবে পায়নি। মুচকি হেসে ওকে উত্তর দেয়, “আরে হ্যাঁ রে বাবা। এখন এইভাবে এইখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যা। অন্য কেউ দেখতে পেলে কিছু একটা ভেবে বসবে।”
ঋতুপর্ণার চেহারা হটাত করে বিষণ্ণ হয়ে যায়, “কেন, দেখে ফেললে কি হবে? তোমার কি দাদ হাজা হয়েছে যে তোমার সাথে কথা বলা বারন?”
কি উত্তর দেবে সুভাষ, জানে না। এলাকার ধনী ঘরের মেয়ে একজন সামান্য ফটো গ্রাফারের সাথে নিভৃতে একান্তে কথা বলছে সেটা কারুর নজরে আসলে ভুরু উঁচিয়ে যাবেই। ঠিক তাই হল। অনিল ওদের দেখে ফেলে।
এগিয়ে আসে ওদের দিকে, “কি রে এইখানে কি করছিস? বর একটু পরেই গাড়িতে উঠবে।”
ঋতুপর্ণা অনিলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে চুপচাপ ওইখান থেকে চলে যায়। ঋতুপর্ণার বিষণ্ণ চেহারা দেখে সুভাষের বুক ভেঙ্গে যায়। কিন্তু অনিলের চলে আসার ফলে ওকে আর বাধা দিতে পারেনা।
ঋতুপর্ণা চলে যেতেই অনিল ওকে সাবধান করে দেয়, “কেন মিছিমিছি মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিস। তোর পকেটে কানাকড়ি নেই আর ঋতুপর্ণা বিপুল প্রাচুর্যে বড় হয়েছে। যদিও প্রেম করিস তাহলে ওকে খাওয়াবি কি। ভেবে দেখেছিস একবার। মেয়েটা এখন অনেক ছোট, ওকে বিয়ে করতে হলে আগে তোকে দাঁড়াতে হবে ওকে সেই বয়সে যেতে হবে। ততদিনে মতিগতি বদলে যাবে। কাজে মন দে। চল ওইদিকে।”
অনিলের কথার কোন উত্তর দেয় না সুভাষ। চুপচাপ বরের গাড়ির দিকে চলে যায় ফটো তুলতে। তবে ঋতুপর্ণার বিষণ্ণ চেহারা ওর বুকে দাগ কেটে চলে যায়। সেদিনের পরে আর ঋতুপর্ণার সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু সুভাষের আর স্বস্তি ছিল না। বিয়ে বউভাতে প্রচুর ফটো তুলেছিল ঠিক, মাঝে মাঝে ঋতুপর্ণার ফটোও তুলেছিল কিন্তু ঋতুপর্ণা আর ওর কাছে আসেনি।
কলেজের পরীক্ষার পরে শীতের ছুটি পরে যায়। একমাস কেটে যায়। ঋতুপর্ণা ছুটিতে দাদা বৌদির সাথে সিমলা কুল্লু মানালি বেড়াতে যায় সেইবারে। সুভাষ মাঝে মাঝেই সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত, যদি ঋতুপর্ণা গাড়িতে করে ওর সামনে দিয়ে যায়, যদি একবার ক্ষণিকের জন্য একটু দর্শন পায়। সুভাষ যে সত্যি ঋতুপর্ণার রূপে, ঋতুপর্ণার চোখের ভাষায়, ঋতুপর্ণার মিষ্টি আদুরে কণ্ঠ স্বরের প্রেমে পরে গেছে।
শীতের ছুটির পরে কলেজ খুলল। ঋতুপর্ণা ক্লাস টেনে উঠল। ছুটির পরে প্রথম যেদিন ঋতুপর্ণা গাড়ি করে কলেজ গেল সেদিন সুভাষ সাইকেল নিয়ে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়েছিল। ঋতুপর্ণা গাড়ির জানালা দিয়ে একবার উঁকি মেরে ওর দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু হাত নাড়ায় নি। বড় কষ্ট পেয়েছিল সুভাষ। বুকটা হুহু করে উঠেছিল। সারাদিন দোকানে বসে ভাবে, এই অভিমানী ললনাকে কি করে শান্ত করা যায়। বিকেলের দিকে এক সময়ে আপনমনে সাইকেল নিয়ে মেয়েদের কলেজে চলে যায়। ছুটির সময়ে গেটের কাছে আলু কাবলি ওয়ালা, ফুচকাওয়ালা ঝালমুড়ি ওয়ালা দের ভিড় জমে ওঠে। সুভাষ দুটো আলু কাবলি কিনে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতুপর্ণার অপেক্ষায়। যদিও জানে হয়ত ঋতুপর্ণা কলেজ থেকে বেড়িয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বাড়ি চলে যাবে তাও সুভাষ দাঁড়িয়ে থাকে।
কলেজ ছুটি হয় আর সুভাষের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। ঋতুপর্ণা বাকি মেয়েদের সাথে গেট থেকে বেড়িয়ে গাড়ির দিকে যায়। মাঝে মাঝে আশে পাশের মেয়েদের দিকে তাকায়। ওদের ড্রাইভার রঞ্জন ওর হাত থেকে কলেজের ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রেখে ঋতুপর্ণার জন্য অপেক্ষা করে। “চলে এসো মামনি, দিদিমনি অপেক্ষা করছে।”
ঋতুপর্ণা হাত নাড়িয়ে উদাস কণ্ঠে বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই আসছি কাকু।”
গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময়ে ওর চোখ পরে অদুরে দাঁড়িয়ে থাকা সুভাষের দিকে। সুভাষ দুই হাতে দুটো আলু কাব্লির ঠোঙ্গা নিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। চোখের মণির সাথে চোখের মণি মিলে যেতেই থমকে যায় ঋতুপর্ণা। ওর বুক হুহু করে ওঠে। মানুষটা সত্যি তাহলে ওর জন্য আলু কাবলি কিনে দাঁড়িয়ে। আলতো মাথা দোলায় ঋতুপর্ণা, কিছু বলতে চেষ্টা করে। ঠিক তখনি রঞ্জন আবার ঋতুপর্ণাকে ডাক দেয়। “মামনি দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার নাচের ক্লাসে যেতে হবে না।”
সুভাষের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চোয়াল চেপে আক্ষেপ করে মাথা নাড়ায় ঋতুপর্ণা। যেন বলতে চাইল, “আমি নিরুপায় সুভাষদা।” মন চাইছিল এক দৌড়ে সুভাষের কাছে চলে যেতে। ওর হাত ধরে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে। কিন্তু পায়ে যে সোনার বেড়ি বাঁধা।
গাড়িতে উঠে নিস্পলক নয়নে সুভাষের দিকে তাকিয়ে থাকে ঋতুপর্ণা। সুভাষ স্থানুর মতন দুই হাতে দুটো ঠোঙ্গা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওর দুই পা কে যেন পেরেক দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে। রাগে দুঃখে সেই দুটো ঠোঙা মাটিতে ফেলে পায়ের তলায় মুচড়ে দিল সুভাষ। গাড়ির মধ্যে বসে থাকা ঋতুপর্ণা, দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। চাইলেও যে ওর কাছে যেতে পারবে না। দুইজনের মাঝের সামাজিক বৈষম্যের অলঙ্ঘনীয় এক প্রাচীর দাঁড়িয়ে।
গাড়িটা হুস করে ওর পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে চলে গেল। ঋতুপর্ণা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। সেটা আর সুভাষের নজরে গেল না। সুভাষ শুধু মাত্র দেখল যে, ঋতুপর্ণা ওর আলু কাবলি উপেক্ষা করে গাড়িতে উঠে চলে গেছে। সুভাষ আর পেছনে ফিরে তাকাল না। সেদিন রাতে অনিলের সাথে মদে চুড় হয়ে পিঙ্কির কোঠাতে গিয়ে পিঙ্কিকে আস্টেপিস্টে যৌন সঙ্গমে মেতে উঠেছিল। বারেবারে ঋতুপর্ণাকে গালি দিয়েছিল সেদিন রাতে। অনিল বুঝেছিল ওর মনের দুঃখটা। শেষ রাতে পিঙ্কি শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরার পরে অনিল আর সুভাষ ওর কোঠা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল অন্ধকার রাস্তায়।
অনিল ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, “আমাদের দেখে যাওয়া ছাড়া আর কাজ নেই বুঝলি। ওই মেয়ে তোর জন্য জন্মায়নি। ওই মেয়ে তোর বুক চিরে বেড়িয়ে যাবে।”
সারা রাত চোখের পাতা এক করেনি ঋতুপর্ণা। একা ঘরে খিল দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল সেই রাতে। লোহার শিক ভেঙ্গে ঘন নীল আকাশে পাখীর মতন বিচরন করা হয়ত ওর কপালে নেই। এই ক্লাস টেনে উঠবে, তারপরে বাবা মায়ের চাপাচাপির ফলে হয়ত বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে। বাবা আর বড়দা দুইজনে ইঞ্জিনিয়ার, ছোড়দা ডাক্তারি পড়ছে। কিন্তু ওর মাথায় অঙ্ক বিজ্ঞান একদম ঢোকেনা। নাচ শিখতে চায়, শান্তিনিকেতনে যেতে চায়। ঋতুপর্ণা পাখী হতে চায়, মেঘের ভেলায় ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় দুর দেশে। পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করতে চায়, কোকিলের কুহু ধ্বনির সাথে গলা মিলিয়ে জ্ঞান গাইতে চায়। কিন্তু বাবাকে বড়দাকে কে বুঝাবে।
সুভাষ রোজ রাতে মদ খায়। এখন পর্যন্ত কেউ কারুর হাত পর্যন্ত ধরেনি কিন্তু দুইপাশে প্রেমের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এই আগুনে ভস্মীভূত হওয়া ছাড়া ওদের কাছে আর কোন পথ খোলা নেই। সুভাষ নিজের ভবিতব্যকে মেনে নেয়। মদের নেশায় ঋতুপর্ণাকে ভুলে থাকতে প্রবল চেষ্টা চালায়।
সেদিন দুপুরের দিকে দোকানে একা একা বসে ছিল সুভাষ। দুপুরে কেউ ফটো তুলতে আসেনা। এমন সময়ে একটা আদিবাসী ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে ওর দোকানে বলে, “সুভাষ দা, সুভাষ দা তোমারে একজন ডাকতিছে।”
সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “কে ডাকছে, কোথায় ডাকছে?”
ছেলেটা দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, “ওই মেয়িডা তোমায় ডাকতিছে।”
দুর থেকে মেয়েটাকে দেখে সুভাষ থমকে দাঁড়িয়ে পরে। কলেজের সাদা সালোয়ার কামিজ, গায়ে একটা ভারী নীল রঙের সোয়েটার, সম্পূর্ণ চেহারা ওড়নায় ঢাকা। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। সাদা ওড়নায় ঢাকা সুগোল স্তনের আকার, হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা পরে যাওয়া কোমর আর সুগোল নিতম্ব, যেন আদিম বালির ঘড়ি দাঁড়িয়ে। সুভাষ মেয়েটার দেহের গড়ন আর কাজল কালো চোখ দেখে বুঝতে পারল কে ওইখানে দাঁড়িয়ে। সুভাষ সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঋতুপর্ণার কাছে যায়।
ঋতুপর্ণাকে গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে, “তুই পাগল হয়েছিস নাকি? কলেজ পালিয়ে কেন এসেছিস?”
ঋতুপর্ণা মুখের ওপর থেকে ওড়না সরিয়ে ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস সুভাষদা তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো।”
সুভাষ আকাশ থেকে পরে, “কি বলছিস জানিস?”
ঋতুপর্ণা ওর হাত ধরে কাতর কণ্ঠে বলে, “হ্যাঁ জানি। আর এটাও জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
সুভাষের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ঋতুপর্ণার বাজু শক্ত করে ধরে বলে, “তুই পাগল হয়ে গেছিস। তুই বাড়ি যা।”
ঋতুপর্ণা ধরা গলায় বলে, “তুমি সত্যি করে বলত যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
সুভাষের বুক ভেঙ্গে যায়। সেদিন তাহলে কে ওর আলু কাবলি উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল গাড়িতে করে। তাহলে কি ওর চোখের ভুল। অন্যদিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “না আমি তোকে একদম ভালোবাসি না। তুই বাড়ি যা।”
ঋতুপর্ণা ওর গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে করে বলে, “আমার চোখে চোখ রেখে বলো কেন তুমি সেদিন কলেজের সামনে ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলে।”
সুভাষ কি উত্তর দেবে। ও যে ঋতুপর্ণাকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু এই ভালোবাসার পরিণতি শুধু মাত্র কান্না ছাড়া আর কিছু নয়। সুভাষ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মিথ্যে বলে ঋতুপর্ণার কাছে, “অনিলের জন্য দুটো ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
চিবিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঋতুপর্ণা, “এত বড় মিথ্যে। আমি দেখেছি তুমি ওই ঠোঙা দুটো মাটিতে ফেলে দিয়েছিলে।”
সুভাষের চোখ জোড়া জলে ভরে যায়। মাথা ঝাঁকিয়ে ঋতুপর্ণাকে বলে, “কি বলব বল। তুই যা শুনতে চাস সেটা আমি তোকে দিতে পারি না।”
ঋতুপর্ণা মাথা ঝাঁকিয়ে ওর কলার ধরে টেনে বলে, “কেন বলতে পারো না, কে বাধা দিয়েছে তোমাকে।”
ঋতুপর্ণার গালে হাত দিয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে ধরা গলায় বলে, “বাড়ি যা ঋতু। দয়া করে বাড়ি ফিরে যা, লক্ষ্মীটি।”
“লক্ষ্মীটি” বলতেই ঋতুপর্ণার দেহ বয়ে এক শিহরণ খেলে যায়। দুইহাতে আঁকড়ে ধরে সুভাষকে। বুকের ওপরে মুখ গুঁজে ধরা গলায় বলে, “একটি বার বল তুমি আমাকে ভালোবাসো ব্যাস আমি চলে যাবো।”
রেশমি চুলে ঠোঁট চেপে সুভাষ শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা ব্যাক্ত করে দেয়, “হ্যাঁ তোকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
ওর লোমশ বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে ঋতুপর্ণা। “ব্যাস এই টুকু শুনতে চেয়েছিলাম।”
সুভাষ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “প্লিস এইবারে বাড়ি যা। বিবি দেখে ফেললে অথবা তোর দাদার কানে কথা উঠলে আমাদের লাশ দামোদরের জলে ভাসবে।”
কিছুতেই ওর বুক থেকে ছাড়ানো যায় না ঋতুপর্ণাকে, “মরতে হলে একসাথে মরব। চলো না কোথাও পালিয়ে যাই।”
কি করে সুভাষ। ইচ্ছে করে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে কিন্তু কোথায় যাবে। কোনোদিন অন্ডাল ছেড়ে বাইরে পা দেয়নি। অন্য শহরের কোথাও কাউকে চেনে না। পকেটে টাকা পয়সা নেই। ঋতুপর্ণার বয়স এখন অনেক কম। ধরা পরে গেলে পুলিস ওকে ধরে নিয়ে যাবে। ক্ষণিকের মধ্যে শত চিন্তা ভর করে আসে ওর মাথার মধ্যে। কিন্তু এইভাবে গাছের আড়ালে ওদের জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকতে কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবি।
সুভাষ ঋতুপর্ণাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আচ্ছা এখন তুই কলেজে ফিরে যা। তুই আমাকে কয়েকটা মাস সময় দে। আমি দেখছি কি করতে পারি।”
শেষ পর্যন্ত চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকায় ঋতুপর্ণা। “সত্যি বলছ?”
ঋতুপর্ণার কপালে ছোট চুমু খেয়ে আদর করে বলে, “তোর মতন পাগলী কে নিয়ে পালাতে হবে যখন তখন না হয় একবার দামোদরের জল দেখেই যাবো।”
ঋতুপর্ণা লাফিয়ে উঠে টুক করে সুভাষের দাড়ি ভর্তি গালে চুমু খেয়ে, লাজুক হেসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সুভাষ হতভম্বের মতন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালে ছোট একটা চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কলেজ থেকে পালালি কি করে?”
ঋতুপর্ণা হেসে বলে, “ওই কাজের মাসীটাকে দশ টাকা দিয়ে পালিয়ে এসেছি। এইবারে দশ টাকা দাও না হলে কলেজে ঢুকতে পারবো না।”
হেসে ফেলে সুভাষ। পকেট থেকে দশ টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, “সাবধানে যাস।”
খিলখিল করে হেসে ঋতুপর্ণা জবাব দেয়, “এই বারে সাবধান আর অসাবধান বলে কিছু নেই। যার কাছ থেকে যেটা শুনতে ইচ্ছে ছিল সেটা শুনে ফেলেছি। এইবারে দামোদরে ভাসতে রাজি আছি।”
ঋতুপর্ণার পা যেন আর মাটিতে পড়ছে না। নেচে ওঠে ওর সারা শরীর। ওরনায় সারা মুখ ঢেকে একটা রিক্সা চেপে উঠে চলে যায়। রিক্সাটা যতক্ষণ না মোড়ের আড়ালে হারিয়ে যায় ততক্ষণ ঋতুপর্ণা আর সুভাষ পরস্পরকে একভাবে দেখে যায়।
সুভাষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালে হাত বুলায়। মেয়েটা সত্যি মস্ত পাগল, তার সাথে ওকেও পাগল করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এর একটা বিহিত করতেই হবে। বাবা শুনলে ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। পাঁচ খানা ভাই বোন তাই কারুর ওপরেই বিশেষ খেয়াল নেই ওদের বাবা মায়ের। ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কোথায় পালাবে, কি খাওয়াবে। কিছু একটা করতেই হবে।
গুটিগুটি পায়ে দোকানে এসে বসে। এই দোকানে কাজ করে আজকাল দুই হাজার টাকা পায় তাতে পাঁচশো টাকা বাড়িতে দিতে হয়। হাজার টাকা ওর মাসের খরচে লাগে। এই কয় মাসে চার হাজার টাকা জমিয়েছে কিন্তু তাতে কতদিন চলবে। এই অন্ডালে থেকে ফটোতুলে জীবন কাটানো অসম্ভব। বিদ্যুৎ বাবুকে এলাকার সবাই চেনে। ওর মেয়েকে নিয়ে পালানো অর্থাৎ সাক্ষাৎ বাঘের মুখ থেকে মাংস ছিনিয়ে নেওয়ার মতন। বুক ঠুকে বেড়িয়ে পরে সুভাষ। ঋতুপর্ণার চোখে সত্যিকারের ভালোবাসার আগুন দেখেছে, এই আগুনে পতঙ্গের মতন ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত।
সারা রাত ঘুমাতে পারে না সুভাষ। এক এক করে অঙ্ক কষে, কি ভাবে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালানো যায়। কিছুতেই কিছু ভেবে উঠতে পারে না। পরেরদিন ভোরের বেলায় নিজের জামা কাপড় একটা ব্যাগে গুছিয়ে জমানো টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পরে নিরুদ্দেশের পানে। বের হওয়ার সময়ে মাকে বলে যায় কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছে ফিরতে হয়ত কয়েকদিন সময় লাগবে। ওর বাড়িতে এই সবের বিশেষ বালাই ছিল না তাই বেড়িয়ে যেতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। সাতদিন কোলকাতা ঘুরে বেড়িয়ে অনেক জায়গায় গিয়ে অনেকের কাছে গিয়েও সুভাষ কোন কাজ পেল না। অগত্যা সুভাষ বিফল মনোরথে সাতদিন পরে অন্ডাল ফিরে আসে।
স্টেসান থেকে বাড়ি আর যায় না। সোজা দোকানে চলে যায়। দোকানে পৌঁছাতেই অনিলের বাবা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মিথ্যে বানিয়ে গল্প বলে সুভাষ, ওর কোন বন্ধুর কাকা মারা গিয়েছে তাই দুর্গাপুরে গিয়েছিল। অনিলের সেই কথা বিশ্বাস হয় না। সুভাষ আর অনিলের বন্ধুত্ত অনেকদিনের।
রাতের বেলা অনিল ওকে চেপে ধরে, “সত্যি করে বল’ত কোথায় পালিয়ে ছিলিস?”
ঋতুপর্ণার কথা লুকিয়ে সুভাষ ওকে বলে, “একটা কাজ চাই রে তাই কোলকাতা গিয়েছিলাম। কিন্তু শালা কেউ কাজ দিতে চায় না। ওইখানে শালা টাকা ওড়ে মাইরি। কিন্তু শালা ঠিক রাস্তা না জানলে সেই টাকা কেউ ধরতে পারে না।”
অনিল ওর পিঠ থাবড়ে জিজ্ঞেস করে, “হটাত তোর টাকার দরকার হল কিসে? এরপরে এই ফটোর দোকান তুই আর আমি মিলেই চালাবো।”
সুভাষ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “না রে আমার অন্ডালে থাকলে হবে না। আমাকে অনেক বড় হতে হবে।”
সুভাষের কণ্ঠ স্বর শুনে অনিল বুঝতে পারে শুধু মাত্র টাকা অর্জনের জন্য সুভাষ কোলকাতা যায়নি এর পেছনে আর কিছু মতলব লুকিয়ে আছে যেটা সুভাষ ওকে খোলসা করে বলতে চাইছে না।
এই সাত দিনে রোজ দিন ঋতুপর্ণা, গাড়ি করে কলেজে যাওয়ার পথে সারাটা রাস্তা জালানার বাইরে তাকিয়ে থাকত। ওর দুই বড় বড় উৎসুক নয়ন শুধু মাত্র সুভাষকে খুঁজে বেড়াত। সাতদিন হয়ে গেল কিন্তু ওর দেখা নেই দেখে খুব মুষড়ে পরে। সত্যি ভালোবাসা বড় বেদনা ময়। এটা জানে যে এই মিলন হয়ত শুধুই পরী কথার মতন অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। সিনেমার পর্দায় দেখা যায় একজন বড়োলোকের মেয়েকে নিয়ে এক গরীব ছেলে পালিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় কি সেটা কখন সম্ভব। অন্তত এই মফঃস্বল শহরে সেটা কখনই সম্ভব নয়। এই শহরে ওর বাবাকে ওর দাদাকে ওর কাকাকে ওদের পরিবারকে সবাই চেনে। যদি সুভাষের সাথে পালাতেও যায় তাহলে ধরা পরে যাবে আর তাতে হয়ত ওদের মৃত্যু হতেও পারে। সুভাষ কি তাহলে এই শহর ছেড়ে ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেল।
কিন্তু সুভাষ ওইদিকে বসে ছিল না। ওর মাথার ভেতরে শুধু একটা মাত্র চিন্তা, কি করে ওর ভালবাসাকে এই শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়। ঋতুপর্ণার সাথে দেখা করা অসম্ভব ব্যাপার। অবশ্য তার আগে ওকে একটা কাজ খুঁজতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কয়েকদিন পরে সুভাষ একটা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে। কোলকাতার একজন নাককরা ফটোগ্রাফার একজন এসিস্টেন্টের খোঁজ করছে। সঙ্গে সঙ্গে সেইদিনেই সুভাষ কোলকাতা চলে যায়।
আদি মাথা দোলায়, “পাপা, এরপরে তুমি আর মা পালিয়েছিলে তাই ত।”
সুভাষ ম্লান হেসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, “হ্যাঁ। তারপরে আমি কোলকাতায় সেই ফটোগ্রাফার বন্ধু, অতিন্দ্রর কাছে এসিস্টেন্টের কাজ পাই। তারপরে একদিন আমি তোর মাকে নিয়ে কোলকাতা পালিয়ে চলে আসি।” কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে সুভাষ। তারপরে জল ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে, “এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? যদি বলি আই সি ইউতে যে শুয়ে আছে সে তোর জন্মদাত্রী মা নয়।”
আদির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। আদি চাপা গলায় আঁতকে ওঠে, “পাপা... একি বলছ তুমি।”
সুভাষ চোয়াল চেপে আলতো মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, সত্যি বলছি।”
আদি চোখে অন্ধকার দেখে। চোখ বুজে দুইহাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতন বসে পরে।
সুভাষ ম্লান হেসে বলে, “দরকার না থাকলে কেন বলতে যাবো বল। একটু তোর পাপার কথাও শোন, না হলে কি করে বুঝবি।”
আদি চেয়ারে বসে বলে, “আচ্ছা বলো আমি শুনছি।”
সুভাষ আবার শুরু করে তার কাহিনী। এইবারে সুভাষ বেশ কয়েক মাস এগিয়ে যায়। এর মাঝে এক বিবাহ অনুষ্ঠানে সুভাষের সাথে ঋতুপর্ণার দেখা হয়েছিল তবে বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। সেই অনুষ্ঠানে সুভাষ চুপচাপ ফটো তোলার দিকে মনোনিবেশ করে। একা একা এদিকে ওদিকে ঘুরে ফিরে ফটো তুলতে ব্যাস্ত হয়ে যায় সুভাষ।
বড় যাত্রী যাওয়ার আগে সুভাষ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময়ে ওর পেছনে এসে দাঁড়ায় ঋতুপর্ণা। মিষ্টি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে খানিক অভিমান ভরা গলায় বলে, “সেদিন আলু কাবলি খাওয়ালে না কেন?”
সুভাষের কানে যেন কেউ মধু ঢেলে দিয়েছে। সুভাষ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “তোর পরীক্ষার দেরি হয়ে যেত তাই।” আসলে সেদিন সুভাষের পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা পড়েছিল। দুই টাকার আলু কাবলি কিনলে সারাদিনে ওর আর বিড়ি খাওয়ার পয়সা হত না।
চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে ঋতুপর্ণা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তাই নাকি। এত চিন্তা এই মেয়েটার জন্য?”
সুভাষ কি বলবে ভেবে পায়নি। মুচকি হেসে ওকে উত্তর দেয়, “আরে হ্যাঁ রে বাবা। এখন এইভাবে এইখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যা। অন্য কেউ দেখতে পেলে কিছু একটা ভেবে বসবে।”
ঋতুপর্ণার চেহারা হটাত করে বিষণ্ণ হয়ে যায়, “কেন, দেখে ফেললে কি হবে? তোমার কি দাদ হাজা হয়েছে যে তোমার সাথে কথা বলা বারন?”
কি উত্তর দেবে সুভাষ, জানে না। এলাকার ধনী ঘরের মেয়ে একজন সামান্য ফটো গ্রাফারের সাথে নিভৃতে একান্তে কথা বলছে সেটা কারুর নজরে আসলে ভুরু উঁচিয়ে যাবেই। ঠিক তাই হল। অনিল ওদের দেখে ফেলে।
এগিয়ে আসে ওদের দিকে, “কি রে এইখানে কি করছিস? বর একটু পরেই গাড়িতে উঠবে।”
ঋতুপর্ণা অনিলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে চুপচাপ ওইখান থেকে চলে যায়। ঋতুপর্ণার বিষণ্ণ চেহারা দেখে সুভাষের বুক ভেঙ্গে যায়। কিন্তু অনিলের চলে আসার ফলে ওকে আর বাধা দিতে পারেনা।
ঋতুপর্ণা চলে যেতেই অনিল ওকে সাবধান করে দেয়, “কেন মিছিমিছি মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিস। তোর পকেটে কানাকড়ি নেই আর ঋতুপর্ণা বিপুল প্রাচুর্যে বড় হয়েছে। যদিও প্রেম করিস তাহলে ওকে খাওয়াবি কি। ভেবে দেখেছিস একবার। মেয়েটা এখন অনেক ছোট, ওকে বিয়ে করতে হলে আগে তোকে দাঁড়াতে হবে ওকে সেই বয়সে যেতে হবে। ততদিনে মতিগতি বদলে যাবে। কাজে মন দে। চল ওইদিকে।”
অনিলের কথার কোন উত্তর দেয় না সুভাষ। চুপচাপ বরের গাড়ির দিকে চলে যায় ফটো তুলতে। তবে ঋতুপর্ণার বিষণ্ণ চেহারা ওর বুকে দাগ কেটে চলে যায়। সেদিনের পরে আর ঋতুপর্ণার সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু সুভাষের আর স্বস্তি ছিল না। বিয়ে বউভাতে প্রচুর ফটো তুলেছিল ঠিক, মাঝে মাঝে ঋতুপর্ণার ফটোও তুলেছিল কিন্তু ঋতুপর্ণা আর ওর কাছে আসেনি।
কলেজের পরীক্ষার পরে শীতের ছুটি পরে যায়। একমাস কেটে যায়। ঋতুপর্ণা ছুটিতে দাদা বৌদির সাথে সিমলা কুল্লু মানালি বেড়াতে যায় সেইবারে। সুভাষ মাঝে মাঝেই সাইকেল নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত, যদি ঋতুপর্ণা গাড়িতে করে ওর সামনে দিয়ে যায়, যদি একবার ক্ষণিকের জন্য একটু দর্শন পায়। সুভাষ যে সত্যি ঋতুপর্ণার রূপে, ঋতুপর্ণার চোখের ভাষায়, ঋতুপর্ণার মিষ্টি আদুরে কণ্ঠ স্বরের প্রেমে পরে গেছে।
শীতের ছুটির পরে কলেজ খুলল। ঋতুপর্ণা ক্লাস টেনে উঠল। ছুটির পরে প্রথম যেদিন ঋতুপর্ণা গাড়ি করে কলেজ গেল সেদিন সুভাষ সাইকেল নিয়ে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়েছিল। ঋতুপর্ণা গাড়ির জানালা দিয়ে একবার উঁকি মেরে ওর দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু হাত নাড়ায় নি। বড় কষ্ট পেয়েছিল সুভাষ। বুকটা হুহু করে উঠেছিল। সারাদিন দোকানে বসে ভাবে, এই অভিমানী ললনাকে কি করে শান্ত করা যায়। বিকেলের দিকে এক সময়ে আপনমনে সাইকেল নিয়ে মেয়েদের কলেজে চলে যায়। ছুটির সময়ে গেটের কাছে আলু কাবলি ওয়ালা, ফুচকাওয়ালা ঝালমুড়ি ওয়ালা দের ভিড় জমে ওঠে। সুভাষ দুটো আলু কাবলি কিনে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতুপর্ণার অপেক্ষায়। যদিও জানে হয়ত ঋতুপর্ণা কলেজ থেকে বেড়িয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বাড়ি চলে যাবে তাও সুভাষ দাঁড়িয়ে থাকে।
কলেজ ছুটি হয় আর সুভাষের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। ঋতুপর্ণা বাকি মেয়েদের সাথে গেট থেকে বেড়িয়ে গাড়ির দিকে যায়। মাঝে মাঝে আশে পাশের মেয়েদের দিকে তাকায়। ওদের ড্রাইভার রঞ্জন ওর হাত থেকে কলেজের ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে রেখে ঋতুপর্ণার জন্য অপেক্ষা করে। “চলে এসো মামনি, দিদিমনি অপেক্ষা করছে।”
ঋতুপর্ণা হাত নাড়িয়ে উদাস কণ্ঠে বান্ধবীদের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই আসছি কাকু।”
গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময়ে ওর চোখ পরে অদুরে দাঁড়িয়ে থাকা সুভাষের দিকে। সুভাষ দুই হাতে দুটো আলু কাব্লির ঠোঙ্গা নিয়ে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। চোখের মণির সাথে চোখের মণি মিলে যেতেই থমকে যায় ঋতুপর্ণা। ওর বুক হুহু করে ওঠে। মানুষটা সত্যি তাহলে ওর জন্য আলু কাবলি কিনে দাঁড়িয়ে। আলতো মাথা দোলায় ঋতুপর্ণা, কিছু বলতে চেষ্টা করে। ঠিক তখনি রঞ্জন আবার ঋতুপর্ণাকে ডাক দেয়। “মামনি দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার নাচের ক্লাসে যেতে হবে না।”
সুভাষের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চোয়াল চেপে আক্ষেপ করে মাথা নাড়ায় ঋতুপর্ণা। যেন বলতে চাইল, “আমি নিরুপায় সুভাষদা।” মন চাইছিল এক দৌড়ে সুভাষের কাছে চলে যেতে। ওর হাত ধরে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে। কিন্তু পায়ে যে সোনার বেড়ি বাঁধা।
গাড়িতে উঠে নিস্পলক নয়নে সুভাষের দিকে তাকিয়ে থাকে ঋতুপর্ণা। সুভাষ স্থানুর মতন দুই হাতে দুটো ঠোঙ্গা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওর দুই পা কে যেন পেরেক দিয়ে মাটির সাথে গেঁথে দিয়েছে। রাগে দুঃখে সেই দুটো ঠোঙা মাটিতে ফেলে পায়ের তলায় মুচড়ে দিল সুভাষ। গাড়ির মধ্যে বসে থাকা ঋতুপর্ণা, দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। চাইলেও যে ওর কাছে যেতে পারবে না। দুইজনের মাঝের সামাজিক বৈষম্যের অলঙ্ঘনীয় এক প্রাচীর দাঁড়িয়ে।
গাড়িটা হুস করে ওর পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে চলে গেল। ঋতুপর্ণা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। সেটা আর সুভাষের নজরে গেল না। সুভাষ শুধু মাত্র দেখল যে, ঋতুপর্ণা ওর আলু কাবলি উপেক্ষা করে গাড়িতে উঠে চলে গেছে। সুভাষ আর পেছনে ফিরে তাকাল না। সেদিন রাতে অনিলের সাথে মদে চুড় হয়ে পিঙ্কির কোঠাতে গিয়ে পিঙ্কিকে আস্টেপিস্টে যৌন সঙ্গমে মেতে উঠেছিল। বারেবারে ঋতুপর্ণাকে গালি দিয়েছিল সেদিন রাতে। অনিল বুঝেছিল ওর মনের দুঃখটা। শেষ রাতে পিঙ্কি শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরার পরে অনিল আর সুভাষ ওর কোঠা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল অন্ধকার রাস্তায়।
অনিল ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, “আমাদের দেখে যাওয়া ছাড়া আর কাজ নেই বুঝলি। ওই মেয়ে তোর জন্য জন্মায়নি। ওই মেয়ে তোর বুক চিরে বেড়িয়ে যাবে।”
সারা রাত চোখের পাতা এক করেনি ঋতুপর্ণা। একা ঘরে খিল দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিল সেই রাতে। লোহার শিক ভেঙ্গে ঘন নীল আকাশে পাখীর মতন বিচরন করা হয়ত ওর কপালে নেই। এই ক্লাস টেনে উঠবে, তারপরে বাবা মায়ের চাপাচাপির ফলে হয়ত বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে। বাবা আর বড়দা দুইজনে ইঞ্জিনিয়ার, ছোড়দা ডাক্তারি পড়ছে। কিন্তু ওর মাথায় অঙ্ক বিজ্ঞান একদম ঢোকেনা। নাচ শিখতে চায়, শান্তিনিকেতনে যেতে চায়। ঋতুপর্ণা পাখী হতে চায়, মেঘের ভেলায় ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় দুর দেশে। পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করতে চায়, কোকিলের কুহু ধ্বনির সাথে গলা মিলিয়ে জ্ঞান গাইতে চায়। কিন্তু বাবাকে বড়দাকে কে বুঝাবে।
সুভাষ রোজ রাতে মদ খায়। এখন পর্যন্ত কেউ কারুর হাত পর্যন্ত ধরেনি কিন্তু দুইপাশে প্রেমের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। এই আগুনে ভস্মীভূত হওয়া ছাড়া ওদের কাছে আর কোন পথ খোলা নেই। সুভাষ নিজের ভবিতব্যকে মেনে নেয়। মদের নেশায় ঋতুপর্ণাকে ভুলে থাকতে প্রবল চেষ্টা চালায়।
সেদিন দুপুরের দিকে দোকানে একা একা বসে ছিল সুভাষ। দুপুরে কেউ ফটো তুলতে আসেনা। এমন সময়ে একটা আদিবাসী ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে ওর দোকানে বলে, “সুভাষ দা, সুভাষ দা তোমারে একজন ডাকতিছে।”
সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “কে ডাকছে, কোথায় ডাকছে?”
ছেলেটা দূরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, “ওই মেয়িডা তোমায় ডাকতিছে।”
দুর থেকে মেয়েটাকে দেখে সুভাষ থমকে দাঁড়িয়ে পরে। কলেজের সাদা সালোয়ার কামিজ, গায়ে একটা ভারী নীল রঙের সোয়েটার, সম্পূর্ণ চেহারা ওড়নায় ঢাকা। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। সাদা ওড়নায় ঢাকা সুগোল স্তনের আকার, হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা পরে যাওয়া কোমর আর সুগোল নিতম্ব, যেন আদিম বালির ঘড়ি দাঁড়িয়ে। সুভাষ মেয়েটার দেহের গড়ন আর কাজল কালো চোখ দেখে বুঝতে পারল কে ওইখানে দাঁড়িয়ে। সুভাষ সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঋতুপর্ণার কাছে যায়।
ঋতুপর্ণাকে গাছের আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে, “তুই পাগল হয়েছিস নাকি? কলেজ পালিয়ে কেন এসেছিস?”
ঋতুপর্ণা মুখের ওপর থেকে ওড়না সরিয়ে ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস সুভাষদা তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো।”
সুভাষ আকাশ থেকে পরে, “কি বলছিস জানিস?”
ঋতুপর্ণা ওর হাত ধরে কাতর কণ্ঠে বলে, “হ্যাঁ জানি। আর এটাও জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
সুভাষের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ঋতুপর্ণার বাজু শক্ত করে ধরে বলে, “তুই পাগল হয়ে গেছিস। তুই বাড়ি যা।”
ঋতুপর্ণা ধরা গলায় বলে, “তুমি সত্যি করে বলত যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”
সুভাষের বুক ভেঙ্গে যায়। সেদিন তাহলে কে ওর আলু কাবলি উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল গাড়িতে করে। তাহলে কি ওর চোখের ভুল। অন্যদিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “না আমি তোকে একদম ভালোবাসি না। তুই বাড়ি যা।”
ঋতুপর্ণা ওর গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে করে বলে, “আমার চোখে চোখ রেখে বলো কেন তুমি সেদিন কলেজের সামনে ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলে।”
সুভাষ কি উত্তর দেবে। ও যে ঋতুপর্ণাকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু এই ভালোবাসার পরিণতি শুধু মাত্র কান্না ছাড়া আর কিছু নয়। সুভাষ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মিথ্যে বলে ঋতুপর্ণার কাছে, “অনিলের জন্য দুটো ঠোঙা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
চিবিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঋতুপর্ণা, “এত বড় মিথ্যে। আমি দেখেছি তুমি ওই ঠোঙা দুটো মাটিতে ফেলে দিয়েছিলে।”
সুভাষের চোখ জোড়া জলে ভরে যায়। মাথা ঝাঁকিয়ে ঋতুপর্ণাকে বলে, “কি বলব বল। তুই যা শুনতে চাস সেটা আমি তোকে দিতে পারি না।”
ঋতুপর্ণা মাথা ঝাঁকিয়ে ওর কলার ধরে টেনে বলে, “কেন বলতে পারো না, কে বাধা দিয়েছে তোমাকে।”
ঋতুপর্ণার গালে হাত দিয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে ধরা গলায় বলে, “বাড়ি যা ঋতু। দয়া করে বাড়ি ফিরে যা, লক্ষ্মীটি।”
“লক্ষ্মীটি” বলতেই ঋতুপর্ণার দেহ বয়ে এক শিহরণ খেলে যায়। দুইহাতে আঁকড়ে ধরে সুভাষকে। বুকের ওপরে মুখ গুঁজে ধরা গলায় বলে, “একটি বার বল তুমি আমাকে ভালোবাসো ব্যাস আমি চলে যাবো।”
রেশমি চুলে ঠোঁট চেপে সুভাষ শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা ব্যাক্ত করে দেয়, “হ্যাঁ তোকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
ওর লোমশ বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে ঋতুপর্ণা। “ব্যাস এই টুকু শুনতে চেয়েছিলাম।”
সুভাষ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “প্লিস এইবারে বাড়ি যা। বিবি দেখে ফেললে অথবা তোর দাদার কানে কথা উঠলে আমাদের লাশ দামোদরের জলে ভাসবে।”
কিছুতেই ওর বুক থেকে ছাড়ানো যায় না ঋতুপর্ণাকে, “মরতে হলে একসাথে মরব। চলো না কোথাও পালিয়ে যাই।”
কি করে সুভাষ। ইচ্ছে করে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে কিন্তু কোথায় যাবে। কোনোদিন অন্ডাল ছেড়ে বাইরে পা দেয়নি। অন্য শহরের কোথাও কাউকে চেনে না। পকেটে টাকা পয়সা নেই। ঋতুপর্ণার বয়স এখন অনেক কম। ধরা পরে গেলে পুলিস ওকে ধরে নিয়ে যাবে। ক্ষণিকের মধ্যে শত চিন্তা ভর করে আসে ওর মাথার মধ্যে। কিন্তু এইভাবে গাছের আড়ালে ওদের জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকতে কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবি।
সুভাষ ঋতুপর্ণাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আচ্ছা এখন তুই কলেজে ফিরে যা। তুই আমাকে কয়েকটা মাস সময় দে। আমি দেখছি কি করতে পারি।”
শেষ পর্যন্ত চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে বুকের ওপর থেকে মুখ তুলে তাকায় ঋতুপর্ণা। “সত্যি বলছ?”
ঋতুপর্ণার কপালে ছোট চুমু খেয়ে আদর করে বলে, “তোর মতন পাগলী কে নিয়ে পালাতে হবে যখন তখন না হয় একবার দামোদরের জল দেখেই যাবো।”
ঋতুপর্ণা লাফিয়ে উঠে টুক করে সুভাষের দাড়ি ভর্তি গালে চুমু খেয়ে, লাজুক হেসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সুভাষ হতভম্বের মতন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর গালে ছোট একটা চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কলেজ থেকে পালালি কি করে?”
