14-09-2020, 05:56 PM
২৩ পর্ব
মনি শংকর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো বিন্দু একভাবেই আছে। সেও বিন্দুকে নাড়ালো না। শুধু মাথার কাছে বসে তার মাথাটা তুলে নিল নিজের উরুর উপর। বিন্দু দুই হাতে মনি শংকরের দুই হাত চেপে ধরে রাখলো। কেউ কোন কথা বললো না। শুধু হাতের চাপ বাড়া আর কমার মধ্য দিয়ে তাদের হৃদয়ের সব কথা বলা হয়ে গেল। বিন্দু ভুলে গেল সব অভিমান। নতুন মনি শংকরের জন্ম হলো আজ সকালে।
এটাই মা দুর্গার কৃপা যে বাঙ্গালী ঘরের বউ সময়ে মা দূর্গার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠে।
আগামীকাল অমিতকে রিলিজ করা হবে। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সর্বশেষ এক্স-রে তে দেখা গেছে ভাংগা হাড়গুলি সব জোড়া লাগতে শুরু করেছে। শরীরের কোথাও কোন ব্যথা বা ইনফেকশান নেই। বাম হাতের মুভমেন্ট একদম সাবলীল। অমিতের ডাক্তার লোকটা সবসময়ই রসিক। তিনি দেখে টেখে অমিতকে পাঞ্জা দেখিয়ে বললেন, “কি মিঃ চৌধুরী হবে নাকি এক রাউন্ড?” অমিত হাসলো । সেরে উঠায় তারও ভাল লাগছে। তবে বেশ দূর্বল।
অমিত কোথায় উঠবে সেটা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। বন্যা চাইছে ছোট কাকু তাদের বাসায় উঠবে। মনি শংকর তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইছে। এ প্রস্তাব দুটি প্রকাশ পেয়েছে। ম্যাগীর গোপন ইচ্ছা অমিত হোটেলেই ফিরে আসুক। আর অঞ্জলী চায় অমিত তাদের পুরনো বাড়িতে ফিরে যাক। বাড়িটাকে আশ্রমের জন্য দান করা হলেও মূল বসতবাড়িটা মালিকদের বসবাসের জন্যই রাখা আছে। যদিও পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির আদলে তৈরী এ বাড়িতে মালিকদের কেউ আর থাকে না। নিরাপত্তার জন্য এটা বেশ উপযোগী। তাই অমিতেরও ইচ্ছা সে সেখানেই উঠবে। কিন্তু হোটেলে উঠা বা পুরনো বাড়িতে এ বিষয় দুটি এখনও মনে মনে রয়ে গেছে।
অমিতের কেবিনের পাশেই নার্সেস স্টেশন। রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত অঞ্জলীর ডিউটি। তবে সে সন্ধ্যে ছটা নাগাদ চলে আসে । আবার ডিউটি শেষ করে ফিরতে ফিরতে সকাল আটটা মত বেজে যায়। কাজে ভাল। কথা বলে কম। দায়িত্বশীল। তার মূল কাজ হলো নার্সদের ডিউটি সমন্বয়। কাজটা সে ভালমতই করছে। তাকে সারাক্ষণ নার্সেস স্টেশনে পাওয়া যায়। এক মিনিটের জন্য ফাকি দেয় না। ফলে কয়েকদিনের মাঝেই সকল ডাক্তারের কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হয়ে গেল। অঞ্জলীও সারাক্ষন অমিতকে চোখে চোখে রাখতে পেরে খুশী। তবে সে অমিতের কেবিনে ঢুকে না।
গত কদিন ধরে হাসপাতালে রোগীদের চাপ তেমন একটা নেই। নার্সেস স্টেশনে বসে অঞ্জলী চেয়ারে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে ঠাকুরমার চিঠিটা বিশ্লেষণ করছিল। তার মাথাটা একদম অমিতের মাথার পাশে। মাঝখানে কেবল একটা হার্ডবোর্ড পার্টিশান। তবে অমিত সেটা জানে না। অমিত জানে অঞ্জলী তার আশে পাশেই কোথাও আছে। কিন্তু এতটা কাছে তার সে ভাবেনি। যাই হোক অঞ্জলী চিঠিটার তেমন কোন হদীস বের করতে পারলো না। তার ধারণা খুব সহজ কোন একটা সংকেত লুকিয়ে আছে এখানে অথচ সহজে চোখে পড়ছে না।
কিছুক্ষণ মাথা ঘামিয়ে বিরক্ত হয়ে তার মনে হল, অমিতকে পার্টিশানের এপাশ থেকে একটা কিস করলে কেমন হয়? তাকিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। সে চকাস শব্দ করে পার্টিশানের গায়ে কিস করলো। অমিত কি টের পেল সেটা? না। কিস করলাম, অথচ যাকে করলাম সে জানতে পারলো না। বাহ্* বেশ মজার তো। কিছু একটা মাথায় আসতে চাইছে অঞ্জলীর। কিন্তু আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিস। KISS. নানা ভাবে উচ্চারণ করছে আর ভাবছে। হঠাত করেই সূত্রটা পেয়ে গেল অঞ্জলী। ইলেভেন নাইন নাইনটিন স্কোয়ার। হা হা হা হা। পেন্সিল আর নোট প্যাড নিয়ে বসে গেল সে। দ্রুত হিসাব কষছে।
নাইট গ্লাসটা চোখ থেকে নামিয়েই প্রতাপ হাজরা হাসপাতালে তার লোককে ফোন দিল। “এই শালা গর্দভ আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? আগামীকাল রিলিজ হয়ে গেলে তখন তো তুই তার টিকির সন্ধানও পাবি না।”
“দেখুন আপনার সব কথা আমি মানছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থাও আপনাকে দেখতে হবে। সব সময় কেউ না কেউ কেবিনে আছে। ব্যাটা নিজেও এখন বেশ সজাগ। সবচে বড় কথা এখানে দুটো টিকটিকি রয়েছে।”
“শাট আপ। বড় বাবুর সাথে কথা হয়েছে। কোন টিকটিকি ফিকি থাকবে না।”
“আছে। দুজন। একজন প্যাশেন্ট আর একজন এটেনডেন্ট।”
“শালাতো জ্বালিয়ে মারলো দেখছি। আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওদের সরাবার ব্যবস্থা করছি। এর পর যেন আবার অন্যকোন অজুহাত তুলো না। তাহলে তোমার সব গুমোড় আমি পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেব।”
চুপসে গেলেন ডাক্তার অমলেশ মূখার্জী। জীবনে একটাই পাপ করেছিলেন তিনি। আর সেটা ছিল এই প্রতাপ হাজরার পাতা ফাঁদ। সেই ফাঁদ থেকে এখন আর বেরোতে পারছেন না। এক তরুণীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক হয়েছিল তার। সে সূত্রে প্রেগনেন্ট হয়ে যায় মেয়েটি। পরে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অ্যাবরশন করানো হয়। আসলে মেয়েটা ছিল প্রতাপ হাজরার রোপন করা এজেন্ট। তাদের সকল অপকর্ম গোপন ভিডিওতে ধারণ করা আছে প্রতাপ হাজরার কাছে। এটাই তার অপরাধ ব্যবসার পুঁজি। ব্ল্যাক মেইলিং। হাজারো মানুষকে ফাঁসিয়ে রেখছে সে। যখন যাকে প্রয়োজন তাকেই ব্যবহার করে। যেমন আজ করছে হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার অমলেশ মুখার্জীকে।
