22-09-2020, 11:49 PM
সাপের কোঠর (#০৫)
একটা পুরুষের কণ্ঠ স্বর শোনা গেল, "একা এসেছিস?"
নয়না উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
পুরুষের কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করে, "কাগজ পত্র?"
নয়না চাপা কণ্ঠে গর্জে ওঠে, "আগে ভাইকে দেখি তারপরে।"
পুরুষ কণ্ঠ উত্তর দেয়, "ঠিক আছে। পেছনে আয়।"
কয়েকটা পায়ের আওয়াজ গাড়ির পেছনের দিকে এগিয়ে আসে, মনে হয় দুইজন। সঙ্গে সঙ্গে দানা, গোড়ালি থেকে পিস্তল বের করে হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ, কি দেখল কে জানে তবে নয়নার সাথে ওই দুষ্কৃতীদের পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যায়। গোড়ালি থেকে দুটো পিস্তল বের করে হাতে তুলে নেয় দানা। অতি সন্তর্পণে ডিকি খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেড়িয়ে আসে। সামনে একটা পুরানো ভাঙ্গা বিলেতি আমলের বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। দেখে অনেকটা ভুতুরে বাড়ির মতন মনে হল। দুটো পিস্তলের ডগায় সাইলেন্সার লাগিয়ে হাতে পা টিপে টিপে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ভাঙ্গা জানালার মধ্যে দিয়ে ভেতরের আলো দেখা পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে ভাঙ্গাচোরা বৈঠক খানায় মোহন আর চারজন ছেলে দাঁড়িয়ে। সবার হাতেই বন্দুক। বুবাইকে কোথাও দেখতে পায় না। দুইজন দুষ্কৃতি নয়নার মাথায় পিস্তল রেখে দাঁড়িয়ে।
আহত ক্ষুব্ধ নয়নার দিকে এগিয়ে এসে মোহন দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে ওঠে, "শালী তোর জন্য আমার বন্ধু আজ মারা গেছে।"
নয়না পাল্টা সুরে বলে, "নিজের ক্ষমতায় কুলায়নি, শেষ পর্যন্ত ভাইকে হাতিয়ার করে আমাকে ধরলি? ভাবিস না তোরা বেঁচে যাবি।" বলেই বাঁকা হাসি দেয়।
মোহন ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, "আজ তুই বাঁচবি না। তোকে শেষ করার জন্য এইখানে ডাকা।" বলে নয়নাকে চেপে ধরে মাটির ওপরে বসিয়ে দেয়।
আহত সাপের মতন ফুঁসে ওঠে নয়না, "আমার ভাই কোথায়?" ওর হাতের ফাইল গুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
মাটি থেকে ফাইল গুলো উঠিয়ে এক এক করে দেখে মোহন ক্রুর হাসি দিয়ে বলে, "শালা মাদারচোদ দানা, আমার প্রকল্প হাতাতে গেছিল। তোর ভাইকে অপহরন করার পরিকল্পনা আসলে কার জানিস?"
দানা চোখ বন্ধ করে নেয়, এটা অবশ্যাম্ভাবি। মোহন অথবা সিমোন নয়নাকে বলেই দিত। নয়না ফুঁসে ওঠে, "মানে?"
অট্টহাসিতে ফেটে পরে মোহন খৈতান, হাতের পিস্তল নয়নার নাকের সামনে নাচিয়ে বলে, "তোর সুহৃদ বন্ধু, তোর হিতৈষী দানার ষড়যন্ত্র এটা।"
নয়নার চোখ জ্বলে ওঠে, মাথা ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "না, বিশ্বাস করি না। আগে বল, আমার ভাই কোথায়?"
পাশের একটা ছেলেকে মোহন নির্দেশ দেয় বুবাইকে আনতে। মোহন কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে হাসতে হাসতে বলে, "দানা তোর হিতৈষী, তোর সাথে আসেনি কেন? তোকে একাই আমার কাছে পাঠিয়েছে মরার জন্য? (চুকচুক করে মোহন) ইসসস আজকে রাতে তুই শেষ হবি আর আমার প্রকল্প গুলো আমার হাতে চলে আসবে।"
নয়না চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে, হয়ত দানাকেই খুঁজছে ওর চোখ। দুই চোখে ভয়ঙ্কর আগুন নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "তোমরা তো ওর মেয়েকে অপহরন করতে চেয়েছিলে তাই না? আর সেটা আমার হাত দিয়েই করাতে। এটা ওর মাথার উপজ কোনোদিন হতে পারে না মোহন, এই পরিকল্পনা সিমোনের মাথার উপজ।"
ঠিক তখনি একটা ছেলে বুবাইকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। বুবাইয়ের পেছন পেছন হাসতে হাসতে সিমোন ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। সিমোনকে এইখানে দেখে একদিকে দানা আর অন্যদিকে নয়না, দুইজনে অবাক হয়ে যায়। ওরা ভাবতে পারেনি সিমোন নিজে এইখানে আসবে।
বুবাইকে দেখে নয়না কেঁদে ওঠে, "আমার ভাইকে ছেড়ে দাও। তোমার কথা মতন আমি তোমার প্রকল্পের কাগজ পত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি আর নিজেও এসেছি। জানি তুমি আমাকে আজ রাতে শেষ করে দেবে। কিন্তু সত্যি বলছি বিমানের মৃত্যুর পেছনে আমি দায়ী নই।"
বুবাইকে ছেলেটা ছেড়ে দিতেই এক দৌড়ে দিদির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর মুখে শরীরে হাত বুলিয়ে স্নেহ করে জিজ্ঞেস করে, "কিছু করেছে তোমাকে সোনা?"
বুবাই মাথা নাড়িয়ে সিমোনকে দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, "মেরেছে আমাকে।"
হিংস্র নয়নার চোখ থেকে জলের জায়গায় রক্ত ঠিকরে বেড়িয়ে আসে। প্রাণপণ শক্তি দিয়ে বুবাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে মোহনের দিকে রক্ত চক্ষু হেনে জিজ্ঞেস করে, "একে কেন মেরেছো? একি ক্ষতি করেছে তোমাদের?"
সিমোন চিবিয়ে চিবিয়ে হাসতে হাসতে বলে, "না না এ কোন ক্ষতি করেনি তবে শালা মাদারজাত ভাই তোর। যখন থেকে এসেছে বোকাচোদা ছেলে শুধু দুদু খাবে দুদু খাবে বলে কাঁদছে। অত বড় ছেলেটা শেষে কিনা আমার বুকে হাত দেয়? কোন আস্পর্ধায় আমার বুকে হাত দেয়।" ওর দিকে পিস্তল উঁচিয়ে গর্জে ওঠে, "তোদের দুটোকেই আজকে শেষ করে দেব।"
নয়না চকিতে গোড়ালি থেকে দুটি পিস্তল একসাথে বের করে "দুম দুম" "দুম দুম" করে পর পর মোহনকে আর সিমোনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। দুটো গুলি মোহনের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। সিমোনে কাঁধে লাগে দুটো গুলি। অতর্কিত হামলায় মোহন কিছু বুঝতে পারে না কিন্তু ততক্ষনে গুলি ওর পেট বুক ফুঁড়ে বেড়িয়ে গেছে। বাকি ছেলেগুলো হিংস্র নয়নার রক্ত চক্ষু দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্ধ নয়নার পিস্তল ওদের দিকে তাগ করা, এক পা নড়লে গুলি ওদের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে।
রক্তাক্ত মোহন খৈতান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর সিমোন চিৎকার করে, "নাআআআ....." মোহনকে জড়িয়ে ধরে। রক্তাক্ত স্বামীর মাথা কোলে তুলে সিমোন নয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে ওঠে, "তুই একে গুলি করলি?" বলেই পাশে একটা লাঠির মতন কিছু ছিল সেটা হাতে নিয়ে নয়নাকে মারতে উদ্যত হয়।
হিংস্র ক্ষুদ্ধ নয়না ফুঁসতে ফুঁসতে বাকিদের দিকে পিস্তল তাগ করে মোহনের দিকে এগিয়ে যায়। নয়নার হাতে দুটো পিস্তল দেখে সিমোনের চেহারা আতঙ্কে রক্ত শূন্য হয়ে যায়। দানা চুপচাপ জানালা দিয়ে দেখে যায়, এর মধ্যে একজন শেষ, একজন আহত একজন ক্ষুদ্ধ। ক্ষুদ্ধ নয়নাকে যদি সিমোনে না মারে তাহলে ওর মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী। এখন কেন শক্তি, নাসির বলাইদের দেখা নেই, বারেবারে ঘড়ি দেখে দানা। এতক্ষণে ওদের এইখানে এসে যাওয়ার কথা।
মোহন আর সিমোনের দিকে এগিয়ে যায় নয়না। রক্তাক্ত মোহনের গলার ওপরে পা তুলে মাটির সাথে পিষে ধরে নয়না গর্জে ওঠে, "আমার বাবা আমার ভাইকে মারতে গেছিল তাকে পর্যন্ত ছাড়িনি। তোকে কেন ছেড়ে দেব?"
