24-08-2020, 10:31 AM
যুদ্ধের দামামা (#০২)
মনা আর পিন্টুকে নিয়ে দানা, মহুয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মহুয়ার বাড়ির দিকে যেতে যেতে বারেবারে রুহির হাসিহাসি মুখ খানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওর বাড়িতে গেলেই ছোট ছোট পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ওর কোলের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। পিতাকে মনে নেই রুহির, তবে বারেবারে এই দানার বুকের মাঝে পিতার শীতল স্নেহ পরশ খুঁজে বেড়ায়। দানা সেটা অনুধাবন করে তাই কচি শিশুটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে যতক্ষণ মহুয়ার সাথে থাকে।
সকাল ন’টা নাগাদ মহুয়ার বাড়িতে মনা আর পিন্টুকে নিয়ে পৌঁছে যায়।
এত সকালে দানাকে ঠিক এই ভাবে দেখতে পাবে সেটা মহুয়া আশা করেনি। ওকে দেখে ভারী খুশি, কিন্তু পেছনে মনা আর পিন্টুকে দেখে একটু চিন্তিত হয়ে যায়।
মহুয়া দানাকে প্রশ্ন করে, "তোমার কি হয়েছে? তোমাকে এমন ঝোড়ো কাকের মতন কেন দেখাচ্ছে?"
দানা উঁকি মেরে একবার শোয়ার ঘরের দিকে তাকায়। কচি শিশু রুহি, লেপের তলায় তখন গুটিসুটি মেরে অঘোরে ঘুমিয়ে। মহুয়া জানে, দানা রুহিকে খুব ভালোবাসে, তাই ওর পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলে, "মেয়েকে এত কি দেখছ? জাগিয়ে দেব নাকি?"
দানা মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে, "না না, শুয়ে থাক। পরে জাগিও।" মহুয়ার হাত ধরে শোয়ার ঘরে নিয়ে যায়। বিছানায় বসিয়ে ওকে বলে, "তোমার সাথে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার ছিল আমার।"
উৎসুক মহুয়া ওকে জিজ্ঞেস করে, "কি ব্যাপার কি হয়েছে? তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে তুমি যুদ্ধ করে এসেছ। কি হয়েছে সত্যি করে বল।"
মহুয়ার উদ্বেগ মাখা কণ্ঠ আর কোমল হাতের ছোঁয়ায় দানার অন্তর কেঁপে ওঠে। খুব ভালোবাসে মহুয়াকে তাই ওকে মিথ্যে বলা যাবে না। এতদিন মহুয়া জানে যে নয়নার সাথে শুধু মাত্র গাড়ির চালক আর মালিকের সম্পর্ক। মহুয়া ওদের ভেতরের গোপন শারীরিক মিলনের ব্যাপারে কিছুই জানে না। নয়নার সাথে যে বাপ্পা নস্করের গোপন সম্পর্ক আর সেই সাথে বিমান চন্দের সাথেও যে গোপন সম্পর্ক সেটা দানার মুখে অনেক দিন আগেই মহুয়া শুনেছে। এমনকি সঙ্গীতাকে কি ভাবে নয়নার কবল থেকে বাঁচিয়ে এনেছে সেটাও মহুয়া জানে। আর সব জানে বলেই ওর খুব গর্ব যে শেষ পর্যন্ত একজন প্রকৃত পুরুষকে ভালোবাসে। কিন্তু মহুয়া যদি জানতে পারে দানার আর নয়নার গোপন শারীরিক সম্পর্ক তাহলে কি মহুয়া সেটা মেনে নেবে? নয়নার সাথে দানার সাক্ষাৎ ওদের ভালোবাসার পরেই হয়েছে, তাও ওকে ছেড়ে কেন দানা ওই ছলনাময়ী নারীর কবলে পড়ল? নিরুত্তর দানা অনেকক্ষণ মহুয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বাক্য সংগঠিত করার আপ্রান চেষ্টা করে।
মহুয়া ওর চোখের ভাষা পড়ে ফেলে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি রাতের বেলা নয়নার সাথে কিছু করেছ?"
দানার ঠোঁট কেঁপে ওঠে, হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি স্থির হয়ে যায়। ওর সামনে মাথা নিচু করে বসে আলতো মাথা নাড়ায়, "হ্যাঁ।"
পাশেই রুহি শুয়ে তাই, চাপা কণ্ঠে দানাকে জিজ্ঞেস করে, "কি করেছ ওর সাথে? আর এমন ঝোড় কাকের মতন তোমাকে দেখাচ্ছে কেন?"
