26-08-2020, 05:21 PM
।। পাঁচ ।।
আমার যাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না। সোমনাথদা প্রায় জোড় করেই নিয়ে গেল আমায়। তারাতলায় ঢুকে সবে একপেগ হুইস্কি নিয়ে বসেছি দুজনে। ফোনটা সামনেই রাখা রয়েছে টেবিলে। মাঝে মাঝে ফোনটার দিকে তাকাচ্ছি আর ভেতরটা কেমন যেন করছে। সোমনাথদাও আমার মতন তাকাচ্ছে। যেন কামিনীর ফোন এলেই ধরবে। আগ বাড়িয়ে কথা বলবে কামিনীর সঙ্গে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি কি গো? একটু মজা করব বলে তোমাকে ওখানে নিয়ে গেলাম, আর তুমি কিনা কামিনীর খপ্পরে পড়ে বসে আছ? একটা বেশ্যাকে সামলাতে পারলে না। তুমি কি?"
হুইস্কির গ্লাসে মুখ ঠেকিয়ে শুধু সোমনাথদার দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু আমার মনটা যেন কেমন চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গোল্ডেন প্রোডাক্টস কোম্পানীর সেলস এক্সিকিউটিভ সুদীপ বসু এখন যাকে নিয়ে চিন্তা করছে, সে ঐ কাল রাতের শিহরণ তোলা নারী কামিনী। কামের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল শরীরে। কোথায় লাগে আর বাকীরা? একটা বারুদের স্তুপ কে নিয়ে দেশলাই কাঠির মতন জ্বলে উঠেছিলাম কালকে। এত সহজে কি ও আমাকে রেহাই দেবে? নাকি ভনিতা করেছে সকালবেলা। কামিনী আমার জন্য বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে দেবে। এ যেন অকল্পনীয় ব্যাপার।
সোমনাথদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে সুদীপ। এখনও ঐ মাগীটাকে নিয়ে পড়ে রয়েছো?"
আমি কোন জবাব দিচ্ছি না দেখে সোমনাথদা বলল, "তোমার কি হয়েছে বলোতো? সেই থেকে দেখছি ওই একই টেনশনে। কামিনী যেন তোমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তুমি কি ভয় পাচ্ছো? না সত্যি ওকে দিল দিয়ে বসে আছ? কামিনীকে সাথে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে মস্তি করবে? বলো তাহলে, আমি ব্যাবস্থা করে দেব? বীরজুকে একটা ফোন লাগাই। দেখি ও কি বলে? বীরজুর ফোন নম্বর আছে আমার কাছে।"
পকেট থেকে নিজের সেল ফোনটা বার করে কথা বলতেই যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ কি মনে করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "কিন্তু সে তো অনেক খরচার ব্যাপার। তোমার তো পকেট খালি হয়ে যাবে সুদীপ।"
আমি সোমনাথদার দিকে তাকিয়ে বললাম, "কিন্ত কামিনী তো আর পয়সা নেবে না আমার কাছ থেকে। ও তো তাই বলেছে। এমনি এমনিই....."
আগেও বলেছি কথাটা। সোমনাথদার বিশ্বাস হয়নি। এবারও হল না। কিন্তু টেবিলে বসে এমন অট্টহাসি দিল, পাশের টেবিলে বসা লোকগুলোও আমাদের কে দেখতে লাগল অবাক চোখে। সোনাগাছির মাগী নিয়ে কি কান্ডটাই না হচ্ছে তারাতলায় বসে। যেন আলোচনার একটা চরম বিষয় পাওয়া গেছে। কামিনী সেই যে ঘাড়ে চেপে বসেছে, আর ঘাড় থেকে নামতেই চাইছে না। আমার অবস্থা শোচনীয়।
একটু রসিকতা করে সোমনাথদা বলল, "দাঁড়াও না। ওর ফোনটা আসতে দাও। তারপর কেমন রসিয়ে রসিয়ে কথা বলি ওর সাথে তুমি দেখো। ফ্রীতে বেশ্যাভোগ? আমিও চান্স নেব আজকে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।"
আমি এবার একটু সিরিয়াস হলাম। সোমনাথদাকে বললাম, "তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছ না সোমনাথদা। ও আমার ফোন নম্বর নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ফোনটা যখন তখন আসতে পারে। সবসময় কি ফোন অফ করে রেখে দেব? তোমাকে তো পাব না? ও যদি সত্যি ফোন করে?"
সোমনাথদা এবার একটু সিরিয়াস হল। বলল, "তোমার সত্যি বিশ্বাস আছে ও ফোন করতে পারে?"
আমি প্রশ্নটা সোমনাথদার দিকেই ছুঁড়ে দিলাম। বললাম, "ধরে নাও যদি করে?"
এবার একটু হতাশ গলায় আপেক্ষের সুরে সোমনাথদা বলল, তাহলে তো ধরতে হবে, "সত্যি তোমার গলায় লটকেছে। ফ্রীতে একটা চান্স নেব বলে ঠিক করেছিলাম। সেটা আর হল না।"
আমি এবার যথেষ্টই সিরিয়াস। সোমনাথদাকে বললাম, "আর যদি করে, জেনে রেখো এবার ওর এসপার কি ওসপার। সব টেনশন আমি দূর করে নেব নিজেই।"
চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাচ্ছে সোমনাথদা, বলল, "কি করবে তুমি? এসপার ওসপার মানে?"
হুইস্কির গ্লাসটা মুখে ঠেকিয়ে বললাম, "ওকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসব।"
প্রায় আঁতকে উঠল সোমনাথদা। বলল, "তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কার সাথে পাঙ্গা নেবে তুমি? ওটা রেডলাইট এরিয়া। বাইরে থেকে মস্তানরা এসেও দাদাগিরি দেখাতে পারে না ওখানে। তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেবে তোমার। পাগল হয়েছ নাকি তুমি? তাছাড়া একটা বেশ্যাকে তুলে নিয়ে আসবে ঘরে? সুদীপ তোমার মা কি ভাববে? কি উল্টোপাল্টা ভাবছ? এক রাত্রিরের খোরাক ভেবে ওটা মন থেকে মুছে ফেল।"
আমি বললাম, "সত্যিই তো মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছি। কিন্তু পারছি কোথায়?"
এবার আমার হাত দুটো ধরে ফেললো সোমনাথদা। কাতর স্বরে একেবারে অনুনয় বিনয় করে বড় ভাইয়ের মত বলল, "জীবনে অনেক মেয়ে জুটবে সুদীপ। আমি বলছি, ঐ বেশ্যাটাকে তুমি ছেড়ে দাও। একটা ভাল মেয়ে দেখে এবার বিয়ে করে ফেল। আমার সত্যি ভুল হয়ে গেছে, তোমাকে কাল সোনাগাছি নিয়ে গিয়ে। এখন বুঝতে পারছি।"
অযথা টেনশন বাড়িয়ে আমি সোমনাথদাকেও অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছি। বুঝতে পারছি মেয়েছেলের হাওয়া কোনদিন গায়ে লাগেনি বলেই আজ আমার এমন অবস্থা। সবাই ওখানে মস্তি করতে যায়। আর আমি কিনা ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছি।
আলোচনার বিষয়বস্তুটা পাল্টাতে চাইছিলাম। সোমনাথদা এবার নিজে থেকেই বলল, "এই কারনে আমি রাখী ছাড়া অন্য কারুর ঘরে যাই না। পুরো বেশ্যাপট্টীতে ওই শুধু অন্যরকম। কারুর সাথে ভণিতা করা ও পছন্দ করে না। মেয়েটা খুবই ভাল মেয়ে, জানো তো সুদীপ। ওর জন্য কষ্ট হয়। পাকে চক্রে এই পেশায় এসে অবতীর্ণ হয়েছে, নয়তো ওর মত মেয়েকে সত্যি ওখানে মানায় না। রাখীর জন্য আমার খুব মায়া হয়।"
আমি বললাম, "কাল তো ভালই কেটেছে তোমার রাতটা। একে ভাল মেয়ে, সুন্দরী। তারপর আবার তুমি বলছ ও একেবারেই অন্যরকম।"
সোমনাথদা বলল, "কেন তুমি কাল রাতে ওকে দেখে কিছু বোঝোনি? বুঝবে কি করে? এখনও তো কামিনীর নেশায় বুঁদ হয়ে আছো। কামিনী ছাড়া আর কি কাউকে ভাল লাগবে তোমার?"
একটু অবাক হলাম, সোমনাথদার কথা শুনে। বললাম, "আমার ভাল লাগা না লাগায় কি যায় আসে? যার সাথে তোমার এত মাখো মাখো সম্পর্ক, সেখানে আমিই বা মাথা গলাতে যাব কেন? তাছাড়া বেশ্যা মানে তো বেশ্যাই। হতে পারে ও একটু অন্য ধরনের। কাল আমারও ওকে ভাল লেগেছিল ওর আন্তরিকতায়। কিন্তু যার সাথে তোমার দৈহিক সম্পর্ক, তাকে তো তোমার একটু বেশী করে ভাল লাগবেই।"
সোমনাথদা হূইস্কির গ্লাসটা এক ঢোঁকে পুরো শেষ করে দিয়ে বলল, "দৈহিক সম্পর্ক? ভালোই বলেছো!"
আমি এবার বেশ অবাক হলাম, বললাম, "তার মানে তুমি সত্যি কিছু করোনি? কাল রাতে তো মশা মেরেছো শুনলাম। এর আগে কোনোদিন?"
সোমনাথদা মাথা নাড়লো, "না সুদীপ। রাখীর সঙ্গে কোনদিন আমার দৈহিক সম্পর্ক হয় নি।"
একেবারে তাজ্জব হয়ে গেলাম সোমনাদার কথা শুনে। বুড়ো লোকটা পয়সা খরচা করে সোনাগাছিতে যায় এমনি এমনি? শুধুই কি গল্প করার জন্য? এতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। রাখী একজন প্রস্টিটিউট। তার ওপর সোমনাথদা তার বাঁধা খদ্দের। এমন খদ্দেরের মুখে এসব কি কথা?
আমার দিকে তাকিয়ে সোমনাথদা বলল, "আমি জানি তোমার আমার কথা বিশ্বাস হবে না। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তাই ই সুদীপ। আমি রাখীর একজন ভাল বন্ধু। এর বেশী কিছু নয়। ওকে জড়িয়ে ধরে মাঝে ওর গায়ে একটু চিমটি কেটে দিই, আদর করি, মস্করা করি। কিন্তু ইন্টারকোর্স রাখীর সাথে আমার কোনদিন হয় নি।"
আমি একটু আগ্রহের সাথেই বললাম, "কিন্তু কেন সোমনাথদা? তোমার আনন্দটাই তো তাহলে মাটি। শুধু গল্প করার জন্য তুমি একটা বেশ্যার কাছে যাও? এটা তো অদ্ভূত ব্যাপার। কাল রাতে তুমি তাহলে....."
সোমনাথদা বলল, "হ্যাঁ কিছুই করিনি আমি। আর করব না কোনদিন।"
আমি বললাম, "কিন্তু কেন?"
সোমনাথদা বললো, "ও আমাকে অন্যরকম চোখে দেখে সুদীপ। আমাকে শ্রদ্ধা করে। অনেক দূঃখ করে বলেছে ওর জীবনের কথা। রাখী এই জীবিকা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। গণিকার জীবন ওরও ভাল লাগে না। কোন এক পুরুষকে ভালবেসে আজ ও এই জায়গায়, রাখী পড়াশুনা করেছে। ইচ্ছে করলে ও ভাল চাকরীও করতে পারত। নিয়তি ওকে টেনে আনল সোনাগাছির বেশ্যাপট্টীতে।"
আমি বললাম, "কিন্তু সোমনাথদা, তুমিও বলেছ, বেশ্যাদের ভাবভালবাসা কখনও হয় না। তাহলে রাখীর বেলায় কেন এটা?"
সোমনাথদা বললো, "রাখী যখন ভালবাসত কাউকে, তখনও ও বেশ্যা হয় নি। নিষ্পাপ মেয়েটির মধ্যে অগাধ ভালবাসা ছিল ঐ ছেলেটির জন্য। কিন্তু ছেলেটিই ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।"
আমি অবাক হয়ে শুনছি সোমনাথদার কথা। বললাম, "তারপর?"
সোমনাথদা বলল, "তারপরটা খুব মর্মান্তিক সুদীপ। রাখী সেই ঘটনা যেদিন আমায় বলেছিল, ওর দুচোখে দেখেছিলাম জল। কান্না চেপে রাখতে পারেনি। কি সাংঘাতিক বর্বরতার কাজ করেছিল ঐ ছেলেটা।"
আমি জানতে চাইলাম, "কি করেছিল?"
সোমনাথদা খুলে বললো, "ছেলেটা রাখীকে একদিন বাড়ীতে ডেকে নিয়ে আসে। ওর দুজন বন্ধুও ছিল সেই সময়। ফাঁকা বাড়ীতে রাখীর সাথে প্রথমে খুব জমিয়ে গল্প করে ওরা। রাখীও বুঝতে পারেনি মতলবটা। রাখীর শরবতের সাথে ওরা কিছু মিশিয়ে দেয়। নিস্তেজ রাখীর শরীরটাকে বিছানাতে শুইয়ে একপ্রকার ছেলেটির উপস্থিতিতেই ওরা রাখীকে ''. করে। ছেলেটিরও এতে মদত ছিল। মন প্রাণ দিয়ে যাকে ভালবাসত, এমন বিশ্বাসঘাতকতায় রাখী ভীষন ভেঙে পড়ে। ভাবতেও পারেনি যাকে ভালবাসতো, সেই এরকম কাজ করে বসবে।
আমি বললাম, "ছেলেগুলোর কোনো সাজা হয় নি তারপরে?"
সোমনাথদা মাথা ঝাঁকালো, হ্যাঁ, জেল খাটছে এখন। সেই সাথে রাখীর প্রেমিকও। রাখীর বাড়ীতে রাখীর মা সব শুনে খুব ভেঙে পড়েন। পাড়াপড়শী জানতে পারে। তারপর থেকে রাখী কাউকে মুখ দেখাতে পারত না। একদিন মাকে ছেড়ে ও চলে আসে। দুসম্পর্কের এক বদমায়েশ মামা ছিল ওর। কোনরকম সহানূভূতি দেখানো তো দূরের কথা। অসহায় রাখীকে মামা বলে, তোর তো জীবনে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। ভালবেসে নিজের দেহটাকেই খুইয়ে বসেছিস তুই। এখন থেকে শরীর বেচে রোজগারের ধান্দা কর। আমি তোকে ভাল একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। মামার হাত ধরেই রাখী তারপর থেকে সোনাগাছিতে। এখনও আমাকে বলে, সত্যি সেদিন নিজের জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল সোমনাথদা। আমার ইচ্ছা না থাকলে মামা আমাকে জোড় করে এখানে নিয়ে আসতে পারত না। কিন্তু আজ বুঝি, জীবনটাকে যদি নতুন করে আবার ফিরে পেতাম। এই বেশ্যার জীবন আমার আর ভাল লাগে না। পয়সা নিয়ে লোককে শরীর বেচা। আমার শরীরতো এমনিই এঁটো হয়ে গেছে সোমনাথদা।"
কিছুক্ষণের জন্য সোমনাথদার কথা শুনে পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সোমনাথদা বলল, "আমিও তাই মেয়েটার কাছে যাই, কিন্তু গল্প ছাড়া কিছুই করি না। ও বাড়ীতে মাকে মাসে মাসে যে টাকাটা পাঠায়, ওটা আমিই দিই। মেয়েটার জন্য আমার সত্যি দয়া হয়।"
আমি চোখ কপালে তুললাম, "কি বলছ তুমি সোমনাথদা!"
সোমনাথদা স্মিত হাসলো, "সত্যিই বলছি।"
জীবনে এমন নিস্বার্থ, দয়ালু প্রকৃতির লোক দেখিনি। লোকটার প্রতি আমার ভালবাসা আর শ্রদ্ধাটা যেন নতুন করে তৈরী হল। কাল শুধু শুধু আমি সোমনাথদাকে ভুল বুঝেছিলাম, তার জন্য খুবই আফসোস হচ্ছে এখন।
সোমনাথদা বলল, "আমি রাখীকে একবার বলে দেখব নাকি? কামিনীর ব্যাপারটা। ও যদি শুনে সত্যি মিথ্যে ব্যাপারটা যাচাই করে দেয়।"
আমি সোমনাথদাকে বাধা দিলাম। বললাম, "না না রাখীকে বলতে যেও না। আমি নিজেই এ ব্যাপারটা সামাল দিয়ে দেব।"
স্টারলেট গার্ডেন থেকে আমরা দুজনে যখন মাল খেয়ে বেরোলাম, তখন অনেক রাত্রি। সোমনাথদা একটা ট্যাক্সি ধরল। বলল, "তোমাকে বাড়ীতে ড্রপ করে দিই?"
আমি বললাম, "না তার দরকার নেই। শুধু শুধু তোমাকে অনেকটা পথ ঘুরতে হবে। আমি একটা অন্য ট্যাক্সি ধরে নিচ্ছি।"
সোমনাথদা আমাকে গুডনাইট করে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, "ভয় নেই। একটা দিক দিয়ে তুমি রেহাই পেলে। কামিনী তোমাকে যখন আর ফোন করেনি, তখন আর করবেও না। তুমি নিশ্চিন্তে এখন বাড়ী যাও।"
আমি বললাম, "হ্যাঁ মনে তো হচ্ছে তাই।"
একটা ট্যাক্সি আমিও ধরলাম। ড্রাইভারকে বললাম, বাড়ী যাব। মল্লিকবাজার হয়ে মৌলালি ধরতে। ও সেভাবেই রওনা দিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সুখটান দিলাম। হাতে নিয়ে মোবাইলটা নড়াচড়া করছি আর ভাবছি টেনশন যেটা ছিল, সেটা অনেকটাই কেটে গেছে এখন। কামিনী নিজেই ওর ভূতটা আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে।
গাড়ী মল্লিকবাজার ক্রশ করে মৌলালির দিকে যাচ্ছে, আমার একটু চোখে ঘুম ঘুম এসেছে। গাড়ীর জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া এসে লাগছে মুখে। চোখটা বুজে সীটে গা টা এলিয়ে দিয়েছিলাম। এমন সময়ই ফোনটা হঠাৎই বাজতে লাগল। চোখ খুলে ধড়মড় করে সীটের ওপর বসে পড়েছি। কে ফোন করল?
কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই, উল্টো দিক দিয়ে কন্ঠস্বর ভেসে এল, "আমি কামিনী বলছি। কি ব্যাপার? ফোনটা অফ করে রেখেছিলে? আমি তো সেই সন্ধে থেকে তোমাকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বলেছিলাম না তোমাকে সন্ধে হলেই তোমাকে চলে আসতে। কোথায় এখন তুমি? আমি বসে আছি তোমার জন্য। শীগগীর চলে এসো এক্ষুনি।"
কামিনীর ফোন পেয়ে আমার ভেতরটা ছ্যাঁক করে উঠল। শেষ পর্যন্ত যে ওর ফোনটা আসবে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এ কি খেলা শুরু হয়েছে আমার জীবন নিয়ে? মেয়েছেলেকে টাকা দিয়ে ফুর্তী করেছি, তারপরেও আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে, এখনও পিছু ছাড়ছে না, কোন মানে হয়?
কামিনী যেন নাছোড়বান্দা, আমাকে বলল, "তুমি আসবে কিনা বলো? নইলে....."
আমি এবার একটু রেগে গেলাম, বললাম, "নইলে মানে? কি করবে তুমি?"
কামিনী বলল, "আমি অনেক কিছুই করতে পারি।"
ওকে ফোনে বললাম, "আমার যাওয়া না যাওয়াটা সম্পূর্ণ আমার নিজের ইচ্ছের ওপর। তাছাড়া....."
কামিনী বলল, "তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলে। সন্ধে হলেই চলে আসবে।"
ফোনটা ধরে ট্যাক্সির মধ্যেই একটু উত্তেজিত হয়ে গেলাম, বললাম, "কথা দিলেই তো সব সময় কথা রাখা যায় না। তাছাড়া বাড়ীতে আমার মা রয়েছেন, তাকে ফেলে রোজ রোজ বাইরে কাটানো আমার সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমি মাকে অসুবিধেয় ফেলতে পারব না।"
কামিনী এবার একটু ব্যাঙ্গ করল আমাকে, বলল, "মায়ের প্রতি অতই দরদ যখন মায়ের আঁচলের তলাতেই পড়ে থাকতে পারতে, ফুর্তী লোটাতে সোনাগাছি এলে কেন?"
ওর কথা শুনে রাগে মাথা গরম হয়ে গেল আমার, মাথায় রক্ত চড়ে গেছে, কামিনীকে বললাম, "মুখ সামলে কথা বলো কামিনী, তোমার সাথে ফুর্তী করেছি বিনা পয়সায় নয়। পাঁচ হাজার টাকা গুনে গুনে দিয়েছি তোমায়, শরীরে বেচে ধান্দা করো, তোমাদের মুখে আবার এসব কথা কেন?"
ট্যাক্সিওয়ালাও বুঝলো, কোন একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে, আমি এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছি, আমার রীতিমতন লড়াই হচ্ছে তার সাথে, শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে আমি না গালাগাল দিয়ে বসি।
কামিনী বলল, "ফোনটা অফ করে রেখে দিয়েছিলে কেন? আমার ভয়ে?"
আমি বললাম, "তা কেন? আমার শরীরটা আসলে ভাল ছিল না, সন্ধেবেলা শুয়েছিলাম।"
কামিনী বললো, "তাহলে এখন কোথায় তুমি?"
আমি বললাম, "একটা কাজে বেরিয়েছিলাম, কাজটা সেরে এখন বাড়ী ফিরছি।"
কামিনী বলল, "এসো না রাজা। দেখো তোমার জন্য তোমার রানী কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।"
একটু আগে ওর কথার মধ্যে যে ঝাঁঝালো ভাবটা ছিল এখন সেটা পাল্টে গেল নিমেষেই। ফোনে রীতিমতন কাকুতি মিনতি করে আমার মনটাকে আবার দূর্বল করে দেবার চেষ্টা করতে লাগল কামিনী।
আমাকে বলতে লাগল, "তোমাকে না দেখতে পেলে আমার সারারাত ঘুমই হবে না ডারলিং। এই কামিনী এখন তোমার দিওয়ানী হয়ে গেছে। তোমার জন্য বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে দিলাম, আর তুমি কিনা আমার মনটাই বুঝতে পারলে না?"
আমি চুপ করে শুনছি ওর কথা, সোমনাথদার কথাটা মনে পড়ল, ওকে বললাম, "সবই বুঝতে পারছি কামিনী, তোমার আমাকে ভাল লেগেছে, আমারও তোমাকে। কিন্তু তুমি যে পেশাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছ, সেটা থেকে বেরোনো কি সম্ভব? তোমার জগৎটা একরকম, আর আমারটা আর এক রকম। সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশের মানু্ষ আমরা দুজন, তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে হলে, আমাকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে অনেকের কাছে, তাছাড়া তুমিই বা ওখান থেকে আসবে কি করে? রোজ রোজ ভালবাসার খেলা খেলতে আমি তোমার ওখানে যাব? এও কি সম্ভব?"
