14-09-2020, 01:27 AM
রক্তের খেলা (#১০)
ঘড়ি দেখে দানা, রাত সাড়ে দশটা বাজে। মহানগরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বারোটা হয়ে যাবে। গাড়ি নিয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যাবে না। একা নয়নাকে গাড়িতে করে মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। বাকিদের গাড়ি নিয়ে ওর পিছুপিছু আসতে বলে। এবোড়খাবোড় মাঠের মধ্যে দিয়ে নাচতে নাচতে গাড়ি চালিয়ে বড় রাস্তা ধরে। বড় রাস্তায় ওঠার আগে এক বার পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে। বিমান চন্দের বাগান বাড়ি দাউদাউ করে জ্বলছে। ততক্ষণে মনে হয় গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে গেছে ওইখানে। রাতের নিস্তব্ধতা চিরে বহু মানুষের হইচই শোনা যায়। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেয়।
কোমরে শুধু মাত্র একটা তোয়ালে, ঊর্ধ্বাঙ্গ খালি এইমত অবস্থায় মহানগরে পৌঁছালে সমস্যায় পরে যাবে। পেছনের সিটে নয়না তখন অজ্ঞান। তোয়ালে দিয়ে ওর শরীর যদিও ঢেকে দিয়েছিল কিন্তু গাড়ির নাচনের ফলে তোয়ালে আবার সরে গেছে। বেশ কিছুদুর গিয়ে একটা খালি জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দেয়। বাকিদের মহানগরে ফিরে যেতে বলে আর বলে মহুয়াকে যে জানিয়ে দেয় দানা ঠিক আছে। শক্তি আর বলাইকে গাড়ি পরিস্কার করার সরঞ্জাম আনতে অনুরোধ করে, রাতের মধ্যেই গাড়ি পরিষ্কার করে ফেলেতে হবে। নয়নাকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে তারপরে বাড়ি ফিরবে বলে জানিয়ে দেয়। আকরাম শক্তি গাড়ি চালিয়ে মহানগরের দিকে চলে যায়। কোথায় যাবে এত রাতে? নিজের বাড়িতে না নয়নার বাড়িতে? ওকে আর নয়নাকে রক্তাক্ত এইমত অবস্থায় দেখলে মহুয়া ভিরমি খেয়ে যাবে, ভয়ে কেঁদে ফেলবে। নয়নার বাড়িতে যাওয়া উচিত, ওইখানে ওকে রেখে তারপরে নিজের বাড়ি চলে আসবে। না না, নিজের বাড়িতে যাওয়াই বিবেচ্য, মহুয়া এতক্ষণে নিশ্চয় চরম উৎকণ্ঠায় প্রহর গুনছে। এতক্ষণ পরে আর মাথা কাজ করছে না। বারেবারে রুহির আদো আবদার কানে ভেসে আসে, "ডিনার?" চোরা পকেটে যে মোবাইলটা ছিল সেটা এতক্ষণে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ওর জামা কাপড়ের সাথে।
সকাল হলেই এই শহর জ্বলে উঠবে, একসাথে দুই তাবড় রাজনৈতিক নেতা খুন হয়েছে। সকাল হলেই পুলিস গোয়েন্দা নিজেদের তদন্তে নেমে পড়বে। নিজেকে কি ভাবে বাঁচাবে সেটা ভাবে, যদিও নিজে থেকে একটাও গুলি চালায়নি দানা। যতদূর মনে পড়ে ওই বাড়িতে ওর অস্তিত্বের প্রমান নেই কিন্তু নয়নার অস্তিত্বের প্রমান হয়ত খুঁজে বের করে নেবে গোয়েন্দারা। নয়নাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে দানার ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়নাকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চালাতে হবে।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে জলের খোঁজে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। একটু দূরে রাস্তার পাশে একটা পুকুরের দেখা পায়। তোয়ালে খুলে পুকুরে নেমে গলা পর্যন্ত ভালো ভাবে স্নান করে নেয়। তোয়ালে দিয়ে গা হাত পা মুছে আবার তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে এপাশ ওপাশ দেখে। একটা প্লাস্টিকের বোতল পেয়ে যায় আর তাতে পুকুর থেকে জল নিয়ে নেয় নয়নার জন্য। গাড়িতে এসে নয়নার মুখে চোখে জলের ছিটা মারতেই ভয়ার্ত চোখ মেলে আসেপাসে তাকায় নয়না। কোথায় আছে ঠাহর পেতে একটু সময় লাগে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সারা শরীরে রক্ত মাখা, ওর শরীরে একটা তোয়ালে জড়ানো। প্রচন্ড আতঙ্কে নয়নার চেহারা রক্ত শুন্য, চোখে ভাষা নেই। দানাকে দেখে ফ্যাকাসে চেহারায় আবার কেঁদে ফেলে।
মাথা জোরে জোরে নাড়িয়ে আর্তনাদ করে, "আমার সব শেষ হয়ে গেল দানা, আমার সব শেষ হয়ে গেল।"
দানা ওর পাশে বসে প্রবোধ দিয়ে বলে, "শান্ত হও নয়না, নিজে বেঁচে গেছ এই অনেক। ওইখানে থাকলে তুমিও বাপ্পার গুলিতে নয়ত নিতাইয়ের গুলিতে প্রান হারাতে।"
ওর বুকের ওপরে কিল মারতে মারতে চেঁচিয়ে ওঠে, "আমি কি করবো, দানা। আমি সব কিছু হারিয়ে ফেলেছি।"
দানা ওর হাত ধরে শান্ত কণ্ঠে বলে, "কাছেই একটা পুকুর আছে। সব থেকে আগে ওই পুকুরে নেমে স্নান করে গায়ের রক্ত ধুয়ে ফেল। তারপরে দেখি কোথায় যাওয়া যায়, কি করা যায়।"
নয়না তোয়ালে জড়িয়ে দানার পেছন পেছন পুকুর পাড়ে আসে। কোনোদিন কি পুকুরে নেমেছিল এই অভিনেত্রী নয়না বোস? তোয়ালে খুলে উলঙ্গ হয়ে পুকুরে নেমে, দানার নির্দেশ মতন গলা পর্যন্ত ভালো করে ডলে ডলে রক্ত মুছে স্নান সেরে ফেলে। তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে খানিকটা শান্ত হয়। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে গেছে, বেদনার সাথে সাথে চেহারায় ভয়ার্ত চাহনি। সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে কোনোরকমে বেঁচে ফিরে এসেছে। দানার বাজু আঁকড়ে ধরে ওর দেহের উত্তাপ নিজের দেহে মাখিয়ে নেয়। দানার দিকে প্রগাড় কৃতজ্ঞতার ভরা চোখে তাকায়। দুই চোখ ছলকে ওঠে। এই অশ্রু কি মেকি না সত্যি? দানা ওই অশ্রু দেখে ভোলার পাত্র আর নয়। তাও চেহারায় শান্ত ভাব এনে ওকে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। পেছনের সিটে কুঁকড়ে পা গুটিয়ে এক কোনায় বসে পড়ে নয়না। খালি রাস্তা ধরে প্রবল গতিতে গাড়ি চালিয়ে দেয় মহানগরের উদ্দেশ্যে।
নয়না মিহি কণ্ঠে ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, "তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো ভেবে পাচ্ছি না দানা। তুমি না থাকলে সত্যি আজকে ওইখানে মরে পড়ে থাকতাম।" একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, "কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না, বাপ্পা নস্কর এই বাড়ির খবর কি ভাবে পেল?"
সামনের আয়নায় নয়নার চোখে চোখ রেখে উত্তর দেয় দানা, "ওইদিন বাপ্পা নস্করকে হুমকি দিয়ে শালা ভুল করেছিলাম। জানতাম না যে শালা মাদারচোদ আমার পেছনে লোক লাগাবে। শালা আমাকে অনুসরন করতে করতে যে শেষ পর্যন্ত এইখানে এসে পৌঁছাবে সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল।"
কোনরকমে ঠোঁটে ম্লান হাসি টেনে বলে, "আমাদের কপালে মৃত্যু লেখা ছিল না তাই ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছেন।"
দানা মনে মনে হেসে ফেলে, বাঁচানোর চক্রান্ত ওর। এরপরে না হলে মোহন খৈতান আর সিমোন খৈতানকে ফাঁদে কি করে ফেলবে? গাড়ি চালাতে চালাতে মাথায় ষড়যন্ত্র আঁটে যদি সব কিছু ঠিকঠাক হয় তাহলে তিন চারদিনের মধ্যেই নয়নার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে সেই সাথে এক নয় মোহন খৈতানের, নয় সিমোন খৈতানের। তবে এখন পর্যন্ত কঙ্কনা দেবনাথ আর নাসরিন আখতার বাকি। এদের কি ভাবে ধরবে? সঠিক জানা নেই তবে কঙ্কনা আর নাসরিনকে পারলে নিজের সামনে ওদের জানিয়ে খুন করবে। রমলা বিশ্বাস আর দুলাল মিত্রকে দানা কিছু করতে চায় না।
নয়না ওকে জিজ্ঞেস করে, "কোথায় যাচ্ছি?"
দানা উত্তর দেয়, "আমার বাড়ি।"
চুপচাপ নয়না জানালার বাইরে ভাসাভাসা চোখ নিয়ে তাকিয়ে কোথাও হারিয়ে যায়। কিছু পরে নয়নার দুই চোখ ছলকে ওঠে, ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কেঁপে ওঠে। বেদনা ভরা কণ্ঠে বলে, "সনু আর সুমিতা চলে গেল।" দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে, "সমুদ্র আমার ভালোবাসা দানা, ওকে আমি ভালবাসতাম।"
কি বলছে নয়না? দানা একটু আধটু যে বোঝেনি সেটা নয়। দানা চোরা হেসে গাড়ি চালাতে মন দেয়। কিন্তু এই ধূর্ত হিংস্র নারীকে কোন মতেই বাঁচিয়ে রাখা উচিত নয়। বিমান আর নেই এখন হয়ত মহানগরে ফিরে গিয়ে মোহনের কোলে ঢলে পড়বে আর ওর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। একটু আগেই বিমান আর সমুদ্রের কাছে ওর বিরুদ্ধে ফাঁদা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সব কিছু জেনে ফেলেছে। এই চূড়ান্ত ছলনাময়ী নারীকে কোনোদিন বিশ্বাস করা উচিত নয়।