14-09-2020, 06:14 PM
(২৬ পর্ব)
অঞ্জলী আসলেই অলরাউন্ডার। ঠাকুরমার চিঠিটার মর্ম প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছে। কিছু কিছু সংশয় এখনও আছে। তবে সেটা কিছু দিনের মধ্যেই নিরসন হবে বলে তার বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা ঝুকিঁ নিতে হবে। আর অমিত ঝুকিঁটা নেবে বলেই সিদ্ধান্ত নিল। অঞ্জলীর উপর আস্থা রেখে আজ পর্যন্ত ঠকেনি। তার আগে পুরো বিষয়টা আরও ভালভাবে বুঝার জন্য একটা ট্রায়াল দেবার সিদ্ধান্ত নিল।
বার বার তর্ক করলো ওরা দুজন। বার বার প্রথম থেকে শুরু করলো। অঞ্জলী ব্যাখ্যা করতে লাগলো, ” Asseet শব্দটির ভ্যালু ৬৯। তুমি জান এটা অনেক অর্থ বহন করে।”
“আমি কেমন করে জানবো, আমি কি তোমার সাথে ৬৯ করেছি?” অমিত ঠাট্টা করে।
“একদম ফাজলামো করো না। খুব সিরিয়াস। আমার ধারণা ঠাকুরমা বুঝাতে চাইছেন তিনি যা লিখেছেন কখনও কখনো তার উল্টো অর্থ করতে হবে। যেমন তিনি বলেছেন আমি আমার সকল Asseet তোমাদের মাঝে ভাগ করে দিয়েছি। আমার কাছে এর অর্থ হলো তিনি তার সকর সম্পদ তোমাদের মাঝে ভাগ করে দেননি। কিছু সম্পদ গোপন রয়ে গেছে। এজন্যই তিনি ইচ্ছা করে বানানটি ভুল লিখেছেন।”
“তার মানে তিনি মাটি খুড়ে কিছু সোনাদানা হীরে জহরত তার ঘরের মেঝেতে লুকিয়ে রেখেছেন? কোদাল শাবল নিয়ে তাহলে আজই পুরনো বাড়ির মেঝে খুড়তে শুরু করে দিই?”
অমিতের রসিকতা অঞ্জলী গায়ে মাখে না। ” তিনি বলেছেন, কোম্পানী চালাতে হলে Bank আর Union এই দুটোর উপরই তোমাকে নির্ভর করতে হবে। সাধারণ ভাবে ব্যাবসার জন্য ব্যাংকের সাথে লেনদেন আর ফ্যাক্টরীতে ইউনিয়নের সাথে দেনদরবার তোমাকে করতেই হবে। তুমি শব্দ দুটিকে একত্র করে উল্টে দাও। দাঁড়াচ্ছে ইউনিয়ন ব্যাংক। রায় গ্রুপের মেজর লেনদেন এই ব্যাংকের সাথে। ঠাকুরমার পিএস হিসাবে আমি বিষয়টা ভাল করেই জানি। Bank এর ভ্যালু ২৮ আর Unionএর ভ্যালু ৭৩। আবার দুটো সংখ্যারই অংক গুলির যোগফল ১০। আমার যুক্তি বলছে এটা ইউনিয়ন ব্যাংকের লকার সার্ভিসের সাথে সম্পৃক্ত।”
“ওরে বাপস্*! তার মানে মাটির নীচে নয়। বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে বলতে হবে ঠাকুরমা আমার জন্য আপনাদের লকারে কিছু টাকা রেখে গেছেন। টাকা গুলি দিয়ে দিন। ব্যাগ ভরে নিয়ে যাই।”
“যতই রসিকতা কর আমি এখানে বেশ একটা ক্লু দেখতে পাচ্ছি।খেয়াল কর তার পরের কথা, তোমার Knowledge-Attitude-Endevour তোমাকে পথ দেখাবে। এখানে পথ হলো পাসওয়ার্ড। আর শব্দ গুলির নিউমেরিক ভ্যালু ৯৩-১০০-১০৪ হলো সেই পাসওয়ার্ড যা দিয়ে তুমি ডিজিটাল লকার খুলতে পারবে।”
“মানলাম কাল সকালে ব্যাংকে গিয়ে ডিজিটাল লকার খুলে ধন-সম্পদ সব বের করে নিয়ে আসবো। কিন্তু শুধু A নয় আমি তোমাকে A টু Z ভালবাসি এই শেষ লাইনটার কি মানে দাড়ঁ করাবে তুমি। আমি তোমাকে এক থেকে ছাব্বিশ পর্যন্ত ভালবাসি?”
“এ কথার অর্থও আমি বের করেছি। তবে বলার আগে আমায় একটু আদর করে দাও রাজ কুমার।”
প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী অঞ্জলীর মূখ থেকে এমন কথা শুনে ভিতরটা তরল হয়ে গেল অমিতের। এক পাগল করা আকর্ষণ আছে অঞ্জলীর। কামনা নয় মুগ্ধতার দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে অমিত। তার পর টেনে নেয় বুকের মাঝে। অনেক অনেকক্ষণ চেপে ধরে রাখে বুকের মাঝে। চওড়া বুকে মূখ গুজে পেলব বাহুতে অঞ্জলী জড়িয়ে রাখে অমিতের গলা। প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য উপভোগ করে। দীর্ঘ সময় পর অমিত হাতের বাধন ঢিলে করে। তাকায় চোখ তুলে দুজন দুজনের দিকে। তার পর পাগলের মত চুমু খায় অমিত অঞ্জলীর ঠোটে। জীবনে এই প্রথম। প্রথম কোন পুরুষ ভালবেসে অঞ্জলীকে চুমু খেল। এর আগে বার দুই অঞ্জলী অমিতকে চুমু খেয়েছে। কিন্তু অমিত রিটার্ন করেনি। আজ তার আগ্রাসী চুম্বনে অস্থির হয়ে উঠে অঞ্জলী। তার নাকের ফুটো বড় হয়ে যায়। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়। রক্তে এড্রিনালিন দাপাদাপি করে। নিজেও গাঢ় চুম্বনে সিক্ত করে অমিতকে। অমিত আস্তে করে ব্লাউজের উপর দিয়ে হাত ছোয়ায় অঞ্জলীর শক্ত খাড়া স্তনাগ্রের উপর। কিন্তু নিজেকে সামলায় অঞ্জলী। “না রাজকুমার, আর না, এবার ছাড়।”
অঞ্জলীর সামনে অমিত বরাবরই সুবোধ বালক। সে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও অঞ্জলীকে ছেড়ে দেয়। তারা ভদ্রস্থ হতে না হতেই দরজার বাইরে একাধিক কন্ঠে খিলখিল হাসির শব্দ শুনা যায়। লজ্জায় অধোবদন অঞ্জলী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। নিশ্চই বিন্দু বৌদি আর বন্যা। দরজার আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য করছিল। অঞ্জলীকে আসতে দেখে সটকে পড়েছে।
“তুমি কিন্তু শেষ লাইনটার ব্যাখ্যা এখনও দাওনি।” অমিত ঠাকুরমার চিঠি প্রসংগে ফিরে যায়।
“লজ্জা লাগছে যে, কেমন করে বলি?”
“চোখ বন্ধ করে বলো, মেয়েদের লজ্জা সব চোখে।”
“ঠাকুর মা বলতে চেয়েছেন শুধু অঞ্জলী নয়, আমিও তোমাকে আর অঞ্জলীকে ভালবাসি। আরও পরিষ্কার করলে হয়, তিনি আমাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।”
অমিতের মূখটা খুবই উজ্জল হয়ে উঠলো। এই একটা বিষয়ে তার মনে একটু খুত ছিল। ঠাকুরমার অনুমোদনবিহীন একটা কাজে তার মনে সংশয় ছিল। আজ সেটুকুও দূর হয়ে যাওয়ায় সত্যি সত্যি তার মনটা ভাল হয়ে গেল। “আমি তোমাকে আর একটা চুমু দেব।”
“না বাইরে বিন্দু বৌদি আর বন্যা রয়েছে। তারা আমাদের দেখছে।”
বিন্দু অঞ্জলীকে ছাড়লো রাতের ডিনারের পর।
ঠাকুরমার মৃত্যুর পর অঞ্জলী ইউনিয়ন ব্যাংকে তেমন একটা আসেনি আর। অনেকদিন পর বলে ম্যানেজার ছাড়া নতুন স্টাফরা কেউ চিনতে পারলো না। বর্তমান ম্যানেজার তখন ছিল সদ্য জয়েন করা এক তরুণ অফিসার। সে খুব খাতির যত্ন করলো তাকে। বিগ ক্লায়েন্টের বিগ এন্টারটেইনমেন্ট। কর্পোরেট কালচারে অঞ্জলী অভ্যস্ত। ভাব ধরে রেখেই সে তাদের লকার সার্ভিস সম্পর্কে জানতে চাইল। জানতে চাইল কতটা নিরাপদ আর কতটা গোপনীয়।
তোতা পাখীর মত বুলি ফুটলো ম্যানেজারের মূখে। “আমরা সুইস ব্যাংক নই। তবে এ কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমাদের সার্ভিস তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সবচে বড় কথা কোন পরিস্থিতিতেই আমরা আমাদের ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা ডিসক্লোজ করি না। এ লকার ভাংগা সম্ভব নয়। এটার পাসওয়ার্ড হ্যাক করা যায় না। এমনকি শত বছর আনক্লেইমড থাকলেও আমরা কাস্টমারের খোঁজ করি না। কারণ আমাদের কাছে কোন রেকর্ডই থাকে না কোন লকারটা কাকে দেয়া হয়েছে। আমরা শুধু আমাদের এম্পটি লকারগুলির খবর বলতে পারি।”
“হুম।” বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো অঞ্জলী। “আমি কি একবার এরিয়াটা ঘুরে দেখতে পারি?”
“অবশ্যই ম্যাডাম, আসুন।”
ম্যানেজারের পিছন পিছন অঞ্জলী লকার রুমের দিকে গেল। নানান রকমের ফরমালিটিজ মেইনটেইন করার পর তারা সেখানে ঢুকতে পারল। বিরাট এলাকা। দশটা বড় আকারের রুম। প্রতিটা রুমে দশটা করে বুথ আর প্রতিটা বুথে একটা করে লকার। তেমন খালি নেই। অঞ্জলীর টার্গেট হলো দশ নম্বর রুমের দশ নম্বর বুথ।
“আচ্ছা ধরুন আমি যদি এক নম্বর রুমের এক নম্বর বুথের লকারে কিছু রাখতে চাই পারবো?”
“না খালি নেই।”
“পাঁচ নাম্বার রুমের পাঁচ নাম্বার বুথের লকারে?”
“সেটাও খালি নেই।”
“দশ নাম্বার রুমের দশ নাম্বার বুথের লকারে?
“তাও খালি নেই।”
“ব্যাটার আপনি আমাকে বলুন কোনটা কোনটা খালি আছে।”
ম্যানেজার বেশ কটা খালি লকারের নম্বর বললো যার মধ্যে দশ নম্বর রুমের নয় নম্বর বুথের লকারটা রয়েছে। তার এটাই পছন্দ হলো।
তারা ফিরে এল ম্যানেজারের রুমে। ম্যানেজার তাকে বার বার করে বলে দিল “লকারগুলি সম্পূর্ণ ডিজিটাল লক। আপনি আপনার নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে একবার বন্ধ করে দিলে এটা আর কেউ খুলতে পারবে না। এমন কি আপনার নামধাম এবং কোন লকারটি আপনি ভাড়া নিয়েছেন তারও কোন রেকর্ড আমাদের কাছে থাকবে না। শুধু আপনাকে আমরা একটা কোড নাম্বার দেব। যেটা দিয়ে আপনি আমাদের সিস্টেমে ঢুকতে পারবেন। তারপর আপনার নিজস্ব একটা পিন নম্বর সেট করে সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসবেন। এই পিন যার কাছে থকাবে সেই আমাদের সিস্টেমে ঢুকতে পারবে। সিস্টেমে ঢুকে পিন নম্বর সেট করে এন্টার করলে যদি ম্যাচ করে তাহলে গ্রীন লাইট জ্বলবে এবং আপনি লকার রুমে ঢুকবার সুযোগ পাবেন। তারপর আবার নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে বুথ খুলতে হবে এবং আর একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে লকার খুলতে হবে।”
“এ তো মহা জটিলতা। এত সব মনে রাখবো কি ভাবে?”
“সরি ম্যাডাম, ক্লাইয়েন্টের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমাদের এটা করতে হয়েছে। আপনাকে দেখানোর জন্য আমি যখন প্রবেশ করি তখন আমাকেও একই ভাবে লকার রুমে ঢুকতে হয়েছে। আমার নামে এখানে একটা লকার রয়েছে। আর আমরা কখনও এক সাথে দুজন ক্লায়েন্টকে লকার এরিয়ায় ঢুকতে দেই না। একবারে একজন। এবং সম্পূর্ণ খালি হাতে। ঢুকতে হবে।”
“উফফফ। একদম হাপ ধরে গেছে অফিসার। কাল পরশু আবার আসবো। কিছু অর্নামেন্ট রাখবো আমি।”
“আমিও তাই ধারণা করেছি। অর্নামেন্ট আর ডকুমেন্টস এ দুটোই মানুষ বেশী রাখে। ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনার যদি এসকর্ট লাগে বলবেন। আমরা এসকর্ট দিয়ে ভ্যালুড ক্লাইয়েন্টকে সহায়তা করে থাকি। এর জন্য এক্সট্রা কোন ফি নেই।”
“থ্যাংক্যু অফিসার। আই এম রিয়েলি কনভিনসড।”
“আমরা রায় গ্রুপের অনেক পুরনো আর বিশ্বস্ত ব্যাংকার ম্যাডাম। আপনি জানেন গ্রান্ড ম্যাম আমাদের খুব পছন্দ করতেন।”
ম্যানেজার অঞ্জলীকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। অঞ্জলীর বার বার মনে হতে লাগলো কাজটা সে শেষ পর্যন্ত করতে পারবে। সে ভীষণ উত্তেজিত বোধ করলো।
ব্যাংকের লকার সিস্টেমের সব কথা শুনে অমিত বললো, “বাদ দাও। ঠাকুরমা আদৌ কোন লকার ভাড়া করেছিলেন কিনা সেটারই যখন কোন রেকর্ড নেই তুমি কেমন করে তা খুজেঁ বের করবে! তার পর সেটা খুলে তোমার ধন রত্ন হাতাবে!”
“ধন রত্ন আদৌ যদি কিছু থাকে তবে সেটা আমার নয় তোমার।”
“যার ই হোক এ সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে আমার ইচ্ছা করছে না।”
“তো কি ইচ্ছা করছে মাই লাভ!”
“আমি কাশী যাব। পিসিমাকে নিয়ে আসবো। তিনি তোমার অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন।”
“আমার অভিভাবক কে হবে? জামাই বাবু না দিদি?”
“একজন হলেই হলো।”
“খুব রোমান্টিক তাই না?”
“আচ্ছা কনে দেখার সময় তুমিও কি সাথে আসবে না তোমার গুরুজনেরাই কেবল দেখে যাবে? বর পণ কিছু দিতে হবে জানি। কি চাই গো তোমার?”
“অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা।”
“রাজ্যটা ছোট। তবে তার পুরোটাই তোমাকে দেয়া হবে। আর তোমার মনোরঞ্জনের জন্য এই সেবাদাসী সারাক্ষণ হাজির থাকবে।”
মূল বাড়ির সবুজ লনে দুজন হাটছিল আর কথা বলছিল। এ দিকটায় অঞ্জলী ছাড়া আর কেউ আসে না। তারা হাটছিল পাশাপাশি। অঞ্জলীর একটা হাত অমিতের মুঠিতে ধরা। তার আংগুল গুলি একটু একটু কাঁপছে। প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরীর মত লাগছে ওকে।
ব্যাংক থেকে ফেরার পথে অমিতকে মনি শংকরের বাসা থেকে তুলে এনেছে অঞ্জলী। বন্যা সাথে আসতে চেয়েছিল। বিন্দু কষে একটা ধমক দিয়েছে। “মাসিমনি আর ছোট কাকু প্রেম করবে, সেখানে তুমি কেন কাবাব মে হাড্ডি হতে যাবে শুনি?”
ঝিলিক দিয়ে উঠে বন্যার চোখ, “ছোট মা, তুমি ভাল কথা মনে করেছ। মাকে তো এখনো বলাই হয়নি তার আই বুড়ো বোনটা আমার কাকুর ঘাড়ে চেপেছে।”
খপ করে বন্যার চুলের মুঠি ধরলো বিন্দু। এটা তার সবচে প্রিয় একটা কাজ। বন্যার মাথার পিছনের ঝুটিটা চেপে ধরা। “এই বাঁদর মেয়ে সব কথা মাকে বলতে হবে কেন? ছোট মা জেনেছে তাতে হবে না? আর মাসিমনির নিন্দে করছিস বলে দেব ওকে?”
“উফ্*! না! ছাড়ো তো ছোট মা! লাগছে আমার। মাসিমনিকে তুমি কিছু বলতে যেওনা কিন্তু!”
“ঠিক আছে ছাড়লাম। তবে আশ্রমে যাওয়া হবে না তোমার। তুমি আমার কাছে থাকবে।”
দুই প্রজন্মের দুই নারী। কি যে গভীর বন্ধুত্ব!
ঠিক হল পরদিন সকালে অঞ্জলী আর অমিত যাবে ইউনিয়ন ব্যাংকে। রাতে অমিত অঞ্জলীর এখানেই খাবে। ম্যাগীকে আসতে বলেছে। সুব্রতও আসবে। ওরা যথা সময়েই এল। সুব্রতই ম্যাগীকে পিক করেছে।
ইদানীং সুব্রত আর ম্যাগীর মাঝে বেশ সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। অমিতকে কেন্দ্র করেই তাদের মাঝে আলাপ এবং সে সূত্রে ফ্রেন্ডশীপ। এটা আরও গভীরতা পেয়েছে ম্যাগীর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণে। হায়ার স্টাডিজের জন্য সুব্রত অনেকদিন থেকে একটা স্কলারশীপের চেষ্টা করে আসছিল। ডিপার্টমেন্ট অনুমতিও দিয়েছে। কিন্তু সুব্রত স্কলারশীপ যোগাড় করে উঠতে পারছিল না। ম্যাগীর কানে সেটা যেতেই সে তার সাংবাদিক কানেকশান কাজে লাগিয়ে খুব অল্প দিনের মাঝেই দুটো অফার ম্যানেজ করে দিয়েছে। আগামী বছরের কোন এক সময় হায়ার স্টাডিজের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবে সুব্রত।
সুব্রত বা ম্যাগী কারো ঘর সংসার নেই। অফিসের পরে অফুরন্ত সময়। সময়টা তারা ইদানীং বেশ উপভোগ করছে। আজ যেমন দুপুর থেকেই দুজন শপিং এ বেরিয়ে ছিল। ম্যাগী জেনেছে শারদীয় দুর্গা পুজা বাংগালী * সমাজের প্রধানতম উতসব। এক্সমাসের মত এদিনে সবাই সবাইকে গিফট করে। সুব্রত ম্যাগী আর অঞ্জলীর জন্য গিফট কিনলো। ম্যাগীও সুব্রত, অঞ্জলী এবং রায় পরিবারের প্রায় সবার জন্য গিফট কিনলো। সুব্রত স্রেফ দুটি শাড়ি কিনলো। একটা অঞ্জলী আর একটা ম্যাগীর জন্য। কিন্তু ম্যাগী একেক জনের জন্য একেক রকমের গিফট কিনলো। এ ক্ষেত্রে সুব্রত ছিল তার কনসালটেন্ট। কাপড়-চোপড়ের বাইরে ম্যাগী অঞ্জলী আর বন্যার জন্য কানের দুল এবং অমিতের জন্য রিং কিনলো। অলংকার গুলিতে ডায়মন্ড বসানো। এ পছন্দের পিছনে কি কারণ ম্যাগী ঠিক জানে না। সুব্রত বলেছে সে কিনেছে। কেনার পর গিফট প্যাকেটগুলি সুব্রত তার কাছে রেখে ম্যাগীকে হোটেলে গিয়ে রেডী হতে বলেছে। সন্ধ্যের পর নিজে ড্রাইভ করে ম্যাগীকে নিয়ে এসেছে আশ্রমে।
গিফট পেয়ে অঞ্জলী অমিত দুজনেই খুশী হলো। অঞ্জলী শাড়িটা রেখে দিল দশমীর দিন পড়বে বলে। কিন্তু দুল জোড়া তখুনি পড়ে ফেললো। খুব মানিয়েছে ওকে। অমিতও রিংটা সাথে সাথে পড়লো। রিংটা পড়লো সে মধ্যমায়। ওয়েডিং রিং পড়ার জন্য অনামিকা খালি রেখেছে। এটা নিয়ে ম্যাগী একটু ঠাট্টা মশকারাও করেছে। তাদের ডিনার হয়েছে প্রাণবন্ত। ডিনার টেবিলে অমিত-অঞ্জলী আর সুব্রত-ম্যাগী দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। পরস্পরের কাছে ধরাও পড়েছে। আবার ভান করেছে কিছুই হয়নি।
ডিনার শেষে অমিতকে মনি শংকরের বাসায় আর ম্যাগীকে হোটেলে পৌছে দিল সুব্রত। অঞ্জলী সাথে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু অমিত বারণ করেছে। সারাক্ষণ হয় পুলিশ না হয় অন্য গার্ড নিয়ে চলতে তার ভাল লাগে না। বাসায় পৌছে অঞ্জলীকে ফোন দিয়ে কনফার্ম করেছে। সুব্রত নামতে চায়নি। কিন্তু বিন্দু তাকে কফি না খাইয়ে কোন ভাবেই ছাড়লো না। ম্যাগীও সুযোগ পেয়ে গিফট গুলিকে সবাইকে পৌছে দিল। বন্যা কানের দুল পেয়ে খুব খুশী হলো। যখন জানলো মাসিমনি সাথে সাথে দুল জোড়া পড়েছে সেও সাথে সাথে পড়ে নিল।
সুব্রত যখন ম্যাগীকে হোটেলের সামনে ছাড়লো তখন রাত প্রায় দশটা। নামার আগে ম্যাগী সুব্রতকে বললো, “অভ্যেস থাকলে এসো, এক বোতল শ্যাম্পেইন আছে আমার কাছে।”
“নো থ্যাংকস” স্মিত হেসে মানা করলো সুব্রত।
বিদায়ী হ্যান্ডশেকটা একটু বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো। হাতটা যতক্ষণ ধরে রাখলে আলাদা কোন অর্থ হয় না তার চে বেশী সময় ধরে রাখলো দুজনেই।
ম্যানেজারকে আগে থেকে কিছুই ইনফরম করেনি অঞ্জলী। সরাসরি এসে হাজির হয়েছে। অমিত রয়েছে সাথে। বিজনেস স্যুটে দারুণ মানিয়েছে তাকে। লবীতে ঢুকতেই ম্যানেজার তাদের সিসিটিভিতে দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। অঞ্জলী পরিচয় করিয়ে দিল, “ড. অমিতাভ রায় চেৌধুরী, ডিরেক্টর রায় গ্রুপ।”
“আই নো হিম ভেরী ওয়েল ম্যাডাম। হি ইজ নাও অ্যা সেলিব্রেটি।”
সকল ফরমালিটিজ ম্যাইনটেইন করে অঞ্জলী তার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে লকার রুমের উদ্দেশ্যে গেল। সেখানে তাকে আবার অনেক ফরমালিটিজ মেইনটেইন করতে হলো। কোন বিস্ফোরক দ্রব্য, বেআইনী দ্রব্য নেই সে মর্মে ডিক্লারেশন দিতে হলো। সেখানে তাকে একটা পিন নম্বর দেয়া হলো। অঞ্জলী সিস্টেমে ঢুকে ব্যাংকে পিন নম্বর চেইঞ্জ করে নিজস্ব পিন নম্বর সেট করলো। সে নাম্বার দরজায় সেট করে দশ নম্বর রুমে ঢুকলো। তার পর নয় নম্বর বুথে একটা পাসওয়ার্ড সেট করলো। তারপর লকারে আবার পাসওয়ার্ড সেট করে লক করলো।
এবার শুরু হলো তার আসল উত্তেজনা। কারন দশ নম্বর রুমে ঢুকার জন্য যে যে পাসওয়ার্ড সেট করেছে সেটা দিয়েই ঢুকতে পারবে। কিন্তু দশ নম্বর বুথে শুধু ওনারের পাসওয়ার্ড লাগবে। দুর্গা দুর্গা বলে সে পুশ করলো ১০০। সাথে সাথে ক্লিক শব্দে বুথের দরজা খুলে গেল। দেরী না করে আবার পুশ করলো ১০৪। এন্টার দিয়ে দম বন্ধ করে দাড়িয়ে রইল। এক সেকেন্ড পর লকারের দরজায় গ্রীন লাইট জ্বললো। তবুও অঞ্জলীর মনে হলো অনন্তকাল। লকার রুমে ঢুকার আগেই তার হাতে গ্লাভস পরা ছিল। মেটালিক নবটা ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল।
ভিতরে একটা ছোট প্যাকেট। ওয়াটার প্রুফ, ফায়ার প্রুফ কাগজে মোড়া। প্যাকেটটা হ্যান্ড ব্যাগে ভরে আবার লক করলো যথা নিয়মে। দ্রুত কাজ করছে। কিন্তু সতর্ক রইল যাতে ভুল না হয়। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে। ম্যানেজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অমিতকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।
অঞ্জলী আসলেই অলরাউন্ডার। ঠাকুরমার চিঠিটার মর্ম প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছে। কিছু কিছু সংশয় এখনও আছে। তবে সেটা কিছু দিনের মধ্যেই নিরসন হবে বলে তার বিশ্বাস। এ ক্ষেত্রে মোটামুটি একটা ঝুকিঁ নিতে হবে। আর অমিত ঝুকিঁটা নেবে বলেই সিদ্ধান্ত নিল। অঞ্জলীর উপর আস্থা রেখে আজ পর্যন্ত ঠকেনি। তার আগে পুরো বিষয়টা আরও ভালভাবে বুঝার জন্য একটা ট্রায়াল দেবার সিদ্ধান্ত নিল।
বার বার তর্ক করলো ওরা দুজন। বার বার প্রথম থেকে শুরু করলো। অঞ্জলী ব্যাখ্যা করতে লাগলো, ” Asseet শব্দটির ভ্যালু ৬৯। তুমি জান এটা অনেক অর্থ বহন করে।”
“আমি কেমন করে জানবো, আমি কি তোমার সাথে ৬৯ করেছি?” অমিত ঠাট্টা করে।
“একদম ফাজলামো করো না। খুব সিরিয়াস। আমার ধারণা ঠাকুরমা বুঝাতে চাইছেন তিনি যা লিখেছেন কখনও কখনো তার উল্টো অর্থ করতে হবে। যেমন তিনি বলেছেন আমি আমার সকল Asseet তোমাদের মাঝে ভাগ করে দিয়েছি। আমার কাছে এর অর্থ হলো তিনি তার সকর সম্পদ তোমাদের মাঝে ভাগ করে দেননি। কিছু সম্পদ গোপন রয়ে গেছে। এজন্যই তিনি ইচ্ছা করে বানানটি ভুল লিখেছেন।”
“তার মানে তিনি মাটি খুড়ে কিছু সোনাদানা হীরে জহরত তার ঘরের মেঝেতে লুকিয়ে রেখেছেন? কোদাল শাবল নিয়ে তাহলে আজই পুরনো বাড়ির মেঝে খুড়তে শুরু করে দিই?”
অমিতের রসিকতা অঞ্জলী গায়ে মাখে না। ” তিনি বলেছেন, কোম্পানী চালাতে হলে Bank আর Union এই দুটোর উপরই তোমাকে নির্ভর করতে হবে। সাধারণ ভাবে ব্যাবসার জন্য ব্যাংকের সাথে লেনদেন আর ফ্যাক্টরীতে ইউনিয়নের সাথে দেনদরবার তোমাকে করতেই হবে। তুমি শব্দ দুটিকে একত্র করে উল্টে দাও। দাঁড়াচ্ছে ইউনিয়ন ব্যাংক। রায় গ্রুপের মেজর লেনদেন এই ব্যাংকের সাথে। ঠাকুরমার পিএস হিসাবে আমি বিষয়টা ভাল করেই জানি। Bank এর ভ্যালু ২৮ আর Unionএর ভ্যালু ৭৩। আবার দুটো সংখ্যারই অংক গুলির যোগফল ১০। আমার যুক্তি বলছে এটা ইউনিয়ন ব্যাংকের লকার সার্ভিসের সাথে সম্পৃক্ত।”
“ওরে বাপস্*! তার মানে মাটির নীচে নয়। বড় বড় ব্যাগ নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে বলতে হবে ঠাকুরমা আমার জন্য আপনাদের লকারে কিছু টাকা রেখে গেছেন। টাকা গুলি দিয়ে দিন। ব্যাগ ভরে নিয়ে যাই।”
“যতই রসিকতা কর আমি এখানে বেশ একটা ক্লু দেখতে পাচ্ছি।খেয়াল কর তার পরের কথা, তোমার Knowledge-Attitude-Endevour তোমাকে পথ দেখাবে। এখানে পথ হলো পাসওয়ার্ড। আর শব্দ গুলির নিউমেরিক ভ্যালু ৯৩-১০০-১০৪ হলো সেই পাসওয়ার্ড যা দিয়ে তুমি ডিজিটাল লকার খুলতে পারবে।”
“মানলাম কাল সকালে ব্যাংকে গিয়ে ডিজিটাল লকার খুলে ধন-সম্পদ সব বের করে নিয়ে আসবো। কিন্তু শুধু A নয় আমি তোমাকে A টু Z ভালবাসি এই শেষ লাইনটার কি মানে দাড়ঁ করাবে তুমি। আমি তোমাকে এক থেকে ছাব্বিশ পর্যন্ত ভালবাসি?”
“এ কথার অর্থও আমি বের করেছি। তবে বলার আগে আমায় একটু আদর করে দাও রাজ কুমার।”
প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী অঞ্জলীর মূখ থেকে এমন কথা শুনে ভিতরটা তরল হয়ে গেল অমিতের। এক পাগল করা আকর্ষণ আছে অঞ্জলীর। কামনা নয় মুগ্ধতার দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে অমিত। তার পর টেনে নেয় বুকের মাঝে। অনেক অনেকক্ষণ চেপে ধরে রাখে বুকের মাঝে। চওড়া বুকে মূখ গুজে পেলব বাহুতে অঞ্জলী জড়িয়ে রাখে অমিতের গলা। প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য উপভোগ করে। দীর্ঘ সময় পর অমিত হাতের বাধন ঢিলে করে। তাকায় চোখ তুলে দুজন দুজনের দিকে। তার পর পাগলের মত চুমু খায় অমিত অঞ্জলীর ঠোটে। জীবনে এই প্রথম। প্রথম কোন পুরুষ ভালবেসে অঞ্জলীকে চুমু খেল। এর আগে বার দুই অঞ্জলী অমিতকে চুমু খেয়েছে। কিন্তু অমিত রিটার্ন করেনি। আজ তার আগ্রাসী চুম্বনে অস্থির হয়ে উঠে অঞ্জলী। তার নাকের ফুটো বড় হয়ে যায়। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়। রক্তে এড্রিনালিন দাপাদাপি করে। নিজেও গাঢ় চুম্বনে সিক্ত করে অমিতকে। অমিত আস্তে করে ব্লাউজের উপর দিয়ে হাত ছোয়ায় অঞ্জলীর শক্ত খাড়া স্তনাগ্রের উপর। কিন্তু নিজেকে সামলায় অঞ্জলী। “না রাজকুমার, আর না, এবার ছাড়।”
অঞ্জলীর সামনে অমিত বরাবরই সুবোধ বালক। সে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও অঞ্জলীকে ছেড়ে দেয়। তারা ভদ্রস্থ হতে না হতেই দরজার বাইরে একাধিক কন্ঠে খিলখিল হাসির শব্দ শুনা যায়। লজ্জায় অধোবদন অঞ্জলী দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। নিশ্চই বিন্দু বৌদি আর বন্যা। দরজার আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য করছিল। অঞ্জলীকে আসতে দেখে সটকে পড়েছে।
“তুমি কিন্তু শেষ লাইনটার ব্যাখ্যা এখনও দাওনি।” অমিত ঠাকুরমার চিঠি প্রসংগে ফিরে যায়।
“লজ্জা লাগছে যে, কেমন করে বলি?”
“চোখ বন্ধ করে বলো, মেয়েদের লজ্জা সব চোখে।”
“ঠাকুর মা বলতে চেয়েছেন শুধু অঞ্জলী নয়, আমিও তোমাকে আর অঞ্জলীকে ভালবাসি। আরও পরিষ্কার করলে হয়, তিনি আমাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।”
অমিতের মূখটা খুবই উজ্জল হয়ে উঠলো। এই একটা বিষয়ে তার মনে একটু খুত ছিল। ঠাকুরমার অনুমোদনবিহীন একটা কাজে তার মনে সংশয় ছিল। আজ সেটুকুও দূর হয়ে যাওয়ায় সত্যি সত্যি তার মনটা ভাল হয়ে গেল। “আমি তোমাকে আর একটা চুমু দেব।”
“না বাইরে বিন্দু বৌদি আর বন্যা রয়েছে। তারা আমাদের দেখছে।”
বিন্দু অঞ্জলীকে ছাড়লো রাতের ডিনারের পর।
ঠাকুরমার মৃত্যুর পর অঞ্জলী ইউনিয়ন ব্যাংকে তেমন একটা আসেনি আর। অনেকদিন পর বলে ম্যানেজার ছাড়া নতুন স্টাফরা কেউ চিনতে পারলো না। বর্তমান ম্যানেজার তখন ছিল সদ্য জয়েন করা এক তরুণ অফিসার। সে খুব খাতির যত্ন করলো তাকে। বিগ ক্লায়েন্টের বিগ এন্টারটেইনমেন্ট। কর্পোরেট কালচারে অঞ্জলী অভ্যস্ত। ভাব ধরে রেখেই সে তাদের লকার সার্ভিস সম্পর্কে জানতে চাইল। জানতে চাইল কতটা নিরাপদ আর কতটা গোপনীয়।
তোতা পাখীর মত বুলি ফুটলো ম্যানেজারের মূখে। “আমরা সুইস ব্যাংক নই। তবে এ কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমাদের সার্ভিস তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সবচে বড় কথা কোন পরিস্থিতিতেই আমরা আমাদের ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা ডিসক্লোজ করি না। এ লকার ভাংগা সম্ভব নয়। এটার পাসওয়ার্ড হ্যাক করা যায় না। এমনকি শত বছর আনক্লেইমড থাকলেও আমরা কাস্টমারের খোঁজ করি না। কারণ আমাদের কাছে কোন রেকর্ডই থাকে না কোন লকারটা কাকে দেয়া হয়েছে। আমরা শুধু আমাদের এম্পটি লকারগুলির খবর বলতে পারি।”
“হুম।” বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো অঞ্জলী। “আমি কি একবার এরিয়াটা ঘুরে দেখতে পারি?”
“অবশ্যই ম্যাডাম, আসুন।”
ম্যানেজারের পিছন পিছন অঞ্জলী লকার রুমের দিকে গেল। নানান রকমের ফরমালিটিজ মেইনটেইন করার পর তারা সেখানে ঢুকতে পারল। বিরাট এলাকা। দশটা বড় আকারের রুম। প্রতিটা রুমে দশটা করে বুথ আর প্রতিটা বুথে একটা করে লকার। তেমন খালি নেই। অঞ্জলীর টার্গেট হলো দশ নম্বর রুমের দশ নম্বর বুথ।
“আচ্ছা ধরুন আমি যদি এক নম্বর রুমের এক নম্বর বুথের লকারে কিছু রাখতে চাই পারবো?”
“না খালি নেই।”
“পাঁচ নাম্বার রুমের পাঁচ নাম্বার বুথের লকারে?”
“সেটাও খালি নেই।”
“দশ নাম্বার রুমের দশ নাম্বার বুথের লকারে?
“তাও খালি নেই।”
“ব্যাটার আপনি আমাকে বলুন কোনটা কোনটা খালি আছে।”
ম্যানেজার বেশ কটা খালি লকারের নম্বর বললো যার মধ্যে দশ নম্বর রুমের নয় নম্বর বুথের লকারটা রয়েছে। তার এটাই পছন্দ হলো।
তারা ফিরে এল ম্যানেজারের রুমে। ম্যানেজার তাকে বার বার করে বলে দিল “লকারগুলি সম্পূর্ণ ডিজিটাল লক। আপনি আপনার নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে একবার বন্ধ করে দিলে এটা আর কেউ খুলতে পারবে না। এমন কি আপনার নামধাম এবং কোন লকারটি আপনি ভাড়া নিয়েছেন তারও কোন রেকর্ড আমাদের কাছে থাকবে না। শুধু আপনাকে আমরা একটা কোড নাম্বার দেব। যেটা দিয়ে আপনি আমাদের সিস্টেমে ঢুকতে পারবেন। তারপর আপনার নিজস্ব একটা পিন নম্বর সেট করে সিস্টেম থেকে বের হয়ে আসবেন। এই পিন যার কাছে থকাবে সেই আমাদের সিস্টেমে ঢুকতে পারবে। সিস্টেমে ঢুকে পিন নম্বর সেট করে এন্টার করলে যদি ম্যাচ করে তাহলে গ্রীন লাইট জ্বলবে এবং আপনি লকার রুমে ঢুকবার সুযোগ পাবেন। তারপর আবার নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে বুথ খুলতে হবে এবং আর একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে লকার খুলতে হবে।”
“এ তো মহা জটিলতা। এত সব মনে রাখবো কি ভাবে?”
