22-09-2020, 07:58 PM
সাপের কোঠর (#০৪)
রুহিকে বাড়িতে রেখে দিয়েই মহুয়া আর দানা, নয়নার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। নয়নার বাড়ির সামনে গিয়ে আকরামের সাথে দেখা হয়। আকরাম জানায়, বাড়িতে তখন পুলিস আসেনি, তবে ওর সেক্রেটারি আর ম্যানেজার এসে পৌঁছে গেছে। সবাই হয়তো দানা আর মহুয়ার অপেক্ষা করছে।
মহুয়াকে দেখে নয়না একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমার অদৃষ্ট, আমার পাপের বোঝা আমার ভাইকে কেন পোহাতে হবে মহুয়া। আমার ভাই কারুর ক্ষতি করেনি মহুয়া, প্লিজ কিছু একটা করো।"
দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওই কথা শুনে, টাকার জোরে কত কাজের মেয়ের সর্বনাশ এই মন্দ বুদ্ধি ছেলেটা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। সেদিন দানা না থাকলে হয়ত সঙ্গীতাকে আঁচড়ে কামড়ে আধমরা করে দিত। মহুয়ার দুই চোখে আগুন ঠিকরে পড়ছে, যেন বলতে চায়, কোন একসময়ে সুযোগ পেলে আমার মেয়েকে অপহরনের চক্রান্ত করেছিলে তাই না?
ঘর ভর্তি লোকজন, সেক্রেটারি আর ম্যানেজারের সাথে আরো বেশ কয়েক জন লোক এসে গেছে। সবার এক কথা, পুলিসে খবর দাও, আগে ওই স্মিতা নামের মডেল কে ধরা হোক তাহলেই কে অপহরন করেছে সেটা জানা যাবে। ময়নার সাথে যে দানার যোগাযোগ আছে সেটা নয়না জানে না। কিন্তু ময়নাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, ইতিমধ্যে শহর ছাড়িয়ে, এই প্রদেশ ছাড়িয়ে ট্রেনে করে ওরা অন্য শহরে গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য চলে গেছে। এখন পর্যন্ত কোন ফোন আসেনি। নিতা এক কোনায় চুপচাপ বসে। কি চলছে ওর মনে? হয়তো ভাবছে, আপদ বিদায় হয়েছে ভালোই হয়েছে।
মহুয়া আড় চোখে একবার দানার দিকে তাকিয়ে নয়নাকে ধরে সোফার ওপরে বসিয়ে বলে, "কি করে হলো এই সব একটু খুলে বলো তো?"
নয়না চোখের জল মুছে সব ঘটনা খুলে বলে, যার অধিকাংশ মহুয়ার জানা। নয়না শুটিংয়ে ব্যাস্ত ছিল, এই কয়দিনে বুবাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার একদম সময় পায়নি। স্মিতা নামের মডেলটা বুবাইয়ের মনে ধরে যাওয়াতে ওকে বাড়িতে আসতে বলতো আর বুবাইয়ের সাথে সময় কাটানোর জন্য বেশ ভালো টাকাই দিত ওকে। সেদিন দুপুরে, বুবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে স্মিতা। প্রথমে গররাজি হয় নয়না, অচেনা একজনের সাথে বুবাইকে ছাড়তে নারাজ, কিন্তু বুবাই নাছোড়বান্দা, শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দেয়। বিকেলে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে স্মিতা আর বুবাই কোথাও বেড়াতে বের হয়। ট্যাক্সি শহর ছাড়িয়ে বড় রাস্তা ধরলে নিতার সন্দেহ হয়। স্মিতা ওকে বলে শহরের বাইরে একটা বড় পার্ক আছে সেখানে নিয়ে যাবে বুবাইকে। নিতা চুপ করে থাকে, কিন্তু যখন স্মিতাকে কারুর সাথে ফোনে কথা বলতে শোনে তখন নিতার সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে যায় যে স্মিতার অভিসন্ধি অন্য কিছু। সেটা সত্য প্রমানিত করে কিছুপরেই ওদের ট্যাক্সির সামনে একটা কালো রঙের ভ্যান গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই গাড়ি থেকে জনা চারেক মুখোশ পরা ছেলে নেমে ট্যাক্সি চালকের মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দেয়। তারপরে নিতাকে আর স্মিতাকে বেঁধে ফেলে, ওদের চোখ বেঁধে নাকের ওপরে রুমাল চপে অজ্ঞান করে দেয়। তারেপরে ওরা বুবাইকে নিয়ে কোথাও চলে যায়। ট্যাক্সি চালক আর নিতার জ্ঞান ফিরলে দেখে যে, সেই স্থানে স্মিতা নেই। ওদের কাছের ফোন, টাকা পয়সা যা ছিল সব ওই দুস্কৃতিরা নিয়ে চলে গেছে। ট্যাক্সি চালকের সাহায্যে বাড়ি পৌঁছেই নয়নাকে ফোন করে সব জানিয়ে দেয় নিতা। শুটিং ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে মহুয়াকে ফোন করে নয়না।
ওরা সবাই ফোনের অপেক্ষায় বসে। এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা করে মাঝ রাত হয়ে যায়। চরম উৎকণ্ঠায় নয়নার ওষ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। চোখের জল আর ফুরানোর নাম নেই। মহুয়া যত ওকে শান্ত হতে বলে ততই নয়না কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। দানা চুপচাপ গম্ভীর ভাবে সোফায় বসে ফোনের অপেক্ষা করে।
মাঝ রাতে নয়নার ফোন বেজে ওঠে। কাঁপা হাতে সবার দিকে তাকিয়ে নয়না ফোন উঠায়। অন্যপাশে এক অচেনা পুরুষের কণ্ঠস্বর ওকে বলে, "তোর ভাই ভালো আছে। যদি ওকে জ্যান্ত দেখতে চাস তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোর হিতৈষী বন্ধু বিশ্বজিৎ মন্ডলের কাছে মিস্টার মোহন খৈতানের প্রকল্পের যা কাগজপত্র আছে, সেই সব নিয়ে তমালগুড়ির রাস্তা ধর। ওই কাগজপত্র হাতে পেলে আমরা তোর ভাইকে ছেড়ে দেব। বাকি নির্দেশ মহানগর ছাড়ানোর পরে পাবি।"
আগন্তুকের নির্দেশ শুনে দানা আর মহুয়া যেমন স্থম্ভিত হয়ে যায় তেমনি নয়না অবাক হয়ে যায়। নয়না একবার মহুয়ার দিকে তাকায় একবার দানার দিকে। দানা ফাঁদে পড়ে গেছে, এটা যে সিমোন আর মোহনের কুটিল চাল সেটা বুঝতে একটুকু দেরি লাগলো না। এখন যদি দানা না বলে তাহলে নয়না প্রশ্ন উঠাবে, হয়ত মোহন সোজাসুজি বলে দেবে এই চক্রান্তের পেছনে দানার বুদ্ধি কাজ করছে। সমুদ্রের মৃত্যুতে নয়না একে ক্ষুদ্ধ আহত বাঘিনীর মতন ফুঁসছে, যদি জানতে পারে যে ওর ভাইয়ের এই অপহরনের পেছনে দানার হাত আছে, তাহলে দানা ঘোর বিপদে পরে যাবে। আর যদি দানা নয়নার সাথে কাগজ পত্র নিয়ে যায়, তাহলে ওর বেঁচে ফিরে আসার আশঙ্কা এক প্রকার নেই। ওইখানে নিশ্চয় সিমোনের সামনে পড়লে নয়নাকে সবকিছু খুলে বলে দেবে আর তখন দুইজনে একত্রে মিলে ওকে জ্যান্ত ছাড়বে না। মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে, সেই সাথে দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ওর মাথার ওপরে কেউ যেন গরম তরল গলানো লোহা ঢেলে দিয়েছে। আগন্তুক যে মোহন খৈতান নিজে সেটা প্রমান হয়ে যায়। পুলিসের কাছে যাওয়া যাবে না, নয়নার সামনে মুখ খোলা যাবে না। ভীষণ উভয়সঙ্কটে পরে যায় মহুয়া আর দানা। পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে চোখে চোখে ইঙ্গিতে কথা সারে।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, "কি করবে?"
দানা ইঙ্গিতে জানায়, "দাঁড়াও দেখি।"
ফোন ছেড়ে মাথা নিচু করে নয়না কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, তারপরে মাথা নাড়িয়ে ওদের বলে, "মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র মানে ভাইয়ের কিডন্যাপের পেছনে ওদের হাত।" কাতর কণ্ঠে দানার দিকে তাকিয়ে বলে, "কি করবো দানা?"
দানা নিজেও জানে না কি করবে। ভীষণ উভয়সঙ্কটে পরে গেছে। যেদিকে পা রাখবে সেদিকে সাক্ষাৎ মৃত্যু। যদি এখুনি নয়নাকে আসল কথা খুলে বলে তাহলেও ওর নিস্তার নেই আর যদি ওর সাথে যায় তাহলেও নিস্তার নেই। দানার চিন্তামগ্ন রূপ দেখে মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে। এইবারে দানাকে একদম জালে আটকে ফেলেছে সিমোনে, এই জাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কোন লক্ষন দেখতে পাচ্ছে না কেউই। দানা খানিকক্ষণ ভেবে চিন্তে ঠিক করে, কাগজ পত্র, বন্দুক পিস্তল লোকজন সাথে নিয়েই যাবে। তবে নয়নার চোখের আড়াল করে। আসলে দানা চায় সবাই শেষ হয়ে যাক, কিন্তু নয়না দেখে ফেললে লোকজন নিয়ে যেতে বাধা দেবে।
দানার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নয়না আরও বেশি বিচলিত হয়ে ওঠে। মহুয়ার হাত ধরে কাতর প্রার্থনা করে, "কি করবো বলে দাও।"
মহুয়ার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে উত্তর দেয়, "আমি জানি না নয়না।"
নয়না ওর হাত ধরে বলে, "এক বার শুধু একবার আমার ভাই ফিরে আসুক তারপরে ওদের আমি শেষ করে দেব।" কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে, "প্লিজ, দানাকে বল মোহনের কাগজ পত্র নিয়ে আমার সাথে যেতে।"
দানা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় মহুয়াকে হ্যাঁ বলতে বলে। মহুয়া নয়নাকে বলে, "ঠিক আছে আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি, তুমি ততখনে তৈরি হয়ে নাও।"
নয়না ঘরে ঢুকতেই, মহুয়া দানাকে একদিকে টেনে মনের আশঙ্কা ব্যাক্ত করে জিজ্ঞেস করে, "এইবারে কি হবে গো? যদি কাগজ পত্র না নিয়ে যাও তাহলে ওইখানে গিয়ে সিমোনে সব কিছু নয়নাকে বলে দেবে আর দুইজনে একত্র হয়ে গেলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। আর যদি নিয়ে যাও তাহলেও বিপদ।"
বুক ভরে শ্বাস নেয় দানা, কিছুক্ষণ ভেবে নিজের পরিকল্পনা জানায়, "আমি কাগজ পত্র আর নয়নাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যাওয়ার কিছুপরে তুমি বাকিদের আমাকে অনুসরন করতে বলে দেবে। বেশি চিন্তা করো না, পাপড়ি।"
মহুয়া ছলছল চোখে ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে, কি বলে? চিন্তা করবে না? আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় এই দশ মিনিটে ওর গায়ের এক লিটার রক্ত শুকিয়ে গেছে আর ছেলেটা চিন্তা করতে বারন করে? মেয়েদের কি কোনোদিন বুঝেছে? ওর জামা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মহুয়া, একটু পরেই নয়নাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। জানে না সকালে ফিরবে আদৌ না ফিরবে না। যদি না ফেরে তাহলে সোজা পুলিশ, কিন্তু ততক্ষণে ওর যা সর্বনাশ হওয়ার সেটা হয়েই যাবে। তাও সিমোন আর মোহনকে ছাড়বে না মহুয়া। বিমানের বাগান বাড়ি যাওয়ার চেয়েও এটা বেশি ভয়ঙ্কর। সেই সময়ে ওদের কাছে একটা পরিকল্পনা ছিল এইবারে ওদের কাছে কোন পরিকল্পনা নেই। জানেই না মোহন খৈতান কোথায় বুবাইকে লুকিয়ে রেখেছে, জানেই না ওদের সাথে কতজন লোক থাকবে। মহুয়া ওর বাজু শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো ছেড়ে দিলেই উড়ে চলে যাবে চিরতরে। বারেবারে এই যাওয়া আর নিতে পারছে না মহুয়া, রোজদিন দানা বাড়ি থেকে বের হলে ওর বুক কাঁপে, ঠিক ঠাক বাড়িতে ফিরবে তো?
নয়না জিন্স আর শার্ট পরে তৈরি, পায়ে জুতো গলায় স্কার্ফ দেখে মহুয়া আর দানার কিঞ্চিত সন্দেহ হয়। দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে না যে একদম পুরুষ মার্কা পোশাক পরে যেতে হবে।
ওদের দিকে এগিয়ে এসে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার কাছে পিস্তল আছে?"
দানা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, "তুমি পিস্তল নিয়ে কি করবে?"
চোয়াল শক্ত করে চোখের জল মুছে দানাকে উত্তর দেয়, "পিস্তল থাকলে দাও দানা।" তারপরে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি জানো না ভাইয়ের জন্য আমি কি করতে পারি। ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল বলে আমি আমার বাবাকে ছাড়িনি। আর এরা পর, এদের মাথায় গুলি করে তবে ফিরবো।"
নয়নাকে ক্ষান্ত করে দানা বলে, "আমি সাথেই আছি, চলো। যা হবার সেটা দুইজনে একসাথে মোকাবিলা করবো আমরা।"
ওইদিকে সবাই জানে যে এক মরণ ফাঁদে পা রাখতে চলেছে কিন্তু সেই কথা কেউই মুখ থেকে বলতে চাইছে না।
বের হওয়ার আগে নয়না আর্ত চোখে মহুয়ার হাত ধরে বলে, "পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও মহুয়া। আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ভীষণ এক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ ছিলাম। এতদিনে বলার সাহস হয়নি। আসলে কি জানো, বাপ্পা নস্করকে সরানোর পরে আমাদের মতলব ছিল দানাকে সরানোর। যে কোন বাবা মায়ের প্রাণ তার সন্তানের মধ্যে আটকে থাকে। রুহিকে অপহরন করলে দানা ভেঙ্গে পড়বে, আর তখন ওকে দিয়ে যা কিছু করিয়ে নেওয়া যাবে।"
কথাটা কানে যেতেই মহুয়ার চোখে আগুন ঠিকড়ে বের হয়। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অতীব জ্বলন্ত জ্বালামুখী শান্ত করে হিমশীতল কণ্ঠে উত্তর দেয়, "তুমি এই ষড়যন্ত্র করেছিলে সেটা আমি জানতাম। ভেবেছিলাম নিজে মুখে স্বীকার করবে, কোনোদিন কিন্তু করলে না। যাইহোক, এখন যাও, দেখ কি হয়।"
বাড়ি থেকে নীচে নেমে নয়না নিজের গাড়িতে ওঠে। দানা, আকরামের কাছ থেকে আরো দুটো পিস্তল চেয়ে নেয়। নিজের দুইখানা নয়নাকে দেবে আর নিজের কাছে দুই খানা রাখবে। খৈতানের মুখোমুখি হলে কে কার সাথে মিলে যাবে তার ঠিকানা নেই। যদি নয়না আর সিমোন মিলে যায় তাহলে নিজের আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চাই, আর যদি না মেশে তাহলে নয়না সিমোনকে মারবে তার জন্য ওকে বন্দুক দিতে হবে।
গাড়িতে ওঠার আগে মহুয়া ওর হাত শক্ত করে ধরে ছলছল চোখে বলে, "সকালে ব্রেকফাস্টে কি খাবে?"
কথাটা শুনে দানার নাকের পাটা ফুলে ওঠে, বুকের মাঝে প্রেয়সীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মহুয়া সর্বশক্তি দিয়ে দানাকে জড়িয়ে ধরে, যদি এটা ওদের শেষ দেখা হয় তাহলে ভোররাতে মা মেয়ে দুইজনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে। এই জীবনে যদি দানা এসে ওর হাত না ধরে তাহলে আর কারুর হাত ও ধরবে না।
বহুকষ্টে মহুয়াকে আলিঙ্গন পাশ থেকে ছেড়ে দিয়ে নয়নার সাথে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির স্টিয়ারিং দানার হাতে। মহুয়া অনেকক্ষণ ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না রাতের অন্ধকারে দানার গাড়ি মিলিয়ে যায়। নয়না নির্বাক, দানা নির্বাক, মুখে কোন কথা নেই কারুর, দুইজনে চিন্তায় মগ্ন, কি হবে এরপরে। গাড়ি নিয়ে সোজা নিজের অফিসে যায়, সেখান থেকে খৈতানের প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়ে আবার গাড়িতে ওঠে। হাতে একটু সময় আছে, তাই ধীরে ধীরেই গাড়ি চালাতে থাকে।
ঠিক সেই সময়ে আবার নয়নার ফোন বেজে ওঠে। নয়না আর দানা মুখ চাওয়াচায়ি করে, ইঙ্গিতে ফোন উঠাতে বলে নয়নাকে। ফোনে অন্য পাশের আগন্তুক ওকে নির্দেশ দেয়, "বিশ্বজিতের কাছ থেকে কি মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়েছিস?"
নয়না উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
আগন্তুক নির্দেশ দেয়, "তাহলে এইবারে বিশ্বজিতকে গাড়ি থেকে নেমে যেত বল। তোকে বলে দিয়েছিলাম একা আসতে। আমাদের সাথে কোন চালাকি করতে যাস না নয়না।"
কথাটা শুনে মনে হল ওদের কেউ অনুসরন করছে না হলে এতক্ষণ পরে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতো না। গাড়ি আবার দানার অফিসে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। চরম উৎকণ্ঠায় নয়নার গলা শুকিয়ে গেছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। একা যাওয়া ভীষণ বিপদ। দানা ওকে শান্ত করে বলে গাড়ির ডিকিতে বন্দী হয়ে ওর সাথেই যাবে। নিরুপায় নয়না দানার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের পার্কিংয়ে চলে যায়। নামার আগে নিজের দুটো পিস্তল নয়নার হাতে তুলে দিয়ে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয় কি ভাবে গুলি চালাতে হবে। নয়না জানে একবার ওদের হাতে পড়লে ওর নিস্তার নেই সুতরাং যদি মরতে হয় তাহলে ওদের মেরে ফেলে তবেই মরবে আর সেই প্রস্তুতি নেয়। দানা ওকে আরো বলে, কোমরে অথবা পকেটে পিস্তল সবাই রাখে আর ওকে নিশ্চয় মোহনের লোকেরা পরীক্ষা করবে। পকেটে পিস্তল থাকলে অতি সহজে ধরা পরে যাবে, সুতরাং পিস্তল দুটো পায়ের গোড়ালিতে বেঁধে দেয়। এত নীচ পর্যন্ত কেউই আর পরীক্ষা করে দেখবে না, সুযোগ বুঝে যেন নয়না গুলি চালায়। দানা পাশেই থাকবে। চুপচাপ সব কথা মন দিয়ে শোনার পরে দানাকে কি বলবে ভেবে পায় না নয়না।
নয়নার ছলছল চোখ দেখে দানার শরীর রিরি করে জ্বলে ওঠে। একবার মনে হয় এইখানেই ওকে মেরে ফেলে দিক কিন্তু নিজের হাতে রক্ত মাখাতে চায় না। কিন্তু যদি সিমোন ওকে সব কিছু বলে দেয় তাহলে দানার নিস্তার নেই। খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র নয়নাকে দিয়ে গাড়ির ডিকির মধ্যে ঢুকে পড়ে। নয়না ডিকি বন্ধ না করে দানাকে ভেতর থেকে টেনে ধরে থাকতে বলে। আকরামের দেওয়া দুটো পিস্তল নিজের গোড়ালিতে বেঁধে গুটিসুটি মেরে গাড়ির ডিকিতে ঢুকে পড়ে। নয়না ওকে বলে, ওর কাছে যেমন নির্দেশ আসবে, সুযোগ মতন দানাকে জানিয়ে দেবে।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করে দেয়, অন্ধকার দম বন্ধ হয়ে আসা ডিকির মধ্যে থেকে কিছুই বোঝা যায় না কোথায় যাচ্ছে। তমালগুড়ির রাস্তা মোহনের বাগান বাড়ির রাস্তা থেকে ভিন্ন দিকে, এইদিকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটাই চিন্তা। একটাই ভরসা, ওদের পেছনে হয়ত এতক্ষণে আকরাম, নাসির শক্তি বলাই সবাই অনুসরন করছে। অবশ্য এই অনুসরনের বিষয়ে নয়নার অজানা।
অনেকক্ষণ গাড়ি চলার পরে নয়নার জোর গলা শোনা যায়, "মেটেবাড়ি পার করেছি।" কিছুপরে, "বাঁ দিকে গ্রামের মধ্যে ঢুকলাম। ...... সামনে একটা পুরানো ভাঙ্গা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। ...... পেছনে একটা গাড়ি আসছে। ......"
গাড়ি যেমন নাচানাচি শুরু করেছে সেটা থেকে অনায়াসে বোঝা গেল যে গাড়ি এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে। কিছুদুর গিয়ে গাড়ি থেমে গেল। পাশে আরো একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। অন্ধকারে ছোট বদ্ধ ডিকিতে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়।
রুহিকে বাড়িতে রেখে দিয়েই মহুয়া আর দানা, নয়নার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। নয়নার বাড়ির সামনে গিয়ে আকরামের সাথে দেখা হয়। আকরাম জানায়, বাড়িতে তখন পুলিস আসেনি, তবে ওর সেক্রেটারি আর ম্যানেজার এসে পৌঁছে গেছে। সবাই হয়তো দানা আর মহুয়ার অপেক্ষা করছে।
মহুয়াকে দেখে নয়না একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমার অদৃষ্ট, আমার পাপের বোঝা আমার ভাইকে কেন পোহাতে হবে মহুয়া। আমার ভাই কারুর ক্ষতি করেনি মহুয়া, প্লিজ কিছু একটা করো।"
দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ওই কথা শুনে, টাকার জোরে কত কাজের মেয়ের সর্বনাশ এই মন্দ বুদ্ধি ছেলেটা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। সেদিন দানা না থাকলে হয়ত সঙ্গীতাকে আঁচড়ে কামড়ে আধমরা করে দিত। মহুয়ার দুই চোখে আগুন ঠিকরে পড়ছে, যেন বলতে চায়, কোন একসময়ে সুযোগ পেলে আমার মেয়েকে অপহরনের চক্রান্ত করেছিলে তাই না?
ঘর ভর্তি লোকজন, সেক্রেটারি আর ম্যানেজারের সাথে আরো বেশ কয়েক জন লোক এসে গেছে। সবার এক কথা, পুলিসে খবর দাও, আগে ওই স্মিতা নামের মডেল কে ধরা হোক তাহলেই কে অপহরন করেছে সেটা জানা যাবে। ময়নার সাথে যে দানার যোগাযোগ আছে সেটা নয়না জানে না। কিন্তু ময়নাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, ইতিমধ্যে শহর ছাড়িয়ে, এই প্রদেশ ছাড়িয়ে ট্রেনে করে ওরা অন্য শহরে গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য চলে গেছে। এখন পর্যন্ত কোন ফোন আসেনি। নিতা এক কোনায় চুপচাপ বসে। কি চলছে ওর মনে? হয়তো ভাবছে, আপদ বিদায় হয়েছে ভালোই হয়েছে।
মহুয়া আড় চোখে একবার দানার দিকে তাকিয়ে নয়নাকে ধরে সোফার ওপরে বসিয়ে বলে, "কি করে হলো এই সব একটু খুলে বলো তো?"
নয়না চোখের জল মুছে সব ঘটনা খুলে বলে, যার অধিকাংশ মহুয়ার জানা। নয়না শুটিংয়ে ব্যাস্ত ছিল, এই কয়দিনে বুবাইয়ের দিকে নজর দেওয়ার একদম সময় পায়নি। স্মিতা নামের মডেলটা বুবাইয়ের মনে ধরে যাওয়াতে ওকে বাড়িতে আসতে বলতো আর বুবাইয়ের সাথে সময় কাটানোর জন্য বেশ ভালো টাকাই দিত ওকে। সেদিন দুপুরে, বুবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে স্মিতা। প্রথমে গররাজি হয় নয়না, অচেনা একজনের সাথে বুবাইকে ছাড়তে নারাজ, কিন্তু বুবাই নাছোড়বান্দা, শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দেয়। বিকেলে নিতাকে সঙ্গে নিয়ে স্মিতা আর বুবাই কোথাও বেড়াতে বের হয়। ট্যাক্সি শহর ছাড়িয়ে বড় রাস্তা ধরলে নিতার সন্দেহ হয়। স্মিতা ওকে বলে শহরের বাইরে একটা বড় পার্ক আছে সেখানে নিয়ে যাবে বুবাইকে। নিতা চুপ করে থাকে, কিন্তু যখন স্মিতাকে কারুর সাথে ফোনে কথা বলতে শোনে তখন নিতার সন্দেহ বদ্ধমূল হয়ে যায় যে স্মিতার অভিসন্ধি অন্য কিছু। সেটা সত্য প্রমানিত করে কিছুপরেই ওদের ট্যাক্সির সামনে একটা কালো রঙের ভ্যান গাড়ি এসে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই গাড়ি থেকে জনা চারেক মুখোশ পরা ছেলে নেমে ট্যাক্সি চালকের মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দেয়। তারপরে নিতাকে আর স্মিতাকে বেঁধে ফেলে, ওদের চোখ বেঁধে নাকের ওপরে রুমাল চপে অজ্ঞান করে দেয়। তারেপরে ওরা বুবাইকে নিয়ে কোথাও চলে যায়। ট্যাক্সি চালক আর নিতার জ্ঞান ফিরলে দেখে যে, সেই স্থানে স্মিতা নেই। ওদের কাছের ফোন, টাকা পয়সা যা ছিল সব ওই দুস্কৃতিরা নিয়ে চলে গেছে। ট্যাক্সি চালকের সাহায্যে বাড়ি পৌঁছেই নয়নাকে ফোন করে সব জানিয়ে দেয় নিতা। শুটিং ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে মহুয়াকে ফোন করে নয়না।
