24-08-2020, 07:16 PM
যুদ্ধের দামামা (#০৩)
বের হওয়ার সময়ে ফারহানের সাথে দেখা হয়ে যায়। ফারহানকে একপাশে টেনে ওকে বাপ্পা নস্করের ওপরে কড়া নজর রাখতে বলে। ফারহান হেসে জানিয়ে দেয়, অনেক আগে থেকেই সেই কাজ করার কথা ভেবে রেখেছে। বাপ্পা নস্কর সংক্রান্ত সব জরুরি খবর দানার কাছে পৌঁছে যাবে। গাড়ির পেছনে বসা লোকেরা সাধারণত ড্রাইভারকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। ফোনে অথবা পাশের লোকের সাথে গাড়ির পেছনের সিটে বসে অনেক গোপন কথাবার্তা সারে এই সব লোকেরা। ফারহান আগে এই সব কথায় বিশেষ কান দিত না কোনোদিন কিন্তু দানার পরিকল্পনা অনুযায়ী এরপর থেকে কান পেতে রাখবে বলে কথা দেয় আর সুযোগ পেলে মোবাইলে সেই কথা টেপ করে নিতে চেষ্টা করবে।
বাপ্পা নস্করের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাবে ঠিক করতে পারে না। সেই পুরানো কালী পাড়ার বস্তির নিজের গুমটি, সেই পুরানো আশ্রয়। তবে পুরানো হলেও দানা এখন ওই এলাকার মুকুট হীন রাজা, এলাকার অনেক লোকেই দানাকে চেনে। যেতে আসতে দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসাবাদ করে, ছোটরা সম্মান করে। সেইসব দেখে দানার বেশ ভালো লাগে। বস্তিতে ঢুকেই বুড়ো দুলালের সাথে একবার দেখা করে যায়। বুড়ো দুলালের বাড়ি একদম পাকা করে দিয়েছে, ডাক্তার হাসপাতালে নিয়মিত দেখায়। শরীর স্বাস্থ্য ভালোই আছে। তারপরে বরুনের বাড়িতে ঢুঁ মারে, বরুনের গুমটির হাল ফিরিয়ে দিয়েছে, বাড়িতে এলেই সুনিতা বৌদি ওকে না খাইয়ে ছাড়ে না। দেবু আর বস্তিতে ফিরে আসেনি, তবে দানার হাত দিয়ে মাঝে মাঝে বাবা মায়ের জন্য টাকা পাঠায়। দানাও নিজে থেকে কিছু কিছু দিয়ে বুড়ো বুড়িকে সাহায্য করে।
নিজের গুমটি খুলে চুপচাপ বিছানার ওপরে বসে থাকে। পরবর্তী পদক্ষেপ কি নেবে সেটা কিছুতেই ভেবে পায় না। তবে কঙ্কনা আর নাসরিনের ঘরে ঢুকে সামনা সামনি খুন করবে দানা। এইসবের শুরু ওই কঙ্কনা আর নাসরিন, ওদের জন্যেই দানা আজকে এই গভীর খাদে গড়িয়ে পড়েছে। ওর জীবনে কঙ্কনা না আসলে ওর ভালোবাসা কোনোদিন ওকে ছেড়ে যেত না। চিত্ত বড়ই চঞ্চল হয়ে ওঠে, গুমটিতে একা বসে থাকতে একদম ভালো লাগে না। নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হয়। কঙ্কনা আর নাসরিনের বাড়ির ঠিকানা জানে না, ওদের ছবি পর্যন্ত নিজের মোবাইলে কোনোদিন তুলে রাখেনি। অবশ্য যাদের সাথে সহবাস করেছে তাদের কারুর ছবি দানা কোনোদিন তোলেনি কারন বেশ্যা বৃত্তি পেশায় সেটা একদম নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ। নয়নার বাড়ির ওপরে কড়া নজর রাখতে হবে, সুমিতা আর সমুদ্রের ওপরেও কড়া নজর রাখতে হবে। বিমান চন্দ, বাপ্পা নস্কর, নয়না বোস, রমলা বিশ্বাস, কঙ্কনা দেবনাথ, নাসরিন আখতার, সিমোন খৈতান, মোহন খৈতান সবাই এক একটা রিং কিন্তু এই রিং গুলো জুড়ে একটা শেকল আর কিছুতেই বানাতে পারছে না। মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে যেতে শুরু করে দেয়। কিন্তু সঙ্গীতার প্রেমিক, মৈনাককে কে খুন করতে পারে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে না। কঙ্কনা আর নাসরিন কেন দানাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সেটা বুঝে উঠতে এখন পারেনি। রমলার দুর্বল নাড়ি কোথায় সেটা জানতে হবে। দিনে দিনে প্রশ্নের পাহাড় ওর মাথার ওপরে চেপে বসেছে।
সন্ধ্যের পরে শঙ্কর রমিজ আরো অনেকে মদনার দোকানে পৌঁছে যায়। এক কোনায় জটলা পাকিয়ে বসে সারাদিনের খবরাখবর আর পরবর্তী পরিকল্পনা করতে শুরু করে। মনা আর পিন্টুর কাছে মহুয়ার কথা জানতে চায়।
পিন্টু মাথা চুলকিয়ে হেসে ফেলে, "মহুয়া ম্যাডাম সারাদিন বাড়িতেই ছিলেন। বিকেলে কাজের মেয়ের সাথে একবার বাজারে বেরিয়েছিলেন তারপরে রুহির সাথে সামনের পার্কে নিয়ে গেছিলেন। আমরাও পেছন পেছন আড়াল করে ম্যাডামকে অনুসরন করছিলাম কিন্তু ম্যাডামের নজর এড়াতে পারলাম না। ধরা পরে গেলাম ওনার কাছে।" দানা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, পিন্টু মিচকি হেসে, "ম্যাডাম তারপরে বাড়িতে ডেকে আমাদের চা, মিষ্টি খাইয়ে তবে ছাড়লেন।"
দানা মনে মনে হেসে ফেলে, বড় মিষ্টি নরম এই মেয়েটা।
বলাইয়ের কাছে ইন্দ্রাণীর ব্যাপারে জানতে চাইলে বলাই জানায়, "ম্যাডাম সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান। বিকেলে ফিরে আসেন। একটা কলেজে মনে হয় চাকরি করেন। বাড়িতে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, তবে কোন ছেলে মেয়েকে দেখলাম না। বিকেলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়িতে পড়াশুনা করতে আসে। এই ব্যাস আর সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল না আমার।"
নাসির আর আকরামকে, নয়না আর সমুদ্রের ওপরে নজর রাখতে নির্দেশ দেয়। তখন কার মতন আলোচনা সেরে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে বলে পরেরদিন যথারীতি এই এক জায়গায় ওদের আলোচনা সভা বসবে। নতুন কোন খবর পেলে ফোনেই যেন দানাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গীতাকে দেখাশুনা করার জন্য শঙ্কর আর রমিজকে অনুরোধ করে। শঙ্কর আর রমিজ জানিয়ে দেয় একবার যখন ওরা মহেন্দ্র বাবুর কাছে চলে গেছে তখন সাক্ষাৎ যমদূত না এলে ওদের গায়ে কেউ আঁচড় কাটতে পারবে না।
রাতের বেলা সুনিতা বৌদির হাতের রান্না খেয়ে, অনেকক্ষণ বরুনের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মেরে নিজের গুমটিতে ফিরে আসে। নরম বিছানা বড় কণ্টকময় বলে মনে হয়। সিগারেট জ্বালিয়ে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে শুরু করে দেয়। ইন্দ্রাণীর বাড়িতে ওই নতুন ভদ্রলোক কে? দানাকে ছাড়া পরে ইন্দ্রাণী কি অন্য কারুর প্রেমে পড়েছে? হয়তো বা হতেও পারে। তবে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন ইন্দ্রাণী ওকে জানিয়েছিল যে রাতের ওই বেশ্যা বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে সুস্থ কর্ম জীবন পালন করবে আর সেটাই বর্তমানে করছে। শুধু মাত্র দানাই ভেসে গেছে। ইন্দ্রাণীর সাথে একটি বার দেখা করার জন্য মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। ওর হৃদয় দ্বিবিভক্ত হয়ে যায়, ইন্দ্রাণীর প্রতি পুরানো প্রেম ফের একবার জেগে ওঠে, কিন্তু মহুয়াকে মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না। রুহি নিশ্চয় এতক্ষণ জেগে জেগে ওর অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর হয়ত রুহির সাথে দেখা হবে না ওর।
"টুং টাং টুং টাং" মোবাইল বেজে উঠল। এতরাতে শুধু মাত্র মহুয়া ছাড়া আর কেউ ওকে ফোন করতে পারে না। মোবাইল উঠিয়ে দেখে ওর ধারনা সঠিক।
মহুয়া ওইপাশ থেকে শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "সারা দিনে তোমার খাওয়া দাওয়া হয়েছে?"