অমিতের কেবিনে ঢুকার আগে এর সামনে দিয়ে একবার হেটে গেলেন তিনি। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। নার্সেস স্টেশনে নতুন নার্সটাকে দেখা যাচ্ছে নোট বুকে কি যেন লিখছে। ঘরের ভিতর অ্যা্টেনডেন্ট মেয়েটা আছে। সে কোন সমস্যা নয়। তিনি রাউন্ডের নাম করে এ কেবিন ও কেবিনে একবার করে ঢু মারলেন। তারপর সন্তর্পনে ঢুকে পড়লেন অমিতের কেবিনে।
অমিত ঘুমাচ্ছে। পাশের রুমে বন্যাও ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ ম্যাগী আসেনি। বিন্দু, মঞ্জু দুজনই আসতে চেয়েছিল, বন্যা ভাগিয়ে দিয়েছে। অমিতের কেবিনে ঢুকে দ্বিধায় পড়ে গেলেন ডাক্তার অমলেশ মূখার্জী। তিনি জীবন দেন জীবন হরন করেন না। একজন ঘুমন্ত মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার মত নীচ মানসিকতা তিনি অর্জন করতে পারেননি। তার বিবেক তাকে আটকে রাখছে। অ্যাপ্রনের পকেটে সিরিঞ্জটা আছে। খালি সিরিঞ্জ। সুইটা শরীরে ফুটিয়ে জাস্ট প্লাঞ্জারটা পুশ করে দিলেই হবে। ঘুমের মাঝেই মারা যাবে মারা যাবে অমিত। হার্ট অ্যাটাকে। খুন বলে প্রমাণ করতে পারবে না কেউই। তিনি যদি ব্যর্থ হন প্রতাপ হাজরা তার ভিডিও প্রকাশ করে দেবে। তার সংসার ভেংগে যাবে। মেয়েটার বিয়ে হবে না। ;., আর অ্যাবরশনের দায়ে জেল হবে তার। যাবজ্জীবনও হতে পারে। আহ! আর ভাবতে পারছেন না তিনি। পকেটে হাত দিয়ে সিরিঞ্জটা স্পর্শ করলেন।
রাত বারটার পর ইমারজেন্সী কল ছাড়া কোন ডাক্তার কেবিন রাউন্ড দেয় না। ডাক্তার অমলেশ মুখার্জীকে রাউন্ডে বেরোতে দেখে অঞ্জলীর ধারণা হলো কোথাও কোন ইমারজেন্সী দেখা দিয়েছে। কিন্তু যে দুটি কেবিনে তিনি ঢুকলেন সেখানে কোন ইমারজেন্সী রোগী নেই। তার মনে খটকা লাগলো। সে নোট প্যাডে লেখার ভান করে চোখের কোণে ডঃ মূখার্জীকে ধরে রাখলো। যখন ইতি উতি তাকিয়ে ডাক্তার বাবু অমিতের কেবিনে ঢুকলেন তখনই অঞ্জলী উঠে দাড়ালো। দ্রুত দরজার সামনে এসে দেখল ডাক্তার বাবু অমিতের বিছানার পাশে দাড়িয়ে ইতস্ত করছেন।অমিত ইমারজেন্সী কোন রোগী নয়। তার কেবিন থেকে কলও করা হয়নি। রুটিন ডিউটিও নয়। নিশ্চই কোন বদ মতলব আছে। অঞ্জলী তার পিছনে দরজার আড়ালে ঠাই দাড়িয়ে রইল। ডাক্তার বাবু টেরই পেলেন না। অনেকক্ষণ ইতস্ত করে তিনি যখন খালিক সিরিঞ্জটা বের করলেন তখন অঞ্জলী তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলো। সিনেমায় এরকমটি দেখেছে সে।
মূহুর্তেই সে তার করণীয় ঠিক করে ফেলল। ডাক্তার বাবু সিরিঞ্জটা পুশ করতে যাবেন এমন সময় পিছন থেকে তার কব্জি চেপে ধরলো অঞ্জলী। পিস্তলটা ঠেকালো একদম ঘাড়ের মাঝখানে। ঘাড়ে পিস্তলের ছোয়া আর কব্জিতে অঞ্জলীর হাত পড়তেই জমে ফ্রিজ হয়ে গেলেন ডাক্তার বাবু। অঞ্জলী কোন শব্দ না করে চোখের ইশারায় বের হতে বললো। ডাক্তার সোজা হতেই সিরিঞ্জসহ হাতটা ঠেলে আবার অ্যাপ্রনের ভিতর ঢুকিয়ে দিল অঞ্জলী। পিস্তলটা মুঠি করে নিজের অ্যাপ্রনের পকেটে রাখলো। আংগুলটা ছুইয়ে রইল ট্রিগার। ডাক্তারের একদম বগলদাবা হয়ে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। গভীর রাতে ডিউটিরত ডাক্তার-নার্স রোমান্স কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। দুজন স্বাভাবিক ভাবে হেটে চলে এল অমলেশ মূখার্জীর চেম্বারে।
চেম্বারে ঢুকে দরজা লক করলো অঞ্জলী। তারপর খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “কেন ডক্টর?” অমলেশ মূখার্জী মূখ খুললো। ভয়ে কাপতে কাপতে বলল সব কিছু। অঞ্জলীর মায়া হলো না। এধরনের মেরুদন্ডহীন কেচো টাইপ লোক বেঁচে থাকলে সমাজে আরও অসংখ্য অমিতকে জীবন দিতে হবে। অঞ্জলী তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। তারপর রেকর্ডার অন করে এতক্ষণ ডাক্তার বাবু যা বললেন তা প্লে করে শুনালো। ডাক্তারের ছুচোর মত মূখটা আরও লম্বাটে হয়ে গেল। খুব আস্তে কিন্তু কঠিন কন্ঠে বললো অঞ্জলী, “আপনার বেঁচে থাকাটা আরও কষ্টদায়ক হয়ে গেল ডক্টর। রেকর্ডটা পুলিশের হাতে চলে যাবে।” পিছন ফিরে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অঞ্জলী। তাকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে বা বেরুতে কেউ দেখেনি।
সকাল বেলা হাসপাতাল জুড়ে হৈ চৈ শুনা গেল। ধড়মড় করে উঠলো বন্যা। “কি হয়েছে রে মা?” অমিত জানতে চাইল। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে বন্যা জানালো, “এক ডাক্তার বাবু কাল রাতে তার চেম্বারে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।”
“শীট!” গর্জে উঠলো প্রতাপ হাজরা। ডাক্তার অমলেশ মুখার্জীর মৃত্যুর খবর বেরিযেছে পত্রিকায়। সেটা দেখেই তার রাগ। রাত থেকেই গজরাচ্ছিল সে। কাজ শেষ করে ফোন করার কথা ছিল। কিন্তু ডাক্তারের কোন ফোন পায়নি। সর্ব শেষ তাকে অমিতের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে আসতে দেখা গেছে। সাথে এক সুন্দরী নার্স।
“শালা বুড়ো বয়সে মৌজ করতে গিয়ে মরেছে নিশ্চই।” সে সিদ্ধানেইত এল। অমিত লোকটাতো অসম্ভব ভোগাচ্ছে। এ ব্যাটার জন্য তার প্রেস্টিজ পাংচার হবার যোগাড়। এবার যা করার সে নিজেই করবে।
অঞ্জলী খুব শান্তভাবে নিল ডাক্তারের মৃত্যু সংবাদটাকে। মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিল ডাক্তারের কথাবার্তা। অন্য সকলের সাথে মিলে দুঃখ প্রকাশ করলো। তার পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানালো। মনে মনে গেথে রাখলো অমলেশ বাবুর মেয়ের বিয়ে আর ছেলের পড়াশুনার বিষয়টা দেখতে হবে।
খুব দ্রুত একটা ছুটির দরখাস্ত লিখলো অঞ্জলী। জরূরী প্রয়োজনে গ্রামে যেতে হবে এরকম কারণ দেখিয়ে। তার পর সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ফিরে এল ঘন্টা দুই পরে তার স্বাভাবিক গেট আপ এ। অমিত রিলিজ হবে বেলা এগারটায়। ম্যাগী আর বিন্দু ছাড়া সবাই এসেছে। বিন্দু অমিতের জন্য ঘরদোর গোছগাছ করছে। তাকে সহযোগিতা করছে ম্যাগী।
মনি শংকর ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো বিন্দু একভাবেই আছে। সেও বিন্দুকে নাড়ালো না। শুধু মাথার কাছে বসে তার মাথাটা তুলে নিল নিজের উরুর উপর। বিন্দু দুই হাতে মনি শংকরের দুই হাত চেপে ধরে রাখলো। কেউ কোন কথা বললো না। শুধু হাতের চাপ বাড়া আর কমার মধ্য দিয়ে তাদের হৃদয়ের সব কথা বলা হয়ে গেল। বিন্দু ভুলে গেল সব অভিমান। নতুন মনি শংকরের জন্ম হলো আজ সকালে।
এটাই মা দুর্গার কৃপা যে বাঙ্গালী ঘরের বউ সময়ে মা দূর্গার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠে।
আগামীকাল অমিতকে রিলিজ করা হবে। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সর্বশেষ এক্স-রে তে দেখা গেছে ভাংগা হাড়গুলি সব জোড়া লাগতে শুরু করেছে। শরীরের কোথাও কোন ব্যথা বা ইনফেকশান নেই। বাম হাতের মুভমেন্ট একদম সাবলীল। অমিতের ডাক্তার লোকটা সবসময়ই রসিক। তিনি দেখে টেখে অমিতকে পাঞ্জা দেখিয়ে বললেন, “কি মিঃ চৌধুরী হবে নাকি এক রাউন্ড?” অমিত হাসলো । সেরে উঠায় তারও ভাল লাগছে। তবে বেশ দূর্বল।
অমিত কোথায় উঠবে সেটা এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। বন্যা চাইছে ছোট কাকু তাদের বাসায় উঠবে। মনি শংকর তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইছে। এ প্রস্তাব দুটি প্রকাশ পেয়েছে। ম্যাগীর গোপন ইচ্ছা অমিত হোটেলেই ফিরে আসুক। আর অঞ্জলী চায় অমিত তাদের পুরনো বাড়িতে ফিরে যাক। বাড়িটাকে আশ্রমের জন্য দান করা হলেও মূল বসতবাড়িটা মালিকদের বসবাসের জন্যই রাখা আছে। যদিও পুরনো আমলের জমিদার বাড়ির আদলে তৈরী এ বাড়িতে মালিকদের কেউ আর থাকে না। নিরাপত্তার জন্য এটা বেশ উপযোগী। তাই অমিতেরও ইচ্ছা সে সেখানেই উঠবে। কিন্তু হোটেলে উঠা বা পুরনো বাড়িতে এ বিষয় দুটি এখনও মনে মনে রয়ে গেছে।
অমিতের কেবিনের পাশেই নার্সেস স্টেশন। রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত অঞ্জলীর ডিউটি। তবে সে সন্ধ্যে ছটা নাগাদ চলে আসে । আবার ডিউটি শেষ করে ফিরতে ফিরতে সকাল আটটা মত বেজে যায়। কাজে ভাল। কথা বলে কম। দায়িত্বশীল। তার মূল কাজ হলো নার্সদের ডিউটি সমন্বয়। কাজটা সে ভালমতই করছে। তাকে সারাক্ষণ নার্সেস স্টেশনে পাওয়া যায়। এক মিনিটের জন্য ফাকি দেয় না। ফলে কয়েকদিনের মাঝেই সকল ডাক্তারের কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হয়ে গেল। অঞ্জলীও সারাক্ষন অমিতকে চোখে চোখে রাখতে পেরে খুশী। তবে সে অমিতের কেবিনে ঢুকে না।
গত কদিন ধরে হাসপাতালে রোগীদের চাপ তেমন একটা নেই। নার্সেস স্টেশনে বসে অঞ্জলী চেয়ারে হেলান দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে ঠাকুরমার চিঠিটা বিশ্লেষণ করছিল। তার মাথাটা একদম অমিতের মাথার পাশে। মাঝখানে কেবল একটা হার্ডবোর্ড পার্টিশান। তবে অমিত সেটা জানে না। অমিত জানে অঞ্জলী তার আশে পাশেই কোথাও আছে। কিন্তু এতটা কাছে তার সে ভাবেনি। যাই হোক অঞ্জলী চিঠিটার তেমন কোন হদীস বের করতে পারলো না। তার ধারণা খুব সহজ কোন একটা সংকেত লুকিয়ে আছে এখানে অথচ সহজে চোখে পড়ছে না।
