25-08-2020, 09:34 PM
(This post was last modified: 08-07-2022, 04:30 PM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
গত তিন দিন ধরে একটি এক্সহিবিশানে অংশগ্রহন করেছে আমি যে সংস্থায় কাজ করি সেটি, নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। আর, পেশাগত প্রয়োজনে রোজ ই হাজির হয়েছি আমি সেখানে। তা, আজ সকালে আর যেতে ইচ্ছে করছিল না একটুও। একে রবিবার, তায় এমন সোনা ঝরানো দিন! কিন্তু, যেতেই হলো...ওই বলে না, পাপী পেট কি সওয়াল হ্যায়।
এই রাত্তিরবেলা যখন লিখছি, ভাবছি, ভাগ্যিস! ভাগ্যিস আজ গেছিলাম, নইলে যে আরো একটু আলো, একটু ভালো...দেখতে পেতাম না?
তাহলে, খুলেই বলি। গতকাল কাজের ফাঁকেই, দুপুরবেলা এক্সহিবিশান স্টল থেকে একটু বেরিয়েছিলাম বাইরে, আর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম বাবুঘাট। নেতাজী ইন্ডোর থেকে সামান্যই দূর। তা সেখানে গিয়েই দেখলাম ইতিউতি অনেক সরস্বতী ঠাকুর পড়ে আছেন। মানে ভাসান না দিয়ে যে সব মূর্তিকে গঙ্গার ধারে রেখে দেওয়া হয়েছে। পাশে ভাঙা ঘট, ফুলের মালা, চাঁদমালা আরও কত কী পড়ে আছে। নিতান্ত অবহেলায়। চুপচাপ। দেখে কাল খুব খারাপ লেগেছিল।ভাবছিলাম, ক্যালেন্ডারের হিসেবে ঠিক দুদিন আগে যে পুজো গেল...বাসন্তী শাড়ি, স্লেট, কুল আর দোয়াত কলম মুখর, প্রেমমুখর পুজো...সেই পুজো শেষে এমনি অবহেলা!? মন এত খারাপ হয়ে গেছিল যে ছবি তুলিনি।
কিন্তু আজ...
আজ, আমার সেই এক্সহিবিশানের শেষদিন ছিল। অনুষ্ঠানের পর হাওড়াগামী বাস ধরব বলে বাবুঘাট স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ দেখলাম একটি ছোট্ট বাচ্চা, বছর তিন বা চারেক হবে, মাটি মাটি লাগা পুরোনো সোয়েটার পরা...সাথে একটা লাল প্যান্ট, যার কোমরের ইলাস্টিক টা কেবল নেমে আসছে নীচের দিকে...মাথার চুল উলোঝুলো...দেখেই মনে হয় বাবুঘাট বা গঙ্গা সন্নিহিত জায়গার ফুটয়াথে থাকা পরিবারের একজন...পথশিশু। এগিয়ে আসছে ফুটপাথ ধরে।
আমার বাস আসছিল না। তাই তাকিয়ে ছিলাম বাচ্চাটির দিকেই। ভাবছিলাম কী করবে বাচ্চাটা? কোথায় যাচ্ছে? এমনিই দেখছিলাম, বাস টা আসছিল না তো, তাই।
কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ফুটপাথের ওপর রাখা একটি দেবীমূর্তির দিকে। তারপর সেই মূর্তিকে জড়িয়ে ধরল। যেভাবে পুতুলকে, টেডি বিয়ারকে জড়িয়ে ধয়ে ছোট্ট বাচ্চারা। তারপর মায়ের গালে চুমো দিল বাচ্চাটা। আর, তারপর ই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল ফুটপাথ ধরে আরেকটু দূরে।
আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
মনে হল, ও যেন আমাদের সব্বার হয়ে মা সরস্বতীর কাছে একটু উষ্ণতা পাঠিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো...দুদিন আগের মাতামাতি আর তারপর ই ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে মৃন্ময়ী মূর্তি পরিত্যাগ করার মধ্যে যে ক্রুরতা আর স্বার্থপরতা আছে, আমাদের সবার মধ্যে, তার বিরুদ্ধে...।
বাচ্চা টার মাথার সেই মাটি মাখা চুল ঘেঁটে দিয়ে ধন্যবাদ দেব...আমার মতো তথাকথিত সেইসব মানুষদের হয়ে যারা পুজোয় মজা করার পরেই দূষন - তা সে শব্দ বা দৃশ্য - যাই হোক না কেন, ঘটানোর জন্য...তার আগেই, আমার বাস এসে গেলো...আমি আমি আরো একবার নিজের স্বার্থপরতার প্রমান দিয়ে উঠে পড়লাম বাসে...। কিন্তু, মনে অদ্ভুত এক উষ্ণতা নিয়ে...।
রক্তমাংসের কলকাতার যীশুর দেখা পেয়েছি যে!
