Thread Rating:
  • 32 Vote(s) - 3.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মহানগরের আলেয়া
চৌষট্টি ছক (#০৪)


এতক্ষণ যেন একটা শীতল যুদ্ধ চলছিল ওই রেস্টুরেন্টের টেবিলে। আশেপাশের অনেক লোকের দৃষ্টি ছিল ওদের টেবিলের ওপরে। বিশেষ করে অভিনেত্রী নয়নার জন্য। ওরা উঠে যেতেই অনেকেই নয়নাকে ছেঁকে ধরে। মহুয়া আর দানা আর পেছনে তাকায়নি। বুকের মধ্যে একটা ভালো লাগার মৃদু মলয় নিয়ে দানা আর মহুয়া বেড়িয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

গাড়িতে উঠেই মহুয়া খিলখিল করে হেসে ফেলে, "কেমন দিলাম বলো।"

দানা অবাক হয়ে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাছি মারতে ভয় পেত মহুয়া আর এই কয়দিনে এত পরিবর্তন? সত্যি ভালোবাসা মানুষের হৃদয় বদলে দেয়, মনে এক দুরন্ত শক্তির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়।

দানা গাড়ি চালাতে চালাতে ওকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি ওইখানে ঠিক কি করতে চাইছিলে বলো তো?"

মহুয়া হেসে ওর হাত ধরে বলে, "পারলে কুটিকুটি করে কেটে ফেলতাম, কিন্তু মেয়েটাকে দিয়ে অনেক কাজ করানোর বাকি, তাই না। তাই ছেড়ে দিলাম। পরে অনেক কাজে আসবে এই মেয়ে। আমার কথা লিখে রাখো।"

দানা জিজ্ঞেস করে, "কি রকম কাজে আসবে?"

মহুয়া হেসে বলে, "আরে দেখো না, ঠিক সময়ে তোমার নিজের বুদ্ধি খুলে যাবে। আমার মন বলছে এর সাহায্যে আমরা রমলাকে ধরতে পারবো, আর রমলাকে ধরতে পারলে হয়ত কঙ্কনা আর নাসরিনের খবর পাওয়া যাবে। আস্তিনে একটা তাস থাকা ভালো। নাও নাও গাড়ি চালাও এইবারে। ওইদিকে পিন্টু আবার মণির পেছনে লাইন মারছে বুঝেছো।"

হেসে ফেলে দানা, ওর কাজের মেয়ের পেছনে যে পিন্টু লাগবে সেটা ভালো ভাবেই জানত। মেয়েটা কালো হলেও দেখতে শুনতে ভালো, পিন্টু এলেই আগ বাড়িয়ে জল দেয়, ওর চোখের সামনে বেশ ঘোরাঘুরি করে।

ঠিক পরেরদিন দুপুর নাগাদ নয়না দানাকে ফোনে জানায় একবার বিমানের সাথে দেখা করতে। দানা জিজ্ঞেস করলে নয়না জানিয়ে দেয় দুর গ্রামের বাগান বাড়িতে বিমান চন্দ দানার সাথে দেখা করতে চায়। এই মহানগরের বুকে দেখা সাক্ষাৎ করা বিপ্পজনক, পাছে বাপ্পা নস্করের কানে কথা চলে যায় সেই ভয়ে। বিকেলের দিকে আকরাম নাসিরকে সাথে নিয়ে দানা বেড়িয়ে পড়ে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মহুয়া ওকে বারেবারে সাবধান করে দেয়। দেবুকে ফোন করে দানা, জানতে চায় বিমান চন্দ একা না সাথে কেউ আছে। দেবু ওকে জানায় যে বাড়ির মধ্যে বিমান চন্দ, নয়না, সমুদ্র ছাড়া আর কেউ নেই। সেই শুনে দানা স্বস্তির শ্বাস নেয়। ওর শুধু একমাত্র ভয় মহুয়া আর রুহিকে নিয়ে। এই দুইজনে যদি পাশে না থাকত তাহলে অনেকদিন আগেই খুনোখুনিতে নেমে পড়তো।

গ্রামের ওই নির্জন বাগান বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। বুকের ভেতর টানটান উত্তেজনা, বাড়ির ভেতরে কি শুধু মাত্র তিনজন না আরো কেউ অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে? দেবু নিশ্চয় বিমানের খাস লোক। ওকে কতটা বিশ্বাস করা যেতে পারে। সঠিক জানা নেই দানার। বড় বড় গাছের মাঝাখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। বাড়ির সামনে দুটো গাড়ি পাশাপাশি দাঁড় করানো। চিনতে অসুবিধে হয় না, একটা নয়নার অন্যটা বিমান চন্দের। ওর গাড়ির আওয়াজ শুনে সমুদ্র বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। পকেটের পিস্তল দেখে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে দানা, পেছন পেছন আকরাম আর নাসির।

সমুদ্র এগিয়ে এসে ওদের তিনজনকে দেখে বলে, "শুধু মাত্র তুই ভেতরে ঢুকতে পারবি, আর কেউ নয়।"

দানা মৃদু হেসে বলে, "ওরা বাড়িতে ঢুকতে আসেনি রে। চল চল ভেতরে চল।" ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ফিসফিস করে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে, "কি রে, বিমানের কি মতিগতি রে?"

সমুদ্র বাঁকা হেসে বলে, "শালা কুত্তা, তুই এই কয়দিনে অনেক ঝানু মাল হয়ে গেছিস। যাই হোক বিমানের মতিগতি ভালোই আছে।" চোখ টিপে চোরা হেসে বলে, "বুঝতেই পারছিস পাশে নয়নাকে পেয়েছে।" দুইজনেই হেসে দেয় ওই কথায়।

যদিও এর আগে অনেক বার নয়নাকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছে, তবে দানা কোনোদিন ভেতরে ঢোকেনি। ছোট বাড়ি তাই বসার ঘর ছোট। একটা ছোট কাঁচের টেবিলের চারপাশে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা সোফা। ওকে দেখেই নয়না আময়িক হেসে উঠে দাঁড়ায়। বিমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিমান আপাদমস্তক দানাকে জরিপ করে। কিছুদিন আগে এই ছেলেটা নয়নার গাড়ি চালাত আর আজকে ওকে পাশে বসিয়ে কথা বলতে হবে ভেবেই ওর চোখমুখ কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু নয়না যা বলেছে সেটা যদি দানা করতে পারে তাহলে অনেক লাভবান হবে। দানা অল্প মাথা নুইয়ে বিমানের সামনের একটা সোফায় বসে পড়ে। ওদের মাঝখানের সোফায় নয়না বিরাজমান।

বিমান সোজাসুজি দানাকে প্রশ্ন করে, "দেখ দানা, নয়নার কথা শুনেই তোমাকে ডাকা। আমি কি চাই সেটা আশা করি ভালো ভাবে জানো। আগে সেটা সম্পন্ন হোক তারপরে মোহনের সাথে আমি তোমার দেখা করিয়ে দেব।"

দানা জানে এইখানে ওর বস্তির মানসিকতা নিয়ে থাকলে চলবে না। ওকে এক ধুরন্ধর খেলোয়ার হতে হবে। চোয়াল চেপে বাঁকা হেসে বিমানকে বলে, "আপনি আগে মোহন খৈতানের অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প গুলো আমার নামে করান তারপরে বাপ্পা নস্করকে সরানোর ব্যাবস্থা আমি করবো।"

বিমান ধূর্ত এক হাসি দিয়ে বলে, "তোমার মতন হাজার হাজার মানুষ চড়িয়ে খাই। আগে তুমি তোমার কাজ করো, তারপরে আমি করবো।"

দানা হাত মুঠো করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বিমান চন্দের দিকে হিমশীতল চাহনি দিয়ে বলে, "বাপ্পা নস্করকে সরানোর ইচ্ছে আমার নেই বিমান বাবু। তার দৌলতে আমার ব্যাবসা ভালোই চলছে। মাঝ পথে বাপ্পা নস্করকে উস্কিয়ে সেই ব্যাবসায় ক্ষতি আমি করতে চাই না।" নয়নার দিকে তাকিয়ে দাঁত পিষে বলে, "বাকিটা আমি কি করতে পারি সেটা নয়না আপনাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবে। আমি আসি কেমন।"

ওই চাহনি দেখে নয়নার বুক এক অজানা শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দানার হাত ধরে বলে, "না না যেও না। বিমান করবে।" বিমানের দিকে ঝাঁঝিয়ে ওঠে নয়না, "তুমি কি করছো? এটা কেন বুঝতে পারছো না যে দানা আমার খুব বিশ্বাসী। সেদিন তোমাকে আর আমাকে একসাথে দেখার পরেও কিন্তু বাপ্পার সামনে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি। বুঝতেই পারছো দানা আমার কথা কতটা মেনে চলে। তুমি মোহনের সাথে কথা বলো। ওকে বুঝাও, ওকে মানাও। এইভাবে প্রকল্প গুলো পড়ে থাকলে তোমার লোকসান মোহনের লোকসান। তার চেয়ে ওই প্রকল্প গুলো দানার নামে করে দিতে পরামর্শ দাও। বাপ্পা নস্কর ভাববে দানা তোমাদের হাতের মুঠোতে করে ফেলেছে। বাপ্পা নস্কর নিশ্চিন্ত হলেই দানা ওর ওপরে চরম আঘাত হানতে পারবে।"

মুখের সামনে হাত মুঠি করে বিমান অনেকক্ষণ চুপচাপ দানার দিকে তাকিয়ে চিন্তা মগ্ন হয়ে যায়। দানাও চুপচাপ বিমান চন্দকে আর নয়নাকে পড়ার চেষ্টা চালায়। ইষ্ট নাম জপ করে দানা, এইবারে ধরা পড়ে যাবে না তো এই দুইজনার কাছে। দুইজনেই একসাথে জালে উঠে গেছে। চোখে মুখে জয়ের ছোঁয়া, কিন্তু এই ভাবব্যাক্তি কিছুতেই ওদের সামনে দেখান যাবে না।

বেশ কিছুক্ষন পরে গলা খাঁকড়ে দানা বিমানকে জিজ্ঞেস করে, "কি ভাবলেন বিমান বাবু? হাত বাড়াবেন না আমি চলে যাবো। বুদ্ধিমতী নয়না কিন্তু সঠিক বুদ্ধি দিয়েছে। মোহন খৈতানের প্রকল্প গুলো আমার হাতে চলে এলে বাপ্পা নস্কর নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে আমি ওর লোক আর তখনি ওকে আঘাত করার মোক্ষম সুযোগ চলে আসবে।"

বিমান চন্দ অনেক ভেবেচিন্তে দানার কাছ থেকে দুইদিনের সময় চায়। নয়নাকে বুদ্ধিমতী বলাতে খুব খুশি। মনে প্রাণে দানাকে ধন্যবাদ জানায়। গাড়িতে ওঠার আগে দানার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে কানে কানে বলে, "তোমার স্ত্রী সত্যি ভারী সুন্দরী, তাই বলে কি আমাকে ভুলে যাবে?"

দানা মাথা নাড়িয়ে ওর গালে আলতো টোকা দিয়ে বলে, "ইসসস তুমি না সত্যি বড় মিষ্টি। যাই হোক পারলে এই আলোচনার রেকর্ডিংটা দিও।"

নয়না মিচকি হেসে মাথা দোলায়, "সমুদ্র সব রেকর্ড করেছে। তোমার চিন্তা নেই, দিয়ে দেব।" দানার হাত ধরে অনুরোধ করে, "একদিন বিকেলে মিসেস আর মেয়েকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসো।"

দানা মাথা দোলায়, সময় করে একদিন আসবে। তবে মনের গভীরে এক শঙ্কা দেখা দেয়। নয়না এই হাসি হাসি চেহারার পেছনে কোন ষড়যন্ত্র লুকিয়ে সেটা কিছুতেই ধরতে পারে না। মনে মনে একটা জয়ের হাসি নিয়ে ওইখান থেকে বেরিয়ে পড়ে দানা।

বাড়িতে এসে মহুয়াকে সব খুলে বলতেই ওকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খায়। একে একে ওদের জালে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সবাই, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর এখন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। কঙ্কনা আর নাসরিনের খবরাখবর নেই, রমলা বিশ্বাস না বিমান চন্দ, কে মৈনাকের আসল খুনি সেটাও জানা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত রমলার পেছনে চর নিযুক্ত করা হয়নি, রমলার দুর্বলতা শুধু মাত্র নয়না জানে কিন্তু ওকে বেশি চেপে ধরলে উলটো ফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সেইদিন রাতে নয়না ওকে ফোনে জানায় যে বিমান রাজি আছে মোহনের সাথে দেখা করানোর জন্য আর মহুয়ার নির্দেশ অনুযায়ী ওদের আলোচনা সমুদ্র রেকর্ড করে নিয়েছে। পরের বার দেখা হলে সেই টেপ দিয়ে দেবে।
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মহানগরের আলেয়া - by Mr Fantastic - 01-09-2020, 12:19 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)