ওরা সবাই ফোনের অপেক্ষায় বসে। এক ঘণ্টা দুই ঘণ্টা করে মাঝ রাত হয়ে যায়। চরম উৎকণ্ঠায় নয়নার ওষ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। চোখের জল আর ফুরানোর নাম নেই। মহুয়া যত ওকে শান্ত হতে বলে ততই নয়না কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। দানা চুপচাপ গম্ভীর ভাবে সোফায় বসে ফোনের অপেক্ষা করে।
মাঝ রাতে নয়নার ফোন বেজে ওঠে। কাঁপা হাতে সবার দিকে তাকিয়ে নয়না ফোন উঠায়। অন্যপাশে এক অচেনা পুরুষের কণ্ঠস্বর ওকে বলে, "তোর ভাই ভালো আছে। যদি ওকে জ্যান্ত দেখতে চাস তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোর হিতৈষী বন্ধু বিশ্বজিৎ মন্ডলের কাছে মিস্টার মোহন খৈতানের প্রকল্পের যা কাগজপত্র আছে, সেই সব নিয়ে তমালগুড়ির রাস্তা ধর। ওই কাগজপত্র হাতে পেলে আমরা তোর ভাইকে ছেড়ে দেব। বাকি নির্দেশ মহানগর ছাড়ানোর পরে পাবি।"
আগন্তুকের নির্দেশ শুনে দানা আর মহুয়া যেমন স্থম্ভিত হয়ে যায় তেমনি নয়না অবাক হয়ে যায়। নয়না একবার মহুয়ার দিকে তাকায় একবার দানার দিকে। দানা ফাঁদে পড়ে গেছে, এটা যে সিমোন আর মোহনের কুটিল চাল সেটা বুঝতে একটুকু দেরি লাগলো না। এখন যদি দানা না বলে তাহলে নয়না প্রশ্ন উঠাবে, হয়ত মোহন সোজাসুজি বলে দেবে এই চক্রান্তের পেছনে দানার বুদ্ধি কাজ করছে। সমুদ্রের মৃত্যুতে নয়না একে ক্ষুদ্ধ আহত বাঘিনীর মতন ফুঁসছে, যদি জানতে পারে যে ওর ভাইয়ের এই অপহরনের পেছনে দানার হাত আছে, তাহলে দানা ঘোর বিপদে পরে যাবে। আর যদি দানা নয়নার সাথে কাগজ পত্র নিয়ে যায়, তাহলে ওর বেঁচে ফিরে আসার আশঙ্কা এক প্রকার নেই। ওইখানে নিশ্চয় সিমোনের সামনে পড়লে নয়নাকে সবকিছু খুলে বলে দেবে আর তখন দুইজনে একত্রে মিলে ওকে জ্যান্ত ছাড়বে না। মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে, সেই সাথে দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ওর মাথার ওপরে কেউ যেন গরম তরল গলানো লোহা ঢেলে দিয়েছে। আগন্তুক যে মোহন খৈতান নিজে সেটা প্রমান হয়ে যায়। পুলিসের কাছে যাওয়া যাবে না, নয়নার সামনে মুখ খোলা যাবে না। ভীষণ উভয়সঙ্কটে পরে যায় মহুয়া আর দানা। পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে চোখে চোখে ইঙ্গিতে কথা সারে।
মহুয়া জিজ্ঞেস করে, "কি করবে?"
দানা ইঙ্গিতে জানায়, "দাঁড়াও দেখি।"
ফোন ছেড়ে মাথা নিচু করে নয়না কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, তারপরে মাথা নাড়িয়ে ওদের বলে, "মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র মানে ভাইয়ের কিডন্যাপের পেছনে ওদের হাত।" কাতর কণ্ঠে দানার দিকে তাকিয়ে বলে, "কি করবো দানা?"
দানা নিজেও জানে না কি করবে। ভীষণ উভয়সঙ্কটে পরে গেছে। যেদিকে পা রাখবে সেদিকে সাক্ষাৎ মৃত্যু। যদি এখুনি নয়নাকে আসল কথা খুলে বলে তাহলেও ওর নিস্তার নেই আর যদি ওর সাথে যায় তাহলেও নিস্তার নেই। দানার চিন্তামগ্ন রূপ দেখে মহুয়ার বুক কেঁপে ওঠে। এইবারে দানাকে একদম জালে আটকে ফেলেছে সিমোনে, এই জাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কোন লক্ষন দেখতে পাচ্ছে না কেউই। দানা খানিকক্ষণ ভেবে চিন্তে ঠিক করে, কাগজ পত্র, বন্দুক পিস্তল লোকজন সাথে নিয়েই যাবে। তবে নয়নার চোখের আড়াল করে। আসলে দানা চায় সবাই শেষ হয়ে যাক, কিন্তু নয়না দেখে ফেললে লোকজন নিয়ে যেতে বাধা দেবে।
দানার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নয়না আরও বেশি বিচলিত হয়ে ওঠে। মহুয়ার হাত ধরে কাতর প্রার্থনা করে, "কি করবো বলে দাও।"
মহুয়ার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে উত্তর দেয়, "আমি জানি না নয়না।"
নয়না ওর হাত ধরে বলে, "এক বার শুধু একবার আমার ভাই ফিরে আসুক তারপরে ওদের আমি শেষ করে দেব।" কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে, "প্লিজ, দানাকে বল মোহনের কাগজ পত্র নিয়ে আমার সাথে যেতে।"
দানা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় মহুয়াকে হ্যাঁ বলতে বলে। মহুয়া নয়নাকে বলে, "ঠিক আছে আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি, তুমি ততখনে তৈরি হয়ে নাও।"
নয়না ঘরে ঢুকতেই, মহুয়া দানাকে একদিকে টেনে মনের আশঙ্কা ব্যাক্ত করে জিজ্ঞেস করে, "এইবারে কি হবে গো? যদি কাগজ পত্র না নিয়ে যাও তাহলে ওইখানে গিয়ে সিমোনে সব কিছু নয়নাকে বলে দেবে আর দুইজনে একত্র হয়ে গেলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। আর যদি নিয়ে যাও তাহলেও বিপদ।"
