25-08-2020, 03:08 PM
বারো
গোধূলি লগ্ন (#০১)
ইন্দ্রাণীর সাথে না দেখা করলেই নয়, ওকে জানাতেই হবে এইসব ব্যাপারে। ইন্দ্রাণীকে সতর্ক করতে হবে, পারলে এই মহানগর থেকে দূরে কোথাও কয়েক মাসের জন্য সরিয়ে দিতে হবে। একবার নয়না সুস্থ হয়ে উঠলে, ওই ধূর্ত সুচতুর নারী থেমে থাকবে না। সুযোগ খুঁজবে ইন্দ্রাণীকে আঘাত করতে যাতে দানাকে কুপোকাত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু নয়না আঘাত হানার আগেই ওকে আঘাত করতে হবে। জানিয়ে দিতে হবে দানা কিছুতেই দমবে না।
নয়না সাথে ;.,ের ঘটনার চারদিন পরে একদিন বিকেলে দানা ঠিক করে নেয়, ইন্দ্রাণীকে ফোন করবে। মোবাইল খুলে ফোন করতে যাবার আগে একবার ইষ্ট নাম জপ করে নেয়। ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই প্রায় দশ মাস হয়ে গেছে। এতদিন পরে হঠাৎ কি ভাবে কথা শুরু করবে..... যদিও ওর এই বর্তমান ফোন নাম্বার ইন্দ্রাণীর কাছে নেই, হয়তো ফোন নাও উঠাতে পারে। যদি উঠায় তাহলে ওর কণ্ঠ স্বর শুনে ওর ফোন কেটে দেয় তাহলে কি করবে? এই সব ভাবতে ভাবতেই দানা ঘামিয়ে যায়। কিছুটা আশঙ্কায়, কিছুটা চাপা উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত দানা ইন্দ্রাণীকে ফোন লাগায়।
ওইপাশ থেকে ইন্দ্রাণীর নরম কণ্ঠস্বর শুনেই দানার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শত গুন বেড়ে যায়, "হ্যালো কে বলছেন?"
দানার গলা শুকিয়ে আসে, বার কতক ঢোঁক গিলে, মনে সাহস সঞ্চার করে, "আমি দানা।"
ইন্দ্রাণী চোখ বুজে নির্বাক হয়ে যায়, যেন ওর শরীর জোরে কেউ নাড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে। এইদিকে দানা নিরুত্তর হয়ে থাকে ইন্দ্রাণীর পরবর্তী উত্তরের জন্য। ইন্দ্রাণী হিমশীতল কণ্ঠে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে, ফোন কেন করেছো?"
দানা ঠিক কোথা থেকে কথাবার্তা শুরু করবে সেটা ভেবে পায় না, একটুখানি চুপ থাকার পরে বলে, "তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাই।"
উত্তর আসে সেই হিমশীতল কণ্ঠে, "কেন দেখা করতে চাও?"
দানা বুকের ধুকপুকানি ধীরে ধীরে বেড়েই চলে, গলা শুকিয়ে কাঠ। বার কয়েক ঢোঁক গিলে বলে, "কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল তোমার সাথে।"
গম্ভীর কণ্ঠে ইন্দ্রাণী প্রশ্ন করে, "কি ব্যাপার বলো।"
দানার গলা শুকিয়ে আসে, এতদিন পরে কথা বলছে ইন্দ্রাণীর সাথে। ওর কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় দানা যে ওকে ফোন করেছে সেটা ইন্দ্রাণীর একদম পছন্দ নয়, কিন্তু ইন্দ্রাণীকে সাবধান করতেই হবে না হলে কোন না কোন সময়ে নয়না ওকে আঘাত করতে পারে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দানা বলে, "দেখো আমি জানি তুমি আমার ওপরে রেগে আছো আর সেটাই স্বাভাবিক। তোমার জায়গায় আমি থাকলেও নিজের ওপরে রেগে যেতাম, বাড়ি থেকে বের করে দিতাম। কিন্তু দয়া করে একটি বার আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। অনেক কিছু বলার আছে।"
ইন্দ্রাণী চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দেয়, "দশ মাস পরে আমার কথা মনে পড়েছে? তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই বুঝেছো। তুমি আর আমাকে ফোন করবে না।"
ইন্দ্রাণীর ভেতরের ক্রোধ, বিদ্বেষ দানার অনুধাবন করতে অসুবিধে হয় না, তাও একবার শেষ চেষ্টা করে ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা করার জন্য, "প্লিস পাখী, একটি বার শুধু তোমার সাথে দেখা করতে চাই।"
"পাখী" ডাক মনে হয় ইন্দ্রাণীকে নাড়িয়ে দিল, কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে ওইপাশ থেকে ধরা কণ্ঠে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "আমাকে ওই নামে ডাকার অধিকার অনেকদিন আগেই হারিয়েছো দানা। একদম আমাকে ওই নামে ডাকবে না। তোমার যা কিছু বলার সেটা ফোনে বলে দাও।"
দানা কাতর প্রার্থনা করে, "আচ্ছা আমি ক্ষমা চাইতে আসিনি, শুধু তোমার সাথে একটি বার দেখা করতে চাই। আমি একটু সমস্যায় পড়েছি তাই তোমার সাথে দেখা করা খুব জরুরি।"
ইন্দ্রাণী উৎসুক হয়ে ওঠে, একসময়ে দানাকে ভালবাসতো ঠিক তাই বুকটা একটু কেঁপে ওঠে। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, "কাকে নিয়ে সমস্যা? কঙ্কনা কি আবার তোমার পেছনে লেগেছে নাকি?"
কঙ্কনার নাম শুনতেই দানার শরীরে লোম খাড়া হয়ে যায়। কঙ্কনা কি এখন ইন্দ্রাণী আর দানার ওপরে নজর রেখেছে? ইন্দ্রাণী কি এখন পর্যন্ত কঙ্কনার সাথে সম্পর্ক রেখেছে? প্রশ্নের ভিড় জমে ওঠে দানার মনে, এর উত্তর একমাত্র ইন্দ্রাণীর কাছেই পাওয়া যাবে। তবে এইবারে কঙ্কনা নয়, নয়না একটা বড় সমস্যা। কঙ্কনা আর নয়না দুইজনেই মারাত্মক ধূর্ত আর ভয়ঙ্কর নারী। দানা চাপা কণ্ঠে ইন্দ্রাণীকে জানায়, "না, ঠিক কঙ্কনা নয় অন্য কেউ।"
ম্লান হেসে দানাকে জিজ্ঞেস করে ইন্দ্রাণী, "আবার কি কোন মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছো?"
অবশেষে ইন্দ্রাণীর ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি ফুটেছে, দানা মন খুশিতে ভরে ওঠে। মাথা চুলকে মিচকি হেসে বলে, "অনেকটা তাই, তবে এইবারে সমস্যা একটু বেশি সংকটজনক।"
ইন্দ্রাণী মৃদু হেসে বলে, "বারেবারে নারী সংক্রান্ত সঙ্কটে পড়তে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না?" কিছুক্ষণ থেমে একটু ভেবে বলে, "ঠিক আছে, কাল বিকেল ছ'টার পরে আমি খালি আছি।"
আনন্দে দানা লাফিয়ে ওঠে। শ্বাসের গতি এতক্ষণ রুদ্ধ করেছিল, এই বারে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, "আচ্ছা ঠিক আছে, পাখী। অনেক অনেক ধন্যবাদ পাখী।"