কিছুক্ষণ মাথা ঘামিয়ে বিরক্ত হয়ে তার মনে হল, অমিতকে পার্টিশানের এপাশ থেকে একটা কিস করলে কেমন হয়? তাকিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। সে চকাস শব্দ করে পার্টিশানের গায়ে কিস করলো। অমিত কি টের পেল সেটা? না। কিস করলাম, অথচ যাকে করলাম সে জানতে পারলো না। বাহ্* বেশ মজার তো। কিছু একটা মাথায় আসতে চাইছে অঞ্জলীর। কিন্তু আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিস। KISS. নানা ভাবে উচ্চারণ করছে আর ভাবছে। হঠাত করেই সূত্রটা পেয়ে গেল অঞ্জলী। ইলেভেন নাইন নাইনটিন স্কোয়ার। হা হা হা হা। পেন্সিল আর নোট প্যাড নিয়ে বসে গেল সে। দ্রুত হিসাব কষছে।
নাইট গ্লাসটা চোখ থেকে নামিয়েই প্রতাপ হাজরা হাসপাতালে তার লোককে ফোন দিল। “এই শালা গর্দভ আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? আগামীকাল রিলিজ হয়ে গেলে তখন তো তুই তার টিকির সন্ধানও পাবি না।”
“দেখুন আপনার সব কথা আমি মানছি। কিন্তু বাস্তব অবস্থাও আপনাকে দেখতে হবে। সব সময় কেউ না কেউ কেবিনে আছে। ব্যাটা নিজেও এখন বেশ সজাগ। সবচে বড় কথা এখানে দুটো টিকটিকি রয়েছে।”
“শাট আপ। বড় বাবুর সাথে কথা হয়েছে। কোন টিকটিকি ফিকি থাকবে না।”
“আছে। দুজন। একজন প্যাশেন্ট আর একজন এটেনডেন্ট।”
“শালাতো জ্বালিয়ে মারলো দেখছি। আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওদের সরাবার ব্যবস্থা করছি। এর পর যেন আবার অন্যকোন অজুহাত তুলো না। তাহলে তোমার সব গুমোড় আমি পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেব।”
চুপসে গেলেন ডাক্তার অমলেশ মূখার্জী। জীবনে একটাই পাপ করেছিলেন তিনি। আর সেটা ছিল এই প্রতাপ হাজরার পাতা ফাঁদ। সেই ফাঁদ থেকে এখন আর বেরোতে পারছেন না। এক তরুণীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক হয়েছিল তার। সে সূত্রে প্রেগনেন্ট হয়ে যায় মেয়েটি। পরে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অ্যাবরশন করানো হয়। আসলে মেয়েটা ছিল প্রতাপ হাজরার রোপন করা এজেন্ট। তাদের সকল অপকর্ম গোপন ভিডিওতে ধারণ করা আছে প্রতাপ হাজরার কাছে। এটাই তার অপরাধ ব্যবসার পুঁজি। ব্ল্যাক মেইলিং। হাজারো মানুষকে ফাঁসিয়ে রেখছে সে। যখন যাকে প্রয়োজন তাকেই ব্যবহার করে। যেমন আজ করছে হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার অমলেশ মুখার্জীকে।
অমিতের কেবিনে ঢুকার আগে এর সামনে দিয়ে একবার হেটে গেলেন তিনি। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। নার্সেস স্টেশনে নতুন নার্সটাকে দেখা যাচ্ছে নোট বুকে কি যেন লিখছে। ঘরের ভিতর অ্যা্টেনডেন্ট মেয়েটা আছে। সে কোন সমস্যা নয়। তিনি রাউন্ডের নাম করে এ কেবিন ও কেবিনে একবার করে ঢু মারলেন। তারপর সন্তর্পনে ঢুকে পড়লেন অমিতের কেবিনে।
অমিত ঘুমাচ্ছে। পাশের রুমে বন্যাও ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ ম্যাগী আসেনি। বিন্দু, মঞ্জু দুজনই আসতে চেয়েছিল, বন্যা ভাগিয়ে দিয়েছে। অমিতের কেবিনে ঢুকে দ্বিধায় পড়ে গেলেন ডাক্তার অমলেশ মূখার্জী। তিনি জীবন দেন জীবন হরন করেন না। একজন ঘুমন্ত মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার মত নীচ মানসিকতা তিনি অর্জন করতে পারেননি। তার বিবেক তাকে আটকে রাখছে। অ্যাপ্রনের পকেটে সিরিঞ্জটা আছে। খালি সিরিঞ্জ। সুইটা শরীরে ফুটিয়ে জাস্ট প্লাঞ্জারটা পুশ করে দিলেই হবে। ঘুমের মাঝেই মারা যাবে মারা যাবে অমিত। হার্ট অ্যাটাকে। খুন বলে প্রমাণ করতে পারবে না কেউই। তিনি যদি ব্যর্থ হন প্রতাপ হাজরা তার ভিডিও প্রকাশ করে দেবে। তার সংসার ভেংগে যাবে। মেয়েটার বিয়ে হবে না। ;., আর অ্যাবরশনের দায়ে জেল হবে তার। যাবজ্জীবনও হতে পারে। আহ! আর ভাবতে পারছেন না তিনি। পকেটে হাত দিয়ে সিরিঞ্জটা স্পর্শ করলেন।
রাত বারটার পর ইমারজেন্সী কল ছাড়া কোন ডাক্তার কেবিন রাউন্ড দেয় না। ডাক্তার অমলেশ মুখার্জীকে রাউন্ডে বেরোতে দেখে অঞ্জলীর ধারণা হলো কোথাও কোন ইমারজেন্সী দেখা দিয়েছে। কিন্তু যে দুটি কেবিনে তিনি ঢুকলেন সেখানে কোন ইমারজেন্সী রোগী নেই। তার মনে খটকা লাগলো। সে নোট প্যাডে লেখার ভান করে চোখের কোণে ডঃ মূখার্জীকে ধরে রাখলো। যখন ইতি উতি তাকিয়ে ডাক্তার বাবু অমিতের কেবিনে ঢুকলেন তখনই অঞ্জলী উঠে দাড়ালো। দ্রুত দরজার সামনে এসে দেখল ডাক্তার বাবু অমিতের বিছানার পাশে দাড়িয়ে ইতস্ত করছেন।অমিত ইমারজেন্সী কোন রোগী নয়। তার কেবিন থেকে কলও করা হয়নি। রুটিন ডিউটিও নয়। নিশ্চই কোন বদ মতলব আছে। অঞ্জলী তার পিছনে দরজার আড়ালে ঠাই দাড়িয়ে রইল। ডাক্তার বাবু টেরই পেলেন না। অনেকক্ষণ ইতস্ত করে তিনি যখন খালিক সিরিঞ্জটা বের করলেন তখন অঞ্জলী তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলো। সিনেমায় এরকমটি দেখেছে সে।
মূহুর্তেই সে তার করণীয় ঠিক করে ফেলল। ডাক্তার বাবু সিরিঞ্জটা পুশ করতে যাবেন এমন সময় পিছন থেকে তার কব্জি চেপে ধরলো অঞ্জলী। পিস্তলটা ঠেকালো একদম ঘাড়ের মাঝখানে। ঘাড়ে পিস্তলের ছোয়া আর কব্জিতে অঞ্জলীর হাত পড়তেই জমে ফ্রিজ হয়ে গেলেন ডাক্তার বাবু। অঞ্জলী কোন শব্দ না করে চোখের ইশারায় বের হতে বললো। ডাক্তার সোজা হতেই সিরিঞ্জসহ হাতটা ঠেলে আবার অ্যাপ্রনের ভিতর ঢুকিয়ে দিল অঞ্জলী। পিস্তলটা মুঠি করে নিজের অ্যাপ্রনের পকেটে রাখলো। আংগুলটা ছুইয়ে রইল ট্রিগার। ডাক্তারের একদম বগলদাবা হয়ে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে। গভীর রাতে ডিউটিরত ডাক্তার-নার্স রোমান্স কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। দুজন স্বাভাবিক ভাবে হেটে চলে এল অমলেশ মূখার্জীর চেম্বারে।
চেম্বারে ঢুকে দরজা লক করলো অঞ্জলী। তারপর খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, “কেন ডক্টর?” অমলেশ মূখার্জী মূখ খুললো। ভয়ে কাপতে কাপতে বলল সব কিছু। অঞ্জলীর মায়া হলো না। এধরনের মেরুদন্ডহীন কেচো টাইপ লোক বেঁচে থাকলে সমাজে আরও অসংখ্য অমিতকে জীবন দিতে হবে। অঞ্জলী তার পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো। তারপর রেকর্ডার অন করে এতক্ষণ ডাক্তার বাবু যা বললেন তা প্লে করে শুনালো। ডাক্তারের ছুচোর মত মূখটা আরও লম্বাটে হয়ে গেল। খুব আস্তে কিন্তু কঠিন কন্ঠে বললো অঞ্জলী, “আপনার বেঁচে থাকাটা আরও কষ্টদায়ক হয়ে গেল ডক্টর। রেকর্ডটা পুলিশের হাতে চলে যাবে।” পিছন ফিরে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অঞ্জলী। তাকে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতে বা বেরুতে কেউ দেখেনি।
সকাল বেলা হাসপাতাল জুড়ে হৈ চৈ শুনা গেল। ধড়মড় করে উঠলো বন্যা। “কি হয়েছে রে মা?” অমিত জানতে চাইল। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে বন্যা জানালো, “এক ডাক্তার বাবু কাল রাতে তার চেম্বারে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।”
“শীট!” গর্জে উঠলো প্রতাপ হাজরা। ডাক্তার অমলেশ মুখার্জীর মৃত্যুর খবর বেরিযেছে পত্রিকায়। সেটা দেখেই তার রাগ। রাত থেকেই গজরাচ্ছিল সে। কাজ শেষ করে ফোন করার কথা ছিল। কিন্তু ডাক্তারের কোন ফোন পায়নি। সর্ব শেষ তাকে অমিতের কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে আসতে দেখা গেছে। সাথে এক সুন্দরী নার্স।
“শালা বুড়ো বয়সে মৌজ করতে গিয়ে মরেছে নিশ্চই।” সে সিদ্ধানেইত এল। অমিত লোকটাতো অসম্ভব ভোগাচ্ছে। এ ব্যাটার জন্য তার প্রেস্টিজ পাংচার হবার যোগাড়। এবার যা করার সে নিজেই করবে।
অঞ্জলী খুব শান্তভাবে নিল ডাক্তারের মৃত্যু সংবাদটাকে। মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিল ডাক্তারের কথাবার্তা। অন্য সকলের সাথে মিলে দুঃখ প্রকাশ করলো। তার পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানালো। মনে মনে গেথে রাখলো অমলেশ বাবুর মেয়ের বিয়ে আর ছেলের পড়াশুনার বিষয়টা দেখতে হবে।
খুব দ্রুত একটা ছুটির দরখাস্ত লিখলো অঞ্জলী। জরূরী প্রয়োজনে গ্রামে যেতে হবে এরকম কারণ দেখিয়ে। তার পর সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ফিরে এল ঘন্টা দুই পরে তার স্বাভাবিক গেট আপ এ। অমিত রিলিজ হবে বেলা এগারটায়। ম্যাগী আর বিন্দু ছাড়া সবাই এসেছে। বিন্দু অমিতের জন্য ঘরদোর গোছগাছ করছে। তাকে সহযোগিতা করছে ম্যাগী।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!