“সরি ম্যাডাম, ক্লাইয়েন্টের নিরাপত্তার কথা ভেবেই আমাদের এটা করতে হয়েছে। আপনাকে দেখানোর জন্য আমি যখন প্রবেশ করি তখন আমাকেও একই ভাবে লকার রুমে ঢুকতে হয়েছে। আমার নামে এখানে একটা লকার রয়েছে। আর আমরা কখনও এক সাথে দুজন ক্লায়েন্টকে লকার এরিয়ায় ঢুকতে দেই না। একবারে একজন। এবং সম্পূর্ণ খালি হাতে। ঢুকতে হবে।”
“উফফফ। একদম হাপ ধরে গেছে অফিসার। কাল পরশু আবার আসবো। কিছু অর্নামেন্ট রাখবো আমি।”
“আমিও তাই ধারণা করেছি। অর্নামেন্ট আর ডকুমেন্টস এ দুটোই মানুষ বেশী রাখে। ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনার যদি এসকর্ট লাগে বলবেন। আমরা এসকর্ট দিয়ে ভ্যালুড ক্লাইয়েন্টকে সহায়তা করে থাকি। এর জন্য এক্সট্রা কোন ফি নেই।”
“থ্যাংক্যু অফিসার। আই এম রিয়েলি কনভিনসড।”
“আমরা রায় গ্রুপের অনেক পুরনো আর বিশ্বস্ত ব্যাংকার ম্যাডাম। আপনি জানেন গ্রান্ড ম্যাম আমাদের খুব পছন্দ করতেন।”
ম্যানেজার অঞ্জলীকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। অঞ্জলীর বার বার মনে হতে লাগলো কাজটা সে শেষ পর্যন্ত করতে পারবে। সে ভীষণ উত্তেজিত বোধ করলো।
ব্যাংকের লকার সিস্টেমের সব কথা শুনে অমিত বললো, “বাদ দাও। ঠাকুরমা আদৌ কোন লকার ভাড়া করেছিলেন কিনা সেটারই যখন কোন রেকর্ড নেই তুমি কেমন করে তা খুজেঁ বের করবে! তার পর সেটা খুলে তোমার ধন রত্ন হাতাবে!”
“ধন রত্ন আদৌ যদি কিছু থাকে তবে সেটা আমার নয় তোমার।”
“যার ই হোক এ সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে আমার ইচ্ছা করছে না।”
“তো কি ইচ্ছা করছে মাই লাভ!”
“আমি কাশী যাব। পিসিমাকে নিয়ে আসবো। তিনি তোমার অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন।”
“আমার অভিভাবক কে হবে? জামাই বাবু না দিদি?”
“একজন হলেই হলো।”
“খুব রোমান্টিক তাই না?”
“আচ্ছা কনে দেখার সময় তুমিও কি সাথে আসবে না তোমার গুরুজনেরাই কেবল দেখে যাবে? বর পণ কিছু দিতে হবে জানি। কি চাই গো তোমার?”
“অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা।”
“রাজ্যটা ছোট। তবে তার পুরোটাই তোমাকে দেয়া হবে। আর তোমার মনোরঞ্জনের জন্য এই সেবাদাসী সারাক্ষণ হাজির থাকবে।”
মূল বাড়ির সবুজ লনে দুজন হাটছিল আর কথা বলছিল। এ দিকটায় অঞ্জলী ছাড়া আর কেউ আসে না। তারা হাটছিল পাশাপাশি। অঞ্জলীর একটা হাত অমিতের মুঠিতে ধরা। তার আংগুল গুলি একটু একটু কাঁপছে। প্রথম প্রেমে পড়া কিশোরীর মত লাগছে ওকে।
ব্যাংক থেকে ফেরার পথে অমিতকে মনি শংকরের বাসা থেকে তুলে এনেছে অঞ্জলী। বন্যা সাথে আসতে চেয়েছিল। বিন্দু কষে একটা ধমক দিয়েছে। “মাসিমনি আর ছোট কাকু প্রেম করবে, সেখানে তুমি কেন কাবাব মে হাড্ডি হতে যাবে শুনি?”
ঝিলিক দিয়ে উঠে বন্যার চোখ, “ছোট মা, তুমি ভাল কথা মনে করেছ। মাকে তো এখনো বলাই হয়নি তার আই বুড়ো বোনটা আমার কাকুর ঘাড়ে চেপেছে।”
খপ করে বন্যার চুলের মুঠি ধরলো বিন্দু। এটা তার সবচে প্রিয় একটা কাজ। বন্যার মাথার পিছনের ঝুটিটা চেপে ধরা। “এই বাঁদর মেয়ে সব কথা মাকে বলতে হবে কেন? ছোট মা জেনেছে তাতে হবে না? আর মাসিমনির নিন্দে করছিস বলে দেব ওকে?”
“উফ্*! না! ছাড়ো তো ছোট মা! লাগছে আমার। মাসিমনিকে তুমি কিছু বলতে যেওনা কিন্তু!”
“ঠিক আছে ছাড়লাম। তবে আশ্রমে যাওয়া হবে না তোমার। তুমি আমার কাছে থাকবে।”
দুই প্রজন্মের দুই নারী। কি যে গভীর বন্ধুত্ব!
ঠিক হল পরদিন সকালে অঞ্জলী আর অমিত যাবে ইউনিয়ন ব্যাংকে। রাতে অমিত অঞ্জলীর এখানেই খাবে। ম্যাগীকে আসতে বলেছে। সুব্রতও আসবে। ওরা যথা সময়েই এল। সুব্রতই ম্যাগীকে পিক করেছে।
ইদানীং সুব্রত আর ম্যাগীর মাঝে বেশ সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। অমিতকে কেন্দ্র করেই তাদের মাঝে আলাপ এবং সে সূত্রে ফ্রেন্ডশীপ। এটা আরও গভীরতা পেয়েছে ম্যাগীর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কারণে। হায়ার স্টাডিজের জন্য সুব্রত অনেকদিন থেকে একটা স্কলারশীপের চেষ্টা করে আসছিল। ডিপার্টমেন্ট অনুমতিও দিয়েছে। কিন্তু সুব্রত স্কলারশীপ যোগাড় করে উঠতে পারছিল না। ম্যাগীর কানে সেটা যেতেই সে তার সাংবাদিক কানেকশান কাজে লাগিয়ে খুব অল্প দিনের মাঝেই দুটো অফার ম্যানেজ করে দিয়েছে। আগামী বছরের কোন এক সময় হায়ার স্টাডিজের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবে সুব্রত।
সুব্রত বা ম্যাগী কারো ঘর সংসার নেই। অফিসের পরে অফুরন্ত সময়। সময়টা তারা ইদানীং বেশ উপভোগ করছে। আজ যেমন দুপুর থেকেই দুজন শপিং এ বেরিয়ে ছিল। ম্যাগী জেনেছে শারদীয় দুর্গা পুজা বাংগালী * সমাজের প্রধানতম উতসব। এক্সমাসের মত এদিনে সবাই সবাইকে গিফট করে। সুব্রত ম্যাগী আর অঞ্জলীর জন্য গিফট কিনলো। ম্যাগীও সুব্রত, অঞ্জলী এবং রায় পরিবারের প্রায় সবার জন্য গিফট কিনলো। সুব্রত স্রেফ দুটি শাড়ি কিনলো। একটা অঞ্জলী আর একটা ম্যাগীর জন্য। কিন্তু ম্যাগী একেক জনের জন্য একেক রকমের গিফট কিনলো। এ ক্ষেত্রে সুব্রত ছিল তার কনসালটেন্ট। কাপড়-চোপড়ের বাইরে ম্যাগী অঞ্জলী আর বন্যার জন্য কানের দুল এবং অমিতের জন্য রিং কিনলো। অলংকার গুলিতে ডায়মন্ড বসানো। এ পছন্দের পিছনে কি কারণ ম্যাগী ঠিক জানে না। সুব্রত বলেছে সে কিনেছে। কেনার পর গিফট প্যাকেটগুলি সুব্রত তার কাছে রেখে ম্যাগীকে হোটেলে গিয়ে রেডী হতে বলেছে। সন্ধ্যের পর নিজে ড্রাইভ করে ম্যাগীকে নিয়ে এসেছে আশ্রমে।
গিফট পেয়ে অঞ্জলী অমিত দুজনেই খুশী হলো। অঞ্জলী শাড়িটা রেখে দিল দশমীর দিন পড়বে বলে। কিন্তু দুল জোড়া তখুনি পড়ে ফেললো। খুব মানিয়েছে ওকে। অমিতও রিংটা সাথে সাথে পড়লো। রিংটা পড়লো সে মধ্যমায়। ওয়েডিং রিং পড়ার জন্য অনামিকা খালি রেখেছে। এটা নিয়ে ম্যাগী একটু ঠাট্টা মশকারাও করেছে। তাদের ডিনার হয়েছে প্রাণবন্ত। ডিনার টেবিলে অমিত-অঞ্জলী আর সুব্রত-ম্যাগী দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। পরস্পরের কাছে ধরাও পড়েছে। আবার ভান করেছে কিছুই হয়নি।
ডিনার শেষে অমিতকে মনি শংকরের বাসায় আর ম্যাগীকে হোটেলে পৌছে দিল সুব্রত। অঞ্জলী সাথে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু অমিত বারণ করেছে। সারাক্ষণ হয় পুলিশ না হয় অন্য গার্ড নিয়ে চলতে তার ভাল লাগে না। বাসায় পৌছে অঞ্জলীকে ফোন দিয়ে কনফার্ম করেছে। সুব্রত নামতে চায়নি। কিন্তু বিন্দু তাকে কফি না খাইয়ে কোন ভাবেই ছাড়লো না। ম্যাগীও সুযোগ পেয়ে গিফট গুলিকে সবাইকে পৌছে দিল। বন্যা কানের দুল পেয়ে খুব খুশী হলো। যখন জানলো মাসিমনি সাথে সাথে দুল জোড়া পড়েছে সেও সাথে সাথে পড়ে নিল।
সুব্রত যখন ম্যাগীকে হোটেলের সামনে ছাড়লো তখন রাত প্রায় দশটা। নামার আগে ম্যাগী সুব্রতকে বললো, “অভ্যেস থাকলে এসো, এক বোতল শ্যাম্পেইন আছে আমার কাছে।”
“নো থ্যাংকস” স্মিত হেসে মানা করলো সুব্রত।
বিদায়ী হ্যান্ডশেকটা একটু বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো। হাতটা যতক্ষণ ধরে রাখলে আলাদা কোন অর্থ হয় না তার চে বেশী সময় ধরে রাখলো দুজনেই।
ম্যানেজারকে আগে থেকে কিছুই ইনফরম করেনি অঞ্জলী। সরাসরি এসে হাজির হয়েছে। অমিত রয়েছে সাথে। বিজনেস স্যুটে দারুণ মানিয়েছে তাকে। লবীতে ঢুকতেই ম্যানেজার তাদের সিসিটিভিতে দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। অঞ্জলী পরিচয় করিয়ে দিল, “ড. অমিতাভ রায় চেৌধুরী, ডিরেক্টর রায় গ্রুপ।”
“আই নো হিম ভেরী ওয়েল ম্যাডাম। হি ইজ নাও অ্যা সেলিব্রেটি।”
সকল ফরমালিটিজ ম্যাইনটেইন করে অঞ্জলী তার হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে লকার রুমের উদ্দেশ্যে গেল। সেখানে তাকে আবার অনেক ফরমালিটিজ মেইনটেইন করতে হলো। কোন বিস্ফোরক দ্রব্য, বেআইনী দ্রব্য নেই সে মর্মে ডিক্লারেশন দিতে হলো। সেখানে তাকে একটা পিন নম্বর দেয়া হলো। অঞ্জলী সিস্টেমে ঢুকে ব্যাংকে পিন নম্বর চেইঞ্জ করে নিজস্ব পিন নম্বর সেট করলো। সে নাম্বার দরজায় সেট করে দশ নম্বর রুমে ঢুকলো। তার পর নয় নম্বর বুথে একটা পাসওয়ার্ড সেট করলো। তারপর লকারে আবার পাসওয়ার্ড সেট করে লক করলো।
এবার শুরু হলো তার আসল উত্তেজনা। কারন দশ নম্বর রুমে ঢুকার জন্য যে যে পাসওয়ার্ড সেট করেছে সেটা দিয়েই ঢুকতে পারবে। কিন্তু দশ নম্বর বুথে শুধু ওনারের পাসওয়ার্ড লাগবে। দুর্গা দুর্গা বলে সে পুশ করলো ১০০। সাথে সাথে ক্লিক শব্দে বুথের দরজা খুলে গেল। দেরী না করে আবার পুশ করলো ১০৪। এন্টার দিয়ে দম বন্ধ করে দাড়িয়ে রইল। এক সেকেন্ড পর লকারের দরজায় গ্রীন লাইট জ্বললো। তবুও অঞ্জলীর মনে হলো অনন্তকাল। লকার রুমে ঢুকার আগেই তার হাতে গ্লাভস পরা ছিল। মেটালিক নবটা ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল।
ভিতরে একটা ছোট প্যাকেট। ওয়াটার প্রুফ, ফায়ার প্রুফ কাগজে মোড়া। প্যাকেটটা হ্যান্ড ব্যাগে ভরে আবার লক করলো যথা নিয়মে। দ্রুত কাজ করছে। কিন্তু সতর্ক রইল যাতে ভুল না হয়। তারপর বেরিয়ে এল বাইরে। ম্যানেজারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অমিতকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!