15-09-2020, 03:46 PM
ঠ) আমি মা হলাম
(Upload No. 179)
চুমকী বৌদিও চোখ বড় বড় করে বললো, “ওমা, দ্যাখ দ্যাখ সতী, তোর মেয়ে তার মাসিমণির গলা শুনেই উঠে পড়েছে। আমার সোনা মা, এসো আমার কোলে এসো” বলে খুব সাবধানতার সাথে শ্রীজাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর ছোট্ট কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো, “ওলে লেলে লেলে লেলে, আমাল থোত্ত থোনা মা, আমাল থোত্ত থোনামণি, উমমম উমমমম উমমমম” বলে শ্রীজার ছোট্ট মুখটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুললো।
আমি চুমকী বৌদির কাণ্ড দেখে একেবারে স্তম্ভিত। দীপ আর বিদিশার দিকে চেয়ে দেখি ওদেরও একই অবস্থা। আমি এতোটাই বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম যে বৌদি যে আমাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করলো সেটাও খেয়াল করি নি। বৌদির মুখে চোখে এতো খুশী ছিটকে বেড়চ্ছিলো যে আমরা তিনজনেই হাঁ হয়ে তার শ্রীজাকে আদর করা দেখে যাচ্ছিলাম।
অনেকক্ষণ শ্রীজাকে আদর করে বৌদি ওকে আমার কোলে দিয়ে বললো। “ধর তোর মেয়েকে। আমাকে এখন জেঠীমার কর্তব্য করতে দে আগে” বলে ঘরের কোনায় নামিয়ে রাখা প্যাকেটগুলো কাছে টেনে এনে একটা একটা করে খুলে খুলে শ্রীজার হাতে ছুঁইয়ে আরেকপাশে রেখে দিলো। আমরা তিনজন একেবারে হতবাক হয়ে বৌদির কাণ্ড কারখানা দেখে যাচ্ছিলাম। কত কিছু যে সে এনেছে শ্রীজার জন্যে! কোনো প্যাকেটে বেবী কেয়ারের কাপড়, গেঞ্জী, প্যান্টি, কোনো প্যাকেটে গরম জামা কাপড়, কোনোটাতে টুপি, মোজা, আবার কোনো প্যাকেটের ভেতর কাপড়ের নরম জুতো আর মোজা। একে একে অন্যান্য প্যাকেট গুলো খুলে টাওয়েলের সেট, মশারী, বেবী কসমেটিক্স, বডি অয়েল, অনেকগুলো পোশাকের সেট, কয়েকটা ন্যাপকিনের সেট, আরও কত কী। আমার তো দেখতে দেখতে চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম। সবার শেষ ছোট্ট একটা জুয়েলারীর বাক্স বের করে তার ভেতর থেকে একটা খুব সুন্দর দেখতে গলার চেইন বের করে শ্রীজার গলায় পড়িয়ে দিয়ে আবার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আমার গলা যেন প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমার নবজন্মা মেয়ের প্রতি চুমকী বৌদির এ ব্যবহারে আমার দু’চোখ ছাপিয়ে জল আসতে চাইছিলো যেন। মাথা নীচু করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আমি উদ্গত কান্নাকে ঠেকাবার চেষ্টা করলাম। বিদিশার মুখেও কোনো কথা নেই। হঠাৎ টের পেলাম দীপ উঠে বাইরের রুমে চলে গেলো। চুমকী বৌদির আর সেদিকে হুঁশ নেই। সে শ্রীজাকে আদর করতেই ব্যস্ত। বিদিশার দিকে মুখ তুলে চাইতেই বিদিশা আমাকে হাতের ইশারা করে বাইরের রুমে চলে গেলো।
উদ্গত কান্নাকে কণ্ঠরোধ করে চেপে রাখতে সফল হলেও চোখের জলের ধারাকে আটকাতে পারলাম না। জল ভরা চোখেই সদ্য মা হয়ে ওঠা এক রমণী দেখতে থাকলো তার স্বল্প পরিচিতা আরেক রমণী তার নবজাত শিশুকন্যাকে আদর করছে, স্নেহ চুম্বনে ভড়িয়ে দিচ্ছে। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক মা-ই নিজের সন্তানকে অপরের ভালোবাসা পেতে দেখলে অভিভূত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয় নি। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো চুমকী বৌদি যেন আমার মা, আমার আজন্ম পরিচিত খুব কাছের একজন, যে আমার খুশীতে আমার চেয়েও বেশী খুশী হয়েছে।
সামনের ঘর থেকে হঠাৎ বিদিশার গলা শুনতে পেলাম। বিদিশা বলছে, “একি দীপদা, এ কি ছেলেমানুষি করছো বলো তো? কেঁদো না প্লীজ। সামলাও নিজেকে। কী হয়েছে বলবে তো”?
বিদিশার গলা শুনে চুমকী বৌদিও চমকে উঠলো। ভালো করে কান পাততেই একটা খুব চাপা গুমড়ে ওঠার শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম দীপ বোধ হয় কাঁদছে। দীপের সঙ্গে এতোদিন ঘর করে আমি জেনেছি যে ও বেশ শক্ত মনের মানুষ। কোনো কিছুতেই সহজে ঘাবড়ায় না। আর বিচার বিবেচনাও যথেষ্ট পরিপক্ক। তাকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে আমিও কম অবাক হলাম না। কী হলো দীপের? কাঁদছে কেন ও? ওর মনে কি অজান্তে কোনো ব্যথা দিয়ে ফেলেছি আমরা কেউ? আমার এমন ভাবনার মধ্যেই চুমকী বৌদি আমার কোলে শ্রীজাকে শুইয়ে দিয়ে বললো, “দাঁড়া, ভাবিসনে, আমি দেখছি” বলে সে-ও বাইরের রুমে চলে গেলো।
আমারও আর একা বসে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। আমারও ইচ্ছে করছিলো ছুটে বাইরের ঘরে গিয়ে দীপকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু মা আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছেন, আগামী দশদিন এই ভেতরের রুম থেকে আমি যেন অন্য কোথাও না যাই। তাই মনে মনে চাইছিলাম বিদিশা বা চুমকী বৌদি জোর করে দীপকে এঘরে নিয়ে আসুক।
প্রায় তিন চার মিনিট ধরে শুনলাম খুব চাপা গলায় চুমকী বৌদি আর বিদিশা কথা বলছে। আমার বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ডটা কোন এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। আমি আর থাকতে না পেরে শ্রীজাকে কোলে নিয়েই বিছানা থেকে নামবার চেষ্টা করতেই বৌদির গলা শুনতে পেলাম, “এই তোর আবার কি হলো? তুই আবার নামছিস কেন? আমরা তো এসে গেছি। তুই বোস”।
মুখ উঠিয়ে দেখি বিদিশা আর চুমকী বৌদি দীপের দু’হাত ধরে আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। দীপের মুখের দিকে চেয়ে দেখি ওর চোখের কোল দুটো বেশ ফুলে উঠেছে। কয়েকটা মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বললো না। আমিও প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে আমার তখনও দামামা বেজে চলেছে।
আমিও কোনো কথা না বলে দীপের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম। চুমকী বৌদি দীপকে টেনে এনে আমার পাশে বসিয়ে দিলো। দীপ ততক্ষণে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওর হৃদয়ের কোনও এক গুপ্ত স্থানে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কাছে আসতেই আমি দীপের একটা হাত প্রায় খামচে ধরে বলে উঠলাম, “কী হয়েছে তোমার সোনা? বলো আমাকে। আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি? যদি তেমন কিছু করেই থাকি তাহলে সেটা আমাকে খুলে বলে বুঝিয়ে দাও। আমাকে শাস্তি দাও। নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে না রেখে আমাকে খুলে বলো? মেয়ে হয়েছে বলে তুমি কি দুঃখ পেয়েছো? আমার ওপরে রাগ করেছো”?
দীপ চট করে একহাতে আমার মুখ চেপে ধরে বললো, “ছিঃ মণি, এসব কী বলছো তুমি? আমি কখনো তোমার ওপর রাগ করতে পারি? আর ছেলে হয়নি বলে আমার দুঃখ হতে পারে? আমি তো বরাবরই মেয়েই চাইছিলাম, সে কি তুমি জানো না? আমার কান্না পেয়েছিলো সম্পূর্ণ অন্য কারনে। তার সাথে তোমাদের কারুর কোনো সংযোগ নেই”।
বলেই চুমকী বৌদির একটা হাত ধরে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বললো, “থ্যাঙ্ক ইউ বৌদি। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। তুমি জানো না আজ তুমি কী করলে”।
চুমকী বৌদি বেশ অবাক হয়ে বললো, “ওমা, আমি আবার এমন কী করলাম? ওঃ, বুঝেছি। তোমার মেয়ের জন্যে এসব এনেছি বলেই বুঝি এ কথা বলছো? কিন্তু বিশ্বাস করো দীপ তোমাদের কাউকে দুঃখ দেবার জন্যে এসব কিছু করি নি আমি। তোমাকে আর সতীকে দেখার পর থেকে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো তোমরা আমার পরম আপনজন। তাই তোমাদের মেয়ে হয়েছে শুনে আমি আর থাকতে পারলাম না ছুটে না এসে। কিন্তু তোমরা যদি এতে সত্যিই দুঃখ পেয়ে থাকো তাহলে আমি ক্ষমা চাইছি তোমাদের সকলের কাছে”।
দীপ বৌদির হাত ধরে বিছানার একপাশে বসিয়ে দিয়ে বললো, “ও কথা বোলো না বৌদি। এখানে বোসো। আমি বলছি সব খুলে। বিদিশা তুমিও এসো”।
বিদিশাও এসে আমার আরেকপাশে বসতে দীপ বললো, “জানো বৌদি, খুব ছোটো বেলায় বাবাকে হারিয়েছি আমি। বাবা চলে যাবার পর অভিভাবক হয়েছিলো আমার বড়দা, যে আমার থেকে প্রায় পঁচিশ বছর বড়। কলেজ ফাইনাল পাশ করার পরেই আমার জীবনে একের পর এক বিপর্যয় আসতে শুরু করেছিলো। আমার নিজের দুই দাদা ছিলো। বড়দা থাকতেন মেঘালয়ে আর ছোড়দা থাকতেন আসামে। বড়দার আদেশে মেঘালয়ে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু প্রায় সমবয়সী ভাইপো আর বড় বৌদির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়াশোনায় মন দিতে পারি নি। বড়দা বড় বৌদি প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফিরে এসে ছিলাম আসামে। সেখানেও ছোটো বৌদি ভালো চোখে দেখতেন না আমাকে। বিধবা মা, যার হাতে আর্থিক, সাংসারিক বা প্রশাসনিক কোনও ক্ষমতাই ছিলোনা, নিঃশব্দে আমার জন্যে কেবল চোখের জল ফেলতেন। ছোটো বৌদির প্ররোচনায় ছোড়দাও একদিন আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনটে বছর শুকনো ঝরাপাতার মতো শুধু এখানে সেখানে উড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। ওই তিন বছরে আমি বেঁচে থাকার জন্যে রিক্সা চালানো থেকে শুরু করে মুদির দোকান, বিনা বেতনের চাকরী, টিউশানি কত কিছুই না করেছি। চুরি না করেও চোর অপবাদ মাথা পেতে নিতে বাধ্য হয়েছি। কার কোন পূন্য ফলে জানিনা, শেষ মেশ ব্যাঙ্কে চাকরী পেয়েছি। চাকরী পাবার সাথে সাথে মা-র সমস্ত খাওয়া পড়া আর চিকিৎসার ভার নিজে হাতে তুলে নিয়েছিলাম। বছরে দু’বার গিয়ে তার সাথে দেখা করি। তারপর ধীরে ধীরে সতী, বিদিশা আর তোমরা আমার জীবনে এলে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১, এ ক’টা বছর যে কীভাবে কাটিয়েছি সেটা ভাবলে এখন শুধু একটা দুঃস্বপ্নের মতোই লাগে। একটানা পাঁচ দিন পেটে কোনো খাবার জোটেনি আমার। আজ সেইসব আত্মীয় স্বজনদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কোন