বলেই মোহনের মাথা লক্ষ্য করে আরো একটা গুলি করে, যার ফলে ওর মাথার খুলি গুঁড়িয়ে যায় আর সিমোনের কামিজ রক্তে ভেসে যায়।
মৃত মোহনের মাথা কোলে করে সিমোন আর্তনাদ করে ওঠে, "একি করলে তুমি? এই সব দানার ষড়যন্ত্র এইসব না হলে কি আর তোমার ভাইকে আমরা কিডন্যাপ করতে পারি? ওই আমাদের হাতে তোমার ভাইকে তুলে দিয়েছে।"
মোহন শেষ, সিমোন শেষ পর্যন্ত সত্য উজাগর করেই দিয়েছে। এইবারে দানাকে সামনে আসতেই হবে, নয়নার সম্মুখীন হতেই হবে, জানালার পেছনে আর লুকিয়ে থাকা নয়। তাল ঠুকে শেষ পর্যন্ত পিস্তল হাতে জানালা ভেঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। জানালা ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে নয়না, ছলছল চোখে একবার ওর দিকে তাকায়। দুই হাতের পিস্তল পাশের ছেলেগুলোর দিকে তাগ করে এগিয়ে আসে নয়নার দিকে।
বুবাইকে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দিদিকে জড়িয়ে ধরে। ভাইকে দুই হাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে পড়ে নয়না। পাশের ছেলে গুলো দানার দিকে এগিয়ে আসতে যায়, সঙ্গে সঙ্গে দানার হাতের পিস্তলের গুলিতে এক এক করে দুইজনে প্রান হারায়। বাকি দুইজন সেখান থেকে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচে।
ছলছল চোখে নয়না এক হাতে পিস্তল এক হাতে ভাইকে জড়িয়ে একবার দানার দিকে তাকায়। তারপরে সিমোনের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমাকে মারার ওর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আমি যদি ওর মেয়েকে অপহরন করতাম যেটা তোমরা করাতে চেয়েছিলে তাহলে কি ও আমাকে ছেড়ে দিত? কিন্তু আমার ভাই কেন সিমোন....." উত্তরের অপেক্ষা করে না নয়না। কথাটা শেষ করেই সিমোনের মাথা লক্ষ্য করে একটা গুলি করে ওর মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। প্রাণহীন সিমোন নিজের প্রাণহীন স্বামী মোহনের পাশে লুটিয়ে পড়ে।
দানার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়, এর পরের গুলি ওর মাথা অথবা বুক লক্ষ্য করেই হবে সেটা অজানা নয়। তবুও দানা নয়নার দিকে পিস্তল তাগ করে না। আহত হিংস্র বাঘিনী নয়নার চোখে চোখ রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দানাও জানে এই নারীকে এইখানে শেষ করে দেওয়া উচিত, নয়না বেঁচে থাকলে ওর সমুহ বিপদ, ওর পরিবারের সমুহ বিপদ।
নয়না আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে ম্লান হেসে বলে, "সত্যি আমার মরে যাওয়াই উচিত, তাই না দানা? আমি বেঁচে থাকলে তুমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু আমি মরে গেলে আমার ভাইকে কে দেখবে? তুমি দেখবে? না না....." বলতে বলতে বুবাইকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে। বুবাই দিদিকে দুই হাতে জড়িয়ে কাঁধে মাথা গুঁজে দেয়। জল ভরা চোখে নয়না, একবার ভায়ের মাথায় চুমু খেয়ে ওর কানের ওপরে বন্দুক ধরে। স্মিত হেসে নয়না বলে, "আমি সত্যি ভীষণ পাপী, দানা। এই দেখো, আমি রুহিকে অপহরন করতাম আর অদৃষ্ট ঠিক আমার ভাইকে এদের হাতেই অপহরন করিয়ে সেই শাস্তি আমায় দিল। সমু আর সুমিতা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই পৃথিবীতে আমার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে নেই দানা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি মরে গেলে আমার ভাইকে কেউ দেখবে না দানা।"
"দুম" একটা গুলি সোজা বুবাইয়ের মাথার খুলি ভেদ করে দেয়। দানার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। বুবাই কেঁপে ওঠে, ফুটো মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে নয়নার সারা চেহারা আর জামা ভিজিয়ে লাল করে দেয়। চোখ বন্ধ করে মৃত ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। দানা হাত থেকে পিস্তল ফেলে চুপচাপ স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে থাকে। নয়না যে নিজের ভাইকে মেরে ফেলবে সেটা দানা স্বপ্নেও ভাবেনি। ভেবেছিল সিমোন অথবা মোহন হয়ত ওদের পৌঁছানর আগেই বুবাইকে মেরে ফেলবে।
ঠিক তখনি বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দড়াম করে সামনের দরজা খুলে শক্তি আকরামের সাথে পুলিস এসে প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে। দানার শরীর পাথরের মতন শক্ত হয়ে যায়। মন থেকে চেয়েছিল নয়নার মৃত্যু হোক কিন্তু এইভাবে শেষ পর্যন্ত? দানা ধারনা করতে পারেনি যে নয়না নিজে হাতে নিজের ভাইকে হত্যা করবে। দানা ভেবেছিল সিমোন অথবা মোহনের হাতে নয়না আর তার ভাই খুন হবে আর কঙ্কনা আর নাসরিনের খুনে সিমোনেকে ফাঁসিয়ে দেবে। কিন্তু একা নয়না যে সবাইকে হত্যা করবে সেটা ওর ধারনার বাইরে ছিল, বিশেষ করে নিজে হাতে নিজের ভাইকে হত্যা করার ব্যাপারটা।
শক্তি ধীর পায়ে দানার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতে মোবাইল তুলে দেয়। নিথর দানা, শক্তির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ওর দিকে তাকায়। শক্তি ইশারায় জানায় ফোনের অন্যপাশে মহুয়া। দানা মোবাইল তুলে মহুয়ার সাথে কথা বলে।
মহুয়া ওইপাশ থেকে চাপা গলায় বলে, "জিত নয়না আর বুবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।"
দানা স্থম্ভিত হয়ে যায়। একি বলছে মহুয়া?
মহুয়া আবার দানাকে বলে, "জিত, প্লিজ নয়না আর বুবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। যে করে হোক ফিরিয়ে নিয়ে এসো।"
নির্বাক দানা এক ভাবে সামনে বসা নয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোলে মৃত বুবাই, সারা শরীর ভাইয়ের রক্তে ভেসে গেছে নয়নার। দানা কোনোরকমে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে একটু বলবে?"
মহুয়া উত্তরে বলে, "তুমি যে করে হোক ফিরিয়ে নিয়ে এসো। বাড়ি এসো তারপরে সব বলছি।"
দানা শক্তির দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। শক্তি মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই নয়না বলে ওঠে।
নয়না চোখ খুলে দানার দিকে তাকিয়ে বলে, "জানো দানা, জীবনে প্রচুর পাপ করেছি। সমু নেই, আমার ভালোবাসা আমার বন্ধু আমার সবকিছু - সেই রাতে হারিয়ে গেছে।" নিজের কানের ওপরে পিস্তল রেখে ছলছল চোখে বলে, "মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে ভালো থেকো, দানা। আমি আমার সমুর কাছে চললাম।"
পুলিস ওর দিকে এগিয়ে যায় বিরত করতে। দানা হাত উঠিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "দাঁড়াও, প্লিজ দাঁড়াও। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।"
নয়না স্মিত হেসে জল ভরা চোখ বন্ধ করে মৃত বুবাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে নিজের কানের ওপরে গুলি চালায় "দুম"। গুলিটা নয়নার মাথার খুলি ভেদ করে যায়, রক্তের ফিনকি বেড়িয়ে আসে। পুলিস, দানা আকরাম শক্তি সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। পুলিস কাউকেই বাঁচাতে পারে না।
দানা নিজের মাথা ধরে অনেকক্ষণ চুপচাপ ওইখানে বসে থাকে। ওর হাত থেকে মোবাইল মাটিতে পড়ে যায়। মোবাইলে মহুয়ার অস্ফুট আর্তনাদ শোনা যায়, "না......"
চারপাশে ছড়ানো মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র। শক্তি মনা এক এক করে সেই কাগজ পত্র গুলো উঠিয়ে ফাইল বদ্ধ করে। পুলিস নিজের কাজে লেগে পড়ে।
দানা কাঁপতে কাঁপতে মোবাইল তুলে মহুয়াকে বলে, "হঠাৎ কি হলো?"
মহুয়া চাপা আহত কণ্ঠে উত্তর দেয়, "নয়না, বড়দার মেয়ে, শায়ন্তনি। বড়দার ডান হাতের আঘাতের দাগ, কুড়ি বছর আগের ওর মেয়ের দেওয়া। বাড়ি আসো, বড়দা বসে আছেন, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।"
চোখের সামনে সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায় দানার। পুলিস ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব কিছু খুলে জানায়। সিমোনে আর মোহন, নয়নার ভাইকে অপহরন করেছিল। বুবাইকে ছাড়ার বদলে ওরা নয়নাকে খুন করতে চেয়েছিল আর চেয়েছিল দানার নামে যে সম্পত্তি আছে সেই গুলো হাতিয়ে নিতে। কিন্তু একা নয়না বাকি সবাইকে মেরে ফেলে আর সেটা চাক্ষুষ পুলিসের সামনেই হয়েছে। পিস্তলের কথা জিজ্ঞাসা করলে দানা জানায় ওর কাছে কোন পিস্তল ছিল না, নয়না কোথা থেকে পিস্তল যোগাড় করেছে সেটা ওর জানা নেই।
নয়নার মৃত্যু দানাকে বিশেষ নাড়া দেয়না তবে চোখের সামনে নিজের ভাইকে খুন করেছে সেটা দেখে দানা বেশ বিচলিত হয়ে ওঠে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নয়না কি চেয়েছিল সেটাই বোঝা গেল না। অর্থ যশ প্রতিপত্তি, না প্রেম ভালোবাসা? কাকে বেশি ভালবাসতো নয়না ওরফে শায়ন্তনি বসাক? উত্তর আসে রক্তাক্ত লুটিয়ে থাকা শায়ন্তনি বসাকের ভগ্ন হৃদয় থেকে..... সমুদ্রকে ভালবাসতো শায়ন্তনি বসাক, আর অভিনেত্রী নয়না বোসের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল রাজনৈতিক দলের নেত্রী হওয়ার। আর দূরে দানার বাড়িতে অপেক্ষায় এক পিতা, হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে কাছে পাবার আশায় হয়তো বসে আছে। এই ছলনাময়ী মহানগর প্রচুর আলেয়ায় ভরা। ওর বাড়িতে অপেক্ষারত এক আলোকের জ্যোতি, মহুয়া।
********** পর্ব ষোল সমাপ্ত **********
********** সমাপ্ত **********
একটা পুরুষের কণ্ঠ স্বর শোনা গেল, "একা এসেছিস?"
নয়না উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
পুরুষের কণ্ঠস্বর প্রশ্ন করে, "কাগজ পত্র?"
নয়না চাপা কণ্ঠে গর্জে ওঠে, "আগে ভাইকে দেখি তারপরে।"
পুরুষ কণ্ঠ উত্তর দেয়, "ঠিক আছে। পেছনে আয়।"
কয়েকটা পায়ের আওয়াজ গাড়ির পেছনের দিকে এগিয়ে আসে, মনে হয় দুইজন। সঙ্গে সঙ্গে দানা, গোড়ালি থেকে পিস্তল বের করে হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ, কি দেখল কে জানে তবে নয়নার সাথে ওই দুষ্কৃতীদের পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যায়। গোড়ালি থেকে দুটো পিস্তল বের করে হাতে তুলে নেয় দানা। অতি সন্তর্পণে ডিকি খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেড়িয়ে আসে। সামনে একটা পুরানো ভাঙ্গা বিলেতি আমলের বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। দেখে অনেকটা ভুতুরে বাড়ির মতন মনে হল। দুটো পিস্তলের ডগায় সাইলেন্সার লাগিয়ে হাতে পা টিপে টিপে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ভাঙ্গা জানালার মধ্যে দিয়ে ভেতরের আলো দেখা পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে ভাঙ্গাচোরা বৈঠক খানায় মোহন আর চারজন ছেলে দাঁড়িয়ে। সবার হাতেই বন্দুক। বুবাইকে কোথাও দেখতে পায় না। দুইজন দুষ্কৃতি নয়নার মাথায় পিস্তল রেখে দাঁড়িয়ে।
আহত ক্ষুব্ধ নয়নার দিকে এগিয়ে এসে মোহন দাঁতে দাঁত পিষে গর্জে ওঠে, "শালী তোর জন্য আমার বন্ধু আজ মারা গেছে।"
নয়না পাল্টা সুরে বলে, "নিজের ক্ষমতায় কুলায়নি, শেষ পর্যন্ত ভাইকে হাতিয়ার করে আমাকে ধরলি? ভাবিস না তোরা বেঁচে যাবি।" বলেই বাঁকা হাসি দেয়।
মোহন ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, "আজ তুই বাঁচবি না। তোকে শেষ করার জন্য এইখানে ডাকা।" বলে নয়নাকে চেপে ধরে মাটির ওপরে বসিয়ে দেয়।
আহত সাপের মতন ফুঁসে ওঠে নয়না, "আমার ভাই কোথায়?" ওর হাতের ফাইল গুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে।
মাটি থেকে ফাইল গুলো উঠিয়ে এক এক করে দেখে মোহন ক্রুর হাসি দিয়ে বলে, "শালা মাদারচোদ দানা, আমার প্রকল্প হাতাতে গেছিল। তোর ভাইকে অপহরন করার পরিকল্পনা আসলে কার জানিস?"
দানা চোখ বন্ধ করে নেয়, এটা অবশ্যাম্ভাবি। মোহন অথবা সিমোন নয়নাকে বলেই দিত। নয়না ফুঁসে ওঠে, "মানে?"
অট্টহাসিতে ফেটে পরে মোহন খৈতান, হাতের পিস্তল নয়নার নাকের সামনে নাচিয়ে বলে, "তোর সুহৃদ বন্ধু, তোর হিতৈষী দানার ষড়যন্ত্র এটা।"
নয়নার চোখ জ্বলে ওঠে, মাথা ঝাঁকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "না, বিশ্বাস করি না। আগে বল, আমার ভাই কোথায়?"
পাশের একটা ছেলেকে মোহন নির্দেশ দেয় বুবাইকে আনতে। মোহন কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে হাসতে হাসতে বলে, "দানা তোর হিতৈষী, তোর সাথে আসেনি কেন? তোকে একাই আমার কাছে পাঠিয়েছে মরার জন্য? (চুকচুক করে মোহন) ইসসস আজকে রাতে তুই শেষ হবি আর আমার প্রকল্প গুলো আমার হাতে চলে আসবে।"
নয়না চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখে, হয়ত দানাকেই খুঁজছে ওর চোখ। দুই চোখে ভয়ঙ্কর আগুন নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "তোমরা তো ওর মেয়েকে অপহরন করতে চেয়েছিলে তাই না? আর সেটা আমার হাত দিয়েই করাতে। এটা ওর মাথার উপজ কোনোদিন হতে পারে না মোহন, এই পরিকল্পনা সিমোনের মাথার উপজ।"
ঠিক তখনি একটা ছেলে বুবাইকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। বুবাইয়ের পেছন পেছন হাসতে হাসতে সিমোন ঘরের মধ্যে ঢুকে পরে। সিমোনকে এইখানে দেখে একদিকে দানা আর অন্যদিকে নয়না, দুইজনে অবাক হয়ে যায়। ওরা ভাবতে পারেনি সিমোন নিজে এইখানে আসবে।
বুবাইকে দেখে নয়না কেঁদে ওঠে, "আমার ভাইকে ছেড়ে দাও। তোমার কথা মতন আমি তোমার প্রকল্পের কাগজ পত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি আর নিজেও এসেছি। জানি তুমি আমাকে আজ রাতে শেষ করে দেবে। কিন্তু সত্যি বলছি বিমানের মৃত্যুর পেছনে আমি দায়ী নই।"
বুবাইকে ছেলেটা ছেড়ে দিতেই এক দৌড়ে দিদির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর মুখে শরীরে হাত বুলিয়ে স্নেহ করে জিজ্ঞেস করে, "কিছু করেছে তোমাকে সোনা?"
বুবাই মাথা নাড়িয়ে সিমোনকে দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে, "মেরেছে আমাকে।"
হিংস্র নয়নার চোখ থেকে জলের জায়গায় রক্ত ঠিকরে বেড়িয়ে আসে। প্রাণপণ শক্তি দিয়ে বুবাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে মোহনের দিকে রক্ত চক্ষু হেনে জিজ্ঞেস করে, "একে কেন মেরেছো? একি ক্ষতি করেছে তোমাদের?"
সিমোন চিবিয়ে চিবিয়ে হাসতে হাসতে বলে, "না না এ কোন ক্ষতি করেনি তবে শালা মাদারজাত ভাই তোর। যখন থেকে এসেছে বোকাচোদা ছেলে শুধু দুদু খাবে দুদু খাবে বলে কাঁদছে। অত বড় ছেলেটা শেষে কিনা আমার বুকে হাত দেয়? কোন আস্পর্ধায় আমার বুকে হাত দেয়।" ওর দিকে পিস্তল উঁচিয়ে গর্জে ওঠে, "তোদের দুটোকেই আজকে শেষ করে দেব।"
নয়না চকিতে গোড়ালি থেকে দুটি পিস্তল একসাথে বের করে "দুম দুম" "দুম দুম" করে পর পর মোহনকে আর সিমোনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। দুটো গুলি মোহনের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। সিমোনে কাঁধে লাগে দুটো গুলি। অতর্কিত হামলায় মোহন কিছু বুঝতে পারে না কিন্তু ততক্ষনে গুলি ওর পেট বুক ফুঁড়ে বেড়িয়ে গেছে। বাকি ছেলেগুলো হিংস্র নয়নার রক্ত চক্ষু দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্ধ নয়নার পিস্তল ওদের দিকে তাগ করা, এক পা নড়লে গুলি ওদের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে।
রক্তাক্ত মোহন খৈতান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর সিমোন চিৎকার করে, "নাআআআ....." মোহনকে জড়িয়ে ধরে। রক্তাক্ত স্বামীর মাথা কোলে তুলে সিমোন নয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে ওঠে, "তুই একে গুলি করলি?" বলেই পাশে একটা লাঠির মতন কিছু ছিল সেটা হাতে নিয়ে নয়নাকে মারতে উদ্যত হয়।
হিংস্র ক্ষুদ্ধ নয়না ফুঁসতে ফুঁসতে বাকিদের দিকে পিস্তল তাগ করে মোহনের দিকে এগিয়ে যায়। নয়নার হাতে দুটো পিস্তল দেখে সিমোনের চেহারা আতঙ্কে রক্ত শূন্য হয়ে যায়। দানা চুপচাপ জানালা দিয়ে দেখে যায়, এর মধ্যে একজন শেষ, একজন আহত একজন ক্ষুদ্ধ। ক্ষুদ্ধ নয়নাকে যদি সিমোনে না মারে তাহলে ওর মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী। এখন কেন শক্তি, নাসির বলাইদের দেখা নেই, বারেবারে ঘড়ি দেখে দানা। এতক্ষণে ওদের এইখানে এসে যাওয়ার কথা।
মোহন আর সিমোনের দিকে এগিয়ে যায় নয়না। রক্তাক্ত মোহনের গলার ওপরে পা তুলে মাটির সাথে পিষে ধরে নয়না গর্জে ওঠে, "আমার বাবা আমার ভাইকে মারতে গেছিল তাকে পর্যন্ত ছাড়িনি। তোকে কেন ছেড়ে দেব?"
