13-09-2020, 12:11 PM
ক্ষণিকের জন্য এই দৃশ্য দেখে দানার চোখ বেদনায় জ্বলে ওঠে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। দানা চোয়াল চেপে সেই বেদনা যুক্ত অনুভুতি গিলে ফেলে। এইখানে প্রতিশোধের খেলাতেই নামতে এসেছিল, এই চক্রান্ত সবাইকে নির্মূল করা। সঙ্গীতার চোখের জলের প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেছে। সুমিতা আর সমুদ্র জানতো নয়নার বাড়িতে সঙ্গীতাকে ;., করা হবে। বিমানের মৃত্যু, সঙ্গীতার প্রেমিক মৈনাকের মৃত্যুর প্রতিশোধ। বাপ্পা নস্কর আর বাকিদের মৃত্যু, ফারহানকে মারার প্রচেষ্টার প্রতিশোধ। চোয়াল চেপে নয়নাকে টেনে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। নয়না কিছুতেই সমুদ্রের মৃত দেহ ছেড়ে যাবে না। জোরে জোরে মাথা নাড়ায় নয়না, "আমাকে সনুর সাথে একটু থাকতে দাও দানা....."
ওর মুখ চেপে ধরে দানা। মাথা নাড়িয়ে বলে, "গুলির আওয়াজে কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামবাসী এইখানে চলে আসবে। একটু বুঝতে চেষ্টা কর, আমাদের এখুনি এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে না হলে আমরা ধরা পড়ে যাবো।"
নয়নাকে টানতে টানতে ওর গাড়ির দিকে নিয়ে যায়। গাড়ির দিকে যাওয়ার সময়ে একটা বেড়াল কাছে থেকেই ডেকে উঠলো। দানা পেছন ঘুরে ওই ঝোপের আড়ালের বেড়ালের দিকে দেখে ইশারায় জানিয়ে দিল এখন একটু কাজ বাকি।
ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নয়না অজ্ঞান হয়ে গেল। ওকে কোলে তুলে গাড়ির পেছনের সিটে শুইয়ে দিল দানা। নিজের গায়ে একটা সুতো নেই, নয়নার গায়ে সমুদ্রের রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। ফর্সা স্তন জোড়া রক্তে লাল হয়ে গেছে, বুকে পেটে রক্তে মাখামাখি। একবারের জন্য মনে হল এই রাতে একে এইখানে খুন করে চলে যায়। না, তাহলে মোহন খৈতান আর সিমোন খৈতানকে কি করে ধরবে? নয়নাকে টোপ হিসাবে ব্যাবহার করতে হবে ওই দুই ধূর্ত নর নারীকে ফাঁদে ফেলার জন্য।
মহুয়া কি ঘুমিয়ে পড়েছে? না প্রেয়সী ঘুমাতে পারে নি। নাছোড়বান্দা ফুলপরী, রুহি খুব বায়না ধরেছিল, "ডাডার সাথে ডিনার করবো।" মহুয়া অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্থ করে রুহিকে। বারেবারে মন বিচলিত হয়ে যায়, উড়ে চলে যায় দানার কাছে। কোথায় আছে, কি করছে, কেমন আছে? সিঁথিতে সিঁদুর পরানো বাকি, ওর ভাগ্যে কি সত্যি সেই সিঁদুর জুটবে? না এই রাত ওর অপেক্ষাতেই শেষ হয়ে যাবে আর এক রক্তিম বেদনা দায়ক সকালের দেখা দেবে। রুদ্ধশ্বাসে রাত জেগে বারান্দায় বসে থাকে। কি মুশকিল রে বাবা, সময় আর কাটতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা কেন একটু তাড়াতাড়ি চলে না? গলার নিচে খাবার কেন ঠিক ভাবে জল পর্যন্ত গলতে পারল না মহুয়ার। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে বারেবারে কিন্তু এই ছলছল চোখে কি করে রুহির সামনে যাবে?
দানা, গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয় যাতে নয়নার জ্ঞান ফিরলেও যেন গাড়ির বাইরে আসতে না পারে। বেশ কিছুক্ষণ ওইখানে দাঁড়িয়ে চাপা উত্তেজনা দমিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। চারপাশে সুন্দর ফুরফুরে বাতাস বয়ে চলে, এই বাতাস কি জানে এই কিছুক্ষণ আগে এই বাড়িতে মৃত্যুর তান্ডব হয়ে গেছে? মাথার ওপরে খোলা আকাশ, শত সহস্র তারা ঝিকিমিকি করছে। হঠাৎ মনে হল যেন ওই আকাশের কোন এক কোনায় একটা তারা একটু বেশি করে জ্বলজ্বল করে উঠল, ওইটা কি মৈনাক? আবার দরজা খুলে নয়নাকে দেখে নেয়। পেছনের সিটে নগ্ন নয়না তখন অজ্ঞান।
গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটো বেড়াল, দুটো কুকুর আর একটা পাখী ঝোপ ঝাড় থেকে বেড়িয়ে এলো। দানা মাথার ওপরে দুই আঙ্গুল ঘুরিয়ে ইশারা করে। নাড়ু আর শক্তি পিস্তল হাতে বাড়ির পেছনের দিকে দৌড়ে চলে যায়। বলাই, আকরাম আর নাসিরকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যায় দানা। আকরাম নিজের জামা খুলে দানার হাতে ধরিয়ে দেয়। দানা সেই জামা কোমরে বেঁধে নিজের লজ্জা ঢাকে। কারুর মুখে কোন কথা নেই, শুধু মাত্র চোখের ইঙ্গিতে আর হাতের ইশারায় কাজ করে চলে। বাড়ির সামনে সার দিয়ে তিনটে গাড়ি দাঁড়ানো। দানা ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় তিনটে গাড়ির পেট্রোল ট্যাঙ্ক খুলে পেট্রোল বের করে গাড়ির ওপরে ছড়িয়ে দিতে। নাসির আর বলাই সেই কাজে নেমে পড়ে। আকরাম দানাকে একজোড়া ডাক্তারের দস্তানা ধরিয়ে দেয় আর সেই সাথে কাপড়ে ঢাকা চপ্পল। এটা ওদের নিখুঁত পরিকল্পনার অঙ্গ, যাতে ঘরের মধ্যে কোথাও ওদের হাতের ছাপ না পড়ে।
আকরাম আর দানা খোলা পিস্তল হাতে পা টিপে টিপে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একপাশে নয়নার ড্রাইভারের মৃতদেহ, মাথা ফুটিফাটা হয়ে গেছে। অন্যপাশে দেবুর মৃতদেহ, ওর বুকে দুটো গুলি ওকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভাঙ্গা দরজার ঠিক মুখে একটা ছেলের মৃতদেহ, এটা নিতাইয়ের লোক। রক্ত বাঁচিয়ে এদিক ওদিক দেখে শোয়ার ঘরে ঢোকে। সাদা বিছানা, নগ্ন সুমিতা আর নগ্ন বিমানের রক্তে লাল হয়ে গেছে। দরজার কাছেই বাপ্পা নস্করের প্রাণহীন দেহ। দানা খুঁজে খুঁজে নিজের জামা কাপড়, মোবাইল পার্স আর নয়নার পোশাক পার্স মোবাইল জুতো হাতে তুলে নেয়। এইসব পোশাক এইখানে একদম রাখা চলবে না, পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রামকে নির্দেশ দেয় বাথরুমে জল ঢেলে পরিষ্কার করে দিতে। পেছনের দরজা দিয়ে নাড়ু আর শক্তি ঘরে ঢুকে জানিয়ে দেয় সবাই শেষ, কেউ বেঁচে নেই। শক্তি, আক্রামের সাথে বাথরুম ধুতে চলে যায়। দানা ঘরের এপাশ ওপাশ ভালো ভাবে দেখে যেখানে যেখানে হাত রেখেছিল বলে মনে হয় সেই সব জায়গা মুছে ফেলে। ঘরের অনেক জায়গায় নিশ্চয় নয়নার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে কিন্তু নিরুপায় অত শত ধোয়া মোছার সময় ওদের হাতে নেই। চারপাশে রক্তের ছড়াছড়ি, খুব বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে পা ফেলে এগোতে হয় ওদের, পাছে কোথাও রক্তের মধ্যে পা পড়ে গেলে সমস্যায় পরে যাবে। মৃত সাতজনের ছাড়া আর কারুর ছাপ এই বাড়িতে রাখতে চায় না। তার চেয়ে ভালো পেট্রোল ঢেলে গাড়ি বাড়ি সব পুড়িয়ে ফেলা। হাতের ছাপ পাওয়া মুশকিল হবে, কিন্তু এই মৃতদেহ গুলো পুলিসের হাতে পড়ে যাবে।
নিঃশব্দে আর রুদ্ধশ্বাসে সবাই তড়িৎ গতিতে নিজেদের কাজ সারে। নাসির আর বলাই পেট্রোলের ক্যান নিয়ে বাড়ির মধ্যে আর বাড়ির চারদিকে ছিটিয়ে দেয়। বাথরুম থেকে একটা তোয়ালে নিয়ে কোমরে জড়িয়ে দেয় দানা। নিজের পোশাক আর নয়নার পোশাক রক্তে ভিজে গেছে ওই পোশাক আর পরা যাবে না। নয়নার জন্য আরো একটা তোয়ালে নিয়ে নেয়। আকরাম শক্তি জানিয়ে দেয় কাজ শেষ।