ঋতুপর্ণা হেসে বলে, “ওই কাজের মাসীটাকে দশ টাকা দিয়ে পালিয়ে এসেছি। এইবারে দশ টাকা দাও না হলে কলেজে ঢুকতে পারবো না।”
হেসে ফেলে সুভাষ। পকেট থেকে দশ টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, “সাবধানে যাস।”
খিলখিল করে হেসে ঋতুপর্ণা জবাব দেয়, “এই বারে সাবধান আর অসাবধান বলে কিছু নেই। যার কাছ থেকে যেটা শুনতে ইচ্ছে ছিল সেটা শুনে ফেলেছি। এইবারে দামোদরে ভাসতে রাজি আছি।”
ঋতুপর্ণার পা যেন আর মাটিতে পড়ছে না। নেচে ওঠে ওর সারা শরীর। ওরনায় সারা মুখ ঢেকে একটা রিক্সা চেপে উঠে চলে যায়। রিক্সাটা যতক্ষণ না মোড়ের আড়ালে হারিয়ে যায় ততক্ষণ ঋতুপর্ণা আর সুভাষ পরস্পরকে একভাবে দেখে যায়।
সুভাষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালে হাত বুলায়। মেয়েটা সত্যি মস্ত পাগল, তার সাথে ওকেও পাগল করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু এর একটা বিহিত করতেই হবে। বাবা শুনলে ওকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। পাঁচ খানা ভাই বোন তাই কারুর ওপরেই বিশেষ খেয়াল নেই ওদের বাবা মায়ের। ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কোথায় পালাবে, কি খাওয়াবে। কিছু একটা করতেই হবে।
গুটিগুটি পায়ে দোকানে এসে বসে। এই দোকানে কাজ করে আজকাল দুই হাজার টাকা পায় তাতে পাঁচশো টাকা বাড়িতে দিতে হয়। হাজার টাকা ওর মাসের খরচে লাগে। এই কয় মাসে চার হাজার টাকা জমিয়েছে কিন্তু তাতে কতদিন চলবে। এই অন্ডালে থেকে ফটোতুলে জীবন কাটানো অসম্ভব। বিদ্যুৎ বাবুকে এলাকার সবাই চেনে। ওর মেয়েকে নিয়ে পালানো অর্থাৎ সাক্ষাৎ বাঘের মুখ থেকে মাংস ছিনিয়ে নেওয়ার মতন। বুক ঠুকে বেড়িয়ে পরে সুভাষ। ঋতুপর্ণার চোখে সত্যিকারের ভালোবাসার আগুন দেখেছে, এই আগুনে পতঙ্গের মতন ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত।
সারা রাত ঘুমাতে পারে না সুভাষ। এক এক করে অঙ্ক কষে, কি ভাবে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে পালানো যায়। কিছুতেই কিছু ভেবে উঠতে পারে না। পরেরদিন ভোরের বেলায় নিজের জামা কাপড় একটা ব্যাগে গুছিয়ে জমানো টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পরে নিরুদ্দেশের পানে। বের হওয়ার সময়ে মাকে বলে যায় কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছে ফিরতে হয়ত কয়েকদিন সময় লাগবে। ওর বাড়িতে এই সবের বিশেষ বালাই ছিল না তাই বেড়িয়ে যেতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। সাতদিন কোলকাতা ঘুরে বেড়িয়ে অনেক জায়গায় গিয়ে অনেকের কাছে গিয়েও সুভাষ কোন কাজ পেল না। অগত্যা সুভাষ বিফল মনোরথে সাতদিন পরে অন্ডাল ফিরে আসে।
স্টেসান থেকে বাড়ি আর যায় না। সোজা দোকানে চলে যায়। দোকানে পৌঁছাতেই অনিলের বাবা ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মিথ্যে বানিয়ে গল্প বলে সুভাষ, ওর কোন বন্ধুর কাকা মারা গিয়েছে তাই দুর্গাপুরে গিয়েছিল। অনিলের সেই কথা বিশ্বাস হয় না। সুভাষ আর অনিলের বন্ধুত্ত অনেকদিনের।
রাতের বেলা অনিল ওকে চেপে ধরে, “সত্যি করে বল’ত কোথায় পালিয়ে ছিলিস?”
ঋতুপর্ণার কথা লুকিয়ে সুভাষ ওকে বলে, “একটা কাজ চাই রে তাই কোলকাতা গিয়েছিলাম। কিন্তু শালা কেউ কাজ দিতে চায় না। ওইখানে শালা টাকা ওড়ে মাইরি। কিন্তু শালা ঠিক রাস্তা না জানলে সেই টাকা কেউ ধরতে পারে না।”
অনিল ওর পিঠ থাবড়ে জিজ্ঞেস করে, “হটাত তোর টাকার দরকার হল কিসে? এরপরে এই ফটোর দোকান তুই আর আমি মিলেই চালাবো।”
সুভাষ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “না রে আমার অন্ডালে থাকলে হবে না। আমাকে অনেক বড় হতে হবে।”
সুভাষের কণ্ঠ স্বর শুনে অনিল বুঝতে পারে শুধু মাত্র টাকা অর্জনের জন্য সুভাষ কোলকাতা যায়নি এর পেছনে আর কিছু মতলব লুকিয়ে আছে যেটা সুভাষ ওকে খোলসা করে বলতে চাইছে না।
এই সাত দিনে রোজ দিন ঋতুপর্ণা, গাড়ি করে কলেজে যাওয়ার পথে সারাটা রাস্তা জালানার বাইরে তাকিয়ে থাকত। ওর দুই বড় বড় উৎসুক নয়ন শুধু মাত্র সুভাষকে খুঁজে বেড়াত। সাতদিন হয়ে গেল কিন্তু ওর দেখা নেই দেখে খুব মুষড়ে পরে। সত্যি ভালোবাসা বড় বেদনা ময়। এটা জানে যে এই মিলন হয়ত শুধুই পরী কথার মতন অলীক স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। সিনেমার পর্দায় দেখা যায় একজন বড়োলোকের মেয়েকে নিয়ে এক গরীব ছেলে পালিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় কি সেটা কখন সম্ভব। অন্তত এই মফঃস্বল শহরে সেটা কখনই সম্ভব নয়। এই শহরে ওর বাবাকে ওর দাদাকে ওর কাকাকে ওদের পরিবারকে সবাই চেনে। যদি সুভাষের সাথে পালাতেও যায় তাহলে ধরা পরে যাবে আর তাতে হয়ত ওদের মৃত্যু হতেও পারে। সুভাষ কি তাহলে এই শহর ছেড়ে ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেল।
কিন্তু সুভাষ ওইদিকে বসে ছিল না। ওর মাথার ভেতরে শুধু একটা মাত্র চিন্তা, কি করে ওর ভালবাসাকে এই শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়। ঋতুপর্ণার সাথে দেখা করা অসম্ভব ব্যাপার। অবশ্য তার আগে ওকে একটা কাজ খুঁজতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কয়েকদিন পরে সুভাষ একটা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে। কোলকাতার একজন নাককরা ফটোগ্রাফার একজন এসিস্টেন্টের খোঁজ করছে। সঙ্গে সঙ্গে সেইদিনেই সুভাষ কোলকাতা চলে যায়।
আদি মাথা দোলায়, “পাপা, এরপরে তুমি আর মা পালিয়েছিলে তাই ত।”
সুভাষ ম্লান হেসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, “হ্যাঁ। তারপরে আমি কোলকাতায় সেই ফটোগ্রাফার বন্ধু, অতিন্দ্রর কাছে এসিস্টেন্টের কাজ পাই। তারপরে একদিন আমি তোর মাকে নিয়ে কোলকাতা পালিয়ে চলে আসি।” কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে সুভাষ। তারপরে জল ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলে, “এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? যদি বলি আই সি ইউতে যে শুয়ে আছে সে তোর জন্মদাত্রী মা নয়।”
আদির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। আদি চাপা গলায় আঁতকে ওঠে, “পাপা... একি বলছ তুমি।”
সুভাষ চোয়াল চেপে আলতো মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, সত্যি বলছি।”
আদি চোখে অন্ধকার দেখে। চোখ বুজে দুইহাতে মুখ ঢেকে চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতন বসে পরে।