ওই মিষ্টি শীতল কণ্ঠ স্বর শুনেই দানার পরান ডাক ছেড়ে ওঠে। সারাদিনের ক্লেদ ক্লান্তি এক নিমেষে উবে যায়। শরীরে এক নতুন শক্তি ভর করে আসে। কণ্ঠে উৎফুল্ল, বুকের মধ্যে রক্তের চাঞ্চল্য বেড়ে ওঠে। মাথা চুলকে মৃদু হেসে বলে, "হ্যাঁ মানে একটু খেয়েছি।"
মহুয়া শান্ত কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, "সারা দিন কি করলে?"
দানা উত্তরে সবিস্তারে সব কিছু জানায়।
সব কিছু শোনার পরে মহুয়া ওকে বলে, "আমার কথা দয়া করে একটু মন দিয়ে শোন।"
দানা চুপ করে থাকে। মহুয়া ওকে বলে, "তোমাকে মাথা গরম করলে একদম চলবে না। নয়না যদি বাপ্পা নস্করকে খুন করার পরিকল্পনা করতে পারে তার অর্থ নয়না অতি ধুরন্ধর মহিলা। এর থেকে তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। তবে নয়নাকে সম্মুখ সমরে তুমি কোনোদিন হারাতে পারবে না। তোমাকে একটা সুচতুর পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।"
অন্য পাশে দানা মাথা দোলায়। মহুয়া ওকে বলে, "তোমাকে আগে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে যাতে তুমি ওদের সমকক্ষ হতে পারো। তোমার কাছে লোকবলের খামতি নেই। ফারহান, মহেন্দ্রবাবু, শঙ্করদা, রমিজ ভাই, মনা পিন্টু মদনা সবাই তোমার সাথে। সেই সাথে তোমার দরকার টাকার। (বেশ কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় মহুয়া) তোমার টাকার দরকার, সেই টাকা আমি দেব।"
দানার চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও এই নারী ওকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। ওকে দূরে ঠেলে দেয়নি। দানার ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে। কিছু বলতে চায় কিন্তু মহুয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, "আগে আমার কথা মন দিয়ে শোনো। শক্তিশালী প্রতিপত্তিশালী ব্যাক্তি না হলে ওদের দুর্গে আঘাত হানা দুঃসাধ্য। কোন একটা বড় সড় কোন ব্যাবসা করো।"
এইবারে দানাকে ওর কাছ থেকে সাহায্য নিতেই হবে, না হলে ওই ক্ষমতাশালীদের দুর্গে আঘাত হানতে পারবে না। যাদের বিরুদ্ধে লড়াই তারা কেউ অনেক বড়লোক, কেউ বিত্তশালী শিল্পপতি, কেউ রাজনৈতিক দলের নেতা, কেউ সংবাদ মাধ্যমে রয়েছে, কেউ অভিনয় জগতের নামকরা ব্যাক্তি। দানা মাথা নাড়ায় আর চুপচাপ "হ্যাঁ হ্যাঁ..... বুঝেছি বুঝেছি....." বলতে বলতে ওর কথা শুনে যায়। দানার এই নীচ ব্যাবহারের পরেও এই নারী ওকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। এই মেয়েটা সত্যি ওকে ভালোবাসে না হলে এতরাতে ফোন করে কথা বলত না। দানার মন ছটফট করে ওঠে মহুয়াকে জড়িয়ে ধরার জন্য।
দানা ধরা গলায় মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে, "রুহি ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?"
অন্য পাশে মহুয়া চোখের কোল মুছে মৃদু হেসে বলে, "হ্যাঁ অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা শোনো, তুমি কি ইন্দ্রাণীদির সাথে দেখা করেছ?"
দানা মাথা নাড়ায়, "না এখন দেখা করিনি। কি ভাবে করব ভেবে পাচ্ছি না।"
মহুয়া ওকে বলে, "যত তাড়াতাড়ি পারো একবার দেখা করে এস। তবে....." একটু থেমে যায়, গলার স্বর খাদে নেমে যায়, "আমি তোমাকে ভীষণ..... সাবধানে থেকো, জিত।"
"জিত" এই নামে কেউ ওকে কোনোদিন ডাকেনি। সবাই ওকে দানা বলেই ডেকে গেছে। মায়ের পরে কেউ ভালোবেসে ওকে কোন নাম দেয়নি। এই প্রথম মহুয়ার মুখে নিজের নতুন নামকরনে দানা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওর সাথে আরো কথা বলার জন্য মন মাঝি চঞ্চল হয়ে ওঠে। লাফিয়ে উঠে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই মহুয়া ফোন কেটে দেয়। মহুয়ার মন একটা ফুলের চেয়েও নরম আর নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক ওর ভালোবাসা। অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল ওকে ভালোবেসে "পাপড়ি" বলে ডাকবে কিন্তু সেই সম্বোধন করার আগেই সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল।