15-09-2020, 12:03 AM
রক্তের খেলা (#১১)
এমন সময়ে কাজের মেয়ে মণি দৌড়ে নিচে এসে খবর দেয় নয়না বমি করছে। দানা আর মহুয়া দৌড়ে ঘরে ঢুকে দেখে, নয়না বমি করে বাথরুমের মেঝেতে অচৈতন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। সমুদ্র আর সুমিতার মৃত্যু ওকে বড় নাড়িয়ে দিয়েছে। কাজের মেয়ে দুটোর সাহায্যে নয়নার চোখে মুখে জল দিয়ে হুঁশ ফিরিয়ে আনে। দানা ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে আবার বিছানায় শুইয়ে দেয়। সেই রাতে দানার আর মহুয়ার আর ঘুম হল না। বসার ঘরে বসে সকালের অপেক্ষায় প্রহর গোনে দুইজনে।
সকালের দিকে টিভি চালায় দানা, এতক্ষণে নিশ্চয় ওই খবর চারদিকে আগুনের মতন ছড়িয়ে গেছে। খবরের চ্যানেল খুলতেই বড় বড় করে ভেসে ওঠে ব্রেকিং নিউজ। রাজনৈতিক দলনেতা বিমান চন্দের বাগান বাড়িতে বিমান চন্দ খুন হয়েছে, সেই সাথে বিধায়ক বাপ্পা নস্কর খুন হয়েছে। অভিনেত্রী নয়নার বোসের সেক্রেটারি সুমিতা আর ম্যানেজার সমুদ্র মারা গেছে। আরো চারজনের মৃত দেহ পাওয়া গেছে। বাগান বাড়ির একাংশ আগুনে পুড়ে গেছে কিন্তু দেহ গুলো ভালো ভাবে জ্বলার আগেই গ্রামের লোকজন আগুন নিভিয়ে দেয়। কেন এতগুলো লোক একসাথে এক জায়গায় মারা গেছে সেই সম্বন্ধে তদন্ত চলছে। তবে পুলিস গোয়েন্দার প্রাথমিক সুত্রের খবর, বাপ্পা নস্কর আর বিমান চন্দের রাজনৈতিক বিরোধিতার ফলে পরস্পরকে খুন করেছে। বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা জ্বলে যাওয়া বন্দুক উদ্ধার করেছে পুলিস। অভিনেত্রী নয়না বোস কি ওই স্থানে উপস্থিত ছিল সেটা সঠিক এখন জানা যায়নি। তবে অভিনেত্রীর ফোন পাওয়া যাচ্ছে না, বাড়িতে ফোন করেও তার খবর পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকের যতদূর ধারনা, ওরা সবাই ওই বাগান বাড়িতে মধু লীলা করতে গিয়েছিল, কারন সুমিতা আর বিমানের দেহে কোন বস্ত্র ছিল না। বাড়ির পেছনে সমুদ্রের মৃত দেহে শুধু মাত্র একটা জাঙ্গিয়া ছিল।
সকাল সকাল দানার ফোন বেজে ওঠে। কে করলো এত সকালে ফোন? ফোন তুলে দেখে, শিল্পপতি মোহন খৈতান ফোন করেছে। মহুয়া আর দানা, চাপা উত্তেজনায় মুখ চাওয়াচায়ি করে। সঙ্গে সঙ্গে টিভি বন্ধ করে দুইজনে শোয়ার ঘরে ঢুকে পরে। পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
ফোন তুলে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে দানা বলে, "হ্যালো, হঠাৎ এত সকালে ফোন করেছেন?"
ওইপাশ থেকে মোহন চাপা গলায় প্রশ্ন করে, "আপনি এখন ঘুমাচ্ছেন? টিভি খুলে দেখুন সর্বনাশ হয়ে গেছে। সারা জগত তোলপাড় হয়ে গেছে।"
দানা না জানার ভান করে প্রশ্ন করে, "কি হয়েছে একটু খুলে বলুন।"
মোহন খৈতান চেঁচিয়ে ওঠে, "অবুঝ হওয়ার ভান করবেন না মিস্টার বিশ্বজিৎ মন্ডল। আপনি ভালো ভাবেই জানেন আমি কিসের কথা বলতে চাইছি। বিমানের বাগান বাড়িতে নয়না ছিল আমি জানি।"
দানার কান গরম হয়ে যায়। ভেবেছিল এই কথা কেউ জানে না এইবারে পুলিসের কাছে যদি মোহন খৈতান মুখ খুলে দেয় তাহলে ওর সর্বনাশ। মোহন চাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে, "নয়না কোথায়, মিস্টার মন্ডল? আমি হলফ করে বলতে পারি আপনি নয়নার খবর জানেন।"
দানা চুপ করে যায়, মহুয়া চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে দানাকে নির্দেশ দেয় সব সত্যি বলতে। দানা অবাক হয়ে যায়, ফোন চেপে চাপা আঁতকে ওঠে, "কি বলতে চাইছো?"