বলেই মোহনের মাথা লক্ষ্য করে আরো একটা গুলি করে, যার ফলে ওর মাথার খুলি গুঁড়িয়ে যায় আর সিমোনের কামিজ রক্তে ভেসে যায়।
মৃত মোহনের মাথা কোলে করে সিমোন আর্তনাদ করে ওঠে, "একি করলে তুমি? এই সব দানার ষড়যন্ত্র এইসব না হলে কি আর তোমার ভাইকে আমরা কিডন্যাপ করতে পারি? ওই আমাদের হাতে তোমার ভাইকে তুলে দিয়েছে।"
মোহন শেষ, সিমোন শেষ পর্যন্ত সত্য উজাগর করেই দিয়েছে। এইবারে দানাকে সামনে আসতেই হবে, নয়নার সম্মুখীন হতেই হবে, জানালার পেছনে আর লুকিয়ে থাকা নয়। তাল ঠুকে শেষ পর্যন্ত পিস্তল হাতে জানালা ভেঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। জানালা ভাঙ্গার আওয়াজ শুনে নয়না, ছলছল চোখে একবার ওর দিকে তাকায়। দুই হাতের পিস্তল পাশের ছেলেগুলোর দিকে তাগ করে এগিয়ে আসে নয়নার দিকে।
বুবাইকে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দিদিকে জড়িয়ে ধরে। ভাইকে দুই হাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে পড়ে নয়না। পাশের ছেলে গুলো দানার দিকে এগিয়ে আসতে যায়, সঙ্গে সঙ্গে দানার হাতের পিস্তলের গুলিতে এক এক করে দুইজনে প্রান হারায়। বাকি দুইজন সেখান থেকে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচে।
ছলছল চোখে নয়না এক হাতে পিস্তল এক হাতে ভাইকে জড়িয়ে একবার দানার দিকে তাকায়। তারপরে সিমোনের দিকে তাকিয়ে বলে, "আমাকে মারার ওর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আমি যদি ওর মেয়েকে অপহরন করতাম যেটা তোমরা করাতে চেয়েছিলে তাহলে কি ও আমাকে ছেড়ে দিত? কিন্তু আমার ভাই কেন সিমোন....." উত্তরের অপেক্ষা করে না নয়না। কথাটা শেষ করেই সিমোনের মাথা লক্ষ্য করে একটা গুলি করে ওর মাথার খুলি উড়িয়ে দেয়। প্রাণহীন সিমোন নিজের প্রাণহীন স্বামী মোহনের পাশে লুটিয়ে পড়ে।
দানার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়, এর পরের গুলি ওর মাথা অথবা বুক লক্ষ্য করেই হবে সেটা অজানা নয়। তবুও দানা নয়নার দিকে পিস্তল তাগ করে না। আহত হিংস্র বাঘিনী নয়নার চোখে চোখ রেখে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দানাও জানে এই নারীকে এইখানে শেষ করে দেওয়া উচিত, নয়না বেঁচে থাকলে ওর সমুহ বিপদ, ওর পরিবারের সমুহ বিপদ।
নয়না আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে ম্লান হেসে বলে, "সত্যি আমার মরে যাওয়াই উচিত, তাই না দানা? আমি বেঁচে থাকলে তুমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু আমি মরে গেলে আমার ভাইকে কে দেখবে? তুমি দেখবে? না না....." বলতে বলতে বুবাইকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে। বুবাই দিদিকে দুই হাতে জড়িয়ে কাঁধে মাথা গুঁজে দেয়। জল ভরা চোখে নয়না, একবার ভায়ের মাথায় চুমু খেয়ে ওর কানের ওপরে বন্দুক ধরে। স্মিত হেসে নয়না বলে, "আমি সত্যি ভীষণ পাপী, দানা। এই দেখো, আমি রুহিকে অপহরন করতাম আর অদৃষ্ট ঠিক আমার ভাইকে এদের হাতেই অপহরন করিয়ে সেই শাস্তি আমায় দিল। সমু আর সুমিতা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই পৃথিবীতে আমার জন্য আর কেউ অপেক্ষা করে নেই দানা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি মরে গেলে আমার ভাইকে কেউ দেখবে না দানা।"
"দুম" একটা গুলি সোজা বুবাইয়ের মাথার খুলি ভেদ করে দেয়। দানার সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। বুবাই কেঁপে ওঠে, ফুটো মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে নয়নার সারা চেহারা আর জামা ভিজিয়ে লাল করে দেয়। চোখ বন্ধ করে মৃত ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। দানা হাত থেকে পিস্তল ফেলে চুপচাপ স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে থাকে। নয়না যে নিজের ভাইকে মেরে ফেলবে সেটা দানা স্বপ্নেও ভাবেনি। ভেবেছিল সিমোন অথবা মোহন হয়ত ওদের পৌঁছানর আগেই বুবাইকে মেরে ফেলবে।
ঠিক তখনি বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দড়াম করে সামনের দরজা খুলে শক্তি আকরামের সাথে পুলিস এসে প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে। দানার শরীর পাথরের মতন শক্ত হয়ে যায়। মন থেকে চেয়েছিল নয়নার মৃত্যু হোক কিন্তু এইভাবে শেষ পর্যন্ত? দানা ধারনা করতে পারেনি যে নয়না নিজে হাতে নিজের ভাইকে হত্যা করবে। দানা ভেবেছিল সিমোন অথবা মোহনের হাতে নয়না আর তার ভাই খুন হবে আর কঙ্কনা আর নাসরিনের খুনে সিমোনেকে ফাঁসিয়ে দেবে। কিন্তু একা নয়না যে সবাইকে হত্যা করবে সেটা ওর ধারনার বাইরে ছিল, বিশেষ করে নিজে হাতে নিজের ভাইকে হত্যা করার ব্যাপারটা।
শক্তি ধীর পায়ে দানার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাতে মোবাইল তুলে দেয়। নিথর দানা, শক্তির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ওর দিকে তাকায়। শক্তি ইশারায় জানায় ফোনের অন্যপাশে মহুয়া। দানা মোবাইল তুলে মহুয়ার সাথে কথা বলে।
মহুয়া ওইপাশ থেকে চাপা গলায় বলে, "জিত নয়না আর বুবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।"
দানা স্থম্ভিত হয়ে যায়। একি বলছে মহুয়া?
মহুয়া আবার দানাকে বলে, "জিত, প্লিজ নয়না আর বুবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। যে করে হোক ফিরিয়ে নিয়ে এসো।"
নির্বাক দানা এক ভাবে সামনে বসা নয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। কোলে মৃত বুবাই, সারা শরীর ভাইয়ের রক্তে ভেসে গেছে নয়নার। দানা কোনোরকমে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে একটু বলবে?"
মহুয়া উত্তরে বলে, "তুমি যে করে হোক ফিরিয়ে নিয়ে এসো। বাড়ি এসো তারপরে সব বলছি।"
দানা শক্তির দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। শক্তি মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই নয়না বলে ওঠে।
নয়না চোখ খুলে দানার দিকে তাকিয়ে বলে, "জানো দানা, জীবনে প্রচুর পাপ করেছি। সমু নেই, আমার ভালোবাসা আমার বন্ধু আমার সবকিছু - সেই রাতে হারিয়ে গেছে।" নিজের কানের ওপরে পিস্তল রেখে ছলছল চোখে বলে, "মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে ভালো থেকো, দানা। আমি আমার সমুর কাছে চললাম।"
পুলিস ওর দিকে এগিয়ে যায় বিরত করতে। দানা হাত উঠিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, "দাঁড়াও, প্লিজ দাঁড়াও। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।"
নয়না স্মিত হেসে জল ভরা চোখ বন্ধ করে মৃত বুবাইকে বুকের কাছে জড়িয়ে নিজের কানের ওপরে গুলি চালায় "দুম"। গুলিটা নয়নার মাথার খুলি ভেদ করে যায়, রক্তের ফিনকি বেড়িয়ে আসে। পুলিস, দানা আকরাম শক্তি সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। পুলিস কাউকেই বাঁচাতে পারে না।
দানা নিজের মাথা ধরে অনেকক্ষণ চুপচাপ ওইখানে বসে থাকে। ওর হাত থেকে মোবাইল মাটিতে পড়ে যায়। মোবাইলে মহুয়ার অস্ফুট আর্তনাদ শোনা যায়, "না......"
চারপাশে ছড়ানো মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র। শক্তি মনা এক এক করে সেই কাগজ পত্র গুলো উঠিয়ে ফাইল বদ্ধ করে। পুলিস নিজের কাজে লেগে পড়ে।
দানা কাঁপতে কাঁপতে মোবাইল তুলে মহুয়াকে বলে, "হঠাৎ কি হলো?"
মহুয়া চাপা আহত কণ্ঠে উত্তর দেয়, "নয়না, বড়দার মেয়ে, শায়ন্তনি। বড়দার ডান হাতের আঘাতের দাগ, কুড়ি বছর আগের ওর মেয়ের দেওয়া। বাড়ি আসো, বড়দা বসে আছেন, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।"
চোখের সামনে সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায় দানার। পুলিস ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব কিছু খুলে জানায়। সিমোনে আর মোহন, নয়নার ভাইকে অপহরন করেছিল। বুবাইকে ছাড়ার বদলে ওরা নয়নাকে খুন করতে চেয়েছিল আর চেয়েছিল দানার নামে যে সম্পত্তি আছে সেই গুলো হাতিয়ে নিতে। কিন্তু একা নয়না বাকি সবাইকে মেরে ফেলে আর সেটা চাক্ষুষ পুলিসের সামনেই হয়েছে। পিস্তলের কথা জিজ্ঞাসা করলে দানা জানায় ওর কাছে কোন পিস্তল ছিল না, নয়না কোথা থেকে পিস্তল যোগাড় করেছে সেটা ওর জানা নেই।
নয়নার মৃত্যু দানাকে বিশেষ নাড়া দেয়না তবে চোখের সামনে নিজের ভাইকে খুন করেছে সেটা দেখে দানা বেশ বিচলিত হয়ে ওঠে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নয়না কি চেয়েছিল সেটাই বোঝা গেল না। অর্থ যশ প্রতিপত্তি, না প্রেম ভালোবাসা? কাকে বেশি ভালবাসতো নয়না ওরফে শায়ন্তনি বসাক? উত্তর আসে রক্তাক্ত লুটিয়ে থাকা শায়ন্তনি বসাকের ভগ্ন হৃদয় থেকে..... সমুদ্রকে ভালবাসতো শায়ন্তনি বসাক, আর অভিনেত্রী নয়না বোসের সুপ্ত ইচ্ছে ছিল রাজনৈতিক দলের নেত্রী হওয়ার। আর দূরে দানার বাড়িতে অপেক্ষায় এক পিতা, হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে কাছে পাবার আশায় হয়তো বসে আছে। এই ছলনাময়ী মহানগর প্রচুর আলেয়ায় ভরা। ওর বাড়িতে অপেক্ষারত এক আলোকের জ্যোতি, মহুয়া।
********** পর্ব ষোল সমাপ্ত **********
********** সমাপ্ত **********