26-08-2020, 07:55 PM
।। অন্তিম পর্ব ।।
ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে সোমনাথদা আমাকে ওর বাড়ী নিয়ে গেল। একা থাকে লোকটা। কোন বাঁধন নেই। প্রাণ খোলা লোকটার সাথে অনেক রাত্রি অবধি কথা বলে আমার মনটা যেন এবার কিছুটা হালকা হল।
সোমনাথদা বলল, "এবার শুয়ে পড়ো সুদীপ। কাল সকালে তোমার সাথে এখানে কেউ দেখা করতে আসবে।"
কে আসবে জানি না, অনেক জিজ্ঞেস করতেও সোমনাথদা কিছুতেই তার নামটা বলল না, আমার মনে হল কাল সকালটা আমার বাকী জীবনের প্রথম দিন, সব কিছু ভুলে আমাকে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
কামিনীর কষ্টটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আমি শুয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙল দেরীতে। সোমনাথদা নিজের হাতে চা বানিয়ে নিয়ে এল আমার কাছে, বলল, "গুড মর্নিং। এই তো তোমাকে এবার খুব ফ্রেশ লাগছে। নাও তাড়াতাড়ি চা টা খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও, সে আসছে।"
আমি বললাম, "কে আসছে সোমনাথ দা?"
সোমনাথদা বলল, "রাখী।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "রাখী এখানে? কি করে?"
সোমনাথদা হেসে বললো, "বেশ্যার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে ও সুদীপ। রাখী সোনাগাছি ছেড়ে দিয়েছে চিরকালের জন্য।"
আমি এবার আরো অবাক গেলাম, বললাম, "কি করে এটা সম্ভব হল?"
সোমনাথদা বলল, "সবই ধরে নাও হয়েছে আমারই জন্য। রাখী যার জন্য কৃতজ্ঞ আমার কাছে। আমি চাইনি মেয়েটা ওভাবে নিষিদ্ধপল্লীতে পড়ে থেকে জীবনটা নষ্ট করুক। আবার নয়তো পড়বে কোনো ভেড়ুয়ার খপ্পরে, ওর জীবনটা এমনিতেই কষ্টে ভরা, আরও নষ্ট হবে।"
আমি বললাম, "এমন অসাধ্য সাধনের কাজটা তুমি করলে কেমন করে?"
সোমনাথদা বলল, "আমার কিছু টাকা গেছে এর জন্য। একেবারে খালি হাতে তো কোন মেয়েকে নিষিদ্ধ এলাকা থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় না। যার কাছে গচ্ছিত রেখে এসেছিল ওর সেই আত্মীয়, তাকে দিয়েছি হাজার বিশেক। তবেই মুক্তি পেয়েছে রাখী।"
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সোমনাথদার দিকে। এমন উদার মনের মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
সোমনাথ দা বলল, "আমি এর মধ্যে রাখীর বাড়ীতেও ঘুরে এসেছি সুদীপ। রাখীর মায়ের সাথেও দেখা করে এসেছি। খুব ভাল মানু্য। শুধু আমাকে বলেছেন, মেয়েটার জন্য কষ্ট হয়, ভালবেসে একটা ছেলের খপ্পরে পড়ে কি কষ্টটাই না পেল জীবনে। ও এখন কোথায় আছে জানো?"
রাখীর মা'কে আমি সত্যি কথাটা বলতে পারিনি সুদীপ। চোখে জল চলে এসেছিল। সেদিনই ঠিক করেছিলাম, রাখীকে ঐ গলতা থেকে আমি বার করব খুব শীঘ্রই।
আমি সোমনাথদাকে বললাম, "রাখী এখন তাহলে কি করবে?"
সোমনাথদা আন্তরিকভাবে হেসে বললো, "ওর জন্য আমি একটা চাকরীও ঠিক করেছি সুদীপ। রাখী তো লেখাপড়াও জানে। এখন শুধু একটা বাসার প্রয়োজন। যেখানে ও থেকে চাকরীটা অনায়াসে করতে পারবে।"
আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরা রয়েছে, মুখে না দিয়ে সোমনাথদার কথা শুনছি। সোমনাথদা বলল, "চা খেয়ে নাও সুদীপ। তোমার চা ঠান্ডা হচ্ছে।"
এরকম মানুষও কি আছে পৃথিবীতে? ভালবাসা নেই, শরীরি লালসা নেই, অথচ একটা লোক নিঃস্বার্থভাবে মেয়েটার জন্য কত কিছু করছে। আমাকে অবাক করে সোমনাথদা বলল, "রাখীর জন্য ভাল একটা পাত্রও খুঁজছি, সুদীপ তুমি ওকে বিয়ে করবে?"
আমি চোখ দুটো গোল গোল করে তাকিয়ে আছি সোমনাথদার দিকে। আমার কাছে এসে একটু আমার চোখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে সোমনাথদা বলল, "হাজার হোক, ও তো কামিনী নয়? তুমি যাকে ভালবেসে পাগলের মতন শুধু ছুটে গেছ সোনাগাছিতে, তোমার ভালবাসার দাম যে দিতে পারিনি, তাকে ভুলে পারবে না এই মেয়েটাকে একটা নতুন জীবন ফিরিয়ে দিতে? রাখীকে তুমি ভালবাসতে পারো নি হয়তো আমারই ভুলে, কিন্তু ও এমনই মেয়ে, যাকে সত্যি কারে ভালবাসা যায়।"
আমি কি শুনছি আমি জানি না। অথচ সোমনাথদা পাগলের মতন শুধু সেধে যাচ্ছে আমাকে।
সোমনাথদা বললো, "আমি জানি সুদীপ তোমার মনের কি অবস্থা। কিন্তু দেখো, ঐ একটা মেয়ে, শুধু তোমার কথা চিন্তা করেই আমাকে ফোন করেছে, কাল রাতে যখন বললাম, তুমি আছো আমার বাড়ীতে, আমাকে বলল, ভালই হল, তোমার বাড়ী যাচ্ছি, তোমার বন্ধুর সাথেও তাহলে দেখা হয়ে যাবে। ওনার এই মূহূর্তে মনের শান্তিটা শুধু দরকার। পাশে দরকার এমন কাউকে, যে সত্যি ওনাকে ভালবাসবে।"
একটু চুপ করে থেকে আবার সোমনাথদা বলল, "রাখী ইচ্ছে করলে কামিনীর থেকেও তোমাকে অনেক বেশী ভালবাসতে পারে সুদীপ। এ ভালবাসা নির্ভেজাল, খাঁটি বিশুদ্ধের মতন। ওর শুধু ভয় হয়, একবার ভুল ও করেছিল জীবনে, আবার যদি সেরকম হয়। তাহলে হয়তো বাঁচতে পারবে না আর জীবনে।"
এবার আমার হাতটা ধরে সোমনাথদা বলল, "আমি তোমাকে বলেছিলাম না ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমার ভুল এটাই, আমি তখনও বুঝিনি তুমি কোন বেশ্যাকে ভালবাসতে পারো। রাখীর ঘরে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু রাখীর সাথে তুমি যৌনসংসর্গ করো আমি চাইনি। সেদিন যদি বুঝতাম, তুমি কারুর প্রেমে পড়তে চাইছ? তাহলে কি....."
সব শুনে বললাম, "সোমনাথদা, তাই বলে কি রাখী রাজী হবে? ও তো আমার আর কামিনীর ব্যাপারটা শুনেছে নিশ্চই।"
সোমনাথদা বলল, "ওর জীবনেও তো এর থেকেও খারাপ ঘটনা ঘটেছে, সবকিছু তুমি যদি মানিয়ে নাও, তাহলে ও কেন পারবে না?"
আমার চোখে মুখে এবার ভেসে আসছিল কাল রাতে রাখীর দেখা সেই মুখটা, কি করুন মুখ করে চিন্তিত অবস্থায় আমার জন্য বারান্দাতে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল রাখী, অথচ আমি একবারের জন্যও ফিরে তাকাই নি ওর দিকে। মেয়েটা সত্যি ভাল নইলে এমন......
বলতে বলতেই সোমনাথদার বাড়ীর বাইরে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। সোমনাথদা বলল, "রাখী এসে গেছে, দাঁড়াও ওকে নিয়ে আসি ভেতরে। আমার বাড়ীতে আগে তো কোনদিন আসেনি, মুখটা না দেখালে চিনতে অসুবিধে হবে।"
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে থ মেরে বসে আছি, ভাবছি আমার শরীরে তাহলে কি এক অন্য নারীর ছোঁয়া লাগতে চলেছে, এ নারী ঐ সোনাগাছিরই মেয়ে, তার হাত ধরেই ভালবাসাকে আবার ফিরে পেতে চলেছি? আমি জানি না।
ঘরের পর্দাটা সরিয়ে সোমনাথদা ঢুকলো, পেছনে পেছনে রাখী। একটা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ী পড়েছে, মিষ্টি রাখীকে আরও মিষ্টি দেখাচ্ছে।
আমার পাশে বসে রাখী বলল, "কেমন আছেন ভালো?"
আমি মাথাটা নাড়লাম, ঘাড়টা নিচু করলাম। সোমনাথদা বলল, "রাখী বলছিল, তোমাকে খোঁজার জন্য ও নাকি লোক পাঠিয়েছিল কালকে। অনেকক্ষণ পরে খুঁজে এসে সে বলেছে, না উনি নেই, বোধহয় চলে গেছেন।"
আমি ভাল করে তাকাতেই পারছি না রাখীর দিকে। সোমনাথদা বলল, "সুদীপ পাস্ট ইজ পাস্ট। পেছনের দিকে ভেবে কোন লাভ নেই। যা হয়েছে ভুলে যাও। আমরা দুজনেই আছি তোমার পাশে।"
রাখীর মুখের দিকে তাকালাম, দেখলাম ওর মুখে মিষ্টি হাসি, যে হাসির মধ্যে কোন ছল নেই, পুরুষমানুষকে প্রলুব্ধ করার কোন বাসনা নেই।
রাখী আমাকে বলল, "কষ্ট পেয়েছেন বলে আমার সাথেও কথা বলবেন না? বা রে? আমি যে এলাম আপনারই জন্য।"
এই রাখীই আমার লজ্জাটা কাটিয়ে দিয়েছিল একদিন, কামিনীর শরীরি প্রেমে পাগল হয়ে তাড়নার মতন ছুটে গেছি তারপর থেকে। এতদিন বাদে রাখীকে দেখতে পেয়ে লজ্জাটা যেন নতুন করে আবার ফিরে এসেছে। মুখটা তুলে বললাম, "আমি জানি, আজ আপনার নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে।"
আমাকে অবাক করে রাখী বলল, "কামিনীকে ভালবেসে ফেলেছিলেন, আবার কি কাউকে ভালবাসতে পারবেন?"
সত্যিই কি পারবো? এর উত্তর আমি জানি না। সোমনাথদা বলল, "রাখী কিন্তু আবার নতুন করে কারুর ভালবাসা পেতে চায়। যদি তুমি সুদীপ রাজী থাকো।"
প্রাণ খোলা লোকটার কথা শুনে আমাদের দুজনেরই অস্বস্তি বেড়ে গেছে, আমি গম্ভীর, রাখীও গম্ভীর। সোমনাথদা দুটো কান ধরে বলল, "সরি বাবা, আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না।"
রাখী আর আমি দুজনেই হাসতে লাগলাম সোমনাথদার কথা শুনে। ওর সাথে এরপরে আমার অনেক কথা হল। রাখী কোথায় চাকরী পেয়েছে সব জানলাম। ওর বাড়ীর গল্প, মায়ের কথা, অনেক্ষণ ধরে শুনলাম। কথা বলতে বলতেই রাখী আমার হাতটা একটু ধরলো, যেন মনে একটু শক্তি দেওয়ার মতন। আমার হাতের ওপরে রাখীর হাতের কোমল স্পর্শ। আমিও ওর হাতে হাত রাখলাম। রাখী আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল, "আমি খুব খারাপ মেয়ে সুদীপ, পারবে কি আমায় ভালবাসতে?"
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখটা ওর ছলছল করছে। ভালবাসার কাতর প্রার্থনা একটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়া লোকটাকেই করছে। ওর মুখটা দু হাত দিয়ে ধরলাম, কিছু বলতে চেষ্টা করলাম, রাখী বলল, "কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি তোমাকে দেখে, সোমনাথদাকে দশদিন আগেই বলেছিলাম, তোমার কথা। আমাকে বলল, সুদীপ এখন আর ফোন করে না, দেখাও হয় না। এই কদিনে ও কেমন পাল্টে গেছে, কেন জানি। আমার তো সেইদিনই তোমাকে ভাল লেগে গিয়েছিল সুদীপ, সোমনাথদাকে অন্তর থেকে বলেছিলাম ভাল লাগার কথাটা, সোমনাথদা হয়তো সেভাবে তোমাকে পায়েনি বলেই বলতে পারেনি আমার মনের কথাটা।"
ভাবতে পারছিলাম না, একই দিনে দুটো মেয়েই আমাকে এক সাথে ভালবেসে ফেলেছিল, অথচ একজনের ভালবাসাকে বুঝতে বুঝতে আমার অনেক দেরী হয়ে গেল।
আবেগে হঠাৎই রাখীর ঠোঁটের ওপর নেমে এলো আমার ঠোঁট। আমি ওর সাথে তখন চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে গেছি। ভীষন ভালবাসার খেলা চলছে, ঠিক এই মূহূর্তে সোমনাথদা কিন্তু ঘরের ভেতরে আর নেই।
সমাপ্ত
ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে সোমনাথদা আমাকে ওর বাড়ী নিয়ে গেল। একা থাকে লোকটা। কোন বাঁধন নেই। প্রাণ খোলা লোকটার সাথে অনেক রাত্রি অবধি কথা বলে আমার মনটা যেন এবার কিছুটা হালকা হল।
সোমনাথদা বলল, "এবার শুয়ে পড়ো সুদীপ। কাল সকালে তোমার সাথে এখানে কেউ দেখা করতে আসবে।"
কে আসবে জানি না, অনেক জিজ্ঞেস করতেও সোমনাথদা কিছুতেই তার নামটা বলল না, আমার মনে হল কাল সকালটা আমার বাকী জীবনের প্রথম দিন, সব কিছু ভুলে আমাকে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
কামিনীর কষ্টটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আমি শুয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙল দেরীতে। সোমনাথদা নিজের হাতে চা বানিয়ে নিয়ে এল আমার কাছে, বলল, "গুড মর্নিং। এই তো তোমাকে এবার খুব ফ্রেশ লাগছে। নাও তাড়াতাড়ি চা টা খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও, সে আসছে।"
আমি বললাম, "কে আসছে সোমনাথ দা?"
সোমনাথদা বলল, "রাখী।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "রাখী এখানে? কি করে?"
সোমনাথদা হেসে বললো, "বেশ্যার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে ও সুদীপ। রাখী সোনাগাছি ছেড়ে দিয়েছে চিরকালের জন্য।"
আমি এবার আরো অবাক গেলাম, বললাম, "কি করে এটা সম্ভব হল?"
সোমনাথদা বলল, "সবই ধরে নাও হয়েছে আমারই জন্য। রাখী যার জন্য কৃতজ্ঞ আমার কাছে। আমি চাইনি মেয়েটা ওভাবে নিষিদ্ধপল্লীতে পড়ে থেকে জীবনটা নষ্ট করুক। আবার নয়তো পড়বে কোনো ভেড়ুয়ার খপ্পরে, ওর জীবনটা এমনিতেই কষ্টে ভরা, আরও নষ্ট হবে।"
আমি বললাম, "এমন অসাধ্য সাধনের কাজটা তুমি করলে কেমন করে?"
সোমনাথদা বলল, "আমার কিছু টাকা গেছে এর জন্য। একেবারে খালি হাতে তো কোন মেয়েকে নিষিদ্ধ এলাকা থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় না। যার কাছে গচ্ছিত রেখে এসেছিল ওর সেই আত্মীয়, তাকে দিয়েছি হাজার বিশেক। তবেই মুক্তি পেয়েছে রাখী।"
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি সোমনাথদার দিকে। এমন উদার মনের মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
সোমনাথ দা বলল, "আমি এর মধ্যে রাখীর বাড়ীতেও ঘুরে এসেছি সুদীপ। রাখীর মায়ের সাথেও দেখা করে এসেছি। খুব ভাল মানু্য। শুধু আমাকে বলেছেন, মেয়েটার জন্য কষ্ট হয়, ভালবেসে একটা ছেলের খপ্পরে পড়ে কি কষ্টটাই না পেল জীবনে। ও এখন কোথায় আছে জানো?"
রাখীর মা'কে আমি সত্যি কথাটা বলতে পারিনি সুদীপ। চোখে জল চলে এসেছিল। সেদিনই ঠিক করেছিলাম, রাখীকে ঐ গলতা থেকে আমি বার করব খুব শীঘ্রই।
আমি সোমনাথদাকে বললাম, "রাখী এখন তাহলে কি করবে?"
সোমনাথদা আন্তরিকভাবে হেসে বললো, "ওর জন্য আমি একটা চাকরীও ঠিক করেছি সুদীপ। রাখী তো লেখাপড়াও জানে। এখন শুধু একটা বাসার প্রয়োজন। যেখানে ও থেকে চাকরীটা অনায়াসে করতে পারবে।"
আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরা রয়েছে, মুখে না দিয়ে সোমনাথদার কথা শুনছি। সোমনাথদা বলল, "চা খেয়ে নাও সুদীপ। তোমার চা ঠান্ডা হচ্ছে।"
এরকম মানুষও কি আছে পৃথিবীতে? ভালবাসা নেই, শরীরি লালসা নেই, অথচ একটা লোক নিঃস্বার্থভাবে মেয়েটার জন্য কত কিছু করছে। আমাকে অবাক করে সোমনাথদা বলল, "রাখীর জন্য ভাল একটা পাত্রও খুঁজছি, সুদীপ তুমি ওকে বিয়ে করবে?"
আমি চোখ দুটো গোল গোল করে তাকিয়ে আছি সোমনাথদার দিকে। আমার কাছে এসে একটু আমার চোখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে সোমনাথদা বলল, "হাজার হোক, ও তো কামিনী নয়? তুমি যাকে ভালবেসে পাগলের মতন শুধু ছুটে গেছ সোনাগাছিতে, তোমার ভালবাসার দাম যে দিতে পারিনি, তাকে ভুলে পারবে না এই মেয়েটাকে একটা নতুন জীবন ফিরিয়ে দিতে? রাখীকে তুমি ভালবাসতে পারো নি হয়তো আমারই ভুলে, কিন্তু ও এমনই মেয়ে, যাকে সত্যি কারে ভালবাসা যায়।"
আমি কি শুনছি আমি জানি না। অথচ সোমনাথদা পাগলের মতন শুধু সেধে যাচ্ছে আমাকে।
সোমনাথদা বললো, "আমি জানি সুদীপ তোমার মনের কি অবস্থা। কিন্তু দেখো, ঐ একটা মেয়ে, শুধু তোমার কথা চিন্তা করেই আমাকে ফোন করেছে, কাল রাতে যখন বললাম, তুমি আছো আমার বাড়ীতে, আমাকে বলল, ভালই হল, তোমার বাড়ী যাচ্ছি, তোমার বন্ধুর সাথেও তাহলে দেখা হয়ে যাবে। ওনার এই মূহূর্তে মনের শান্তিটা শুধু দরকার। পাশে দরকার এমন কাউকে, যে সত্যি ওনাকে ভালবাসবে।"
একটু চুপ করে থেকে আবার সোমনাথদা বলল, "রাখী ইচ্ছে করলে কামিনীর থেকেও তোমাকে অনেক বেশী ভালবাসতে পারে সুদীপ। এ ভালবাসা নির্ভেজাল, খাঁটি বিশুদ্ধের মতন। ওর শুধু ভয় হয়, একবার ভুল ও করেছিল জীবনে, আবার যদি সেরকম হয়। তাহলে হয়তো বাঁচতে পারবে না আর জীবনে।"
এবার আমার হাতটা ধরে সোমনাথদা বলল, "আমি তোমাকে বলেছিলাম না ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। আমার ভুল এটাই, আমি তখনও বুঝিনি তুমি কোন বেশ্যাকে ভালবাসতে পারো। রাখীর ঘরে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু রাখীর সাথে তুমি যৌনসংসর্গ করো আমি চাইনি। সেদিন যদি বুঝতাম, তুমি কারুর প্রেমে পড়তে চাইছ? তাহলে কি....."
সব শুনে বললাম, "সোমনাথদা, তাই বলে কি রাখী রাজী হবে? ও তো আমার আর কামিনীর ব্যাপারটা শুনেছে নিশ্চই।"
সোমনাথদা বলল, "ওর জীবনেও তো এর থেকেও খারাপ ঘটনা ঘটেছে, সবকিছু তুমি যদি মানিয়ে নাও, তাহলে ও কেন পারবে না?"
আমার চোখে মুখে এবার ভেসে আসছিল কাল রাতে রাখীর দেখা সেই মুখটা, কি করুন মুখ করে চিন্তিত অবস্থায় আমার জন্য বারান্দাতে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল রাখী, অথচ আমি একবারের জন্যও ফিরে তাকাই নি ওর দিকে। মেয়েটা সত্যি ভাল নইলে এমন......
বলতে বলতেই সোমনাথদার বাড়ীর বাইরে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। সোমনাথদা বলল, "রাখী এসে গেছে, দাঁড়াও ওকে নিয়ে আসি ভেতরে। আমার বাড়ীতে আগে তো কোনদিন আসেনি, মুখটা না দেখালে চিনতে অসুবিধে হবে।"
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে থ মেরে বসে আছি, ভাবছি আমার শরীরে তাহলে কি এক অন্য নারীর ছোঁয়া লাগতে চলেছে, এ নারী ঐ সোনাগাছিরই মেয়ে, তার হাত ধরেই ভালবাসাকে আবার ফিরে পেতে চলেছি? আমি জানি না।
ঘরের পর্দাটা সরিয়ে সোমনাথদা ঢুকলো, পেছনে পেছনে রাখী। একটা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ী পড়েছে, মিষ্টি রাখীকে আরও মিষ্টি দেখাচ্ছে।
আমার পাশে বসে রাখী বলল, "কেমন আছেন ভালো?"
আমি মাথাটা নাড়লাম, ঘাড়টা নিচু করলাম। সোমনাথদা বলল, "রাখী বলছিল, তোমাকে খোঁজার জন্য ও নাকি লোক পাঠিয়েছিল কালকে। অনেকক্ষণ পরে খুঁজে এসে সে বলেছে, না উনি নেই, বোধহয় চলে গেছেন।"
আমি ভাল করে তাকাতেই পারছি না রাখীর দিকে। সোমনাথদা বলল, "সুদীপ পাস্ট ইজ পাস্ট। পেছনের দিকে ভেবে কোন লাভ নেই। যা হয়েছে ভুলে যাও। আমরা দুজনেই আছি তোমার পাশে।"
রাখীর মুখের দিকে তাকালাম, দেখলাম ওর মুখে মিষ্টি হাসি, যে হাসির মধ্যে কোন ছল নেই, পুরুষমানুষকে প্রলুব্ধ করার কোন বাসনা নেই।
রাখী আমাকে বলল, "কষ্ট পেয়েছেন বলে আমার সাথেও কথা বলবেন না? বা রে? আমি যে এলাম আপনারই জন্য।"
এই রাখীই আমার লজ্জাটা কাটিয়ে দিয়েছিল একদিন, কামিনীর শরীরি প্রেমে পাগল হয়ে তাড়নার মতন ছুটে গেছি তারপর থেকে। এতদিন বাদে রাখীকে দেখতে পেয়ে লজ্জাটা যেন নতুন করে আবার ফিরে এসেছে। মুখটা তুলে বললাম, "আমি জানি, আজ আপনার নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে।"
আমাকে অবাক করে রাখী বলল, "কামিনীকে ভালবেসে ফেলেছিলেন, আবার কি কাউকে ভালবাসতে পারবেন?"
সত্যিই কি পারবো? এর উত্তর আমি জানি না। সোমনাথদা বলল, "রাখী কিন্তু আবার নতুন করে কারুর ভালবাসা পেতে চায়। যদি তুমি সুদীপ রাজী থাকো।"
প্রাণ খোলা লোকটার কথা শুনে আমাদের দুজনেরই অস্বস্তি বেড়ে গেছে, আমি গম্ভীর, রাখীও গম্ভীর। সোমনাথদা দুটো কান ধরে বলল, "সরি বাবা, আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না।"
রাখী আর আমি দুজনেই হাসতে লাগলাম সোমনাথদার কথা শুনে। ওর সাথে এরপরে আমার অনেক কথা হল। রাখী কোথায় চাকরী পেয়েছে সব জানলাম। ওর বাড়ীর গল্প, মায়ের কথা, অনেক্ষণ ধরে শুনলাম। কথা বলতে বলতেই রাখী আমার হাতটা একটু ধরলো, যেন মনে একটু শক্তি দেওয়ার মতন। আমার হাতের ওপরে রাখীর হাতের কোমল স্পর্শ। আমিও ওর হাতে হাত রাখলাম। রাখী আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল, "আমি খুব খারাপ মেয়ে সুদীপ, পারবে কি আমায় ভালবাসতে?"
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখটা ওর ছলছল করছে। ভালবাসার কাতর প্রার্থনা একটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়া লোকটাকেই করছে। ওর মুখটা দু হাত দিয়ে ধরলাম, কিছু বলতে চেষ্টা করলাম, রাখী বলল, "কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি তোমাকে দেখে, সোমনাথদাকে দশদিন আগেই বলেছিলাম, তোমার কথা। আমাকে বলল, সুদীপ এখন আর ফোন করে না, দেখাও হয় না। এই কদিনে ও কেমন পাল্টে গেছে, কেন জানি। আমার তো সেইদিনই তোমাকে ভাল লেগে গিয়েছিল সুদীপ, সোমনাথদাকে অন্তর থেকে বলেছিলাম ভাল লাগার কথাটা, সোমনাথদা হয়তো সেভাবে তোমাকে পায়েনি বলেই বলতে পারেনি আমার মনের কথাটা।"
ভাবতে পারছিলাম না, একই দিনে দুটো মেয়েই আমাকে এক সাথে ভালবেসে ফেলেছিল, অথচ একজনের ভালবাসাকে বুঝতে বুঝতে আমার অনেক দেরী হয়ে গেল।
আবেগে হঠাৎই রাখীর ঠোঁটের ওপর নেমে এলো আমার ঠোঁট। আমি ওর সাথে তখন চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে গেছি। ভীষন ভালবাসার খেলা চলছে, ঠিক এই মূহূর্তে সোমনাথদা কিন্তু ঘরের ভেতরে আর নেই।
সমাপ্ত
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!