__________________________________________
কলকাতার যীশু
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী--
লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায়।
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।
স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি,
কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই;
দু’দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেয়ে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টাল্মাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।
এই রাত্তিরবেলা যখন লিখছি, ভাবছি, ভাগ্যিস! ভাগ্যিস আজ গেছিলাম, নইলে যে আরো একটু আলো, একটু ভালো...দেখতে পেতাম না?
তাহলে, খুলেই বলি। গতকাল কাজের ফাঁকেই, দুপুরবেলা এক্সহিবিশান স্টল থেকে একটু বেরিয়েছিলাম বাইরে, আর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম বাবুঘাট। নেতাজী ইন্ডোর থেকে সামান্যই দূর। তা সেখানে গিয়েই দেখলাম ইতিউতি অনেক সরস্বতী ঠাকুর পড়ে আছেন। মানে ভাসান না দিয়ে যে সব মূর্তিকে গঙ্গার ধারে রেখে দেওয়া হয়েছে। পাশে ভাঙা ঘট, ফুলের মালা, চাঁদমালা আরও কত কী পড়ে আছে। নিতান্ত অবহেলায়। চুপচাপ। দেখে কাল খুব খারাপ লেগেছিল।ভাবছিলাম, ক্যালেন্ডারের হিসেবে ঠিক দুদিন আগে যে পুজো গেল...বাসন্তী শাড়ি, স্লেট, কুল আর দোয়াত কলম মুখর, প্রেমমুখর পুজো...সেই পুজো শেষে এমনি অবহেলা!? মন এত খারাপ হয়ে গেছিল যে ছবি তুলিনি।
কিন্তু আজ...
আজ, আমার সেই এক্সহিবিশানের শেষদিন ছিল। অনুষ্ঠানের পর হাওড়াগামী বাস ধরব বলে বাবুঘাট স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ দেখলাম একটি ছোট্ট বাচ্চা, বছর তিন বা চারেক হবে, মাটি মাটি লাগা পুরোনো সোয়েটার পরা...সাথে একটা লাল প্যান্ট, যার কোমরের ইলাস্টিক টা কেবল নেমে আসছে নীচের দিকে...মাথার চুল উলোঝুলো...দেখেই মনে হয় বাবুঘাট বা গঙ্গা সন্নিহিত জায়গার ফুটয়াথে থাকা পরিবারের একজন...পথশিশু। এগিয়ে আসছে ফুটপাথ ধরে।
আমার বাস আসছিল না। তাই তাকিয়ে ছিলাম বাচ্চাটির দিকেই। ভাবছিলাম কী করবে বাচ্চাটা? কোথায় যাচ্ছে? এমনিই দেখছিলাম, বাস টা আসছিল না তো, তাই।
কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চাটা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ফুটপাথের ওপর রাখা একটি দেবীমূর্তির দিকে। তারপর সেই মূর্তিকে জড়িয়ে ধরল। যেভাবে পুতুলকে, টেডি বিয়ারকে জড়িয়ে ধয়ে ছোট্ট বাচ্চারা। তারপর মায়ের গালে চুমো দিল বাচ্চাটা। আর, তারপর ই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল ফুটপাথ ধরে আরেকটু দূরে।
আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
মনে হল, ও যেন আমাদের সব্বার হয়ে মা সরস্বতীর কাছে একটু উষ্ণতা পাঠিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো...দুদিন আগের মাতামাতি আর তারপর ই ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে মৃন্ময়ী মূর্তি পরিত্যাগ করার মধ্যে যে ক্রুরতা আর স্বার্থপরতা আছে, আমাদের সবার মধ্যে, তার বিরুদ্ধে...।
বাচ্চা টার মাথার সেই মাটি মাখা চুল ঘেঁটে দিয়ে ধন্যবাদ দেব...আমার মতো তথাকথিত সেইসব মানুষদের হয়ে যারা পুজোয় মজা করার পরেই দূষন - তা সে শব্দ বা দৃশ্য - যাই হোক না কেন, ঘটানোর জন্য...তার আগেই, আমার বাস এসে গেলো...আমি আমি আরো একবার নিজের স্বার্থপরতার প্রমান দিয়ে উঠে পড়লাম বাসে...। কিন্তু, মনে অদ্ভুত এক উষ্ণতা নিয়ে...।
রক্তমাংসের কলকাতার যীশুর দেখা পেয়েছি যে!
__________________________________________
কলকাতার যীশু
- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী--
লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।
খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায়।
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।
স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি,
কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই;
দু’দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেয়ে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টাল্মাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।