মহুয়া ঠোঁট আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে থাকতে বলে বলে, "ওকে বলো তুমি আর নয়না ওইখানে ছিলে। কিন্তু বাপ্পা নস্কর আসার আগেই তোমরা দুইজনে ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছিলে। বাকি আমি তোমাকে পরে বলছি। তুমি আগে মোহনের সাথে কথাবার্তা সারো।"
মহুয়ার পরিকল্পনা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না দানা, কিন্তু বুদ্ধিমতী প্রেয়সী নিশ্চয় কিছু একটা ভেবেই ওকে এই কথা বলতে বলেছে। মোহনের প্রশ্নের উত্তরে বলে, "হ্যাঁ আমি জানি নয়না কোথায়। নয়না আমার বাড়িতে।"
ওইপাশে গর্জে ওঠে মোহন খৈতান, "আপনি সবার সাথে চাল খেলে বেড়াচ্ছেন। আপনাকে আমি দেখে নেব।"
দানা চোয়াল চেপে ক্রোধ সংবরণ করে বলে, "আমি কারুর সাথে কোন চাল চালিনি মিস্টার খৈতান। আমি জানি না বাপ্পা নস্কর কি ভাবে ওই বাড়ির খবর পেল। আমি এটাও ভালো ভাবে জানি একটু বাদে পুলিস গোয়েন্দা আমার বাড়িতে চলে আসবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। যেটা সত্যি সেটাই আমি ওদের বলবো।"
মোহন মুষড়ে পড়ে দানার কথা শুনে। ভাঙ্গা কণ্ঠে দানাকে বলে, "ওই ছেনালি মাগী নয়নাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না। ওই মাগীর চক্করে পরে আমার বন্ধু প্রান হারিয়েছে। ওকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।"
দানা ওকে শান্ত হতে অনুরোধ করে বলে, "কয়েক সপ্তাহ খুব গরম থাকবে এই মহানগর। একসাথে দুই বড় রাজনৈতিক দলের নেতার খুন সেই সাথে অভিনেত্রী নয়নার সেক্রেটারি আর ম্যানেজারের খুন। এখুনি মাথা গরম করে কিছু করতে যাবেন না, মিস্টার খৈতান। হিতে বিপরিত হয়ে যাবে। কয়েক দিন শান্ত থাকুন।"
কণ্ঠস্বর নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, "আপনি যখন আমাকে বিশ্বাস করে চারশো কোটি টাকার প্রকল্প দিয়েছেন তখন এইটুকু বিশ্বাস রাখুন আমি আপনাকে সাহায্য করবো।"
মোহন ভাঙ্গা কণ্ঠে বলে, "বলছেন?"
দানা উত্তর দেয়, "হ্যাঁ, আরো একটা কথা। পরের সপ্তাহে আপনার ওই বাগান বাড়িতে একবার দেখা করতে চাই। বিস্তারে সব পরিকল্পনা ওই বাড়িতে জানাবো আপনাকে।"
মোহন দাঁত পিষে বলে, "আমার সাথে ছল চাতুরি চলবে না মিস্টার মন্ডল। আপনি জানেন না আমি কি করতে পারি।"
দানা মনে মনে হাসে, জানে টাকার জোরে অনেক কিছু করতে পারে সিমোন আর মোহন খৈতান তবে এতদিন একটা রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়া ওদের মাথার ওপরে ছিল। সেটা সরে যেতেই ওরা দিশা হারা হয়ে পড়েছে। দানা জানিয়ে দেয় ওর সাথে কোন ছল চাতুরি করবে না।
ফোনে কথা শেষ হলে মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে কেন ওকে সত্যি বলতে বলেছে। মহুয়া ফিসফিস করে ওকে বলে, "গোয়েন্দা পুলিস তদন্তে নামবে এইবারে। এটা খুব সংবেদনশীল কেস। এই ঘটনায় রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়ে উঠবে। কেউ কাউকে ছেড়ে দেবে না, জিত। গোয়েন্দা পুলিসকে সব সত্যি বলবে, শুধু মাত্র একটা জায়গায় একটু হেরফের করবে। বলবে তুমি আর নয়না, বাপ্পা নস্কর আসার আগেই ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলে তাই তোমাদের খুঁজে পায়নি ওরা আর মারতে পারেনি। বাকিটা নিজের বুদ্ধি বিবেচনা করে ঠাণ্ডা মাথায় সকল উত্তর দেবে। গোয়েন্দারা জিজ্ঞেস করলে বাপ্পা নস্কর আর নয়নার সম্পর্কের বিষয়ে জানিয়ে দেবে, সেই সাথে বাপ্পা নস্করের দৌরাত্মের সব কিছু খুলে বলে দেবে। দেখবে এক ঢিলে দুই পাখী মরে যাবে। মৈনাকের খুনের তদন্ত যদি একবার খুলে যায় তাহলে সিমোন ধরা পড়বে। আর যদি ধরা না পড়ে তাহলে আমরা নয়নাকে কাজে লাগাবো। বর্তমানে সুমিতা আর সমুদ্রের মৃত্যুর ফলে নয়না খুব ভেঙ্গে পড়েছে। নয়নার যা মনের অবস্থা ওকে সম্পূর্ণ গল্প বানাতে গেলেই গোয়েন্দারা ধরে ফেলবে। আমি নয়নাকে বুঝিয়ে দেব ভালো করে চিন্তা নেই।"
দানা বুঝতে পারে ওর প্রেয়সী সুচতুর এবং বুদ্ধিমতী। নিজেকে বাঁচাতে হলে সত্যির আশ্রয় নেওয়া বিবেচ্য তাতে অনেক সুবিধা। সঙ্গীতার প্রেমিকের খুনিদের ধরা যাবে।
আলোচনা সেরে বাইরে বেড়িয়ে দেখে নয়না ঘুম থেকে উঠে গেছে। চোখ মুখ ভার, চেহারায় ক্লান্তির সাথে সাথে ভীষণ বেদনার ছাপ স্পষ্ট। কাজের মেয়ে চা বানিয়ে আনলে বসার ঘরে ওরা তিনজনে বসে পরবর্তী পদক্ষেপের আলোচনা করে। মহুয়া নয়নাকে পাখী পড়ার মতন জানিয়ে দেয় কি কি বলতে হবে। কখন নয়না ওই বাড়িতে গিয়েছিল কাদের সাথে গিয়েছিল, কে কে এসেছিল। দানাকে ডাকা হয়েছিল সব যেন খুলে বলে পুলিসকে। শুধু মাত্র একটা ছোট ফের বদল করতে হবে এই গল্পে, নয়নাকে জিজ্ঞেস করলে যেন বলে যে দানা আসার কিছু পরেই ওরা ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। গাড়ি নিয়ে অন্য কোথাও একটু খোলা আকাশের নীচে নিজদের সান্নিধ্য উপভোগ করছিল। শেষের কথা শুনে নয়না চমকে ওঠে। দানার স্ত্রী সত্যি জানে যে ওদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে? তাও এত মাথা ঠাণ্ডা রেখে কি করে মহুয়া ওকে এই সব কথা বলছে? কে এরা, এদের মনে কি কিছু ভিন্ন চক্রান্ত চলছে? মহুয়া আর দানার ঠাণ্ডা হিমশীতল চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই ওদের মনের ভেতরে কি চলেছে।
ঠিক সেই সময়ে রমলার ফোন আসে দানার কাছে। এতদিন পরে রমলার ফোন পেয়ে দানা অবাক হয়ে যায়। ফোন নিয়ে স্টাডিতে চলে যায়। রুহি ততক্ষণে জেগে গেছে। মহুয়া রুহিকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। নয়না চুপচাপ বসার ঘর মাথা ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। ওর চোখের জল আর থামতেই চায় না। সব থেকে প্রিয় বান্ধবী আর বুকের ভালোবাসার মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে।
রমলা ফোন তুলেই দানাকে বলে, "কি করে এই সব হলো?"
দানা অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করে, "কি হলো?"
রমলা চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "না জানার ভান করবে না দানা। আমি জানি তুমি বাপ্পা নস্করের খুব কাছের লোক সেই সাথে আবার মোহনের বিশাল প্রকল্প গুলো হাতে পেয়ে গেছ সুতরাং তুমি বিমানের কাছের লোক। এত কিছু হয়ে গেল আর তুমি না জানার ভান করছো?"
চোয়াল চেপে হেসে দানা উত্তর দেয়, "কি চাও তুমি?"
রমলা ফিসফিস করে বলে, "এইবারে ময়দান একদম খালি হয়ে গেছে। দুলাল একবার তোমার সাথে দেখা করতে চায়।"
এতদিনে দুলাল মিত্রের খেয়াল পড়লো? দানা চোয়াল চেপে উত্তর দেয়, "এখন আমার কাছে সময় নেই রমলা। পরে দুলালের সাথে আলোচনা করব এই বিষয়ে। একটু পরেই হয়তো পুলিস গোয়েন্দা সাংবাদিকের ভিড় লেগে যাবে আমার বাড়িতে। ওদের সামনে আমি সব সত্যি কথা বলবো।"
রমলা আঁতকে ওঠে, "কি বলছ তুমি? না না, নয়না ফেঁসে গেলে আমিও ফেঁসে যাবো। গোয়েন্দারা খুঁজে খুঁজে নয়নার সাথে আমার সম্পর্ক বের করে ফেলবে আর....."
দানা চোরা হেসে বলে, "তুমি চুপ থাকো আমিও চুপ থাকবো। শুধু একটা কথা মনে রেখো, কঙ্কনা আর নাসরিন যেদিন এই শহরে পা রাখবে সেইদিন আমি যেন খবর পাই।"
রমলা ওকে বলে, "হ্যাঁ হ্যাঁ তাই হবে।"
এমন সময়ে রুহি এসে ওকে বকাঝকা শুরু করে দেয়, "ডিনার করতে আতনি কেন?"
রুহিকে কোলে নিয়ে ওর নরম টোপা গাল চুম্বন করে বলে, "কাল রাতে একটু কাজ ছিল, মা। আজকে আমরা সবাই মিলে ডিনার করবো।"
রুহি মাথা নাড়িয়ে বলে, "আন্তি কাঁদছে কেন?"