দানা ওর হাতখানি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, "দয়া করে আমাকে ভুল বুঝোনা মহুয়া।"
মহুয়ার বুকের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। উৎসুক ছলছল চোখে দানার দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়। দানা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে শুরু করে, রাতের ঘটনা। কি ভাবে নয়না, বাপ্পা নস্করকে খুন পরিকল্পনা করে। কি ভাবে বারে বারে ইন্দ্রাণীর নাম নিয়ে ওকে শাসানোর এক আভাস দেয়। কি ভাবে প্রচন্ড কামুকী নয়না ওকে ধর্ষকামে প্ররোচিত করে, আর শেষ পর্যন্ত দানা মদের নেশায় আর ভীষণ ক্রোধে নয়নাকে বেঁধে চরম ধর্ষকামে মেতে ওঠে। এই সব কথা বলার সময়ে ভীষণ অনুতাপে দানা একটি বারের জন্য মহুয়ার দিকে তাকাতে পারেনি।
দানার মুখ থেকে সব ঘটনা শুনতে শুনতে, আতঙ্কে মহুয়ার শরীর ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, শেষ পর্যন্ত দানা? যে ওকে ওই নরপিশাচ শ্বশুরের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই মানুষ কি ভাবে এক ভীষণ কাম পিশাচ দানবে পরিনত হতে পারে? তার মানে ভবিষ্যতে মহুয়াকে ওই ভাবে ;., করতে পিছ পা হবে না। কিন্তু দানার চোখে জল দেখে মহুয়ার আতঙ্ক ভেঙ্গে ক্রোধে শরীর জ্বলে ওঠে। ওর হাতের থেকে হাত ছাড়িয়ে ঠাসিয়ে দানার গালে একটা চড় কষিয়ে দেয়। দানা এই চড়ের প্রতীক্ষায় ছিল, জানত যে মহুয়া এই সব শোনার পরে ওকে একটা চড় কষাবে।
দানার হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে উঠিয়ে চাপা গলায় ওকে বলে, "বেড়িয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। তোমার ছায়াও যেন আমার রুহির ধারে কাছে আসে না।"
ভীষণ বেদনায় দানা কুঁকড়ে যায়, চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। মহুয়ার হাত ধরতে চেষ্টা করে কিন্তু মহুয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে পিছিয়ে যায়। দানা ওর সামনে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে বলে, "আমি জানি আমি একটা পশুর মতন কাজ করেছি কিন্তু নয়না নিজেই চেয়েছিল এটা। আর ওকে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।"
মহুয়া ঝাঁঝিয়ে ওঠে, "তাহলে ওই ধূর্ত কামুকী নয়নার সাথে তোমার তফাৎ কোথায়? একটা কুকুর তোমাকে যদি কামড়ায় তাহলে তুমি সেই কুকুরকেও কামড়াবে? মহেন্দ্র বাবু কি এই শিক্ষা তোমাকে দিয়েছিলেন? ভবিষ্যতে আমি যদি কখন কিছু ভুল করে ফেলি তাহলে আমাকেও তুমি বেঁধে ;., করবে, তাই না?"
ওই কথা শুনে দানার বুক ফেটে যায়, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ঋজু দেহ ঝড়ের প্রকোপে এক ছিন্ন লতার মতন মহুয়ার পায়ের কাছে নেতিয়ে পড়ে। অনুতপ্ত গলায় মহুয়ার সামনে মাথা নিচু করে ধরা গলায় বলে, "না মহুয়া, এই রুহির....."
রুহির নাম শুনতেই আরো একটা চড় দানার গালে কষিয়ে বলে, "একদম ওই মুখে আমার মেয়ের নাম নেবে না। কত আশা করে মেয়েটা রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠে যে বিকেলে অথবা রাতের বেলা ওর দানা ওর জন্য চকোলেট নিয়ে আসবে আর তুমি কি না শেষ পর্যন্ত একটা নৃশংস পশুর মতন আচরন করলে? ছিঃ দানা, ছিঃ। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ঘৃণা বোধ করছে দানা। এখুনি তুমি আমার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাও।"
মহুয়ার চোখের জল বাঁধ মানতে নারাজ, কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বিছানায় বসে ঘুমন্ত রুহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে, "আমার অদৃষ্ট, ভগবান আমার কপালে প্রকৃত পুরুষ কোনোদিন জুটিয়ে দেয় নি। কলেজে অন্য ছেলেরা আমাকে দেখে টিটকিরি মারত সেই দেখে আমার বাবা আমার পড়াশুনা ছাড়িয়ে দিল, আর শেষ পর্যন্ত ইতর লোকেশের হাতে আমাকে বেচে দিল। জীবনে স্বামীর ভালোবাসা কি বুঝতে পারিনি। রাজেশ মারা যাওয়ার পরে, শ্বশুর আমার শরীর নিয়ে যথেচ্ছ ভাবে নিজের কামুক ইতর কামনা বাসনা চরিতার্থ করল। শেষ পর্যন্ত তোমাকে পেয়ে ভেবেছিলাম জীবনটা শান্তিতে কাটবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি?"
এর উত্তর দানার কাছে নেই, দানা সত্যি পাপী। প্রথমে ইন্দ্রাণীর পাপী তারপরে মহুয়ার কাছে পাপী। এই পাপের আর ক্ষমা নেই। এইবারে কোথায় যাবে দানা? কি করবে? কিন্তু এইবারে যুদ্ধে নেমেছে, সুতরাং ওদের কাছ থেকে সরে থাকলেও দূরে থাকতে পারবে না কিছুতেই। আহত নাগিনী নয়না নিশ্চয় সুযোগ খুঁজবে ইন্দ্রাণীকে আঘাত করার। দানা নত মস্তকে পাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে মহুয়ার বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসে।