11-09-2020, 03:12 PM
পর্ব পাঁচ। রাগ অনুরাগ (#2-#27)
সারাটা রাস্তা দিয়ার মনে অসংখ্য প্রশ্নের ভিড় করে আসে। দ্বিধায় দোদুল্যমান হৃদয় কে কিছুতেই মেলাতে পারে না গত রাতের ঘটনার সাথে আজকে সকালের ঘটনা। এক রাতের মধ্যে এইভাবে ওর জীবনে এতটা ওঠানামা কোনদিন হয়নি। কি চাইছে অভিনন্দন, কি চাইছে অভির মা? কেন গতরাতে অভিকে শাসন করছিলেন আর কেনই বা সকালে দিয়ার সম্বন্ধে এত প্রশ্ন। দিয়াকে কি সত্যি ভালোবাসে অভি, যদি সত্যি ভালোবাসে তাহলে অভি কেন এত চুপচাপ আছে? একটা শব্দ না করে এতটা রাস্তা পার করে এলো শুধুমাত্র ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে বলে? বাসে উঠিয়ে দিলেই সহজে দিয়া বাড়ি চলে আসতে পারতো। অভির মা যদি অভিকে বকাঝকা করে থাকেন, তাহলে সকালে কেন আবার বাড়িতে আসতে বলেছেন? প্রচুর প্রশ্ন, কিন্তু যার কাছে উত্তর সেতো কোন কথাই বলছে না।
দিয়ার পাড়ার গলিতে ঢোকার মুখে বাইকটা একটু ধিরে করে দেয় অভি। বাইক একটু আস্তে হতেই দিয়া বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে যায়, হটাত কি হল এইখানে বাইক থামাবে নাকি? অভি নিশ্চয় প্রশ্ন করবে, কি বলবে? যা ভাবছিল তাই হল।
বাইক গলির মুখে দাঁড় করিয়ে অভি প্রশ্ন করল, “একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?”
দিয়া মাথা দোলায়, “হুম।”
অভি, “তুমি কি রাতে ঘুমাওনি?”
দিয়া চোখ বন্ধ করে নেয়, কি করে বলবে গতরাতে তোমার ওই অবস্থা দেখার পর সত্যি নিজেকে খুব বড় অপরাধি মনে হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর ঘুড়িয়ে দিয়ে বলে, “হ্যাঁ একটু ঘুমিয়েছি তো।”
অভি ধিরে ধিরে বাইকটা গলির মধ্যে ঢুকাতে ঢুকাতে প্রশ্ন করে, “তোমার কি হয়েছে একটু বলবে?”
দিয়া চেঁচিয়ে ওঠে, না বলব না, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। না দিয়া এটা বলতে পারেনি, ছোট উত্তর দেয়, “কিছু হয়নি তো, কি হবে। ঠিক ভাবে ঘুম হয়নি তাই বড্ড ঘুম ঘুম পাচ্ছে।”
অভি ভাবলও এই ঠান্ডা ভাব কাটানোর জন্য একটু রসিকতার প্রয়োজন আছে, “কেন কেন, ছাড়পোকা কেটে ছিল নাকি?”
দিয়ার বুঝতে অসুবিধে হয়না যে অভি রসিকতা করেই কথাটা বলেছে। মনে মনে বলে, ছাড়পোকা কেন কাটতে যাবে, এত বড় একটা শয়তান আছে, তার বড় বড় দাঁত আছে সেই কেটেছে। আলতো মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আমি এত সকালে উঠি না তাই।”
সত্যি বাবা, মেয়েটা একদম চুপ মেরে গেছে, কিছুতেই মন গলাতে পারছে না। “ওহ আচ্ছা” বলে অভিও চুপ করে যায়।
দিয়ার বাড়ির অদুরে বাইক দাঁড় করায় অভি। এত সকালে ঠিক বাড়ির সামনে নামাতে একটু দ্বিধা বোধ করে। যদিও এখন রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়নি, তাও। দিয়া নেমে পড়ে বাইক থেকে, হাত বাড়িয়ে ব্যাগ চায়। অভি ব্যাগ খুলে হাতে দেওয়ার সময়ে দিয়ার হাতের সাথে অভির আঙ্গুল ছুঁয়ে যায়। অভি ব্যাগ ধরে থাকে, দিয়া হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করে ব্যাগ নেওয়ার জন্য। ব্যাগের স্ট্রাপ হাতে নিয়ে একটু টানাটানি। অভি কিছুতেই ব্যাগ ছাড়বে না।
দিয়া ব্যাগের স্ট্রাপ ধরে টেনে বলে, “ব্যাগ ছাড়ো আমি বাড়ি যাবো।” ওর কণ্ঠে এক বেদনার সুর।
অভি ব্যাগ না ছেড়ে প্রশ্ন করে, “সত্যি তোমার কিছু হয়নি?”
দিয়া এবারে রাগত সুরে অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “না কিছু হয়নি। আমাকে যেতে দেবে নাকি ব্যাগ নিয়ে তুমি চলে যাবে?”
অভির খুব ইচ্ছে করছিল বলেই ফেলে, ব্যাগ কেন তোমায় নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু দিয়ার থমথমে চেহারা দেখে সেই সাহস পেলো না। ব্যাগের স্ট্রাপ ছেড়ে দিয়ে একটু আহত হয়েই বলে, “সাবধানে থেকো।”
বড্ড কান্না পায় দিয়ার, চোখ জোড়া জ্বালা জ্বালা করে ওঠে। অভির সামনে বেশিক্ষন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। শেষ কথাটা বলে ফেলাই উচিত। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে অভির দিকে দুইপা এগিয়ে বলে, “অভি, একটা কথা বলব?” অভি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দিয়ার দিকে, কি বলতে চায় মেয়েটা। দিয়া বলে, “তোমার পৃথিবী আর আমার পৃথিবী সম্পূর্ণ আলাদা, অভিনন্দন।”
বাজ পরে অভির বুকের মধ্যে, কি বলতে চলেছে? “অভিনন্দন” শব্দটা ভীষণ ভাবেই জোর দিয়ে বলে দিয়া। গত রাতে বন্ধুত্ত হল, এক উচ্ছলতা ওর ঘরের মধ্যেও ছিল। চোয়াল চেপে দিয়ার মুখের দিকে তাকায়, দুই চোখ ছলছল করছে। হটাত এমন উচ্ছল মেয়েটার চোখে জল দেখে অভি প্রমাদ গোনে। বাইক থেকে নেমে এসে দিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলে, “যা বলার একটু খুলে বল, প্লিজ।”
অভির হাত কাঁধে পড়তেই, দিয়া মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে নেয়। ভীষণ ইচ্ছে করছে শেষ বারের মতন একবার দুই হাতে এই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে। ওর উচ্ছলতার মাশুল এই ছেলেটা গত রাতে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দিয়েছে। সেই দৃশ্য মনে পড়তেই নিজেকে খুব বড় অপরাধি বলে মনে হয়। অস্পষ্ট গলায় বলে, “কি বলবো বলো, আমি ত অনেক কিছুই ভেবেছিলাম...” বলেই ফুঁপিয়ে ওঠে।
অভি বুঝতে পারলো এইবারে দিয়ার হৃদয়ের বেদনা। দিয়া যে ঠিক কি ভেবেছিল, সেটা অভি ভালো ভাবেই বোঝে এবং সেটা এখন বুঝেছে সেটা নয়, এই কথাটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল অভিনন্দন। সেটাই এড়াতে গত রাতে গাড়িতে আসার সময়ে বলেছিল ওর জীবনে শুধু মাত্র দিদিভাই আর বড়মা। দিয়া নিশ্চয় সেটাই ধরে বসে আছে। অভি যে রাতে বড়মায়ের সাথে কথা বলেছে এবং বড়মা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা দিয়ার না জানারই কথা। দিয়ার বাড়ির অদুরে দাঁড়িয়েছিল না হলে দিয়াকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিত। দিয়ার থমথমে চেহারা দেখে অভির খুব কষ্ট হল, নিশ্চয় এই ভেবেই মেয়েটা সারাটা রাত ঘুমায়নি।
দিয়ার মাথার ওপর ঝুঁকে খুব নিচু গলায় বলে, “তোমায় কিচ্ছু বলতে হবে না, তুমি চোখ মোছ।”
দিয়া ভাবে ওকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য অভি এই কথা বলছে, তাই মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে থাকে। অভির দেহের আকর্ষণে ওকে যেন মাটির সাথে গেঁথে রেখে দিয়েছে, চাইলেও যেন নড়তে পারছে না সামনে থেকে। উলটো হাতে চোখ মুছে নেয়, কিন্তু কিছুতেই অভির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। ওর মাথায় অভির উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ ওর বুকের মাঝে ভীষণ আন্দোলন ডেকে আনে।
মেয়েটা যে কিছুতেই মাথা উঁচু করছে না, কি মুশকিল। অভি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দিয়ার মাথায় আলতো নাক ছুঁইয়ে বলে, “এত সকালে এই ভাবে কেউ যদি আমাদের দেখতে পায় তাহলে সেটা খারাপ দেখাবে দিয়া।”
মরন দশা আমার, দিয়া ভাবে। দিয়ার বুক ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আর অভি এখন পরে আছে কে কি ভাববে না ভাববে সেই চিন্তায়। শেষ বারের জন্য ঝাঁঝিয়ে উঠতে মন করে, বলে ফেলে, কেউ দেখুক না দেখুক সেটা তে তোমার খুব চিন্তা তাই না। না দিয়া সেই কথা মুখে আনতে পারেনি, শুধু মনে হয়েছে ওর গায়ের কোট, ওর হাসির আওয়াজ আর অভির ওইভাবে মাথা হেট করে হাঁটু গেড়ে বসে থাকাটা।
দিয়ার চোখে জল মানায় না একদম, সবসময়ে প্রজাপতির মতন উচ্ছল উদ্দাম দুষ্টুমি করে বেড়াবে সেটাই দিয়ার আসল পরিচয়। মেয়েটা এখন একদম চুপ। এইভাবে শুকনো মুখ করে বসে থাকা দিয়ার মানায় না। মনের কথাটা এই সকালে বলে ফেলাই উচিত না হলে দিয়ার মন কিছুতেই হাল্কা হবে না। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার দিয়ার চোখে জল মানায় না।”
দিয়া প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে না অভি ওর কানে কানে কি বলল। ঠিক শুনেছে, “আমার দিয়া”। ধুকধুক...ধুকধুক... হৃদয়ের স্পন্দন এক ধাক্কায় বেড়ে ওঠে।
অভি না থেমে বলে, “আমার দিয়া শুধু হাসবে আর নেচে বেড়াবে।”
দিয়া এবারে কান্না ভুলে যায়। ভীষণ দুষ্টু এই ছেলেটা। মাথা তুলে অভির দিকে তাকাতে যাবে কি অভির থুতনির মধ্যে দিয়ার মাথা ধাক্কা খায়। উফফফফ...
অভি উফফফ করে ওঠে, “কি হল, এইভাবে মারবে নাকি?”
দিয়া ভুরু কুঁচকে অভির চোখের দিকে তাকিয়ে। সত্যি কি বলতে চাইছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। অভির চোখ জোড়া ভীষণ চকচক করছে, কেমন যেন এক মুচকি দুষ্টুমির হাসি ওই ঠোঁটে মাখা। সত্যি ঠিক দেখছে ত অভিকে? না ঠিক দেখছে। কানে ঠিক শুনেছে, “আমার দিয়া” কি বলতে চাইছে, একবার স্পষ্ট করেই বলে ফেলুক। অভির চোখের হাসি দেখে দিয়া খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে যায়।
চোখের পাতায় জল, অনুরাগের হাসি ঠোঁটের কোনায় মাখিয়ে অভির বুকের ওপর দুম করে একটা কিল মেরে বলে, “শয়তান ছেলে, এবারে সত্যি মারবো কিন্তু।” বলে বুকের ওপর মাথা ঠেকিয়ে দেয়।
পকেটে রাখা ফোনটা অনেক্ষন ধরেই বেজে চলেছে। ফোন বের করে দেখল যে বড়মায়ের বেশ কয়েকটা মিস কল। এতক্ষন ফোনের দিকে খেয়াল করেনি। বাড়ি যাওয়ার তাড়াও আছে, সেই সাথে দিয়াকে ছেড়ে যেতেও ভালো লাগছে না। ভালোবাসার ছোট আভাস, প্রথম পদক্ষেপ, এইভাবে দুম করে সাত সকালে বেড়িয়ে যাবে সেটা কি আর আগে থেকে ভেবেছিল অভিনন্দন? ফোন সাইলেন্ট করে আবার পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল অভি। বড়মা জানে যে দিয়াকে ছাড়তে এসেছে, সুতরাং কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে পারে।
রাস্তার মাঝখানে না হলে অভি তৎক্ষণাৎ দিয়াকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিত। দুই হাতে পিষে ধরত প্রথম ভালোবাসার ললনাকে। চুমুতে চুমুতে দিয়ার মিষ্টি ঠোঁট জোড়া ভরিয়ে তুলতো। হাত দুটো ভীষণ নিশপিশ করছিল বটে কিন্তু বুকের উচ্ছলতা সামলে বাইকে উঠে বলে, “বিকেলে মার খেতে আসবো।”
দিয়া নেচে ওঠে, বলে কি ছেলেটা, সত্যি আসবে? কিছুই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। শীতের ভোর নয়, যেন বসন্ত কাল এসে গেছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে কষে ছেলেটার গালে একটা চড় মারে আর তারপর দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে সেই জায়গায় নরম ঠোঁট চেপে ধরে। শয়তান ছেলে, প্রথমে হাসাবে, তারপর কাঁদাবে, তারপর আবার হাসাবে, তারপর কি যে করবে কে জানে। ব্যাগ দুটো হাতে তুলে মিষ্টি হেসে বলে, “বিকেলে না এলে একদম গলা টিপে দেবো কিন্তু।”
অভি বাইক স্টারট করে মাথা নিচু করে বলে, “জো হুকুম মহারানী।” বলেই বুকের বাঁ দিকে একটা কিল মারে।
মাটিতে পা নেই, দিয়া ব্যাগ হাতে একটু নেচে ওঠে। নাক কুঁচকে, ঠোঁট কুঁচকে হাওয়া চুমু ছুঁড়ে দেয় অভির দিকে। ভুরু নাচিয়ে ইশারা করে, “এবারে যাও।”
অভি দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আগে বাড়িতে ঢোক তারপর যাবো।”
দিয়া জোরে মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, আগে তুমি আসো তারপর আমি যাবো।”
আবার বড়মায়ের ফোন, পকেটের মধ্যে ক্রমাগত ভাইব্রেট করে চলেছে। অগত্যা অভি কি করে, হেলমেট চাপিয়ে বাইক চালিয়ে দেয়। তিরিশ মিনিটের পথ, পোনেরো মিনিটে পার করে দেয়। শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা বলে ফেলে বেশ হাল্কা মনে হচ্ছে, মনেই হচ্ছে না যে বাইক চালাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন এক পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চেপে নীল আকাশের বুকে উড়ে চলেছে। কি ভীষণ দুষ্টু মেয়েটা, গতকাল রাতে যেভাবে বুকের ওপরে মাথা রেখে একটু খানি শুয়েছিল, তাতে অভির বুকের স্পন্দন যে কতজোরে ধুকধুক করছিল সেটা বোঝানোর উপায় নেই। মনে হয়েছিল অন্ধকার গাড়িতে দিয়ার ঠোঁটে একটা মিষ্টি চুম্বন এঁকে দেয়।
দিয়া, দময়ন্তী ঘোষ, কবে প্রথম দেখা হয়েছিল মেয়েটার সাথে? কবে সঠিক ভাবে মাথায় এসেছিল? প্রায় এক বছর আগের কথা, ঝন্টুর বিয়েতে প্রথম দেখা। বরের গাড়ি বিয়ে বাড়ির সামনে থামতেই, গাড়ির দরজা খুলে প্রথমে নেমে এসেছিল অভি। ঝন্টু তখন গাড়ির মধ্যে বসে। বর এসেছে, বর এসেছে, বিয়ে বাড়িতে ভীষণ শোরগোল বেধে যায়। বাড়ির সামনের লোহার গেট আটকে লেখার বোনেরা আর বান্ধবীরা, দশ হাজার না দিলে বরকে ঢুকতে দেবে না। মেয়েদের দলের মধ্যে সব থেকে সামনে ছিল দিয়া, দুই হাতে গেটের দুই পাল্লা ধরে অভির সামনে দাঁড়িয়ে। অভিও কম যায়না, দশ হাজার কেন চাই? আমাদের ছেলের দাম কি শুধু মাত্র দশ হাজার নাকি? সেই শুনে দিয়া বলেছিল, না, ভাবলাম এত দুর থেকে এসেছেন তাই শুধু মাত্র দশ হাজারে ছেড়ে দেই। অভি হেসে ফেলে, এতদুর থেকে এসেছি বলেই তো কোন টাকা পয়সা আনিনি। এখানে ভাবলাম ফ্রিতে খানা পিনা পাবো, মজা করব আর চলে যাবো। ওর এই কথা শুনে সবাই কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না। দিয়া হারতে নারাজ, দশ হাজার দিলে তবেই গেট খুলবে। অভিও সমান তালে বলে, দশ হাজার পয়সা দিতে পারে এর বেশি নয়। অভি, পাশের একজনকে ডেকে একটা চেয়ার আনতে বলে, সেই চেয়ারে গেটের সামনে বসে পরে। ঝন্টু তখন গাড়ির ভেতর। ওদিকে মেয়েদের জটলার পেছনে লেখার মা বরন কুলো নিয়ে প্রস্তুত, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, বরকে বরন করে আনতে হবে। অভি সেটাই চাইছিল, যতক্ষণ না বড়রা মধস্ততা করবে ততক্ষন এরা কিছুতেই গেট ছাড়বে না। দেরি দেখে শেষ পর্যন্ত পাপা অভিকে বলেন যে এত জেদ না করে যা চাইছে দিয়ে দিতে। পাপার আদেশ অমান্য করতে পারে না, অগত্যা অভি পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দিয়ে দেয়। কিন্তু দিয়া আর বাকি মেয়েরা সেটা কিছুতেই নেবে না, দশ হাজার টাকা না দিলে কিছুতেই গেট ছাড়বে না। অভি বলল এর বেশি এক পয়সা নেই, ওর কাজ ছিল বর আনার, বর এনেছে, এবারে মেয়ের বাড়ির লোকেরা ঠিক করুক বিয়ে করাবে কি করাতে চায় না। ওইদিকে লেখার বাবা এসে শেষ পর্যন্ত মেয়েদের জটলাকে শান্ত করান। সেই প্রথম দেখা দময়ন্তীর সাথে। ভারী সুন্দর সাজিয়েছিল নিজের প্রানের বান্ধবীকে। তারপর আর সেভাবে দিয়ার সাথে পরিচয় হয়নি অভির। ভাগ্নে তিতাসের শরীর খারাপ করল, সেই রাতেই গাড়ি করে বড়দিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল অভি। বৌভাতের দিনে কাজের মধ্যে ব্যাস্ত থাকায় আর ঠিক ভাবে দেখা হয়নি দিয়ার সাথে। তারপর দময়ন্তী নামটা মুছে গিয়েছিল ওর মাথা থেকে। দিদিভাইয়ের বিয়েতে, লেখা যদি দিয়াকে না ডাকতো তাহলে চিরতরে মুছে যেত দিয়া।
বাড়ির সামনে বাইক রাখতেই দিয়ার ফোন আসে, “পৌঁছেছ?”
অভি হেসে বলে, “হ্যাঁ রে বাবা, এই পৌছালাম, এখন বাড়িতে ঢুকতে পারিনি।”
দিয়া প্রশ্ন করে, “বিকেলে কখন আসবে?” দিয়ার কণ্ঠে সেই পুরানো উতফুল্ল, পুরানো চঞ্চলতা শুনে নেচে ওঠে অভির হৃদয়।
অভি মনে মনে একটু খানি সময় হিসেব করে উত্তর দেয়, “এই পাঁচ’টা নাগাদ পৌঁছে যাবো।”
দিয়া যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে, “আচ্ছা আমরা কোথায় যাবো?”
অভি হেসে ফেলে, “তোর প্রেমের চোরাবালিতে যাবো...”
দিয়া ফোনের মধ্যে চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “তাহলে তাড়াতাড়ি আসিস ডুবে মরতে...”
তোর প্রেমের চোরাবালিতে, হারাতেও নেই ভয়,
চাই না কেউ আমাকে টেনে তুলুক, বিচ্ছিন্ন করে দিক দুটি প্রান,
তোর নীলচে চোখের চোরাবালিতে ডুবে মরব বলে এসেছি তোর কূলে,
এই মরনেও সুখ, তোর বুকে জমা চোরাবালিতে।।
সারাটা রাস্তা দিয়ার মনে অসংখ্য প্রশ্নের ভিড় করে আসে। দ্বিধায় দোদুল্যমান হৃদয় কে কিছুতেই মেলাতে পারে না গত রাতের ঘটনার সাথে আজকে সকালের ঘটনা। এক রাতের মধ্যে এইভাবে ওর জীবনে এতটা ওঠানামা কোনদিন হয়নি। কি চাইছে অভিনন্দন, কি চাইছে অভির মা? কেন গতরাতে অভিকে শাসন করছিলেন আর কেনই বা সকালে দিয়ার সম্বন্ধে এত প্রশ্ন। দিয়াকে কি সত্যি ভালোবাসে অভি, যদি সত্যি ভালোবাসে তাহলে অভি কেন এত চুপচাপ আছে? একটা শব্দ না করে এতটা রাস্তা পার করে এলো শুধুমাত্র ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে বলে? বাসে উঠিয়ে দিলেই সহজে দিয়া বাড়ি চলে আসতে পারতো। অভির মা যদি অভিকে বকাঝকা করে থাকেন, তাহলে সকালে কেন আবার বাড়িতে আসতে বলেছেন? প্রচুর প্রশ্ন, কিন্তু যার কাছে উত্তর সেতো কোন কথাই বলছে না।
দিয়ার পাড়ার গলিতে ঢোকার মুখে বাইকটা একটু ধিরে করে দেয় অভি। বাইক একটু আস্তে হতেই দিয়া বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে যায়, হটাত কি হল এইখানে বাইক থামাবে নাকি? অভি নিশ্চয় প্রশ্ন করবে, কি বলবে? যা ভাবছিল তাই হল।
বাইক গলির মুখে দাঁড় করিয়ে অভি প্রশ্ন করল, “একটা প্রশ্ন করতে পারি কি?”
দিয়া মাথা দোলায়, “হুম।”
অভি, “তুমি কি রাতে ঘুমাওনি?”
দিয়া চোখ বন্ধ করে নেয়, কি করে বলবে গতরাতে তোমার ওই অবস্থা দেখার পর সত্যি নিজেকে খুব বড় অপরাধি মনে হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর ঘুড়িয়ে দিয়ে বলে, “হ্যাঁ একটু ঘুমিয়েছি তো।”
অভি ধিরে ধিরে বাইকটা গলির মধ্যে ঢুকাতে ঢুকাতে প্রশ্ন করে, “তোমার কি হয়েছে একটু বলবে?”
দিয়া চেঁচিয়ে ওঠে, না বলব না, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। না দিয়া এটা বলতে পারেনি, ছোট উত্তর দেয়, “কিছু হয়নি তো, কি হবে। ঠিক ভাবে ঘুম হয়নি তাই বড্ড ঘুম ঘুম পাচ্ছে।”
অভি ভাবলও এই ঠান্ডা ভাব কাটানোর জন্য একটু রসিকতার প্রয়োজন আছে, “কেন কেন, ছাড়পোকা কেটে ছিল নাকি?”
দিয়ার বুঝতে অসুবিধে হয়না যে অভি রসিকতা করেই কথাটা বলেছে। মনে মনে বলে, ছাড়পোকা কেন কাটতে যাবে, এত বড় একটা শয়তান আছে, তার বড় বড় দাঁত আছে সেই কেটেছে। আলতো মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “আমি এত সকালে উঠি না তাই।”
সত্যি বাবা, মেয়েটা একদম চুপ মেরে গেছে, কিছুতেই মন গলাতে পারছে না। “ওহ আচ্ছা” বলে অভিও চুপ করে যায়।
দিয়ার বাড়ির অদুরে বাইক দাঁড় করায় অভি। এত সকালে ঠিক বাড়ির সামনে নামাতে একটু দ্বিধা বোধ করে। যদিও এখন রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুরু হয়নি, তাও। দিয়া নেমে পড়ে বাইক থেকে, হাত বাড়িয়ে ব্যাগ চায়। অভি ব্যাগ খুলে হাতে দেওয়ার সময়ে দিয়ার হাতের সাথে অভির আঙ্গুল ছুঁয়ে যায়। অভি ব্যাগ ধরে থাকে, দিয়া হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করে ব্যাগ নেওয়ার জন্য। ব্যাগের স্ট্রাপ হাতে নিয়ে একটু টানাটানি। অভি কিছুতেই ব্যাগ ছাড়বে না।
দিয়া ব্যাগের স্ট্রাপ ধরে টেনে বলে, “ব্যাগ ছাড়ো আমি বাড়ি যাবো।” ওর কণ্ঠে এক বেদনার সুর।
অভি ব্যাগ না ছেড়ে প্রশ্ন করে, “সত্যি তোমার কিছু হয়নি?”
দিয়া এবারে রাগত সুরে অভির দিকে তাকিয়ে বলে, “না কিছু হয়নি। আমাকে যেতে দেবে নাকি ব্যাগ নিয়ে তুমি চলে যাবে?”
অভির খুব ইচ্ছে করছিল বলেই ফেলে, ব্যাগ কেন তোমায় নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু দিয়ার থমথমে চেহারা দেখে সেই সাহস পেলো না। ব্যাগের স্ট্রাপ ছেড়ে দিয়ে একটু আহত হয়েই বলে, “সাবধানে থেকো।”
বড্ড কান্না পায় দিয়ার, চোখ জোড়া জ্বালা জ্বালা করে ওঠে। অভির সামনে বেশিক্ষন এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। শেষ কথাটা বলে ফেলাই উচিত। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে অভির দিকে দুইপা এগিয়ে বলে, “অভি, একটা কথা বলব?” অভি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দিয়ার দিকে, কি বলতে চায় মেয়েটা। দিয়া বলে, “তোমার পৃথিবী আর আমার পৃথিবী সম্পূর্ণ আলাদা, অভিনন্দন।”
বাজ পরে অভির বুকের মধ্যে, কি বলতে চলেছে? “অভিনন্দন” শব্দটা ভীষণ ভাবেই জোর দিয়ে বলে দিয়া। গত রাতে বন্ধুত্ত হল, এক উচ্ছলতা ওর ঘরের মধ্যেও ছিল। চোয়াল চেপে দিয়ার মুখের দিকে তাকায়, দুই চোখ ছলছল করছে। হটাত এমন উচ্ছল মেয়েটার চোখে জল দেখে অভি প্রমাদ গোনে। বাইক থেকে নেমে এসে দিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলে, “যা বলার একটু খুলে বল, প্লিজ।”
অভির হাত কাঁধে পড়তেই, দিয়া মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে নেয়। ভীষণ ইচ্ছে করছে শেষ বারের মতন একবার দুই হাতে এই ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে। ওর উচ্ছলতার মাশুল এই ছেলেটা গত রাতে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দিয়েছে। সেই দৃশ্য মনে পড়তেই নিজেকে খুব বড় অপরাধি বলে মনে হয়। অস্পষ্ট গলায় বলে, “কি বলবো বলো, আমি ত অনেক কিছুই ভেবেছিলাম...” বলেই ফুঁপিয়ে ওঠে।
অভি বুঝতে পারলো এইবারে দিয়ার হৃদয়ের বেদনা। দিয়া যে ঠিক কি ভেবেছিল, সেটা অভি ভালো ভাবেই বোঝে এবং সেটা এখন বুঝেছে সেটা নয়, এই কথাটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল অভিনন্দন। সেটাই এড়াতে গত রাতে গাড়িতে আসার সময়ে বলেছিল ওর জীবনে শুধু মাত্র দিদিভাই আর বড়মা। দিয়া নিশ্চয় সেটাই ধরে বসে আছে। অভি যে রাতে বড়মায়ের সাথে কথা বলেছে এবং বড়মা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেটা দিয়ার না জানারই কথা। দিয়ার বাড়ির অদুরে দাঁড়িয়েছিল না হলে দিয়াকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিত। দিয়ার থমথমে চেহারা দেখে অভির খুব কষ্ট হল, নিশ্চয় এই ভেবেই মেয়েটা সারাটা রাত ঘুমায়নি।
দিয়ার মাথার ওপর ঝুঁকে খুব নিচু গলায় বলে, “তোমায় কিচ্ছু বলতে হবে না, তুমি চোখ মোছ।”
দিয়া ভাবে ওকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য অভি এই কথা বলছে, তাই মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে থাকে। অভির দেহের আকর্ষণে ওকে যেন মাটির সাথে গেঁথে রেখে দিয়েছে, চাইলেও যেন নড়তে পারছে না সামনে থেকে। উলটো হাতে চোখ মুছে নেয়, কিন্তু কিছুতেই অভির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। ওর মাথায় অভির উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ ওর বুকের মাঝে ভীষণ আন্দোলন ডেকে আনে।
মেয়েটা যে কিছুতেই মাথা উঁচু করছে না, কি মুশকিল। অভি এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দিয়ার মাথায় আলতো নাক ছুঁইয়ে বলে, “এত সকালে এই ভাবে কেউ যদি আমাদের দেখতে পায় তাহলে সেটা খারাপ দেখাবে দিয়া।”
মরন দশা আমার, দিয়া ভাবে। দিয়ার বুক ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আর অভি এখন পরে আছে কে কি ভাববে না ভাববে সেই চিন্তায়। শেষ বারের জন্য ঝাঁঝিয়ে উঠতে মন করে, বলে ফেলে, কেউ দেখুক না দেখুক সেটা তে তোমার খুব চিন্তা তাই না। না দিয়া সেই কথা মুখে আনতে পারেনি, শুধু মনে হয়েছে ওর গায়ের কোট, ওর হাসির আওয়াজ আর অভির ওইভাবে মাথা হেট করে হাঁটু গেড়ে বসে থাকাটা।
দিয়ার চোখে জল মানায় না একদম, সবসময়ে প্রজাপতির মতন উচ্ছল উদ্দাম দুষ্টুমি করে বেড়াবে সেটাই দিয়ার আসল পরিচয়। মেয়েটা এখন একদম চুপ। এইভাবে শুকনো মুখ করে বসে থাকা দিয়ার মানায় না। মনের কথাটা এই সকালে বলে ফেলাই উচিত না হলে দিয়ার মন কিছুতেই হাল্কা হবে না। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার দিয়ার চোখে জল মানায় না।”
দিয়া প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে না অভি ওর কানে কানে কি বলল। ঠিক শুনেছে, “আমার দিয়া”। ধুকধুক...ধুকধুক... হৃদয়ের স্পন্দন এক ধাক্কায় বেড়ে ওঠে।
অভি না থেমে বলে, “আমার দিয়া শুধু হাসবে আর নেচে বেড়াবে।”
দিয়া এবারে কান্না ভুলে যায়। ভীষণ দুষ্টু এই ছেলেটা। মাথা তুলে অভির দিকে তাকাতে যাবে কি অভির থুতনির মধ্যে দিয়ার মাথা ধাক্কা খায়। উফফফফ...
অভি উফফফ করে ওঠে, “কি হল, এইভাবে মারবে নাকি?”
দিয়া ভুরু কুঁচকে অভির চোখের দিকে তাকিয়ে। সত্যি কি বলতে চাইছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। অভির চোখ জোড়া ভীষণ চকচক করছে, কেমন যেন এক মুচকি দুষ্টুমির হাসি ওই ঠোঁটে মাখা। সত্যি ঠিক দেখছে ত অভিকে? না ঠিক দেখছে। কানে ঠিক শুনেছে, “আমার দিয়া” কি বলতে চাইছে, একবার স্পষ্ট করেই বলে ফেলুক। অভির চোখের হাসি দেখে দিয়া খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে যায়।
চোখের পাতায় জল, অনুরাগের হাসি ঠোঁটের কোনায় মাখিয়ে অভির বুকের ওপর দুম করে একটা কিল মেরে বলে, “শয়তান ছেলে, এবারে সত্যি মারবো কিন্তু।” বলে বুকের ওপর মাথা ঠেকিয়ে দেয়।
পকেটে রাখা ফোনটা অনেক্ষন ধরেই বেজে চলেছে। ফোন বের করে দেখল যে বড়মায়ের বেশ কয়েকটা মিস কল। এতক্ষন ফোনের দিকে খেয়াল করেনি। বাড়ি যাওয়ার তাড়াও আছে, সেই সাথে দিয়াকে ছেড়ে যেতেও ভালো লাগছে না। ভালোবাসার ছোট আভাস, প্রথম পদক্ষেপ, এইভাবে দুম করে সাত সকালে বেড়িয়ে যাবে সেটা কি আর আগে থেকে ভেবেছিল অভিনন্দন? ফোন সাইলেন্ট করে আবার পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল অভি। বড়মা জানে যে দিয়াকে ছাড়তে এসেছে, সুতরাং কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে পারে।
রাস্তার মাঝখানে না হলে অভি তৎক্ষণাৎ দিয়াকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিত। দুই হাতে পিষে ধরত প্রথম ভালোবাসার ললনাকে। চুমুতে চুমুতে দিয়ার মিষ্টি ঠোঁট জোড়া ভরিয়ে তুলতো। হাত দুটো ভীষণ নিশপিশ করছিল বটে কিন্তু বুকের উচ্ছলতা সামলে বাইকে উঠে বলে, “বিকেলে মার খেতে আসবো।”
দিয়া নেচে ওঠে, বলে কি ছেলেটা, সত্যি আসবে? কিছুই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। শীতের ভোর নয়, যেন বসন্ত কাল এসে গেছে। ভীষণ ইচ্ছে করছে কষে ছেলেটার গালে একটা চড় মারে আর তারপর দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে সেই জায়গায় নরম ঠোঁট চেপে ধরে। শয়তান ছেলে, প্রথমে হাসাবে, তারপর কাঁদাবে, তারপর আবার হাসাবে, তারপর কি যে করবে কে জানে। ব্যাগ দুটো হাতে তুলে মিষ্টি হেসে বলে, “বিকেলে না এলে একদম গলা টিপে দেবো কিন্তু।”
অভি বাইক স্টারট করে মাথা নিচু করে বলে, “জো হুকুম মহারানী।” বলেই বুকের বাঁ দিকে একটা কিল মারে।
মাটিতে পা নেই, দিয়া ব্যাগ হাতে একটু নেচে ওঠে। নাক কুঁচকে, ঠোঁট কুঁচকে হাওয়া চুমু ছুঁড়ে দেয় অভির দিকে। ভুরু নাচিয়ে ইশারা করে, “এবারে যাও।”
অভি দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি আগে বাড়িতে ঢোক তারপর যাবো।”
দিয়া জোরে মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, আগে তুমি আসো তারপর আমি যাবো।”
আবার বড়মায়ের ফোন, পকেটের মধ্যে ক্রমাগত ভাইব্রেট করে চলেছে। অগত্যা অভি কি করে, হেলমেট চাপিয়ে বাইক চালিয়ে দেয়। তিরিশ মিনিটের পথ, পোনেরো মিনিটে পার করে দেয়। শেষ পর্যন্ত মনের কথাটা বলে ফেলে বেশ হাল্কা মনে হচ্ছে, মনেই হচ্ছে না যে বাইক চালাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন এক পক্ষীরাজ ঘোড়ার পিঠে চেপে নীল আকাশের বুকে উড়ে চলেছে। কি ভীষণ দুষ্টু মেয়েটা, গতকাল রাতে যেভাবে বুকের ওপরে মাথা রেখে একটু খানি শুয়েছিল, তাতে অভির বুকের স্পন্দন যে কতজোরে ধুকধুক করছিল সেটা বোঝানোর উপায় নেই। মনে হয়েছিল অন্ধকার গাড়িতে দিয়ার ঠোঁটে একটা মিষ্টি চুম্বন এঁকে দেয়।
দিয়া, দময়ন্তী ঘোষ, কবে প্রথম দেখা হয়েছিল মেয়েটার সাথে? কবে সঠিক ভাবে মাথায় এসেছিল? প্রায় এক বছর আগের কথা, ঝন্টুর বিয়েতে প্রথম দেখা। বরের গাড়ি বিয়ে বাড়ির সামনে থামতেই, গাড়ির দরজা খুলে প্রথমে নেমে এসেছিল অভি। ঝন্টু তখন গাড়ির মধ্যে বসে। বর এসেছে, বর এসেছে, বিয়ে বাড়িতে ভীষণ শোরগোল বেধে যায়। বাড়ির সামনের লোহার গেট আটকে লেখার বোনেরা আর বান্ধবীরা, দশ হাজার না দিলে বরকে ঢুকতে দেবে না। মেয়েদের দলের মধ্যে সব থেকে সামনে ছিল দিয়া, দুই হাতে গেটের দুই পাল্লা ধরে অভির সামনে দাঁড়িয়ে। অভিও কম যায়না, দশ হাজার কেন চাই? আমাদের ছেলের দাম কি শুধু মাত্র দশ হাজার নাকি? সেই শুনে দিয়া বলেছিল, না, ভাবলাম এত দুর থেকে এসেছেন তাই শুধু মাত্র দশ হাজারে ছেড়ে দেই। অভি হেসে ফেলে, এতদুর থেকে এসেছি বলেই তো কোন টাকা পয়সা আনিনি। এখানে ভাবলাম ফ্রিতে খানা পিনা পাবো, মজা করব আর চলে যাবো। ওর এই কথা শুনে সবাই কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না। দিয়া হারতে নারাজ, দশ হাজার দিলে তবেই গেট খুলবে। অভিও সমান তালে বলে, দশ হাজার পয়সা দিতে পারে এর বেশি নয়। অভি, পাশের একজনকে ডেকে একটা চেয়ার আনতে বলে, সেই চেয়ারে গেটের সামনে বসে পরে। ঝন্টু তখন গাড়ির ভেতর। ওদিকে মেয়েদের জটলার পেছনে লেখার মা বরন কুলো নিয়ে প্রস্তুত, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, বরকে বরন করে আনতে হবে। অভি সেটাই চাইছিল, যতক্ষণ না বড়রা মধস্ততা করবে ততক্ষন এরা কিছুতেই গেট ছাড়বে না। দেরি দেখে শেষ পর্যন্ত পাপা অভিকে বলেন যে এত জেদ না করে যা চাইছে দিয়ে দিতে। পাপার আদেশ অমান্য করতে পারে না, অগত্যা অভি পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দিয়ে দেয়। কিন্তু দিয়া আর বাকি মেয়েরা সেটা কিছুতেই নেবে না, দশ হাজার টাকা না দিলে কিছুতেই গেট ছাড়বে না। অভি বলল এর বেশি এক পয়সা নেই, ওর কাজ ছিল বর আনার, বর এনেছে, এবারে মেয়ের বাড়ির লোকেরা ঠিক করুক বিয়ে করাবে কি করাতে চায় না। ওইদিকে লেখার বাবা এসে শেষ পর্যন্ত মেয়েদের জটলাকে শান্ত করান। সেই প্রথম দেখা দময়ন্তীর সাথে। ভারী সুন্দর সাজিয়েছিল নিজের প্রানের বান্ধবীকে। তারপর আর সেভাবে দিয়ার সাথে পরিচয় হয়নি অভির। ভাগ্নে তিতাসের শরীর খারাপ করল, সেই রাতেই গাড়ি করে বড়দিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল অভি। বৌভাতের দিনে কাজের মধ্যে ব্যাস্ত থাকায় আর ঠিক ভাবে দেখা হয়নি দিয়ার সাথে। তারপর দময়ন্তী নামটা মুছে গিয়েছিল ওর মাথা থেকে। দিদিভাইয়ের বিয়েতে, লেখা যদি দিয়াকে না ডাকতো তাহলে চিরতরে মুছে যেত দিয়া।
বাড়ির সামনে বাইক রাখতেই দিয়ার ফোন আসে, “পৌঁছেছ?”
অভি হেসে বলে, “হ্যাঁ রে বাবা, এই পৌছালাম, এখন বাড়িতে ঢুকতে পারিনি।”
দিয়া প্রশ্ন করে, “বিকেলে কখন আসবে?” দিয়ার কণ্ঠে সেই পুরানো উতফুল্ল, পুরানো চঞ্চলতা শুনে নেচে ওঠে অভির হৃদয়।
অভি মনে মনে একটু খানি সময় হিসেব করে উত্তর দেয়, “এই পাঁচ’টা নাগাদ পৌঁছে যাবো।”
দিয়া যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে, “আচ্ছা আমরা কোথায় যাবো?”
অভি হেসে ফেলে, “তোর প্রেমের চোরাবালিতে যাবো...”
দিয়া ফোনের মধ্যে চুমু ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “তাহলে তাড়াতাড়ি আসিস ডুবে মরতে...”
তোর প্রেমের চোরাবালিতে, হারাতেও নেই ভয়,
চাই না কেউ আমাকে টেনে তুলুক, বিচ্ছিন্ন করে দিক দুটি প্রান,
তোর নীলচে চোখের চোরাবালিতে ডুবে মরব বলে এসেছি তোর কূলে,
এই মরনেও সুখ, তোর বুকে জমা চোরাবালিতে।।