12-09-2020, 09:50 AM
পর্ব পাঁচ। রাগ অনুরাগ (#9-#34)
নাগের বাজারের দিকে যেতে যেতে দিয়ার কথাতে ওদের বাড়ির সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলো অভি। দিয়াদের বাড়িটা ঠাকুরদার আমলের, শুধু নিচের তলা বানানো ছিল। নিচের তলা দুই ভাগে ভাগ হয়, একপাশে দিয়ার পরিবার অন্যপাশে জেঠু। ওপরের তলায়, দুই কাকা ছোট ছোট ফ্লাট বানিয়ে আছে। খুড়তুতো জ্যাঠতুতো মিলিয়ে ওরা প্রায় জনা দশেক ভাই বোন। দিয়ার দাদা সৈকত, বেড়াচাপায় একটা হেলথ সেন্টারে চাকরি করে। দাদার প্রেমিকা, পৌলমি বিরাটিতে থাকে, একটা নার্সারি কলেজে চাকরি করে। আগে পৌলমিকে বেশ ভালো লাগতো, কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে যে বিয়ের পর আলাদা হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে, সেদিন থেকে পৌলমিকে একদম দেখতে পারে না দিয়া। দাদার ইচ্ছে বিয়ে করার, কিন্তু বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত নিজে বিয়ে করতে পারছে না। বাড়িতে বাড়তি কোন ঘর নেই, নতুন কোন রুম তৈরি করার জায়গাও নেই। ওর দাদার আলাদা বাড়ি তৈরি করার অথবা বাড়ি ভাড়া করে চলে যাওয়ার ক্ষমতা এখন সেই ভাবে হয়নি। সেইজন্য ওর দাদা দিয়ার বিয়ের অপেক্ষায় আছে। দিয়ার গল্প শুনতে শুনতে অভি মনে মনে হেসে ফেলে, মেয়েটা এক মিনিটের জন্য চুপ করে থাকতে পারে না। তবে এই গলা না শুনলে মনে হয় কিছু যেন পায়নি, দিনটা যেন অসমাপ্ত থেকে গেল। কতদিন হল, মনে হয় দিন পাঁচেক হয়েছে শুধু মাত্র, তাও যেন মনে হয় কতদিনের চেনা।
সাতগাছি পেরিয়ে দিয়াকে জিজ্ঞেস করে, “এবারে কোথায়?”
দিয়া, “ওই মলের পারকিং এ বাইক পার্ক কর, তারপর ঘুরবো।”
অভি ওকে বলল, “তুমি এখানে দাঁড়াও আমি তাহলে বাইক পার্ক করে আসছি।”
বাইক থেকে নেমে দিয়া বলে, “ঠিক আছে আমি তাহলে ভেতরে থাকবো।”
বাইক থেকে নেমে, সারা শরীরে এক হিল্লোল তুলে এক প্রকার নাচতে নাচতে মলের দিকে এগিয়ে গেলো দিয়া। পেছন থেকে দিয়ার চলন দেখে অভির বুকের মধ্যেও উষ্ণ রক্ত নাচতে শুরু করে দেয়। চাপা জেগিন্স ভারী সুগোল নিতম্বের সাথে রঙের প্রলেপের মতন লেপটে গেছে। ভাগ্যিস জেগন্সের কাপড় একটু মোটা ধরনের না হলে হয়ত নিতম্বের সাথে এঁটে বসা প্যান্টির দাগটাও পেছন থেকে দেখা যেত। আজকাল অনেক মেয়েরা এত চাপা লেগিন্স পরে বের হয় যে, ওদের ভারী নিতম্বের ওপরে জেঁকে বসা প্যান্টির দাগ পেছন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। দিয়ার চলন, উচ্ছল প্রজাপতির মতন, এক লাল রঙের প্রজাপতি নিজের খেয়ালে বাতাসে উড়ে চলেছে। গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ার আগে একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে অভির দিকে তাকায় দিয়া। অভি তখন ওইখানে দাঁড়িয়ে দিয়ার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই দেখে দিয়া ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে ইশারায় জানায়, তাড়াতাড়ি আসো না হলে কপালে দুঃখ আছে। মাথা নাড়াল অভি, মলের পারকিঙ্গে বাইক রেখে মলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কোথায় দিয়া, বলেছিল গেটের কাছেই কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটা সত্যি মাঝে মাঝে কোথায় যে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষন পরে দিয়া বেড়িয়ে এলো মেয়েদের ওয়াশরুম থেকে। হেলমেট পরে চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, সেই গুলো আবার আঁচরে, লম্বা চুল মাথার ওপরে একটা হেয়ারব্যান্ড দিয়ে আটকে নিয়েছে।
কাছে এসে অভির ডান হাত ধরে বলে, “চলো।”
অভি জিজ্ঞেস করে, “কোথায়?”
দিয়া মুচকি হেসে বলে, “দেখা যাক কোথায়। তবে মলের বাইরে চলো।”
অবাক হয়ে যায় অভি, “বাইক?”
দিয়া হেসে ফেলে, “ধ্যাত ছেলে, এখানে বাইক পার্ক করে অনেকে বাইরে শপিং করে।”
অভি, “হুম বুঝলাম।”
দিয়ার নরম আঙ্গুল অভির কঠিন আঙ্গুলের সাথে পেঁচিয়ে যায় ততক্ষনে। হাতের মধ্যে আলতো চাপ দিয়ে মিষ্টি করে বলে, “বুবু, এই সব বুদ্ধি আইআইটি তে শেখায় না, এই সব শেখার জন্য পাড়ার কলেজ আছে।” বলেই ফিক করে হেসে ফেলে।
অভি হেসে বলে, “তার জন্য তুমি আছো তো।”
দিয়া, “একদম শতকরা সঙ্গে আছি।”
কথা বলতে বলতে মল থেকে বেড়িয়ে পরে ওরা। পঁচিশে ডিসেম্বর আসতে আর দিন দশেক বাকি, রাস্তায় বেশ ভিড়, লোকজন কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছে। বেশির ভাগ যুবক যুবতী, হাতে হাত রেখে প্রেমে মগ্ন। দুইজনেই বেশ ঘন হয়ে হাতে হাত রেখে এদিকে ওদিকে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে।
দিয়া জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, দিদি কি কাল চলে যাবে?”
অভি, “হুম।”
দিয়া, “কখন ফ্লাইট?”
অভি, “বিকেলের ফ্লাইট।”
দিয়া, “আমি আসতে পারি সি অফ করতে?”
অভি হেসে ফেলে, “না এখুনি নয়। পাপা থাকবে, তার ওপরে শিতাভ্রর বাড়ির লোকজন থাকবে। এই অবস্থায় তোমার না আসাটা বেটার হবে।”
আবদারটা করার পরে দিয়া বুঝতে পারে যে এটা ঠিক হয়নি। ওদের ব্যাপারে এখন শুধুমাত্র অভির মা আর অভির দিদি জানে, ওইভাবে এয়ারপোর্টে গেলে সবাই জেনে যাবে বুঝে যাবে, সেটা যুক্তি সঙ্গত হবে না। দিয়া ছোট উত্তর দেয়, “আচ্ছা।”
অভি খানিক পরে জিজ্ঞেস করে, “লেখা বা ঝন্টু কি এরমাঝে তোমাকে ফোন করেছিল?”
ঝন্টুর নাম শুনেই দিয়ার চেহারার ভাব বদলে যায়। দিয়া চোয়াল চেপে সেই ভাব লুকিয়ে নিয়ে বলে, “হ্যাঁ গতকাল দুপুরের দিকে ঝন্টু ফোন করেছিল।”
অভি, “গতকাল এই কথা আমাকে বলনি তো?”
দিয়া, “না এমনি বলিনি।”
অভি প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে আমাকে বলবে না?”
দিয়া মাথা নাড়ায়, “না কিছু হয়নি।”
দিয়ার শুকনো মুখ দেখে অভি বুঝতে পারে যে কিছু একটা হয়েছে আর সেটা দিয়া বলতে চাইছে না। লেখার সাথে দিয়ার খুব গভীর বন্ধুত্ত, তবে মাঝেমাঝে এই গভীর বন্ধুত্তেও চিড় ধরতে পারে, হয়ত কোন এক ভুল বোঝাবুঝি। দিয়ার চেহারায় হটাত করেই কালো মেঘের ছায়া অভিকে ভাবিয়ে তোলে।
একপ্রকার আধিকারের সুরেই জিজ্ঞেস করে দিয়াকে, “কি হয়েছে?”
দিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই উত্তর দেয়, “বলছি তো কিছু হয়নি। আমার সব বিষয়ে তোমার এত প্রশ্ন কিসের?”
অভি দমে যায় কথাটা শুনে, “বেশ তাহলে। উত্তর যখন দেবে না তাহলে হাত ধরেছ কেন? একা একা চলতে পারো তো।”
দিয়া, “এখানে দাঁড়িয়ে কি ঝগড়া করবে নাকি?”
অভি, “আমি ঝগড়া করব বলে আসিনি, দিয়া।”
অভির হাতের মুঠো থেকে একটা ঝটকা দিয়ে দিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। হাতটা ছাড়ানোর সময়ে বুকের মধ্যে ভীষণ কষ্ট হয়, আসলে অভিকে এই ফোনের ব্যাপারে জানাতে চাইছিল না। যতহোক লেখা ওর বান্ধবী মাত্র, কিন্তু অভির খুব কাছের আত্মীয়।
হাত ছাড়িয়ে হাঁটা থামিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি জেনে কি করবে?”
চোয়াল চেপে উত্তর দেয় অভি, “দরকার আছে। তোমার চোখ ভীষণ ভাবে কথা বলে, দিয়া। কিছু একটা তো হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি।” দিয়া মাথা নিচু করে নেয়। অভি ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “এইভাবে মাঝপথে হাত ছেড়ে দেবো বলে এই হাত ধরিনি, দিয়া।”
কথাটা ভীষণ সত্যি, দিয়ার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা এই কথার তাৎপর্য ভালো করে বোঝে। ক্ষনিকের জন্য দৃষ্টি বাষ্পীভূত হয়ে আসে, সেটা সামলে নিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “ওই যে টাকা দিয়েছিল সেই নিয়ে আর কি।” অভি ভুরু কুঁচকে দিয়ার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। দিয়া বলে, “এখন পনেরো হাজারের মতন বাকি।” বলে থেমে যায়।
অভি জিজ্ঞেস করে, “সেটা জানি, তারপর?”
কাঁচুমাচু মুখ করে মাথা নাড়ায় দিয়া, “প্লিজ বুবু, আমি চাই না আমার জন্য তোমার আর ঝন্টুর মধ্যে কোন মনোমালিন্য হোক।”
কথাটা শুনে অভির চোয়াল কঠিন হয়ে যায়, “সেটা পরের কথা। আমি জানতে চাই তারপর কে কি বলেছে।”
গলা শুকিয়ে আসে দিয়ার, “কালকে জানো, ঝন্টু সেটা কথায় কথায় আমাকে একটু শুনিয়ে দিল।”
অভি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “লেখা জানে এইসব?”
দিয়া মাথা নাড়ায়, “না মানে, লেখা শুধু এইটুকু জানে যে ঝন্টু আমাকে টাকা দিয়েছে। বাকি কিছু জানে না।”
অভি অবাক, “মানে? লেখা জানে না এমন কি করে হয়?”
দিয়া বুক ভিরে শ্বাস নিয়ে বলে, “কোথাও বসে কথা বলি?” অভির পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলে, “প্লিজ এইভাবে হাত ছেড়ো না।”
অভি চাপা কঠিন কণ্ঠে বলে, “এরপর যা জিজ্ঞেস করব তার সোজা উত্তর দেবে। না হলে...”
বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে অভির হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
অভি স্মিত হেসে দিয়ার ম্লান চেহারা দেখে বলে, “এই সুনু, আমি আছি তো।”
দিয়ার চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে, “জানি তো তাই মাঝে মাঝে বড্ড ভয় হয়।”
একটা রেস্টুরেন্তে বসে কোল্ড কফির অর্ডার দিয়ে দিয়া বলতে শুরু করে, “জানো, লেখা খুব নরম গোচরের মেয়ে। একটু চুপচাপ থাকতে ভালোবাসে, মনের মধ্যে কুটিলতা নেই। সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলে। আমার এই মেকআপ আর্টিস্ট হওয়ার পেছনে ওর কিছু অবদান আছে। ওর বিয়ের পরে, ঝন্টুকে বলে আমার মেক আপ কেনার জন্য পঞ্চাস হাজার টাকা দিয়েছিল। আমি প্রথমে নিতে চাইনি, এক প্রকার জোর করেই লেখা আমাকে সেই টাকা দিয়েছিল। ও আমাকে দিয়েছিল বন্ধুত্তের খাতিরে, কন ধার হিসাবে নয়, তাই কোনদিন আমার কাছ ফেরত চায়নি। টাকাটা লেখা নিজে হাতে দেয়নি, দিয়েছিল ঝন্টু। টাকা পাওয়ার পরে আমি অবশ্য লেখাকে জানিয়েছিলাম যে ঝন্টু আমাকে টাকা দিয়েছে। তবে টাকা দেওয়ার আগে ঝন্টুর প্রচুর প্রশ্ন। কোথায় খরচ করবে, কি ভাবে খরচ করবে। ব্যাবসায়ি মানুষ, এমন প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক সেটা বুঝতেই পেরেছিলাম। সেই ভেবেই আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি সব টাকা ফেরত দিয়ে দেবো। আমি চাইনি আমার জন্য লেখার মান সন্মান ওর শ্বশুর বাড়ির সামনে নিচু হয়ে যাক।” অভি চুপ করে দিয়ার কথা গুলো শুনে যায়। দিয়া হাতের নখ খুটতে খুটতে বলে, “এখন পনেরো বাকি। সেটা আর শোধ করতে পারছি না। কিছুতেই সেই ভাবে টাকা জমাতে পারি না, জানো। শুধু বিয়ের সিজেনে একটু বেশ কিছু আয় হয় আর বাকি গুলোতে সেইভাবে কিছুই আসে না। বাকি মাস গুলোর কথা ভেবে আমাকে খরচ করতে হয়। কিছু একটা কেনার আগে অনেক ভাবতে হয়। বাবার কাছে কতদিন এইভাবে হাত পাতা যায় বলো।”
অভি জিজ্ঞেস করে, “ঝন্টু কি বলেছে?”
দিয়া অভির দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, “গতকাল দুপুরে ফোন করে বলে...”
অভি, “কি বলে?”
দিয়া, “এখন আসল ফেরত দিতে পারিনি, এরপর নাকি সুদ চাই।”
অভি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
দিয়া অন্য দিকে মুখ ঘুড়িয়ে বলে, “জানি না।”
অভি হেসে ফেলে, “আরে হয়ত তোমার সাথে ইয়ারকি মেরেছে।”
দিয়া নিজের থমথমে চেহারায় হাসি ফুটিয়ে বলে, “হ্যাঁ তাই হবে।” একটু থেমে কোল্ড কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তুমিও তো লেখার সাথে ইয়ার্কি ঠট্টা করো?”
অভি মুচকি হসে মাথা দোলায়, “হুম, ভীষণ ভাবেই করি। সম্পর্কে বৌদি তায় আবার আমার চেয়ে একটু ছোট আবার ঝন্টুর বৌ, সেই হিসাবে বেশ করি।”
ম্লান হাসে দিয়া, “আমিও প্রথমে ঝন্টুর ইয়ার্কি ঠট্টা ঠিক সেই ভাবেই ভাবতাম...” বলতে বলতে থেমে গেল দিয়া।
দিয়ার থমথমে চেহারা আর ম্লান হাসির অর্থ ভীষণ ভাবেই অভিকে ভাবিয়ে তোলে। ঝন্টুর ব্যাপারে ঠিক কি বলতে চাইছে দিয়া? মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন, সব না হলেও ঝন্টুর চরিত্র সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল, তবে বৌয়ের বান্ধবীর সাথে ইয়ার্কি ঠাট্টা চলতেই পারে। কিন্তু দিয়ার চোখের ভাষা অন্য কিছু একটা বলতে চাইছে।
অভি ওর থুঁতনি ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, “এখন ঝন্টুকে একটা ফোন করতে পারো?”
দিয়া চাপা আঁতকে ওঠে, “নাহ... তুমি পাগল হলে নাকি?”
অভি চোয়াল চেপে বলে, “তুমি ফোন কর, ও কি বলে আমি শুনতে চাই। স্পিকারে দেবে আর কল রেকরডিং করবে।”
একটু ইতস্তত করে দিয়া, তারপর ঝন্টুকে রিং করে। মোবাইল টেবিলে রেখে স্পিকার চালিয়ে দেয়। অন্যপাশ থেকে ঝন্টু একটু পরে ফোন উঠিয়ে বলে, “কি হল কি ব্যাপার?”
দিয়া ঠোঁটে মেকি হাসি মাখিয়ে বলে, “না এমনি। মানে লেখার ফোন পাচ্ছিলাম না তাই তোমাকে ফোন করলাম।”
ঝন্টুর কণ্ঠে একটু চটুল হাসি, “আচ্ছা, তাই নাকি? না কি আমার কথা মনে পরে গেল?”
ঝন্টুর হাসি শুনে অভির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দিয়া একবার অভির দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “যে রকম ভাববে সেটাই।” একটু থেমে বলে, “তুমি গতকাল সুদের কথা বলছিলে।”
ঝন্টু গলা নামিয়ে বলে, “হ্যাঁ, বল।”
দিয়া একবার অভির কঠিন চেহারার দিকে তাকিয়ে, মেকি চটুল হেসে ঝন্টুকে উত্তর দেয়, “হিসেব করলে কি, কতটা সুদ হয়?”
ঝন্টু নচু গলায় বলে, “ক্যাশ না কাইন্ড (নগদ না অন্যকিছু)?”
কথাটা কানে যেতেই অভির হাত মুঠো হয়ে যায়, ইচ্ছে করে এখুনি নৈহাটি গিয়ে ঝন্টুর কলার ধরে কানের গোড়ায় কষিয়ে একটা চড় দিতে। কোন মতে রাগ গিলে নেয় অভি। অভির রক্ত লাল চোখ দেখে দিয়ার ভয় হয়, ওর হাত চেপে ধরে শান্ত করে ঝন্টুকে উত্তর দেয়, “কি চাই তোমার?”
ঝন্টু চাপা হেসে উত্তর দেয়, “কি হিসাবে দিতে পারবে? আমার দুটোতেই চলবে।”
অভি ফোনের স্পিকার চেপে ধরে দিয়াকে ইশারা করে ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করতে যে কাইন্ডে ঠিক কি চায় সেটা জিজ্ঞেস করুক। হাজার প্রশ্ন নিয়ে অভির দিকে তাকায়। অভি অভয় দিয়ে দিয়াকে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলে। অভি জানতে চায় ঝন্টুর আসল অভিসন্ধি।
দিয়া মেকি চটুল হেসে ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা কাইন্ডে দিলে কি রকম কাইন্ড চাই তোমার?”
এই কথা শুনে ঝন্টুর জিবে যেন জল চলে এলো, “সত্যি বলছ?”
দিয়া অভির দিকে একবার তাকিয়ে ফোনের উত্তর দেয়, “হ্যাঁ...”
ঝন্টু চাপা হেসে বলে, “বেশ তো কবে দিতে চাও?”
দিয়া চোয়াল চেপে উত্তর দেয়, “কি চাও, কবে চাও খুলে বল?”
ঝন্টু, “এর পরের মঙ্গলবার হতে পারে?”
দিয়া জিজ্ঞেস করে, “কি হতে পারে?”
ঝন্টু একগাল হেসে বলে, “ন্যাকা সেজো না দিয়া। তুমিও জানো আমি কি চাই আমিও জানি তোমার মনের কি ইচ্ছে।”
দিয়া, “না, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কি বলতে চাইছ, একটু খুলেই বল না।”
ঝন্টু, “এই একটু কাছাকাছি আসা এই আর কি। তুমি তো এমনিতে কাছেই আসো না আজাকাল, টাকা দেওয়ার পরে একদম হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছো।” দিয়া একটা মেকি হাসি দেয়। ঝন্টু বলে, “পরের মঙ্গলবার আমরা তাহলে এই এক নম্বর গেটের কাছের কোন হোটেলে মিট করতে পারি। তারপর সেখানে দুজনে মিলে একটু গল্প গুজব একটু হুইস্কি একটু মজা করব এই আর কি। ওহ, হ্যাঁ, তুমি প্লিজ একটা হট প্যান্ট নিয়ে এসো। উফফফ তোমার ওই মোটা মোটা থাই গুলো...”
এইভাবে অভির সামনে অন্য কেউ ওর শরীরের বর্ণনা দিচ্ছে কানে যেতেই দিয়ার কান লাল হয়ে যায়। অভির রক্ত চক্ষু দেখে দিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টুকে থামিয়ে দেয়, “হ্যাঁ আমি সব বুঝে গেছি। দেখছি কি করা যায়...”
ঝন্টুর শেষ কথাটা শুনে অভি আহত ময়াল সাপের মতন ভীষণ ভাবেই ফুঁসতে শুরু করে দেয়। কথা গুলো যেন অভির কানের মধ্যে লাভা বইয়ে দেয়। ঝন্টুর এত বড় সাহস যে এই নোংরা ভাষায় দিয়াকে এইভাবে অপমান জনক কথাবার্তা বলবে? ওর চোয়াল কঠিন হয়ে যায়। দিয়া চোখ বুজে দুই হাতের মধ্যে অভির হাত দুটো শক্ত করে ধরে থাকে। চেহারায় কাতর মিনতি, এই তোমার মামাতো ভাইয়ের আসল রূপ। অভি মাথা ঝাঁকিয়ে চাপা গর্জে ওঠে, শালাকে আমি মেরে ফেলবো। দিয়া ওকে ক্ষান্ত করে, প্লিজ বুবুসোনা শান্ত হও। অভি চোয়াল চেপে ঝন্টুকে বলতে বলে যে ও টাকা দিয়ে দেবে। অভির একাউন্টে এই হাজার পঞ্চাসের মতন পরে রয়েছে, বড়দি কিছু দিয়ে গেছে, তার কিছু দিয়াকে দিয়ে দেবে।
লজ্জায় অপমানে দিয়ার কান গাল সারা চেহারা লাল হয়ে গেছে। ঝন্টুর সাথে বিন্দু মাত্র কথা বলার ইচ্ছে নেই তাও অভির কথা মেনে ঝন্টুকে বলে, “আচ্ছা পরের মঙ্গলবার তো হবে না, আমার একটা কাজ আছে। মানে বুঝতেই পারছো এখন পুরো বিয়ের সিজেন চলছে। প্রচন্ড ব্যাস্ত।”
ঝন্টু শীতল চাপা গলায় বলে, “অনেকদিন হয়ে গেল কিন্তু দিয়া...”
দিয়া, “সরি, সে আমি জানি, কিন্তু এই মাসে সত্যি খুব বিজি থাকবো। তোমার যদি নেহাত এখন চাই তাহলে ক্যাশ দেবো...”
ঝন্টু হেসে ফেলে, “আরে আরে কি হল, একদম আসতে পারবে না নাকি?”
দিয়া চাপা কঠোর কণ্ঠে উত্তর দেয়, “না গো, এই মাসে একদম সম্ভব নয়। তোমার ইন্টারেস্ট কত হয় বল, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি শোধ করে দেবো।”
ঝন্টুর কণ্ঠে নিরুচ্ছাস যেন কিছু ওর নাগাল থেকে হাত ফসকে বেড়িয়ে গেল, “ওহ, আচ্ছা। তাহলে এই দশ হাজারের মতন হয়... কবে দিচ্ছো তাহলে?”
দিয়া, “একটু সময় দাও, এই মাসের মধ্যে পনেরো দিয়ে দেব। বাকিটা একটু পরে।”
ঝন্টু ছোট উত্তর দেয়, “ফারস্ট জানুয়ারির মধ্যে দিয়ে দিও তাহলে।”
দিয়া, “হুম, আচ্ছা আজকে রাখছি।”
ঝন্টু আহত কণ্ঠে হেসে বলে, “লেখাকে ফোন করবে না?”
দিয়া মেকি হেসে উত্তর দেয়, “হুম পরে করব।”
নাগের বাজারের দিকে যেতে যেতে দিয়ার কথাতে ওদের বাড়ির সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলো অভি। দিয়াদের বাড়িটা ঠাকুরদার আমলের, শুধু নিচের তলা বানানো ছিল। নিচের তলা দুই ভাগে ভাগ হয়, একপাশে দিয়ার পরিবার অন্যপাশে জেঠু। ওপরের তলায়, দুই কাকা ছোট ছোট ফ্লাট বানিয়ে আছে। খুড়তুতো জ্যাঠতুতো মিলিয়ে ওরা প্রায় জনা দশেক ভাই বোন। দিয়ার দাদা সৈকত, বেড়াচাপায় একটা হেলথ সেন্টারে চাকরি করে। দাদার প্রেমিকা, পৌলমি বিরাটিতে থাকে, একটা নার্সারি কলেজে চাকরি করে। আগে পৌলমিকে বেশ ভালো লাগতো, কিন্তু যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে যে বিয়ের পর আলাদা হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে, সেদিন থেকে পৌলমিকে একদম দেখতে পারে না দিয়া। দাদার ইচ্ছে বিয়ে করার, কিন্তু বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত নিজে বিয়ে করতে পারছে না। বাড়িতে বাড়তি কোন ঘর নেই, নতুন কোন রুম তৈরি করার জায়গাও নেই। ওর দাদার আলাদা বাড়ি তৈরি করার অথবা বাড়ি ভাড়া করে চলে যাওয়ার ক্ষমতা এখন সেই ভাবে হয়নি। সেইজন্য ওর দাদা দিয়ার বিয়ের অপেক্ষায় আছে। দিয়ার গল্প শুনতে শুনতে অভি মনে মনে হেসে ফেলে, মেয়েটা এক মিনিটের জন্য চুপ করে থাকতে পারে না। তবে এই গলা না শুনলে মনে হয় কিছু যেন পায়নি, দিনটা যেন অসমাপ্ত থেকে গেল। কতদিন হল, মনে হয় দিন পাঁচেক হয়েছে শুধু মাত্র, তাও যেন মনে হয় কতদিনের চেনা।
সাতগাছি পেরিয়ে দিয়াকে জিজ্ঞেস করে, “এবারে কোথায়?”
দিয়া, “ওই মলের পারকিং এ বাইক পার্ক কর, তারপর ঘুরবো।”
অভি ওকে বলল, “তুমি এখানে দাঁড়াও আমি তাহলে বাইক পার্ক করে আসছি।”
বাইক থেকে নেমে দিয়া বলে, “ঠিক আছে আমি তাহলে ভেতরে থাকবো।”
বাইক থেকে নেমে, সারা শরীরে এক হিল্লোল তুলে এক প্রকার নাচতে নাচতে মলের দিকে এগিয়ে গেলো দিয়া। পেছন থেকে দিয়ার চলন দেখে অভির বুকের মধ্যেও উষ্ণ রক্ত নাচতে শুরু করে দেয়। চাপা জেগিন্স ভারী সুগোল নিতম্বের সাথে রঙের প্রলেপের মতন লেপটে গেছে। ভাগ্যিস জেগন্সের কাপড় একটু মোটা ধরনের না হলে হয়ত নিতম্বের সাথে এঁটে বসা প্যান্টির দাগটাও পেছন থেকে দেখা যেত। আজকাল অনেক মেয়েরা এত চাপা লেগিন্স পরে বের হয় যে, ওদের ভারী নিতম্বের ওপরে জেঁকে বসা প্যান্টির দাগ পেছন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। দিয়ার চলন, উচ্ছল প্রজাপতির মতন, এক লাল রঙের প্রজাপতি নিজের খেয়ালে বাতাসে উড়ে চলেছে। গেটের মধ্যে ঢুকে পড়ার আগে একবার ঘাড় ঘুড়িয়ে অভির দিকে তাকায় দিয়া। অভি তখন ওইখানে দাঁড়িয়ে দিয়ার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই দেখে দিয়া ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে ইশারায় জানায়, তাড়াতাড়ি আসো না হলে কপালে দুঃখ আছে। মাথা নাড়াল অভি, মলের পারকিঙ্গে বাইক রেখে মলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কোথায় দিয়া, বলেছিল গেটের কাছেই কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটা সত্যি মাঝে মাঝে কোথায় যে হারিয়ে যায়। কিছুক্ষন পরে দিয়া বেড়িয়ে এলো মেয়েদের ওয়াশরুম থেকে। হেলমেট পরে চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, সেই গুলো আবার আঁচরে, লম্বা চুল মাথার ওপরে একটা হেয়ারব্যান্ড দিয়ে আটকে নিয়েছে।
কাছে এসে অভির ডান হাত ধরে বলে, “চলো।”
অভি জিজ্ঞেস করে, “কোথায়?”
দিয়া মুচকি হেসে বলে, “দেখা যাক কোথায়। তবে মলের বাইরে চলো।”
অবাক হয়ে যায় অভি, “বাইক?”
দিয়া হেসে ফেলে, “ধ্যাত ছেলে, এখানে বাইক পার্ক করে অনেকে বাইরে শপিং করে।”
অভি, “হুম বুঝলাম।”
দিয়ার নরম আঙ্গুল অভির কঠিন আঙ্গুলের সাথে পেঁচিয়ে যায় ততক্ষনে। হাতের মধ্যে আলতো চাপ দিয়ে মিষ্টি করে বলে, “বুবু, এই সব বুদ্ধি আইআইটি তে শেখায় না, এই সব শেখার জন্য পাড়ার কলেজ আছে।” বলেই ফিক করে হেসে ফেলে।
অভি হেসে বলে, “তার জন্য তুমি আছো তো।”
দিয়া, “একদম শতকরা সঙ্গে আছি।”
কথা বলতে বলতে মল থেকে বেড়িয়ে পরে ওরা। পঁচিশে ডিসেম্বর আসতে আর দিন দশেক বাকি, রাস্তায় বেশ ভিড়, লোকজন কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছে। বেশির ভাগ যুবক যুবতী, হাতে হাত রেখে প্রেমে মগ্ন। দুইজনেই বেশ ঘন হয়ে হাতে হাত রেখে এদিকে ওদিকে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে।
দিয়া জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, দিদি কি কাল চলে যাবে?”
অভি, “হুম।”
দিয়া, “কখন ফ্লাইট?”
অভি, “বিকেলের ফ্লাইট।”
দিয়া, “আমি আসতে পারি সি অফ করতে?”
অভি হেসে ফেলে, “না এখুনি নয়। পাপা থাকবে, তার ওপরে শিতাভ্রর বাড়ির লোকজন থাকবে। এই অবস্থায় তোমার না আসাটা বেটার হবে।”
আবদারটা করার পরে দিয়া বুঝতে পারে যে এটা ঠিক হয়নি। ওদের ব্যাপারে এখন শুধুমাত্র অভির মা আর অভির দিদি জানে, ওইভাবে এয়ারপোর্টে গেলে সবাই জেনে যাবে বুঝে যাবে, সেটা যুক্তি সঙ্গত হবে না। দিয়া ছোট উত্তর দেয়, “আচ্ছা।”
অভি খানিক পরে জিজ্ঞেস করে, “লেখা বা ঝন্টু কি এরমাঝে তোমাকে ফোন করেছিল?”
ঝন্টুর নাম শুনেই দিয়ার চেহারার ভাব বদলে যায়। দিয়া চোয়াল চেপে সেই ভাব লুকিয়ে নিয়ে বলে, “হ্যাঁ গতকাল দুপুরের দিকে ঝন্টু ফোন করেছিল।”
অভি, “গতকাল এই কথা আমাকে বলনি তো?”
দিয়া, “না এমনি বলিনি।”
অভি প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে আমাকে বলবে না?”
দিয়া মাথা নাড়ায়, “না কিছু হয়নি।”
দিয়ার শুকনো মুখ দেখে অভি বুঝতে পারে যে কিছু একটা হয়েছে আর সেটা দিয়া বলতে চাইছে না। লেখার সাথে দিয়ার খুব গভীর বন্ধুত্ত, তবে মাঝেমাঝে এই গভীর বন্ধুত্তেও চিড় ধরতে পারে, হয়ত কোন এক ভুল বোঝাবুঝি। দিয়ার চেহারায় হটাত করেই কালো মেঘের ছায়া অভিকে ভাবিয়ে তোলে।
একপ্রকার আধিকারের সুরেই জিজ্ঞেস করে দিয়াকে, “কি হয়েছে?”
দিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই উত্তর দেয়, “বলছি তো কিছু হয়নি। আমার সব বিষয়ে তোমার এত প্রশ্ন কিসের?”
অভি দমে যায় কথাটা শুনে, “বেশ তাহলে। উত্তর যখন দেবে না তাহলে হাত ধরেছ কেন? একা একা চলতে পারো তো।”
দিয়া, “এখানে দাঁড়িয়ে কি ঝগড়া করবে নাকি?”
অভি, “আমি ঝগড়া করব বলে আসিনি, দিয়া।”
অভির হাতের মুঠো থেকে একটা ঝটকা দিয়ে দিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। হাতটা ছাড়ানোর সময়ে বুকের মধ্যে ভীষণ কষ্ট হয়, আসলে অভিকে এই ফোনের ব্যাপারে জানাতে চাইছিল না। যতহোক লেখা ওর বান্ধবী মাত্র, কিন্তু অভির খুব কাছের আত্মীয়।
হাত ছাড়িয়ে হাঁটা থামিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি জেনে কি করবে?”
চোয়াল চেপে উত্তর দেয় অভি, “দরকার আছে। তোমার চোখ ভীষণ ভাবে কথা বলে, দিয়া। কিছু একটা তো হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি।” দিয়া মাথা নিচু করে নেয়। অভি ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “এইভাবে মাঝপথে হাত ছেড়ে দেবো বলে এই হাত ধরিনি, দিয়া।”
কথাটা ভীষণ সত্যি, দিয়ার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা এই কথার তাৎপর্য ভালো করে বোঝে। ক্ষনিকের জন্য দৃষ্টি বাষ্পীভূত হয়ে আসে, সেটা সামলে নিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “ওই যে টাকা দিয়েছিল সেই নিয়ে আর কি।” অভি ভুরু কুঁচকে দিয়ার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। দিয়া বলে, “এখন পনেরো হাজারের মতন বাকি।” বলে থেমে যায়।
অভি জিজ্ঞেস করে, “সেটা জানি, তারপর?”
কাঁচুমাচু মুখ করে মাথা নাড়ায় দিয়া, “প্লিজ বুবু, আমি চাই না আমার জন্য তোমার আর ঝন্টুর মধ্যে কোন মনোমালিন্য হোক।”
কথাটা শুনে অভির চোয়াল কঠিন হয়ে যায়, “সেটা পরের কথা। আমি জানতে চাই তারপর কে কি বলেছে।”
গলা শুকিয়ে আসে দিয়ার, “কালকে জানো, ঝন্টু সেটা কথায় কথায় আমাকে একটু শুনিয়ে দিল।”
অভি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “লেখা জানে এইসব?”
দিয়া মাথা নাড়ায়, “না মানে, লেখা শুধু এইটুকু জানে যে ঝন্টু আমাকে টাকা দিয়েছে। বাকি কিছু জানে না।”
অভি অবাক, “মানে? লেখা জানে না এমন কি করে হয়?”
দিয়া বুক ভিরে শ্বাস নিয়ে বলে, “কোথাও বসে কথা বলি?” অভির পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলে, “প্লিজ এইভাবে হাত ছেড়ো না।”
অভি চাপা কঠিন কণ্ঠে বলে, “এরপর যা জিজ্ঞেস করব তার সোজা উত্তর দেবে। না হলে...”
বাধ্য মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে অভির হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
অভি স্মিত হেসে দিয়ার ম্লান চেহারা দেখে বলে, “এই সুনু, আমি আছি তো।”
দিয়ার চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে, “জানি তো তাই মাঝে মাঝে বড্ড ভয় হয়।”
একটা রেস্টুরেন্তে বসে কোল্ড কফির অর্ডার দিয়ে দিয়া বলতে শুরু করে, “জানো, লেখা খুব নরম গোচরের মেয়ে। একটু চুপচাপ থাকতে ভালোবাসে, মনের মধ্যে কুটিলতা নেই। সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলে। আমার এই মেকআপ আর্টিস্ট হওয়ার পেছনে ওর কিছু অবদান আছে। ওর বিয়ের পরে, ঝন্টুকে বলে আমার মেক আপ কেনার জন্য পঞ্চাস হাজার টাকা দিয়েছিল। আমি প্রথমে নিতে চাইনি, এক প্রকার জোর করেই লেখা আমাকে সেই টাকা দিয়েছিল। ও আমাকে দিয়েছিল বন্ধুত্তের খাতিরে, কন ধার হিসাবে নয়, তাই কোনদিন আমার কাছ ফেরত চায়নি। টাকাটা লেখা নিজে হাতে দেয়নি, দিয়েছিল ঝন্টু। টাকা পাওয়ার পরে আমি অবশ্য লেখাকে জানিয়েছিলাম যে ঝন্টু আমাকে টাকা দিয়েছে। তবে টাকা দেওয়ার আগে ঝন্টুর প্রচুর প্রশ্ন। কোথায় খরচ করবে, কি ভাবে খরচ করবে। ব্যাবসায়ি মানুষ, এমন প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক সেটা বুঝতেই পেরেছিলাম। সেই ভেবেই আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি সব টাকা ফেরত দিয়ে দেবো। আমি চাইনি আমার জন্য লেখার মান সন্মান ওর শ্বশুর বাড়ির সামনে নিচু হয়ে যাক।” অভি চুপ করে দিয়ার কথা গুলো শুনে যায়। দিয়া হাতের নখ খুটতে খুটতে বলে, “এখন পনেরো বাকি। সেটা আর শোধ করতে পারছি না। কিছুতেই সেই ভাবে টাকা জমাতে পারি না, জানো। শুধু বিয়ের সিজেনে একটু বেশ কিছু আয় হয় আর বাকি গুলোতে সেইভাবে কিছুই আসে না। বাকি মাস গুলোর কথা ভেবে আমাকে খরচ করতে হয়। কিছু একটা কেনার আগে অনেক ভাবতে হয়। বাবার কাছে কতদিন এইভাবে হাত পাতা যায় বলো।”
অভি জিজ্ঞেস করে, “ঝন্টু কি বলেছে?”
দিয়া অভির দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, “গতকাল দুপুরে ফোন করে বলে...”
অভি, “কি বলে?”
দিয়া, “এখন আসল ফেরত দিতে পারিনি, এরপর নাকি সুদ চাই।”
অভি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
দিয়া অন্য দিকে মুখ ঘুড়িয়ে বলে, “জানি না।”
অভি হেসে ফেলে, “আরে হয়ত তোমার সাথে ইয়ারকি মেরেছে।”
দিয়া নিজের থমথমে চেহারায় হাসি ফুটিয়ে বলে, “হ্যাঁ তাই হবে।” একটু থেমে কোল্ড কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তুমিও তো লেখার সাথে ইয়ার্কি ঠট্টা করো?”
অভি মুচকি হসে মাথা দোলায়, “হুম, ভীষণ ভাবেই করি। সম্পর্কে বৌদি তায় আবার আমার চেয়ে একটু ছোট আবার ঝন্টুর বৌ, সেই হিসাবে বেশ করি।”
ম্লান হাসে দিয়া, “আমিও প্রথমে ঝন্টুর ইয়ার্কি ঠট্টা ঠিক সেই ভাবেই ভাবতাম...” বলতে বলতে থেমে গেল দিয়া।
দিয়ার থমথমে চেহারা আর ম্লান হাসির অর্থ ভীষণ ভাবেই অভিকে ভাবিয়ে তোলে। ঝন্টুর ব্যাপারে ঠিক কি বলতে চাইছে দিয়া? মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন, সব না হলেও ঝন্টুর চরিত্র সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল, তবে বৌয়ের বান্ধবীর সাথে ইয়ার্কি ঠাট্টা চলতেই পারে। কিন্তু দিয়ার চোখের ভাষা অন্য কিছু একটা বলতে চাইছে।
অভি ওর থুঁতনি ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে, “এখন ঝন্টুকে একটা ফোন করতে পারো?”
দিয়া চাপা আঁতকে ওঠে, “নাহ... তুমি পাগল হলে নাকি?”
অভি চোয়াল চেপে বলে, “তুমি ফোন কর, ও কি বলে আমি শুনতে চাই। স্পিকারে দেবে আর কল রেকরডিং করবে।”
একটু ইতস্তত করে দিয়া, তারপর ঝন্টুকে রিং করে। মোবাইল টেবিলে রেখে স্পিকার চালিয়ে দেয়। অন্যপাশ থেকে ঝন্টু একটু পরে ফোন উঠিয়ে বলে, “কি হল কি ব্যাপার?”
দিয়া ঠোঁটে মেকি হাসি মাখিয়ে বলে, “না এমনি। মানে লেখার ফোন পাচ্ছিলাম না তাই তোমাকে ফোন করলাম।”
ঝন্টুর কণ্ঠে একটু চটুল হাসি, “আচ্ছা, তাই নাকি? না কি আমার কথা মনে পরে গেল?”
ঝন্টুর হাসি শুনে অভির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দিয়া একবার অভির দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “যে রকম ভাববে সেটাই।” একটু থেমে বলে, “তুমি গতকাল সুদের কথা বলছিলে।”
ঝন্টু গলা নামিয়ে বলে, “হ্যাঁ, বল।”
দিয়া একবার অভির কঠিন চেহারার দিকে তাকিয়ে, মেকি চটুল হেসে ঝন্টুকে উত্তর দেয়, “হিসেব করলে কি, কতটা সুদ হয়?”
ঝন্টু নচু গলায় বলে, “ক্যাশ না কাইন্ড (নগদ না অন্যকিছু)?”
কথাটা কানে যেতেই অভির হাত মুঠো হয়ে যায়, ইচ্ছে করে এখুনি নৈহাটি গিয়ে ঝন্টুর কলার ধরে কানের গোড়ায় কষিয়ে একটা চড় দিতে। কোন মতে রাগ গিলে নেয় অভি। অভির রক্ত লাল চোখ দেখে দিয়ার ভয় হয়, ওর হাত চেপে ধরে শান্ত করে ঝন্টুকে উত্তর দেয়, “কি চাই তোমার?”
ঝন্টু চাপা হেসে উত্তর দেয়, “কি হিসাবে দিতে পারবে? আমার দুটোতেই চলবে।”
অভি ফোনের স্পিকার চেপে ধরে দিয়াকে ইশারা করে ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করতে যে কাইন্ডে ঠিক কি চায় সেটা জিজ্ঞেস করুক। হাজার প্রশ্ন নিয়ে অভির দিকে তাকায়। অভি অভয় দিয়ে দিয়াকে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলে। অভি জানতে চায় ঝন্টুর আসল অভিসন্ধি।
দিয়া মেকি চটুল হেসে ঝন্টুকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা কাইন্ডে দিলে কি রকম কাইন্ড চাই তোমার?”
এই কথা শুনে ঝন্টুর জিবে যেন জল চলে এলো, “সত্যি বলছ?”
দিয়া অভির দিকে একবার তাকিয়ে ফোনের উত্তর দেয়, “হ্যাঁ...”
ঝন্টু চাপা হেসে বলে, “বেশ তো কবে দিতে চাও?”
দিয়া চোয়াল চেপে উত্তর দেয়, “কি চাও, কবে চাও খুলে বল?”
ঝন্টু, “এর পরের মঙ্গলবার হতে পারে?”
দিয়া জিজ্ঞেস করে, “কি হতে পারে?”
ঝন্টু একগাল হেসে বলে, “ন্যাকা সেজো না দিয়া। তুমিও জানো আমি কি চাই আমিও জানি তোমার মনের কি ইচ্ছে।”
দিয়া, “না, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কি বলতে চাইছ, একটু খুলেই বল না।”
ঝন্টু, “এই একটু কাছাকাছি আসা এই আর কি। তুমি তো এমনিতে কাছেই আসো না আজাকাল, টাকা দেওয়ার পরে একদম হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছো।” দিয়া একটা মেকি হাসি দেয়। ঝন্টু বলে, “পরের মঙ্গলবার আমরা তাহলে এই এক নম্বর গেটের কাছের কোন হোটেলে মিট করতে পারি। তারপর সেখানে দুজনে মিলে একটু গল্প গুজব একটু হুইস্কি একটু মজা করব এই আর কি। ওহ, হ্যাঁ, তুমি প্লিজ একটা হট প্যান্ট নিয়ে এসো। উফফফ তোমার ওই মোটা মোটা থাই গুলো...”
এইভাবে অভির সামনে অন্য কেউ ওর শরীরের বর্ণনা দিচ্ছে কানে যেতেই দিয়ার কান লাল হয়ে যায়। অভির রক্ত চক্ষু দেখে দিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টুকে থামিয়ে দেয়, “হ্যাঁ আমি সব বুঝে গেছি। দেখছি কি করা যায়...”
ঝন্টুর শেষ কথাটা শুনে অভি আহত ময়াল সাপের মতন ভীষণ ভাবেই ফুঁসতে শুরু করে দেয়। কথা গুলো যেন অভির কানের মধ্যে লাভা বইয়ে দেয়। ঝন্টুর এত বড় সাহস যে এই নোংরা ভাষায় দিয়াকে এইভাবে অপমান জনক কথাবার্তা বলবে? ওর চোয়াল কঠিন হয়ে যায়। দিয়া চোখ বুজে দুই হাতের মধ্যে অভির হাত দুটো শক্ত করে ধরে থাকে। চেহারায় কাতর মিনতি, এই তোমার মামাতো ভাইয়ের আসল রূপ। অভি মাথা ঝাঁকিয়ে চাপা গর্জে ওঠে, শালাকে আমি মেরে ফেলবো। দিয়া ওকে ক্ষান্ত করে, প্লিজ বুবুসোনা শান্ত হও। অভি চোয়াল চেপে ঝন্টুকে বলতে বলে যে ও টাকা দিয়ে দেবে। অভির একাউন্টে এই হাজার পঞ্চাসের মতন পরে রয়েছে, বড়দি কিছু দিয়ে গেছে, তার কিছু দিয়াকে দিয়ে দেবে।
লজ্জায় অপমানে দিয়ার কান গাল সারা চেহারা লাল হয়ে গেছে। ঝন্টুর সাথে বিন্দু মাত্র কথা বলার ইচ্ছে নেই তাও অভির কথা মেনে ঝন্টুকে বলে, “আচ্ছা পরের মঙ্গলবার তো হবে না, আমার একটা কাজ আছে। মানে বুঝতেই পারছো এখন পুরো বিয়ের সিজেন চলছে। প্রচন্ড ব্যাস্ত।”
ঝন্টু শীতল চাপা গলায় বলে, “অনেকদিন হয়ে গেল কিন্তু দিয়া...”
দিয়া, “সরি, সে আমি জানি, কিন্তু এই মাসে সত্যি খুব বিজি থাকবো। তোমার যদি নেহাত এখন চাই তাহলে ক্যাশ দেবো...”
ঝন্টু হেসে ফেলে, “আরে আরে কি হল, একদম আসতে পারবে না নাকি?”
দিয়া চাপা কঠোর কণ্ঠে উত্তর দেয়, “না গো, এই মাসে একদম সম্ভব নয়। তোমার ইন্টারেস্ট কত হয় বল, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি শোধ করে দেবো।”
ঝন্টুর কণ্ঠে নিরুচ্ছাস যেন কিছু ওর নাগাল থেকে হাত ফসকে বেড়িয়ে গেল, “ওহ, আচ্ছা। তাহলে এই দশ হাজারের মতন হয়... কবে দিচ্ছো তাহলে?”
দিয়া, “একটু সময় দাও, এই মাসের মধ্যে পনেরো দিয়ে দেব। বাকিটা একটু পরে।”
ঝন্টু ছোট উত্তর দেয়, “ফারস্ট জানুয়ারির মধ্যে দিয়ে দিও তাহলে।”
দিয়া, “হুম, আচ্ছা আজকে রাখছি।”
ঝন্টু আহত কণ্ঠে হেসে বলে, “লেখাকে ফোন করবে না?”
দিয়া মেকি হেসে উত্তর দেয়, “হুম পরে করব।”