22-09-2020, 10:43 PM
আমি নাস্রিন, ইরাকের এক প্রত্যন্ত ছোটো গ্রাম দ্বেলাহতে থাকি। পাশে বয়ে চলেছে একটা ছোটো নদী নাম দিয়ালা, গ্রীষ্ম কালে সেই নদীতে পানি থাকে না বললেই চলে। যে টুকু থাকে সে টুকু কোন রকমে বাঁধ দিয়ে জমা করে পানের উপযোগী করা হয়। কিছু দুরে শুরু হয়ে যায় মরুভুমি, তপ্ত বালুচর। আল্লাহ্* আমাদের প্রতি অতটা সদয় নয়। আব্বাজান উঠপাখীর একটা ফার্মে কাজ করে, আর তাতে যা রোজগার হয় কোনোরকমে বাড়ির সবার পেটে রুটি যোগাড় হয়। বেশির ভাগ রাতে আম্মু শুধু পানি খেয়ে, পেটের ওপরে ভিজে কাপড় বেঁধে শুয়ে পরে। আব্বাজান কোনদিন কোন পাতা চিবিয়ে, বা একটু আলু পুড়িয়ে খেয়ে থাকতেন, কিন্তু আমাদের জন্য রোজ রুটি কিনে আনত। আব্বু আর আম্মু ছাড়া বাড়িতে আমরা চার ভাই বোন, আমার পরের ভাই জামাল, ছোটো ভাই মাজিদ, আর ছোটো বোন আবিদা। আমাদের বাড়িতে বিজলি বাতি ছিলনা, আধুনিক সুখের থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। চিত্তবিনোদনের জন্য আমি ভাই বোনেদের সাথে খেলতাম। অন্ধকার নামলে আব্বাজানের মুখে গল্প শোনা আর লন্ঠনের আলোতে উঠের লোমের গালিচা বোনা ছাড়া কোন কাজ ছিল না।
আমার বারন্ত দেহ, পরনের কাপড় এঁটে বসে থাকে আমার তরুণী দেহের ওপরে। মাঝে মাঝে আরশিতে নিজেকে দেখে বড় ভালো লাগত। আরশি আমাকে বলত যে আমি নাকি বেশ সুন্দরী দেখতে, ডিম্বাকৃতি মুখবয়াব, মাথা লম্বা চুল, মাখনের মতন মসৃণ আর ফর্সা ত্বক, বুকের ওপরে দুটি ছোটো উঠপাখীর ডিম যেন বাঁধা। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই হাত চলে যেত নিজের দেহের ওপরে। কোনোরকমে পরনের কাপড় পরে বেড়িয়ে আসতাম বাথরুম থেকে। মাঝে মাঝে মনে হত যেন নিজের চোখে আমার তন্বী দেহটিকে খুবলে দিচ্ছে, হেসে ফেলতাম আরশি দেখে।
প্রায় রাতেই ভাই বোনেদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমি ছাদে চলে যেতাম। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, দেখতাম। ঘন কালো আকাশের বুকে শত সহস্র তারা যেন আমাকে ডাকত, আমি হাত বাড়িয়ে তাদের ডাকের উত্তর দিতাম। শুধু মাত্র রাতের বেলায় আমি স্বাধীনতার বাতাসের শ্বাস নিতে সক্ষম হতাম। ছেলেরা দূর মাদ্রাসায় পড়তে যেতে পারত, কিন্তু মেয়েরা সেখানে পড়তে যেতে পারেনা। আমি বড় ভাই, জামালের বই উলটে পালটে দেখতাম। জামাল আমাকে এই চার দেয়ালের বাইরের গল্প বলত। এইভাবে অন্তত হাসি কান্না মাখিয়ে আমাদের দিন চলছিল।