কামিনী বলল, "রোজ তোমাকে আসতে হবে না রাজা, অন্তত আজকের রাতটার জন্য তো আসো? তোমাকে দেখতে না পেলে মরে যাব আমি। সারারাত ছটফট করে মরব, তারপরে হয়তো মনের দূঃখে কিছু একটা করে বসবো, জেনে রেখো, তুমি যখন নেই এই কামিনীও তোমার নেই। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না রাজা, তুমি আমার জান, আমার সব কিছু।"
রাত বিরেতে এ কি ঝেমেলা। মেয়েটা যে দেখছি সত্যি সত্যি দিল দিয়ে বসে আছে আমাকে। জীবনে চরম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কি করব, তাই ভাবছি। আমার মনে হল, এত জোড় দিয়ে যখন বলছে, তারমানে কামিনীর ভালবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই।
ফোনটা তখনও ছাড়ে নি ও, আমাকে শেষ বারের মতন বলল, "তুমি আসছো তো তাহলে? আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।"
কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে সত্যি কষ্ট হচ্ছিল আমার, মনের মধ্যে যে আশঙ্কাটা রয়ে গিয়েছিল, সেটাই কামিনী বাস্তব করে দেখালো। সোমনাথদার কথাও সত্যি হল না, আমার জীবনে সবকিছুই যেন কেমন ওলোটপালোট হয়ে গেল।
বাড়ীতে মা আমাকে দেখতে না পেলে আবার চিন্তা করবে, কামিনীকে বললাম, "ঠিক আছে আমি মায়ের সাথে একটু দেখা করে তারপর তোমার কাছে আসছি।"
ট্যাক্সি ততক্ষণে বাড়ীর কাছে এসে গেছে, আমি ট্যাক্সিটাকে ছাড়লাম না। ড্রাইভারটা আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে, ওকে বললাম, "একটু দাঁড়ান আমি ভেতর থেকে এক্ষুনি আসছি।"
মায়ের সাথে দেখা করলাম, মা'কে বললাম, "মা একটু কাজে বেরোচ্ছি, অফিসের কাজে একটু শিলিগুড়ি যেতে হবে আমাকে।"
মা বলল, "সেকীরে এত রাত্রে? হঠাৎ?"
আমি বললাম, "কাজ পড়েছে মা। অফিস থেকে ফোন এসেছিল, এক্ষুনি বাস বা ট্রেন যা হোক ধরে যেতে হবে, কাল সকালে গিয়ে পৌঁছোবো, সারাদিন কাল শিলিগুড়িতে কাজ করে তারপর আবার ব্যাক করব।"
এক বেশ্যার ভালবাসার মোহে আবদ্ধ হয়ে আমাকে মায়ের কাছে মিথ্যে কথাটা বলতে হল, কাজের নাম করে আমি আবার সেই সোনাগাছিতেই যাচ্ছি, মা'কে বুঝতেও দিলাম না।
একটা ছোট্ট সুটকেশের মধ্যে কিছু জামাকাপড় নিয়ে নিলাম। মা বুঝল, সত্যিই তার মানে আমি অফিসের কাজেই যাচ্ছি, এই সুদীপ বসুর গন্তব্যস্থল যে শিলিগুড়ি নয়, সোনাগাছি, সেটা মা ঘূণাক্ষরেও টের পেল না।
ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ীতে উঠে বললাম, "চলুন আমি এখন সোনাগাছি যাব।"
রীতিমতন হকচকিয়ে যাবার মতন অবস্থা, তবুও ড্রাইভারটা আমাকে না করল না, গাড়ী ঘুরিয়ে সোনাগাছির দিকে রওনা দিয়েছি, মনে হল, ফয়সলাটা আজ আমাকে ওখানে গিয়ে করতেই হবে, রোজ রোজ কামিনী যদি ফোন করে বিব্রত করে আমায়, আমার কাজকর্ম সব ব্যহত হবে। স্বাভাবিক জীবনে কালো অন্ধকার নেমে আসবে আমার। আমি কামিনীকে বোঝাবো, "রোজ রোজ এখানে আসা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তার চেয়ে তুমিই সব পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে চলো আমার সাথে, আমি রাজরানী করে রাখব তোমাকে। ভালবাসার জন্য এই নোংরা জায়গাটাকে কাল থেকে ছাড়তেই হবে তোমাকে। তুমি যদি না চলো, তাহলে জেনে রেখো এই সুদীপ বসুও কোনদিন আসবে না তোমার ডাকে। হাজার বার চেষ্টা করেও এই বান্দাকে তখন টলাতে পারবে না তুমি। আজ এলাম, এটাই আমার শেষ আসা তোমার কাছে!"
সোমনাথদা আমাকে বলেছিল, ওখানে গিয়ে দাদাগিরিটা দেখাতে যেও না, সেটাও আমার মাথায় ছিল, ঠিক করলাম, কামিনীকে ভালভাবে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা। ও যেন আমার ইচ্ছেটাকে মেনে নিতে রাজী হয়, ভালবাসার অগ্নিপরীক্ষা এবার কামিনীকেই দিতে হবে, আমার জন্য। নিজের খোলস ছেড়ে কামিনী কিভাবে গন্ডী ছেড়ে বাইরে বেরোয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ট্যাক্সি গিয়ে পৌঁছোলো সোনাগাছিতে। আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কামিনীর ঘরের দিকে এগোতে লাগলাম। আশে পাশে বীরজু, চিন্না, মোটাসোটা দালালগুলোর কাউকেই তেমন নজর পড়ল না। বুঝলাম অন্য খদ্দেরকে নিয়ে ধান্দা করছে মনে হয়, নয়তো মদ ভাঙ খেয়ে পড়ে আছে অন্য কোথাও, আমার ওদিকে নজর করে লাভ নেই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সেই বেশ্যাটাকে আবার নজর পড়ল, যে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়েছিল ঘরের মধ্যে। সামনা সামনি পড়ে চোখাচুখি হতেই ও বলল, "আরিব্বাস ফির আ গ্যয়া? কউন জাদু কিয়া রে তেরে পর? যারা হাম কো ভী বাতানা?" বলেই আমার পথ আগলে দাঁড়ালো।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "আমাকে যেতে দাও, আমি কামিনীর ঘরে যাব।"
মেয়েটা আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে ফেললো। বলল, "কামিনী? কামিনী জাদু কিয়া তেরে পর? উসকো সাম্ভাল নেহী পায়েগা তু। জরিলা সাপ হ্যায় ও। নাগিন হ্যায় নাগিন। খা যায়েগি তেরে কো।"
একটা বেশ্যা হয়ে আর একটা বেশ্যার সন্মন্ধে খারাপ খারাপ কথা বলছে, এরা মনে হয় খদ্দের নিয়ে নিজেদের মধ্যে রেশারেশি করে, কামিনীর শরীরের মধ্যে যে চোখ ধাঁধানো ব্যাপারটা আছে, সেটা বাকীদের নেই বলেই কি এত রাগ? সব ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে?
মেয়েটা আমাকে রাস্তাই ছাড়ত না, যদি না আর একজন খদ্দের চলে না আসত তক্ষুনি। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ঐ রেন্ডীটা আর একজনকে নিয়ে পড়ল। আমি রেহাই পেয়ে তাড়াতাড়ি কামিনীর ঘরের সামনে চলে এলাম।
ঘরটা চিনে নিতে আমার অসুবিধে হয় নি। কাল রাতে এই ঘরেই আমার কামলালসা চরিতার্থ করেছি, আজ সুদীপ বসু কোন কামলালসা পূরণ করার জন্য এখানে আসেনি, এসেছে কামিনীকে বোঝাতে, তার জীবনটাকে নিয়ে খেলা করার অধিকার একটা বেশ্যার নেই। সে যদি তাকে সত্যিই ভালবাসে, তাহলে সব ছেড়েছুড়ে চলুক এখান থেকে। আজই একশ শতাংশ কথা দিতে হবে কামিনীকে, নইলে তাকে ভুলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা নেই।
আমার যাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না। সোমনাথদা প্রায় জোড় করেই নিয়ে গেল আমায়। তারাতলায় ঢুকে সবে একপেগ হুইস্কি নিয়ে বসেছি দুজনে। ফোনটা সামনেই রাখা রয়েছে টেবিলে। মাঝে মাঝে ফোনটার দিকে তাকাচ্ছি আর ভেতরটা কেমন যেন করছে। সোমনাথদাও আমার মতন তাকাচ্ছে। যেন কামিনীর ফোন এলেই ধরবে। আগ বাড়িয়ে কথা বলবে কামিনীর সঙ্গে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি কি গো? একটু মজা করব বলে তোমাকে ওখানে নিয়ে গেলাম, আর তুমি কিনা কামিনীর খপ্পরে পড়ে বসে আছ? একটা বেশ্যাকে সামলাতে পারলে না। তুমি কি?"
হুইস্কির গ্লাসে মুখ ঠেকিয়ে শুধু সোমনাথদার দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু আমার মনটা যেন কেমন চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গোল্ডেন প্রোডাক্টস কোম্পানীর সেলস এক্সিকিউটিভ সুদীপ বসু এখন যাকে নিয়ে চিন্তা করছে, সে ঐ কাল রাতের শিহরণ তোলা নারী কামিনী। কামের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল শরীরে। কোথায় লাগে আর বাকীরা? একটা বারুদের স্তুপ কে নিয়ে দেশলাই কাঠির মতন জ্বলে উঠেছিলাম কালকে। এত সহজে কি ও আমাকে রেহাই দেবে? নাকি ভনিতা করেছে সকালবেলা। কামিনী আমার জন্য বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে দেবে। এ যেন অকল্পনীয় ব্যাপার।
সোমনাথদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে সুদীপ। এখনও ঐ মাগীটাকে নিয়ে পড়ে রয়েছো?"
আমি কোন জবাব দিচ্ছি না দেখে সোমনাথদা বলল, "তোমার কি হয়েছে বলোতো? সেই থেকে দেখছি ওই একই টেনশনে। কামিনী যেন তোমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তুমি কি ভয় পাচ্ছো? না সত্যি ওকে দিল দিয়ে বসে আছ? কামিনীকে সাথে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে মস্তি করবে? বলো তাহলে, আমি ব্যাবস্থা করে দেব? বীরজুকে একটা ফোন লাগাই। দেখি ও কি বলে? বীরজুর ফোন নম্বর আছে আমার কাছে।"
পকেট থেকে নিজের সেল ফোনটা বার করে কথা বলতেই যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ কি মনে করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "কিন্তু সে তো অনেক খরচার ব্যাপার। তোমার তো পকেট খালি হয়ে যাবে সুদীপ।"
আমি সোমনাথদার দিকে তাকিয়ে বললাম, "কিন্ত কামিনী তো আর পয়সা নেবে না আমার কাছ থেকে। ও তো তাই বলেছে। এমনি এমনিই....."
আগেও বলেছি কথাটা। সোমনাথদার বিশ্বাস হয়নি। এবারও হল না। কিন্তু টেবিলে বসে এমন অট্টহাসি দিল, পাশের টেবিলে বসা লোকগুলোও আমাদের কে দেখতে লাগল অবাক চোখে। সোনাগাছির মাগী নিয়ে কি কান্ডটাই না হচ্ছে তারাতলায় বসে। যেন আলোচনার একটা চরম বিষয় পাওয়া গেছে। কামিনী সেই যে ঘাড়ে চেপে বসেছে, আর ঘাড় থেকে নামতেই চাইছে না। আমার অবস্থা শোচনীয়।
একটু রসিকতা করে সোমনাথদা বলল, "দাঁড়াও না। ওর ফোনটা আসতে দাও। তারপর কেমন রসিয়ে রসিয়ে কথা বলি ওর সাথে তুমি দেখো। ফ্রীতে বেশ্যাভোগ? আমিও চান্স নেব আজকে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে।"
আমি এবার একটু সিরিয়াস হলাম। সোমনাথদাকে বললাম, "তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছ না সোমনাথদা। ও আমার ফোন নম্বর নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ফোনটা যখন তখন আসতে পারে। সবসময় কি ফোন অফ করে রেখে দেব? তোমাকে তো পাব না? ও যদি সত্যি ফোন করে?"
সোমনাথদা এবার একটু সিরিয়াস হল। বলল, "তোমার সত্যি বিশ্বাস আছে ও ফোন করতে পারে?"
আমি প্রশ্নটা সোমনাথদার দিকেই ছুঁড়ে দিলাম। বললাম, "ধরে নাও যদি করে?"
এবার একটু হতাশ গলায় আপেক্ষের সুরে সোমনাথদা বলল, তাহলে তো ধরতে হবে, "সত্যি তোমার গলায় লটকেছে। ফ্রীতে একটা চান্স নেব বলে ঠিক করেছিলাম। সেটা আর হল না।"
আমি এবার যথেষ্টই সিরিয়াস। সোমনাথদাকে বললাম, "আর যদি করে, জেনে রেখো এবার ওর এসপার কি ওসপার। সব টেনশন আমি দূর করে নেব নিজেই।"
চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাচ্ছে সোমনাথদা, বলল, "কি করবে তুমি? এসপার ওসপার মানে?"
হুইস্কির গ্লাসটা মুখে ঠেকিয়ে বললাম, "ওকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসব।"
প্রায় আঁতকে উঠল সোমনাথদা। বলল, "তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কার সাথে পাঙ্গা নেবে তুমি? ওটা রেডলাইট এরিয়া। বাইরে থেকে মস্তানরা এসেও দাদাগিরি দেখাতে পারে না ওখানে। তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেবে তোমার। পাগল হয়েছ নাকি তুমি? তাছাড়া একটা বেশ্যাকে তুলে নিয়ে আসবে ঘরে? সুদীপ তোমার মা কি ভাববে? কি উল্টোপাল্টা ভাবছ? এক রাত্রিরের খোরাক ভেবে ওটা মন থেকে মুছে ফেল।"
আমি বললাম, "সত্যিই তো মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছি। কিন্তু পারছি কোথায়?"
এবার আমার হাত দুটো ধরে ফেললো সোমনাথদা। কাতর স্বরে একেবারে অনুনয় বিনয় করে বড় ভাইয়ের মত বলল, "জীবনে অনেক মেয়ে জুটবে সুদীপ। আমি বলছি, ঐ বেশ্যাটাকে তুমি ছেড়ে দাও। একটা ভাল মেয়ে দেখে এবার বিয়ে করে ফেল। আমার সত্যি ভুল হয়ে গেছে, তোমাকে কাল সোনাগাছি নিয়ে গিয়ে। এখন বুঝতে পারছি।"
অযথা টেনশন বাড়িয়ে আমি সোমনাথদাকেও অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছি। বুঝতে পারছি মেয়েছেলের হাওয়া কোনদিন গায়ে লাগেনি বলেই আজ আমার এমন অবস্থা। সবাই ওখানে মস্তি করতে যায়। আর আমি কিনা ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছি।
আলোচনার বিষয়বস্তুটা পাল্টাতে চাইছিলাম। সোমনাথদা এবার নিজে থেকেই বলল, "এই কারনে আমি রাখী ছাড়া অন্য কারুর ঘরে যাই না। পুরো বেশ্যাপট্টীতে ওই শুধু অন্যরকম। কারুর সাথে ভণিতা করা ও পছন্দ করে না। মেয়েটা খুবই ভাল মেয়ে, জানো তো সুদীপ। ওর জন্য কষ্ট হয়। পাকে চক্রে এই পেশায় এসে অবতীর্ণ হয়েছে, নয়তো ওর মত মেয়েকে সত্যি ওখানে মানায় না। রাখীর জন্য আমার খুব মায়া হয়।"
আমি বললাম, "কাল তো ভালই কেটেছে তোমার রাতটা। একে ভাল মেয়ে, সুন্দরী। তারপর আবার তুমি বলছ ও একেবারেই অন্যরকম।"
সোমনাথদা বলল, "কেন তুমি কাল রাতে ওকে দেখে কিছু বোঝোনি? বুঝবে কি করে? এখনও তো কামিনীর নেশায় বুঁদ হয়ে আছো। কামিনী ছাড়া আর কি কাউকে ভাল লাগবে তোমার?"
একটু অবাক হলাম, সোমনাথদার কথা শুনে। বললাম, "আমার ভাল লাগা না লাগায় কি যায় আসে? যার সাথে তোমার এত মাখো মাখো সম্পর্ক, সেখানে আমিই বা মাথা গলাতে যাব কেন? তাছাড়া বেশ্যা মানে তো বেশ্যাই। হতে পারে ও একটু অন্য ধরনের। কাল আমারও ওকে ভাল লেগেছিল ওর আন্তরিকতায়। কিন্তু যার সাথে তোমার দৈহিক সম্পর্ক, তাকে তো তোমার একটু বেশী করে ভাল লাগবেই।"
সোমনাথদা হূইস্কির গ্লাসটা এক ঢোঁকে পুরো শেষ করে দিয়ে বলল, "দৈহিক সম্পর্ক? ভালোই বলেছো!"
আমি এবার বেশ অবাক হলাম, বললাম, "তার মানে তুমি সত্যি কিছু করোনি? কাল রাতে তো মশা মেরেছো শুনলাম। এর আগে কোনোদিন?"
সোমনাথদা মাথা নাড়লো, "না সুদীপ। রাখীর সঙ্গে কোনদিন আমার দৈহিক সম্পর্ক হয় নি।"
একেবারে তাজ্জব হয়ে গেলাম সোমনাদার কথা শুনে। বুড়ো লোকটা পয়সা খরচা করে সোনাগাছিতে যায় এমনি এমনি? শুধুই কি গল্প করার জন্য? এতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। রাখী একজন প্রস্টিটিউট। তার ওপর সোমনাথদা তার বাঁধা খদ্দের। এমন খদ্দেরের মুখে এসব কি কথা?
আমার দিকে তাকিয়ে সোমনাথদা বলল, "আমি জানি তোমার আমার কথা বিশ্বাস হবে না। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তাই ই সুদীপ। আমি রাখীর একজন ভাল বন্ধু। এর বেশী কিছু নয়। ওকে জড়িয়ে ধরে মাঝে ওর গায়ে একটু চিমটি কেটে দিই, আদর করি, মস্করা করি। কিন্তু ইন্টারকোর্স রাখীর সাথে আমার কোনদিন হয় নি।"
আমি একটু আগ্রহের সাথেই বললাম, "কিন্তু কেন সোমনাথদা? তোমার আনন্দটাই তো তাহলে মাটি। শুধু গল্প করার জন্য তুমি একটা বেশ্যার কাছে যাও? এটা তো অদ্ভূত ব্যাপার। কাল রাতে তুমি তাহলে....."
সোমনাথদা বলল, "হ্যাঁ কিছুই করিনি আমি। আর করব না কোনদিন।"
আমি বললাম, "কিন্তু কেন?"
সোমনাথদা বললো, "ও আমাকে অন্যরকম চোখে দেখে সুদীপ। আমাকে শ্রদ্ধা করে। অনেক দূঃখ করে বলেছে ওর জীবনের কথা। রাখী এই জীবিকা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। গণিকার জীবন ওরও ভাল লাগে না। কোন এক পুরুষকে ভালবেসে আজ ও এই জায়গায়, রাখী পড়াশুনা করেছে। ইচ্ছে করলে ও ভাল চাকরীও করতে পারত। নিয়তি ওকে টেনে আনল সোনাগাছির বেশ্যাপট্টীতে।"
আমি বললাম, "কিন্তু সোমনাথদা, তুমিও বলেছ, বেশ্যাদের ভাবভালবাসা কখনও হয় না। তাহলে রাখীর বেলায় কেন এটা?"
সোমনাথদা বললো, "রাখী যখন ভালবাসত কাউকে, তখনও ও বেশ্যা হয় নি। নিষ্পাপ মেয়েটির মধ্যে অগাধ ভালবাসা ছিল ঐ ছেলেটির জন্য। কিন্তু ছেলেটিই ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।"
আমি অবাক হয়ে শুনছি সোমনাথদার কথা। বললাম, "তারপর?"
সোমনাথদা বলল, "তারপরটা খুব মর্মান্তিক সুদীপ। রাখী সেই ঘটনা যেদিন আমায় বলেছিল, ওর দুচোখে দেখেছিলাম জল। কান্না চেপে রাখতে পারেনি। কি সাংঘাতিক বর্বরতার কাজ করেছিল ঐ ছেলেটা।"
আমি জানতে চাইলাম, "কি করেছিল?"
সোমনাথদা খুলে বললো, "ছেলেটা রাখীকে একদিন বাড়ীতে ডেকে নিয়ে আসে। ওর দুজন বন্ধুও ছিল সেই সময়। ফাঁকা বাড়ীতে রাখীর সাথে প্রথমে খুব জমিয়ে গল্প করে ওরা। রাখীও বুঝতে পারেনি মতলবটা। রাখীর শরবতের সাথে ওরা কিছু মিশিয়ে দেয়। নিস্তেজ রাখীর শরীরটাকে বিছানাতে শুইয়ে একপ্রকার ছেলেটির উপস্থিতিতেই ওরা রাখীকে ''. করে। ছেলেটিরও এতে মদত ছিল। মন প্রাণ দিয়ে যাকে ভালবাসত, এমন বিশ্বাসঘাতকতায় রাখী ভীষন ভেঙে পড়ে। ভাবতেও পারেনি যাকে ভালবাসতো, সেই এরকম কাজ করে বসবে।
আমি বললাম, "ছেলেগুলোর কোনো সাজা হয় নি তারপরে?"
সোমনাথদা মাথা ঝাঁকালো, হ্যাঁ, জেল খাটছে এখন। সেই সাথে রাখীর প্রেমিকও। রাখীর বাড়ীতে রাখীর মা সব শুনে খুব ভেঙে পড়েন। পাড়াপড়শী জানতে পারে। তারপর থেকে রাখী কাউকে মুখ দেখাতে পারত না। একদিন মাকে ছেড়ে ও চলে আসে। দুসম্পর্কের এক বদমায়েশ মামা ছিল ওর। কোনরকম সহানূভূতি দেখানো তো দূরের কথা। অসহায় রাখীকে মামা বলে, তোর তো জীবনে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। ভালবেসে নিজের দেহটাকেই খুইয়ে বসেছিস তুই। এখন থেকে শরীর বেচে রোজগারের ধান্দা কর। আমি তোকে ভাল একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। মামার হাত ধরেই রাখী তারপর থেকে সোনাগাছিতে। এখনও আমাকে বলে, সত্যি সেদিন নিজের জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল সোমনাথদা। আমার ইচ্ছা না থাকলে মামা আমাকে জোড় করে এখানে নিয়ে আসতে পারত না। কিন্তু আজ বুঝি, জীবনটাকে যদি নতুন করে আবার ফিরে পেতাম। এই বেশ্যার জীবন আমার আর ভাল লাগে না। পয়সা নিয়ে লোককে শরীর বেচা। আমার শরীরতো এমনিই এঁটো হয়ে গেছে সোমনাথদা।"
কিছুক্ষণের জন্য সোমনাথদার কথা শুনে পুরো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সোমনাথদা বলল, "আমিও তাই মেয়েটার কাছে যাই, কিন্তু গল্প ছাড়া কিছুই করি না। ও বাড়ীতে মাকে মাসে মাসে যে টাকাটা পাঠায়, ওটা আমিই দিই। মেয়েটার জন্য আমার সত্যি দয়া হয়।"
আমি চোখ কপালে তুললাম, "কি বলছ তুমি সোমনাথদা!"
সোমনাথদা স্মিত হাসলো, "সত্যিই বলছি।"
জীবনে এমন নিস্বার্থ, দয়ালু প্রকৃতির লোক দেখিনি। লোকটার প্রতি আমার ভালবাসা আর শ্রদ্ধাটা যেন নতুন করে তৈরী হল। কাল শুধু শুধু আমি সোমনাথদাকে ভুল বুঝেছিলাম, তার জন্য খুবই আফসোস হচ্ছে এখন।
সোমনাথদা বলল, "আমি রাখীকে একবার বলে দেখব নাকি? কামিনীর ব্যাপারটা। ও যদি শুনে সত্যি মিথ্যে ব্যাপারটা যাচাই করে দেয়।"
আমি সোমনাথদাকে বাধা দিলাম। বললাম, "না না রাখীকে বলতে যেও না। আমি নিজেই এ ব্যাপারটা সামাল দিয়ে দেব।"
স্টারলেট গার্ডেন থেকে আমরা দুজনে যখন মাল খেয়ে বেরোলাম, তখন অনেক রাত্রি। সোমনাথদা একটা ট্যাক্সি ধরল। বলল, "তোমাকে বাড়ীতে ড্রপ করে দিই?"
আমি বললাম, "না তার দরকার নেই। শুধু শুধু তোমাকে অনেকটা পথ ঘুরতে হবে। আমি একটা অন্য ট্যাক্সি ধরে নিচ্ছি।"
সোমনাথদা আমাকে গুডনাইট করে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, "ভয় নেই। একটা দিক দিয়ে তুমি রেহাই পেলে। কামিনী তোমাকে যখন আর ফোন করেনি, তখন আর করবেও না। তুমি নিশ্চিন্তে এখন বাড়ী যাও।"
আমি বললাম, "হ্যাঁ মনে তো হচ্ছে তাই।"
একটা ট্যাক্সি আমিও ধরলাম। ড্রাইভারকে বললাম, বাড়ী যাব। মল্লিকবাজার হয়ে মৌলালি ধরতে। ও সেভাবেই রওনা দিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সুখটান দিলাম। হাতে নিয়ে মোবাইলটা নড়াচড়া করছি আর ভাবছি টেনশন যেটা ছিল, সেটা অনেকটাই কেটে গেছে এখন। কামিনী নিজেই ওর ভূতটা আমার ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে।
গাড়ী মল্লিকবাজার ক্রশ করে মৌলালির দিকে যাচ্ছে, আমার একটু চোখে ঘুম ঘুম এসেছে। গাড়ীর জানলা দিয়ে বাইরের হাওয়া এসে লাগছে মুখে। চোখটা বুজে সীটে গা টা এলিয়ে দিয়েছিলাম। এমন সময়ই ফোনটা হঠাৎই বাজতে লাগল। চোখ খুলে ধড়মড় করে সীটের ওপর বসে পড়েছি। কে ফোন করল?
কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই, উল্টো দিক দিয়ে কন্ঠস্বর ভেসে এল, "আমি কামিনী বলছি। কি ব্যাপার? ফোনটা অফ করে রেখেছিলে? আমি তো সেই সন্ধে থেকে তোমাকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বলেছিলাম না তোমাকে সন্ধে হলেই তোমাকে চলে আসতে। কোথায় এখন তুমি? আমি বসে আছি তোমার জন্য। শীগগীর চলে এসো এক্ষুনি।"
কামিনীর ফোন পেয়ে আমার ভেতরটা ছ্যাঁক করে উঠল। শেষ পর্যন্ত যে ওর ফোনটা আসবে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এ কি খেলা শুরু হয়েছে আমার জীবন নিয়ে? মেয়েছেলেকে টাকা দিয়ে ফুর্তী করেছি, তারপরেও আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে, এখনও পিছু ছাড়ছে না, কোন মানে হয়?
কামিনী যেন নাছোড়বান্দা, আমাকে বলল, "তুমি আসবে কিনা বলো? নইলে....."
আমি এবার একটু রেগে গেলাম, বললাম, "নইলে মানে? কি করবে তুমি?"
কামিনী বলল, "আমি অনেক কিছুই করতে পারি।"
ওকে ফোনে বললাম, "আমার যাওয়া না যাওয়াটা সম্পূর্ণ আমার নিজের ইচ্ছের ওপর। তাছাড়া....."
কামিনী বলল, "তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলে। সন্ধে হলেই চলে আসবে।"
ফোনটা ধরে ট্যাক্সির মধ্যেই একটু উত্তেজিত হয়ে গেলাম, বললাম, "কথা দিলেই তো সব সময় কথা রাখা যায় না। তাছাড়া বাড়ীতে আমার মা রয়েছেন, তাকে ফেলে রোজ রোজ বাইরে কাটানো আমার সম্ভব নয়। তোমার জন্য আমি মাকে অসুবিধেয় ফেলতে পারব না।"
কামিনী এবার একটু ব্যাঙ্গ করল আমাকে, বলল, "মায়ের প্রতি অতই দরদ যখন মায়ের আঁচলের তলাতেই পড়ে থাকতে পারতে, ফুর্তী লোটাতে সোনাগাছি এলে কেন?"
ওর কথা শুনে রাগে মাথা গরম হয়ে গেল আমার, মাথায় রক্ত চড়ে গেছে, কামিনীকে বললাম, "মুখ সামলে কথা বলো কামিনী, তোমার সাথে ফুর্তী করেছি বিনা পয়সায় নয়। পাঁচ হাজার টাকা গুনে গুনে দিয়েছি তোমায়, শরীরে বেচে ধান্দা করো, তোমাদের মুখে আবার এসব কথা কেন?"
ট্যাক্সিওয়ালাও বুঝলো, কোন একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে, আমি এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছি, আমার রীতিমতন লড়াই হচ্ছে তার সাথে, শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে আমি না গালাগাল দিয়ে বসি।
কামিনী বলল, "ফোনটা অফ করে রেখে দিয়েছিলে কেন? আমার ভয়ে?"
আমি বললাম, "তা কেন? আমার শরীরটা আসলে ভাল ছিল না, সন্ধেবেলা শুয়েছিলাম।"
কামিনী বললো, "তাহলে এখন কোথায় তুমি?"
আমি বললাম, "একটা কাজে বেরিয়েছিলাম, কাজটা সেরে এখন বাড়ী ফিরছি।"
কামিনী বলল, "এসো না রাজা। দেখো তোমার জন্য তোমার রানী কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।"
একটু আগে ওর কথার মধ্যে যে ঝাঁঝালো ভাবটা ছিল এখন সেটা পাল্টে গেল নিমেষেই। ফোনে রীতিমতন কাকুতি মিনতি করে আমার মনটাকে আবার দূর্বল করে দেবার চেষ্টা করতে লাগল কামিনী।
আমাকে বলতে লাগল, "তোমাকে না দেখতে পেলে আমার সারারাত ঘুমই হবে না ডারলিং। এই কামিনী এখন তোমার দিওয়ানী হয়ে গেছে। তোমার জন্য বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে দিলাম, আর তুমি কিনা আমার মনটাই বুঝতে পারলে না?"
আমি চুপ করে শুনছি ওর কথা, সোমনাথদার কথাটা মনে পড়ল, ওকে বললাম, "সবই বুঝতে পারছি কামিনী, তোমার আমাকে ভাল লেগেছে, আমারও তোমাকে। কিন্তু তুমি যে পেশাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছ, সেটা থেকে বেরোনো কি সম্ভব? তোমার জগৎটা একরকম, আর আমারটা আর এক রকম। সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশের মানু্ষ আমরা দুজন, তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে হলে, আমাকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে অনেকের কাছে, তাছাড়া তুমিই বা ওখান থেকে আসবে কি করে? রোজ রোজ ভালবাসার খেলা খেলতে আমি তোমার ওখানে যাব? এও কি সম্ভব?"