এইবারে "পাখী" ডাক শুনে ইন্দ্রাণী আর কিছু বলে না, মৃদু হেসে ওকে বলে, "অত লাফাতে হবে না। ঠিক আছে, সময় মতো চলে এসো।"
পরেরদিন আর ওদের আলোচনা সভা বসে না। সবার সাথে ফোনেই সংবাদ যোগাড় সেরে ফেলে। মহুয়া এখন পর্যন্ত মুখ ফুলিয়ে বসে। না না, ঠিক মুখ ফুলিয়ে নয়, ভাঙ্গা বুক নিয়ে বসে। তবে রুহির আধো আধো কণ্ঠস্বর শুনাতে দিয়েছে দানাকে। দানার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট।
ইন্দ্রাণীর সাথে কথাবার্তা বলার পরে দানা বুঝে গেছে, যে ইন্দ্রাণীকে শেষ দেখেছিল আর যে ইন্দ্রাণীর সাথে দেখা করতে চলেছে, দুই নারী সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর। দেখা হওয়ার পরে কি হবে সঠিক জানা নেই। হয়তো সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে আবার সেই পুরানো দিন গুলো মনে পড়ে যাবে। রোজ রাতে ওর বিছানার পাশে বসে ওর আঁচড়ের দাগের ওপরে সোফ্রামাইসিন লাগানো, কোনো কোনদিন সকাল পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করা, ওদের প্রগাঢ় ভালোবাসার খেলা।
সারাদিন শুধু এই চিন্তাতেই কেটে যায়, ওর সামনে গেলে কি করবে। বারেবারে মনে মনে আওড়ায় কি ভাবে কথা থেকে কথা শুরু করবে। আয়নায় দেখে নিজের প্রতিফলন কে ইন্দ্রাণী ভেবে বলে, "না মানে আমি খুব দুঃখিত পাখী।" ইসসস না হল না, একটু নরম কণ্ঠে ক্ষমা চাইতে হবে, "তোমার রাগ করা স্বাভাবিক পাখী।" না না ঠিক হচ্ছে না..... "পাখী তুমি খুব বড় সঙ্কটে"। এই সেরেছে রে.... এইকথা শুরুতেই বললে ওকে এক লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। যাই হোক, মাথা চুলকে গুমটি থেকে বেড়িয়ে পরে ইন্দ্রাণীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। গুমটি থেকে বের হওয়ার আগে শক্তি আর বলাইকে ছুটি দিয়ে দেয়। ইন্দ্রাণীর বাড়ি যাওয়ার পথে গোলাপ, রজনীগন্ধা আর বেশ কিছু ফুল মিশিয়ে একটা বড় ফুলের স্তবক কেনে।
ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে দানা, বার কতক নিজেকে জরিপ করে নেয়। ঠিক ঠাক দেখতে লাগছে না সাধারন? রুদ্ধশ্বাসে দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক সেকেন্ড এক ঘন্টার মতন মনে হয় দানার। দরজা খুলতেই ইন্দ্রাণীকে দেখে দানার মাথা ঘুরে যায়। এতদিন পরে চোখের সামনে ইন্দ্রাণী, একটা গোলাপি শাড়িতে ভীষণ সুন্দরী দেখায়। চূড়ান্ত লাস্যময়ী ইন্দ্রাণী এই এক বছরে অনেক বদলে গেছে, বয়স অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হয়। তবে চেহারার সৌন্দর্যে বিশেষ টোল খায়নি। একটু মেদ জমেছে তবে অসম্ভব সুন্দরী দেখায় ওকে। চোখের সামনে পুরানো প্রেম দেখে, গলার কাছে আওয়াজ দলা পাকিয়ে চলে আসে। ইন্দ্রাণী ওর দিকে ভুরু কুঁচকে মৃদু হেসে তাকিয়ে থাকে। দানার সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে ধীর পায়ে ঢুকে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখে। বসার ঘর অনেক বদলে গেছে। টিভির পাশে একটা বিশাল আলমারি, বই আর বিভিন্ন রকমের ঘর সাজানোর জিনিসে ঠাসা। দেয়ালে বেশ কয়েকটা শুচিস্মিতা আর দেবাদিত্যের ছবি টাঙ্গানো। এই গুলো আগে ওই দেয়ালে ছিল না। ওদের পরিবারের একটা বেশ বড় ছবি সোফার পেছনের দিকে টাঙ্গানো। রঞ্জন, ইন্দ্রাণী, শুচিস্মিতা আর দেবাদিত্য কোন পাহাড়ি জায়গায় ঘুরতে গিয়ে বরফের মধ্যে গড়িয়ে সেই ছবি তোলা। ইন্দ্রাণীর পাশে রঞ্জনকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য দানার মন ভার হয়ে উঠলো।
ইন্দ্রাণী দানাকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কেমন আছো?"