একদিন জামাল কলেজ থেকে এসে আমার পাশে বসে আমাকে বলল যে ও নাকি বিশাল একটা লোহার গাড়ি দেখেছে, সেই গাড়ির সামনে নাকি একটা লম্বা নল। গাড়ির চাকাও নাকি লোহার চেনে বাঁধা, ঘরঘর আওয়াজ করে বালির ওপরে দিয়ে, পাথরের ওপর দিয়ে নাকি সেই গাড়ি চলতে পারে। আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, জামাল বলল, যে সেই গাড়ির পেছনে অনেক লোক ছিল, সবার হাতে বন্দুক, সবার মাথায় লোহার টুপি, পিঠে বস্তা বাঁধা। সেদিনের পর থেকে বাড়ির মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
আব্বু জামাল আর মাজিদকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে উঠপাখীর ফার্মে কাজে লাগিয়ে দিল। আম্মু বাধা দিতে চেষ্টা করলে বলে, দেশে নাকি যুদ্ধ লেগেছে, টাকার প্রয়োজন বেশি, বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে অনেক পড়াশুনা করা যাবে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে জামাল আর মাজিদ গেল আব্বুর সাথে। আমি সেদিন জানালা দিয়ে ওদের কান্না ভরা চোখ দেখি, কিন্তু নিরুপায় এক মেয়ে আমি, কিছুতেই ভাইদের জন্য কিছু করতে পারলাম না। রাতে আমি ছাদের উপরে উঠে দেখি যে আব্বু এক কোনায় বসে কাঁদছে, আমি জিজ্ঞেস করাতে বললেন পেটের রুটি যোগাড় করতে ভাইদের কাজে লাগাতে হয়, ইচ্ছে করে জামালকে মাজিদকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়ায় নি। আমার চাচাজান খালেদের কাছে আব্বু গিয়েছিল কিছু দিনার ধার চাইতে। খালেদ চাচা আব্বুর দিকে বেশ কিছু ফিলা ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠের ফার্মে যদি ছেলেদের কাজ করায় তাহলে কিছু দিনার আগাম দেবে।
মাঝে মাঝেই রাতের অন্ধকার আর নিস্তবধতা খানখান করে দূর থেকে গুলির আওয়াজ বম্ব পড়ার আওয়াজ পেতাম। আমি তিন ভাইবোনের মাথা বুকের মধ্যে নিয়ে কান চেপে ধরতাম, যাতে ওই আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছাতে না পারে। আবিদা কেঁদে উঠত, ওকে কোলে করে বাকি ভাইদের নিয়ে রান্নাঘরের এককোনায় চলে যেতাম, সেখানে বাইরের আওয়াজ একটু কম আসত। গান গেয়ে, গল্প বলে ওদের কোন রকমে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম।
জামাল আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলত, “আপু আমি বড় হলে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব।”
আমি ওর কোঁকড়ানো চুলের ওপরে বিলিকেটে জিজ্ঞেস করতাম, “কোথায় নিয়ে যাবি।”
জামাল বলত, “আপু আমি ছবিতে দেখেছি, ওই নদীর ওই পারে অনেক বড় একটা শহর আছে, সেখানে ছেলে মেয়ে সবাই রাস্তায় বেড়াতে পারে, সবাই পড়াশুনা করতে পারে, সেখানে ওই রকম লোহার গাড়ি রাস্তায় চলে না। সেই রকম এক সহরে আমি নিয়ে যাব, তোমাকে, মাজিদকে, আবিদাকে।”
আমি ওর গালে চুমু খেয়ে বলি, “আম্মুকে নিয়ে যাবি না?”
