27-08-2020, 02:57 PM
[[এক]]
ডলির কাহিনী
আমার নাম ডলি মর্টন, বয়স ছাব্বিশ, জন্ম পেনসিলভনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরে। আমার বাবা একটি ব্যাঙ্কে কেরানীর কাজ করতেন, আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান। আমার যখন দুই বছর বয়স তখন মা মারা যান, মার কথা আমার খুব একটা মনে নেই, আমি বাবার কাছেই বড় হয়েছি। বাবার আয় বেশী ছিল না, কিন্তু আমার পড়াশুনার ওপরে ওর সজাগ দৃষ্টি ছিল, পড়াশুনার ব্যাপারে কোনও কার্পন্য করতেন না, কারন উনি চাইতেন আমি বড় হয়ে কলেজ শিক্ষিকা হই।
আমার বাবা ছিলেন খুবই চুপচাপ এবং কঠোর প্রকৃতির মানুষ, আমাকে ভালবাসতেন ঠিকই কিন্তু তার কোন বহিঃপ্রকাশ ছিল না, আমার মনে পড়ে না উনি আমাকে কোনদিন আদর করেছেন বা আমার কোন আবদার শুনেছেন। আমি বড় হয়েছি কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে, বাবা সবসময় নিজের মতামত আমার উপরে চাপিয়ে দিতেন, আমি যদি নিজের ব্যাপারে কিছু বলবার চেষ্টা করতাম, উনি গ্রাহ্যই করতেন না। সামান্যতম ভুলের জন্যেও আমাকে শাস্তি পেতে হত। বাবা আমাকে নিজের কোলের ওপর উপুড় করে শুইয়ে নিতেন, আমার পেটিকোট কোমরের ওপরে তুলে ড্রয়ার্স নামিয়ে আমার পাছায় চড় মারতেন। বাবার এই মারগুলো ভীষন লাগত, পাছা জ্বলে যেত, আমি হাত পা ছুড়তাম, হাউমাউ করে কাঁদতাম, "আর করবো না", "আর করবো না" বলে চেঁচাতাম।
শাস্তি শেষ হলে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের কাজের মহিলার কাছে যেতাম, মহিলা খুবই ভাল ছিল, আমাকে কোলে নিয়ে শান্ত করত, চোখের জল মুছিয়ে দিত।
বড়ই একাকীত্বে ভরা জীবন ছিল আমার, বাবা কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখতেন না, আমার নিজেরও কোন সমবয়সী বন্ধু ছিল না, তবুও আমি সবসময় হাসি খুশী থাকতাম, আমার শরীর স্বাস্থ্য ভাল ছিল আর আমি বই পড়তে খুব ভালবাসতাম। এইভাবেই আমি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠি, যখন আঠারোয় পা দিলাম তখনই আমার পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতা আর ভরাট স্বাস্থ্যর জন্য আমাকে এক পূর্ণ যুবতীর মত দেখায়। শরীরের সাথে মনেও পরিবর্তন আসে, বাড়ীর এক ঘেয়ে জীবনে হাঁফ ধরে, মন উড়ু উড়ু হয়, মাঝে মাঝেই আমি অন্যায় জিদ করি, অবাধ্যতা করি আর তখনই বাবা আমাকে শাস্তি দেন। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি, ছেলেদের কথা ভাবি, প্রেমের স্বপ্ন দেখি, অথচ পান থেকে চুন খসলে বাবা আমাকে বাচ্চা মেয়ের মত কোলের উপর উপুড় করে আমার উদোম পাছায় চড় মারেন, আর বলেন যতদিন আমার বিয়ের বয়স না হচ্ছে ততদিন অবাধ্যতা করলে আমাকে এইভাবেই শাস্তি পেতে হবে। আমার খুবই খারাপ লাগে, তবুও মুখ বুজে সহ্য করি।
জীবন একভাবে চলে না, আমার জীবনেও হঠাৎ বিরাট পরিবর্তন এল। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর মাত্র কয়েকদিন নিউমোনিয়ায় ভোগার পর মারা গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি মুষড়ে পড়লাম, যদিও বাবার মৃত্যুতে আমার তেমন শোক হয় নি, কারন বাবার সাথে আমার কোনোদিনই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। দুঃখ হল না কিন্তু আমি যে অথৈ জলে পড়েছি সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ রইল না।
আগেই বলেছি, আমার বাবার আয় বেশী ছিল না, অথচ আমার পড়াশুনার জন্য উনি অনেক খরচাপাতি করতেন, ফলে ওর যথেস্ট ধার দেনা হয়েছিল। বাবা মারা যেতেই ঋণদাতারা আমার ঘাড়ে চেপে বসল, ধার শোধ করার সামর্থ্য আমার ছিল না, প্রথমে আসবাবপত্র, শেষে বাড়ীটিও বিক্রি করতে হল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, সমস্ত ঋন শোধ করার পর আমার কাছে না রইল একটি পয়সা, না কোনো মাথা গোঁজার জায়গা, বিশাল এই পৃথিবীতে আমি সহায় সম্বলহীন একটি মেয়ে। একমাস আমাদের কাজের মহিলার সাথে থাকলাম, সে আমাকে খুবই ভালবাসত আর আমাকে আরো কিছুদিন নিজের কাছে রাখতে রাজী ছিল, কিন্তু সেটা সম্ভব হল না, কারন আমাদের বাড়ীর চাকরী যাওয়ার পর তাকে অন্য বাড়ীতে কাজ নিতে হল।
সেই সময় কোনো অনাথাশ্রমে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো গতি ছিল না, কিন্তু আমাকে এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন মিস রুথ ডীন নামে একজন খুবই দয়ালু মহিলা। আমার দুরবস্থার কথা শুনে উনি আমাকে ওর বাড়ীতে আশ্রয় দিলেন।
তিরিশ বছর বয়সী মিস ডীন কোয়েকার সম্প্রদায়ের সদস্যা ছিলেন, কোয়েকাররা নিজেদের "গরীবের বন্ধু" বলে পরিচয় দেয়। মিস ডীন কুমারী ছিলেন, ওর কোনো পুরুষ বন্ধু ছিল না, শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটি বড় বাড়ীতে উনি একাই থাকতেন। ওর যথেস্ট পয়সাকড়ি ছিল, যার বেশীটাই উনি গরীবদের পেছনে খরচ করতেন, দিনের বেশীর ভাগ সময় উনি নানান ধরনের জনহিতকর কাজে ব্যস্ত থাকতেন, যে কোনো মানুষ বিপদে পড়ে ওর কাছে এলে খালি হাতে ফেরত যেত না।
মিস ডীন ছিলেন বেশ লম্বা আর রোগাটে, চোখ আর চুলের রঙ বাদামী, চুল উনি ঝুটি বেঁধে রাখতেন, গায়ের রঙ একটু ফ্যাকাশে, আর সবসময় সাদামাটা পোষাক পরে থাকতেন। রোগা হলে কি হবে ওনার স্বাস্থ্য খারাপ ছিল না, অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন, এইরকম দয়ালু আর ভাল মহিলা আমি জীবনে দুটো দেখিনি। প্রথমদিন থেকেই উনি আমার সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করেন, আমাকে একটা আলাদা ঘর দিয়েছিলেন থাকার জন্য, বাড়ীর চাকরবাকররাও ওকে শ্রদ্ধা করত, ওর কথা শুনত, আমার সাথেও তারা ভাল ব্যবহার করত।
দেশের বিভিন্ন জনহিতকর সংস্থাগুলোর সাথে মিস ডীন নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমার পড়াশুনা শেখা এই সময় খুব কাজে এলো, এই সব সংস্থাগুলোকে চিঠিপত্র লেখার কাজে আমি মিস ডীনকে সাহায্য করতে শুরু করলাম। আমার কাজে খুশী হয়ে উনি আমাকে সেক্রেটারী নিযুক্ত করলেন, এই জন্য উনি আমাকে পারিশ্রামিকও দিতেন, এছাড়া খাওয়া দাওয়া জামা কাপড় ইত্যাদি তো আছেই।
ওঁর বাড়ীতে আমি খুবই আরামে ছিলাম, জীবনে এত সুখও কখনো পাইনি, কোন বকাঝকা নেই, কোন চোখ রাঙানি নেই, সবথেকে বড় কথা বাবার সেই বীভৎস শাস্তি, পাছায় চড় মারা, তাও নেই। আমি ওকে দিদির মত শ্রদ্ধা করতাম, উনি আমাকে ছোট বোনের মত ভালবাসতেন। উনি চাইতেন আমি যেন সব সময় ভাল পোশাক পরে থাকি, আমাকে দামী লেস দেওয়া পেটিকোট, অন্তর্বাস আর খুব সুন্দর কয়েকটা ফ্রক কিনে দিয়েছিলেন। আমি সেজে গুজে থাকতাম, কিন্তু মিস ডীন নিজে অতি সাধারন কাপড়ের অন্তর্বাস আর কোয়েকারদের ছাই রঙের স্কার্ট আর ব্লাউজ পরেই থাকতেন।
দাসপ্রথাকে মিস ডীন মনে প্রানে ঘৃণা করতেন, উনি অ্যাবলিশনিস্ট পার্টীর সক্রিয় সদস্যা ছিলেন। দক্ষিনের রাজ্যগুলিতে যে সব কোয়েকাররা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাত তাদের সাথে উনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, তাদের অর্থ সাহায্য করতেন। দক্ষিনের রাজ্যগুলি থেকে পালিয়ে এসেছে এমন দাস বা দাসী প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে এসে উঠত, উনি তাদের খাওয়া পরা দিয়ে রাখতেন যতদিন না ওরা কাজকর্ম পায়। পেনসিলভনিয়া রাজ্যে দাসপ্রথা ছিল না, কাজেই দাসেদের খোলাখুলি সাহায্য করতে ওনার কোনো অসুবিধা হত না।
দুটো বছর খুব আনন্দে কাটল, আমার সমবয়সী অনেক বন্ধুও হল। মিস ডীন কোয়েকার ছিলেন তাই কোন ক্লাবে বা নাচের পার্টিতে যাওয়া পছন্দ করতেন না, কিন্তু মাঝে মাঝেই উনি আমার সমবয়সী ছেলে মেয়েদের বাড়ীতে খেতে ডাকতেন, আমিও তাদের বাড়ী যেতাম, আমার অনেক মেয়ে বন্ধু হয়েছিল, ছেলেরাও আমাকে প্রসংশার নজরে দেখত, কিন্তু কোন ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়নি।
আমি যখনকার কথা বলছি, তখন উত্তর আর দক্ষিনের মধ্যে অশান্তি দিন কে দিন বাড়ছে, লোকেদের মুখে প্রায়ই যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে যদিও শেষ পর্যন্ত যে এই রকম ভীষন একটা গৃহযুদ্ধ হবে সে ধারনা তখনো কারোর ছিল না। ১৮৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হার্পার’স ফেরীতে বিখ্যাত অ্যাবলিশনিস্ট জন ব্রাউনের ফাঁসি হল, ব্রাউন সাহেব দাসপ্রথা বন্ধ করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। উত্তরের লোকেরা এই ঘটনায় ভীষন রেগে গিয়ে বলল, ব্রাউন সাহেবের ফাঁসি হয়নি, তাকে খুন করা হয়েছে।
মিস ডীন খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন, জন ব্রাউনের সাথে ওর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল, ব্রাউন সাহেবের সশস্ত্র সংগ্রামের পথকেও উনি সমর্থন করতেন, প্রায়ই বলতেন, এই জঘন্য দাসপ্রথা বন্ধ করার জন্য যে কোনো পথই গ্রহনযোগ্য, দাসেদের মুক্তির জন্য উনি নিজেও বন্দুক ধরতে পেছপা হবেন না।
যতই দিন যায়, মিস ডীন ততই অস্থির হয়ে পড়েন, ওর মনে হয় দক্ষিনের অ্যাবলিশনিস্টদের শুধু অর্থ সাহায্য করে কিছু হবে না, নিজে এই দাসপ্রথা বিরোধী সংগ্রামে ভাগ নিতে হবে। উনি ঠিক করলেন যে দক্ষিনে গিয়ে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাবেন আর দাসেদের পালাতে সাহায্য করবেন।
একদিন বিকেলে আমাকে ডেকে বললেন, "ডলি আমি ঠিক করেছি দক্ষিনে গিয়ে থাকব আর সেখানে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাব। আমার মনে হয় আমি এই কাজটা ছেলেদের থেকে ভাল পারব। একজন পুরুষ যখন একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালায়, তার বিপদের সম্ভাবনা বেশী, কারন দক্ষিনের সাদা বদমাশগুলো সব সময় তার ওপরে নজর রাখবে। কিন্তু একজন মহিলা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাচ্ছে, এটা ওদের মাথায়ই আসবে না। আমি যদি সাবধানে থাকি, আর লোকচক্ষুর আড়ালে এইরকম একটা স্টেশন চালাই, তাহলে আমার ধরা পড়বার সম্ভাবনা খুবই কম"।
মিস ডীনের কথা শুনে আমিও উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, দাসেদের প্রতি আমার চিরকালের সহানুভূতি, ঠিক করলাম আমিও ওর সাথে যাব। কিন্তু একথা মিস ডীনকে বলতেই উনি হৈ হৈ করে উঠলেন, আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে কাজটা খুবই বিপজ্জনক, উনি যে কোন সময় ধরা পড়ে যেতে পারেন, আর একবার ধরা পড়লে দক্ষিনের আইন অনু্যায়ী দীর্ঘদিনের কারাবাস নিশ্চিত।
- "জেলে থাকতে আমি মোটেই ভয় পাই না, সব রকম কস্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে," মিস ডীন বললেন, "কিন্তু ডলি তুমি একটা যুবতী মেয়ে, কোমল শরীর আর মন তোমার, জেলের ঐ কঠিন জীবন তুমি কি করে সহ্য করবে?"
মিস ডীন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন আর বলছেন, "আমি শুনেছি, দক্ষিনের জেলগুলোতে মেয়ে বন্দীদের চুল ছেঁটে দেয়, তোমার ঐ সুন্দর সোনালী চুল ছেঁটে দিলে কি খারাপই না লাগবে। না ডলি তোমাকে আমি নিয়ে যেতে পারব না, যদি তোমার কোন ক্ষতি হয়, আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না"।
- "আমিও কস্ট সহ্য করতে পারব", আমি বললাম, "আর আপনার চুল আমার চুলের থেকে মোটেই কম সুন্দর না, আপনার চুল ছেঁটে দিলে ক্ষতি নেই, আর আমার চুল ছেঁটে দিলে ক্ষতি, এটা কি করে হয়? আপনি আমার জন্যে এত করেছেন, আর আমি কি করে আপনাকে এই বিপদের মধ্যে একলা যেতে দিই? আমি এখানে একা থাকব না, আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাব"।
আমার কথা শুনে মিস ডীন আপ্লুত হয়ে পড়লেন, আর বার বার আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে আমার দক্ষিনে যাওয়া উচিত হবে না, কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, বললাম, "মিস ডীন, আমরা দুজনে থাকলে কাজটা আরো সহজ হবে, স্টেশন চালাবার কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব, আপনি অনুগ্রহ করে আপত্তি করবেন না।"
মিস ডীন খুশী হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আর তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসলেন ওর দক্ষিনের কোয়েকার বন্ধুদের চিঠি লিখতে। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাবার ইচ্ছার কথা জানালেন আর বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলেন দক্ষিনে ঠিক কোথায় এই রকম একটা নতুন স্টেশন চালু করলে দাসেদের উপকার হবে? চিঠি লিখতে লিখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা ডিনার খেতে গেলাম, খাওয়া শেষে আরও অনেকক্ষন আমরা স্টেশন চালাবার ব্যাপারে আলোচনা করলাম।
অল্পদিনের মধ্যেই মিস ডীনের বন্ধুদের কাছ থেকে জবাব এল, ওরা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন খোলা যেতে পারে এমন একাধিক জায়গার নাম জানিয়েছেন, আমরা প্রতিটি জায়গার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করবার পর দক্ষিনের ঠিক মাঝখানে ভার্জিনিয়ার একটি জায়গা পছন্দ করলাম। মিস ডীনের বন্ধু যে বাড়ীটির কথা জানিয়েছেন, সেটা ভার্জিনিয়ার রাজধানী রিচমন্ড থেকে পয়ত্রিশ মাইল দূরে জেমস নদীর পারে হ্যাম্পটন নামে একটি ছোট্ট টাউনের কাছে।
মিস ডীন তখনই ওর পরিচিত এজেন্টকে চিঠি লিখলেন, বাড়ীটি ভাড়া নিয়ে ওটার মেরামত করতে আর প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কিনতে বললেন। আমরা দুজন মহিলা ওখানে গিয়ে কিছুদিন থাকব, এজেন্টকে সেইমত সমস্ত ব্যবস্থা করতে বললেন।
মিস ডীনের এজেন্ট চিঠি লিখে জানাল যে সে বাড়ীটি ভাড়া নিয়ে মেরামতের কাজ শুরু করেছে, এবং আসবাবপত্র ইত্যাদি কিনে বাড়ীটি বাসযোগ্য করতে সপ্তাহ দুয়েকের মত সময় লাগবে। এজেন্ট মহাশয় অবশ্য ঘুনাক্ষরেও জানত না যে বাড়ীটি একটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
হাতে সময় আছে, তাই আমরা ধীরে সুস্থে গোছগাছ শুরু করলাম। মিস ডীন ঠিক করলেন যে শুধু একজন কাজের মহিলাকে সাথে নিয়ে যাবেন আর বাকীদের ফিলাডেলফিয়ার বাড়ীটি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। মার্থা নামে একজন মধ্যবয়সী সাদা মহিলা, সেও কোয়েকার সম্প্রদায়ের, পাঁচ বছর যাবত এই বাড়ীতে কাজ করছে, আর খুবই বিশ্বস্ত। ঠিক হল মার্থাকেই সাথে নিয়ে যাওয়া হবে, কারন মার্থা আমাদের দক্ষিনে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্যটি জানত এবং এব্যাপারে ও নিজেও খুব উৎসাহী ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম আমরা কোথায় যাচ্ছি আর কেন যাচ্ছি সেকথা কাউকেই বলব না, তাই পরিচিতদের বলা হল যে আমরা কিছুদিনের জন্য দক্ষিনের রাজ্যগুলোতে বেড়াতে যাচ্ছি।
