13-09-2020, 08:37 PM
(১০ পর্ব)
অনিন্দিতা রায় অনাথ আশ্রমের অফিসিয়াল ইনচার্জ রোহিতের স্ত্রী মঞ্জু। তবে বাস্তবে এটা চালায় অঞ্জলী। পিসিমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি জাগতিক কোন কাজের সাথে জড়িত থাকতে রাজী হননি। ঠাকুরমার দেয়া রায় হাউজিং এর পচিঁশ শতাংশ শেয়ার মালিকানা আর রায় রিয়েল এস্টেটের ডিরেক্টরশীপ পাওয়ার পর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অঞ্জলী ডাইরক্টর এডমিন হিসাবে ঠাকুরমা বেঁচে থাকা পর্যন্ত কাজ করেছে । ঠাকুরমার মৃত্যুর পর সব শরীকরা আলাদা আলাদা হয়ে যায়। কোম্পানীর ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি। ঠাকুরমা বেঁচে থাকতেই সব সুরাহা করে গেছেন। অমিতের অংশ সিদ্ধার্থকে দেখা শুনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তার পরে রোহিত এখন সেটা দেখছে। আলাদা হওয়ার আগে সব শরীক একমত হয়ে একটি অনাথ আশ্রম গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পিসিমা বাড়িটা দান করেন। অঞ্জলী, শুভ্যেন্দু তাদের শেয়ার মালিকানা দান করে আর এসবের সাথে কোম্পানীর টোটাল প্রফিটের এক শতাংশ প্রতি বছর আশ্রমের জন্য বরাদ্দ থাকবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। শেয়ার মালিকানা আর ডিরেক্টরশীপ ছেড়ে দেয়ার পর রায় গ্রুপের সাথে অঞ্জলীর অফিসিয়াল কোন সম্পর্ক থাকে না।
অঞ্জলী শুভ্যেন্দুর সাথে বিয়েতে কোন ভাবেই সম্মত হয়নি। ঠাকুরমার ঘোষণার পরপরই সে আত্মগোপন করে । অমিত দেশে থাকা অবস্থায় আর ফিরে আসেনি। অমিত চলে যাওয়ার পর সে সরাসরি ঠাকুরমার কাছে গিয়ে তার অসম্মতির কথা জানায়। কারণ জানতে চাইলে সে বলে যে, সে একজনের বাগদত্তা, বিয়ে যদি করতে হয় তাকেই করবে। তবে আপাততঃ সে তার নামটা গোপন রাখতে চাইছে। সময় হলে জানাবে। সেই থেকে পনের বছর পেরিয়ে গেছে। আজও অঞ্জলীর সময় হয়নি। কেউ জানেনা কে সেই রহস্যময় পুরুষ যার সে বাগদত্তা। ঠাকুর মার মৃত্যুর পর সেও পিসিমার সাথে কাশী চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মঞ্জুর জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। তার অনুরোধে অঞ্জলী এই অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব নেয়। ম্যানেজার এডমিন হিসাবে অঞ্জলী যে বেতন ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো অনাথ আশ্রমের ফান্ড থেকে সেটা তাকে দেয়া হয়।
আশ্রমে অনাথ ছেলে মেয়ে ও অসহায় বিধবাদের থাকা খাওয়া, লেখাপড়া, বিনোদন, চিকিতসা ও কর্ম সংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এখানে জনা পঞ্চাশেক বিধবা, দেড় শ মত অনাথ ছেলে ও এক শর মত অনাথ মেয়ে রয়েছে। আশ্রম কর্ম চঞ্চল হয়ে উঠে সেই ভোরে। মন্দিরে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে দিন শুরু হয়। তার পর যার যার নির্ধারিত কাজে চলে যায়। বয়স্ক বিধবাগণ যারা রান্না-বান্না করতে পারেন তারা রান্নার কাজ করেন। যারা সেলাই ফোড়াই করতে পছন্দ করেন তারা সেটা করেন। কেউ হাস-মুরগী পালতে চায়, কেউ আবার কিছুই করে না। যে যেই কাজ করে সে মোতাবেক তার পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়। সেটা তার নিজের কাছে থাকে।
কলেজ বয়সী ছেলে মেয়েরা শহরের বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করে। তাদের পড়াশুনার খরচ আশ্রমের তহবিল থেকে বহন করা হয়। যারা পড়া শুনায় ভাল নয় বা আগ্রহী নয় তাদের নানান ধরণের আত্ম-কর্ম সংস্থানমূলক কাজ শেখানো হয়। কেউ ছোট খাট ব্যবসা করতে চাইলে তাকে পুজি দেয়া হয়। যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলে মেয়েরা রায় গ্রুপের যে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে অগ্রাধিকার পায়। ছেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা থাকার বন্দোবস্ত। সপ্তাহে একদিন ডাক্তার সকলের রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। প্রত্যেকের জন্য শরীর চর্চা এবং মার্শাল আর্ট শেখা বাধ্যতামূলক। এখান থেকে বের হয়ে যে কোন ছেলে মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। প্রতিটি বিষয় অঞ্জলী নিজে তদারক করে। কোথাও কোন ফাক বা খুত থাকার সুযোগ নেই। প্রতি ত্রৈমাসিকে হিসাব নিকাশ সম্পন্ন করে পরবর্তী ত্রৈমাসিকের বাজেট বরাদ্দ নেয়া হয়। কোন দূর্নীতি কোন স্ক্যান্ডাল এখানে প্রবেশ করতে পারে না। আশ্রমের লোকজন অঞ্জলীকে ডাকে মিস বলে। মিসকে তারা যেমন সমীহ করে তেমনি ভালবাসে।
গত দশ বছরে এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী দফতরের কর্মকর্তারা এখানে ভিজিট করতে আসেন।ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে তারা খুটিনাটি আলোচনা করেন। অনেক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এখানে অর্থ যোগান দিয়ে থাকে।। তাদের প্রতিনিধিরাও ভিজিট করতে আসে। এরকমই দুজন ফরেনার সেদিন ভিজিট করতে এলো। একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান এবং তার আমেরিকান স্ত্রী। এরা কোন দাতা সংস্থার প্রতিনিধি নয়। ব্যক্তিগত ভিজিটে তারা এটা দেখতে এসেছে। কাজগুলি এখন একদম রুটিন পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাই এসব তদারকের দায়িত্ব এখন থেকে আশ্রমের সদস্যরাই করে থাকে। মিসের অনুমতি পাওয়ার পর একজন বিধবা মহিলা গাইড তাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছিল। এ ব্লক সে ব্লক দেখার পর তারা দোতলার একটা রুমের সামনে এসে দাড়ালো। পাশাপাশি দুটো রুমের একটা বন্ধ । আর একটা খোলা। খোলা রুমের বিশাল দেয়ালে দুটো বড় পোট্রেট। একটা অনিন্দিতা রায় চৌধুরীর আর একটা তার স্বামী রাজশেখর রায় চৌধুরীর। ছবি দুটোর সামনে ভিজিটরগণ চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। মহিলাটির মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। তবে পুরুষ লোকটির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে দেখা গেল। খুব সন্তর্পনে যদিও সে চোখ মুছে ফেললো তবু তা গাইডের চোখ এড়াল না। এখান থেকে বেরিয়ে তারা পাশের রুমের দিকে ইংগিত করতেই গাইড বললো,” এ রুমটা সাধারণত খোলা হয় না। মাঝে মাঝে শুধু মিস এটা খোলেন। তবে সে সময় তিনি কাউকে সাথে রাখেন না। এ রুমে কি আছে সেটা আমরা কেউ জানিনা।”
দুই দিন পর সেই আমেরিকান মহিলা আবার এসে হাজির। বেলা তখন দশটা মত হবে। ভোর ছটা থেকে টানা কাজ করছে অঞ্জলী। একদম হাপ ধরে গেছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু চোখ বন্ধ করেছিল। এমন সময় ইন্টারকম বাজলো। রিসেপশন থেকে সুদীপা জানাল মিসেস লীনা গোমেজ নামে এক ফরেইনার মহিলা তার সাথে দেখা করতে চান। “পাঠিয়ে দাও” বলে সোজা হয়ে বসল অঞ্জলী। সাথে সাথে সুইং ডোর ঠেলে লীনা গোমেজ ঢুকলো। অঞ্জলী দেখল দীর্ঘ এক হারা গড়নের একটা মেয়ে ঢুকছে। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। বয়স বড় জোর পচিশ কি ছাব্বিশ। ভরাট শরীর। তবে বেশভুষায় শালীন।
“আমি লীনা গোমেজ” পরিষ্কার বাংলায় বলল সে, “কেমন আছেন মিস চ্যাটাজি?”
“ভাল, আপনি কেমন আছেন? কোন কষ্ট হয়নিতো আসতে?” বিদেশী মানুষ দেখলে বাংগালীরা সাধারনত ইংরেজিতে কথা বলে। কিন্তু লীনা এমন ক্যাজুয়াল বাংলায় কথা বলছে যে, তার সাথে ইংরেজীতে কথা বলা তাকে অপমান করার শামীল। তবে সে তার বিস্ময় চেপে রাখলো না।
“আমি খুব অবাক হচ্ছি এবং গর্ববোধ করছি আপনাকে এমন সাবলীল বাংলা বলতে দেখে।”
“ও আচ্ছা” লীনা হাসলো, “আমার স্বামী আব্রাহাম গোমেজ ইন্ডিয়ান বাংগালী। তার কাছ থেকেই শেখা। এছাড়া পেশার কারণেও আমাকে নানা ভাষায় কথা বলতে হয়, নানা জায়গায় যেতে হয়। আমি এক জন ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক। এ মুহুর্তে টাইমসের হয়ে কাজ করছি”, লীনা তার এ্ক্রিডেশন কার্ড দেখাল।
“তা বলুন আমি আপনাকে কেমন করে সাহায্য করতে পারি?”
“আমরা আপনাদের আশ্রম নিয়ে একটা কাভার স্টোরি করতে চাই।”
“চা না কফি?” জবাব দেবার আগে অঞ্জলী জানতে চাইল । “আসলে আমাদের ম্যানেজমেন্ট প্রচার বিমূখ। আমরা খুব সেনসেটিভ মানুষদের নিয়ে কাজ করি। তাই মিডিয়াকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি।”
“কোন সমস্যা নেই। আমি স্টোরী তৈরী করার পর আপনাকে পড়তে দেব। যদি মনে করেন ছাপা হলে আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না তাহলেই কেবল ছাপা হবে।”
“সে ক্ষেত্রে আমাকে বোর্ডের সাথে কথা বলতে হবে।”
“সিওর, আসলে আমরা গত দুদিন আগে আপনার এখানে একবার ঘুরে গেছি। সব কিছু দেখে শুনে আব্রাহামতো খুবই ইমপ্রেসড।”
অঞ্জলীর ভ্রু কুচকালো। কিন্তু বুঝতে দিল না।
“আমি কাল পরশু একবার আপনাকে কল দেব।”
“কোথায় উঠেছেন?”
“ম্যাডিসনে”
“এদেশে প্রথম?”
“এখানে প্রথম, তবে সাব-কন্টিনেন্টের সবকটা দেশেই ঘুরেছি আমি। আব্রাহাম অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আর তেমন ট্রাভেল করি না।”
“আপনি কি আপনার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে নিউজ স্টোরী করতে আমেরিকা থেকে এখানে এসেছেন?”
“ঠিক সেরকম অসুস্থতা নয়। একটা গাড়ী দূর্ঘটনায় তার মাথার পিছনে আঘাত লাগে এবং তার পর থেকে সে চোখে দেখতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। তবে সব কিছু শুনতে পায়। শারিরীক ভাবে বা চলা ফেরায় কোন সমস্যা নেই। সব চে বড় কথা আমি আসবো জেনে সে আমার সংগী হয়েছে। অনেক দিন দেশে ফেরা হয় না। এমন একজনকে একা ছেড়ে দেয়া যায়?”
“হায় ভগবান! বলেন কি? তাকে নিয়ে আসবেন একবার। আমি তার সাথে কথা বলব।’
“অবশ্যই বলবেন। সে এখন আপনাদের একটা তীর্থস্থান কি যেন নাম..ও হ্যা কাশী। কাশীতে গেছে। তার কোন এক ক্লোজ রিলেটিভ সেখানে থাকেন। এলেই আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। আমি আজ উঠি মিস চ্যাটার্জি।”
লীনা হাত বাড়িয়ে দিল। হ্যান্ডসেক করলো দুজন। চোখে চোখে তাকিয়ে দুজন দুজনকে জরীপ করলো।
অঞ্জলী ফোন করে মঞ্জূ আর রোহিতকে নিউজ স্টোরীর বিষয়টা অবহিত করে। পরদিন বোর্ড মিটিং এ বসে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, নিউজ স্টোরী করার বিষয়ে অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে সেটা প্রকাশ করার আগে বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। খবরটা টেলিফোনে দেয়া যেত। কিন্তু একটা অদম্য কৌতুহল অঞ্জলীকে পেয়ে বসেছে। তার জানা দরকার লোকগুলি কে এবং কেনই বা তারা এত ইন্টারেস্টেড। সে গাড়ী নিয়ে সোজা ম্যাডিসনে চলে আসে। রিসেপশনে খোজ নিতেই মিঃ এন্ড মিসেস গোমেজ এর খোঁজ পেয়ে যায়। সরাসরি রুমে নক করে অঞ্জলী। দরজা খুলে দিয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠে লীনা। অঞ্জলীকে সে আশা করেনি।
“খুব সারপ্রাইজ দিলাম কেমন?” অঞ্জলী হাসতে হাসতে বলে।
“এক্সাক্টলি। আমি আপনাকে আশা করিনি। এনি ব্যাড নিউজ?”
“না না গুড নিউজ। বোর্ড পারমিশন দিয়েছে। তবে প্রকাশের আগে আমাদের দেখাতে হবে।”
“সে তো অবশ্যই”
“বাই দ্যা ওয়ে, মিঃ গোমেজকে দেখছি না?”
“ও এখনও ফেরেনি। ওয়েল মিস চ্যাটার্জি আনন্দ সংবাদ দেবার জন্য আমার মনটা খুব খুশী। ড্রিংকস চলবে?”
“না ধন্যবাদ।
“কফি বলি?
“ঠিক আছে।
লীনা জনি ওয়াকারের বোতল থেকে এক পেগ ঢেলে নিজে নিল। আর কফির কাপ অঞ্জলীকে এগিয়ে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে একধরণের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। লীনা এক মুহুর্তেই তার জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব কাহিনী হড় হড় করে বলে ফেললো। অঞ্জলী হাসলো। সেও তার সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানালো।
“ওয়েল মিস চ্যাটার্জী তাহলে আপনার এ গল্পও আমার বেশ কাজে লাগবে। কিছু ইনফরমেশন এখান থেকে নিতে পারবো। আমি সামারাইজ করছি। দেখুন কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা?”
“মিঃ রাজ শেখর রায় চৌধুরী রায় গ্রুপের সূত্রপাত করেন। এটা চরম সমৃদ্ধি লাভ করে মিসেস অনিন্দিতা রায় চৌধুরীর হাতে। তার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। ২২ জন নাতী নাতনী। তিনি তার স্ত্রী এবং ছেলেরা মৃত্যু বরণ করেছেন। নাতী নাতনীরা গ্রুপ চালাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ দেশের বাইরে আছেন। আশ্রমের চেয়ারম্যান বড় নাত বউ ম্যাডাম মঞ্জু । আপনি তার ছোট বোন। চেয়ারম্যানের পক্ষে আপনি কাজ করেন। আপনার স্ট্যাটাস কর্ম সচিব ধরণের। রায় গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের এমডিরা আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার। আমি ঠিক বলছি তো মিস চ্যাটার্জি?”
“হ্যা তুমি ঠিকই বলছো লীনা। আর শুন এসব মিস টিস বাদ দাও। তোমাকে বেশ কদিন কাজ করতে হবে। এত ফরমাল হলে চলবে কেন? আমাকে তুমি অঞ্জু বলবে।”
“ধন্যবাদ অঞ্জু। আচ্ছা আমি একজনকে মিস করে যাচ্ছি। তুমি সবার অবস্থান বলেছ। তবে তোমার ভাষায় ক্রাউন প্রিন্স অমিতাভ রায় চৌধুরীকে সীনে দেখছি না।”
“তিনি আমেরিকায় আছেন এটুকু জানি। তবে কেমন আছেন কি করছেন জানি না।”
“মাই গড। এত বছর ধরে একজন মানুষের ইনফরমেশন তোমরা কেউ জানো না?”
“ঠাকুরমার নিষেধ ছিল। তিনি যদি নিজে থেকে যোগাযোগ না করেন তবে যেন তাকে ডিস্টার্ব না করা হয়। প্রথম দিকে বিষয়টা এমনই ছিল। পরে আমার ধারণা এটা হয়ে গেছে অভিমান পাল্টা অভিমান।”
“বুঝলাম না।”
“পরিবারের লোকজন অভিমান করে আছে তার উপর আর তিনি অভিমান করে আছেন পরিবারের উপর।”
“তুমি তো যোগাযোগ করতে পারতে?
“আমি কেন করতে যাব?”
“কারণ আমি যদি বুঝতে ভুল না করি তার সাথে তোমার বন্ধুত্ব ছিল।”
“আমি তাদের কোম্পানীর একজন কর্মচারী মাত্র।”
“ড্রপ ইট। এস অন্য বিষয়ে কথা বলি।”
“হুম”
“তুমি এত সুন্দর একটা মেয়ে বিয়ে না করে জীবনটা পার করে দিলে কেন?”
“অপেক্ষা করে আছি।
“কার ? প্রিন্স অমিতের?”
“কে বলেছে তোমাকে আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি?”
“এটা জাস্ট আমার অনুমান।”
লীনার এখান থেকে বেরিয়ে অঞ্জলী খুব বোরিং ফিল করতে লাগলো। সে যে উদ্দেশ্যে এসেছিল সেটা পূরণ হয়নি। মেয়েটাকে নিছক সাংবাদিক বলেই মনে হচেছ। গত পনের বছরে সে অমিতের কোন হদীস করতে পারেনি। দিদি জামাই বাবুর এক কথা, ঠাকুরমা নিষেধ করে গেছেন আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করবো না। ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে অমিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড ইউজ করে লেনদেন করেন। তার বাহ্যিক কোন ঠিকানা তাদের জানা নেই। মরিয়া হয়ে বছর কয়েক আগে শুভর সাথে যোগাযোগ করেছিল ,শুভও বলতে পারে না অমিত কোথায় আছে।
অঞ্জলী খেয়াল করেছে অমিতের ভাগের কোম্পানীগুলো প্রায়ই লস করছে অথবা মিনিমাম প্রফিট করে টিকে আছে। ভাগ করার সময় প্রবলেমেটিক কোম্পানীগুলো অমিতকে দেয়া হয়েছে। টেক্সটাইল মিলটা ঠাকুরমা থাকতেও ভাল প্রফিট করেনি। এখন এটা প্রায় বেদখল হওয়ার পথে। এটা পড়েছে অমিতের ভাগে। রোহিতদা নির্ভেজাল ভালমানুষ। তিনি অমিতকে ঠকাবেন এটা মেনে নিতে তার মন সায় দেয় না। তার নিজের দিদি অবশ্য খাওয়া, শোওয়া আর সাজগোজের বাইরে কিছুই জানে না। কিন্তু অমিতের ব্যপারে সেও নিস্পৃহ।
শুভ্যেন্দুর সাথে বিয়েতে রাজী হয়নি অঞ্জলী। বাস্তবে সে কি অমিতের জন্য অপেক্ষা করছে? তার নিজের কাছেও প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই। সে অমিতের কয়েক বছরের সিনিয়র। * র ঘরের বিধবা মেয়ে। অমিতকে বিয়ে করার বাসনা নিতান্তই অবাস্তব স্বপ্ন। তা হলে সে কেন তার জীবন যৌবন এমন অবহেলায় অপচয় করছে? লীনা ধরে নিয়েছে সে অমিতের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু অমিতের কোন খবরই তো সে জানে না। বুকটা খচখচ করে তার।
মনে পড়ে কি ছেলে মানুষী আব্দার করতো অমিত। ধুম ব্যস্ত পড়া শুনার সময় একদিন ডেকে নিল ঘরে। অঞ্জলীর ধারণা ছিল হয়তো শারিরীক ভাবে তাকে চাইছে। সে মনে মনে খুশীও হয়েছিল। গুদ যদি ফাটাতেই হয় এমন তরুনের ধন দিয়ে ফাটানোই উচিত। সে তড়াক করে মূখটা আয়নায় দেখে নিল। এক পোচ লিপস্টিকি, চূলটায় চিরুনীর একটু ছোয়া দিয়ে ট্যাংক টপের উপর একটা চাদর জড়িযে তার ঘরে ঢুকেছিল। ঘরে ঢুকতেই বললো, “আমার টি শার্টটা খুলে দাও।” অঞ্জলী টি শার্ট খুলে দিল। তার ভিতরে শিহরন। আজই কি ঘটবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান? তার টি শার্ট খুলে দেবার সময় নিজের গায়ের চাদর ইচ্ছে করেই ফেলে দিল। শুধু ট্যাংক টপ পড়া অবস্থায় তাকে দেখেও অমিতের কোন ভাবান্তর হলো না। বলল,” আমার শিরদাড়াটা চুলকে দাও।” চুলকানো শেষ হতে বলল,” কিছু মনে করো না ঘুম ভাংগালাম। আসলে তোমাকে খুব দেখতে ইচেছ করছিল তাই। ঘুমোবার আগে তোমার মূখটা না দেখলে ঘুম আসে না,” বলেই শুয়ে পড়েছিল অমিত। “এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও।” অঞ্জলী মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আশা করছিল অমিত তাকে বুকের মাঝে টেনে নেবে। কিন্তু তা নেয়নি। পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে কাদা। একবুক হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছিল অঞ্জলী।
আজও কি এমনি ছেলে মানুষ আছে অমিত? এমনি সরল আর নিস্পৃহ?
এই দুই ফরেইনারের উদ্দেশ্যও বুঝতে পারছে না অঞ্জলী। শুধু মাত্র একটা কাভার স্টোরী করার জন্য দুইজন মানুষ আমেরিকা থেকে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে। কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। লীনার স্বামী লোকটাকে দেখতে পেলে ভাল হতো। চকিতে মনে পড়লো প্রথম দিন তাদেরকে গাইড করেছিল আশ্রমের যে মহিলা তার কথা। তার কাছ থেকে জানতে হবে । আশ্রমে ফিরে তাকে ডেকে আনলো অঞ্জলী। খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো সব কিছু। ঠাকুরমার ছবির সামনে দাড়িয়ে লোকটা চোখ মুছেছে এ তথ্যটা খচ করে বিধলো তাকে। একজন অচেনা লোক কেন ছবি দেখে কাঁদবে? তাছাড়া লীনার ভাষ্যমত সেতো অন্ধ ও বোবা। ছবি তো তার দেখতে পাওয়ার কথা নয়? আচ্ছা অমিত নয়তো? অমিত বিয়ে করে বউ নিয়ে নাম ভাড়িয়ে এখানে কি করছে? এটা তার বাড়ি তার ঘর? সে কেন লুকোচুরি খেলতে যাবে? সব কিছু মিলে অস্থির হয়ে পড়ে অঞ্জলী।
নিত্য দিনের মতো আজও শুরু হলো ভোর ছটায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। ঠাকুর মা আর ঠাকুরদার ছবিতে ফুল দিয়ে ঠাকুরমার বেড রুমের তালা খুললো অঞ্জলী। প্রতিদিন নিয়ম করে সে এ ঘরটা খোলে। নিজের হাতে ঝাট দেয়, মুছে। এখানেও তাদের দুজনের দুটো ছবি আছে। আকারে কিছুটা ছোট। তবে মাঝখানে রয়েছে অমিতের ছবি। এই তিনটা ছবিতেও নিয়ম করে ফুলের মালা পরায় অঞ্জলী। আজ ঘরে ঢুকতেই একটা অন্যরকমের ঘ্রাণ পায় সে। সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে কেউ একজন ঢুকেছিল সন্দেহ নাই। ঘরটা তালা বদ্ধ। চাবি তার কাছে। কে ঢুকতে পারে?
অঞ্জলী বুঝতে পারছে অনাথ আশ্রম, রায় গ্রুপ এসবকে কেন্দ্র করে একটা কিছু ঘটছে। কিন্তু কি ঘটছে তা বুঝতে পারছে না। যা কিছুই ঘটুক অঞ্জলীকে ভয় পেলে চলবে না। এ বাড়ির নুন খেয়েছে সে। তাদের কোন ক্ষতি সে কোনভাবেই হতে দেবে না। আর যদি অমিতের স্বার্থের প্রশ্ন হয়, নিজের জীবন দিয়ে দেবে। যে সম্মান আর ভালবাসা এ ছেলেটির কাছ থেকে পেয়েছে তার জন্য জীবন দিতে একটুও কুন্ঠিত হবে না সে। ইচ্ছে করলেই সে অঞ্জলীকে যখন তখন ভোগ করতে পারতো। কিন্তু কোনদিন এমনকি খারাপ চোখে তাকায়নি পর্যন্ত। সব সময় আগলে রেখেছে। কেউ তাকে কোন ভাবে হার্ট করলে সরাসরি বুক পেতে দাড়িয়েঁছে। যুগের সাথে মিলে না এমন বিরল ধরণের ছেলে। তাই তো বুক বেধেঁ আজো অপেক্ষ্ করে আছে যদি কোনদিন ফিরে আসে?
কিন্তু ফিরে আসলেও তো অঞ্জলীর লাভ নেই। যদি এই দুই বিদেশী অমিত আর তার বউ হয় তাহলে অঞ্জলীর পনের বছরের অপেক্ষা শুধু আক্ষেপ হয়েই থাকবে। এতো শুধু মরিচীকার পেছনে ছুটা। তার স্বত্তা দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। অমিতের মত টগবগে তরুণ আজ অবধি বিয়ে না করে তার মত একটা বিধবার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে এমনটা আশা করাও তো ঠিকনা। সে তো কখনও বলেনি “অঞ্জলী আমি তোমাকে বিয়ে করবো।” আকারে ইংগিতেও বলেনি। তাকে পছন্দ করতো এটা বুঝা যায়। কিন্তু এমন পছন্দ এ বয়সে হাজারটা থাকতে পারে।
হাহাকার করা ঢেউ উঠে বুকের ভিতর। উথাল পাতাল ঢেউ। তার বুকের পাড় ভাংগে। হৃদয়ের ক্ষরণ তীব্র হয়। চোখ ঠিকরে আগুন আসে। জলতো শুকিয়েছে সেই কবে।
অনিন্দিতা রায় অনাথ আশ্রমের অফিসিয়াল ইনচার্জ রোহিতের স্ত্রী মঞ্জু। তবে বাস্তবে এটা চালায় অঞ্জলী। পিসিমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি জাগতিক কোন কাজের সাথে জড়িত থাকতে রাজী হননি। ঠাকুরমার দেয়া রায় হাউজিং এর পচিঁশ শতাংশ শেয়ার মালিকানা আর রায় রিয়েল এস্টেটের ডিরেক্টরশীপ পাওয়ার পর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অঞ্জলী ডাইরক্টর এডমিন হিসাবে ঠাকুরমা বেঁচে থাকা পর্যন্ত কাজ করেছে । ঠাকুরমার মৃত্যুর পর সব শরীকরা আলাদা আলাদা হয়ে যায়। কোম্পানীর ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি। ঠাকুরমা বেঁচে থাকতেই সব সুরাহা করে গেছেন। অমিতের অংশ সিদ্ধার্থকে দেখা শুনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তার পরে রোহিত এখন সেটা দেখছে। আলাদা হওয়ার আগে সব শরীক একমত হয়ে একটি অনাথ আশ্রম গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পিসিমা বাড়িটা দান করেন। অঞ্জলী, শুভ্যেন্দু তাদের শেয়ার মালিকানা দান করে আর এসবের সাথে কোম্পানীর টোটাল প্রফিটের এক শতাংশ প্রতি বছর আশ্রমের জন্য বরাদ্দ থাকবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। শেয়ার মালিকানা আর ডিরেক্টরশীপ ছেড়ে দেয়ার পর রায় গ্রুপের সাথে অঞ্জলীর অফিসিয়াল কোন সম্পর্ক থাকে না।
অঞ্জলী শুভ্যেন্দুর সাথে বিয়েতে কোন ভাবেই সম্মত হয়নি। ঠাকুরমার ঘোষণার পরপরই সে আত্মগোপন করে । অমিত দেশে থাকা অবস্থায় আর ফিরে আসেনি। অমিত চলে যাওয়ার পর সে সরাসরি ঠাকুরমার কাছে গিয়ে তার অসম্মতির কথা জানায়। কারণ জানতে চাইলে সে বলে যে, সে একজনের বাগদত্তা, বিয়ে যদি করতে হয় তাকেই করবে। তবে আপাততঃ সে তার নামটা গোপন রাখতে চাইছে। সময় হলে জানাবে। সেই থেকে পনের বছর পেরিয়ে গেছে। আজও অঞ্জলীর সময় হয়নি। কেউ জানেনা কে সেই রহস্যময় পুরুষ যার সে বাগদত্তা। ঠাকুর মার মৃত্যুর পর সেও পিসিমার সাথে কাশী চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মঞ্জুর জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। তার অনুরোধে অঞ্জলী এই অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব নেয়। ম্যানেজার এডমিন হিসাবে অঞ্জলী যে বেতন ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করতো অনাথ আশ্রমের ফান্ড থেকে সেটা তাকে দেয়া হয়।
আশ্রমে অনাথ ছেলে মেয়ে ও অসহায় বিধবাদের থাকা খাওয়া, লেখাপড়া, বিনোদন, চিকিতসা ও কর্ম সংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এখানে জনা পঞ্চাশেক বিধবা, দেড় শ মত অনাথ ছেলে ও এক শর মত অনাথ মেয়ে রয়েছে। আশ্রম কর্ম চঞ্চল হয়ে উঠে সেই ভোরে। মন্দিরে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে দিন শুরু হয়। তার পর যার যার নির্ধারিত কাজে চলে যায়। বয়স্ক বিধবাগণ যারা রান্না-বান্না করতে পারেন তারা রান্নার কাজ করেন। যারা সেলাই ফোড়াই করতে পছন্দ করেন তারা সেটা করেন। কেউ হাস-মুরগী পালতে চায়, কেউ আবার কিছুই করে না। যে যেই কাজ করে সে মোতাবেক তার পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়। সেটা তার নিজের কাছে থাকে।
কলেজ বয়সী ছেলে মেয়েরা শহরের বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করে। তাদের পড়াশুনার খরচ আশ্রমের তহবিল থেকে বহন করা হয়। যারা পড়া শুনায় ভাল নয় বা আগ্রহী নয় তাদের নানান ধরণের আত্ম-কর্ম সংস্থানমূলক কাজ শেখানো হয়। কেউ ছোট খাট ব্যবসা করতে চাইলে তাকে পুজি দেয়া হয়। যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলে মেয়েরা রায় গ্রুপের যে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে অগ্রাধিকার পায়। ছেলে মেয়েদের আলাদা আলাদা থাকার বন্দোবস্ত। সপ্তাহে একদিন ডাক্তার সকলের রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। প্রত্যেকের জন্য শরীর চর্চা এবং মার্শাল আর্ট শেখা বাধ্যতামূলক। এখান থেকে বের হয়ে যে কোন ছেলে মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। প্রতিটি বিষয় অঞ্জলী নিজে তদারক করে। কোথাও কোন ফাক বা খুত থাকার সুযোগ নেই। প্রতি ত্রৈমাসিকে হিসাব নিকাশ সম্পন্ন করে পরবর্তী ত্রৈমাসিকের বাজেট বরাদ্দ নেয়া হয়। কোন দূর্নীতি কোন স্ক্যান্ডাল এখানে প্রবেশ করতে পারে না। আশ্রমের লোকজন অঞ্জলীকে ডাকে মিস বলে। মিসকে তারা যেমন সমীহ করে তেমনি ভালবাসে।
গত দশ বছরে এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী দফতরের কর্মকর্তারা এখানে ভিজিট করতে আসেন।ব্যবস্থাপনার নানা দিক নিয়ে তারা খুটিনাটি আলোচনা করেন। অনেক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এখানে অর্থ যোগান দিয়ে থাকে।। তাদের প্রতিনিধিরাও ভিজিট করতে আসে। এরকমই দুজন ফরেনার সেদিন ভিজিট করতে এলো। একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান এবং তার আমেরিকান স্ত্রী। এরা কোন দাতা সংস্থার প্রতিনিধি নয়। ব্যক্তিগত ভিজিটে তারা এটা দেখতে এসেছে। কাজগুলি এখন একদম রুটিন পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাই এসব তদারকের দায়িত্ব এখন থেকে আশ্রমের সদস্যরাই করে থাকে। মিসের অনুমতি পাওয়ার পর একজন বিধবা মহিলা গাইড তাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছিল। এ ব্লক সে ব্লক দেখার পর তারা দোতলার একটা রুমের সামনে এসে দাড়ালো। পাশাপাশি দুটো রুমের একটা বন্ধ । আর একটা খোলা। খোলা রুমের বিশাল দেয়ালে দুটো বড় পোট্রেট। একটা অনিন্দিতা রায় চৌধুরীর আর একটা তার স্বামী রাজশেখর রায় চৌধুরীর। ছবি দুটোর সামনে ভিজিটরগণ চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। মহিলাটির মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। তবে পুরুষ লোকটির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে দেখা গেল। খুব সন্তর্পনে যদিও সে চোখ মুছে ফেললো তবু তা গাইডের চোখ এড়াল না। এখান থেকে বেরিয়ে তারা পাশের রুমের দিকে ইংগিত করতেই গাইড বললো,” এ রুমটা সাধারণত খোলা হয় না। মাঝে মাঝে শুধু মিস এটা খোলেন। তবে সে সময় তিনি কাউকে সাথে রাখেন না। এ রুমে কি আছে সেটা আমরা কেউ জানিনা।”
দুই দিন পর সেই আমেরিকান মহিলা আবার এসে হাজির। বেলা তখন দশটা মত হবে। ভোর ছটা থেকে টানা কাজ করছে অঞ্জলী। একদম হাপ ধরে গেছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে একটু চোখ বন্ধ করেছিল। এমন সময় ইন্টারকম বাজলো। রিসেপশন থেকে সুদীপা জানাল মিসেস লীনা গোমেজ নামে এক ফরেইনার মহিলা তার সাথে দেখা করতে চান। “পাঠিয়ে দাও” বলে সোজা হয়ে বসল অঞ্জলী। সাথে সাথে সুইং ডোর ঠেলে লীনা গোমেজ ঢুকলো। অঞ্জলী দেখল দীর্ঘ এক হারা গড়নের একটা মেয়ে ঢুকছে। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। বয়স বড় জোর পচিশ কি ছাব্বিশ। ভরাট শরীর। তবে বেশভুষায় শালীন।
“আমি লীনা গোমেজ” পরিষ্কার বাংলায় বলল সে, “কেমন আছেন মিস চ্যাটাজি?”
“ভাল, আপনি কেমন আছেন? কোন কষ্ট হয়নিতো আসতে?” বিদেশী মানুষ দেখলে বাংগালীরা সাধারনত ইংরেজিতে কথা বলে। কিন্তু লীনা এমন ক্যাজুয়াল বাংলায় কথা বলছে যে, তার সাথে ইংরেজীতে কথা বলা তাকে অপমান করার শামীল। তবে সে তার বিস্ময় চেপে রাখলো না।
“আমি খুব অবাক হচ্ছি এবং গর্ববোধ করছি আপনাকে এমন সাবলীল বাংলা বলতে দেখে।”
“ও আচ্ছা” লীনা হাসলো, “আমার স্বামী আব্রাহাম গোমেজ ইন্ডিয়ান বাংগালী। তার কাছ থেকেই শেখা। এছাড়া পেশার কারণেও আমাকে নানা ভাষায় কথা বলতে হয়, নানা জায়গায় যেতে হয়। আমি এক জন ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক। এ মুহুর্তে টাইমসের হয়ে কাজ করছি”, লীনা তার এ্ক্রিডেশন কার্ড দেখাল।
“তা বলুন আমি আপনাকে কেমন করে সাহায্য করতে পারি?”
“আমরা আপনাদের আশ্রম নিয়ে একটা কাভার স্টোরি করতে চাই।”
“চা না কফি?” জবাব দেবার আগে অঞ্জলী জানতে চাইল । “আসলে আমাদের ম্যানেজমেন্ট প্রচার বিমূখ। আমরা খুব সেনসেটিভ মানুষদের নিয়ে কাজ করি। তাই মিডিয়াকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি।”
“কোন সমস্যা নেই। আমি স্টোরী তৈরী করার পর আপনাকে পড়তে দেব। যদি মনে করেন ছাপা হলে আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না তাহলেই কেবল ছাপা হবে।”
“সে ক্ষেত্রে আমাকে বোর্ডের সাথে কথা বলতে হবে।”
“সিওর, আসলে আমরা গত দুদিন আগে আপনার এখানে একবার ঘুরে গেছি। সব কিছু দেখে শুনে আব্রাহামতো খুবই ইমপ্রেসড।”
অঞ্জলীর ভ্রু কুচকালো। কিন্তু বুঝতে দিল না।
“আমি কাল পরশু একবার আপনাকে কল দেব।”
“কোথায় উঠেছেন?”
“ম্যাডিসনে”
“এদেশে প্রথম?”
“এখানে প্রথম, তবে সাব-কন্টিনেন্টের সবকটা দেশেই ঘুরেছি আমি। আব্রাহাম অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আর তেমন ট্রাভেল করি না।”
“আপনি কি আপনার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে নিউজ স্টোরী করতে আমেরিকা থেকে এখানে এসেছেন?”
“ঠিক সেরকম অসুস্থতা নয়। একটা গাড়ী দূর্ঘটনায় তার মাথার পিছনে আঘাত লাগে এবং তার পর থেকে সে চোখে দেখতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। তবে সব কিছু শুনতে পায়। শারিরীক ভাবে বা চলা ফেরায় কোন সমস্যা নেই। সব চে বড় কথা আমি আসবো জেনে সে আমার সংগী হয়েছে। অনেক দিন দেশে ফেরা হয় না। এমন একজনকে একা ছেড়ে দেয়া যায়?”
“হায় ভগবান! বলেন কি? তাকে নিয়ে আসবেন একবার। আমি তার সাথে কথা বলব।’
“অবশ্যই বলবেন। সে এখন আপনাদের একটা তীর্থস্থান কি যেন নাম..ও হ্যা কাশী। কাশীতে গেছে। তার কোন এক ক্লোজ রিলেটিভ সেখানে থাকেন। এলেই আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। আমি আজ উঠি মিস চ্যাটার্জি।”
লীনা হাত বাড়িয়ে দিল। হ্যান্ডসেক করলো দুজন। চোখে চোখে তাকিয়ে দুজন দুজনকে জরীপ করলো।
অঞ্জলী ফোন করে মঞ্জূ আর রোহিতকে নিউজ স্টোরীর বিষয়টা অবহিত করে। পরদিন বোর্ড মিটিং এ বসে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, নিউজ স্টোরী করার বিষয়ে অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে সেটা প্রকাশ করার আগে বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। খবরটা টেলিফোনে দেয়া যেত। কিন্তু একটা অদম্য কৌতুহল অঞ্জলীকে পেয়ে বসেছে। তার জানা দরকার লোকগুলি কে এবং কেনই বা তারা এত ইন্টারেস্টেড। সে গাড়ী নিয়ে সোজা ম্যাডিসনে চলে আসে। রিসেপশনে খোজ নিতেই মিঃ এন্ড মিসেস গোমেজ এর খোঁজ পেয়ে যায়। সরাসরি রুমে নক করে অঞ্জলী। দরজা খুলে দিয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠে লীনা। অঞ্জলীকে সে আশা করেনি।
“খুব সারপ্রাইজ দিলাম কেমন?” অঞ্জলী হাসতে হাসতে বলে।
“এক্সাক্টলি। আমি আপনাকে আশা করিনি। এনি ব্যাড নিউজ?”
“না না গুড নিউজ। বোর্ড পারমিশন দিয়েছে। তবে প্রকাশের আগে আমাদের দেখাতে হবে।”
“সে তো অবশ্যই”
“বাই দ্যা ওয়ে, মিঃ গোমেজকে দেখছি না?”
“ও এখনও ফেরেনি। ওয়েল মিস চ্যাটার্জি আনন্দ সংবাদ দেবার জন্য আমার মনটা খুব খুশী। ড্রিংকস চলবে?”
“না ধন্যবাদ।
“কফি বলি?
“ঠিক আছে।
লীনা জনি ওয়াকারের বোতল থেকে এক পেগ ঢেলে নিজে নিল। আর কফির কাপ অঞ্জলীকে এগিয়ে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে একধরণের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। লীনা এক মুহুর্তেই তার জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত সব কাহিনী হড় হড় করে বলে ফেললো। অঞ্জলী হাসলো। সেও তার সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানালো।
“ওয়েল মিস চ্যাটার্জী তাহলে আপনার এ গল্পও আমার বেশ কাজে লাগবে। কিছু ইনফরমেশন এখান থেকে নিতে পারবো। আমি সামারাইজ করছি। দেখুন কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা?”
“মিঃ রাজ শেখর রায় চৌধুরী রায় গ্রুপের সূত্রপাত করেন। এটা চরম সমৃদ্ধি লাভ করে মিসেস অনিন্দিতা রায় চৌধুরীর হাতে। তার পাঁচ ছেলে এক মেয়ে। ২২ জন নাতী নাতনী। তিনি তার স্ত্রী এবং ছেলেরা মৃত্যু বরণ করেছেন। নাতী নাতনীরা গ্রুপ চালাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ দেশের বাইরে আছেন। আশ্রমের চেয়ারম্যান বড় নাত বউ ম্যাডাম মঞ্জু । আপনি তার ছোট বোন। চেয়ারম্যানের পক্ষে আপনি কাজ করেন। আপনার স্ট্যাটাস কর্ম সচিব ধরণের। রায় গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের এমডিরা আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার। আমি ঠিক বলছি তো মিস চ্যাটার্জি?”
“হ্যা তুমি ঠিকই বলছো লীনা। আর শুন এসব মিস টিস বাদ দাও। তোমাকে বেশ কদিন কাজ করতে হবে। এত ফরমাল হলে চলবে কেন? আমাকে তুমি অঞ্জু বলবে।”
“ধন্যবাদ অঞ্জু। আচ্ছা আমি একজনকে মিস করে যাচ্ছি। তুমি সবার অবস্থান বলেছ। তবে তোমার ভাষায় ক্রাউন প্রিন্স অমিতাভ রায় চৌধুরীকে সীনে দেখছি না।”
“তিনি আমেরিকায় আছেন এটুকু জানি। তবে কেমন আছেন কি করছেন জানি না।”
“মাই গড। এত বছর ধরে একজন মানুষের ইনফরমেশন তোমরা কেউ জানো না?”
“ঠাকুরমার নিষেধ ছিল। তিনি যদি নিজে থেকে যোগাযোগ না করেন তবে যেন তাকে ডিস্টার্ব না করা হয়। প্রথম দিকে বিষয়টা এমনই ছিল। পরে আমার ধারণা এটা হয়ে গেছে অভিমান পাল্টা অভিমান।”
“বুঝলাম না।”
“পরিবারের লোকজন অভিমান করে আছে তার উপর আর তিনি অভিমান করে আছেন পরিবারের উপর।”
“তুমি তো যোগাযোগ করতে পারতে?
“আমি কেন করতে যাব?”
“কারণ আমি যদি বুঝতে ভুল না করি তার সাথে তোমার বন্ধুত্ব ছিল।”
“আমি তাদের কোম্পানীর একজন কর্মচারী মাত্র।”
“ড্রপ ইট। এস অন্য বিষয়ে কথা বলি।”
“হুম”
“তুমি এত সুন্দর একটা মেয়ে বিয়ে না করে জীবনটা পার করে দিলে কেন?”
“অপেক্ষা করে আছি।
“কার ? প্রিন্স অমিতের?”
“কে বলেছে তোমাকে আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি?”
“এটা জাস্ট আমার অনুমান।”
লীনার এখান থেকে বেরিয়ে অঞ্জলী খুব বোরিং ফিল করতে লাগলো। সে যে উদ্দেশ্যে এসেছিল সেটা পূরণ হয়নি। মেয়েটাকে নিছক সাংবাদিক বলেই মনে হচেছ। গত পনের বছরে সে অমিতের কোন হদীস করতে পারেনি। দিদি জামাই বাবুর এক কথা, ঠাকুরমা নিষেধ করে গেছেন আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করবো না। ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে অমিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড ইউজ করে লেনদেন করেন। তার বাহ্যিক কোন ঠিকানা তাদের জানা নেই। মরিয়া হয়ে বছর কয়েক আগে শুভর সাথে যোগাযোগ করেছিল ,শুভও বলতে পারে না অমিত কোথায় আছে।
অঞ্জলী খেয়াল করেছে অমিতের ভাগের কোম্পানীগুলো প্রায়ই লস করছে অথবা মিনিমাম প্রফিট করে টিকে আছে। ভাগ করার সময় প্রবলেমেটিক কোম্পানীগুলো অমিতকে দেয়া হয়েছে। টেক্সটাইল মিলটা ঠাকুরমা থাকতেও ভাল প্রফিট করেনি। এখন এটা প্রায় বেদখল হওয়ার পথে। এটা পড়েছে অমিতের ভাগে। রোহিতদা নির্ভেজাল ভালমানুষ। তিনি অমিতকে ঠকাবেন এটা মেনে নিতে তার মন সায় দেয় না। তার নিজের দিদি অবশ্য খাওয়া, শোওয়া আর সাজগোজের বাইরে কিছুই জানে না। কিন্তু অমিতের ব্যপারে সেও নিস্পৃহ।
শুভ্যেন্দুর সাথে বিয়েতে রাজী হয়নি অঞ্জলী। বাস্তবে সে কি অমিতের জন্য অপেক্ষা করছে? তার নিজের কাছেও প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই। সে অমিতের কয়েক বছরের সিনিয়র। * র ঘরের বিধবা মেয়ে। অমিতকে বিয়ে করার বাসনা নিতান্তই অবাস্তব স্বপ্ন। তা হলে সে কেন তার জীবন যৌবন এমন অবহেলায় অপচয় করছে? লীনা ধরে নিয়েছে সে অমিতের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু অমিতের কোন খবরই তো সে জানে না। বুকটা খচখচ করে তার।
মনে পড়ে কি ছেলে মানুষী আব্দার করতো অমিত। ধুম ব্যস্ত পড়া শুনার সময় একদিন ডেকে নিল ঘরে। অঞ্জলীর ধারণা ছিল হয়তো শারিরীক ভাবে তাকে চাইছে। সে মনে মনে খুশীও হয়েছিল। গুদ যদি ফাটাতেই হয় এমন তরুনের ধন দিয়ে ফাটানোই উচিত। সে তড়াক করে মূখটা আয়নায় দেখে নিল। এক পোচ লিপস্টিকি, চূলটায় চিরুনীর একটু ছোয়া দিয়ে ট্যাংক টপের উপর একটা চাদর জড়িযে তার ঘরে ঢুকেছিল। ঘরে ঢুকতেই বললো, “আমার টি শার্টটা খুলে দাও।” অঞ্জলী টি শার্ট খুলে দিল। তার ভিতরে শিহরন। আজই কি ঘটবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান? তার টি শার্ট খুলে দেবার সময় নিজের গায়ের চাদর ইচ্ছে করেই ফেলে দিল। শুধু ট্যাংক টপ পড়া অবস্থায় তাকে দেখেও অমিতের কোন ভাবান্তর হলো না। বলল,” আমার শিরদাড়াটা চুলকে দাও।” চুলকানো শেষ হতে বলল,” কিছু মনে করো না ঘুম ভাংগালাম। আসলে তোমাকে খুব দেখতে ইচেছ করছিল তাই। ঘুমোবার আগে তোমার মূখটা না দেখলে ঘুম আসে না,” বলেই শুয়ে পড়েছিল অমিত। “এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও।” অঞ্জলী মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আশা করছিল অমিত তাকে বুকের মাঝে টেনে নেবে। কিন্তু তা নেয়নি। পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে কাদা। একবুক হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছিল অঞ্জলী।
আজও কি এমনি ছেলে মানুষ আছে অমিত? এমনি সরল আর নিস্পৃহ?
এই দুই ফরেইনারের উদ্দেশ্যও বুঝতে পারছে না অঞ্জলী। শুধু মাত্র একটা কাভার স্টোরী করার জন্য দুইজন মানুষ আমেরিকা থেকে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে। কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। লীনার স্বামী লোকটাকে দেখতে পেলে ভাল হতো। চকিতে মনে পড়লো প্রথম দিন তাদেরকে গাইড করেছিল আশ্রমের যে মহিলা তার কথা। তার কাছ থেকে জানতে হবে । আশ্রমে ফিরে তাকে ডেকে আনলো অঞ্জলী। খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো সব কিছু। ঠাকুরমার ছবির সামনে দাড়িয়ে লোকটা চোখ মুছেছে এ তথ্যটা খচ করে বিধলো তাকে। একজন অচেনা লোক কেন ছবি দেখে কাঁদবে? তাছাড়া লীনার ভাষ্যমত সেতো অন্ধ ও বোবা। ছবি তো তার দেখতে পাওয়ার কথা নয়? আচ্ছা অমিত নয়তো? অমিত বিয়ে করে বউ নিয়ে নাম ভাড়িয়ে এখানে কি করছে? এটা তার বাড়ি তার ঘর? সে কেন লুকোচুরি খেলতে যাবে? সব কিছু মিলে অস্থির হয়ে পড়ে অঞ্জলী।
নিত্য দিনের মতো আজও শুরু হলো ভোর ছটায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে। ঠাকুর মা আর ঠাকুরদার ছবিতে ফুল দিয়ে ঠাকুরমার বেড রুমের তালা খুললো অঞ্জলী। প্রতিদিন নিয়ম করে সে এ ঘরটা খোলে। নিজের হাতে ঝাট দেয়, মুছে। এখানেও তাদের দুজনের দুটো ছবি আছে। আকারে কিছুটা ছোট। তবে মাঝখানে রয়েছে অমিতের ছবি। এই তিনটা ছবিতেও নিয়ম করে ফুলের মালা পরায় অঞ্জলী। আজ ঘরে ঢুকতেই একটা অন্যরকমের ঘ্রাণ পায় সে। সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে কেউ একজন ঢুকেছিল সন্দেহ নাই। ঘরটা তালা বদ্ধ। চাবি তার কাছে। কে ঢুকতে পারে?
অঞ্জলী বুঝতে পারছে অনাথ আশ্রম, রায় গ্রুপ এসবকে কেন্দ্র করে একটা কিছু ঘটছে। কিন্তু কি ঘটছে তা বুঝতে পারছে না। যা কিছুই ঘটুক অঞ্জলীকে ভয় পেলে চলবে না। এ বাড়ির নুন খেয়েছে সে। তাদের কোন ক্ষতি সে কোনভাবেই হতে দেবে না। আর যদি অমিতের স্বার্থের প্রশ্ন হয়, নিজের জীবন দিয়ে দেবে। যে সম্মান আর ভালবাসা এ ছেলেটির কাছ থেকে পেয়েছে তার জন্য জীবন দিতে একটুও কুন্ঠিত হবে না সে। ইচ্ছে করলেই সে অঞ্জলীকে যখন তখন ভোগ করতে পারতো। কিন্তু কোনদিন এমনকি খারাপ চোখে তাকায়নি পর্যন্ত। সব সময় আগলে রেখেছে। কেউ তাকে কোন ভাবে হার্ট করলে সরাসরি বুক পেতে দাড়িয়েঁছে। যুগের সাথে মিলে না এমন বিরল ধরণের ছেলে। তাই তো বুক বেধেঁ আজো অপেক্ষ্ করে আছে যদি কোনদিন ফিরে আসে?
কিন্তু ফিরে আসলেও তো অঞ্জলীর লাভ নেই। যদি এই দুই বিদেশী অমিত আর তার বউ হয় তাহলে অঞ্জলীর পনের বছরের অপেক্ষা শুধু আক্ষেপ হয়েই থাকবে। এতো শুধু মরিচীকার পেছনে ছুটা। তার স্বত্তা দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। অমিতের মত টগবগে তরুণ আজ অবধি বিয়ে না করে তার মত একটা বিধবার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে এমনটা আশা করাও তো ঠিকনা। সে তো কখনও বলেনি “অঞ্জলী আমি তোমাকে বিয়ে করবো।” আকারে ইংগিতেও বলেনি। তাকে পছন্দ করতো এটা বুঝা যায়। কিন্তু এমন পছন্দ এ বয়সে হাজারটা থাকতে পারে।
হাহাকার করা ঢেউ উঠে বুকের ভিতর। উথাল পাতাল ঢেউ। তার বুকের পাড় ভাংগে। হৃদয়ের ক্ষরণ তীব্র হয়। চোখ ঠিকরে আগুন আসে। জলতো শুকিয়েছে সেই কবে।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!