30-08-2020, 09:38 PM
মহুয়া ওইদিকে বসে নেই, রুহিকে কোলে নিয়েই কাজে নেমে পড়ে। সব থেকে আগে একটা গাড়ি কিনতে হবে। দানা আর মহুয়া একটা কালো বি.এম.ডাবলু কেনে, দামী বিদেশী গাড়ি শক্তির সাথে সাথে বিত্তের পরিচয়। সামনের মানুষ দানার পোশাক পরিচ্ছদ, দানার গাড়ি দেখেই সর্ব প্রথম যাচাই করবে। এতদিন এম্বাসেডর ট্যাক্সি চালক দানা কোনোদিন স্বপ্নে ভাবেনি নিজের একটা কালো বি.এম.ডাবলু গাড়ি হবে। হাতে চাবি পেয়ে, মহুয়াকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে।
গাড়ির পরে সব থেকে জরুরি টাকা। মহুয়ার নামে যে একশো কোটি টাকার শেয়ার আর বন্ড ছিল সেইগুলো বিক্রি করে প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা হাতে আসে। অত টাকা পাবে সেটা আশাতীত তাই দুইজনে অবাক হয়ে যায়। নতুন কোম্পানির নাম, মেয়ের নামেই রাখা হয়, "রুহি বিল্ডারস প্রাইভেট লিমিটেড।" মহেশ বাবুর তদারকিতে কয়েকদিনের মধ্যে অফিসে লোকজন নিযুক্ত করা হয়। ছোট অফিস, দশ জনের মতন ছেলে মেয়ে নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। মহুয়ার কাজ অফিসে গিয়ে বসা, কিছু না হোক মালিক চোখের সামনে থাকলে কাজ সবাই করে না হলে কেউ কাজ করে না। মহুয়া চায় না অফিসের অবস্থা "চাষা গেল ঘর লাঙ্গল তুলে ধর" এর মতন হোক। রুহি ছোট ছোট পায়ে সারা অফিস ঘুরে সবাইকে মাতিয়ে রাখে।
নিজের গাড়ি নিজেই চালায় দানা। আগে হলুদ রঙের ভাড়ার ট্যাক্সির স্টিয়ারিং হাতে থাকতো এখন নিজের কালো বি.এম.ডাবলুর স্টিয়ারিং। পোশাকে তেমন কিছু ফের বদল হয়নি, যদিও মহুয়ার ইচ্ছে দানা সুট পরুক কিন্তু সেটা দানার একদম ইচ্ছে নয়। একটা সামান্য ট্যাক্সি চালক কি আর সুট পরে? মহুয়া যত ওকে বুঝাতে চায় যে দানা আর সেই ট্যাক্সি চালক নয়। জেদি মহুয়া ওর জন্যে বেশ কয়েকটা সুট বানাতে দেয়।
সকালে রুহি আর মহুয়াকে অফিসে ছেড়ে দিয়ে মহেশ বাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে দানা। মহেশ বাবু ওকে নিয়ে নিজের প্রোজেক্ট গুলো দেখান, কেমন ভাবে কাজ হয়, কার সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয়। ভিতে বেশি সময় লাগে, একবার ভিত গড়ে উঠলে বাকি বিল্ডিং তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা যায়। দানা মন দিয়ে মহেশ বাবুর কাছ থেকে এই ব্যাবসা সংক্রান্ত সব কিছু শিখে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এখন এলাকার কোন বিল্ডারদের সাথে দেখা করা হয়নি দানার। বাপ্পা নস্করের সেক্রেটারি, ইন্দ্রনীল ওদের সাথে কথাবার্তা বলেছে কিন্তু কেউই ওদের জমি ওদের অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প দানাকে বেচতে নারাজ। একদিন দানা নিজেই মহেশ বাবু আর ইন্দ্রনীলকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার এক নামকরা বিল্ডার, সুব্রতর অফিসে যায়। অফিসের সামনে কালো বি.এম.ডাবলু. দাঁড়াতেই সুব্রত অফিস থেকে বেড়িয়ে আসে। দানাকে আগে এই এলাকার উন্নয়নের জন্য দেখেছে তবে বিল্ডার হিসাবে পরিচয় তখন ছিল না। দানার সঙ্গে ইন্দ্রনীলকে সঙ্গে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে দানা বাপ্পা নস্করের খাস লোক।
দানা অফিসে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে সুব্রতকে জিজ্ঞেস করে, "আপনার আজকাল কাজ কেমন চলছে?"
সুব্রত দানাকে বসতে বলে, "দেখুন আমি জানি আপনি কেন এখানে এসেছেন।"
দানা সোজাসুজি সুব্রতকে প্রশ্ন করে, "কয় মাস হয়ে গেল আপনার কাজ বন্ধ, এক বছর হয়ে গেছে তাই না?"
অগত্যা সুব্রত মাথা দোলায়, "হ্যাঁ।"
দানা জিজ্ঞেস করে, "কত টাকা লোকসান হয়েছে আপনার?"
সুব্রত বাঁকা হেসে বলে, "তাতে আপনার কি দরকার?"
ইন্দ্রনীল ওকে বলে, "দেখুন মিস্টার সুব্রত, আমরা এইবারে চাঁদা অথবা প্রকল্পের অংশীদার হতে আসিনি। আপনার যত টাকা খরচ হয়েছে ঠিক সেই দামে দানা আপনার ওই অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প কিনতে চায়।"
সুব্রত একটু ভেবে বলে, "এই এক বছরে অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছে। জিনিস পত্রের দাম বেড়ে গেছে। দেখুন আমি ব্যাবসায় নেমেছি কিন্তু বাপ্পা নস্কর যদি কুড়ি পঁচিশ শতাংশ চায় তাহলে কি করে কাজ করি বলুন?"
ইন্দ্রনীল কিছু বলতে গেলে দানা ওকে থামিয়ে নিজে উত্তর দেয়, "মিস্টার সুব্রত, আমি জানি আপনি ব্যাবসা করতে এসেছেন। আপনার সামনে কয়েকটা বিকল্প রাখতে পারি। প্রথম বিকল্প, আমি আর আপনি মিলে মিশে কাজ করি। আপনার চল্লিশ শতাংশ থাকুক আমার ষাট তাহলে আপনিও টাকা কামাবেন। দ্বিতীয় বিকল্প, গায়ের জোরে আমি আপনার কাছ থেকে কম দামে প্রকল্প কিনে নেব আর তৃতীয়, আপনি এইভাবে বসে থাকুন আর পাঁচ বছরের জন্য। কেননা এর পরের নির্বাচনে আবার বাপ্পা নস্কর এই আসনে জিতবে এবং আমি জেতাবো।"
পরের নির্বাচনে দানা বাপ্পা নস্করকে সমর্থন করবে জেনে ইন্দ্রনীল সন্তুষ্ট। গায়ের জোরে কিনে নিতে পারে দানা সেটা ইন্দ্রনীলকে সাথে দেখেই বুঝে গেছিল সুব্রত। সুব্রত'র কপালে চিন্তার রেখা দেখা দেয়। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে সুব্রত দানাকে বলে, "জমি কিনতে এক কোটি টাকা লেগেছে আর এখন পর্যন্ত আরো এক কোটি জলে গেছে।"
এইবারে মহেশ বাবু মুখ খোলেন, সুব্রতকে বলেন, "আগে সাইট দেখবো তারপরে কাগজ পত্র দেখব। আপনি যেমন একটা দাম বলেছেন তেমনি আমরাও হিসাব নিরীক্ষা করে তারপরে মুল্য ধার্য করব।"
সুব্রত শেষ পর্যন্ত বলেন, "না মানে কয়েকদিন একটু সময় চাই। তবে আপনার প্রথম বিকল্প আমার বেশ লেগেছে।"
দানাও সেটা চায়, যদিও হাতে টাকা আছে তাও ওই অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প গুলো অংশীদারি হিসাবে কাজ করতে চায়। তাতে মাথা ব্যাথা বেশ কম, আগের মালিকের জানাশোনা লোকের দ্বারা কাজ করানো যাবে। নতুন লোক খোঁজার বালাই নেই। হাতে টাকা থাকলে বেশি প্রকল্পে কাজ করতে পারবে তাড়াতাড়ি টাকা আয় হবে।
কয়েকদিন পরে সুব্রতর সাথে সাথে আরও অনেকজন বিল্ডার প্রমোটার ওর সাথে দেখা করে। সবাইকে এক কথা বলে দানা, সবাই ওর কথায় সম্মতি জানায়। সেদিন ইন্দ্রনীল ছাড়াই দানা আর মহেশ বাবু ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন।
সেদিন দানা ওদের জিজ্ঞেস করে, "আপনাদের কি কারনে বাপ্পা নস্কর বাধা দিয়েছিল বলতে পারেন?"
সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করে, দানা বাপ্পা নস্করের লোক ওর সামনে বাপ্পা নস্করের বিরুদ্ধে বলা উচিত হবে কি হবে না সেই নিয়ে ধন্দে পড়ে যায়।
দানা ওদের অভয় দিয়ে বলে, "বলুন না, সমস্যাটা কি হয়েছিল।"
সবার হয়ে সুব্রত উত্তর দেয়, "আমরা বেশির ভাগ আগে বিমান চন্দের রাজনৈতিক দল করতাম। গত বারে বাপ্পা নস্কর জেতার পরে ওকেও আমরা টাকা দেব বলেছিলাম। কিন্তু বাপ্পা নস্কর আমাদের কাছ থেকে কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ চেয়ে বসে। আমরা ছোট ছোট প্রকল্পে হাত দেই, কুড়ি পঁচিশ শতাংশ যদি একা ওকেই দেই তাহলে বাকিদের দিয়ে আমাদের কি বাঁচবে বলুন?"
বাপ্পা নস্করের দৌরাত্মের বিষয়ে দানা অবগত। দানা মাথা দোলায়, "সত্যি কথা।" একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, "তাহলে আপনারা আমার প্রথম বিকল্প পথেই যেতে চান তাই তো?"
সবাই সম্মতি দেয়। দানা ওদের সাথে হাত মিলিয়ে জানিয়ে দেয় কাগজ পত্র তৈরি করতে। একবার কাগজ পত্র হাতে চলে এলে কাজ শুরু করতে পারে সবাই আর সেই সাথে দানাও ওদের সেই মতন টাকা দেবে।
চৌষট্টি ছক (#০২)
সঙ্গীতাকে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিয়েছে ওর বাবা মা। ইন্দ্রাণী শহর ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে গেছে। যাওয়ার আগে ইন্দ্রাণী ওদের সাথে দেখা করে যায়নি, সেই নিয়ে দানা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেও মহুয়া বুঝতে পারে কি কারনে ইন্দ্রাণী আর ওদের সাথে দেখা করেনি। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, মহুয়ার মনের অবস্থা ঠিক সেই রকম ছিল। কাজের চাপে কয়েকদিনের মধ্যেই ইন্দ্রাণীর কথা ভুলে যায় দানা আর মহুয়া স্বস্তির শ্বাস নেয়।
সঙ্গীতা ফ্রান্সে পৌঁছে দানার কাছে তথ্য প্রমান রেকর্ড করা চিপ পাঠিয়ে দেয়। সেই চিপ থেকে দানা, বাপ্পা নস্করের বিরুদ্ধে প্রচুর কারচুপির প্রমান পায়। সঙ্গীতা বেশ ভালো তদন্ত করেছিল, কবে কোন আমলাকে কত টাকা দিয়েছিল, কোন বিল্ডারকে খুন করেছিল, কোন কোন সরকারী কাগজে হেরফের করেছিল সবার নাম ধাম, তারিখ ইত্যাদি সব কিছু ওই চিপ থেকে উদ্ধার করে।
নাসির আর আকরাম খবর দেয় যে নয়না আবার কাজে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। নয়নার পেছনে ছায়ার মতন লেগে থাকতে নির্দেশ দেয় দানা। ওর নতুন ছবির কাজ পুরো দমে চলছে। কোনদিন খুব ভোরে শুটিংয়ে যায়, কোনোদিন সারাদিন স্টুডিওতে, তবে সমুদ্র আর সুমিতা ওর পাশ ছাড়ে না আর। নতুন ড্রাইভার রেখেছে, তবে সে শুধু ওর গাড়ি চালায় ব্যাস। একজন আলাদা করে দেহ রক্ষীও নিযুক্ত করা হয়েছে। ভীষণ ধূর্ত নয়না হয়ত টের পেয়ে গেছে যে দানা ওর ওপরে নজর রেখে চলেছে, তাই বিমানের সাথে দেখা সাক্ষাৎ আর বাপ্পা নস্করের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দিয়েছে।
নিজের কাজে নেমে দানা বেশ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। বিকেলে অফিস থেকে মহুয়াকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আবার কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোনোদিন জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পায় মহুয়া কোনোদিন পায় না। যেদিন পায় নান সেদিন রাতে ফিরলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ লাগে বাড়িতে। ঠিক সময়ে ফিরলে মহুয়া দরজা খোলে আর অসময়ে ফিরলে কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।
বসন্ত প্রায় শেষ, গ্রীষ্মের মুখে এসে পড়েছে মহানগর। সামনের বাগানে কোকিলের কুহু ধ্বনি রোজ সকালে শোনা যায়। আম বকুলের গন্ধে বাড়ি মম মম করে। বাগানটা একটা রাস্তা পেরিয়েই, মাঝে মাঝে মনে হয় একটু মাতাল হলে ভালো হত। রোজ রাতে মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয় তবে রক্তে একটু সুরা চড়লে আরো ভালো হত। বাড়িতে মেয়ের সামনে মদ খাওয়া যায় না। সেদিন মদনার দোকানে বেশ আড্ডা মেরে সময় কাটিয়ে অনেক রাত হয়ে যায়।
মদনা আর কেষ্ট বারেবারে ওকে বলে, "বাড়ি যা, না হলে ম্যাডাম এই বারে ঝ্যাঁটা পেটা করবে।"
অনেকদিন পরে গলায় চোলাই পড়েছে তাই আর সেইসবে কান দেয় না দানা, "ধুর বাল একটু দাঁড়া এই যাচ্ছি।"
তাও এই যাচ্ছি এই যাচ্ছি করতে করতে রাত দশ’টা বেজে যায়। গাড়িতে উঠে মোবাইল খুলে দেখে প্রায় এক ডজন মিসকল, বুঝে যায় প্রিয়তমা খাপ্পা হয়ে আছে। এই রাতে মধ্য মহানগরে কি আর সেই ফুলের দোকান খোলা থাকবে? দেখা যাক কি হয়। মেয়ের জন্য একটা বড় চকোলেট কেনে। ওই নেশা গ্রস্থ অবস্থায় মধ্য মহানগরের ওই ফুলের দোকানে যায় দানা। বরাবরের মতন হলুদ ফুলের স্তবক চাই ওর। এতদিনে দোকানি ওকে চিনে গেছে। ওকে দোকানে ঢুকতে দেখেই হলুদ ফুলের স্তবক ধরিয়ে দেয়।
দোকান থেকে বের হতে যাবে দানা, দেখে সামনে সমুদ্র দাঁড়িয়ে। সমুদ্র ওকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে ওঠে। সেই সাথে দানার নেশার ঘোর কেটে যায়। রাত সাড়ে দশটা কিন্তু মধ্য মহানগর এলাকায় তখন লোকে লোকারণ্য। রাত যত ঘন হয়, তত এই শহর জেগে ওঠে। আর দশটা এগারোটা মানে মানুষের বিকেল। দানাকে অবশ্য একবার সমুদ্র আগেও ফোন করে ডেকেছিল, কিন্তু দানা জানিয়ে দিয়েছিল যে আর ওই মুখো হবে না। ফোনে গলার স্বর শুনে এইটুকু ধারনা হয়েছিল হয়ত ওরা ওর ওপরে অতটা ক্ষেপে নেই। হয়তো নিজেরাই বুঝতে পেরেছে যা কিছু হয়েছে সেই রাতে সব নয়নার প্ররোচনায় আর চূড়ান্ত নেশার ফলে হয়েছে। তবে নয়নার মনোভাব এখন বোঝা যায়নি। নয়না অতি ধুরন্ধর মহিলা ওর মনের কথা জানার জো কারুর নেই।
সমুদ্র দানাকে কাষ্ঠ হেসে জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার এত রাতে ফুল কিনতে বেড়িয়েছিস? এখন কাকে পাল দিচ্ছিস?"
সমুদ্রের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভারী গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে দানা, "নয়না, কেমন আছে?"
সমুদ্র চোরা হাসি দিয়ে বলে, "তুই শালা সেদিন ওই ভাবে নয়নার সাথে সেক্সে মেতে উঠলি, মেয়েটা এক সপ্তাহ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না।"
দানার মস্তিকের সকল শিরা উপশিরা সতর্ক হয়ে ওঠে। নয়না কি সত্যি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছে না এটা একটা চাল। তবে ওকে এই মেকি হাসির আড়ালে থেকেই আঘাত শুরু করতে হবে। বাঁকা হেসে সমুদ্রকে বলে, "এই শোন আমার হয়ে একটু নয়নার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস। সেদিন না মদের ঝোঁকে একটু বেশি করে ফেলেছিলাম।"
সমুদ্র হাসি থামিয়ে গম্ভির কণ্ঠে ওকে বলে, "নয়না একবার তোর সাথে দেখা করতে চায়।"
গাড়ির পরে সব থেকে জরুরি টাকা। মহুয়ার নামে যে একশো কোটি টাকার শেয়ার আর বন্ড ছিল সেইগুলো বিক্রি করে প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা হাতে আসে। অত টাকা পাবে সেটা আশাতীত তাই দুইজনে অবাক হয়ে যায়। নতুন কোম্পানির নাম, মেয়ের নামেই রাখা হয়, "রুহি বিল্ডারস প্রাইভেট লিমিটেড।" মহেশ বাবুর তদারকিতে কয়েকদিনের মধ্যে অফিসে লোকজন নিযুক্ত করা হয়। ছোট অফিস, দশ জনের মতন ছেলে মেয়ে নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। মহুয়ার কাজ অফিসে গিয়ে বসা, কিছু না হোক মালিক চোখের সামনে থাকলে কাজ সবাই করে না হলে কেউ কাজ করে না। মহুয়া চায় না অফিসের অবস্থা "চাষা গেল ঘর লাঙ্গল তুলে ধর" এর মতন হোক। রুহি ছোট ছোট পায়ে সারা অফিস ঘুরে সবাইকে মাতিয়ে রাখে।
নিজের গাড়ি নিজেই চালায় দানা। আগে হলুদ রঙের ভাড়ার ট্যাক্সির স্টিয়ারিং হাতে থাকতো এখন নিজের কালো বি.এম.ডাবলুর স্টিয়ারিং। পোশাকে তেমন কিছু ফের বদল হয়নি, যদিও মহুয়ার ইচ্ছে দানা সুট পরুক কিন্তু সেটা দানার একদম ইচ্ছে নয়। একটা সামান্য ট্যাক্সি চালক কি আর সুট পরে? মহুয়া যত ওকে বুঝাতে চায় যে দানা আর সেই ট্যাক্সি চালক নয়। জেদি মহুয়া ওর জন্যে বেশ কয়েকটা সুট বানাতে দেয়।
সকালে রুহি আর মহুয়াকে অফিসে ছেড়ে দিয়ে মহেশ বাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে দানা। মহেশ বাবু ওকে নিয়ে নিজের প্রোজেক্ট গুলো দেখান, কেমন ভাবে কাজ হয়, কার সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয়। ভিতে বেশি সময় লাগে, একবার ভিত গড়ে উঠলে বাকি বিল্ডিং তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা যায়। দানা মন দিয়ে মহেশ বাবুর কাছ থেকে এই ব্যাবসা সংক্রান্ত সব কিছু শিখে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এখন এলাকার কোন বিল্ডারদের সাথে দেখা করা হয়নি দানার। বাপ্পা নস্করের সেক্রেটারি, ইন্দ্রনীল ওদের সাথে কথাবার্তা বলেছে কিন্তু কেউই ওদের জমি ওদের অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প দানাকে বেচতে নারাজ। একদিন দানা নিজেই মহেশ বাবু আর ইন্দ্রনীলকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার এক নামকরা বিল্ডার, সুব্রতর অফিসে যায়। অফিসের সামনে কালো বি.এম.ডাবলু. দাঁড়াতেই সুব্রত অফিস থেকে বেড়িয়ে আসে। দানাকে আগে এই এলাকার উন্নয়নের জন্য দেখেছে তবে বিল্ডার হিসাবে পরিচয় তখন ছিল না। দানার সঙ্গে ইন্দ্রনীলকে সঙ্গে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে দানা বাপ্পা নস্করের খাস লোক।
দানা অফিসে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে সুব্রতকে জিজ্ঞেস করে, "আপনার আজকাল কাজ কেমন চলছে?"
সুব্রত দানাকে বসতে বলে, "দেখুন আমি জানি আপনি কেন এখানে এসেছেন।"
দানা সোজাসুজি সুব্রতকে প্রশ্ন করে, "কয় মাস হয়ে গেল আপনার কাজ বন্ধ, এক বছর হয়ে গেছে তাই না?"
অগত্যা সুব্রত মাথা দোলায়, "হ্যাঁ।"
দানা জিজ্ঞেস করে, "কত টাকা লোকসান হয়েছে আপনার?"
সুব্রত বাঁকা হেসে বলে, "তাতে আপনার কি দরকার?"
ইন্দ্রনীল ওকে বলে, "দেখুন মিস্টার সুব্রত, আমরা এইবারে চাঁদা অথবা প্রকল্পের অংশীদার হতে আসিনি। আপনার যত টাকা খরচ হয়েছে ঠিক সেই দামে দানা আপনার ওই অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প কিনতে চায়।"
সুব্রত একটু ভেবে বলে, "এই এক বছরে অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছে। জিনিস পত্রের দাম বেড়ে গেছে। দেখুন আমি ব্যাবসায় নেমেছি কিন্তু বাপ্পা নস্কর যদি কুড়ি পঁচিশ শতাংশ চায় তাহলে কি করে কাজ করি বলুন?"
ইন্দ্রনীল কিছু বলতে গেলে দানা ওকে থামিয়ে নিজে উত্তর দেয়, "মিস্টার সুব্রত, আমি জানি আপনি ব্যাবসা করতে এসেছেন। আপনার সামনে কয়েকটা বিকল্প রাখতে পারি। প্রথম বিকল্প, আমি আর আপনি মিলে মিশে কাজ করি। আপনার চল্লিশ শতাংশ থাকুক আমার ষাট তাহলে আপনিও টাকা কামাবেন। দ্বিতীয় বিকল্প, গায়ের জোরে আমি আপনার কাছ থেকে কম দামে প্রকল্প কিনে নেব আর তৃতীয়, আপনি এইভাবে বসে থাকুন আর পাঁচ বছরের জন্য। কেননা এর পরের নির্বাচনে আবার বাপ্পা নস্কর এই আসনে জিতবে এবং আমি জেতাবো।"
পরের নির্বাচনে দানা বাপ্পা নস্করকে সমর্থন করবে জেনে ইন্দ্রনীল সন্তুষ্ট। গায়ের জোরে কিনে নিতে পারে দানা সেটা ইন্দ্রনীলকে সাথে দেখেই বুঝে গেছিল সুব্রত। সুব্রত'র কপালে চিন্তার রেখা দেখা দেয়। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে সুব্রত দানাকে বলে, "জমি কিনতে এক কোটি টাকা লেগেছে আর এখন পর্যন্ত আরো এক কোটি জলে গেছে।"
এইবারে মহেশ বাবু মুখ খোলেন, সুব্রতকে বলেন, "আগে সাইট দেখবো তারপরে কাগজ পত্র দেখব। আপনি যেমন একটা দাম বলেছেন তেমনি আমরাও হিসাব নিরীক্ষা করে তারপরে মুল্য ধার্য করব।"
সুব্রত শেষ পর্যন্ত বলেন, "না মানে কয়েকদিন একটু সময় চাই। তবে আপনার প্রথম বিকল্প আমার বেশ লেগেছে।"
দানাও সেটা চায়, যদিও হাতে টাকা আছে তাও ওই অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প গুলো অংশীদারি হিসাবে কাজ করতে চায়। তাতে মাথা ব্যাথা বেশ কম, আগের মালিকের জানাশোনা লোকের দ্বারা কাজ করানো যাবে। নতুন লোক খোঁজার বালাই নেই। হাতে টাকা থাকলে বেশি প্রকল্পে কাজ করতে পারবে তাড়াতাড়ি টাকা আয় হবে।
কয়েকদিন পরে সুব্রতর সাথে সাথে আরও অনেকজন বিল্ডার প্রমোটার ওর সাথে দেখা করে। সবাইকে এক কথা বলে দানা, সবাই ওর কথায় সম্মতি জানায়। সেদিন ইন্দ্রনীল ছাড়াই দানা আর মহেশ বাবু ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেন।
সেদিন দানা ওদের জিজ্ঞেস করে, "আপনাদের কি কারনে বাপ্পা নস্কর বাধা দিয়েছিল বলতে পারেন?"
সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করে, দানা বাপ্পা নস্করের লোক ওর সামনে বাপ্পা নস্করের বিরুদ্ধে বলা উচিত হবে কি হবে না সেই নিয়ে ধন্দে পড়ে যায়।
দানা ওদের অভয় দিয়ে বলে, "বলুন না, সমস্যাটা কি হয়েছিল।"
সবার হয়ে সুব্রত উত্তর দেয়, "আমরা বেশির ভাগ আগে বিমান চন্দের রাজনৈতিক দল করতাম। গত বারে বাপ্পা নস্কর জেতার পরে ওকেও আমরা টাকা দেব বলেছিলাম। কিন্তু বাপ্পা নস্কর আমাদের কাছ থেকে কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ চেয়ে বসে। আমরা ছোট ছোট প্রকল্পে হাত দেই, কুড়ি পঁচিশ শতাংশ যদি একা ওকেই দেই তাহলে বাকিদের দিয়ে আমাদের কি বাঁচবে বলুন?"
বাপ্পা নস্করের দৌরাত্মের বিষয়ে দানা অবগত। দানা মাথা দোলায়, "সত্যি কথা।" একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, "তাহলে আপনারা আমার প্রথম বিকল্প পথেই যেতে চান তাই তো?"
সবাই সম্মতি দেয়। দানা ওদের সাথে হাত মিলিয়ে জানিয়ে দেয় কাগজ পত্র তৈরি করতে। একবার কাগজ পত্র হাতে চলে এলে কাজ শুরু করতে পারে সবাই আর সেই সাথে দানাও ওদের সেই মতন টাকা দেবে।
চৌষট্টি ছক (#০২)
সঙ্গীতাকে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিয়েছে ওর বাবা মা। ইন্দ্রাণী শহর ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে গেছে। যাওয়ার আগে ইন্দ্রাণী ওদের সাথে দেখা করে যায়নি, সেই নিয়ে দানা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেও মহুয়া বুঝতে পারে কি কারনে ইন্দ্রাণী আর ওদের সাথে দেখা করেনি। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, মহুয়ার মনের অবস্থা ঠিক সেই রকম ছিল। কাজের চাপে কয়েকদিনের মধ্যেই ইন্দ্রাণীর কথা ভুলে যায় দানা আর মহুয়া স্বস্তির শ্বাস নেয়।
সঙ্গীতা ফ্রান্সে পৌঁছে দানার কাছে তথ্য প্রমান রেকর্ড করা চিপ পাঠিয়ে দেয়। সেই চিপ থেকে দানা, বাপ্পা নস্করের বিরুদ্ধে প্রচুর কারচুপির প্রমান পায়। সঙ্গীতা বেশ ভালো তদন্ত করেছিল, কবে কোন আমলাকে কত টাকা দিয়েছিল, কোন বিল্ডারকে খুন করেছিল, কোন কোন সরকারী কাগজে হেরফের করেছিল সবার নাম ধাম, তারিখ ইত্যাদি সব কিছু ওই চিপ থেকে উদ্ধার করে।
নাসির আর আকরাম খবর দেয় যে নয়না আবার কাজে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। নয়নার পেছনে ছায়ার মতন লেগে থাকতে নির্দেশ দেয় দানা। ওর নতুন ছবির কাজ পুরো দমে চলছে। কোনদিন খুব ভোরে শুটিংয়ে যায়, কোনোদিন সারাদিন স্টুডিওতে, তবে সমুদ্র আর সুমিতা ওর পাশ ছাড়ে না আর। নতুন ড্রাইভার রেখেছে, তবে সে শুধু ওর গাড়ি চালায় ব্যাস। একজন আলাদা করে দেহ রক্ষীও নিযুক্ত করা হয়েছে। ভীষণ ধূর্ত নয়না হয়ত টের পেয়ে গেছে যে দানা ওর ওপরে নজর রেখে চলেছে, তাই বিমানের সাথে দেখা সাক্ষাৎ আর বাপ্পা নস্করের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দিয়েছে।
নিজের কাজে নেমে দানা বেশ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। বিকেলে অফিস থেকে মহুয়াকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আবার কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোনোদিন জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পায় মহুয়া কোনোদিন পায় না। যেদিন পায় নান সেদিন রাতে ফিরলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ লাগে বাড়িতে। ঠিক সময়ে ফিরলে মহুয়া দরজা খোলে আর অসময়ে ফিরলে কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়।
বসন্ত প্রায় শেষ, গ্রীষ্মের মুখে এসে পড়েছে মহানগর। সামনের বাগানে কোকিলের কুহু ধ্বনি রোজ সকালে শোনা যায়। আম বকুলের গন্ধে বাড়ি মম মম করে। বাগানটা একটা রাস্তা পেরিয়েই, মাঝে মাঝে মনে হয় একটু মাতাল হলে ভালো হত। রোজ রাতে মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয় তবে রক্তে একটু সুরা চড়লে আরো ভালো হত। বাড়িতে মেয়ের সামনে মদ খাওয়া যায় না। সেদিন মদনার দোকানে বেশ আড্ডা মেরে সময় কাটিয়ে অনেক রাত হয়ে যায়।
মদনা আর কেষ্ট বারেবারে ওকে বলে, "বাড়ি যা, না হলে ম্যাডাম এই বারে ঝ্যাঁটা পেটা করবে।"
অনেকদিন পরে গলায় চোলাই পড়েছে তাই আর সেইসবে কান দেয় না দানা, "ধুর বাল একটু দাঁড়া এই যাচ্ছি।"
তাও এই যাচ্ছি এই যাচ্ছি করতে করতে রাত দশ’টা বেজে যায়। গাড়িতে উঠে মোবাইল খুলে দেখে প্রায় এক ডজন মিসকল, বুঝে যায় প্রিয়তমা খাপ্পা হয়ে আছে। এই রাতে মধ্য মহানগরে কি আর সেই ফুলের দোকান খোলা থাকবে? দেখা যাক কি হয়। মেয়ের জন্য একটা বড় চকোলেট কেনে। ওই নেশা গ্রস্থ অবস্থায় মধ্য মহানগরের ওই ফুলের দোকানে যায় দানা। বরাবরের মতন হলুদ ফুলের স্তবক চাই ওর। এতদিনে দোকানি ওকে চিনে গেছে। ওকে দোকানে ঢুকতে দেখেই হলুদ ফুলের স্তবক ধরিয়ে দেয়।
দোকান থেকে বের হতে যাবে দানা, দেখে সামনে সমুদ্র দাঁড়িয়ে। সমুদ্র ওকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে ওঠে। সেই সাথে দানার নেশার ঘোর কেটে যায়। রাত সাড়ে দশটা কিন্তু মধ্য মহানগর এলাকায় তখন লোকে লোকারণ্য। রাত যত ঘন হয়, তত এই শহর জেগে ওঠে। আর দশটা এগারোটা মানে মানুষের বিকেল। দানাকে অবশ্য একবার সমুদ্র আগেও ফোন করে ডেকেছিল, কিন্তু দানা জানিয়ে দিয়েছিল যে আর ওই মুখো হবে না। ফোনে গলার স্বর শুনে এইটুকু ধারনা হয়েছিল হয়ত ওরা ওর ওপরে অতটা ক্ষেপে নেই। হয়তো নিজেরাই বুঝতে পেরেছে যা কিছু হয়েছে সেই রাতে সব নয়নার প্ররোচনায় আর চূড়ান্ত নেশার ফলে হয়েছে। তবে নয়নার মনোভাব এখন বোঝা যায়নি। নয়না অতি ধুরন্ধর মহিলা ওর মনের কথা জানার জো কারুর নেই।
সমুদ্র দানাকে কাষ্ঠ হেসে জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার এত রাতে ফুল কিনতে বেড়িয়েছিস? এখন কাকে পাল দিচ্ছিস?"
সমুদ্রের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভারী গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে দানা, "নয়না, কেমন আছে?"
সমুদ্র চোরা হাসি দিয়ে বলে, "তুই শালা সেদিন ওই ভাবে নয়নার সাথে সেক্সে মেতে উঠলি, মেয়েটা এক সপ্তাহ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না।"
দানার মস্তিকের সকল শিরা উপশিরা সতর্ক হয়ে ওঠে। নয়না কি সত্যি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছে না এটা একটা চাল। তবে ওকে এই মেকি হাসির আড়ালে থেকেই আঘাত শুরু করতে হবে। বাঁকা হেসে সমুদ্রকে বলে, "এই শোন আমার হয়ে একটু নয়নার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিস। সেদিন না মদের ঝোঁকে একটু বেশি করে ফেলেছিলাম।"
সমুদ্র হাসি থামিয়ে গম্ভির কণ্ঠে ওকে বলে, "নয়না একবার তোর সাথে দেখা করতে চায়।"