14-09-2020, 06:01 PM
২৪ পর্ব
ঠিক হয়েছে এবার মনি শংকরের বাড়িতে উঠবে অমিত। বন্যা খুব মন খারাপ করেছিল। বিন্দুর কথায় শেষ পর্যন্ত থেমেছে। যে কদিন অমিত মনি শংকরের বাড়িতে থাকবে সে কদিন বন্যাও সেখানে থাকবে। এতে বিন্দুর আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। মেয়েটাকে সে যে কি পরিমাণ ভালবাসে তা কল্পনারও বাইরে। নিজের সন্তান থাকলে তাকেও বোধ হয় এতটা ভালবাসতো না। মনি শংকরও তাকে ভালবাসে। রাশভারী মনি শংকর বন্যার সাথে হয়ে যায় শিশু।
ঘর গোছাতে গোছাতে শিস বাজাচ্ছে বিন্দু। ম্যাগী তাকে সহযোগিতার নামে ঝামেলাই করছে বেশী। এটা ওখানে রাখ, ওটা সেখানে রাখ। এরই মাঝে ঘরের পর্দা পাল্টেছে তিনবার। শেষমেষ অস্থির হয়ে বিন্দু ধমক দিলো, “হ্যারে ম্যাগী, এত জ্বালাতন করছিস কেন বলতো? আমার দেবরকে আমি যেভাবে রাখি সে সেভাবেই থাকবে।”
“তাই নাকি? খুব ভাবছিল তোমাদের মাঝে তাই না?”
“ওমা সেকি কথা! থাকবে না কেন? ছোট ঠাকুরপো ছিল আমাদের বাড়ির প্রাণ।”
“আর তুমি ছিলে তার প্রাণ ভোমড়া।”
প্রস্তুত ছিল ম্যাগী। তাই সময় মত সরে যেতে পেরেছে বিন্দুর থাপ্পড় থেকে। তাদের খুনসুটি দেখে বুঝার উপায় নেই দুজন পৃথিবীর দুই গোলার্ধের বাসিন্দা। তাদের মাঝে না আছে কোন সম্পর্ক, না আছে কোন সাদৃশ্য। তবুও কি সুন্দর পারিবারিক আবহ।
“দাঁড়া এবার ঠাকুরপোকে লাগাবো তোর পিছনে।”
“তোমার ঠাকুরপোকে আমার সামনে পিছনে কোনদিক থেকেই লাগাতে পারবে না।”
“ছি! কথার কি ছিরি দেখ? এই ঢ্যামনি তোর কি লজ্জা শরম বলে কিছু নেই?”
“হুম! কৃষ্ণ করলে লীলা আর আমি করলে দোষ, তাই না? আচ্ছা মেজবৌদি তোমার ছোট ঠাকুরপোর বিযে দিচ্ছ না কেন?”
“দেব, এবার নিশ্চই দেব। ভাল একটা মেয়ে খুজেঁ পেলেই দেব। আছে নাকি তোর খুজেঁ কোন মেয়ে?” হঠাত বিন্দুর খেয়াল হলো এ বিষয়ে ম্যাগী কেন কথা বলছে। এটা তো তার বিষয় নয়। পাহারা দিতে গিয়ে আবার প্রেমে পড়েনিতো মেয়েটা?
“এই তুই ঠাকুরপোর বিয়ে নিয়ে এমন উতলা হলি কেন রে? ওর প্রেমে পড়িস নি তো?”
“সে আর বলতে। জনম জনম ধরে তোমার ঠাকুরপোর প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচিছ।”
“উফ তোর ঢ্যামনামি আর গেল না।”
“শুন মেজবৌদি, সুযোগটা দ্বিতীয়বার নাও আসতে পারে তাই সময় থাকতেই বলে রাখছি, তোমার ঠাকুরপো অঞ্জলীদির প্রেমে মজনু হয়ে আছেন গত দেড় যুগ ধরে।
“সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করবি নাতো! অঞ্জলী আমাদের পরিবারেরই একজন প্রায়। ওতো ঠাকুর পোর চে বয়সে বড় আর বাল বিধবা।”
“যিশুর কিরে বৌদি, এটা ঠাট্টা নয় ।
“তুই জানলি কি করে?”
“আমি সাংবাদিক, আমাকে জানতে হয়। জানাটাই আমার কাজ।
“হায় ভগবান, বলিস কি রে হতচ্ছারী?
“অঞ্জলীদি সারা জীবন আই বুড়ো থেকে গেলেন সেতো তোমার ছোট ঠাকুরপোর জন্যই।”
“ওমা সে কি জানতো নাকি যে ঠাকুরপো পনের বছর পরে তার জন্য দেশে ফিরে আসবেন?”
“সে তারমত অপেক্ষা করে গেছে, আসলে আসবে না আসলে নাই।”
“কিন্তু অঞ্জলীও তো বিয়েথা করে সংসারী হয়ে যেতে পারতো। তার সাথে তো ঠাকুরপোর যোগাযোগ ছিল না।”
“তোমার ঠাকুরপোও সে ঝুকি নিয়েই অপেক্ষা করেছে।”
“তোর কথা যদি সত্যি হয় তবে শীঘ্র্ই আমি দুটির চার হাত এক করে দেব।”
“তাই দাও। এ যুগে এমন পৌরাণিক প্রেম খুব বিরল।”
“আচ্ছা তুই এত খবর যখন জানিস তো বল দেখিনি তোর বস কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে?”
“আমার বস একজন সিংহ হৃদয় একজন মানুষ মেজ বৌদি। মাথা কাজ করে কম। হৃদয় কাজ করে বেশী। তাই লাইনে থাকতে পারেন না। বখে যাওয়া ধনীর দুলাল, যাকে তুমি আবার লাইনে ফিরিয়ে এনেছ।”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিন্দু এই বিদেশী মেয়েটার দিকে। তার চোখ কি কিছুই এড়ায় না?
চারটে গাড়ি। রোহিতের শেভ্রোলে, মনি শংকরের বিএমডব্লিউ, মঞ্জুর পোর্সে আর অঞ্জলীর বেন্টলী। শেভ্রোলেটা অমিত নিজে ড্রাইভ করে, অঞ্জলীও বেন্টলী নিজে ড্রাইভ করে। মনি শংকর আর মঞ্জুর গাড়ী চালায় ড্রাইভার। সকলে মিলে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল অমিত শেভ্রোলে নিয়ে মাঝখানে থাকবে। তার সাথে থাকবে বন্যা। সামনে মনি শংকর। পিছনে মঞ্জু আর রোহিত। আর সবার পিছনে থাকবে অঞ্জলী। হাসপাতালের সকল ফরমালিটিজ শেষ হবার পর কিছু রয়ে গেছে কিনা সেটা দেখার জন্য অঞ্জলী ফিরে গেল অমিতের কেবিনে। ভিতরে ঢুকে মনি শংকরকে মেসেজ দিল, “দাদা, কাউকে বুঝতে না দিয়ে অমিতের কেবিনে একবার আস। এক্ষুণি।”
অঞ্জলীর দুঃসাহস দেখে মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল মনি শংকরের। তার পরও চুপ থাকলো। খুব ক্যাজুয়াল ভংগীতে অমিতের কেবিনে ঢুকলো। ঠোটে আংগুল রেখে অঞ্জলী মনি শংকরকে কথা বলতে নিষেধ করলো। তার পর নোট প্যাড নিয়ে দ্রুত লিখলো, “দাদা অতীতের কথা ভুলে যাও। অমিতকে ভালবাস তাই বলছি। কাল রাতেও অমিতের উপর অ্যাটেম্পট হয়েছে। আমার ধারণা আবারও হবে এবং সেটা পথে হবার সম্ভাবনাই বেশী। আগের পরিকল্পনা বাদ দাও। শেষ মূহুর্তে অমিতকে নিয়ে তুমি আলাদা গাড়ীতে উঠ।”
শত্রু-মিত্র যাই হোক অঞ্জলীর বুদ্ধির উপর তার আস্থা আছে। আর যেহেতু মনি শংকর নিজে সাথে থাকবে কাজেই অঞ্জলীর পরিকল্পনা মেনে নিল। গাড়ি ছাড়ার একদম শেষ মূহুর্তে পুলিশ জীপ নিয়ে সুব্রত এসে হাজির হলো। নিজেই ড্রাইভ করছে। স্টার্ট বন্ধ না করেই মনি শংকর আর অমিতকে বললো, “উঠে পড়ুন, কুইক।” কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সাঁ করে বেরিয়ে গেল সুব্রত। পিছন পিছন গেল মনি শংকরের গাড়ি। ড্রাইভার একাই আছে সেটায় । তারপর মঞ্জু আর রোহিত তাদের পোর্সেতে।এবং সবশেষে অঞ্জলীর সাথে বন্যা। শেভ্রোলেটা পরে রইল হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সকলেই খুব দ্রুত সুব্রতকে ফলো করছে। তারা এক কিলোমিটারমত গিয়েছে কি যায়নি, বিকট শব্দে হাসপাতালের সামনে বিস্ফোরিত হলো রোহিতের শেভ্রোলে। টাইম বোমা ছিল গাড়িতে।
দশ মিনিটের মধ্যে মনি শংকরের বাড়ির সামনে পৌছে গেল গাড়ির বহর। লাফ দিয়ে নামলো অমিত আর মনি শংকর। অন্য গাড়ি গুলি থেকে প্যাসেঞ্জাররা এখনও নামা শুরু করেনি সুব্রত রওয়ানা দিল হাসপাতালের পথে। বিস্ফোরণের শব্দ তাদের কানে যায় নি। তবে ওয়াকি টকিতে কোডেড মেসেজ পেয়েছে সুব্রত। হাসপাতালের সামনে পৌছে দেখল বিরাট জটলা। প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা ক্যামেরা হাতে ব্যস্ত। সে নামতেই সবগুলি ক্যামেরা ঘুরে গেল তার দিকে। হরবর করে প্রশ্ন করছে সবাই। “শেষ মূহুর্তে আপনি ড. অমিতাভ রায় চৌধুরীকে লিফট দিয়েছেন। আপনি কি আগে থেকেই জানতেন এরকম কিছু ঘটবে।” সুব্রত জবাব দিল না। দুজন কনস্টেবল আর একজন হাবিলদার ছিল সেখানে। তাদের কাছ থেকে জানলো কেউ হতাহত হয়নি। আশেপাশের দুএকটা দোকানপাটের কাচঁ ভেংগে গেছে। আর গাড়িটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। অনুসন্ধানী চোখে জায়গাটা জরীপ করছে সুব্রত। কোন আলামত পাওয়া যায় কি না। হঠাত করেই তার হাতের রুমালটা পড়ে গেল। কেউ লক্ষ্য করলো না রুমাল তুলার সময় এর সাথে একটা ফেঠে যাওয়া পিতলের টুকরাও ঢুকে গেল সুব্রতর পকেটে।
আবারও ছেকে ধরলো সংবাদকর্মীরা। সুব্রত শুধু বললো,” আমি কিছু জানতাম না বা অনুমান করিনি। রুটিন পেট্রোলে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভিভিআইপি লোকদের গাড়ি বহর দেখে ইনস্টান্টলী লিফট দেবার প্রস্তাব দেই। তারাও রাজী হন। থ্যাংক গড। একটা দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেল।” নমস্কার জানিয়ে গাড়িতে উঠে গেল সুব্রত। আসলে তাকে ফোন করে ডেকে এনেছিল অঞ্জলী। গোপনীয়তার জন্য কারো সাথে কিছু শেয়ার করেনি।
পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিল বিন্দু্। পাশে ম্যাগী। মনি শংকর অমিতকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। মঞ্জু আর রোহিত নামতেই এগিয়ে এল বিন্দু। অনেক অনেক দিন পর তারা এল মনি শংকরের বাড়িতে। অঞ্জলী নামলো না। বন্যাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। রোহিত আর মঞ্জুকে ম্যাগীর হাতে ছেড়ে দিয়ে ফিরতেই দেখল অঞ্জলী চলে যাচ্ছে। হায় হায় করে উঠলো বিন্দু। কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গেছে। অঞ্জলী চলে গেছে মেইন গেইটের কাছে।
সে ঝাড়ি দিল বন্যাকে,”মাসিমনিকে নামতে বললে না কেন?”
“বলেছি তো, তার নাকি অনেক কাজ পড়ে আছে।”
“কাজ না ছাই, আমাদের বাড়িতে নামবে না তাই।”
“তুমি নিশ্চই দাওয়াত করনি?”
“আমি না করলেই বা, তুই করতে পারিসনি?”
“তোমার বাড়িতে আমার মাসিমনিকে আমি কেন দাওয়াত করবো”
খপ করে বন্যার মাথার পিছনে চুলের গোছা মুঠি করে ধরলো বিন্দু। ঝাকুনি দিতে দিতে বললো, “এটা কার বাড়ি বল?”
“ভুল হয়ে গেছে ছোট মা, এটা আমার বাড়ি, এবার ছাড়ো লাগছে।”
“ফের যদি ভুল হয় একটা চুলও রাখবো না তোর মাথায়” বলেই টেনে একদম বুকের কাছে নিয়ে গেল বন্যাকে। তারপর নাকে নাক ঘষে, গাল টিপে আদর করে দিল।
বন্যা ছাড়া এ প্রজন্মের আর কেউ নেই রায় পরিবারে। তাই আঠার পার করেও বন্যা শিশুই রয়ে গেছে সবার কাছে। যৌক্তিক আর অযৌক্তিক নেই, বন্যার চাওয়া, আব্দার আর মতামতই ফাইনাল। তবে মেয়েটা বড় শার্প আর রেশনেল। বড় লোকের আদুরে মেয়ের কোন বৈশিষ্ট্য তার মাঝে নেই। বরং খুবই রেসপনসিবল আর কেয়ারিং। তবে মেজাজী আর ডানপিটে। ছোট বেলার অমিতের সকল বৈশিষ্ট্য তার মাঝে আছে। পড়া শুনায় ভাল। ক্লাসিক্যাল আর মডার্ন দু ধরনের নাচেই তালিম নিয়েছে মায়ের কাছে। বিন্দুর কাছে গান আর অঞ্জলীর কাছে মার্শাল আর্ট। পড়াশুনার চাপে নাচ আর গান বেশী দূর আগায়নি। তবে মার্শাল আর্টের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। মঞ্জুর বার বার বারণ সত্বেও এটা সে চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে গ্রীন বেল্ট পেয়েছে। আর এক ধাপ গেলেই অঞ্জলীর সমান হয়ে যাবে। ভাল ব্যাডমিন্টন আর টেবিল টেনিস খেলে। ছোট মার আদর খেয়ে বন্যা সোজা চলে গেল বসার ঘরে।
বসার ঘরে রোহিত আর মঞ্জু রয়েছে। বন্যা এসে বসলো দুজনের মাঝখানে। রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে টিভির সুইচ অন করলো। সাথে সাথেই লাফ দিয়ে খবরটা চোখে ঠেকল।
ব্রেকিং নিউজ। সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে পার্ক করে রাখা একটি গাড়ি বিস্ফোরিত। এ গাড়িতে ড. অমিতাভ রায় চৌধুরীর যাবার কথা ছিল। শেষ মূহুর্তে পুলিশ তাকে এসকর্ট করে বাসায় পৌছে দিয়েছে। অল্পের জন্য বেচে গেছেন তিনি। আজই মাঝ রাতের দিকে এ হাসপাতালের একজন ডাক্তার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল ধারণা করছে। ড. রায় একজন আন্তর্জাতিক জ্বালানী বিশেষজ্ঞ। কিছু দিন আগেই তার উপর আততায়ী হামলা হয়েছে। আশংকা করা হচেছ কোন আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র দেশের এ কৃতি সন্তানের জীবননাশ করতে চাইছে। তার যথাযথ নিরাপত্তা বিধান করা হয়নি বলে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি যথাযথ তদন্ত হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
রোহিত, মঞ্জু, বন্যা প্রত্যেকের চোখ আটকে আছে টিভির পর্দায়। কেউ কোন কথা বলছে না। চোখের পলক ফেলছে না। দম আটকে আছে তিন জনেরই। খবর শেষ হতে প্রথম দম ফেললো রোহিত। কিন্তু কোন কথা বললো না। মঞ্জু বললো, “রক্ষে কর ভগবান, হচ্ছে কি এসব?” স্বামীর দিকে তাকিয়ে অনুযোগ করলো। যেন রোহিত সব কিছু জানে। সবচে কঠিন প্রতিক্রিয়া হলো বন্যার মাঝে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার পর উর্দ্ধমূখে দৌড় দিল অমিতের ঘরের দিকে। এক ঝটকায় দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো।মনি শংকর আর অমিত দুজনেই ছিল ঘরে। “ছোট বাবা” বলে চীতকার করে ঝাপ দিল মনি শংকরের বুকে।
“হোয়াট হ্যাপেন বেবী! এনিথিং রঙ?”
মনি শংকরের বুক থেকে মূখ না তুলেই অমিতের দিকে আংগুল তুললো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। সব কথা তার মূখের কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। অমিত এটাকে তার স্বাভাবিক প্রগলভতা হিসাবেই ধরে নিল। কিন্তু মনি শংকর জানে বন্যা এখন অনেক ম্যাচিওরড। নিশ্চই সিরিয়াস কিছু।
অনেক কসরতের পর মূল কথাটা জানা গেল। ততক্ষণে বিন্দু, ম্যাগী, রোহিত, মঞ্জু সবাই এ ঘরে এসে হাজির। অমিত সবাইকে শান্ত হতে বললো। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বিন্দুকে বললো, “মেজ বৌদি তোমার লাঞ্চ কতদূর বল। আমি খুব ক্ষুধার্ত।”
তার পর মঞ্জুর দিকে ফিরে আবার বললো, “বড় বৌদি, মূখটাকে এমন আমসি করে রেখেছ কেন? যা হবার হয়েছে। আমি এখনো বেঁচে আছি দ্যাটস অল। এসো, আমাকে শাওয়ার নিতে হেল্প করবে।”
বন্যা আর রোহিত ফিরে গেল বসার ঘরে। অমিতকে নিয়ে মঞ্জু গেল ওয়াশ রুমে। বিন্দু কিচেনে। মনি শংকর ম্যাগীকে ডেকে নিয়ে গেল বাইরের লনে। “আমার হয়ে ইনস্পেক্টর সুব্রতকে থ্যাংকস জানাও। বল রায় পরিবার তার বিষয়টা মনে রাখবে।”
সে নিজে রিং করলো অঞ্জলীর নাম্বারে। অঞ্জলী রিসিভ করতেই মনি শংকর বললো, “তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। দুপুরে আমাদের সাথে লাঞ্চ করলে খুশী হবো।”
“কিন্তু দাদা” অঞ্জলীর কন্ঠে দ্বিধা। কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল।
“কোন কিন্তু নয়, আমি নিজে তোমাকে নিতে আসবো। তৈরী থেকো।” লাইন কেটে দিল মনি শংকর।
অমিতের স্নান শেষ হয়েছে। ওয়াশ রুমে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে অমিতকে বসিয়ে হালকা গরম জলে স্নান করিয়েছে মঞ্জু। এ কাজটা ছোটবেলায় ঠাকুরমা করতেন। বড় বৌদি যখন তার পিঠ রগড়ে চুলে শ্যাম্পু করছিল তখন সেই ছোটবেলার মতই অমিত চেচামেচী করছিল চোখে শ্যাম্পু গিয়েছে বলে।
“চেচিও না ঠাকুরপো, বন্যা বড় হয়েছে। বুঝতে পারলে প্রেস্টিজ পাংচার।”
পিঠে সাবান ডলতে ডলতে মঞ্জু আবার শুরু করলো, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তেমার মনে আছে ঠাকুরমা যখন তোমাকে স্নান করাতেন, তুমি প্রতিবার আমার সফট শ্যাম্পুটা চাইতে।”
অমিত কথা বললো না, শুধু উপরে নীচে মাথা দোলালো।
“এবার বিয়ে থা করে থিতু হও ঠাকুরপো। বন্যাটা কোলে পিঠে ওঠার বয়স পেরিযেছে। তোমাদের ছেলেপিলে হলে একটু যদি সময় কাটে।” বড়বৌদি জল ঢালা শেষ করলেন। তারপর বড় টাওয়েল হাতে দিয়ে বললেন, “এর পরের অংশে আর আমি থাকতে পারছি না।”
অমিত এবারও কথা বললো না, শুধু উপরে নীচে মাথা দোলালো। কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে সে কাঁদছে। চোখে শ্যাম্পু যাওয়ায় সুবিধা হলো, তার চোখের জল বড়বৌদি দেখতে পেল না।
বসার ঘরে রোহিতকে সংগ দিচ্ছিল মনি শংকর। বড় বৌদি আর অমিত এসে যোগদিল তাদের সাথে। বন্যাও এল। সে মোটামুটি স্বাভাবিক হয়েছে। সবাই আসার পর বেরিয়ে পড়লো মনি শংকর। ড্রাভারকে গাড়ি বের করতে বললো। কিন্তু সাথে নিল না। অঞ্জলীকে আনতে গেল নিজে ড্রাইভ করে।
মনি শংকর গাড়ি নিয়ে একদম মূল বাড়ির ভিতর বারান্দার সামনে চলে এল। অঞ্জলী তৈরী ছিল। মনি শংকর পৌছাতে সে শুধু বললো, “দাদা, একটুখানি নামবে?” মনি শংকর নামলো। অঞ্জলী উবু হয়ে প্রণাম করলো তাকে। সোজা হয়ে বললো, “অমিত বড় ভাগ্যবান তোমার মত একটা দাদা আছে তার।”
“তুমিও ভাগ্যবতী, আমি তোমারও দাদা। এবার গাড়িতে ওঠ।” ব্রেক রিলিজ করতে করতে একটা টিস্যু এগিয়ে দিল মনি শংকর অঞ্জলীর দিকে। অঞ্জলীর চোখে জল মনি শংকরের চোখ এড়ায়নি।
হায়রে জগত। কত দ্রুতই না মানুষের সম্পর্ক বদলায়!!
ঠিক হয়েছে এবার মনি শংকরের বাড়িতে উঠবে অমিত। বন্যা খুব মন খারাপ করেছিল। বিন্দুর কথায় শেষ পর্যন্ত থেমেছে। যে কদিন অমিত মনি শংকরের বাড়িতে থাকবে সে কদিন বন্যাও সেখানে থাকবে। এতে বিন্দুর আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। মেয়েটাকে সে যে কি পরিমাণ ভালবাসে তা কল্পনারও বাইরে। নিজের সন্তান থাকলে তাকেও বোধ হয় এতটা ভালবাসতো না। মনি শংকরও তাকে ভালবাসে। রাশভারী মনি শংকর বন্যার সাথে হয়ে যায় শিশু।
ঘর গোছাতে গোছাতে শিস বাজাচ্ছে বিন্দু। ম্যাগী তাকে সহযোগিতার নামে ঝামেলাই করছে বেশী। এটা ওখানে রাখ, ওটা সেখানে রাখ। এরই মাঝে ঘরের পর্দা পাল্টেছে তিনবার। শেষমেষ অস্থির হয়ে বিন্দু ধমক দিলো, “হ্যারে ম্যাগী, এত জ্বালাতন করছিস কেন বলতো? আমার দেবরকে আমি যেভাবে রাখি সে সেভাবেই থাকবে।”
“তাই নাকি? খুব ভাবছিল তোমাদের মাঝে তাই না?”
“ওমা সেকি কথা! থাকবে না কেন? ছোট ঠাকুরপো ছিল আমাদের বাড়ির প্রাণ।”
“আর তুমি ছিলে তার প্রাণ ভোমড়া।”
প্রস্তুত ছিল ম্যাগী। তাই সময় মত সরে যেতে পেরেছে বিন্দুর থাপ্পড় থেকে। তাদের খুনসুটি দেখে বুঝার উপায় নেই দুজন পৃথিবীর দুই গোলার্ধের বাসিন্দা। তাদের মাঝে না আছে কোন সম্পর্ক, না আছে কোন সাদৃশ্য। তবুও কি সুন্দর পারিবারিক আবহ।
“দাঁড়া এবার ঠাকুরপোকে লাগাবো তোর পিছনে।”
“তোমার ঠাকুরপোকে আমার সামনে পিছনে কোনদিক থেকেই লাগাতে পারবে না।”
“ছি! কথার কি ছিরি দেখ? এই ঢ্যামনি তোর কি লজ্জা শরম বলে কিছু নেই?”
“হুম! কৃষ্ণ করলে লীলা আর আমি করলে দোষ, তাই না? আচ্ছা মেজবৌদি তোমার ছোট ঠাকুরপোর বিযে দিচ্ছ না কেন?”
“দেব, এবার নিশ্চই দেব। ভাল একটা মেয়ে খুজেঁ পেলেই দেব। আছে নাকি তোর খুজেঁ কোন মেয়ে?” হঠাত বিন্দুর খেয়াল হলো এ বিষয়ে ম্যাগী কেন কথা বলছে। এটা তো তার বিষয় নয়। পাহারা দিতে গিয়ে আবার প্রেমে পড়েনিতো মেয়েটা?
“এই তুই ঠাকুরপোর বিয়ে নিয়ে এমন উতলা হলি কেন রে? ওর প্রেমে পড়িস নি তো?”
“সে আর বলতে। জনম জনম ধরে তোমার ঠাকুরপোর প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচিছ।”
“উফ তোর ঢ্যামনামি আর গেল না।”
“শুন মেজবৌদি, সুযোগটা দ্বিতীয়বার নাও আসতে পারে তাই সময় থাকতেই বলে রাখছি, তোমার ঠাকুরপো অঞ্জলীদির প্রেমে মজনু হয়ে আছেন গত দেড় যুগ ধরে।
“সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করবি নাতো! অঞ্জলী আমাদের পরিবারেরই একজন প্রায়। ওতো ঠাকুর পোর চে বয়সে বড় আর বাল বিধবা।”
“যিশুর কিরে বৌদি, এটা ঠাট্টা নয় ।
“তুই জানলি কি করে?”
“আমি সাংবাদিক, আমাকে জানতে হয়। জানাটাই আমার কাজ।
“হায় ভগবান, বলিস কি রে হতচ্ছারী?
“অঞ্জলীদি সারা জীবন আই বুড়ো থেকে গেলেন সেতো তোমার ছোট ঠাকুরপোর জন্যই।”
“ওমা সে কি জানতো নাকি যে ঠাকুরপো পনের বছর পরে তার জন্য দেশে ফিরে আসবেন?”
“সে তারমত অপেক্ষা করে গেছে, আসলে আসবে না আসলে নাই।”
“কিন্তু অঞ্জলীও তো বিয়েথা করে সংসারী হয়ে যেতে পারতো। তার সাথে তো ঠাকুরপোর যোগাযোগ ছিল না।”
“তোমার ঠাকুরপোও সে ঝুকি নিয়েই অপেক্ষা করেছে।”
“তোর কথা যদি সত্যি হয় তবে শীঘ্র্ই আমি দুটির চার হাত এক করে দেব।”
“তাই দাও। এ যুগে এমন পৌরাণিক প্রেম খুব বিরল।”
“আচ্ছা তুই এত খবর যখন জানিস তো বল দেখিনি তোর বস কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে?”
“আমার বস একজন সিংহ হৃদয় একজন মানুষ মেজ বৌদি। মাথা কাজ করে কম। হৃদয় কাজ করে বেশী। তাই লাইনে থাকতে পারেন না। বখে যাওয়া ধনীর দুলাল, যাকে তুমি আবার লাইনে ফিরিয়ে এনেছ।”
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বিন্দু এই বিদেশী মেয়েটার দিকে। তার চোখ কি কিছুই এড়ায় না?
চারটে গাড়ি। রোহিতের শেভ্রোলে, মনি শংকরের বিএমডব্লিউ, মঞ্জুর পোর্সে আর অঞ্জলীর বেন্টলী। শেভ্রোলেটা অমিত নিজে ড্রাইভ করে, অঞ্জলীও বেন্টলী নিজে ড্রাইভ করে। মনি শংকর আর মঞ্জুর গাড়ী চালায় ড্রাইভার। সকলে মিলে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল অমিত শেভ্রোলে নিয়ে মাঝখানে থাকবে। তার সাথে থাকবে বন্যা। সামনে মনি শংকর। পিছনে মঞ্জু আর রোহিত। আর সবার পিছনে থাকবে অঞ্জলী। হাসপাতালের সকল ফরমালিটিজ শেষ হবার পর কিছু রয়ে গেছে কিনা সেটা দেখার জন্য অঞ্জলী ফিরে গেল অমিতের কেবিনে। ভিতরে ঢুকে মনি শংকরকে মেসেজ দিল, “দাদা, কাউকে বুঝতে না দিয়ে অমিতের কেবিনে একবার আস। এক্ষুণি।”
অঞ্জলীর দুঃসাহস দেখে মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল মনি শংকরের। তার পরও চুপ থাকলো। খুব ক্যাজুয়াল ভংগীতে অমিতের কেবিনে ঢুকলো। ঠোটে আংগুল রেখে অঞ্জলী মনি শংকরকে কথা বলতে নিষেধ করলো। তার পর নোট প্যাড নিয়ে দ্রুত লিখলো, “দাদা অতীতের কথা ভুলে যাও। অমিতকে ভালবাস তাই বলছি। কাল রাতেও অমিতের উপর অ্যাটেম্পট হয়েছে। আমার ধারণা আবারও হবে এবং সেটা পথে হবার সম্ভাবনাই বেশী। আগের পরিকল্পনা বাদ দাও। শেষ মূহুর্তে অমিতকে নিয়ে তুমি আলাদা গাড়ীতে উঠ।”
শত্রু-মিত্র যাই হোক অঞ্জলীর বুদ্ধির উপর তার আস্থা আছে। আর যেহেতু মনি শংকর নিজে সাথে থাকবে কাজেই অঞ্জলীর পরিকল্পনা মেনে নিল। গাড়ি ছাড়ার একদম শেষ মূহুর্তে পুলিশ জীপ নিয়ে সুব্রত এসে হাজির হলো। নিজেই ড্রাইভ করছে। স্টার্ট বন্ধ না করেই মনি শংকর আর অমিতকে বললো, “উঠে পড়ুন, কুইক।” কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই সাঁ করে বেরিয়ে গেল সুব্রত। পিছন পিছন গেল মনি শংকরের গাড়ি। ড্রাইভার একাই আছে সেটায় । তারপর মঞ্জু আর রোহিত তাদের পোর্সেতে।এবং সবশেষে অঞ্জলীর সাথে বন্যা। শেভ্রোলেটা পরে রইল হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সকলেই খুব দ্রুত সুব্রতকে ফলো করছে। তারা এক কিলোমিটারমত গিয়েছে কি যায়নি, বিকট শব্দে হাসপাতালের সামনে বিস্ফোরিত হলো রোহিতের শেভ্রোলে। টাইম বোমা ছিল গাড়িতে।
দশ মিনিটের মধ্যে মনি শংকরের বাড়ির সামনে পৌছে গেল গাড়ির বহর। লাফ দিয়ে নামলো অমিত আর মনি শংকর। অন্য গাড়ি গুলি থেকে প্যাসেঞ্জাররা এখনও নামা শুরু করেনি সুব্রত রওয়ানা দিল হাসপাতালের পথে। বিস্ফোরণের শব্দ তাদের কানে যায় নি। তবে ওয়াকি টকিতে কোডেড মেসেজ পেয়েছে সুব্রত। হাসপাতালের সামনে পৌছে দেখল বিরাট জটলা। প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা ক্যামেরা হাতে ব্যস্ত। সে নামতেই সবগুলি ক্যামেরা ঘুরে গেল তার দিকে। হরবর করে প্রশ্ন করছে সবাই। “শেষ মূহুর্তে আপনি ড. অমিতাভ রায় চৌধুরীকে লিফট দিয়েছেন। আপনি কি আগে থেকেই জানতেন এরকম কিছু ঘটবে।” সুব্রত জবাব দিল না। দুজন কনস্টেবল আর একজন হাবিলদার ছিল সেখানে। তাদের কাছ থেকে জানলো কেউ হতাহত হয়নি। আশেপাশের দুএকটা দোকানপাটের কাচঁ ভেংগে গেছে। আর গাড়িটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। অনুসন্ধানী চোখে জায়গাটা জরীপ করছে সুব্রত। কোন আলামত পাওয়া যায় কি না। হঠাত করেই তার হাতের রুমালটা পড়ে গেল। কেউ লক্ষ্য করলো না রুমাল তুলার সময় এর সাথে একটা ফেঠে যাওয়া পিতলের টুকরাও ঢুকে গেল সুব্রতর পকেটে।
আবারও ছেকে ধরলো সংবাদকর্মীরা। সুব্রত শুধু বললো,” আমি কিছু জানতাম না বা অনুমান করিনি। রুটিন পেট্রোলে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভিভিআইপি লোকদের গাড়ি বহর দেখে ইনস্টান্টলী লিফট দেবার প্রস্তাব দেই। তারাও রাজী হন। থ্যাংক গড। একটা দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেল।” নমস্কার জানিয়ে গাড়িতে উঠে গেল সুব্রত। আসলে তাকে ফোন করে ডেকে এনেছিল অঞ্জলী। গোপনীয়তার জন্য কারো সাথে কিছু শেয়ার করেনি।
পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিল বিন্দু্। পাশে ম্যাগী। মনি শংকর অমিতকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। মঞ্জু আর রোহিত নামতেই এগিয়ে এল বিন্দু। অনেক অনেক দিন পর তারা এল মনি শংকরের বাড়িতে। অঞ্জলী নামলো না। বন্যাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। রোহিত আর মঞ্জুকে ম্যাগীর হাতে ছেড়ে দিয়ে ফিরতেই দেখল অঞ্জলী চলে যাচ্ছে। হায় হায় করে উঠলো বিন্দু। কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গেছে। অঞ্জলী চলে গেছে মেইন গেইটের কাছে।
সে ঝাড়ি দিল বন্যাকে,”মাসিমনিকে নামতে বললে না কেন?”
“বলেছি তো, তার নাকি অনেক কাজ পড়ে আছে।”
“কাজ না ছাই, আমাদের বাড়িতে নামবে না তাই।”
“তুমি নিশ্চই দাওয়াত করনি?”
“আমি না করলেই বা, তুই করতে পারিসনি?”
“তোমার বাড়িতে আমার মাসিমনিকে আমি কেন দাওয়াত করবো”
খপ করে বন্যার মাথার পিছনে চুলের গোছা মুঠি করে ধরলো বিন্দু। ঝাকুনি দিতে দিতে বললো, “এটা কার বাড়ি বল?”
“ভুল হয়ে গেছে ছোট মা, এটা আমার বাড়ি, এবার ছাড়ো লাগছে।”
“ফের যদি ভুল হয় একটা চুলও রাখবো না তোর মাথায়” বলেই টেনে একদম বুকের কাছে নিয়ে গেল বন্যাকে। তারপর নাকে নাক ঘষে, গাল টিপে আদর করে দিল।
বন্যা ছাড়া এ প্রজন্মের আর কেউ নেই রায় পরিবারে। তাই আঠার পার করেও বন্যা শিশুই রয়ে গেছে সবার কাছে। যৌক্তিক আর অযৌক্তিক নেই, বন্যার চাওয়া, আব্দার আর মতামতই ফাইনাল। তবে মেয়েটা বড় শার্প আর রেশনেল। বড় লোকের আদুরে মেয়ের কোন বৈশিষ্ট্য তার মাঝে নেই। বরং খুবই রেসপনসিবল আর কেয়ারিং। তবে মেজাজী আর ডানপিটে। ছোট বেলার অমিতের সকল বৈশিষ্ট্য তার মাঝে আছে। পড়া শুনায় ভাল। ক্লাসিক্যাল আর মডার্ন দু ধরনের নাচেই তালিম নিয়েছে মায়ের কাছে। বিন্দুর কাছে গান আর অঞ্জলীর কাছে মার্শাল আর্ট। পড়াশুনার চাপে নাচ আর গান বেশী দূর আগায়নি। তবে মার্শাল আর্টের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। মঞ্জুর বার বার বারণ সত্বেও এটা সে চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে গ্রীন বেল্ট পেয়েছে। আর এক ধাপ গেলেই অঞ্জলীর সমান হয়ে যাবে। ভাল ব্যাডমিন্টন আর টেবিল টেনিস খেলে। ছোট মার আদর খেয়ে বন্যা সোজা চলে গেল বসার ঘরে।
বসার ঘরে রোহিত আর মঞ্জু রয়েছে। বন্যা এসে বসলো দুজনের মাঝখানে। রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে টিভির সুইচ অন করলো। সাথে সাথেই লাফ দিয়ে খবরটা চোখে ঠেকল।
ব্রেকিং নিউজ। সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে পার্ক করে রাখা একটি গাড়ি বিস্ফোরিত। এ গাড়িতে ড. অমিতাভ রায় চৌধুরীর যাবার কথা ছিল। শেষ মূহুর্তে পুলিশ তাকে এসকর্ট করে বাসায় পৌছে দিয়েছে। অল্পের জন্য বেচে গেছেন তিনি। আজই মাঝ রাতের দিকে এ হাসপাতালের একজন ডাক্তার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল ধারণা করছে। ড. রায় একজন আন্তর্জাতিক জ্বালানী বিশেষজ্ঞ। কিছু দিন আগেই তার উপর আততায়ী হামলা হয়েছে। আশংকা করা হচেছ কোন আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র দেশের এ কৃতি সন্তানের জীবননাশ করতে চাইছে। তার যথাযথ নিরাপত্তা বিধান করা হয়নি বলে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি যথাযথ তদন্ত হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
রোহিত, মঞ্জু, বন্যা প্রত্যেকের চোখ আটকে আছে টিভির পর্দায়। কেউ কোন কথা বলছে না। চোখের পলক ফেলছে না। দম আটকে আছে তিন জনেরই। খবর শেষ হতে প্রথম দম ফেললো রোহিত। কিন্তু কোন কথা বললো না। মঞ্জু বললো, “রক্ষে কর ভগবান, হচ্ছে কি এসব?” স্বামীর দিকে তাকিয়ে অনুযোগ করলো। যেন রোহিত সব কিছু জানে। সবচে কঠিন প্রতিক্রিয়া হলো বন্যার মাঝে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার পর উর্দ্ধমূখে দৌড় দিল অমিতের ঘরের দিকে। এক ঝটকায় দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো।মনি শংকর আর অমিত দুজনেই ছিল ঘরে। “ছোট বাবা” বলে চীতকার করে ঝাপ দিল মনি শংকরের বুকে।
“হোয়াট হ্যাপেন বেবী! এনিথিং রঙ?”
মনি শংকরের বুক থেকে মূখ না তুলেই অমিতের দিকে আংগুল তুললো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। সব কথা তার মূখের কাছে এসে আটকে যাচ্ছে। অমিত এটাকে তার স্বাভাবিক প্রগলভতা হিসাবেই ধরে নিল। কিন্তু মনি শংকর জানে বন্যা এখন অনেক ম্যাচিওরড। নিশ্চই সিরিয়াস কিছু।
অনেক কসরতের পর মূল কথাটা জানা গেল। ততক্ষণে বিন্দু, ম্যাগী, রোহিত, মঞ্জু সবাই এ ঘরে এসে হাজির। অমিত সবাইকে শান্ত হতে বললো। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বিন্দুকে বললো, “মেজ বৌদি তোমার লাঞ্চ কতদূর বল। আমি খুব ক্ষুধার্ত।”
তার পর মঞ্জুর দিকে ফিরে আবার বললো, “বড় বৌদি, মূখটাকে এমন আমসি করে রেখেছ কেন? যা হবার হয়েছে। আমি এখনো বেঁচে আছি দ্যাটস অল। এসো, আমাকে শাওয়ার নিতে হেল্প করবে।”
বন্যা আর রোহিত ফিরে গেল বসার ঘরে। অমিতকে নিয়ে মঞ্জু গেল ওয়াশ রুমে। বিন্দু কিচেনে। মনি শংকর ম্যাগীকে ডেকে নিয়ে গেল বাইরের লনে। “আমার হয়ে ইনস্পেক্টর সুব্রতকে থ্যাংকস জানাও। বল রায় পরিবার তার বিষয়টা মনে রাখবে।”
সে নিজে রিং করলো অঞ্জলীর নাম্বারে। অঞ্জলী রিসিভ করতেই মনি শংকর বললো, “তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। দুপুরে আমাদের সাথে লাঞ্চ করলে খুশী হবো।”
“কিন্তু দাদা” অঞ্জলীর কন্ঠে দ্বিধা। কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল।
“কোন কিন্তু নয়, আমি নিজে তোমাকে নিতে আসবো। তৈরী থেকো।” লাইন কেটে দিল মনি শংকর।
অমিতের স্নান শেষ হয়েছে। ওয়াশ রুমে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে অমিতকে বসিয়ে হালকা গরম জলে স্নান করিয়েছে মঞ্জু। এ কাজটা ছোটবেলায় ঠাকুরমা করতেন। বড় বৌদি যখন তার পিঠ রগড়ে চুলে শ্যাম্পু করছিল তখন সেই ছোটবেলার মতই অমিত চেচামেচী করছিল চোখে শ্যাম্পু গিয়েছে বলে।
“চেচিও না ঠাকুরপো, বন্যা বড় হয়েছে। বুঝতে পারলে প্রেস্টিজ পাংচার।”
পিঠে সাবান ডলতে ডলতে মঞ্জু আবার শুরু করলো, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তেমার মনে আছে ঠাকুরমা যখন তোমাকে স্নান করাতেন, তুমি প্রতিবার আমার সফট শ্যাম্পুটা চাইতে।”
অমিত কথা বললো না, শুধু উপরে নীচে মাথা দোলালো।
“এবার বিয়ে থা করে থিতু হও ঠাকুরপো। বন্যাটা কোলে পিঠে ওঠার বয়স পেরিযেছে। তোমাদের ছেলেপিলে হলে একটু যদি সময় কাটে।” বড়বৌদি জল ঢালা শেষ করলেন। তারপর বড় টাওয়েল হাতে দিয়ে বললেন, “এর পরের অংশে আর আমি থাকতে পারছি না।”
অমিত এবারও কথা বললো না, শুধু উপরে নীচে মাথা দোলালো। কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে সে কাঁদছে। চোখে শ্যাম্পু যাওয়ায় সুবিধা হলো, তার চোখের জল বড়বৌদি দেখতে পেল না।
বসার ঘরে রোহিতকে সংগ দিচ্ছিল মনি শংকর। বড় বৌদি আর অমিত এসে যোগদিল তাদের সাথে। বন্যাও এল। সে মোটামুটি স্বাভাবিক হয়েছে। সবাই আসার পর বেরিয়ে পড়লো মনি শংকর। ড্রাভারকে গাড়ি বের করতে বললো। কিন্তু সাথে নিল না। অঞ্জলীকে আনতে গেল নিজে ড্রাইভ করে।
মনি শংকর গাড়ি নিয়ে একদম মূল বাড়ির ভিতর বারান্দার সামনে চলে এল। অঞ্জলী তৈরী ছিল। মনি শংকর পৌছাতে সে শুধু বললো, “দাদা, একটুখানি নামবে?” মনি শংকর নামলো। অঞ্জলী উবু হয়ে প্রণাম করলো তাকে। সোজা হয়ে বললো, “অমিত বড় ভাগ্যবান তোমার মত একটা দাদা আছে তার।”
“তুমিও ভাগ্যবতী, আমি তোমারও দাদা। এবার গাড়িতে ওঠ।” ব্রেক রিলিজ করতে করতে একটা টিস্যু এগিয়ে দিল মনি শংকর অঞ্জলীর দিকে। অঞ্জলীর চোখে জল মনি শংকরের চোখ এড়ায়নি।
হায়রে জগত। কত দ্রুতই না মানুষের সম্পর্ক বদলায়!!
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!