26-09-2020, 08:27 PM
পর্ব সাত
তিস্তার সাথে গল্প করলেও আদির মন পরে থাকে ওর রূপসী মায়ের কাছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিস্তার নরম পাছার আর নরম স্তন জোড়া আদর করতে করতে ওরা দুইজনেই আবার কামোত্তেজিত হয়ে ওঠে। তৃষ্ণার্ত দুই নর নারী আবার মেতে ওঠে কামনার খেলায়। এইবারে দুইজনেই বেশ সময়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের শরীর নিয়ে মেতে ওঠে।
বিকেল ছ’টা বাজে, এমন সময়ে আদির ফোন বেজে ওঠে। একটা অজানা ফোন নাম্বার থেকে ফোন আসায় আদি একটু বিরক্ত হয়ে যায়। কামসুখে পরিতৃপ্ত হয়ে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল এরমাঝে উটকো ফোন দেখে মাথা গরম হয়ে যায়।
ফোন তুলে বিরক্তি ভরা গলায় জিজ্ঞেস করে, “হ্যালো কে বলছেন?”
ওইপাশের অজানা আগন্তুকের কণ্ঠ স্বর, “হ্যালো, আপনি কি মিস্টার আদিত্য সান্যাল?”
আদি উত্তর দেয়, “হ্যাঁ। কি ব্যাপার আপনি কে?”
আগন্তুক উত্তর দেয়, “আপনি ঋতুপর্ণা নামে কাউকে চেনেন?”
হটাত এক অজানা অচেনা ব্যাক্তির মুখে মায়ের নাম শুনে আশঙ্কায় আদির বুক কেঁপে ওঠে। তিস্তাকে ছেড়ে উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়িয়ে আগন্তুককে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ, আমার মা। কেন মায়ের কি হয়েছে?”
আগন্তুক উত্তর দেয়, “তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসুন। আপনার মায়ের গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
আদির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। মাথা ঝিমঝিম করে আসে। সমগ্র পৃথিবীতে মা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। না, একটু ভুল ভাবনা, হয়ত বাবা ওর পাশে থাকবে। তবে মায়ের এই দুর্দিনে ওদের পাশে সত্যি কি এসে দাঁড়াবে। সেটা আদৌ আদি জানে না। চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে। কঠিন চোয়াল, দাঁতে দাঁত পিষে অশ্রু সংবরণ করে আগন্তুক কে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে? কোথায় হয়েছে?”
আগন্তুক শুধু মাত্র হস্পিটালের নাম জানিয়ে ওকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে। তিস্তা আদির চেহারা দেখে উৎকণ্ঠা ব্যাক্ত করে। কিন্তু আদির নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হয়। কেন মাকে একা ছাড়তে গেল। যদি মাকে একটু রাজি করানো যেত তাহলে হয়ত মা প্রদীপের সাথে দেখা করতে যেত না। কিন্তু আদির যৌন তৃষ্ণা বড় বেড়ে গিয়েছিল। ওর লিঙ্গ এক যোনি রসে মাখামাখি করার জন্য উঠে পরে লেগেছিল। চোয়াল চেপে তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পরে নেয়। তিস্তা ওকে কারন জিজ্ঞেস করাতে আদি সংক্ষেপে জানায় যে মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেই শুনে তিস্তা আঁতকে ওঠে।
আদি ছলছল চোখে তিস্তাকে অনুরোধ করে ওর সাথে হসপিটাল যেতে। তিস্তা কৌশিকের আসার আছিলা দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। বলে ওদের সাথে দেখা হওয়ার কোন কথাই কৌশিক জানে না সুতরাং এমত অবস্থায় কিছুতেই আদির সাথে হসপিটালে যেতে পারবে না বলে আক্ষেপ ব্যাক্ত করে। আদির শরীর তিস্তার প্রতি ঘৃণায় রিরি করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে তিস্তার সাথে ঝগড়া করার মতন মানসিকতা ওর থাকে না।
জামা প্যান্ট পড়তে পড়তে আদি তিস্তার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “সত্যি তোমার মতন সুবিধাবাদী মেয়ে আর দুটো দেখিনি।”
তিস্তা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ওকে বুঝাতে চেষ্টা করে, “প্লিস আদি একটু বোঝার চেষ্টা করো। কৌশিক সত্যি জানে না তুমি আমার কাছে এসেছো। প্লিস, আদি। ঋতুপর্ণা দিকে আমি সত্যি খুব সন্মান করি। তুমি যাও, আমি কৌশিককে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছে যাবো।”
আদি চোয়াল চেপে তিস্তাকে উত্তর দেয়, “না আর অত দরদ দেখাতে এসো না। আমি চললাম।”
তিস্তা ওকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে কৌশিক ফিরে এলে ওকে সঙ্গে নিয়ে হসপিটাল যাবে। কিন্তু আদি আর দাঁড়ায় না। এক দৌড়ে বাইরে এসে দেখে আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি করে হসপিটাল পৌঁছে যায়।
হসপিটালে পৌঁছাতেই এদিক ওদিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে যে ওর মা গাড়ি এক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হয়েছে। এমারজেন্সিতে গিয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন আগন্তুক ওর দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেয়। “আমি রবিন। আপনার মায়ের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে।” আদি মাথা চেপে বসে পরে।
রবিন আদির কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আপনার মা একটা রেড লাইট জাম্প করেছিল। অন্যদিক থেকে একটা বাস এসে গাড়ির ডান দিকে ধাক্কা মারে। রাস্তার ওপরে গাড়িটা পালটি খেয়ে যায়। সিট বেল্ট বাঁধা না থকার ফলে আপনার মা বামদিকের সিটের ওপরে পরে যায়। গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে মাথায়, গালে গলায় ঢুকে গেছে। লোকজন ছুটে আসে আপনার মাকে বাঁচাতে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে শুধু মাত্র আপনার নাম নিয়েছিল। ওনার মোবাইল থেকে আপনার নাম বের করে আমি আপনাকে ফোন করি। তারপরে পুলিস আর এ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে এই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।”
আদি রবিন বাবুর হাত ধরে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, “আমার মা বেঁচে যাবে ত?”
রবিন বাবু খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলেন, “দেখুন আমি ডাক্তার নই তবে ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওপর ওয়ালার ওপরে ভরসা রাখুন আপনার মা ঠিক হয়ে যাবে।”
ডাক্তারেরা মাকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে চলে গেছে। আদি অপারেশান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে মাথা ঠোকে। নিজেকে দোষারোপ করে। কেন মাকে একা ছাড়ল, কেন মাকে বুঝাতে পারল না যে প্রদীপের কাছে না গিয়ে ওর সাথে বিকেলটা বাড়িতে কাটাতে। কেন নিজের যৌন ক্ষুধার তাড়নায় তিস্তার কাছে গেল। ইত্যাদি ভেবে নিজেকে দোষারোপ করে আদি।
উৎকণ্ঠায় আর প্রচন্ড আশঙ্কায় আদির গলা শুকিয়ে আসে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাঝে মাঝে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আবার কখন দুরদার করে হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করে দেয়। আত্মীয় সজ্জন বলতে ওর কেউ নেই। সাহায্যের জন্য কাকে ফোন করবে ভাবতে ভাবতে আদি কমল জেঠুকে ফোন করে সব জানাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কমল জেঠু কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে চলে আসেন। কমল জেঠু ওকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে ঋতুপর্ণা সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু ছেলের মন কি আর সেই কথা মানে। যতক্ষণ না মাকে চোখের সামনে দাঁড়াতে দেখতে পারবে ততক্ষণ আদির স্বস্তি নেই।
কমল বাবু নিজে একজন বড় ডাক্তার। ঋতুপর্ণাকে চিকিতসারত ডাক্তার, ডক্টর অবিনাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদিকে জানায় মাথার আঘাত বেশ গুরুতর তবে প্রানের আশঙ্কা নেই। সেই শুনে আদি মনে বল পায়। নার্স এসে জানায় এখুনি চার বোতল রক্তের দরকার। আদি নিজের বন্ধুদের ফোন করে। এক বোতল রক্ত এখুনি দিতে পারবে, কিন্তু বাকি তিন বোতলের জন্য বন্ধুদের ডাকে। অনির্বাণ বেশ কয়েকজন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছে যায়। এর মাঝে পুলিস ওদের কাছে এসে গাড়ি থেকে পাওয়া ঋতুপর্ণার মোবাইল পার্স ইত্যাদি দিয়ে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই তিস্তা আর কৌশিক, হসপিটালে এসে হাজির হয়। আদি তখন কারুর সাথে ঠিক করে কথা বলার মতন অবস্থায় ছিল না। তাও তিস্তা আর কৌশিকের প্রশ্নের উত্তরে সব কিছু ব্যাক্ত করে। নার্সের সাথে কৌশিক রক্ত দিতে চলে যায়। তিস্তা ওকে অভয় প্রদান করে, যে ওর মা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এক সেকেন্ড আদির কাছে এক ঘন্টা বলে মনে হয়, এক মিনিট ওর কাছে এক বছর। উৎকণ্ঠায় ওর জিব শুকিয়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে। অপারেশান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ইষ্ট নাম জপ করে আদি। “ভগবান বলে যদি সত্যি কেউ থাকে তাহলে দয়া করে আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।”
কমল জেঠু ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোর বাবাকে কি একটা ফোন করবি?”
আদি কি করবে ভেবে পায়না। সত্যি কি ওর বাবা আর ওর মাকে ভালোবাসে না। কিন্তু ওকে ভীষণ ভালোবাসে। হয়ত ছেলের এই ডাক শুনে বাবার মত বদলে যেতে পারে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আদি বাবাকে ফোন করে।
ওর কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনেই সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি হয়েছে রে? এমন ভাবে কাঁপছিস কেন?”
আদি কাঁপা গলায় বাবাকে জানায়, “পাপা” গলা ধরে আসে আদির, “মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে, পাপা। মা হসপিটালে।”
সেই শুনে সুভাষ চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, “কি ভাবে কোথায় হয়েছে। এখন কি অবস্থা?”
আদি সবিস্তারে বাবাকে এক্সিডেন্টের কথা জানাতেই সুভাষ জানায় যত শীঘ্র সম্ভব সুভাষ কোলকাতা আসবে। সেই শুনে আদি বাবাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। দু চোখ ভোরে আসে জলে।
সুভাষ ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলে, “এই তোর মায়ের কিছু হবে না। আমি নেক্সট ফ্লাইট ধরে কোলকাতা আসছি। সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না।”
এক ঘন্টা কেটে যায়। ডাক্তারেরা অপারেশান করেই চলেছে। ভেতর থেকে কোন খবর নেই। ওর বন্ধুরা, কমল জেঠু যতই ওকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে ততই আদি ক্ষেপে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে কপালে করাঘাত করে মনে মনে বলে, “যার যায় সেই বোঝে এই দুঃখ। একটু চুপ করে থাক সবাই।”
তিন ঘন্টা পরে অপারেশান থিয়েটার থেকে চিকিতসারত ডাক্তার বেড়িয়ে আসে। কমল জেঠু, আদি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ঋতুপর্ণার কথা জিজ্ঞেস করে। ডক্টর অবিনাশ, ওদের নিয়ে নিজের চেম্বারে চলে যান। চেম্বারে বসে আদি আর কমল জেঠুকে সবিস্তারে আঘাতের বিবরণ দেন। ঋতুপর্ণার মাথার ডান দিকে বেশ ভালোই ফেটে গেছে। মাথা ফেটে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল। মাথায় আঘাতের ফলে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়ে গেছে। ডাক্তারেরা সেই কাঁচ ইতিমধ্যে বের করে দিয়েছেন। বাঁ কাঁধের হাড়ে একটু চিড় দেখা গেছে, তা ছাড়া শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় একটু কেটে ছড়ে গেছে তাছাড়া গুরুতর আঘাত হয়নি। মাথায় আঘাতের জন্য ডাক্তারেরা একটু চিন্তিত। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আগামী বাহাত্তর ঘন্টা ঋতুপর্ণাকে পর্যবেক্ষণের জন্য আই সি ইউতে রেখে দেওয়া হবে।
ডাক্তার অবিনাশ ওকে বুঝিয়ে বলেন, “দেখো আদিত্য। মাথায় একটু আঘাত লেগেছে আর বাম কাঁধের হাড়টা একটু সরে গেছে। চিন্তা করার বিশেষ কোন কারন নেই। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তোমার মাকে আই সি ইউতে রাখা হবে। আই সি ইউতে নিয়ে যাওয়ার পরে একবার মাকে দেখে আসতে পারো।”
আদি নির্বাক হয়ে ডাক্তারের কথা শুনে যায়। ছলছল চোখে ডাক্তারকে প্রশ্ন করে, “মা ঠিক হয়ে যাবে ত?”
কমল জেঠু ওর কাঁধে হাত রেখে অভয় প্রদান করে বলেন, “হ্যাঁ সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না। চল বাইরে চল।”
রাত বেড়ে ওঠে। রক্ত দেওয়ার পরে এক এক করে ওর বন্ধুরা বিদায় নেয়। তিস্তা জানিয়ে দেয়, যে ও ওর মায়ের কলেজের সবাইকে ফোন করে এই দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে দেবে। সকালে একবার সবাইকে নিয়ে দেখা করতে আসবে। কমল জেঠুর বয়স হয়েছে তাই আদি ওকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আই সি ইউর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে। কিছুক্ষণ পরে নার্স এসে ওকে খবর দেয় যে ঋতুপর্ণাকে আই সি ইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আদি জিজ্ঞেস করে সে কি তার মাকে দেখতে পারে, উত্তরে নার্স জানায় যে ঋতুপর্ণার জ্ঞান এখন ফেরেনি তবে আদি মায়ের সাথে দেখা করতে পারে।
কাঁচের বড় দরজা ঠেলে আদি আই সি ইউতে ঢোকে। গলায় শ্বাস আটকে যায়। চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে। মাথায় ব্যান্ডেজ, সারা চেহারায় ব্যান্ডেজ, কাঁধে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ঋতুপর্ণা নিস্তেজ এক শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন সাদা বিছানায় শুয়ে। নাকে অক্সিজেনের নল, মুখের মধ্যে নল। এসির গুনগুন আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে ভেসে আসে না। আদির বুক কেঁদে ওঠে। চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। একি রূপ দেখছে। স্বপ্নেও ভাবেনি মাকে কোনোদিন এইভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখতে পাবে। হার্টবিট মনিটর ধুকপুক করে জানান দেয় যে হৃদপিণ্ড খুব ধীরে ধীরে চলছে। আদি একটা চেয়ার টেনে মায়ের পাশে বসে পরে।
বুকের পাঁজর ককিয়ে ওঠে, “মা গো একটি বার চোখ খোলো মা। দেখো তোমার দুষ্টু আদি এসে গেছে, মা। তোমার কিছু হবে না মা। প্লিস একটা বার চোখ খোলো।”
সন্তানের আর্ত কান্না মায়ের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে না। নিস্তব্ধ প্রাণহীন মূর্তির মতন বিছানায় শুয়ে ঋতুপর্ণা। আদি মায়ের ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গালে চেপে ধরে। মায়ের হাতটা যে বড় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এই হাতের ছোঁয়ায় আদি বড় হয়েছে। এই হাত ওকে কতবার খাইয়ে দিয়েছে, স্নান করিয়ে দিয়েছে, আদর করেছে, শীতের রাতে জড়িয়ে ধরেছে, গরমে যখন ঘেমে যেত তখন ঘাম মুছিয়ে দিয়েছে, আদর করে মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের ঠাণ্ডা হাত গালে ধরে চোখ বুজে সেই উষ্ণতার মিষ্টি পরশ খুঁজতে আপ্রান চেষ্টা চালায় ছেলের মন। কিন্তু ওর মায়ের হাতে সেই উষ্ণতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
ছোট বেলায় আদি একটু তোতলা ছিল, সব বাচ্চারাই একটু তোতলা থাকে, ঠিক ভাবে কথা ফোটে না তখন। ওর বাবা ওর মাকে আদর করে “ঋতু” বলে ডাকত। আদি তখন বাবার নকল করে মাকে “ইতু” বলে ডাকত। আদো আদো কণ্ঠে সেই “ইতু” ডাক ঋতুপর্ণার কানে মধুর মতন মনে হত। যেই ওর বাবা ওর গাল টিপে আদর করে বলত, “তবেরে ব্যাটা আমার নকল করা হচ্ছে। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।” তখনি আদি খিলখিল করে হাসতে হসাতে মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে নিত।
আদি মায়ের হাত খানি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, “ইতু, তোমার দুষ্টু আদি তোমার পাশে।” চোখ জ্বালা করে ওঠে। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এমন অভিমান করে চুপ থাকলে কি করে বাঁচব বলো। তুমি যে আমার সব। আমাকে কে ঘুম পাড়াবে? কে আমাকে আদর করে দুষ্টু, শয়তান বলে ডাকবে।” চোখের নোনতা জল এসে ঠোঁটে লাগে আদির। মায়ের হাতের তালুতে ঠোঁট চেপে ধরে। “মা জানো বাবা আসছে। এইবারে চোখ খোলো মা।” বুক কাঁপিয়ে ভীষণ ঝড় আছড়ে পরে।
তিস্তার সাথে গল্প করলেও আদির মন পরে থাকে ওর রূপসী মায়ের কাছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিস্তার নরম পাছার আর নরম স্তন জোড়া আদর করতে করতে ওরা দুইজনেই আবার কামোত্তেজিত হয়ে ওঠে। তৃষ্ণার্ত দুই নর নারী আবার মেতে ওঠে কামনার খেলায়। এইবারে দুইজনেই বেশ সময়ে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের শরীর নিয়ে মেতে ওঠে।
বিকেল ছ’টা বাজে, এমন সময়ে আদির ফোন বেজে ওঠে। একটা অজানা ফোন নাম্বার থেকে ফোন আসায় আদি একটু বিরক্ত হয়ে যায়। কামসুখে পরিতৃপ্ত হয়ে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল এরমাঝে উটকো ফোন দেখে মাথা গরম হয়ে যায়।
ফোন তুলে বিরক্তি ভরা গলায় জিজ্ঞেস করে, “হ্যালো কে বলছেন?”
ওইপাশের অজানা আগন্তুকের কণ্ঠ স্বর, “হ্যালো, আপনি কি মিস্টার আদিত্য সান্যাল?”
আদি উত্তর দেয়, “হ্যাঁ। কি ব্যাপার আপনি কে?”
আগন্তুক উত্তর দেয়, “আপনি ঋতুপর্ণা নামে কাউকে চেনেন?”
হটাত এক অজানা অচেনা ব্যাক্তির মুখে মায়ের নাম শুনে আশঙ্কায় আদির বুক কেঁপে ওঠে। তিস্তাকে ছেড়ে উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়িয়ে আগন্তুককে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ, আমার মা। কেন মায়ের কি হয়েছে?”
আগন্তুক উত্তর দেয়, “তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসুন। আপনার মায়ের গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
আদির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। মাথা ঝিমঝিম করে আসে। সমগ্র পৃথিবীতে মা ছাড়া ওর আর কেউ নেই। না, একটু ভুল ভাবনা, হয়ত বাবা ওর পাশে থাকবে। তবে মায়ের এই দুর্দিনে ওদের পাশে সত্যি কি এসে দাঁড়াবে। সেটা আদৌ আদি জানে না। চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে। কঠিন চোয়াল, দাঁতে দাঁত পিষে অশ্রু সংবরণ করে আগন্তুক কে জিজ্ঞেস করে, “কি ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে? কোথায় হয়েছে?”
আগন্তুক শুধু মাত্র হস্পিটালের নাম জানিয়ে ওকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে। তিস্তা আদির চেহারা দেখে উৎকণ্ঠা ব্যাক্ত করে। কিন্তু আদির নিজের ওপরে ভীষণ রাগ হয়। কেন মাকে একা ছাড়তে গেল। যদি মাকে একটু রাজি করানো যেত তাহলে হয়ত মা প্রদীপের সাথে দেখা করতে যেত না। কিন্তু আদির যৌন তৃষ্ণা বড় বেড়ে গিয়েছিল। ওর লিঙ্গ এক যোনি রসে মাখামাখি করার জন্য উঠে পরে লেগেছিল। চোয়াল চেপে তাড়াতাড়ি জামা কাপড় পরে নেয়। তিস্তা ওকে কারন জিজ্ঞেস করাতে আদি সংক্ষেপে জানায় যে মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেই শুনে তিস্তা আঁতকে ওঠে।
আদি ছলছল চোখে তিস্তাকে অনুরোধ করে ওর সাথে হসপিটাল যেতে। তিস্তা কৌশিকের আসার আছিলা দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। বলে ওদের সাথে দেখা হওয়ার কোন কথাই কৌশিক জানে না সুতরাং এমত অবস্থায় কিছুতেই আদির সাথে হসপিটালে যেতে পারবে না বলে আক্ষেপ ব্যাক্ত করে। আদির শরীর তিস্তার প্রতি ঘৃণায় রিরি করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে তিস্তার সাথে ঝগড়া করার মতন মানসিকতা ওর থাকে না।
জামা প্যান্ট পড়তে পড়তে আদি তিস্তার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “সত্যি তোমার মতন সুবিধাবাদী মেয়ে আর দুটো দেখিনি।”
তিস্তা বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ওকে বুঝাতে চেষ্টা করে, “প্লিস আদি একটু বোঝার চেষ্টা করো। কৌশিক সত্যি জানে না তুমি আমার কাছে এসেছো। প্লিস, আদি। ঋতুপর্ণা দিকে আমি সত্যি খুব সন্মান করি। তুমি যাও, আমি কৌশিককে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছে যাবো।”
আদি চোয়াল চেপে তিস্তাকে উত্তর দেয়, “না আর অত দরদ দেখাতে এসো না। আমি চললাম।”
তিস্তা ওকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে কৌশিক ফিরে এলে ওকে সঙ্গে নিয়ে হসপিটাল যাবে। কিন্তু আদি আর দাঁড়ায় না। এক দৌড়ে বাইরে এসে দেখে আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি করে হসপিটাল পৌঁছে যায়।
হসপিটালে পৌঁছাতেই এদিক ওদিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে যে ওর মা গাড়ি এক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হয়েছে। এমারজেন্সিতে গিয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই একজন আগন্তুক ওর দিকে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেয়। “আমি রবিন। আপনার মায়ের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে।” আদি মাথা চেপে বসে পরে।
রবিন আদির কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আপনার মা একটা রেড লাইট জাম্প করেছিল। অন্যদিক থেকে একটা বাস এসে গাড়ির ডান দিকে ধাক্কা মারে। রাস্তার ওপরে গাড়িটা পালটি খেয়ে যায়। সিট বেল্ট বাঁধা না থকার ফলে আপনার মা বামদিকের সিটের ওপরে পরে যায়। গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে মাথায়, গালে গলায় ঢুকে গেছে। লোকজন ছুটে আসে আপনার মাকে বাঁচাতে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে শুধু মাত্র আপনার নাম নিয়েছিল। ওনার মোবাইল থেকে আপনার নাম বের করে আমি আপনাকে ফোন করি। তারপরে পুলিস আর এ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে এই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।”
আদি রবিন বাবুর হাত ধরে প্রায় কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে, “আমার মা বেঁচে যাবে ত?”
রবিন বাবু খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলেন, “দেখুন আমি ডাক্তার নই তবে ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওপর ওয়ালার ওপরে ভরসা রাখুন আপনার মা ঠিক হয়ে যাবে।”
ডাক্তারেরা মাকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে চলে গেছে। আদি অপারেশান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে মাথা ঠোকে। নিজেকে দোষারোপ করে। কেন মাকে একা ছাড়ল, কেন মাকে বুঝাতে পারল না যে প্রদীপের কাছে না গিয়ে ওর সাথে বিকেলটা বাড়িতে কাটাতে। কেন নিজের যৌন ক্ষুধার তাড়নায় তিস্তার কাছে গেল। ইত্যাদি ভেবে নিজেকে দোষারোপ করে আদি।
উৎকণ্ঠায় আর প্রচন্ড আশঙ্কায় আদির গলা শুকিয়ে আসে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাঝে মাঝে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আবার কখন দুরদার করে হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করে দেয়। আত্মীয় সজ্জন বলতে ওর কেউ নেই। সাহায্যের জন্য কাকে ফোন করবে ভাবতে ভাবতে আদি কমল জেঠুকে ফোন করে সব জানাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে কমল জেঠু কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে চলে আসেন। কমল জেঠু ওকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে ঋতুপর্ণা সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু ছেলের মন কি আর সেই কথা মানে। যতক্ষণ না মাকে চোখের সামনে দাঁড়াতে দেখতে পারবে ততক্ষণ আদির স্বস্তি নেই।
কমল বাবু নিজে একজন বড় ডাক্তার। ঋতুপর্ণাকে চিকিতসারত ডাক্তার, ডক্টর অবিনাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদিকে জানায় মাথার আঘাত বেশ গুরুতর তবে প্রানের আশঙ্কা নেই। সেই শুনে আদি মনে বল পায়। নার্স এসে জানায় এখুনি চার বোতল রক্তের দরকার। আদি নিজের বন্ধুদের ফোন করে। এক বোতল রক্ত এখুনি দিতে পারবে, কিন্তু বাকি তিন বোতলের জন্য বন্ধুদের ডাকে। অনির্বাণ বেশ কয়েকজন নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছে যায়। এর মাঝে পুলিস ওদের কাছে এসে গাড়ি থেকে পাওয়া ঋতুপর্ণার মোবাইল পার্স ইত্যাদি দিয়ে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই তিস্তা আর কৌশিক, হসপিটালে এসে হাজির হয়। আদি তখন কারুর সাথে ঠিক করে কথা বলার মতন অবস্থায় ছিল না। তাও তিস্তা আর কৌশিকের প্রশ্নের উত্তরে সব কিছু ব্যাক্ত করে। নার্সের সাথে কৌশিক রক্ত দিতে চলে যায়। তিস্তা ওকে অভয় প্রদান করে, যে ওর মা সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এক সেকেন্ড আদির কাছে এক ঘন্টা বলে মনে হয়, এক মিনিট ওর কাছে এক বছর। উৎকণ্ঠায় ওর জিব শুকিয়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গেছে। অপারেশান থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে ইষ্ট নাম জপ করে আদি। “ভগবান বলে যদি সত্যি কেউ থাকে তাহলে দয়া করে আমার মাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।”
কমল জেঠু ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোর বাবাকে কি একটা ফোন করবি?”
