14-09-2020, 03:46 PM
(২১ পর্ব)
তিন দিন পর একটা জটিল অপারেশন হলো অমিতের। মাংসের ভিতর সেধিয়ে যাওয়া হাড়ের টুকরা গুলি বের করা হলো। অপারেশনে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তবে রেয়ার গ্রুপের এ নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন ছিল। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। অমিতের ভাগ্য ভাল মনি শংকর আর রামলাল দুজনের রক্তই এ নেগেটিভ। অপারেশনের সময় মনি শংকর হাসপাতালেই ছিল। সে সরাসরি রক্ত দিল। খবর পেয়ে ছুটে এল রামলাল। তার কাছ থেকেও রক্ত নেয়া হল। আশ্রমের ছেলে মেয়েরা লাইন ধরে এসে দাঁড়ালো হাসপাতালের সামনে। সকলেই রক্ত দিতে চায়। পরীক্ষা করে আঠার বছরের উর্দ্ধে এমন কয়েকজনকে চিহ্নিত করে রাখা হলো। যদি ভবিষ্যত দরকার হয়। ম্যাগী অভিভুত হয়ে গেল মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার এমন ধরণ দেখে। পশ্চিমা জগতে এমনটি কল্পনা করাও দুষ্কর।
চব্বিশ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো অমিতের। আইসিইউ থেকে ক্যাবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আজ ৭ দিন হলো বন্যা হাসপাতালে। কিছুতেই সে অমিতকে ছেড়ে যাবে না। বিন্দু, মঞ্জু মাঝে মাঝে আসে। রোহিত, মনি শংকরও খবর রাখে। ম্যাগী রাতে বন্যার সাথে থাকে। অঞ্জলী দিনের বেলা যথারীতি আশ্রমের কাজ করে। রাতে নার্সের ডিউটিতে হাসপাতালে থাকে। তবে সে কোন পার্টিকুলার প্যাশেন্টের ডিউটি করে না। বরং সব ক্যাবিনগুলিতে কার কি প্রয়োজন সেসব খোঁজখবর রাখে। মালিকের লোক হিসাবে একটা নাক উচু ভাব ধরে রেখেছে। এতে সুবিধা হলো ক্যাবিন গুলিতে যখন তখন ঢুকার পাশাপাশি অনাবশ্যক গল্পগুজবের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। তার ছদ্মবেশ বজায় রাখার জন্য এটা বেশ সহায়ক। অঞ্জলীর ধারণা একবার যখন হামলা হয়েছে, তখন আবারও হামলা হবে। আক্রমণটা কোন দিক দিয়ে আসে সেটা বুঝাই মুশকিল। সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। অমিতের ক্যাবিনে ঢুকার সময় সে সবসময় মূখে মাস্ক ব্যবহার করে। বলা তো যায় না, এতগুলি পরিচিত মানুষ, কেউনা কেউ চিনে ফেলতে পারে।
অপারেশনের পাঁচদিনের মাথায় অমিতের অবস্থা বেশ উন্নতির দিকে গেল। আগের ব্যান্ডেজ খুলে নতুন ড্রেসিং করা হয়েছে। ঘা টান ধরে এসেছে। ব্যাথাও কমে আসছে। তবে ভাংগা হাড় জোড়া নিতে কমপক্ষে ছয়মাস সময় লাগবে। ডাক্তার বলেছেন এত দিন অমিতকে হাসপাতালে থাকতে হবে না। ঘা শুকালেই তাকে রিলিজ করে দেয়া হবে। মঞ্জু এসে জোর করেই বন্যাকে নিয়ে গেল। অমিতই ফোন করে মঞ্জু বৌদিকে বলেছে বন্যাকে নিয়ে যাবার জন্য। ঠিক হলো বিন্দু আর ম্যাগী রাতে অমিতকে এটেন্ড করবে।
গত কিছুদিনে ম্যাগী রায় পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের সাথে পরিচিত হয়েছে। এখন সে আর শুধু অফিস স্টাফ নয়। পরিবারের একজনের মত হয়ে গেছে। যে তাকে সবচে অপছন্দ করতো সেই বিন্দুর সাথে তার সবচে বেশী ভাব হয়েছে। চমতকার বন্ধুত্ব হয়েছে বন্যার সাথেও।
বিকালে বন্যা চলে যাওয়ার পর অঞ্জলী ঢুকলো অমিতের ক্যাবিনে। এসময়ে ডাক্তার নার্স বা ভিজিটর কেউ আসবে না। ক্যাবিনে ঢুকেই ভিতর থেকে ছিটকিনী আটকালো। অমিত চোখ বন্ধ করে ছিল। খুট করে শব্দ হতেই চোখ মেলে তাকালো। অঞ্জলীর তখনও মূখ ঢাকা। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল বিছানার কাছে। মূখের কাপড় সরালো। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অমিতের দিকে। মিনিটখানেকের মাথায় অমিতের ঠোট দুটি কাপতে শুরু করলো। দীর্ঘ পনের বছরের দুঃখ কষ্ট অভিমান একসাথে উথলে উঠেছে। সবাইকে ফাকি দিতে পারলেও অমিতকে ফাকি দিতে পারলো না অঞ্জলী। জনম জনম ধরে যে দুটি চোখ বুকের ভিতরে লালন করে আছে অমিত সে চোখ চিনতে মুহুর্ত মাত্র দেরী হয়নি তার। এদিকে দাড়িয়ে থেকেই দু’চোখে বন্যা বয়ে গেল অঞ্জলীর। একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। কথা বলতে পারছে না। অমিত শুয়ে থেকেই ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। অঞ্জলীর ইচ্ছা হলো অমিতের বুকে ঝাপ দেয়। কিন্তু বড় খারাপ সময়ে তাদের দেখা হলো। অমিতের বাড়ানো হাতটা ধরে বিছানার কিনারায় বসলো অঞ্জলী। এক হাতে অমিতের হাতটা বুকের সাথে চেপে রাখলো, আরেকটা হাত মাথার উপর রেখে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো, “খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা?”
অমিত অঞ্জলীর কথার জবাব দিল না। শুধু বললো, “একি হাল হয়েছে তোমার? আমি না হয় অসুস্থ। কিন্তু তোমাকে এমন দেখছি কেন?”
আজ নিয়ে একুশ দিন অঞ্জলী এক মিনিটের জন্য দুচোখের পাতা এক করেনি। কিন্তু অমিতকে সে কথা বলা যাবে না। “তুমি সুস্থ হও সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
আর মাত্র দু তিনটে দিন কষ্ট করো সোনা। আম ঠিক তোমাকে নিয়ে যাব। আর আমি তোমার ক্যাবিনের পার্টিশনের ওপাশেই আছি। যে কোন প্রয়োজনে পার্টিশনে টোকা দিলেই আমি চলে আসবো।”
“একটা চিঠি পেয়েছি আমি। ঠাকুরমার লেখা। এর মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।”
অমিত চিঠির বিষয় বস্তু সবটা অঞ্জলীকে বললো। সব শুনে বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে রইল অঞ্জলী। তারপর বললো, “ভেবোনা আমি এর অর্থ উদ্ধার করতে পারবো।”
হাতটা ছেড়ে দিয়ে গভীর করে চুমু খেল অঞ্জলী অমিতের ঠোটে। নাকে নাক ঘষলো। অঞ্জলীর ভালবাসায় অপত্যের ভাগ থাকে বেশী। আর এটাই পাগল করে অমিতকে। “এবার যেতে হবে মানিক, আমি এখানে একজন নার্স মাত্র। কারো কাছে আমার পরিচয় প্রকাশ করো না।”
গত কিছুদিন থেকে বিন্দুর মনটা খুব ভাল। মনি শংকরের এধরণের পরিবর্তন তার জন্য খুবই আনন্দের। জেদী মেয়ে বিন্দু। মনি শংকর যখন থেকে পরনারীতে আসক্ত হয়েছে তখন থেকে সে মনি শংকরকে কাছে ঘেষতে দেয় না। ফুটন্ত যৌবন নিয়ে আলাদা বিছানায় ঘুমায়। মনি শংকর ড্রিংক করে অন্য মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে অনেক রাতে ঘরে ফিরে। বিন্দুর দিকে ফিরেও তাকায় না। অনেক কষ্টে দিনটা কেটে গেলেও বিন্দুর রাত যেন কিছুতেই কাটতো না। কিন্তু গত কিছু দিন যাবত মনি শংকরের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। মদ খাওয়া বেশ কমিয়ে দিয়েছে। রেসের মাঠে যাওয়াও কমেছে। সবচে বড় কথা গত দুই তিন সপ্তাহ কোন মেয়ের কাছে যায়নি মনি শংকর।
তার ধারণা ছিল ম্যাগী নামক বিদেশী মেয়েটা বুঝি তার নতুন রক্ষিতা। কিন্তু ম্যাগীর সাথে কথা বলে, সময় কাটিয়ে বিন্দুর ধারণা পরিবর্তন হয়েছে। ম্যাগীর ভাষ্য মতে বস কখনও তার দিকে খারাপ নজরে তাকায়নি। এ ধরণের পরিস্থিতির মূখোমূখি হতে পারে এটা ধরে নিয়েই সে কাজে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বসের মাঝে সেকরম কোন আগ্রহ লক্ষ্য করেনি। এমন কি দিন দুই তার সাথে রেসের মাঠেও গিয়েছে। সেখানেও কোন আনডিউ অ্যাডভান্টেজ নেবার চেষ্টা তার মাঝে ছিল না।
বিন্দু সবটা মিলাতে পারে না। এক সময় তার কাছে মনে হতো মনি শংকর প্রচন্ড স্বার্থপর একটা মানুষ। নিজের সুখ, আয়েশ আর তৃপ্তির বাইরে কোন কিছুই কেয়ার করে না। এখন সেটা পাল্টাতে শুরু করেছে। ছোট ঠাকুর পো হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে তার মাঝে অন্য রকম দায়িত্ববোধ তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে সেদিন যখন ছোট ঠাকুরপোকে মনি শংকর নিজের শরীরের রক্ত দিল তখন বিন্দুর কিযে ভাল লেগেছে তা বলে বুঝাতে পারবে না। স্বামীকে নিয়ে গর্বে অহংকারে তার বুকটা ভরে গেছে। কি অসম্ভব পৌরুষদীপ্ত মানুষ মনি শংকর! বড় লোকের সন্তান। অনেকের আভিজাত্য থাকে, তবে সেটা উপভোগ করতে পারে না। মনি শংকর পারে। সে যখন যেখানে যায় সেখানেই সে ফোকাসে থাকে। তার সামনে বাদবাকী সবাই ম্লান হয়ে যায়। এ হেন মনি শংকর যদি দুএকটা মেয়েছেলে নিয়ে আমোদ ফুর্তি করেই থাকে তো করুক না? উপমহাদেশের রাজা বাদশা নবাবদের হারেম তো মশহুর। বিন্দু মনি শংকরকে ক্ষমা করে দিল।
খুব ভোরে মন্দিরে গিয়ে পুজো দিল বিন্দু। সদ্য স্নান করেছে। লাল পেড়ে সাদা সূতী শাড়ী তার পরনে। পুজোর ডালায় ঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে মনি শংকর বিছানায় বসে আড়মোড়া ভাংছে। ছুটির দিনে একটু দেরীতে উঠে মনি শংকর। বিন্দুকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয় সে । এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। বিন্দুর খুব লজ্জা লাগে। আবার স্বামীর এ দৃষ্টিটা ভালও লাগে। হাতের ডালাটা একটা টেবিলের উপর রেখে মনি শংকরকে বলে,” একটু উঠে দাড়াবে?”
কি ছিল বিন্দুর গলায় কে জানে, মনি শংকর বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাড়ালো। গলায় আচল জড়িয়ে স্বামীকে আভুমি প্রণাম করলো। বিন্দুর মাথায় হাত রাখলো সে। তারপর দুই বাহুতে ধরে টেনে পাগলের মত জড়িয়ে ধরলো বুকে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো বিন্দু। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মনি শংকর। কিছুই বুঝতে পারছে না।
জগত সংসারে একটাই মানুষ আছে যাকে ঘাটায় না মনি শংকর। সে হলো বিন্দু। সে নিজে যেমন বেয়াড়া, বিন্দু তার চে হাজারগুণ বেয়াড়া। তার জিবের ধার ইস্পাতের ফলার চেয়েও বেশী। নিত্যদিন তাকে ফালা ফালা করে। আজ কি হলো এমন? মনি শংকর ভেবে পায় না। সে হাতের চেটো দিয়ে বিন্দুর অশ্রু মুছায়। তারপর আরও শক্ত করে জড়িয়ে রাকে বুকের মাঝে। বিন্দু ডালা থেকে পুজোর ফুল নিয়ে মনি শংকরের বুকে কপালে ছোয়ায়। তারপর প্রসাদ হাতে দিয়ে বলে, “খাও।”
“কি হয়েছেরে বউ?” অনেক বছর আগের আটপৌরে ভাষায় সম্বোধন করে মনি শংকর। দুজন বাসি বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে।
“কিছু হয় নি। তোমাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হল তাই।”
বিন্দুর চিবুকটা তুলে ধরে টুক করে চুমু খেল মনি শংকর তার ঠোটে। গভীর করে তাকালো তার চোখে। “তোমার কি হয়েছে গো?” বিন্দুর গলায়ও আটপৌরে আভাষ।
“কিছু হয় নি। তোমাকে চুমু খেতে ইচেছ হলো তাই।”
হেসে ফেললো বিন্দু। মনি শংকরের মাঝে আগের সেই হিউমর ফিরে আসছে। ভাবতেই ভাল লাগছে তার। বিন্দুর হাসি যেন বিদ্যুতের ঝলক। চোখ ফেরানো দায় হলো মনি শংকরের। বিন্দু হঠাত করেই মনি শংকরের সামনে হাটু গেড়ে বসলো। তারপর আচলটা সামনে বাড়িয়ে বললো, “মা দুর্গা আসছেন। তার আগে যদি তোমার কাছে কিছু চাই দেবে?”
মনি শংকর ধারণা করলো পুজোয় কোন দামী অলংকার বা অন্য কিছু হয়তো বিন্দু চাইবে। সে বিনা দ্বিধায় বললো, “তোমার দরিদ্র স্বামীর যা কিছু আছে সবটাই তোমার বিন্দু, বলো তুমি কি চাও।” বর দেবার ভংগীতে হাত উচু করলো মনি শংকর।
“আমি তোমাকে চাই, আমার স্বামী মনি শংকরকে চাই।”
বিন্দুর কথা সবটা কানে যায়নি মনি শংকরের। সে বললো, “তথাস্তু” বলার পর খেয়াল হলো বিন্দুর কথার মর্মার্থ। তারপর স্রেফ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে ।
বিন্দুর সেদিকে খেয়াল নেই। অসম্ভব খুশীতে ঝলমল করে উঠলো তার মূখ। মনি শংকরকে ঠেলে ওয়াশ রুমে পাঠালো সে। “ভিতরে সব কিছু দেয়া আছে। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।”
সময় নিয়ে গোসল সারলো মনি শংকর। এর মাঝে বেডরুমটাকে অন্য রকম করে ফেললো বিন্দু। উইন্ডো স্ক্রীন থেকে শুরু করে বেড শীট পর্যন্ত সব কিছু চেঞ্জ করেছে। ফ্লাওয়ারভাসে টাটকা রজনী গন্ধা। ঘরটা ম ম করছে। ল্যান্ড ফোনের কর্ড খুলে রাখলো। মোবাইলের সুইচ অফ করে দিল। দরজার ছিটকানী ভিতর থেকে আটকে দিল। সব গুলি পর্দা টেনে দিয়ে লুকানো লাইটগুলি জ্বেলে দিল। আলো দেখা যায়, এর উতস বুঝা যায় না। এসিটা এমনভাবে এডজাস্ট করা যে বুঝার উপায় নেই এসি চলছে। অথচ কোন গরম অনুভুত হচ্ছে না।খুব হালকা করে মিউজিক বাঁজছে। প্রেমের গান। চেনা সুর, অচেনা কথা। শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। খুট করে শব্দ হলো বাথ রুমের দরজায়। মনি শংকর কোমড়ে বড় একটা সাদা টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে এল। এসেই সরাসরি ধাক্কা খেল বিন্দুর সাথে। একদম বুকে বুকে। বিন্দু প্রস্তুত ছিল। দাড়িয়ে ছিল ধাক্কার জন্য। তাই পড়ে গেল না। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল স্বামীর ঠোটে। তারপর নিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আর একটা তোয়ালে দিয়ে মনি শংকরের মাথা আর শরীর খুব ভাল করে মুছে দিল।
তিন দিন পর একটা জটিল অপারেশন হলো অমিতের। মাংসের ভিতর সেধিয়ে যাওয়া হাড়ের টুকরা গুলি বের করা হলো। অপারেশনে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তবে রেয়ার গ্রুপের এ নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন ছিল। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। অমিতের ভাগ্য ভাল মনি শংকর আর রামলাল দুজনের রক্তই এ নেগেটিভ। অপারেশনের সময় মনি শংকর হাসপাতালেই ছিল। সে সরাসরি রক্ত দিল। খবর পেয়ে ছুটে এল রামলাল। তার কাছ থেকেও রক্ত নেয়া হল। আশ্রমের ছেলে মেয়েরা লাইন ধরে এসে দাঁড়ালো হাসপাতালের সামনে। সকলেই রক্ত দিতে চায়। পরীক্ষা করে আঠার বছরের উর্দ্ধে এমন কয়েকজনকে চিহ্নিত করে রাখা হলো। যদি ভবিষ্যত দরকার হয়। ম্যাগী অভিভুত হয়ে গেল মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার এমন ধরণ দেখে। পশ্চিমা জগতে এমনটি কল্পনা করাও দুষ্কর।
চব্বিশ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো অমিতের। আইসিইউ থেকে ক্যাবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আজ ৭ দিন হলো বন্যা হাসপাতালে। কিছুতেই সে অমিতকে ছেড়ে যাবে না। বিন্দু, মঞ্জু মাঝে মাঝে আসে। রোহিত, মনি শংকরও খবর রাখে। ম্যাগী রাতে বন্যার সাথে থাকে। অঞ্জলী দিনের বেলা যথারীতি আশ্রমের কাজ করে। রাতে নার্সের ডিউটিতে হাসপাতালে থাকে। তবে সে কোন পার্টিকুলার প্যাশেন্টের ডিউটি করে না। বরং সব ক্যাবিনগুলিতে কার কি প্রয়োজন সেসব খোঁজখবর রাখে। মালিকের লোক হিসাবে একটা নাক উচু ভাব ধরে রেখেছে। এতে সুবিধা হলো ক্যাবিন গুলিতে যখন তখন ঢুকার পাশাপাশি অনাবশ্যক গল্পগুজবের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। তার ছদ্মবেশ বজায় রাখার জন্য এটা বেশ সহায়ক। অঞ্জলীর ধারণা একবার যখন হামলা হয়েছে, তখন আবারও হামলা হবে। আক্রমণটা কোন দিক দিয়ে আসে সেটা বুঝাই মুশকিল। সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। অমিতের ক্যাবিনে ঢুকার সময় সে সবসময় মূখে মাস্ক ব্যবহার করে। বলা তো যায় না, এতগুলি পরিচিত মানুষ, কেউনা কেউ চিনে ফেলতে পারে।
অপারেশনের পাঁচদিনের মাথায় অমিতের অবস্থা বেশ উন্নতির দিকে গেল। আগের ব্যান্ডেজ খুলে নতুন ড্রেসিং করা হয়েছে। ঘা টান ধরে এসেছে। ব্যাথাও কমে আসছে। তবে ভাংগা হাড় জোড়া নিতে কমপক্ষে ছয়মাস সময় লাগবে। ডাক্তার বলেছেন এত দিন অমিতকে হাসপাতালে থাকতে হবে না। ঘা শুকালেই তাকে রিলিজ করে দেয়া হবে। মঞ্জু এসে জোর করেই বন্যাকে নিয়ে গেল। অমিতই ফোন করে মঞ্জু বৌদিকে বলেছে বন্যাকে নিয়ে যাবার জন্য। ঠিক হলো বিন্দু আর ম্যাগী রাতে অমিতকে এটেন্ড করবে।
গত কিছুদিনে ম্যাগী রায় পরিবারের প্রায় সকল সদস্যের সাথে পরিচিত হয়েছে। এখন সে আর শুধু অফিস স্টাফ নয়। পরিবারের একজনের মত হয়ে গেছে। যে তাকে সবচে অপছন্দ করতো সেই বিন্দুর সাথে তার সবচে বেশী ভাব হয়েছে। চমতকার বন্ধুত্ব হয়েছে বন্যার সাথেও।
বিকালে বন্যা চলে যাওয়ার পর অঞ্জলী ঢুকলো অমিতের ক্যাবিনে। এসময়ে ডাক্তার নার্স বা ভিজিটর কেউ আসবে না। ক্যাবিনে ঢুকেই ভিতর থেকে ছিটকিনী আটকালো। অমিত চোখ বন্ধ করে ছিল। খুট করে শব্দ হতেই চোখ মেলে তাকালো। অঞ্জলীর তখনও মূখ ঢাকা। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল বিছানার কাছে। মূখের কাপড় সরালো। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অমিতের দিকে। মিনিটখানেকের মাথায় অমিতের ঠোট দুটি কাপতে শুরু করলো। দীর্ঘ পনের বছরের দুঃখ কষ্ট অভিমান একসাথে উথলে উঠেছে। সবাইকে ফাকি দিতে পারলেও অমিতকে ফাকি দিতে পারলো না অঞ্জলী। জনম জনম ধরে যে দুটি চোখ বুকের ভিতরে লালন করে আছে অমিত সে চোখ চিনতে মুহুর্ত মাত্র দেরী হয়নি তার। এদিকে দাড়িয়ে থেকেই দু’চোখে বন্যা বয়ে গেল অঞ্জলীর। একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে। কথা বলতে পারছে না। অমিত শুয়ে থেকেই ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। অঞ্জলীর ইচ্ছা হলো অমিতের বুকে ঝাপ দেয়। কিন্তু বড় খারাপ সময়ে তাদের দেখা হলো। অমিতের বাড়ানো হাতটা ধরে বিছানার কিনারায় বসলো অঞ্জলী। এক হাতে অমিতের হাতটা বুকের সাথে চেপে রাখলো, আরেকটা হাত মাথার উপর রেখে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো, “খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা?”
অমিত অঞ্জলীর কথার জবাব দিল না। শুধু বললো, “একি হাল হয়েছে তোমার? আমি না হয় অসুস্থ। কিন্তু তোমাকে এমন দেখছি কেন?”
আজ নিয়ে একুশ দিন অঞ্জলী এক মিনিটের জন্য দুচোখের পাতা এক করেনি। কিন্তু অমিতকে সে কথা বলা যাবে না। “তুমি সুস্থ হও সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। নিজের বাড়িতে নিজের ঘরে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
আর মাত্র দু তিনটে দিন কষ্ট করো সোনা। আম ঠিক তোমাকে নিয়ে যাব। আর আমি তোমার ক্যাবিনের পার্টিশনের ওপাশেই আছি। যে কোন প্রয়োজনে পার্টিশনে টোকা দিলেই আমি চলে আসবো।”
“একটা চিঠি পেয়েছি আমি। ঠাকুরমার লেখা। এর মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।”
অমিত চিঠির বিষয় বস্তু সবটা অঞ্জলীকে বললো। সব শুনে বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে রইল অঞ্জলী। তারপর বললো, “ভেবোনা আমি এর অর্থ উদ্ধার করতে পারবো।”
হাতটা ছেড়ে দিয়ে গভীর করে চুমু খেল অঞ্জলী অমিতের ঠোটে। নাকে নাক ঘষলো। অঞ্জলীর ভালবাসায় অপত্যের ভাগ থাকে বেশী। আর এটাই পাগল করে অমিতকে। “এবার যেতে হবে মানিক, আমি এখানে একজন নার্স মাত্র। কারো কাছে আমার পরিচয় প্রকাশ করো না।”
গত কিছুদিন থেকে বিন্দুর মনটা খুব ভাল। মনি শংকরের এধরণের পরিবর্তন তার জন্য খুবই আনন্দের। জেদী মেয়ে বিন্দু। মনি শংকর যখন থেকে পরনারীতে আসক্ত হয়েছে তখন থেকে সে মনি শংকরকে কাছে ঘেষতে দেয় না। ফুটন্ত যৌবন নিয়ে আলাদা বিছানায় ঘুমায়। মনি শংকর ড্রিংক করে অন্য মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে অনেক রাতে ঘরে ফিরে। বিন্দুর দিকে ফিরেও তাকায় না। অনেক কষ্টে দিনটা কেটে গেলেও বিন্দুর রাত যেন কিছুতেই কাটতো না। কিন্তু গত কিছু দিন যাবত মনি শংকরের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। মদ খাওয়া বেশ কমিয়ে দিয়েছে। রেসের মাঠে যাওয়াও কমেছে। সবচে বড় কথা গত দুই তিন সপ্তাহ কোন মেয়ের কাছে যায়নি মনি শংকর।
তার ধারণা ছিল ম্যাগী নামক বিদেশী মেয়েটা বুঝি তার নতুন রক্ষিতা। কিন্তু ম্যাগীর সাথে কথা বলে, সময় কাটিয়ে বিন্দুর ধারণা পরিবর্তন হয়েছে। ম্যাগীর ভাষ্য মতে বস কখনও তার দিকে খারাপ নজরে তাকায়নি। এ ধরণের পরিস্থিতির মূখোমূখি হতে পারে এটা ধরে নিয়েই সে কাজে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু বসের মাঝে সেকরম কোন আগ্রহ লক্ষ্য করেনি। এমন কি দিন দুই তার সাথে রেসের মাঠেও গিয়েছে। সেখানেও কোন আনডিউ অ্যাডভান্টেজ নেবার চেষ্টা তার মাঝে ছিল না।
বিন্দু সবটা মিলাতে পারে না। এক সময় তার কাছে মনে হতো মনি শংকর প্রচন্ড স্বার্থপর একটা মানুষ। নিজের সুখ, আয়েশ আর তৃপ্তির বাইরে কোন কিছুই কেয়ার করে না। এখন সেটা পাল্টাতে শুরু করেছে। ছোট ঠাকুর পো হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে তার মাঝে অন্য রকম দায়িত্ববোধ তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে সেদিন যখন ছোট ঠাকুরপোকে মনি শংকর নিজের শরীরের রক্ত দিল তখন বিন্দুর কিযে ভাল লেগেছে তা বলে বুঝাতে পারবে না। স্বামীকে নিয়ে গর্বে অহংকারে তার বুকটা ভরে গেছে। কি অসম্ভব পৌরুষদীপ্ত মানুষ মনি শংকর! বড় লোকের সন্তান। অনেকের আভিজাত্য থাকে, তবে সেটা উপভোগ করতে পারে না। মনি শংকর পারে। সে যখন যেখানে যায় সেখানেই সে ফোকাসে থাকে। তার সামনে বাদবাকী সবাই ম্লান হয়ে যায়। এ হেন মনি শংকর যদি দুএকটা মেয়েছেলে নিয়ে আমোদ ফুর্তি করেই থাকে তো করুক না? উপমহাদেশের রাজা বাদশা নবাবদের হারেম তো মশহুর। বিন্দু মনি শংকরকে ক্ষমা করে দিল।
খুব ভোরে মন্দিরে গিয়ে পুজো দিল বিন্দু। সদ্য স্নান করেছে। লাল পেড়ে সাদা সূতী শাড়ী তার পরনে। পুজোর ডালায় ঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে মনি শংকর বিছানায় বসে আড়মোড়া ভাংছে। ছুটির দিনে একটু দেরীতে উঠে মনি শংকর। বিন্দুকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয় সে । এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। বিন্দুর খুব লজ্জা লাগে। আবার স্বামীর এ দৃষ্টিটা ভালও লাগে। হাতের ডালাটা একটা টেবিলের উপর রেখে মনি শংকরকে বলে,” একটু উঠে দাড়াবে?”
কি ছিল বিন্দুর গলায় কে জানে, মনি শংকর বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাড়ালো। গলায় আচল জড়িয়ে স্বামীকে আভুমি প্রণাম করলো। বিন্দুর মাথায় হাত রাখলো সে। তারপর দুই বাহুতে ধরে টেনে পাগলের মত জড়িয়ে ধরলো বুকে। স্বামীর বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো বিন্দু। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল মনি শংকর। কিছুই বুঝতে পারছে না।
জগত সংসারে একটাই মানুষ আছে যাকে ঘাটায় না মনি শংকর। সে হলো বিন্দু। সে নিজে যেমন বেয়াড়া, বিন্দু তার চে হাজারগুণ বেয়াড়া। তার জিবের ধার ইস্পাতের ফলার চেয়েও বেশী। নিত্যদিন তাকে ফালা ফালা করে। আজ কি হলো এমন? মনি শংকর ভেবে পায় না। সে হাতের চেটো দিয়ে বিন্দুর অশ্রু মুছায়। তারপর আরও শক্ত করে জড়িয়ে রাকে বুকের মাঝে। বিন্দু ডালা থেকে পুজোর ফুল নিয়ে মনি শংকরের বুকে কপালে ছোয়ায়। তারপর প্রসাদ হাতে দিয়ে বলে, “খাও।”
“কি হয়েছেরে বউ?” অনেক বছর আগের আটপৌরে ভাষায় সম্বোধন করে মনি শংকর। দুজন বাসি বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে।
“কিছু হয় নি। তোমাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হল তাই।”
বিন্দুর চিবুকটা তুলে ধরে টুক করে চুমু খেল মনি শংকর তার ঠোটে। গভীর করে তাকালো তার চোখে। “তোমার কি হয়েছে গো?” বিন্দুর গলায়ও আটপৌরে আভাষ।
“কিছু হয় নি। তোমাকে চুমু খেতে ইচেছ হলো তাই।”
হেসে ফেললো বিন্দু। মনি শংকরের মাঝে আগের সেই হিউমর ফিরে আসছে। ভাবতেই ভাল লাগছে তার। বিন্দুর হাসি যেন বিদ্যুতের ঝলক। চোখ ফেরানো দায় হলো মনি শংকরের। বিন্দু হঠাত করেই মনি শংকরের সামনে হাটু গেড়ে বসলো। তারপর আচলটা সামনে বাড়িয়ে বললো, “মা দুর্গা আসছেন। তার আগে যদি তোমার কাছে কিছু চাই দেবে?”
মনি শংকর ধারণা করলো পুজোয় কোন দামী অলংকার বা অন্য কিছু হয়তো বিন্দু চাইবে। সে বিনা দ্বিধায় বললো, “তোমার দরিদ্র স্বামীর যা কিছু আছে সবটাই তোমার বিন্দু, বলো তুমি কি চাও।” বর দেবার ভংগীতে হাত উচু করলো মনি শংকর।
“আমি তোমাকে চাই, আমার স্বামী মনি শংকরকে চাই।”
বিন্দুর কথা সবটা কানে যায়নি মনি শংকরের। সে বললো, “তথাস্তু” বলার পর খেয়াল হলো বিন্দুর কথার মর্মার্থ। তারপর স্রেফ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সে ।
বিন্দুর সেদিকে খেয়াল নেই। অসম্ভব খুশীতে ঝলমল করে উঠলো তার মূখ। মনি শংকরকে ঠেলে ওয়াশ রুমে পাঠালো সে। “ভিতরে সব কিছু দেয়া আছে। যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।”
সময় নিয়ে গোসল সারলো মনি শংকর। এর মাঝে বেডরুমটাকে অন্য রকম করে ফেললো বিন্দু। উইন্ডো স্ক্রীন থেকে শুরু করে বেড শীট পর্যন্ত সব কিছু চেঞ্জ করেছে। ফ্লাওয়ারভাসে টাটকা রজনী গন্ধা। ঘরটা ম ম করছে। ল্যান্ড ফোনের কর্ড খুলে রাখলো। মোবাইলের সুইচ অফ করে দিল। দরজার ছিটকানী ভিতর থেকে আটকে দিল। সব গুলি পর্দা টেনে দিয়ে লুকানো লাইটগুলি জ্বেলে দিল। আলো দেখা যায়, এর উতস বুঝা যায় না। এসিটা এমনভাবে এডজাস্ট করা যে বুঝার উপায় নেই এসি চলছে। অথচ কোন গরম অনুভুত হচ্ছে না।খুব হালকা করে মিউজিক বাঁজছে। প্রেমের গান। চেনা সুর, অচেনা কথা। শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। খুট করে শব্দ হলো বাথ রুমের দরজায়। মনি শংকর কোমড়ে বড় একটা সাদা টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে এল। এসেই সরাসরি ধাক্কা খেল বিন্দুর সাথে। একদম বুকে বুকে। বিন্দু প্রস্তুত ছিল। দাড়িয়ে ছিল ধাক্কার জন্য। তাই পড়ে গেল না। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল স্বামীর ঠোটে। তারপর নিয়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আর একটা তোয়ালে দিয়ে মনি শংকরের মাথা আর শরীর খুব ভাল করে মুছে দিল।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!