06-09-2020, 08:41 PM
।। আট ।।
পোশাকটা গায়ে আবার যথারীতি চড়িয়ে নিয়ে দেবিকা বলল, "চলো তাহলে তোমাকে একটু এগিয়ে দিই। বাড়ী ফিরবে যখন, এখন ধর্মতলা থেকে প্রচুর মেট্রো ট্রেন আছে। স্টেশন অবধি তোমাকে একটু পৌঁছে দিয়ে, তারপর না হয় আমি আবার ফিরে আসবো এখানে।"
ওর সঙ্গ আমার ত্যাগ করতে ইচ্ছ করছিল না একেবারেই। দেবিকাকে বললাম, "কাল সকালে তাহলে আমাদের দেখা হচ্ছে আবার। তোমাকে কি টালীগঞ্জে পাবো? তুমি আসবে আবার?"
দেবিকা বললো, "নিশ্চয়ই আসবো। রোজ তো যেতে পারি না এখন। তবে তোমার জন্য নিশ্চই আমি যাবো।"
আমি জামা প্যান্ট পরে নিয়ে ওর সাথে আবার হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে আসলাম। পায়ে হেঁটে ধর্মতলায়। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যেই হাত ধরাধরি করে হাঁটছে কত কিশোর কিশোরী আর যুবক যুবতী।
কিন্তু এই ভীড়ে লোকে কেমন আলাদা রকম চোখে দেখছে আমাকে। দেবিকার মতো সুন্দরী যুবতীকে পাশে নিয়ে হাঁটছি, হয়তো সেই জন্যই। ওকে জড়িয়ে ধরছি, রাস্তার মধ্যেই আদর করছি। ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছি। আর আমার আচরণ দেখে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে সবাই। খুব কাছ থেকে কিছু লোক, আমাকে ওরকম করতে দেখে হাসতে হাসতে চলে গেলো। ভাবছি, যে যা ভাবছে, ভাবুক, আজ আমার এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
দেবিকা বলল, "চলো তোমার সাথে নিচে একেবারে পাতাল অবধি যাই। তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে, আমি আবার উঠে আসবো উপরে।"
সিঁড়ি দিয়ে পাতালের মধ্যে ঢুকে, আমি টিকিটের লাইনে দাঁড়ালাম। দেবিকাকে বললাম, "তোমার জন্যও একটা টিকিট কাটি। নইলে তো মেশিন আটকে দেবে। টিকিট ছাড়া ঢোকা যে অসম্ভব।"
তবু দেবিকা বললো, "কাটছো কাটো। কিন্তু আমার এখন টিকিট না হলেও চলে।"
ওর কথা শুনে একটু অবাক হলাম। তবুও টিকিট কাটলাম। দেবিকা অপেক্ষা করছে একটু পেছনে। কিন্তু কাউন্টার ছেড়ে বেরুবার পরেই লক্ষ্য করলাম, ও ওখানে আর দাঁড়িয়ে নেই। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে দেবিকা নেই। নিমেষের মধ্যে ভ্যানিস হয়ে গেছে, চোখের সামনে থেকে।
অবাক হলাম, এই তো ছিল কাছে। আবার তাহলে কোথায় গেল?
সন্ধেবেলা অফিস ফেরত নিত্যযাত্রীদের তাড়াহূড়োতে হূড়োহূড়ি। কিন্তু এর মধ্যেই দেবিকা আমার চোখের সামনে থেকে উধাও। মনটা ভীষন ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। দেবিকা কোথায় হারিয়ে গেলো, ওকে খোঁজার জন্য আমি ছটফট করে এদিক ওদিক তখন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছি।
দেবিকাকে হঠাৎই লক্ষ্য করলাম ও হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। একজন লম্বা ফর্সা পুরুষ টিকিট হাতে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মেশিনটার দিকে। ট্রেন ধরবে বলে অন্যকয়েকজন যাত্রীদের মতো সেও পা বাড়িয়েছে ঐ গেটের দিকে, আর দেবিকাও ঠিক যাচ্ছে ওর পেছনে পেছনে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, "দেবিকা, কোথায় যাচ্ছো তুমি? দেবিকা তুমি তো আমার কথার কোনো জবাব দিলে না।"
অদ্ভূত ব্যাপার। লোকটা টিকিটটা মেশিনে ঢুকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু দেবিকা ওর পেছনে পেছনে প্রবেশ করলো টিকিট ছাড়াই।
ট্রেন আসছে একটা দমদম থেকে। লোকটা তাড়াহূড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে ট্রেনটা ধরবে বলে। দেবিকাও খুব দ্রুত পা চালিয়ে নামছে লোকটাকে পিছু পিছু ধাওয়া করে।
আমি অবাক হলাম। টিকিট মেশিনে ঢুকিয়ে আমিও দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেবিকা তখন তরতর করে নীচে নেমে অনেকটা এগিয়ে গেছে সামনে। দূর থেকে দেখলাম দমদম থেকে টালীগঞ্জ যাবার ট্রেনটা তখন অনেকটাই এগিয়ে এসেছে সামনে। লোকটা প্ল্যাটফর্মের খুব ধারে চলে গেছে। দেবিকাও ঠিক ওর পেছনে। ট্রেন আরো সামনে আসা মাত্রই, পেছন থেকে আচমকাই লোকটাকে ঠেলা মারলো দেবিকা। লম্বা লোকটার শরীরটা ট্রেনের চাকার সামনে পরে গেলো। সেই সাথে দেবিকাও ঝাঁপ দিলো সামনে। মনে হলো ট্রেনের তলায় কাটা পরে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল দুজনের দেহটা।
ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে একটু দূরে। ড্রাইভার ব্রেক কষেও মনে হয় বাঁচাতে পারেনি ওদের দুজনকে। আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে অনেকে। এগিয়ে দেখছে অনেকে, কি হলো শেষ পর্যন্ত ওদের দুজনের। আমি স্তম্ভিত। মর্মান্তিক একটা দৃশ্য দেখলাম চোখের সামনে। ভাবতেই পারছি না, দেবিকা এমন কাজটা করলো কি করে?
প্রতিশোধের আগুনটা জ্বলতে দেখেছিলাম দেবিকার শরীরে। ও বলেছিল, যদি কোনোদিন ওর পুরোনো প্রেমিককে ও দেখতে পায়, তাহলে শোধ তুলবে। উশুল করে নেবে নিজের অপূরনীয় ক্ষতিটাকে। কিন্তু তা বলে কি এইভাবে? একজনকে হত্যা করে, নিজেকেও আত্মাহুতির বলি দিয়ে? কেন দেবিকা এভাবে শেষ করে দিল জীবনটাকে? আমি তো ওকে নিয়ে নতুন স্বপ্নই গড়তে চেয়েছিলাম। নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার আগে দেবিকা একবারও কি আমার কথা চিন্তা করলো না।
ভাবছি, আর শরীরটা তখন থরথর করে কাঁপছে আমার। শুনেছি, মেট্রোর লাইনে ঝাঁপ দিয়ে নাকি প্রাণ হানির ঘটনা আকছার ঘটে। কিন্তু আজ যা চোখের সামনে দেখলাম, কেউ হয়তো জীবনে কল্পনাও করতে পারবে না।
আর একটু আগে থেকে যদি তৎপর হতাম, দুটো প্রাণকেই হয়তো আমি বাঁচাতে পারতাম।
[size=undefined]
কর্তা ব্যক্তিরা এরপর সব একে একে এলেন। লাইন থেকে দেহ দুটো তোলার তোড়জোড় চলছে। একজন তার মধ্যে বললেন, দু মাস আগে একটি অল্পবয়সী মেয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল লাইনে। আজ আবার একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ঘটলো। তবে এবার মনে হয় কোনো একজন পুরুষের প্রানহানি ঘটেছে। সবাই তো তাই বলছে। সিসিটিভি ক্যামেরাতেও তাই ধরা পরেছে।
আমি খুব কাছেই ছিলাম, বললাম, "না না কি বলছেন, আমি দেখেছি, দুজনকে। একটি লোক আর তার পেছনে ছিল একটি মেয়ে। মেয়েটি পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে লোকটাকে। তারপর নিজেও প্রাণ দিয়েছে।"
ওরা বললো, "আপনি কাকে দেখেছেন? আমাদের ক্যামেরাতে তো সেরকম কোনো মেয়ের ছবি ধরা পরেনি। যে লোকটা পড়ে গেল ট্রেন আসার আগের মূহূর্তে। ওর পেছনে তো কোন মেয়ে ছিল না।"
আমি অবাক হলাম। কি বলছে এরা? আমি দেবিকাকে দেখলাম। ও এতক্ষণ আমার সাথে ছিল। আমি ওর সাথে যৌনসঙ্গম করলাম। আমাকে ও দূঃখের কাহিনী শোনালো। তারপরই এই ঘটনা। অথচ এরা বলছে কোনো মেয়ে ঝাঁপ দেয় নি? এর মানেটা তাহলে কি?
একজন তার মধ্যে একটু আমার সাথে আলাদা করে কথা বলার জন্য এগিয়ে এলেন। বললেন, "কি ব্যাপারটা কি বলুন তো? আপনি সঠিক কি দেখেছেন?"
ওনাকে সমস্ত ঘটনাটাই খুলে বললাম। উনি হেসে বললেন, "আপনি সুস্থ আছেন তো? কি যা তা বলছেন। একটি মেয়ে পেছন থেকে লোকটিকে ধাক্কা মেরেছে। আপনি বলছেন দেখেছেন। অথচ আর কেউ দেখেনি। এও কি হতে পারে নাকি?"
আমি চেঁচিয়ে বললাম, "কেন আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করছেন না? আমি সত্যি দেখেছি। মেয়েটির সাথে টালীগঞ্জ থেকে একসাথে ট্রেনে করে আমি এসেছি। মেয়েটি আমার সাথে এতক্ষণ ছিল। আমি ওর বাড়ী গেছি। ওর সাথে কথা বলেছি। ওর সাথে প্রেম ভালবাসা করেছি। শরীরে শরীর বিনিময় করেছি। একসাথে জীবন কাটাবো বলে চিরপ্রতিজ্ঞা করেছি। মেয়েটি ওর দূঃখের কাহিনী শুনিয়ে আমাকে ওর পুরোনো প্রেমিকের কথা বলেছে। যে ওর সাথে প্রতারণা করেছে, ওর জীবনটাকে নষ্ট করেছে। তাকেই ও ধাক্কা মেরেছে পেছন থেকে। আমি সচক্ষে দেখেছি।"
আশে পাশের লোকজন ভীড় করে ফেলেছে আমার কথা শোনবার জন্য। কেউ মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। কেউ বা করছে হাসাহাসি। ভাবছে কি পাগলের প্রলাপই একনাগাড়ে করে যাচ্ছে লোকটা।
আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আর ভাবছি দুটো দেহ যখন একসাথে ট্রেন লাইন থেকে তোলা হবে, তখনই বোধহয় ভুলটা এদের ভাঙবে।
লোকটির ছিন্ন ভিন্ন দেহটাকে কাপড়ে মুড়ে যখন ট্রেন লাইন থেকে তোলা হলো, তখন সত্যি আমার কথা মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেল। ওর দেহের সাথে আর কোনো মৃতদেহ তখন ছিল না। কোনো মেয়ের দেহ পাওয়া যায় নি। দেবিকার শরীরটাকে খুঁজে পায়নি উদ্ধারকারী দল।
দেবিকা আমাকে কথায় কথায় বলেছিল, "ও আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে......" তখন কথাটা ধরতে পারিনি। দেবিকা বলেছিল আমি মরেও শান্তি পাবো না। এই দুটো কথার মধ্যেই ও বোঝাতে চেয়েছিল, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছো তুমি, সে আর ইহজগতে বেঁচে নেই। এই পাতালেই মৃত্যু ঘটেছে তার।
পুরোনো রেকর্ড বলছে, দুমাস আগে একটি সুন্দরী মেয়ের মৃত্যু হয় বালীগঞ্জ স্টেশনে। কিন্তু সেটি আত্মহত্যা না কি হত্যা? সে রহস্য ভেদ করতে পারেননি কেউ । কিন্তু পেরেছি আমি। দেবিকার আত্মাটা শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছিল এতদিন,এ স্টেশন থেকে ও স্টেশনে। ওর আত্মার সাথে যৌনসংসর্গ করেছি আমি। ভাবতেও গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে। দেবিকা প্রতিশোধ নিয়েছে। আর ওর আত্মারও মুক্তি ঘটেছে চিরতরে।
[/size]
সমাপ্ত
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!