আদি কি করবে ভেবে পায়না। সত্যি কি ওর বাবা আর ওর মাকে ভালোবাসে না। কিন্তু ওকে ভীষণ ভালোবাসে। হয়ত ছেলের এই ডাক শুনে বাবার মত বদলে যেতে পারে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আদি বাবাকে ফোন করে।
ওর কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনেই সুভাষ ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোর কি হয়েছে রে? এমন ভাবে কাঁপছিস কেন?”
আদি কাঁপা গলায় বাবাকে জানায়, “পাপা” গলা ধরে আসে আদির, “মায়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে, পাপা। মা হসপিটালে।”
সেই শুনে সুভাষ চাপা আর্তনাদ করে ওঠে, “কি ভাবে কোথায় হয়েছে। এখন কি অবস্থা?”
আদি সবিস্তারে বাবাকে এক্সিডেন্টের কথা জানাতেই সুভাষ জানায় যত শীঘ্র সম্ভব সুভাষ কোলকাতা আসবে। সেই শুনে আদি বাবাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবে ভেবে পায় না। দু চোখ ভোরে আসে জলে।
সুভাষ ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলে, “এই তোর মায়ের কিছু হবে না। আমি নেক্সট ফ্লাইট ধরে কোলকাতা আসছি। সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করিস না।”
এক ঘন্টা কেটে যায়। ডাক্তারেরা অপারেশান করেই চলেছে। ভেতর থেকে কোন খবর নেই। ওর বন্ধুরা, কমল জেঠু যতই ওকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে ততই আদি ক্ষেপে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে কপালে করাঘাত করে মনে মনে বলে, “যার যায় সেই বোঝে এই দুঃখ। একটু চুপ করে থাক সবাই।”
তিন ঘন্টা পরে অপারেশান থিয়েটার থেকে চিকিতসারত ডাক্তার বেড়িয়ে আসে। কমল জেঠু, আদি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ঋতুপর্ণার কথা জিজ্ঞেস করে। ডক্টর অবিনাশ, ওদের নিয়ে নিজের চেম্বারে চলে যান। চেম্বারে বসে আদি আর কমল জেঠুকে সবিস্তারে আঘাতের বিবরণ দেন। ঋতুপর্ণার মাথার ডান দিকে বেশ ভালোই ফেটে গেছে। মাথা ফেটে কাঁচ ঢুকে গিয়েছিল। মাথায় আঘাতের ফলে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়ে গেছে। ডাক্তারেরা সেই কাঁচ ইতিমধ্যে বের করে দিয়েছেন। বাঁ কাঁধের হাড়ে একটু চিড় দেখা গেছে, তা ছাড়া শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় একটু কেটে ছড়ে গেছে তাছাড়া গুরুতর আঘাত হয়নি। মাথায় আঘাতের জন্য ডাক্তারেরা একটু চিন্তিত। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত আগামী বাহাত্তর ঘন্টা ঋতুপর্ণাকে পর্যবেক্ষণের জন্য আই সি ইউতে রেখে দেওয়া হবে।
ডাক্তার অবিনাশ ওকে বুঝিয়ে বলেন, “দেখো আদিত্য। মাথায় একটু আঘাত লেগেছে আর বাম কাঁধের হাড়টা একটু সরে গেছে। চিন্তা করার বিশেষ কোন কারন নেই। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তোমার মাকে আই সি ইউতে রাখা হবে। আই সি ইউতে নিয়ে যাওয়ার পরে একবার মাকে দেখে আসতে পারো।”
আদি নির্বাক হয়ে ডাক্তারের কথা শুনে যায়। ছলছল চোখে ডাক্তারকে প্রশ্ন করে, “মা ঠিক হয়ে যাবে ত?”