জামাল বলে, “আম্মু যে আব্বুকে ছেড়ে যাবে না আপু। আর আব্বুকে নিয়ে যাবো না আমাকে পড়তে দেয়নি।”
আমি কি করে জামালকে বুঝাই, যে আব্বুর বুকের পাঁজর কেটে তোদের মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনেছে।
একদিন উঠের ফার্মে কিছু উগ্রপন্থী হামলা করে, টাকা পয়সা দিয়ে দিতে বলে। সেই গোলমালের মধ্যে খালেদ চাচা অফিস ঘর থেকে চুপিচুপি দিনারের বাক্স নিয়ে পেছনের পথ দিয়ে পালাতে যায় আর তখন এক উগ্রপন্থীর গুলিতে মৃত্যু হয়। খালেদ চাচার ইন্তেকাল হবার পরে আব্বাজান নায়েলা চাচিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আম্মু প্রথমে নায়েলা চাচিকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চায়নি। সেদিন শুনলাম যে খালেদ চাচা নাকি আমাকে একরাতের জন্য ওর বাড়িতে যেতে বলেছিল। আব্বুজান আম্মিকে অনেক বুঝিয়ে বললেন যে নায়েলা একা ছোটো হামিদকে নিয়ে কি করে থাকবে, বাইরের শূয়র কুকুর নায়েলা চাচিকে ছিঁড়ে খাবে। নায়েলা চাচি, খুব সুন্দরী ফর্সা গোলগাল, ঠিক জন্নতের হুর যেন আসমান থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। হামিদ কোলে, জুলু জুলু চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ফোকলা মুখে হাসে। হামিদের হাসি দেখে আম্মিজানের দিল গলে যায়। আম্মি হামিদকে কোলে নিয়ে নায়েলা চাচিকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। আব্বুর কাঁধের ওপরে বোঝা আরও বেড়ে যায়। আমি সারা রাত জেগে বেশ কয়েকটা গালিচা বানাতে শুরু করে দিলাম। একদিন রাতে বাইরে গিয়ে দেখি আব্বু চুপ করে বসে ফিলা গুনছে আর হিসাব কসছে। আমি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিলেন, হামিদের জন্য একটু দুধ কিনতে পারলে বড় ভালো হত।
ফজরের আজান তখন বাজেনি, এমন সময়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাড়ির কাছেই খুব জোরে বম্ব পড়ার আওয়াজ হল। সবাই চমকে উঠে পরে। হামিদ তাঁর স্বরে কেঁদে ওঠে সাথে সাথে আবিদা। নায়েলা চাচি হামিদকে বুকের কাছে চেপে ধরে, আবিদা আম্মির বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। জামাল আর মাজিদ আমাকে জড়িয়ে ধরে। আব্বুজান আমাদের রান্নাঘরের মধ্যে বন্ধ করে বাইরে বেড়িয়ে দেখতে যায় কি হয়েছে। আমি আব্বুজানের পেছন পেছন বেড়িয়ে আসি, দেখতে। আমাদের বাড়ির বেশ কাছেই বন্দুক ধারি বেশ কয়েকটা লোক বাড়ির লোকেদের ওপরে চড়াও হয়ে টেনে টেনে বাড়ি থেকে বের করে মারছে আর টাকা পয়সা চাইছে। যাদের বাড়িতে বিজলিবাতি ছিল, তাদের বাড়ি থেকে টিভি আর বাকি সব জিনিস বাইরে টেনে ফেলে দিচ্ছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই, আজানের সুর বাজার আগে আকাশ বাতাস মেয়েদের কান্নার সুরে ছেলেদের আরত চিৎকারে ভরে যায়। র*্যাট ট্যাট আওয়াজে বন্দুকের গুলি এলোপাথাড়ি বেড়িয়ে এসে এক জন লোককে আমাদের সামনে মাটিতে শুইয়ে দিল।
আব্বু পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে বকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আমি আব্বুকে একা বাইরে যেতে বারন করি। আমি ভেতরে চলে আসি। কিছু পরে দেখলাম যে আব্বুর কলার চেপে ধরে বেশ কয়েকটা বন্দুক ধারি আতঙ্কবাদী আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। আব্বুকে উঠানের ওপরে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিল আর মাথার ওপরে বন্দুক তাগ করে বাড়ির সবাইকে বেড়িয়ে আসতে বলে।
আব্বুকে ওই রকম অসহায় দেখে আমি বেড়িয়ে আসলাম, আমাকে দেখে ওদের চোখ চকচক করে উঠল যেন। একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল যে বাড়ির মধ্যে আর যারা আছে তাদের বের করে আনতে। আমি উত্তর দিলাম যে বাড়িতে আমি আর আব্বু ছাড়া আর কেউ থাকেনা। মানল না, ওরা, আমার চুলের মুঠি ধরে পেটের ওপরে বন্দুকের বাটের গুত মেরে মাটিতে ফেলে দিল। আমি আব্বুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আব্বুর মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, একটা চোখ রক্তের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে। আব্বু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই একটা বন্দুক ধারি আব্বুজানের মাথায় এত জোরে বন্দুকের বাট দিয়ে মারল যে আমার আব্বুজান আমার চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আর উঠল না।
ওদিকে উগ্রপন্থীরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পরে আম্মুজান আর নায়েলা চাচির ওপরে অত্যাচার শুরু করে দিল। আমার কানে ভেসে আসে ভাই বোনেদের কান্না। বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে বের করে দিল। জামাল, মাজিদ আর আবিদা আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। আমি কোন রকমে মাথা উঠিয়ে দেখলাম যে নায়েলা চাচির ওপরে একটা লোক চেপে বসে আর নায়েলা চাচির কাপড় ছিঁড়ে ফেলে করে কামনার অবসান করছে, পাশে আম্মুর উপরে আরও একজন। লোক চারটে আম্মু আর নায়েলা চাচির ওপরে অকথ্য অত্যাচার করে চলেছে।
হামিদ তাঁর স্বরে কাঁদছে, একজন হামিদকে ধরে ঘরের বাইরে ছুঁড়ে দেয়। আমি কোনোরকমে নিজেকে টেনে হামিদকে লুফে নিলাম, বুকের মাঝে চেপে ওর কান্না বন্ধ করতে চেষ্টা করলাম। একটা লোক আমার পরনের কাপড় টেনে খুলতে চেষ্টা করে। জামাল লোকটার পায়ে কামড় বসিয়ে দেয়। সেই উগ্রপন্থী জামালকে বন্দুকের বাট দিয়ে ঘাড়ে মারে, সেই দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আমি কোনোরকমে শরীরের শক্তি জুটিয়ে উগ্রপন্থীর পায়ের মাঝে সজোরে এক লাথি মারলাম। উগ্রপন্থী বন্দুক ছেড়ে জানুসন্ধি ধরে বসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে জামাল ওর ঘাড় কামড়ে ধরে আর এল পাথারি চর লাথি মারতে শুরু করে দেয়।
আমার বারন্ত দেহ, পরনের কাপড় এঁটে বসে থাকে আমার তরুণী দেহের ওপরে। মাঝে মাঝে আরশিতে নিজেকে দেখে বড় ভালো লাগত। আরশি আমাকে বলত যে আমি নাকি বেশ সুন্দরী দেখতে, ডিম্বাকৃতি মুখবয়াব, মাথা লম্বা চুল, মাখনের মতন মসৃণ আর ফর্সা ত্বক, বুকের ওপরে দুটি ছোটো উঠপাখীর ডিম যেন বাঁধা। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই হাত চলে যেত নিজের দেহের ওপরে। কোনোরকমে পরনের কাপড় পরে বেড়িয়ে আসতাম বাথরুম থেকে। মাঝে মাঝে মনে হত যেন নিজের চোখে আমার তন্বী দেহটিকে খুবলে দিচ্ছে, হেসে ফেলতাম আরশি দেখে।
প্রায় রাতেই ভাই বোনেদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমি ছাদে চলে যেতাম। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, দেখতাম। ঘন কালো আকাশের বুকে শত সহস্র তারা যেন আমাকে ডাকত, আমি হাত বাড়িয়ে তাদের ডাকের উত্তর দিতাম। শুধু মাত্র রাতের বেলায় আমি স্বাধীনতার বাতাসের শ্বাস নিতে সক্ষম হতাম। ছেলেরা দূর মাদ্রাসায় পড়তে যেতে পারত, কিন্তু মেয়েরা সেখানে পড়তে যেতে পারেনা। আমি বড় ভাই, জামালের বই উলটে পালটে দেখতাম। জামাল আমাকে এই চার দেয়ালের বাইরের গল্প বলত। এইভাবে অন্তত হাসি কান্না মাখিয়ে আমাদের দিন চলছিল।
একদিন জামাল কলেজ থেকে এসে আমার পাশে বসে আমাকে বলল যে ও নাকি বিশাল একটা লোহার গাড়ি দেখেছে, সেই গাড়ির সামনে নাকি একটা লম্বা নল। গাড়ির চাকাও নাকি লোহার চেনে বাঁধা, ঘরঘর আওয়াজ করে বালির ওপরে দিয়ে, পাথরের ওপর দিয়ে নাকি সেই গাড়ি চলতে পারে। আমি অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, জামাল বলল, যে সেই গাড়ির পেছনে অনেক লোক ছিল, সবার হাতে বন্দুক, সবার মাথায় লোহার টুপি, পিঠে বস্তা বাঁধা। সেদিনের পর থেকে বাড়ির মেয়েদের বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
আব্বু জামাল আর মাজিদকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে উঠপাখীর ফার্মে কাজে লাগিয়ে দিল। আম্মু বাধা দিতে চেষ্টা করলে বলে, দেশে নাকি যুদ্ধ লেগেছে, টাকার প্রয়োজন বেশি, বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে অনেক পড়াশুনা করা যাবে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে জামাল আর মাজিদ গেল আব্বুর সাথে। আমি সেদিন জানালা দিয়ে ওদের কান্না ভরা চোখ দেখি, কিন্তু নিরুপায় এক মেয়ে আমি, কিছুতেই ভাইদের জন্য কিছু করতে পারলাম না। রাতে আমি ছাদের উপরে উঠে দেখি যে আব্বু এক কোনায় বসে কাঁদছে, আমি জিজ্ঞেস করাতে বললেন পেটের রুটি যোগাড় করতে ভাইদের কাজে লাগাতে হয়, ইচ্ছে করে জামালকে মাজিদকে মাদ্রাসা থেকে ছাড়ায় নি। আমার চাচাজান খালেদের কাছে আব্বু গিয়েছিল কিছু দিনার ধার চাইতে। খালেদ চাচা আব্বুর দিকে বেশ কিছু ফিলা ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠের ফার্মে যদি ছেলেদের কাজ করায় তাহলে কিছু দিনার আগাম দেবে।
মাঝে মাঝেই রাতের অন্ধকার আর নিস্তবধতা খানখান করে দূর থেকে গুলির আওয়াজ বম্ব পড়ার আওয়াজ পেতাম। আমি তিন ভাইবোনের মাথা বুকের মধ্যে নিয়ে কান চেপে ধরতাম, যাতে ওই আওয়াজ ওদের কানে পৌঁছাতে না পারে। আবিদা কেঁদে উঠত, ওকে কোলে করে বাকি ভাইদের নিয়ে রান্নাঘরের এককোনায় চলে যেতাম, সেখানে বাইরের আওয়াজ একটু কম আসত। গান গেয়ে, গল্প বলে ওদের কোন রকমে ঘুম পাড়িয়ে দিতাম।
জামাল আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলত, “আপু আমি বড় হলে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব।”
আমি ওর কোঁকড়ানো চুলের ওপরে বিলিকেটে জিজ্ঞেস করতাম, “কোথায় নিয়ে যাবি।”
জামাল বলত, “আপু আমি ছবিতে দেখেছি, ওই নদীর ওই পারে অনেক বড় একটা শহর আছে, সেখানে ছেলে মেয়ে সবাই রাস্তায় বেড়াতে পারে, সবাই পড়াশুনা করতে পারে, সেখানে ওই রকম লোহার গাড়ি রাস্তায় চলে না। সেই রকম এক সহরে আমি নিয়ে যাব, তোমাকে, মাজিদকে, আবিদাকে।”
আমি ওর গালে চুমু খেয়ে বলি, “আম্মুকে নিয়ে যাবি না?”
জামাল বলে, “আম্মু যে আব্বুকে ছেড়ে যাবে না আপু। আর আব্বুকে নিয়ে যাবো না আমাকে পড়তে দেয়নি।”
আমি কি করে জামালকে বুঝাই, যে আব্বুর বুকের পাঁজর কেটে তোদের মাদ্রাসা থেকে ছাড়িয়ে এনেছে।
একদিন উঠের ফার্মে কিছু উগ্রপন্থী হামলা করে, টাকা পয়সা দিয়ে দিতে বলে। সেই গোলমালের মধ্যে খালেদ চাচা অফিস ঘর থেকে চুপিচুপি দিনারের বাক্স নিয়ে পেছনের পথ দিয়ে পালাতে যায় আর তখন এক উগ্রপন্থীর গুলিতে মৃত্যু হয়। খালেদ চাচার ইন্তেকাল হবার পরে আব্বাজান নায়েলা চাচিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আম্মু প্রথমে নায়েলা চাচিকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চায়নি। সেদিন শুনলাম যে খালেদ চাচা নাকি আমাকে একরাতের জন্য ওর বাড়িতে যেতে বলেছিল। আব্বুজান আম্মিকে অনেক বুঝিয়ে বললেন যে নায়েলা একা ছোটো হামিদকে নিয়ে কি করে থাকবে, বাইরের শূয়র কুকুর নায়েলা চাচিকে ছিঁড়ে খাবে। নায়েলা চাচি, খুব সুন্দরী ফর্সা গোলগাল, ঠিক জন্নতের হুর যেন আসমান থেকে মাটিতে নেমে এসেছে। হামিদ কোলে, জুলু জুলু চোখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ফোকলা মুখে হাসে। হামিদের হাসি দেখে আম্মিজানের দিল গলে যায়। আম্মি হামিদকে কোলে নিয়ে নায়েলা চাচিকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। আব্বুর কাঁধের ওপরে বোঝা আরও বেড়ে যায়। আমি সারা রাত জেগে বেশ কয়েকটা গালিচা বানাতে শুরু করে দিলাম। একদিন রাতে বাইরে গিয়ে দেখি আব্বু চুপ করে বসে ফিলা গুনছে আর হিসাব কসছে। আমি জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিলেন, হামিদের জন্য একটু দুধ কিনতে পারলে বড় ভালো হত।
ফজরের আজান তখন বাজেনি, এমন সময়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাড়ির কাছেই খুব জোরে বম্ব পড়ার আওয়াজ হল। সবাই চমকে উঠে পরে। হামিদ তাঁর স্বরে কেঁদে ওঠে সাথে সাথে আবিদা। নায়েলা চাচি হামিদকে বুকের কাছে চেপে ধরে, আবিদা আম্মির বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। জামাল আর মাজিদ আমাকে জড়িয়ে ধরে। আব্বুজান আমাদের রান্নাঘরের মধ্যে বন্ধ করে বাইরে বেড়িয়ে দেখতে যায় কি হয়েছে। আমি আব্বুজানের পেছন পেছন বেড়িয়ে আসি, দেখতে। আমাদের বাড়ির বেশ কাছেই বন্দুক ধারি বেশ কয়েকটা লোক বাড়ির লোকেদের ওপরে চড়াও হয়ে টেনে টেনে বাড়ি থেকে বের করে মারছে আর টাকা পয়সা চাইছে। যাদের বাড়িতে বিজলিবাতি ছিল, তাদের বাড়ি থেকে টিভি আর বাকি সব জিনিস বাইরে টেনে ফেলে দিচ্ছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই, আজানের সুর বাজার আগে আকাশ বাতাস মেয়েদের কান্নার সুরে ছেলেদের আরত চিৎকারে ভরে যায়। র*্যাট ট্যাট আওয়াজে বন্দুকের গুলি এলোপাথাড়ি বেড়িয়ে এসে এক জন লোককে আমাদের সামনে মাটিতে শুইয়ে দিল।
আব্বু পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে বকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আমি আব্বুকে একা বাইরে যেতে বারন করি। আমি ভেতরে চলে আসি। কিছু পরে দেখলাম যে আব্বুর কলার চেপে ধরে বেশ কয়েকটা বন্দুক ধারি আতঙ্কবাদী আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। আব্বুকে উঠানের ওপরে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দিল আর মাথার ওপরে বন্দুক তাগ করে বাড়ির সবাইকে বেড়িয়ে আসতে বলে।
আব্বুকে ওই রকম অসহায় দেখে আমি বেড়িয়ে আসলাম, আমাকে দেখে ওদের চোখ চকচক করে উঠল যেন। একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল যে বাড়ির মধ্যে আর যারা আছে তাদের বের করে আনতে। আমি উত্তর দিলাম যে বাড়িতে আমি আর আব্বু ছাড়া আর কেউ থাকেনা। মানল না, ওরা, আমার চুলের মুঠি ধরে পেটের ওপরে বন্দুকের বাটের গুত মেরে মাটিতে ফেলে দিল। আমি আব্বুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আব্বুর মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, একটা চোখ রক্তের ফলে বন্ধ হয়ে গেছে। আব্বু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই একটা বন্দুক ধারি আব্বুজানের মাথায় এত জোরে বন্দুকের বাট দিয়ে মারল যে আমার আব্বুজান আমার চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আর উঠল না।
ওদিকে উগ্রপন্থীরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পরে আম্মুজান আর নায়েলা চাচির ওপরে অত্যাচার শুরু করে দিল। আমার কানে ভেসে আসে ভাই বোনেদের কান্না। বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে বের করে দিল। জামাল, মাজিদ আর আবিদা আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। আমি কোন রকমে মাথা উঠিয়ে দেখলাম যে নায়েলা চাচির ওপরে একটা লোক চেপে বসে আর নায়েলা চাচির কাপড় ছিঁড়ে ফেলে করে কামনার অবসান করছে, পাশে আম্মুর উপরে আরও একজন। লোক চারটে আম্মু আর নায়েলা চাচির ওপরে অকথ্য অত্যাচার করে চলেছে।
হামিদ তাঁর স্বরে কাঁদছে, একজন হামিদকে ধরে ঘরের বাইরে ছুঁড়ে দেয়। আমি কোনোরকমে নিজেকে টেনে হামিদকে লুফে নিলাম, বুকের মাঝে চেপে ওর কান্না বন্ধ করতে চেষ্টা করলাম। একটা লোক আমার পরনের কাপড় টেনে খুলতে চেষ্টা করে। জামাল লোকটার পায়ে কামড় বসিয়ে দেয়। সেই উগ্রপন্থী জামালকে বন্দুকের বাট দিয়ে ঘাড়ে মারে, সেই দেখে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আমি কোনোরকমে শরীরের শক্তি জুটিয়ে উগ্রপন্থীর পায়ের মাঝে সজোরে এক লাথি মারলাম। উগ্রপন্থী বন্দুক ছেড়ে জানুসন্ধি ধরে বসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে জামাল ওর ঘাড় কামড়ে ধরে আর এল পাথারি চর লাথি মারতে শুরু করে দেয়।