দেখতে দেখতে পনের দিন কেটে গেল এবং মে মাসের এক সুন্দর সকালে আমরা মালপত্র নিয়ে রেল স্টেশনে পৌছলাম আর রিচমন্ডগামী ট্রেনে চেপে বসলাম।
ডলির কাহিনী
আমার নাম ডলি মর্টন, বয়স ছাব্বিশ, জন্ম পেনসিলভনিয়া রাজ্যের ফিলাডেলফিয়া শহরে। আমার বাবা একটি ব্যাঙ্কে কেরানীর কাজ করতেন, আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান। আমার যখন দুই বছর বয়স তখন মা মারা যান, মার কথা আমার খুব একটা মনে নেই, আমি বাবার কাছেই বড় হয়েছি। বাবার আয় বেশী ছিল না, কিন্তু আমার পড়াশুনার ওপরে ওর সজাগ দৃষ্টি ছিল, পড়াশুনার ব্যাপারে কোনও কার্পন্য করতেন না, কারন উনি চাইতেন আমি বড় হয়ে কলেজ শিক্ষিকা হই।
আমার বাবা ছিলেন খুবই চুপচাপ এবং কঠোর প্রকৃতির মানুষ, আমাকে ভালবাসতেন ঠিকই কিন্তু তার কোন বহিঃপ্রকাশ ছিল না, আমার মনে পড়ে না উনি আমাকে কোনদিন আদর করেছেন বা আমার কোন আবদার শুনেছেন। আমি বড় হয়েছি কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে, বাবা সবসময় নিজের মতামত আমার উপরে চাপিয়ে দিতেন, আমি যদি নিজের ব্যাপারে কিছু বলবার চেষ্টা করতাম, উনি গ্রাহ্যই করতেন না। সামান্যতম ভুলের জন্যেও আমাকে শাস্তি পেতে হত। বাবা আমাকে নিজের কোলের ওপর উপুড় করে শুইয়ে নিতেন, আমার পেটিকোট কোমরের ওপরে তুলে ড্রয়ার্স নামিয়ে আমার পাছায় চড় মারতেন। বাবার এই মারগুলো ভীষন লাগত, পাছা জ্বলে যেত, আমি হাত পা ছুড়তাম, হাউমাউ করে কাঁদতাম, "আর করবো না", "আর করবো না" বলে চেঁচাতাম।
শাস্তি শেষ হলে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের কাজের মহিলার কাছে যেতাম, মহিলা খুবই ভাল ছিল, আমাকে কোলে নিয়ে শান্ত করত, চোখের জল মুছিয়ে দিত।
বড়ই একাকীত্বে ভরা জীবন ছিল আমার, বাবা কোনো আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখতেন না, আমার নিজেরও কোন সমবয়সী বন্ধু ছিল না, তবুও আমি সবসময় হাসি খুশী থাকতাম, আমার শরীর স্বাস্থ্য ভাল ছিল আর আমি বই পড়তে খুব ভালবাসতাম। এইভাবেই আমি ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠি, যখন আঠারোয় পা দিলাম তখনই আমার পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতা আর ভরাট স্বাস্থ্যর জন্য আমাকে এক পূর্ণ যুবতীর মত দেখায়। শরীরের সাথে মনেও পরিবর্তন আসে, বাড়ীর এক ঘেয়ে জীবনে হাঁফ ধরে, মন উড়ু উড়ু হয়, মাঝে মাঝেই আমি অন্যায় জিদ করি, অবাধ্যতা করি আর তখনই বাবা আমাকে শাস্তি দেন। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি, ছেলেদের কথা ভাবি, প্রেমের স্বপ্ন দেখি, অথচ পান থেকে চুন খসলে বাবা আমাকে বাচ্চা মেয়ের মত কোলের উপর উপুড় করে আমার উদোম পাছায় চড় মারেন, আর বলেন যতদিন আমার বিয়ের বয়স না হচ্ছে ততদিন অবাধ্যতা করলে আমাকে এইভাবেই শাস্তি পেতে হবে। আমার খুবই খারাপ লাগে, তবুও মুখ বুজে সহ্য করি।
জীবন একভাবে চলে না, আমার জীবনেও হঠাৎ বিরাট পরিবর্তন এল। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আর মাত্র কয়েকদিন নিউমোনিয়ায় ভোগার পর মারা গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি মুষড়ে পড়লাম, যদিও বাবার মৃত্যুতে আমার তেমন শোক হয় নি, কারন বাবার সাথে আমার কোনোদিনই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। দুঃখ হল না কিন্তু আমি যে অথৈ জলে পড়েছি সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ রইল না।
আগেই বলেছি, আমার বাবার আয় বেশী ছিল না, অথচ আমার পড়াশুনার জন্য উনি অনেক খরচাপাতি করতেন, ফলে ওর যথেস্ট ধার দেনা হয়েছিল। বাবা মারা যেতেই ঋণদাতারা আমার ঘাড়ে চেপে বসল, ধার শোধ করার সামর্থ্য আমার ছিল না, প্রথমে আসবাবপত্র, শেষে বাড়ীটিও বিক্রি করতে হল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, সমস্ত ঋন শোধ করার পর আমার কাছে না রইল একটি পয়সা, না কোনো মাথা গোঁজার জায়গা, বিশাল এই পৃথিবীতে আমি সহায় সম্বলহীন একটি মেয়ে। একমাস আমাদের কাজের মহিলার সাথে থাকলাম, সে আমাকে খুবই ভালবাসত আর আমাকে আরো কিছুদিন নিজের কাছে রাখতে রাজী ছিল, কিন্তু সেটা সম্ভব হল না, কারন আমাদের বাড়ীর চাকরী যাওয়ার পর তাকে অন্য বাড়ীতে কাজ নিতে হল।
সেই সময় কোনো অনাথাশ্রমে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো গতি ছিল না, কিন্তু আমাকে এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন মিস রুথ ডীন নামে একজন খুবই দয়ালু মহিলা। আমার দুরবস্থার কথা শুনে উনি আমাকে ওর বাড়ীতে আশ্রয় দিলেন।
তিরিশ বছর বয়সী মিস ডীন কোয়েকার সম্প্রদায়ের সদস্যা ছিলেন, কোয়েকাররা নিজেদের "গরীবের বন্ধু" বলে পরিচয় দেয়। মিস ডীন কুমারী ছিলেন, ওর কোনো পুরুষ বন্ধু ছিল না, শহর থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটি বড় বাড়ীতে উনি একাই থাকতেন। ওর যথেস্ট পয়সাকড়ি ছিল, যার বেশীটাই উনি গরীবদের পেছনে খরচ করতেন, দিনের বেশীর ভাগ সময় উনি নানান ধরনের জনহিতকর কাজে ব্যস্ত থাকতেন, যে কোনো মানুষ বিপদে পড়ে ওর কাছে এলে খালি হাতে ফেরত যেত না।
মিস ডীন ছিলেন বেশ লম্বা আর রোগাটে, চোখ আর চুলের রঙ বাদামী, চুল উনি ঝুটি বেঁধে রাখতেন, গায়ের রঙ একটু ফ্যাকাশে, আর সবসময় সাদামাটা পোষাক পরে থাকতেন। রোগা হলে কি হবে ওনার স্বাস্থ্য খারাপ ছিল না, অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন, এইরকম দয়ালু আর ভাল মহিলা আমি জীবনে দুটো দেখিনি। প্রথমদিন থেকেই উনি আমার সাথে বন্ধুর মত ব্যবহার করেন, আমাকে একটা আলাদা ঘর দিয়েছিলেন থাকার জন্য, বাড়ীর চাকরবাকররাও ওকে শ্রদ্ধা করত, ওর কথা শুনত, আমার সাথেও তারা ভাল ব্যবহার করত।
দেশের বিভিন্ন জনহিতকর সংস্থাগুলোর সাথে মিস ডীন নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমার পড়াশুনা শেখা এই সময় খুব কাজে এলো, এই সব সংস্থাগুলোকে চিঠিপত্র লেখার কাজে আমি মিস ডীনকে সাহায্য করতে শুরু করলাম। আমার কাজে খুশী হয়ে উনি আমাকে সেক্রেটারী নিযুক্ত করলেন, এই জন্য উনি আমাকে পারিশ্রামিকও দিতেন, এছাড়া খাওয়া দাওয়া জামা কাপড় ইত্যাদি তো আছেই।
ওঁর বাড়ীতে আমি খুবই আরামে ছিলাম, জীবনে এত সুখও কখনো পাইনি, কোন বকাঝকা নেই, কোন চোখ রাঙানি নেই, সবথেকে বড় কথা বাবার সেই বীভৎস শাস্তি, পাছায় চড় মারা, তাও নেই। আমি ওকে দিদির মত শ্রদ্ধা করতাম, উনি আমাকে ছোট বোনের মত ভালবাসতেন। উনি চাইতেন আমি যেন সব সময় ভাল পোশাক পরে থাকি, আমাকে দামী লেস দেওয়া পেটিকোট, অন্তর্বাস আর খুব সুন্দর কয়েকটা ফ্রক কিনে দিয়েছিলেন। আমি সেজে গুজে থাকতাম, কিন্তু মিস ডীন নিজে অতি সাধারন কাপড়ের অন্তর্বাস আর কোয়েকারদের ছাই রঙের স্কার্ট আর ব্লাউজ পরেই থাকতেন।
দাসপ্রথাকে মিস ডীন মনে প্রানে ঘৃণা করতেন, উনি অ্যাবলিশনিস্ট পার্টীর সক্রিয় সদস্যা ছিলেন। দক্ষিনের রাজ্যগুলিতে যে সব কোয়েকাররা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাত তাদের সাথে উনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, তাদের অর্থ সাহায্য করতেন। দক্ষিনের রাজ্যগুলি থেকে পালিয়ে এসেছে এমন দাস বা দাসী প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে এসে উঠত, উনি তাদের খাওয়া পরা দিয়ে রাখতেন যতদিন না ওরা কাজকর্ম পায়। পেনসিলভনিয়া রাজ্যে দাসপ্রথা ছিল না, কাজেই দাসেদের খোলাখুলি সাহায্য করতে ওনার কোনো অসুবিধা হত না।
দুটো বছর খুব আনন্দে কাটল, আমার সমবয়সী অনেক বন্ধুও হল। মিস ডীন কোয়েকার ছিলেন তাই কোন ক্লাবে বা নাচের পার্টিতে যাওয়া পছন্দ করতেন না, কিন্তু মাঝে মাঝেই উনি আমার সমবয়সী ছেলে মেয়েদের বাড়ীতে খেতে ডাকতেন, আমিও তাদের বাড়ী যেতাম, আমার অনেক মেয়ে বন্ধু হয়েছিল, ছেলেরাও আমাকে প্রসংশার নজরে দেখত, কিন্তু কোন ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়নি।
আমি যখনকার কথা বলছি, তখন উত্তর আর দক্ষিনের মধ্যে অশান্তি দিন কে দিন বাড়ছে, লোকেদের মুখে প্রায়ই যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে যদিও শেষ পর্যন্ত যে এই রকম ভীষন একটা গৃহযুদ্ধ হবে সে ধারনা তখনো কারোর ছিল না। ১৮৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে হার্পার’স ফেরীতে বিখ্যাত অ্যাবলিশনিস্ট জন ব্রাউনের ফাঁসি হল, ব্রাউন সাহেব দাসপ্রথা বন্ধ করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। উত্তরের লোকেরা এই ঘটনায় ভীষন রেগে গিয়ে বলল, ব্রাউন সাহেবের ফাঁসি হয়নি, তাকে খুন করা হয়েছে।
মিস ডীন খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন, জন ব্রাউনের সাথে ওর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল, ব্রাউন সাহেবের সশস্ত্র সংগ্রামের পথকেও উনি সমর্থন করতেন, প্রায়ই বলতেন, এই জঘন্য দাসপ্রথা বন্ধ করার জন্য যে কোনো পথই গ্রহনযোগ্য, দাসেদের মুক্তির জন্য উনি নিজেও বন্দুক ধরতে পেছপা হবেন না।
যতই দিন যায়, মিস ডীন ততই অস্থির হয়ে পড়েন, ওর মনে হয় দক্ষিনের অ্যাবলিশনিস্টদের শুধু অর্থ সাহায্য করে কিছু হবে না, নিজে এই দাসপ্রথা বিরোধী সংগ্রামে ভাগ নিতে হবে। উনি ঠিক করলেন যে দক্ষিনে গিয়ে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাবেন আর দাসেদের পালাতে সাহায্য করবেন।
একদিন বিকেলে আমাকে ডেকে বললেন, "ডলি আমি ঠিক করেছি দক্ষিনে গিয়ে থাকব আর সেখানে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাব। আমার মনে হয় আমি এই কাজটা ছেলেদের থেকে ভাল পারব। একজন পুরুষ যখন একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালায়, তার বিপদের সম্ভাবনা বেশী, কারন দক্ষিনের সাদা বদমাশগুলো সব সময় তার ওপরে নজর রাখবে। কিন্তু একজন মহিলা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাচ্ছে, এটা ওদের মাথায়ই আসবে না। আমি যদি সাবধানে থাকি, আর লোকচক্ষুর আড়ালে এইরকম একটা স্টেশন চালাই, তাহলে আমার ধরা পড়বার সম্ভাবনা খুবই কম"।
মিস ডীনের কথা শুনে আমিও উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, দাসেদের প্রতি আমার চিরকালের সহানুভূতি, ঠিক করলাম আমিও ওর সাথে যাব। কিন্তু একথা মিস ডীনকে বলতেই উনি হৈ হৈ করে উঠলেন, আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে কাজটা খুবই বিপজ্জনক, উনি যে কোন সময় ধরা পড়ে যেতে পারেন, আর একবার ধরা পড়লে দক্ষিনের আইন অনু্যায়ী দীর্ঘদিনের কারাবাস নিশ্চিত।
- "জেলে থাকতে আমি মোটেই ভয় পাই না, সব রকম কস্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে," মিস ডীন বললেন, "কিন্তু ডলি তুমি একটা যুবতী মেয়ে, কোমল শরীর আর মন তোমার, জেলের ঐ কঠিন জীবন তুমি কি করে সহ্য করবে?"
মিস ডীন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন আর বলছেন, "আমি শুনেছি, দক্ষিনের জেলগুলোতে মেয়ে বন্দীদের চুল ছেঁটে দেয়, তোমার ঐ সুন্দর সোনালী চুল ছেঁটে দিলে কি খারাপই না লাগবে। না ডলি তোমাকে আমি নিয়ে যেতে পারব না, যদি তোমার কোন ক্ষতি হয়, আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না"।
- "আমিও কস্ট সহ্য করতে পারব", আমি বললাম, "আর আপনার চুল আমার চুলের থেকে মোটেই কম সুন্দর না, আপনার চুল ছেঁটে দিলে ক্ষতি নেই, আর আমার চুল ছেঁটে দিলে ক্ষতি, এটা কি করে হয়? আপনি আমার জন্যে এত করেছেন, আর আমি কি করে আপনাকে এই বিপদের মধ্যে একলা যেতে দিই? আমি এখানে একা থাকব না, আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাব"।
আমার কথা শুনে মিস ডীন আপ্লুত হয়ে পড়লেন, আর বার বার আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে আমার দক্ষিনে যাওয়া উচিত হবে না, কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা, বললাম, "মিস ডীন, আমরা দুজনে থাকলে কাজটা আরো সহজ হবে, স্টেশন চালাবার কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব, আপনি অনুগ্রহ করে আপত্তি করবেন না।"
মিস ডীন খুশী হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আর তখনই কাগজ কলম নিয়ে বসলেন ওর দক্ষিনের কোয়েকার বন্ধুদের চিঠি লিখতে। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন চালাবার ইচ্ছার কথা জানালেন আর বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলেন দক্ষিনে ঠিক কোথায় এই রকম একটা নতুন স্টেশন চালু করলে দাসেদের উপকার হবে? চিঠি লিখতে লিখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা ডিনার খেতে গেলাম, খাওয়া শেষে আরও অনেকক্ষন আমরা স্টেশন চালাবার ব্যাপারে আলোচনা করলাম।
অল্পদিনের মধ্যেই মিস ডীনের বন্ধুদের কাছ থেকে জবাব এল, ওরা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন খোলা যেতে পারে এমন একাধিক জায়গার নাম জানিয়েছেন, আমরা প্রতিটি জায়গার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করবার পর দক্ষিনের ঠিক মাঝখানে ভার্জিনিয়ার একটি জায়গা পছন্দ করলাম। মিস ডীনের বন্ধু যে বাড়ীটির কথা জানিয়েছেন, সেটা ভার্জিনিয়ার রাজধানী রিচমন্ড থেকে পয়ত্রিশ মাইল দূরে জেমস নদীর পারে হ্যাম্পটন নামে একটি ছোট্ট টাউনের কাছে।
মিস ডীন তখনই ওর পরিচিত এজেন্টকে চিঠি লিখলেন, বাড়ীটি ভাড়া নিয়ে ওটার মেরামত করতে আর প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কিনতে বললেন। আমরা দুজন মহিলা ওখানে গিয়ে কিছুদিন থাকব, এজেন্টকে সেইমত সমস্ত ব্যবস্থা করতে বললেন।
মিস ডীনের এজেন্ট চিঠি লিখে জানাল যে সে বাড়ীটি ভাড়া নিয়ে মেরামতের কাজ শুরু করেছে, এবং আসবাবপত্র ইত্যাদি কিনে বাড়ীটি বাসযোগ্য করতে সপ্তাহ দুয়েকের মত সময় লাগবে। এজেন্ট মহাশয় অবশ্য ঘুনাক্ষরেও জানত না যে বাড়ীটি একটি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
হাতে সময় আছে, তাই আমরা ধীরে সুস্থে গোছগাছ শুরু করলাম। মিস ডীন ঠিক করলেন যে শুধু একজন কাজের মহিলাকে সাথে নিয়ে যাবেন আর বাকীদের ফিলাডেলফিয়ার বাড়ীটি রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব দিয়ে যাবেন। মার্থা নামে একজন মধ্যবয়সী সাদা মহিলা, সেও কোয়েকার সম্প্রদায়ের, পাঁচ বছর যাবত এই বাড়ীতে কাজ করছে, আর খুবই বিশ্বস্ত। ঠিক হল মার্থাকেই সাথে নিয়ে যাওয়া হবে, কারন মার্থা আমাদের দক্ষিনে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্যটি জানত এবং এব্যাপারে ও নিজেও খুব উৎসাহী ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম আমরা কোথায় যাচ্ছি আর কেন যাচ্ছি সেকথা কাউকেই বলব না, তাই পরিচিতদের বলা হল যে আমরা কিছুদিনের জন্য দক্ষিনের রাজ্যগুলোতে বেড়াতে যাচ্ছি।
দেখতে দেখতে পনের দিন কেটে গেল এবং মে মাসের এক সুন্দর সকালে আমরা মালপত্র নিয়ে রেল স্টেশনে পৌছলাম আর রিচমন্ডগামী ট্রেনে চেপে বসলাম।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!