কমল জেঠু ওর কাঁধে হাত রেখে অভয় প্রদান করে বলেন, “হ্যাঁ সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করিস না। চল বাইরে চল।”
রাত বেড়ে ওঠে। রক্ত দেওয়ার পরে এক এক করে ওর বন্ধুরা বিদায় নেয়। তিস্তা জানিয়ে দেয়, যে ও ওর মায়ের কলেজের সবাইকে ফোন করে এই দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে দেবে। সকালে একবার সবাইকে নিয়ে দেখা করতে আসবে। কমল জেঠুর বয়স হয়েছে তাই আদি ওকে বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করে।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আই সি ইউর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে। কিছুক্ষণ পরে নার্স এসে ওকে খবর দেয় যে ঋতুপর্ণাকে আই সি ইউতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আদি জিজ্ঞেস করে সে কি তার মাকে দেখতে পারে, উত্তরে নার্স জানায় যে ঋতুপর্ণার জ্ঞান এখন ফেরেনি তবে আদি মায়ের সাথে দেখা করতে পারে।
কাঁচের বড় দরজা ঠেলে আদি আই সি ইউতে ঢোকে। গলায় শ্বাস আটকে যায়। চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে। মাথায় ব্যান্ডেজ, সারা চেহারায় ব্যান্ডেজ, কাঁধে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ঋতুপর্ণা নিস্তেজ এক শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন সাদা বিছানায় শুয়ে। নাকে অক্সিজেনের নল, মুখের মধ্যে নল। এসির গুনগুন আওয়াজ ছাড়া আর কিছু কানে ভেসে আসে না। আদির বুক কেঁদে ওঠে। চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। একি রূপ দেখছে। স্বপ্নেও ভাবেনি মাকে কোনোদিন এইভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখতে পাবে। হার্টবিট মনিটর ধুকপুক করে জানান দেয় যে হৃদপিণ্ড খুব ধীরে ধীরে চলছে। আদি একটা চেয়ার টেনে মায়ের পাশে বসে পরে।
বুকের পাঁজর ককিয়ে ওঠে, “মা গো একটি বার চোখ খোলো মা। দেখো তোমার দুষ্টু আদি এসে গেছে, মা। তোমার কিছু হবে না মা। প্লিস একটা বার চোখ খোলো।”
সন্তানের আর্ত কান্না মায়ের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে না। নিস্তব্ধ প্রাণহীন মূর্তির মতন বিছানায় শুয়ে ঋতুপর্ণা। আদি মায়ের ডান হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গালে চেপে ধরে। মায়ের হাতটা যে বড় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এই হাতের ছোঁয়ায় আদি বড় হয়েছে। এই হাত ওকে কতবার খাইয়ে দিয়েছে, স্নান করিয়ে দিয়েছে, আদর করেছে, শীতের রাতে জড়িয়ে ধরেছে, গরমে যখন ঘেমে যেত তখন ঘাম মুছিয়ে দিয়েছে, আদর করে মাথার চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের ঠাণ্ডা হাত গালে ধরে চোখ বুজে সেই উষ্ণতার মিষ্টি পরশ খুঁজতে আপ্রান চেষ্টা চালায় ছেলের মন। কিন্তু ওর মায়ের হাতে সেই উষ্ণতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
ছোট বেলায় আদি একটু তোতলা ছিল, সব বাচ্চারাই একটু তোতলা থাকে, ঠিক ভাবে কথা ফোটে না তখন। ওর বাবা ওর মাকে আদর করে “ঋতু” বলে ডাকত। আদি তখন বাবার নকল করে মাকে “ইতু” বলে ডাকত। আদো আদো কণ্ঠে সেই “ইতু” ডাক ঋতুপর্ণার কানে মধুর মতন মনে হত। যেই ওর বাবা ওর গাল টিপে আদর করে বলত, “তবেরে ব্যাটা আমার নকল করা হচ্ছে। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।” তখনি আদি খিলখিল করে হাসতে হসাতে মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে নিত।
আদি মায়ের হাত খানি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, “ইতু, তোমার দুষ্টু আদি তোমার পাশে।” চোখ জ্বালা করে ওঠে। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এমন অভিমান করে চুপ থাকলে কি করে বাঁচব বলো। তুমি যে আমার সব। আমাকে কে ঘুম পাড়াবে? কে আমাকে আদর করে দুষ্টু, শয়তান বলে ডাকবে।” চোখের নোনতা জল এসে ঠোঁটে লাগে আদির। মায়ের হাতের তালুতে ঠোঁট চেপে ধরে। “মা জানো বাবা আসছে। এইবারে চোখ খোলো মা।” বুক কাঁপিয়ে ভীষণ ঝড় আছড়ে পরে।