কামিনী বলল, "রোজ তোমাকে আসতে হবে না রাজা, অন্তত আজকের রাতটার জন্য তো আসো? তোমাকে দেখতে না পেলে মরে যাব আমি। সারারাত ছটফট করে মরব, তারপরে হয়তো মনের দূঃখে কিছু একটা করে বসবো, জেনে রেখো, তুমি যখন নেই এই কামিনীও তোমার নেই। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না রাজা, তুমি আমার জান, আমার সব কিছু।"
রাত বিরেতে এ কি ঝেমেলা। মেয়েটা যে দেখছি সত্যি সত্যি দিল দিয়ে বসে আছে আমাকে। জীবনে চরম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কি করব, তাই ভাবছি। আমার মনে হল, এত জোড় দিয়ে যখন বলছে, তারমানে কামিনীর ভালবাসার মধ্যে কোন খাদ নেই।
ফোনটা তখনও ছাড়ে নি ও, আমাকে শেষ বারের মতন বলল, "তুমি আসছো তো তাহলে? আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।"
কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে সত্যি কষ্ট হচ্ছিল আমার, মনের মধ্যে যে আশঙ্কাটা রয়ে গিয়েছিল, সেটাই কামিনী বাস্তব করে দেখালো। সোমনাথদার কথাও সত্যি হল না, আমার জীবনে সবকিছুই যেন কেমন ওলোটপালোট হয়ে গেল।
বাড়ীতে মা আমাকে দেখতে না পেলে আবার চিন্তা করবে, কামিনীকে বললাম, "ঠিক আছে আমি মায়ের সাথে একটু দেখা করে তারপর তোমার কাছে আসছি।"
ট্যাক্সি ততক্ষণে বাড়ীর কাছে এসে গেছে, আমি ট্যাক্সিটাকে ছাড়লাম না। ড্রাইভারটা আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে, ওকে বললাম, "একটু দাঁড়ান আমি ভেতর থেকে এক্ষুনি আসছি।"
মায়ের সাথে দেখা করলাম, মা'কে বললাম, "মা একটু কাজে বেরোচ্ছি, অফিসের কাজে একটু শিলিগুড়ি যেতে হবে আমাকে।"
মা বলল, "সেকীরে এত রাত্রে? হঠাৎ?"
আমি বললাম, "কাজ পড়েছে মা। অফিস থেকে ফোন এসেছিল, এক্ষুনি বাস বা ট্রেন যা হোক ধরে যেতে হবে, কাল সকালে গিয়ে পৌঁছোবো, সারাদিন কাল শিলিগুড়িতে কাজ করে তারপর আবার ব্যাক করব।"
এক বেশ্যার ভালবাসার মোহে আবদ্ধ হয়ে আমাকে মায়ের কাছে মিথ্যে কথাটা বলতে হল, কাজের নাম করে আমি আবার সেই সোনাগাছিতেই যাচ্ছি, মা'কে বুঝতেও দিলাম না।
একটা ছোট্ট সুটকেশের মধ্যে কিছু জামাকাপড় নিয়ে নিলাম। মা বুঝল, সত্যিই তার মানে আমি অফিসের কাজেই যাচ্ছি, এই সুদীপ বসুর গন্তব্যস্থল যে শিলিগুড়ি নয়, সোনাগাছি, সেটা মা ঘূণাক্ষরেও টের পেল না।
ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ীতে উঠে বললাম, "চলুন আমি এখন সোনাগাছি যাব।"
রীতিমতন হকচকিয়ে যাবার মতন অবস্থা, তবুও ড্রাইভারটা আমাকে না করল না, গাড়ী ঘুরিয়ে সোনাগাছির দিকে রওনা দিয়েছি, মনে হল, ফয়সলাটা আজ আমাকে ওখানে গিয়ে করতেই হবে, রোজ রোজ কামিনী যদি ফোন করে বিব্রত করে আমায়, আমার কাজকর্ম সব ব্যহত হবে। স্বাভাবিক জীবনে কালো অন্ধকার নেমে আসবে আমার। আমি কামিনীকে বোঝাবো, "রোজ রোজ এখানে আসা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তার চেয়ে তুমিই সব পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে চলো আমার সাথে, আমি রাজরানী করে রাখব তোমাকে। ভালবাসার জন্য এই নোংরা জায়গাটাকে কাল থেকে ছাড়তেই হবে তোমাকে। তুমি যদি না চলো, তাহলে জেনে রেখো এই সুদীপ বসুও কোনদিন আসবে না তোমার ডাকে। হাজার বার চেষ্টা করেও এই বান্দাকে তখন টলাতে পারবে না তুমি। আজ এলাম, এটাই আমার শেষ আসা তোমার কাছে!"
সোমনাথদা আমাকে বলেছিল, ওখানে গিয়ে দাদাগিরিটা দেখাতে যেও না, সেটাও আমার মাথায় ছিল, ঠিক করলাম, কামিনীকে ভালভাবে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা। ও যেন আমার ইচ্ছেটাকে মেনে নিতে রাজী হয়, ভালবাসার অগ্নিপরীক্ষা এবার কামিনীকেই দিতে হবে, আমার জন্য। নিজের খোলস ছেড়ে কামিনী কিভাবে গন্ডী ছেড়ে বাইরে বেরোয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ট্যাক্সি গিয়ে পৌঁছোলো সোনাগাছিতে। আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কামিনীর ঘরের দিকে এগোতে লাগলাম। আশে পাশে বীরজু, চিন্না, মোটাসোটা দালালগুলোর কাউকেই তেমন নজর পড়ল না। বুঝলাম অন্য খদ্দেরকে নিয়ে ধান্দা করছে মনে হয়, নয়তো মদ ভাঙ খেয়ে পড়ে আছে অন্য কোথাও, আমার ওদিকে নজর করে লাভ নেই।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সেই বেশ্যাটাকে আবার নজর পড়ল, যে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়েছিল ঘরের মধ্যে। সামনা সামনি পড়ে চোখাচুখি হতেই ও বলল, "আরিব্বাস ফির আ গ্যয়া? কউন জাদু কিয়া রে তেরে পর? যারা হাম কো ভী বাতানা?" বলেই আমার পথ আগলে দাঁড়ালো।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "আমাকে যেতে দাও, আমি কামিনীর ঘরে যাব।"
মেয়েটা আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে ফেললো। বলল, "কামিনী? কামিনী জাদু কিয়া তেরে পর? উসকো সাম্ভাল নেহী পায়েগা তু। জরিলা সাপ হ্যায় ও। নাগিন হ্যায় নাগিন। খা যায়েগি তেরে কো।"
একটা বেশ্যা হয়ে আর একটা বেশ্যার সন্মন্ধে খারাপ খারাপ কথা বলছে, এরা মনে হয় খদ্দের নিয়ে নিজেদের মধ্যে রেশারেশি করে, কামিনীর শরীরের মধ্যে যে চোখ ধাঁধানো ব্যাপারটা আছে, সেটা বাকীদের নেই বলেই কি এত রাগ? সব ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে?
মেয়েটা আমাকে রাস্তাই ছাড়ত না, যদি না আর একজন খদ্দের চলে না আসত তক্ষুনি। আমাকে ছেড়ে দিয়ে ঐ রেন্ডীটা আর একজনকে নিয়ে পড়ল। আমি রেহাই পেয়ে তাড়াতাড়ি কামিনীর ঘরের সামনে চলে এলাম।
ঘরটা চিনে নিতে আমার অসুবিধে হয় নি। কাল রাতে এই ঘরেই আমার কামলালসা চরিতার্থ করেছি, আজ সুদীপ বসু কোন কামলালসা পূরণ করার জন্য এখানে আসেনি, এসেছে কামিনীকে বোঝাতে, তার জীবনটাকে নিয়ে খেলা করার অধিকার একটা বেশ্যার নেই। সে যদি তাকে সত্যিই ভালবাসে, তাহলে সব ছেড়েছুড়ে চলুক এখান থেকে। আজই একশ শতাংশ কথা দিতে হবে কামিনীকে, নইলে তাকে ভুলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা নেই।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!