দানা ঘাড় ঘুরিয়ে ইন্দ্রাণীর মৃদু হাসি হাসি মুখ দেখে উত্তর দেয়, "এই চলে যাচ্ছে।" বলে ওর হাতে ফুলের স্তবক ধরিয়ে দেয়।
ইন্দ্রাণী ওর হাত থেকে ফুলের স্তবক নেওয়ার সময়ে দানার আঙ্গুলের সাথে ওর আঙ্গুল ঠেকে যায়। ক্ষণিকের ওই পরশে দুইজনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পরে। পরস্পরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পরে দানাকে ইন্দ্রাণী সোফার ওপরে বসতে বলে। ইন্দ্রাণী বেশ একটু তফাতে অন্য ছোট সোফার ওপরে বসে ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
আপাদমস্তক দানাকে জরিপ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, "এতদিন পরে আমার কথা মনে পড়েছে?"
দানাও এতদিনে অনেক বদলে গেছে। পোশাকের ধরন দেখে ট্যাক্সি চালক, অথবা গাড়ির চালক বলে কেউ বলতে পারবে না।
দানা ম্লান হেসে আমতা আমতা বলে, "না মানে হ্যাঁ....."
ইন্দ্রাণী ওকে প্রশ্ন করে, "এতদিন কি করলে? আজকাল কি করছ তুমি?"
নিজের কথা কোথা থেকে শুরু করবে সেটা ভাবতে শুরু করে। দানা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে মৃদু হেসে ওকে বলে, "এই নয় দশ মাসে অনেক কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে, বলতে শুরু করলে সকাল হয়ে যাবে।"
ইন্দ্রাণী মৃদু হেসে জানায়, "সকাল পর্যন্ত আমার কাছে সময় আছে দানা।"
বুকের মধ্যে বল সঞ্চার করে দানা নিজের কাহিনী শুরু করে। ইন্দ্রাণীর কাছ থেকে ধাক্কা খাওয়ার পরে আর নিজের পাপবোধে দানা এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রেল স্টেশানে যায়। সেইখানে দানার সাথে বাপ্পা নস্করের ড্রাইভার, ফারহানের সাথে দেখা হয়। ফারহান ওকে নিয়ে মহেন্দ্রবাবুর কাছে যায়। মহেন্দ্রবাবুর কাছে দানা অনেকদিন কাজ করে। যদিও আইন বিরুদ্ধ কাজ, তাও দানার সেই কাজ ভালো লাগে। ছোট নৌকায় সমুদ্রে যাওয়া, সাগর জলে ঝাঁপ দিয়ে সোনার বাক্স তোলা, বড় বড় ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে মাছ ধরা ইত্যাদি। সেই সাথে পিস্তল রিভলভার চালানো শেখে। তারপরে ফারহানের সাথে বেশ কিছুদিন বাপ্পা নস্করের সঙ্গে সঙ্গে কাটায়।
ইন্দ্রাণী একমনে শ্বাস রুদ্ধ করে দানার রোমাঞ্চকর কাহিনী কোন প্রশ্ন না করে শুনে যায়। মাঝে মাঝেই এটা ওটা প্রশ্ন করে, "সমুদ্রে যেতে ভয় করেনি?" "কি কি মাছ ধরতে তুমি?" "শেষ পর্যন্ত বাপ্পা নস্করের সাথে?" ইত্যাদি।
সেই সব উত্তর দেওয়ার পরে দানা ইন্দ্রাণীকে জানায় যে ও অভিনেত্রী নয়না বোসের ড্রাইভারের কাজে যোগ দেয়। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত অভিনেত্রী নয়নার বোসের গাড়ির চালকের কাজ করত কিন্তু একটা সমস্যায় জড়িয়ে পরে সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। ইচ্ছে করেই মহুয়াকে বাঁচানোর কাহিনী, আর মহুয়ার প্রেমের কথা দানা এড়িয়ে যায়। মনের এক কোনায় একটি বারের জন্য ইন্দ্রাণীকে কাছে পাওয়ার প্রবল বাসনা মাথা চাড়া দেয়।