পূণ্যের ফলে সতীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি জানিনা। ঠিক তেমনি জানিনা, বিদিশা আমার কে, তুমি আমার কে? বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজন কতো জনকেই তো দেখলাম। সব সম্পর্কগুলোই কেমন যেন ঠুনকো। তোমাদের সাথে আমার কী সম্পর্ক বলো তো? যে ছেলেটা একসময়ে পাঁচ দিনেও নিজের পেটে খাবারের একটা দানা পর্যন্ত দিতে পারেনি আজ তার মেয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মেই তোমার কাছ থেকে এতো সব উপহার সামগ্রী পেলো। এ কার পূণ্য ফলে জানিনা”।
একটু থেকে দীপ আবার আমার দিকে চেয়ে বললো, “আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে মণি? আত্মীয়, স্বজন, পরিজন কাকে বলে? ওই যারা আমাকে তাদের নিজেদের কাছ থেকে রাস্তার কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলো, তারা? না কি এই যে এ মুহূর্তে তোমার আমার পাশে বসে আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে, এই বিদিশা চুমকী বৌদিরা”?
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। নিজের পরিবার আত্মীয় স্বজনদের সাথে দীপের যে কোনো সম্পর্ক নেই সে কথা দীপ আমায় বিয়ের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু বিয়ের পর এই তিন চার বছরে বিভিন্ন সময়ে শুধু আমার শাশুড়ি মা ছাড়া দীপের মুখে আর কারো কথা শুনিনি। দু’একবার প্রসঙ্গক্রমে তাদের কথা উঠে এলেও দীপ খুব চালাকী করে সেসব এড়িয়ে যেতো। আমি বুঝতে পারতাম, যে কোনো কারনেই হোক দীপ তাদের কথা আলোচনা করতে চায় না আমার সাথে। আমিও কোনোদিন ওকে জোর করিনি। আমার শাশুড়িকে দেখেছি আমি। খুব ধর্মপ্রাণা মহিলা। নিরামিশভোজী শাশুড়ি মা এখনও নিজের রান্না নিজে করে খান। আর ভাগবদ, গীতা, মহাভারত, রামায়ন পাঠ করেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। সেকালের ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া, কিন্তু তার হাতের লেখা দেখলে বই পুস্তকের ছাপানো অক্ষরগুলোকেও তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমরা গেলে নিজে হাতে রান্না করে আমায় খাওয়ান প্রতিবার।
কিন্তু আজ চুমকী বৌদি ওর মনের ভেতরটাকে এমনভাবে আন্দোলিত করে দিয়েছে যে ওর মনের বদ্ধ আগল খুলে গেছে। তাই এসব কথা বলছে। কিন্তু ওই ‘পাঁচ দিন না খেয়ে থাকা’, ‘রিক্সা চালানো’, ‘চোর অপবাদ পাওয়া’ এ সব কথা শুনে আমি আর আমার চোখের জল আটকাতে পারলাম না। দীপের দুঃখের প্রতিটা কথা যেন আমার বুকের মধ্যে হাতুরীর ঘা হয়ে আঘাত করছিলো, তাই দীপের মুখ চেপে ধরে আমি কেঁদে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলাম, “দীপ, তুমি থামবে এবার? আর কিচ্ছুটি বোলো না। আমি আর শুনতে পারছি না। প্লীজ চুপ করো” বলে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
______________________________
ss_sexy
(Upload No. 179)
চুমকী বৌদিও চোখ বড় বড় করে বললো, “ওমা, দ্যাখ দ্যাখ সতী, তোর মেয়ে তার মাসিমণির গলা শুনেই উঠে পড়েছে। আমার সোনা মা, এসো আমার কোলে এসো” বলে খুব সাবধানতার সাথে শ্রীজাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর ছোট্ট কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো, “ওলে লেলে লেলে লেলে, আমাল থোত্ত থোনা মা, আমাল থোত্ত থোনামণি, উমমম উমমমম উমমমম” বলে শ্রীজার ছোট্ট মুখটাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুললো।
আমি চুমকী বৌদির কাণ্ড দেখে একেবারে স্তম্ভিত। দীপ আর বিদিশার দিকে চেয়ে দেখি ওদেরও একই অবস্থা। আমি এতোটাই বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম যে বৌদি যে আমাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করলো সেটাও খেয়াল করি নি। বৌদির মুখে চোখে এতো খুশী ছিটকে বেড়চ্ছিলো যে আমরা তিনজনেই হাঁ হয়ে তার শ্রীজাকে আদর করা দেখে যাচ্ছিলাম।
অনেকক্ষণ শ্রীজাকে আদর করে বৌদি ওকে আমার কোলে দিয়ে বললো। “ধর তোর মেয়েকে। আমাকে এখন জেঠীমার কর্তব্য করতে দে আগে” বলে ঘরের কোনায় নামিয়ে রাখা প্যাকেটগুলো কাছে টেনে এনে একটা একটা করে খুলে খুলে শ্রীজার হাতে ছুঁইয়ে আরেকপাশে রেখে দিলো। আমরা তিনজন একেবারে হতবাক হয়ে বৌদির কাণ্ড কারখানা দেখে যাচ্ছিলাম। কত কিছু যে সে এনেছে শ্রীজার জন্যে! কোনো প্যাকেটে বেবী কেয়ারের কাপড়, গেঞ্জী, প্যান্টি, কোনো প্যাকেটে গরম জামা কাপড়, কোনোটাতে টুপি, মোজা, আবার কোনো প্যাকেটের ভেতর কাপড়ের নরম জুতো আর মোজা। একে একে অন্যান্য প্যাকেট গুলো খুলে টাওয়েলের সেট, মশারী, বেবী কসমেটিক্স, বডি অয়েল, অনেকগুলো পোশাকের সেট, কয়েকটা ন্যাপকিনের সেট, আরও কত কী। আমার তো দেখতে দেখতে চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম। সবার শেষ ছোট্ট একটা জুয়েলারীর বাক্স বের করে তার ভেতর থেকে একটা খুব সুন্দর দেখতে গলার চেইন বের করে শ্রীজার গলায় পড়িয়ে দিয়ে আবার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আমার গলা যেন প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমার নবজন্মা মেয়ের প্রতি চুমকী বৌদির এ ব্যবহারে আমার দু’চোখ ছাপিয়ে জল আসতে চাইছিলো যেন। মাথা নীচু করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আমি উদ্গত কান্নাকে ঠেকাবার চেষ্টা করলাম। বিদিশার মুখেও কোনো কথা নেই। হঠাৎ টের পেলাম দীপ উঠে বাইরের রুমে চলে গেলো। চুমকী বৌদির আর সেদিকে হুঁশ নেই। সে শ্রীজাকে আদর করতেই ব্যস্ত। বিদিশার দিকে মুখ তুলে চাইতেই বিদিশা আমাকে হাতের ইশারা করে বাইরের রুমে চলে গেলো।
উদ্গত কান্নাকে কণ্ঠরোধ করে চেপে রাখতে সফল হলেও চোখের জলের ধারাকে আটকাতে পারলাম না। জল ভরা চোখেই সদ্য মা হয়ে ওঠা এক রমণী দেখতে থাকলো তার স্বল্প পরিচিতা আরেক রমণী তার নবজাত শিশুকন্যাকে আদর করছে, স্নেহ চুম্বনে ভড়িয়ে দিচ্ছে। হয়তো এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক মা-ই নিজের সন্তানকে অপরের ভালোবাসা পেতে দেখলে অভিভূত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয় নি। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো চুমকী বৌদি যেন আমার মা, আমার আজন্ম পরিচিত খুব কাছের একজন, যে আমার খুশীতে আমার চেয়েও বেশী খুশী হয়েছে।
সামনের ঘর থেকে হঠাৎ বিদিশার গলা শুনতে পেলাম। বিদিশা বলছে, “একি দীপদা, এ কি ছেলেমানুষি করছো বলো তো? কেঁদো না প্লীজ। সামলাও নিজেকে। কী হয়েছে বলবে তো”?
বিদিশার গলা শুনে চুমকী বৌদিও চমকে উঠলো। ভালো করে কান পাততেই একটা খুব চাপা গুমড়ে ওঠার শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম দীপ বোধ হয় কাঁদছে। দীপের সঙ্গে এতোদিন ঘর করে আমি জেনেছি যে ও বেশ শক্ত মনের মানুষ। কোনো কিছুতেই সহজে ঘাবড়ায় না। আর বিচার বিবেচনাও যথেষ্ট পরিপক্ক। তাকে এমনভাবে কাঁদতে দেখে আমিও কম অবাক হলাম না। কী হলো দীপের? কাঁদছে কেন ও? ওর মনে কি অজান্তে কোনো ব্যথা দিয়ে ফেলেছি আমরা কেউ? আমার এমন ভাবনার মধ্যেই চুমকী বৌদি আমার কোলে শ্রীজাকে শুইয়ে দিয়ে বললো, “দাঁড়া, ভাবিসনে, আমি দেখছি” বলে সে-ও বাইরের রুমে চলে গেলো।
আমারও আর একা বসে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। আমারও ইচ্ছে করছিলো ছুটে বাইরের ঘরে গিয়ে দীপকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু মা আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছেন, আগামী দশদিন এই ভেতরের রুম থেকে আমি যেন অন্য কোথাও না যাই। তাই মনে মনে চাইছিলাম বিদিশা বা চুমকী বৌদি জোর করে দীপকে এঘরে নিয়ে আসুক।
প্রায় তিন চার মিনিট ধরে শুনলাম খুব চাপা গলায় চুমকী বৌদি আর বিদিশা কথা বলছে। আমার বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ডটা কোন এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। আমি আর থাকতে না পেরে শ্রীজাকে কোলে নিয়েই বিছানা থেকে নামবার চেষ্টা করতেই বৌদির গলা শুনতে পেলাম, “এই তোর আবার কি হলো? তুই আবার নামছিস কেন? আমরা তো এসে গেছি। তুই বোস”।
মুখ উঠিয়ে দেখি বিদিশা আর চুমকী বৌদি দীপের দু’হাত ধরে আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। দীপের মুখের দিকে চেয়ে দেখি ওর চোখের কোল দুটো বেশ ফুলে উঠেছে। কয়েকটা মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বললো না। আমিও প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে আমার তখনও দামামা বেজে চলেছে।
আমিও কোনো কথা না বলে দীপের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম। চুমকী বৌদি দীপকে টেনে এনে আমার পাশে বসিয়ে দিলো। দীপ ততক্ষণে নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওর হৃদয়ের কোনও এক গুপ্ত স্থানে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। কাছে আসতেই আমি দীপের একটা হাত প্রায় খামচে ধরে বলে উঠলাম, “কী হয়েছে তোমার সোনা? বলো আমাকে। আমি কি কিছু ভুল করে ফেলেছি? যদি তেমন কিছু করেই থাকি তাহলে সেটা আমাকে খুলে বলে বুঝিয়ে দাও। আমাকে শাস্তি দাও। নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে না রেখে আমাকে খুলে বলো? মেয়ে হয়েছে বলে তুমি কি দুঃখ পেয়েছো? আমার ওপরে রাগ করেছো”?
দীপ চট করে একহাতে আমার মুখ চেপে ধরে বললো, “ছিঃ মণি, এসব কী বলছো তুমি? আমি কখনো তোমার ওপর রাগ করতে পারি? আর ছেলে হয়নি বলে আমার দুঃখ হতে পারে? আমি তো বরাবরই মেয়েই চাইছিলাম, সে কি তুমি জানো না? আমার কান্না পেয়েছিলো সম্পূর্ণ অন্য কারনে। তার সাথে তোমাদের কারুর কোনো সংযোগ নেই”।
বলেই চুমকী বৌদির একটা হাত ধরে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বললো, “থ্যাঙ্ক ইউ বৌদি। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। তুমি জানো না আজ তুমি কী করলে”।
চুমকী বৌদি বেশ অবাক হয়ে বললো, “ওমা, আমি আবার এমন কী করলাম? ওঃ, বুঝেছি। তোমার মেয়ের জন্যে এসব এনেছি বলেই বুঝি এ কথা বলছো? কিন্তু বিশ্বাস করো দীপ তোমাদের কাউকে দুঃখ দেবার জন্যে এসব কিছু করি নি আমি। তোমাকে আর সতীকে দেখার পর থেকে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো তোমরা আমার পরম আপনজন। তাই তোমাদের মেয়ে হয়েছে শুনে আমি আর থাকতে পারলাম না ছুটে না এসে। কিন্তু তোমরা যদি এতে সত্যিই দুঃখ পেয়ে থাকো তাহলে আমি ক্ষমা চাইছি তোমাদের সকলের কাছে”।
দীপ বৌদির হাত ধরে বিছানার একপাশে বসিয়ে দিয়ে বললো, “ও কথা বোলো না বৌদি। এখানে বোসো। আমি বলছি সব খুলে। বিদিশা তুমিও এসো”।
বিদিশাও এসে আমার আরেকপাশে বসতে দীপ বললো, “জানো বৌদি, খুব ছোটো বেলায় বাবাকে হারিয়েছি আমি। বাবা চলে যাবার পর অভিভাবক হয়েছিলো আমার বড়দা, যে আমার থেকে প্রায় পঁচিশ বছর বড়। কলেজ ফাইনাল পাশ করার পরেই আমার জীবনে একের পর এক বিপর্যয় আসতে শুরু করেছিলো। আমার নিজের দুই দাদা ছিলো। বড়দা থাকতেন মেঘালয়ে আর ছোড়দা থাকতেন আসামে। বড়দার আদেশে মেঘালয়ে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু প্রায় সমবয়সী ভাইপো আর বড় বৌদির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়াশোনায় মন দিতে পারি নি। বড়দা বড় বৌদি প্রায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফিরে এসে ছিলাম আসামে। সেখানেও ছোটো বৌদি ভালো চোখে দেখতেন না আমাকে। বিধবা মা, যার হাতে আর্থিক, সাংসারিক বা প্রশাসনিক কোনও ক্ষমতাই ছিলোনা, নিঃশব্দে আমার জন্যে কেবল চোখের জল ফেলতেন। ছোটো বৌদির প্ররোচনায় ছোড়দাও একদিন আমাকে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর তিনটে বছর শুকনো ঝরাপাতার মতো শুধু এখানে সেখানে উড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। ওই তিন বছরে আমি বেঁচে থাকার জন্যে রিক্সা চালানো থেকে শুরু করে মুদির দোকান, বিনা বেতনের চাকরী, টিউশানি কত কিছুই না করেছি। চুরি না করেও চোর অপবাদ মাথা পেতে নিতে বাধ্য হয়েছি। কার কোন পূন্য ফলে জানিনা, শেষ মেশ ব্যাঙ্কে চাকরী পেয়েছি। চাকরী পাবার সাথে সাথে মা-র সমস্ত খাওয়া পড়া আর চিকিৎসার ভার নিজে হাতে তুলে নিয়েছিলাম। বছরে দু’বার গিয়ে তার সাথে দেখা করি। তারপর ধীরে ধীরে সতী, বিদিশা আর তোমরা আমার জীবনে এলে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১, এ ক’টা বছর যে কীভাবে কাটিয়েছি সেটা ভাবলে এখন শুধু একটা দুঃস্বপ্নের মতোই লাগে। একটানা পাঁচ দিন পেটে কোনো খাবার জোটেনি আমার। আজ সেইসব আত্মীয় স্বজনদের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কোন পূণ্যের ফলে সতীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি জানিনা। ঠিক তেমনি জানিনা, বিদিশা আমার কে, তুমি আমার কে? বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজন কতো জনকেই তো দেখলাম। সব সম্পর্কগুলোই কেমন যেন ঠুনকো। তোমাদের সাথে আমার কী সম্পর্ক বলো তো? যে ছেলেটা একসময়ে পাঁচ দিনেও নিজের পেটে খাবারের একটা দানা পর্যন্ত দিতে পারেনি আজ তার মেয়ে মায়ের পেট থেকে জন্মেই তোমার কাছ থেকে এতো সব উপহার সামগ্রী পেলো। এ কার পূণ্য ফলে জানিনা”।
একটু থেকে দীপ আবার আমার দিকে চেয়ে বললো, “আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে মণি? আত্মীয়, স্বজন, পরিজন কাকে বলে? ওই যারা আমাকে তাদের নিজেদের কাছ থেকে রাস্তার কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলো, তারা? না কি এই যে এ মুহূর্তে তোমার আমার পাশে বসে আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে, এই বিদিশা চুমকী বৌদিরা”?
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। নিজের পরিবার আত্মীয় স্বজনদের সাথে দীপের যে কোনো সম্পর্ক নেই সে কথা দীপ আমায় বিয়ের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু বিয়ের পর এই তিন চার বছরে বিভিন্ন সময়ে শুধু আমার শাশুড়ি মা ছাড়া দীপের মুখে আর কারো কথা শুনিনি। দু’একবার প্রসঙ্গক্রমে তাদের কথা উঠে এলেও দীপ খুব চালাকী করে সেসব এড়িয়ে যেতো। আমি বুঝতে পারতাম, যে কোনো কারনেই হোক দীপ তাদের কথা আলোচনা করতে চায় না আমার সাথে। আমিও কোনোদিন ওকে জোর করিনি। আমার শাশুড়িকে দেখেছি আমি। খুব ধর্মপ্রাণা মহিলা। নিরামিশভোজী শাশুড়ি মা এখনও নিজের রান্না নিজে করে খান। আর ভাগবদ, গীতা, মহাভারত, রামায়ন পাঠ করেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। সেকালের ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া, কিন্তু তার হাতের লেখা দেখলে বই পুস্তকের ছাপানো অক্ষরগুলোকেও তুচ্ছ বলে মনে হয়। আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমরা গেলে নিজে হাতে রান্না করে আমায় খাওয়ান প্রতিবার।
কিন্তু আজ চুমকী বৌদি ওর মনের ভেতরটাকে এমনভাবে আন্দোলিত করে দিয়েছে যে ওর মনের বদ্ধ আগল খুলে গেছে। তাই এসব কথা বলছে। কিন্তু ওই ‘পাঁচ দিন না খেয়ে থাকা’, ‘রিক্সা চালানো’, ‘চোর অপবাদ পাওয়া’ এ সব কথা শুনে আমি আর আমার চোখের জল আটকাতে পারলাম না। দীপের দুঃখের প্রতিটা কথা যেন আমার বুকের মধ্যে হাতুরীর ঘা হয়ে আঘাত করছিলো, তাই দীপের মুখ চেপে ধরে আমি কেঁদে উঠে চিৎকার করে বলে উঠলাম, “দীপ, তুমি থামবে এবার? আর কিচ্ছুটি বোলো না। আমি আর শুনতে পারছি না। প্লীজ চুপ করো” বলে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
______________________________
ss_sexy