বুক ভরে শ্বাস নেয় দানা, কিছুক্ষণ ভেবে নিজের পরিকল্পনা জানায়, "আমি কাগজ পত্র আর নয়নাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যাওয়ার কিছুপরে তুমি বাকিদের আমাকে অনুসরন করতে বলে দেবে। বেশি চিন্তা করো না, পাপড়ি।"
মহুয়া ছলছল চোখে ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে, কি বলে? চিন্তা করবে না? আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় এই দশ মিনিটে ওর গায়ের এক লিটার রক্ত শুকিয়ে গেছে আর ছেলেটা চিন্তা করতে বারন করে? মেয়েদের কি কোনোদিন বুঝেছে? ওর জামা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মহুয়া, একটু পরেই নয়নাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। জানে না সকালে ফিরবে আদৌ না ফিরবে না। যদি না ফেরে তাহলে সোজা পুলিশ, কিন্তু ততক্ষণে ওর যা সর্বনাশ হওয়ার সেটা হয়েই যাবে। তাও সিমোন আর মোহনকে ছাড়বে না মহুয়া। বিমানের বাগান বাড়ি যাওয়ার চেয়েও এটা বেশি ভয়ঙ্কর। সেই সময়ে ওদের কাছে একটা পরিকল্পনা ছিল এইবারে ওদের কাছে কোন পরিকল্পনা নেই। জানেই না মোহন খৈতান কোথায় বুবাইকে লুকিয়ে রেখেছে, জানেই না ওদের সাথে কতজন লোক থাকবে। মহুয়া ওর বাজু শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো ছেড়ে দিলেই উড়ে চলে যাবে চিরতরে। বারেবারে এই যাওয়া আর নিতে পারছে না মহুয়া, রোজদিন দানা বাড়ি থেকে বের হলে ওর বুক কাঁপে, ঠিক ঠাক বাড়িতে ফিরবে তো?
নয়না জিন্স আর শার্ট পরে তৈরি, পায়ে জুতো গলায় স্কার্ফ দেখে মহুয়া আর দানার কিঞ্চিত সন্দেহ হয়। দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে না যে একদম পুরুষ মার্কা পোশাক পরে যেতে হবে।
ওদের দিকে এগিয়ে এসে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "তোমার কাছে পিস্তল আছে?"
দানা অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, "তুমি পিস্তল নিয়ে কি করবে?"
চোয়াল শক্ত করে চোখের জল মুছে দানাকে উত্তর দেয়, "পিস্তল থাকলে দাও দানা।" তারপরে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, "তুমি জানো না ভাইয়ের জন্য আমি কি করতে পারি। ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়েছিল বলে আমি আমার বাবাকে ছাড়িনি। আর এরা পর, এদের মাথায় গুলি করে তবে ফিরবো।"
নয়নাকে ক্ষান্ত করে দানা বলে, "আমি সাথেই আছি, চলো। যা হবার সেটা দুইজনে একসাথে মোকাবিলা করবো আমরা।"
ওইদিকে সবাই জানে যে এক মরণ ফাঁদে পা রাখতে চলেছে কিন্তু সেই কথা কেউই মুখ থেকে বলতে চাইছে না।
বের হওয়ার আগে নয়না আর্ত চোখে মহুয়ার হাত ধরে বলে, "পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও মহুয়া। আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ভীষণ এক ষড়যন্ত্রের অঙ্গ ছিলাম। এতদিনে বলার সাহস হয়নি। আসলে কি জানো, বাপ্পা নস্করকে সরানোর পরে আমাদের মতলব ছিল দানাকে সরানোর। যে কোন বাবা মায়ের প্রাণ তার সন্তানের মধ্যে আটকে থাকে। রুহিকে অপহরন করলে দানা ভেঙ্গে পড়বে, আর তখন ওকে দিয়ে যা কিছু করিয়ে নেওয়া যাবে।"
কথাটা কানে যেতেই মহুয়ার চোখে আগুন ঠিকড়ে বের হয়। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অতীব জ্বলন্ত জ্বালামুখী শান্ত করে হিমশীতল কণ্ঠে উত্তর দেয়, "তুমি এই ষড়যন্ত্র করেছিলে সেটা আমি জানতাম। ভেবেছিলাম নিজে মুখে স্বীকার করবে, কোনোদিন কিন্তু করলে না। যাইহোক, এখন যাও, দেখ কি হয়।"
বাড়ি থেকে নীচে নেমে নয়না নিজের গাড়িতে ওঠে। দানা, আকরামের কাছ থেকে আরো দুটো পিস্তল চেয়ে নেয়। নিজের দুইখানা নয়নাকে দেবে আর নিজের কাছে দুই খানা রাখবে। খৈতানের মুখোমুখি হলে কে কার সাথে মিলে যাবে তার ঠিকানা নেই। যদি নয়না আর সিমোন মিলে যায় তাহলে নিজের আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক চাই, আর যদি না মেশে তাহলে নয়না সিমোনকে মারবে তার জন্য ওকে বন্দুক দিতে হবে।
গাড়িতে ওঠার আগে মহুয়া ওর হাত শক্ত করে ধরে ছলছল চোখে বলে, "সকালে ব্রেকফাস্টে কি খাবে?"
কথাটা শুনে দানার নাকের পাটা ফুলে ওঠে, বুকের মাঝে প্রেয়সীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মহুয়া সর্বশক্তি দিয়ে দানাকে জড়িয়ে ধরে, যদি এটা ওদের শেষ দেখা হয় তাহলে ভোররাতে মা মেয়ে দুইজনে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবে। এই জীবনে যদি দানা এসে ওর হাত না ধরে তাহলে আর কারুর হাত ও ধরবে না।
বহুকষ্টে মহুয়াকে আলিঙ্গন পাশ থেকে ছেড়ে দিয়ে নয়নার সাথে গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির স্টিয়ারিং দানার হাতে। মহুয়া অনেকক্ষণ ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না রাতের অন্ধকারে দানার গাড়ি মিলিয়ে যায়। নয়না নির্বাক, দানা নির্বাক, মুখে কোন কথা নেই কারুর, দুইজনে চিন্তায় মগ্ন, কি হবে এরপরে। গাড়ি নিয়ে সোজা নিজের অফিসে যায়, সেখান থেকে খৈতানের প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়ে আবার গাড়িতে ওঠে। হাতে একটু সময় আছে, তাই ধীরে ধীরেই গাড়ি চালাতে থাকে।
ঠিক সেই সময়ে আবার নয়নার ফোন বেজে ওঠে। নয়না আর দানা মুখ চাওয়াচায়ি করে, ইঙ্গিতে ফোন উঠাতে বলে নয়নাকে। ফোনে অন্য পাশের আগন্তুক ওকে নির্দেশ দেয়, "বিশ্বজিতের কাছ থেকে কি মোহন খৈতানের প্রকল্পের কাগজপত্র নিয়েছিস?"
নয়না উত্তর দেয়, "হ্যাঁ।"
আগন্তুক নির্দেশ দেয়, "তাহলে এইবারে বিশ্বজিতকে গাড়ি থেকে নেমে যেত বল। তোকে বলে দিয়েছিলাম একা আসতে। আমাদের সাথে কোন চালাকি করতে যাস না নয়না।"
কথাটা শুনে মনে হল ওদের কেউ অনুসরন করছে না হলে এতক্ষণ পরে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতো না। গাড়ি আবার দানার অফিসে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। চরম উৎকণ্ঠায় নয়নার গলা শুকিয়ে গেছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। একা যাওয়া ভীষণ বিপদ। দানা ওকে শান্ত করে বলে গাড়ির ডিকিতে বন্দী হয়ে ওর সাথেই যাবে। নিরুপায় নয়না দানার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের পার্কিংয়ে চলে যায়। নামার আগে নিজের দুটো পিস্তল নয়নার হাতে তুলে দিয়ে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয় কি ভাবে গুলি চালাতে হবে। নয়না জানে একবার ওদের হাতে পড়লে ওর নিস্তার নেই সুতরাং যদি মরতে হয় তাহলে ওদের মেরে ফেলে তবেই মরবে আর সেই প্রস্তুতি নেয়। দানা ওকে আরো বলে, কোমরে অথবা পকেটে পিস্তল সবাই রাখে আর ওকে নিশ্চয় মোহনের লোকেরা পরীক্ষা করবে। পকেটে পিস্তল থাকলে অতি সহজে ধরা পরে যাবে, সুতরাং পিস্তল দুটো পায়ের গোড়ালিতে বেঁধে দেয়। এত নীচ পর্যন্ত কেউই আর পরীক্ষা করে দেখবে না, সুযোগ বুঝে যেন নয়না গুলি চালায়। দানা পাশেই থাকবে। চুপচাপ সব কথা মন দিয়ে শোনার পরে দানাকে কি বলবে ভেবে পায় না নয়না।
নয়নার ছলছল চোখ দেখে দানার শরীর রিরি করে জ্বলে ওঠে। একবার মনে হয় এইখানেই ওকে মেরে ফেলে দিক কিন্তু নিজের হাতে রক্ত মাখাতে চায় না। কিন্তু যদি সিমোন ওকে সব কিছু বলে দেয় তাহলে দানার নিস্তার নেই। খৈতানের প্রকল্পের কাগজ পত্র নয়নাকে দিয়ে গাড়ির ডিকির মধ্যে ঢুকে পড়ে। নয়না ডিকি বন্ধ না করে দানাকে ভেতর থেকে টেনে ধরে থাকতে বলে। আকরামের দেওয়া দুটো পিস্তল নিজের গোড়ালিতে বেঁধে গুটিসুটি মেরে গাড়ির ডিকিতে ঢুকে পড়ে। নয়না ওকে বলে, ওর কাছে যেমন নির্দেশ আসবে, সুযোগ মতন দানাকে জানিয়ে দেবে।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করে দেয়, অন্ধকার দম বন্ধ হয়ে আসা ডিকির মধ্যে থেকে কিছুই বোঝা যায় না কোথায় যাচ্ছে। তমালগুড়ির রাস্তা মোহনের বাগান বাড়ির রাস্তা থেকে ভিন্ন দিকে, এইদিকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটাই চিন্তা। একটাই ভরসা, ওদের পেছনে হয়ত এতক্ষণে আকরাম, নাসির শক্তি বলাই সবাই অনুসরন করছে। অবশ্য এই অনুসরনের বিষয়ে নয়নার অজানা।
অনেকক্ষণ গাড়ি চলার পরে নয়নার জোর গলা শোনা যায়, "মেটেবাড়ি পার করেছি।" কিছুপরে, "বাঁ দিকে গ্রামের মধ্যে ঢুকলাম। ...... সামনে একটা পুরানো ভাঙ্গা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। ...... পেছনে একটা গাড়ি আসছে। ......"
গাড়ি যেমন নাচানাচি শুরু করেছে সেটা থেকে অনায়াসে বোঝা গেল যে গাড়ি এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে। কিছুদুর গিয়ে গাড়ি থেমে গেল। পাশে আরো একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। অন্ধকারে ছোট বদ্ধ ডিকিতে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়।