Thread Rating:
  • 32 Vote(s) - 3.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মহানগরের আলেয়া
গোধূলি লগ্ন (#০৩)

ইন্দ্রাণীর বাড়ি থেকে বের হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা বাজে। কথায় গল্পে এতটা সময় কেটে গেছে সেটা আর ওর খেয়াল নেই। মোবাইল খুলে মহুয়াকে একটা ফোন করতে বৃথা চেষ্টা করে। জানিয়ে দেওয়া ভালো যে আগামী কাল ইন্দ্রাণীর সাথে ওর বাড়িতে আসবে। যথারীতি ফোন বেজে বেজে থেমে যায়। কি করে বুঝাবে দানা, এইবারে ওর মনে আর কোন দ্বিরুক্তি নেই, "জিত" এইবারে নিজের "পাপড়ি"র গভীর আলিঙ্গনে ধরা দিতে চায়।

রাত আর কাটতে চায় না, বিনিদ্র রজনী প্রবল উত্তেজনায় কেটে যায়। কাকভোরে উঠে স্নান সেরে মনা আর পিন্টুকে ছুটির কথা জানিয়ে দেয়। এগারোটা কেন লাগাতে যাবে দানা, ঠিক দশটা নাগাদ ইন্দ্রাণীর বাড়িতে হাজির। গিয়ে দেখে ইন্দ্রাণীর দরজায় তালা মারা। সেই দেখে দানা একটু চিন্তিত হয়ে যায়। শক্তিকে ফোন করতে, শক্তি জানায় যে ইন্দ্রাণী ম্যাডাম, এই সকালে কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছে। যদিও বিশেষ কোন দোকান তখন পর্যন্ত ঠিক ভাবে খোলেনি তাও মধ্য মহানগরের বেশ কয়েকটা বড় বড় দোকান ইতিমধ্যে খুলে গেছে। দানা একটা ট্যাক্সি নিয়ে মধ্যমহানগরে চলে আসে। ফাঁকা রাস্তাঘাট, অফিসের ভিড় ছাড়া এমনি লোকের ভিড় এখন পর্যন্ত জমে ওঠেনি মধ্য মহানগরে। শক্তির অভিমুখ নির্দেশ অনুযায়ী ইন্দ্রাণীকে খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হলনা দানাকে। এই সময়ে দানাকে ওইখানে দেখে ইন্দ্রাণী আশ্চর্য চকিত হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে কি ভাবে ওকে খুঁজে পেয়েছে।

শক্তি আর বলাইয়ের কথা বলতেই ইন্দ্রাণী হেসে ফেলে, "এখন নজর রেখে চলেছো?"

দানা মাথা চুলকিয়ে বলে, "কি করি বল। চোখে চোখে না রাখলে যে বিপদে পরে যাবো।"

ইন্দ্রাণী হেসে ওকে বলে, "এই দেখো আর দরকার নেই ওদের। এইবারে ওদের ছুটি দিয়ে দাও।"

দানা ওকে বলে, "তুমি শহর না ছাড়া পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই তাই এই বিষয়ে কিছু আমি শুনতে চাই না। আর হ্যাঁ, তুমি কোথায় যাচ্ছ সেটা যেন ঘুণাক্ষরেও তোমার কোন বন্ধু বান্ধবীকে জানিও না।"

চোখে দুষ্টুমির হাসি নিয়ে ইন্দ্রাণী জিব কেটে আঁতকে ওঠে, "ইসস আমি যে রমলাকে বলে দিয়েছি, কি হবে?"

দানার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, কিছুক্ষণ ভেবে বলে, "ঠিক আছে, ওকে আমি দেখে নেব। তবে আমগুরিতে কখন তোমার আশেপাশে কোন সন্দেহ জনক ব্যাক্তি অথবা কোন ঘটনা ঘটলে আমাকে জানাবে। সব থেকে আগে আমি রমলার মাথা ওর ধড় থেকে নামিয়ে দেব। তারপরে ওর কাটা মাথাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।"

দানার এই রুদ্র মূর্তি ইন্দ্রাণী কোনোদিন দেখেনি তাই একটু ভয় পেয়ে যায় সেই সাথে নিরাপত্তার এক ছোঁয়া মনের ভেতরে শীতল মলয়ের পরশ বুলিয়ে চলে যায়। ওর বাজু জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে বলে, "এই না গো। বন্ধুদের ওপরে আর বিশ্বাস নেই। বিশেষ করে রমলার কাছে যেদিন শুনলাম যে একজনের খবর অন্যজনের কাছে বেচে টাকা আদায় করেছে, সেদিন থেকে ওর ওপরে বিশ্বাস উঠে গেছে। বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানেনা আমি কোথায় যাচ্ছি।"

দানা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ইন্দ্রাণী, মহুয়ার জন্য একটা দামী শাড়ি কেনে, রুহির জন্য দামী পোশাক, সাদা ফারের জ্যাকেট, বেশ বড়সড় একটা পুতুল, বেশ কিছু খেলনা। এইসব কেনা কাটা করতে করতে ওদের বেশ দেরি হয়ে যায়। তারপরে শক্তির গাড়ি করেই ওরা মহুয়ার বাড়ি এসে পৌঁছায়।

লিফট দিয়ে উপরে ওঠার সময়ে দানা প্রমাদ গোনে। জানে একবার সামনা সামনি পড়লেই বিশাল ঝগড়া লাগিয়ে দেবে, কিন্তু সাথে ইন্দ্রাণী আছে এই একটা বাঁচোয়া। ইন্দ্রাণী কে দেখে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে মহুয়া? কিছুতেই সেটা আর ভেবে পায় না দানা। রেগে হয়ত যাবে না, তবে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে।

দানা সরাসরি ওর ফ্লাটের দরজার সামনে দাঁড়ায় না। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রাণীকে ইশারা করে ফ্লাটের কলিং বেল বাজাতে। হাত ভর্তি জিনিস পত্র নিয়ে ইন্দ্রাণী একটু বিরক্তি প্রকাশ করে। দানা এসে ওর হাত থেকে জিনিস পত্র নিয়ে নেয় কিন্তু আবার সেই আড়ালে দাঁড়িয়ে যায়। বেশ কয়েকবার কলিং বেল পরে মহুয়া দরজা খুলে এক অচেনা মহিলাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পরে। এই চেহারা দানার মোবাইলে অনেক আগে একবার দেখেছে। এই চেহারা ভোলার নয়। ইন্দ্রাণী ওর দিকে হাসিহাসি চেহারা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে মহুয়া ওকে চিনতে পারে।

অবাক চোখে ইন্দ্রাণীকে সামনে দেখে মহুয়া জিজ্ঞেস করে, "আপনি এইখানে?"

ইন্দ্রাণী হেসে ওর হাত ধরে বলে, "তোমাকে দেখতে এলাম এই আর কি।"

মহুয়া মুচকি হেসে ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞেস করে, "শয়তানটা তাহলে নিশ্চয় আশেপাশেই লুকিয়ে আছে তাই না?"

দানা আড়াল থেকে হাত ভর্তি জিনিস পত্রের ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে একটা দেঁতো হাসি দেয় মহুয়াকে দেখে। সেই হাসি দেখে খুশির চেয়ে বেশি, মহুয়া ওর ওপরে অভিমান করে মুখ ফুলিয়ে নেয়।

ইন্দ্রাণী, মহুয়ার হাত ধরে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। মহুয়া বেশ আশ্চর্য হয়ে যায় ওদের দুইজন কে একসাথে দেখে। ওর চোখের মুক ভাষা অতি সহজে ইন্দ্রাণী ধরে ফেলে আর তাই হেসে বলে, "তোর গাধাটার সাথে তুই নাকি বেশ কয়েকদিন থেকে কথা বলছিস না? তাই ভাবলাম একেবারে কান ধরে নিয়ে আসি আর তোর কোলে ছেড়ে যাই।"

"তুমি" থেকে এক বাক্যে "তুই" সম্বোধনে, মহুয়ার শুন্য হৃদয় খুশির জোয়ারে ভরে ওঠে। ইন্দ্রাণীকে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায়, "এতদিন কোথায় ছিলে গো তুমি?" বলেই ইন্দ্রাণীর ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়।

ইন্দ্রাণী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলে, "এই পাগলী মেয়ে তুই কাঁদছিস কেন? তোকে ছেড়ে কেউ কোথাও যাচ্ছে না। এই দ্যাখ তোর জন্যে ওকে ধরে নিয়ে এসেছি আর তুই কাঁদছিস?" ওর মুখ আঁজলা করে ধরে চোখের জল মুছিয়ে বলে, "ওর ওই দানা নাম পালটে দে। দানা নামে একটা বুনো গন্ধ ছড়িয়ে, বুঝলি। তাই বারেবারে বুনো ষাঁড়ের মতন এদিক ওদিকে পালিয়ে যায়।"

চোখে জল, ঠোঁটে হাসি মনের মধ্যে অসীম খুশির জোয়ার। মহুয়া ইন্দ্রাণীকে হাসি কান্না মিশিয়ে বলে, "শেষদিনে দিয়েছিলাম একটা নাম, ভেবেছিলাম....."

ইন্দ্রাণী হেসে ফেলে, "আচ্ছা বাবা, তুই যা ভেবেছিস সেটা এখন তোর কাছেই রাখ, ঠিক আছে। এইবারে প্রান ভরে একটু তোকে ভালো ভাবে দেখি।" উৎসুক ইন্দ্রাণী চোখ টিপে ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি নাম দিয়েছিলিস ওই শয়তানটার?"

লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, "আমাকে একপ্রকার জিতে নিয়ে এসেছিল তাই, জিত।"

ইন্দ্রাণী ওর থুঁতনি নাড়িয়ে আদর করে বলে, "ইসসস মেয়ের লজ্জা দেখে মরে যাই।"

সেই কথা শুনে মহুয়া আরো লজ্জা পেয়ে যায়। ফর্সা চেহারা লাল হয়ে যায়, পারলে এখুনি কোথাও মুখ লুকিয়ে ফেলে। দানার দিকে আড় চোখে অগ্নি দৃষ্টি হেনে ইশারায় জানায়, হাতের কাছে পেলে মেরে ফেলবে।

ওর ভালোবাসার দুই নারীর এহেন মিলন দুই চোখ ভরে দেখে যায়। ওদের দেখে কেউ বলবে না যে দুই সম্পূর্ণ অচেনা নারী এই মাত্র ওদের পরিচয় হয়েছে।

ইন্দ্রাণী, মহুয়ার বিশাল পাঁচ খানা ঘরের ফ্লাট দেখে জিজ্ঞেস করে, "এত বড় বাড়িতে একা থাকতে তোর ভয় করে না রে?"

দানা ওকে খেপিয়ে ইন্দ্রাণীর প্রশ্নের উত্তরে বলে, "চিন্তা নেই পাখী, এক বছরের মধ্যে, ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট টিম তৈরি করে ফ্লাট ভরিয়ে দেব।"

লজ্জায় মহুয়ার চেহারা লাল হয়ে যায়। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে বলে, "সবসময়ে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা মুখে না আনলে হয় না, তাই না?"

কচি রুহি কোথা থেকে ছুট্টে এসে দানার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতদিন কাছে পায়নি আদো আদো কণ্ঠে সব নালিশ জানায়, "ডাডা, ডাডা, মাম্মা আমাতে কারতুন দেত্তে দেয়নি।" "আচ্ছা মাম্মাকে আমি বকে দেব।" "ডাডা, মাই চকোলেট।" দানা পকেট থেকে চকোলেট বের করে দেয়। গাল বাড়িয়ে বলে, "ডাডা, মাই কিসি....." দানা ওর টোপা গালে চুমু খায়। রুহিকে কোলে নিয়ে দানা মেতে ওঠে।

মহুয়া কিছুতেই ইন্দ্রাণীকে না খাইয়ে ছাড়বে না। দানাকে ছেড়েই দুইজনে রান্না ঘরে ঢুকে পড়ে। যদিও রান্নার আলাদা লোক আছে তাও নিজের হাতে রান্না শুরু করে। নিরামিষ সুস্বাদু আহার। সেই দেখে ইন্দ্রাণী ওকে বলে যে দানা আমিষ ভোজি প্রাণী। মহুয়া হেসে বলে, ওর আমিষের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে, মাছ মাংস নিজে কোনোদিন খায়নি তবে ওর জন্য এরপর থেকে রান্না করা, খাওয়া একটু একটু করে শিখে নেবে। খাওয়ার পরে ইন্দ্রাণী বিদায় নিতে চায়, মহুয়া কিছুতেই ছাড়তে চায় না, বারেবারে আরো একটু সময় থাকতে অনুরোধ করে।

সেই শুনে ইন্দ্রাণী ওকে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে ধরা গলায় বলে, "তোরা দুটোতে ঠিক থাকিস, আর ওই ছেলেটাকে হাত ছাড়া করসি না।" দানাকে বলে, "এরপরে যেন এদিকে ওদিকে আর দেখা না হয়। ভালোবাসা বারেবারে দরজার টোকা মারে না, দানা।"

সঙ্গে সঙ্গে মহুয়া ওর কানেকানে বলে, "দানা নয়, দানা নয়, জিত।"

ইন্দ্রাণী হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, "তোর জিত শুধু মাত্র তোর আর কারুর নয়। বাকি সকলের কাছে দানা, আমার কাছেও দানা।"
Like Reply


Messages In This Thread
RE: মহানগরের আলেয়া - by Mr Fantastic - 26-08-2020, 10:17 AM



Users browsing this thread: