06-03-2019, 01:14 PM
৯৬
থানা থেকে ফিরতেই শ্রী দীপ্তকে চেপে ধরল।
‘কী ব্যাপার গো? তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠাল যে পুলিশ?’
‘বলছি বলছি বাবা আর তর সয় না। একটু বসতে দাও, তারপরে বলছি। মনি কোথায়?’
‘ও অভিদের বাড়িতে গেছে। দীপ্তির দেখাশোনা করার জন্য রেখে এলাম আমিই। একটু আগেই আমি চলে এসেছি। ওদের ওপর দিয়ে যা ঝড় চলছে তিনদিন ধরে। পুষ্করদাও এই সময়ে নেই। তবে ফোন করেছিল, আজই ফিরছে বলে জানিয়েছে অভিকে,’ বলল শ্রী।
‘ও আজ ফিরছে? যাক। এই সময়ে পুষ্করের পাশে থাকাটা জরুরী ছিল। শুধু ফোনে খবরাখবর নিয়ে কী হয়!’ জবাব দিল দীপ্ত।
‘তা কী বলল ও সি বল না,’ আব্দার করল শ্রী।
‘ওরাএদের মাথায় যে ছিল সেই লোকটাকে ট্র্যাক করতে পেরেছে।‘
‘হ্যাঁ... সে কি! ধরা পড়ে গেছে?’
‘না এখনও ধরা পড়ে নি, তবে জানতে পেরেছে কোথায় আছে। রওনা হয়ে গেছে পুলিশের একটা টীম ওকে ধরতে।‘
‘তাই? যাক বাবা। এত তাড়াতাড়ি পুলিশ কেসটা সলভ করতে পারবে ভাবি নি। আমার তো চিন্তায় দুদিন ধরে ঘুমই হচ্ছে না।‘
‘হুম’ বলে ছোট্ট উত্তর দিল দীপ্ত।
‘শ্রী, একটা খুব খারাপ খবর। তোমাকে সামলাতে হবে ব্যাপারটা কিন্তু।‘
‘কী হয়েছে দীপ?’
‘ও সি যা বললেন, তা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও তোমাকে বলছি। অভি, মনি, দীপ্তি কাউকে এখনই বোলো না।‘
‘আরে ভনিতা না করে বলো না প্লিজ..’
‘পুলিশ জেনেছে যে পুষ্কর-ই এই গোটা র্যা কেটের মাথায় আছে। বড় সাহেব বলে যার নাম করছিল সবাই, সেটা নাকি পুষ্কর। ওদের বাড়িতে দীপ্তি-অভি-পুষ্করের একটা ফ্যামিলি ফটো দেখেই ও সি-র সন্দেহ হয়। তারপর বাকিদের দেখিয়ে ওরা কনফার্ম করেছে যে বড় সাহেবই পুষ্কর।‘
কথাগুলো একটানা যখন বলে যাচ্ছিল দীপ্ত, তার মাঝেই শ্রী মুখে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে পিছতে পিছতে ধপ করে খাটে বসে পড়েছিল..
অস্ফূটে শুধু বলতে পারল, ‘কী --- ব—ল—ছ তুউউউ মিইই...’
দীপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর সিগারেট ধরালো একটা।
প্রায় মিনিট দশেক ওরা কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
শ্রী কপালটা হাতের চেটোয় রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল, দীপ্ত সিগারেটটা খেতে খেতে জানলা দিয়ে পুষ্কর-দীপ্তিদের বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল।
বিকেল হয়ে আসছে প্রায়। ‘পুষ্কর কখন আসবে দীপ্তি বলেছে কিছু?’
মাথা নাড়ল শ্রী।
‘পাড়ার মধ্যে থেকে পুলিশ এসে ওকে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা খুব বাজে হবে। অভি আর দীপ্তির এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। ও সিকে তাই বলেছি, যা করার থানাতেই যেন করেন। অভিদের তো কোনও দোষ নেই।‘
একটা লম্বা শ্বাস নিল শ্রী।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। শ্রী উঠে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। সাতটা নাগাদ মনি ফোন করল ওর বাবাকে।
‘বল মনি,’ ফোনটা ধরে নীচু গলায় বলল দীপ্ত। ওর মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা এখনই মেয়েকে জানতে দিতে চায় না ও।
মেয়ের কথাগুলো শুনছিল দীপ্ত আর ওর ভুরু দুটো কুঁচকে উঠছিল, শ্রী ওর বরের মুখের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে ছিল।
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে দীপ্ত আস্তে আস্তে বলল, ‘পুষ্কর ফিরে এসেছে একটু আগে। একবার যাওয়া দরকার তোমার। আমি যেতে পারব না এখনই। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে ফেলার পরে ওকে ফেস করতে পারব না।‘
ও আবারও মোবাইলটা নিয়ে ও সি সাহেবের নম্বরটা ডায়াল করল। জানিয়ে দিল খবরটা যে পুষ্কর ফিরে এসেছে। ও সি ওর গুরুদায়িত্বটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এখন সেটাই মনে করিয়ে দিলেন।
ও সি দীপ্তর ফোনটা ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ভিক্টরের ফোন ঢুকল তাঁর মোবাইলে।
‘স্যার, সে তো পালিয়েছে মনে হচ্ছে।‘
‘হুম, এক্ষুনি খবর পেলাম, বাড়ি ফিরেছে পুষ্কর। একটু আগে। তোমরা ফিরে এসো।‘
দীপ্ত আর শ্রী কথা বলছিল যে ও সি-র দেওয়া দায়্ত্বিটা কীভাবে পালন করবে। পুষ্করকে থানায় নিয়ে যেতে হবে ওকেই। এই দায়িত্বটাই দিয়েছেন ও সি ওকে।
‘চলো যাওয়া যাক দীপ্তিদের বাড়িতে,’ বউকে বলল দীপ্ত।
মিনিট পাঁচেক পরে যখন পাশের বাড়ির সদর দরজায় বেল দিল ওরা দুজন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিল ওদের মেয়ে মনি।
‘এসো। মেসো ওপরের ঘরে গেল।‘
শ্রী আর দীপ্ত ওদের বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় বসল। দুজনেই চুপচাপ।
দীপ্তি বা অভি বা পুষ্কর বা মনি যেন কিছুতেই আগে থেকে কিছু বুঝতে না পারে, সেটা ওদের দুজনেরই মাথায় আছে। তাই ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক টেনশন করছে শ্রী আর দীপ্ত – দুজনেই। একেকটা মিনিট যেন মনে হচ্ছে এক ঘন্টা লম্বা।
সেই হিসাবে প্রায় পাঁচ ঘন্টা, মানে, মিনিট পাঁচেক পরেই ওপর থেকে নেমে এল পুষ্কর। শ্রী আর দীপ্ত দুজনেই চমকে ওর দিকে তাকাল। এই লোকটা – এত বছরের পরিচয়, বন্ধুত্ব – সে কি না পর্নো ফিল্মের র্যা কেট চালায়! তার জন্য নিজের স্ত্রীকেও কিডন্যাপ করিয়ে নিতে ছাড়ে না। কনিকা বলে ওই মহিলাকে প্রায় আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দেয়। সাবিনার মতো সাধারণ ঘরের একটা মেয়েকে নিয়ে আসে অপরাধ জগতে!!
ওদের বিশ্বাস হচ্ছিল না এখনও।
***
৯৭
‘কী সাংঘাতিক কান্ড দেখ দীপ্ত। আমি তো অভির কাছ থেকে শুনে বিশ্বাসই করতে পারি নি প্রথমে। তা-ও তোরা দুজনে পাশে ছিলি, না হলে অভিটা একা একা যে কী করত, সেটা ভেবেই তো ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! এত সাহস, দিনের বেলা পাড়ার থেকে কিডন্যাপ!’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছিল দীপ্ত।
মাঝে বেশ কিছুদিন দুই বন্ধুর দেখা হয় নি।
দীপ্ত একট স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘হুম। সে তো বটে। কিন্তু দীপ্তি যে ভাবে ওদের খপ্পর থেকে পালিয়েছে, ওর যে এত সাহস, সেটা বোঝা যায় নি আগে। যাক তুই ছিলি কোথায়? এদিকে একের পর এক ঝামেলায় পড়ছে।‘
‘আমি একটা কাজে উড়িষ্যা গিয়েছিলাম রে। কিছুতেই ফিরতে পারছিলাম না। ভাগ্যিস তোরা ছিলি পাশে!’
দীপ্ত এবার বলল, ‘শোন, এই গোটা পিরিয়েডে তুই তো ছিলি না, ও সি তোকে একবার থানায় যেতে বলেছে। আমিও যাব তোর সঙ্গে। গোটা ব্যাপারটা তোকে ডিটেলসে জানাবেন বলেছেন।‘
‘থা-না-য়! আমাকে?’
দীপ্ত মনে মনে বলল, সে তো তোকে যেতেই হবে রে বন্ধু! তুই যা করেছিস, তাতে কতদিন থাকতে হয় ভেতরে, সেটা কে জানে!
‘হ্যাঁ রে। চিন্তা করিস না। আমিও যাব।‘
‘এখনই যেতে হবে? এতটা জার্নি করে এলাম তো। তারওপরে গত দুতিন ধরে যা যা ফোন পাচ্ছি এখান থেকে, টেনশনের মধ্যে ছিলাম তো!’
‘ও সি আমাকে বলেছেন তুই ফিরলেই যেন নিয়ে যাই আমি তোকে।‘
‘ও। আচ্ছা। চল তাহলে। দীপ্তিকে বলে আসি, দাঁড়া এক মিনিট।‘
অভি আর মনি ওপরেই ছিল।
বাবাকে থানায় যেতে হবে শুনে অভিও নিচে নেমে এল পুষ্করের সঙ্গে।
দীপ্ত শ্রীকে বলল, ‘আমি না ফেরা পর্যন্ত তুমি দীপ্তির কাছেই থাক।‘
পুষ্করকে নিয়ে দীপ্ত বেরিয়ে গেল। এত সহজে যে ব্যাপারটা সামলাতে পারবে, সেটা আন্দাজ করতে পারে নি দীপ্ত বা শ্রী কেউই।
রাস্তায় যেতে যেতেই একটা এস এম এস করে দিয়েছিল দীপ্ত। ও সি কে লিখেছিল নিয়ে আসছি।
তাই থানায় ঢুকতেই ওদের নিজের ঘরে ডেকে নিলেন ও সি সাহেব।
‘আসুন আসুন পুষ্করবাবু। এই কদিনে আপনার স্ত্রী ছেলের সঙ্গে এতবার দেখা হয়েছে, কবার বাড়িতেও গেলাম। আপনার সঙ্গেই আলাপটা হয় নি। বসুন।‘
পুষ্করের চেহারাটা ও সি সাহেবের ছবির মতো মনে আছে। এখন চাক্ষুষ দেখলেন উনি। সাবিনাকে বলাই আছে – এমন একটা জানলায় ওকে বসিয়ে রেখেছে যাতে ওরা থানায় ঢোকামাত্রই পুষ্করকে আইডেন্টিফাই করতে পারে সাবিনা। আর ওরা যখন ও সি-র ঘরে বসে বসে কথা বলবে, তার মধ্যেই একজন কনস্টেবল ছোট্ট একটা চিট কাগজে কনফার্মেশনটা নিয়ে পৌঁছে দেবে সাহেবের ঘরে।
পুষ্কর চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘আমি আসলে উড়িষ্যায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। কিছুতেই ফিরতে পারছিলাম না। তবে দীপ্তির কিডন্যাপ হওয়ার পরে আমি কিছুটা জোর করেই ফিরে এলাম। তো গোটা ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো স্যার। এগুলো কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।‘
‘বলব সব পুষ্করবাবু। চা খান একটু?’ আর্দালিকে চা আনতে বললেন ও সি।
‘আপনি উড়িষ্যার কোন জায়গায় গিয়েছিলেন পুষ্করবাবু?’ উনি জানেন কোথায় ছিল পুষ্করের মোবাইল টাওয়ার লোকেশান।
‘বেহরমপুরে ছিলাম।‘
‘ও। অফিসের কাজে?’
‘মূলত অফিসেরই কাজ ছিল।‘
‘কী কাজ করেন আপনি?’
‘আমি একটা এক্সোপর্ট-ইম্পোর্ট ফার্মে চাকরী করি।‘
‘আচ্ছা। নিন চা এসে গেছে। খেতে থাকুন, আমি গোটা ঘটনাটা ব্রিফ করি আপনাকে।‘
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলেন তিনি – সেই কনিকার বাড়ির ঘটনাটা যখন বিজন উকিল উনাকে জানিয়েছিলেন ভোর রাতে – তখন থেকে। উনি লক্ষ্য রাখছিলেন পুষ্করের চোখমুখের দিকে। মনে মনে ভাবছিলেন, কত বড় ক্রিমিনাল হলে এরকম অবাক হওয়ার নাটক করা যায়। যেন কিছুই জানে না – এই প্রথম শুনছে পর্ন ফিল্ম র্যানকেটের কথা।
কনিকার ঘটনা, অভির কথা জানতে পারা, মধুমিতার ভিডিয়ো আর অভি-মনির মোবাইল থেকে পাঠানো ছবি হ্যাক হয়ে গিয়ে পর্ণ সাইটে চলে যাওয়া, তারপরে দীপ্তনু-সুতনু-সাবিনাদের খোঁজ পাওয়া, কনিকা, শ্রী-দীপ্ত আর মধুমিতাদের বাড়িতে গোপন ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া – কিছুই বাদ দিলেন না ও সি।
ও সি-র কথার মাঝে মাঝে পুষ্কর ‘কী সাংঘাতিক’, ‘সে কি, এরকমও হয় না কি’ ধরনের কথা বলছিল।
ও সি তখন আবারও মনে মনে বলছিলেন, তুমি জানো না এগুলো হয় যে! শুয়োরের বাচ্চা।
দীপ্তিকে কীভাবে সিংয়ের বাড়িতে খুঁজে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলো যখন বলছিলেন, তখন বেশ কয়েকবার পুষ্কর মাথা নামিয়ে দিয়েছিল টেবিলের ওপরে। ও সি বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে নিজের নোংরা কাজের ফল যে তার নিজের স্ত্রী-ছেলেকেও ভুগতে হয়েছে, সেটা জেনে কি অনুতপ্ত হচ্ছে পুষ্কর?
শেষে তিনি বললেন দীপ্তির কিডন্যাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আর ওর অসীম সাহসের সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে আসার গল্প।
এই বার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে ও সি সাহেবকে। দীপ্তি দেবী আর অভির জন্য খারাপ লাগছে যে তাদের স্বামী বা বাবাকে এইভাবে ট্রিট করতে হবে তাঁকে, কিন্তু কিছু করার নেই। এতবড় র্যা কেট ভাঙ্গতেই হবে। ততক্ষণে সাবিনার কনফার্মেশন দেওয়া ছোট্ট চিট কাগজ ওসি-র হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে কনস্টেবল।
‘এই কিডন্যাপিংয়ের পরে যখন আমি আপনাদের বাড়িতে গেলাম, একটা অদ্ভূত জিনিষ পেলাম। গোটা তদন্তটাই ঘুরে গেল। আগে আমরা একটা আলেয়ার পেছনে ছুটছিলাম – সবাই বলছিল বড় সাহেবের কথা, কিন্তু এক সিং আর সাবিনা ছাড়া ওকে কেউই দেখে নি। সাবিনার কাছ থেকে বড়সাহেবের চেহারা শুনেছিলাম.. আর আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখি সেই বড়সাহেবের ছবি!’
বোমাটা ফাটিয়েই দিলেন ও সি।
‘মা—নেএএএএএ?’ পুষ্করের গলা দিয়ে যেভাবে কথাটা বেরলো, তাকেই কাঁচা বাংলায় বলা হয় চমকে চোদ্দো!
‘চমকে গেলেন যে পুষ্করবাবু! সত্যিই বড়সাহেবের ছবি ছিল আপনার বাড়িতে.. এই যে’ বলে ওদের ফ্যামিলি ফটোটা বার করলেন।
‘সিং আর সাবিনা – যে দুজন স্বচক্ষে দেখেছেন, তারা দুজনেই কনফার্ম করেছে যে এটাই বড় সাহেব – এই গোটা পর্ণ ফিল্ম র্যা কেটের মাথা,’ কথাগুলো বলার সময়ে ফ্যামিলি ফটোতে পুষ্করের মুখের ওপরে আঙ্গুল বোলাচ্ছিলেন ও সি সাহেব।
এবার পুষ্কর বেশ জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘কী বলছেন কি আপনি এসব? দীপ্ত, শোন, দেখ.. কী বলছেন উনি? আপনার কী মাথা খারাপ না কি?’
দীপ্ত চুপ করে বসেছিল। সেদিকে তাকিয়ে পুষ্কর বলল, ‘দীপ্ত, তুই তো আমাকে এত বছর ধরে চিনিস। উনি কী যা তা বলছেন?’
‘নাটক করে লাভ নেই, চুপচাপ বসুন পুষ্করবাবু, ওরফে বড়সাহেব,’ একটু কড়া হলেন। বেল দিয়ে আর্দালিকে ডাকলেন তিনি। সে এলে বললেন ‘সাবিনাকে ডাক’।
‘কে সাবিনা?’ পুষ্কর জোর গলায় বলে উঠল।
সাবিনা ঘরে ঢুকল।
‘দেখুন তো পুষ্করবাবু, একে তো আপনি চেনেন। কয়েকদিন আগেই তো দেখেছেন। তনিমা। মনে আছে তো? আপনার আলিপুরের ফ্ল্যাটে গিয়ে দুটো সুটকেস দিয়ে এসেছিল, আর ল্যাপটপগুলো?’
সাবিনা সরাসরি পুষ্করের দিকে তাকিয়েছিল। ওর চোখে আগুন। পুষ্কর বলে উঠল, ‘আমি এই প্রথম দেখলাম একে। আর আলিপুরে আমার আবার কোন ফ্ল্যাট? কীসের সুটকেসের কথা বলছেন!’
‘আপনি-ই ভাল বলতে পারবেন, কোন সুটকেসের কথা বলছি। যেগুলো থেকে কয়েকটা হার্ড ড্রাইভ আর ল্যাপটপ আপনি কাপুরকে দিয়েছিলেন দুবাই পাঠানোর জন্য।সেটাও তো উড়িষ্যাতেই দিয়েছিলেন – ভুলে গেলেন সব?’
এবার পুষ্করের গলাটা যেন একটু কেঁপে গেল।
‘স্যার বিশ্বাস করুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন। আমি উড়িষ্যা গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। আর আমি যদি এসবে জড়িত থাকব, নিজের বউ ছেলেকে কেন জড়াব? দীপ্ত তুই কিছু বলছিস না কেন রে? বল তুইইইইই।‘
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছিল পুষ্কর।
ও সি শান্ত গলায় বললেন, ‘দেখ পুষ্কর, আমি চাই না যে পেট থেকে কথা আদায় করার যেসব কায়দা আমাদের আছে, সেগুলো তোমার ওপরে কাজে লাগাতে। শুধু তোমার স্ত্রী ছেলের কথা ভেবেই চাই না ওগুলো করতে। তবে ভালয় ভালয় যদি বলে দাও তাহলে ওই অপ্রিয় কাজগুলো করতে হবে না আমাকে।‘ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন ও সি, সেটা পুষ্করের খেয়াল হল না, কিন্তু দীপ্তর কানে লেগেছিল ব্যাপারটা।
পাশের চেয়ারে বসে এবার বহু দিনের বন্ধুকে কেঁদে ফেলতে দেখল দীপ্ত।
তখনই ও সি-র মোবাইলে একটা ফোন এল।
***
৯৮
উনি ফোনটা কানে লাগিয়েই উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। ঘরের বাইরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফিস ফিস করে বললেন, ‘হোল্ড অন।‘
ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে একজন কনস্টেবলকে বললেন, ‘সাবিনাকে আমার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এস।‘
‘হ্যাঁ বলো তো ডিটেলসে.. কী হয়েছে?’
মিনিট দশেক কানে ধরেছিলেন ফোনটা ও সি সাহেব। মাঝে মাঝে শুধু হু, আচ্ছা বলে যাচ্ছিলেন।
ফোনটা শেষ করে সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ে আবারও একটা সিগারেট ধরালেন উনি।
উনার অফিস ঘর থেকে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছিল। পুষ্করের গলা।
সিগারেটটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ও সি। সাবিনা কোন ঘরে আছে জানতে চাইলেন এক কনস্টেবলকে।
সেই ঘরে ঢুকে দেখলেন সাবিনা চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে আছে।
উনাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল সাবিনা। বলল, ‘না স্যার এটা বড় সাহেব নয়।‘
‘তবে যে তুমি জানলা দিয়ে চেহারা দেখে চিট পাঠালে কনফার্ম করে!’
‘স্যার একদম একরকম, কিন্তু এটা সে নয়। গলা শুনে বুঝলাম!’
‘তুমি কতক্ষণ কথা বলেছিলে সেদিন রাতে যে তার মধ্যেই গলা শুনে মনে রাখতে পেরেছ তুমি?’
‘স্যার ছোট থেকেই আমার এই একটা গুণ – একবার কারও গলা শুনলে আমি কখনও ভুলি না। যত কমই শুনি না কেন। বড় সাহেবের গলা আর এই ভদ্রলোকের গলা এক না স্যার।‘
ও সি ভেবেছিলেন কেসটা মিটে গেল। রাতেই পুষ্করকে লক আপ করে দেবেন। কিন্তু একটু আগে যে ফোনটা করেছিল ভিক্টর আর তারপরে সাবিনা যা বলল, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, কেসটা এখনও পুরোপুরি শেষ হয় নি।
ভিক্টর জানিয়েছে যে ওরা যখন ফেরার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে যাচ্ছিল, তখনই লোকাল পুলিশ – যাদের তারা গোটা ব্যাপারটা বেহরমপুরে গিয়েই জানিয়েছিল – তাদেরই এক ইনফর্মার জানিয়েছে যে বাসস্ট্যান্ডে ওই চেহারার লোককে দেখা গেছে।
ভিক্টরের নিয়ে আসা ছবি বেশ কিছু কপি করে নিজেদের ইনফর্মারদের পৌঁছে দিয়েছিল বেহরমপুর পুলিশ।
ভিক্টর লোকাল পুলিশকে নিয়ে দৌড়েছিল বাস স্ট্যান্ডের দিকে। কিন্তু একটু আগেই যে ও সি সাহেব বললেন পুষ্কর বাড়ি ফিরে গেছে, তাহলে বেহরমপুরের বাসস্ট্যান্ডে কী করছে?
ভিক্টরের মন বলছিল এরকম অনেক ভুলভাল খবর ইনফর্মাররা দেয়। এটাও সেরকমই কিছু একটা হবে।
তবে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যে নাটক হল, তার পরে ও নিশ্চিত যে পুষ্কর আর বড় সাহেব এক নয়। বেহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে যাকে ধরা হল সেই বড় সাহেব না হোক অপরাধী তো বটেই। না হলে পুলিশ আসতে দেখেই সে তাড়াতাড়ি হেঁটে বাসস্ট্যান্ডের বাইরের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে কেন, আর ইনফর্মারেরর ছুঁড়ে দেওয়া কলার খোসায় পা পিছলে পড়েও সে কোনও তর্ক না করেই আরও দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করবে কেন!
ভিক্টর আর ওদের দলটা যখন খুব কাছাকাছি, তখনই দৌড়তে শুরু করেছিল লোকটা। কাঁধে একটা ল্যাপটপ ব্যাগ। আর কোনও লাগেজ ছিল না ওর কাছে।
সে চেষ্টা করছিল একটা অটোতে উঠে চলে যাওয়ার। কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে ভিক্টর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর কলারটা টেনে ধরে। অটোচালকও ঝামেলা দেখে অটোটা থামিয়ে রেখেছিল।
বেশ চেঁচামেচি করেছিল ওই লোকটা। কিন্তু ৫-৬ জন পুলিশের সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠে নি।
বেহরমপুরের পুলিশ দেখা গেল বেশ কড়া দাওয়া দিতে সদা সর্বদা তৈরী। সেদ্ধ করা গরম ডিমও দরকার হয় না তাদের! পুরণো পদ্ধতিতেই ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় মুখ থেকে কথা বার করে ফেলল তারা।
থানায় নিয়ে আসার পরেই ও সি-কে ফোন করে খবরটা জানিয়েছিল ভিক্টর।
তারপরেই ও সি সাহেব ধন্দে পড়েছিলেন। বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল সাবিনার কথা।
***
থানা থেকে ফিরতেই শ্রী দীপ্তকে চেপে ধরল।
‘কী ব্যাপার গো? তাড়াতাড়ি ডেকে পাঠাল যে পুলিশ?’
‘বলছি বলছি বাবা আর তর সয় না। একটু বসতে দাও, তারপরে বলছি। মনি কোথায়?’
‘ও অভিদের বাড়িতে গেছে। দীপ্তির দেখাশোনা করার জন্য রেখে এলাম আমিই। একটু আগেই আমি চলে এসেছি। ওদের ওপর দিয়ে যা ঝড় চলছে তিনদিন ধরে। পুষ্করদাও এই সময়ে নেই। তবে ফোন করেছিল, আজই ফিরছে বলে জানিয়েছে অভিকে,’ বলল শ্রী।
‘ও আজ ফিরছে? যাক। এই সময়ে পুষ্করের পাশে থাকাটা জরুরী ছিল। শুধু ফোনে খবরাখবর নিয়ে কী হয়!’ জবাব দিল দীপ্ত।
‘তা কী বলল ও সি বল না,’ আব্দার করল শ্রী।
‘ওরাএদের মাথায় যে ছিল সেই লোকটাকে ট্র্যাক করতে পেরেছে।‘
‘হ্যাঁ... সে কি! ধরা পড়ে গেছে?’
‘না এখনও ধরা পড়ে নি, তবে জানতে পেরেছে কোথায় আছে। রওনা হয়ে গেছে পুলিশের একটা টীম ওকে ধরতে।‘
‘তাই? যাক বাবা। এত তাড়াতাড়ি পুলিশ কেসটা সলভ করতে পারবে ভাবি নি। আমার তো চিন্তায় দুদিন ধরে ঘুমই হচ্ছে না।‘
‘হুম’ বলে ছোট্ট উত্তর দিল দীপ্ত।
‘শ্রী, একটা খুব খারাপ খবর। তোমাকে সামলাতে হবে ব্যাপারটা কিন্তু।‘
‘কী হয়েছে দীপ?’
‘ও সি যা বললেন, তা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও তোমাকে বলছি। অভি, মনি, দীপ্তি কাউকে এখনই বোলো না।‘
‘আরে ভনিতা না করে বলো না প্লিজ..’
‘পুলিশ জেনেছে যে পুষ্কর-ই এই গোটা র্যা কেটের মাথায় আছে। বড় সাহেব বলে যার নাম করছিল সবাই, সেটা নাকি পুষ্কর। ওদের বাড়িতে দীপ্তি-অভি-পুষ্করের একটা ফ্যামিলি ফটো দেখেই ও সি-র সন্দেহ হয়। তারপর বাকিদের দেখিয়ে ওরা কনফার্ম করেছে যে বড় সাহেবই পুষ্কর।‘
কথাগুলো একটানা যখন বলে যাচ্ছিল দীপ্ত, তার মাঝেই শ্রী মুখে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে পিছতে পিছতে ধপ করে খাটে বসে পড়েছিল..
অস্ফূটে শুধু বলতে পারল, ‘কী --- ব—ল—ছ তুউউউ মিইই...’
দীপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর সিগারেট ধরালো একটা।
প্রায় মিনিট দশেক ওরা কেউ কোনও কথা বলতে পারল না।
শ্রী কপালটা হাতের চেটোয় রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল, দীপ্ত সিগারেটটা খেতে খেতে জানলা দিয়ে পুষ্কর-দীপ্তিদের বাড়ির দিকে তাকিয়েছিল।
বিকেল হয়ে আসছে প্রায়। ‘পুষ্কর কখন আসবে দীপ্তি বলেছে কিছু?’
মাথা নাড়ল শ্রী।
‘পাড়ার মধ্যে থেকে পুলিশ এসে ওকে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা খুব বাজে হবে। অভি আর দীপ্তির এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। ও সিকে তাই বলেছি, যা করার থানাতেই যেন করেন। অভিদের তো কোনও দোষ নেই।‘
একটা লম্বা শ্বাস নিল শ্রী।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। শ্রী উঠে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল। সাতটা নাগাদ মনি ফোন করল ওর বাবাকে।
‘বল মনি,’ ফোনটা ধরে নীচু গলায় বলল দীপ্ত। ওর মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা এখনই মেয়েকে জানতে দিতে চায় না ও।
মেয়ের কথাগুলো শুনছিল দীপ্ত আর ওর ভুরু দুটো কুঁচকে উঠছিল, শ্রী ওর বরের মুখের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে ছিল।
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে দীপ্ত আস্তে আস্তে বলল, ‘পুষ্কর ফিরে এসেছে একটু আগে। একবার যাওয়া দরকার তোমার। আমি যেতে পারব না এখনই। ওর ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে ফেলার পরে ওকে ফেস করতে পারব না।‘
ও আবারও মোবাইলটা নিয়ে ও সি সাহেবের নম্বরটা ডায়াল করল। জানিয়ে দিল খবরটা যে পুষ্কর ফিরে এসেছে। ও সি ওর গুরুদায়িত্বটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এখন সেটাই মনে করিয়ে দিলেন।
ও সি দীপ্তর ফোনটা ছাড়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ভিক্টরের ফোন ঢুকল তাঁর মোবাইলে।
‘স্যার, সে তো পালিয়েছে মনে হচ্ছে।‘
‘হুম, এক্ষুনি খবর পেলাম, বাড়ি ফিরেছে পুষ্কর। একটু আগে। তোমরা ফিরে এসো।‘
দীপ্ত আর শ্রী কথা বলছিল যে ও সি-র দেওয়া দায়্ত্বিটা কীভাবে পালন করবে। পুষ্করকে থানায় নিয়ে যেতে হবে ওকেই। এই দায়িত্বটাই দিয়েছেন ও সি ওকে।
‘চলো যাওয়া যাক দীপ্তিদের বাড়িতে,’ বউকে বলল দীপ্ত।
মিনিট পাঁচেক পরে যখন পাশের বাড়ির সদর দরজায় বেল দিল ওরা দুজন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিল ওদের মেয়ে মনি।
‘এসো। মেসো ওপরের ঘরে গেল।‘
শ্রী আর দীপ্ত ওদের বাড়ির ড্রয়িং রুমের সোফায় বসল। দুজনেই চুপচাপ।
দীপ্তি বা অভি বা পুষ্কর বা মনি যেন কিছুতেই আগে থেকে কিছু বুঝতে না পারে, সেটা ওদের দুজনেরই মাথায় আছে। তাই ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক টেনশন করছে শ্রী আর দীপ্ত – দুজনেই। একেকটা মিনিট যেন মনে হচ্ছে এক ঘন্টা লম্বা।
সেই হিসাবে প্রায় পাঁচ ঘন্টা, মানে, মিনিট পাঁচেক পরেই ওপর থেকে নেমে এল পুষ্কর। শ্রী আর দীপ্ত দুজনেই চমকে ওর দিকে তাকাল। এই লোকটা – এত বছরের পরিচয়, বন্ধুত্ব – সে কি না পর্নো ফিল্মের র্যা কেট চালায়! তার জন্য নিজের স্ত্রীকেও কিডন্যাপ করিয়ে নিতে ছাড়ে না। কনিকা বলে ওই মহিলাকে প্রায় আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দেয়। সাবিনার মতো সাধারণ ঘরের একটা মেয়েকে নিয়ে আসে অপরাধ জগতে!!
ওদের বিশ্বাস হচ্ছিল না এখনও।
***
৯৭
‘কী সাংঘাতিক কান্ড দেখ দীপ্ত। আমি তো অভির কাছ থেকে শুনে বিশ্বাসই করতে পারি নি প্রথমে। তা-ও তোরা দুজনে পাশে ছিলি, না হলে অভিটা একা একা যে কী করত, সেটা ভেবেই তো ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! এত সাহস, দিনের বেলা পাড়ার থেকে কিডন্যাপ!’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলছিল দীপ্ত।
মাঝে বেশ কিছুদিন দুই বন্ধুর দেখা হয় নি।
দীপ্ত একট স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘হুম। সে তো বটে। কিন্তু দীপ্তি যে ভাবে ওদের খপ্পর থেকে পালিয়েছে, ওর যে এত সাহস, সেটা বোঝা যায় নি আগে। যাক তুই ছিলি কোথায়? এদিকে একের পর এক ঝামেলায় পড়ছে।‘
‘আমি একটা কাজে উড়িষ্যা গিয়েছিলাম রে। কিছুতেই ফিরতে পারছিলাম না। ভাগ্যিস তোরা ছিলি পাশে!’
দীপ্ত এবার বলল, ‘শোন, এই গোটা পিরিয়েডে তুই তো ছিলি না, ও সি তোকে একবার থানায় যেতে বলেছে। আমিও যাব তোর সঙ্গে। গোটা ব্যাপারটা তোকে ডিটেলসে জানাবেন বলেছেন।‘
‘থা-না-য়! আমাকে?’
দীপ্ত মনে মনে বলল, সে তো তোকে যেতেই হবে রে বন্ধু! তুই যা করেছিস, তাতে কতদিন থাকতে হয় ভেতরে, সেটা কে জানে!
‘হ্যাঁ রে। চিন্তা করিস না। আমিও যাব।‘
‘এখনই যেতে হবে? এতটা জার্নি করে এলাম তো। তারওপরে গত দুতিন ধরে যা যা ফোন পাচ্ছি এখান থেকে, টেনশনের মধ্যে ছিলাম তো!’
‘ও সি আমাকে বলেছেন তুই ফিরলেই যেন নিয়ে যাই আমি তোকে।‘
‘ও। আচ্ছা। চল তাহলে। দীপ্তিকে বলে আসি, দাঁড়া এক মিনিট।‘
অভি আর মনি ওপরেই ছিল।
বাবাকে থানায় যেতে হবে শুনে অভিও নিচে নেমে এল পুষ্করের সঙ্গে।
দীপ্ত শ্রীকে বলল, ‘আমি না ফেরা পর্যন্ত তুমি দীপ্তির কাছেই থাক।‘
পুষ্করকে নিয়ে দীপ্ত বেরিয়ে গেল। এত সহজে যে ব্যাপারটা সামলাতে পারবে, সেটা আন্দাজ করতে পারে নি দীপ্ত বা শ্রী কেউই।
রাস্তায় যেতে যেতেই একটা এস এম এস করে দিয়েছিল দীপ্ত। ও সি কে লিখেছিল নিয়ে আসছি।
তাই থানায় ঢুকতেই ওদের নিজের ঘরে ডেকে নিলেন ও সি সাহেব।
‘আসুন আসুন পুষ্করবাবু। এই কদিনে আপনার স্ত্রী ছেলের সঙ্গে এতবার দেখা হয়েছে, কবার বাড়িতেও গেলাম। আপনার সঙ্গেই আলাপটা হয় নি। বসুন।‘
পুষ্করের চেহারাটা ও সি সাহেবের ছবির মতো মনে আছে। এখন চাক্ষুষ দেখলেন উনি। সাবিনাকে বলাই আছে – এমন একটা জানলায় ওকে বসিয়ে রেখেছে যাতে ওরা থানায় ঢোকামাত্রই পুষ্করকে আইডেন্টিফাই করতে পারে সাবিনা। আর ওরা যখন ও সি-র ঘরে বসে বসে কথা বলবে, তার মধ্যেই একজন কনস্টেবল ছোট্ট একটা চিট কাগজে কনফার্মেশনটা নিয়ে পৌঁছে দেবে সাহেবের ঘরে।
পুষ্কর চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘আমি আসলে উড়িষ্যায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। কিছুতেই ফিরতে পারছিলাম না। তবে দীপ্তির কিডন্যাপ হওয়ার পরে আমি কিছুটা জোর করেই ফিরে এলাম। তো গোটা ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো স্যার। এগুলো কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।‘
‘বলব সব পুষ্করবাবু। চা খান একটু?’ আর্দালিকে চা আনতে বললেন ও সি।
‘আপনি উড়িষ্যার কোন জায়গায় গিয়েছিলেন পুষ্করবাবু?’ উনি জানেন কোথায় ছিল পুষ্করের মোবাইল টাওয়ার লোকেশান।
‘বেহরমপুরে ছিলাম।‘
‘ও। অফিসের কাজে?’
‘মূলত অফিসেরই কাজ ছিল।‘
‘কী কাজ করেন আপনি?’
‘আমি একটা এক্সোপর্ট-ইম্পোর্ট ফার্মে চাকরী করি।‘
‘আচ্ছা। নিন চা এসে গেছে। খেতে থাকুন, আমি গোটা ঘটনাটা ব্রিফ করি আপনাকে।‘
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলেন তিনি – সেই কনিকার বাড়ির ঘটনাটা যখন বিজন উকিল উনাকে জানিয়েছিলেন ভোর রাতে – তখন থেকে। উনি লক্ষ্য রাখছিলেন পুষ্করের চোখমুখের দিকে। মনে মনে ভাবছিলেন, কত বড় ক্রিমিনাল হলে এরকম অবাক হওয়ার নাটক করা যায়। যেন কিছুই জানে না – এই প্রথম শুনছে পর্ন ফিল্ম র্যানকেটের কথা।
কনিকার ঘটনা, অভির কথা জানতে পারা, মধুমিতার ভিডিয়ো আর অভি-মনির মোবাইল থেকে পাঠানো ছবি হ্যাক হয়ে গিয়ে পর্ণ সাইটে চলে যাওয়া, তারপরে দীপ্তনু-সুতনু-সাবিনাদের খোঁজ পাওয়া, কনিকা, শ্রী-দীপ্ত আর মধুমিতাদের বাড়িতে গোপন ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া – কিছুই বাদ দিলেন না ও সি।
ও সি-র কথার মাঝে মাঝে পুষ্কর ‘কী সাংঘাতিক’, ‘সে কি, এরকমও হয় না কি’ ধরনের কথা বলছিল।
ও সি তখন আবারও মনে মনে বলছিলেন, তুমি জানো না এগুলো হয় যে! শুয়োরের বাচ্চা।
দীপ্তিকে কীভাবে সিংয়ের বাড়িতে খুঁজে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলো যখন বলছিলেন, তখন বেশ কয়েকবার পুষ্কর মাথা নামিয়ে দিয়েছিল টেবিলের ওপরে। ও সি বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে নিজের নোংরা কাজের ফল যে তার নিজের স্ত্রী-ছেলেকেও ভুগতে হয়েছে, সেটা জেনে কি অনুতপ্ত হচ্ছে পুষ্কর?
শেষে তিনি বললেন দীপ্তির কিডন্যাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আর ওর অসীম সাহসের সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে আসার গল্প।
এই বার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে ও সি সাহেবকে। দীপ্তি দেবী আর অভির জন্য খারাপ লাগছে যে তাদের স্বামী বা বাবাকে এইভাবে ট্রিট করতে হবে তাঁকে, কিন্তু কিছু করার নেই। এতবড় র্যা কেট ভাঙ্গতেই হবে। ততক্ষণে সাবিনার কনফার্মেশন দেওয়া ছোট্ট চিট কাগজ ওসি-র হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেছে কনস্টেবল।
‘এই কিডন্যাপিংয়ের পরে যখন আমি আপনাদের বাড়িতে গেলাম, একটা অদ্ভূত জিনিষ পেলাম। গোটা তদন্তটাই ঘুরে গেল। আগে আমরা একটা আলেয়ার পেছনে ছুটছিলাম – সবাই বলছিল বড় সাহেবের কথা, কিন্তু এক সিং আর সাবিনা ছাড়া ওকে কেউই দেখে নি। সাবিনার কাছ থেকে বড়সাহেবের চেহারা শুনেছিলাম.. আর আপনার বাড়িতে গিয়ে দেখি সেই বড়সাহেবের ছবি!’
বোমাটা ফাটিয়েই দিলেন ও সি।
‘মা—নেএএএএএ?’ পুষ্করের গলা দিয়ে যেভাবে কথাটা বেরলো, তাকেই কাঁচা বাংলায় বলা হয় চমকে চোদ্দো!
‘চমকে গেলেন যে পুষ্করবাবু! সত্যিই বড়সাহেবের ছবি ছিল আপনার বাড়িতে.. এই যে’ বলে ওদের ফ্যামিলি ফটোটা বার করলেন।
‘সিং আর সাবিনা – যে দুজন স্বচক্ষে দেখেছেন, তারা দুজনেই কনফার্ম করেছে যে এটাই বড় সাহেব – এই গোটা পর্ণ ফিল্ম র্যা কেটের মাথা,’ কথাগুলো বলার সময়ে ফ্যামিলি ফটোতে পুষ্করের মুখের ওপরে আঙ্গুল বোলাচ্ছিলেন ও সি সাহেব।
এবার পুষ্কর বেশ জোরে চিৎকার করে উঠল, ‘কী বলছেন কি আপনি এসব? দীপ্ত, শোন, দেখ.. কী বলছেন উনি? আপনার কী মাথা খারাপ না কি?’
দীপ্ত চুপ করে বসেছিল। সেদিকে তাকিয়ে পুষ্কর বলল, ‘দীপ্ত, তুই তো আমাকে এত বছর ধরে চিনিস। উনি কী যা তা বলছেন?’
‘নাটক করে লাভ নেই, চুপচাপ বসুন পুষ্করবাবু, ওরফে বড়সাহেব,’ একটু কড়া হলেন। বেল দিয়ে আর্দালিকে ডাকলেন তিনি। সে এলে বললেন ‘সাবিনাকে ডাক’।
‘কে সাবিনা?’ পুষ্কর জোর গলায় বলে উঠল।
সাবিনা ঘরে ঢুকল।
‘দেখুন তো পুষ্করবাবু, একে তো আপনি চেনেন। কয়েকদিন আগেই তো দেখেছেন। তনিমা। মনে আছে তো? আপনার আলিপুরের ফ্ল্যাটে গিয়ে দুটো সুটকেস দিয়ে এসেছিল, আর ল্যাপটপগুলো?’
সাবিনা সরাসরি পুষ্করের দিকে তাকিয়েছিল। ওর চোখে আগুন। পুষ্কর বলে উঠল, ‘আমি এই প্রথম দেখলাম একে। আর আলিপুরে আমার আবার কোন ফ্ল্যাট? কীসের সুটকেসের কথা বলছেন!’
‘আপনি-ই ভাল বলতে পারবেন, কোন সুটকেসের কথা বলছি। যেগুলো থেকে কয়েকটা হার্ড ড্রাইভ আর ল্যাপটপ আপনি কাপুরকে দিয়েছিলেন দুবাই পাঠানোর জন্য।সেটাও তো উড়িষ্যাতেই দিয়েছিলেন – ভুলে গেলেন সব?’
এবার পুষ্করের গলাটা যেন একটু কেঁপে গেল।
‘স্যার বিশ্বাস করুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন। আমি উড়িষ্যা গিয়েছিলাম অফিসের কাজে। আর আমি যদি এসবে জড়িত থাকব, নিজের বউ ছেলেকে কেন জড়াব? দীপ্ত তুই কিছু বলছিস না কেন রে? বল তুইইইইই।‘
উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছিল পুষ্কর।
ও সি শান্ত গলায় বললেন, ‘দেখ পুষ্কর, আমি চাই না যে পেট থেকে কথা আদায় করার যেসব কায়দা আমাদের আছে, সেগুলো তোমার ওপরে কাজে লাগাতে। শুধু তোমার স্ত্রী ছেলের কথা ভেবেই চাই না ওগুলো করতে। তবে ভালয় ভালয় যদি বলে দাও তাহলে ওই অপ্রিয় কাজগুলো করতে হবে না আমাকে।‘ আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন ও সি, সেটা পুষ্করের খেয়াল হল না, কিন্তু দীপ্তর কানে লেগেছিল ব্যাপারটা।
পাশের চেয়ারে বসে এবার বহু দিনের বন্ধুকে কেঁদে ফেলতে দেখল দীপ্ত।
তখনই ও সি-র মোবাইলে একটা ফোন এল।
***
৯৮
উনি ফোনটা কানে লাগিয়েই উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। ঘরের বাইরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফিস ফিস করে বললেন, ‘হোল্ড অন।‘
ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে একজন কনস্টেবলকে বললেন, ‘সাবিনাকে আমার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এস।‘
‘হ্যাঁ বলো তো ডিটেলসে.. কী হয়েছে?’
মিনিট দশেক কানে ধরেছিলেন ফোনটা ও সি সাহেব। মাঝে মাঝে শুধু হু, আচ্ছা বলে যাচ্ছিলেন।
ফোনটা শেষ করে সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ে আবারও একটা সিগারেট ধরালেন উনি।
উনার অফিস ঘর থেকে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছিল। পুষ্করের গলা।
সিগারেটটা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ও সি। সাবিনা কোন ঘরে আছে জানতে চাইলেন এক কনস্টেবলকে।
সেই ঘরে ঢুকে দেখলেন সাবিনা চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে আছে।
উনাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল সাবিনা। বলল, ‘না স্যার এটা বড় সাহেব নয়।‘
‘তবে যে তুমি জানলা দিয়ে চেহারা দেখে চিট পাঠালে কনফার্ম করে!’
‘স্যার একদম একরকম, কিন্তু এটা সে নয়। গলা শুনে বুঝলাম!’
‘তুমি কতক্ষণ কথা বলেছিলে সেদিন রাতে যে তার মধ্যেই গলা শুনে মনে রাখতে পেরেছ তুমি?’
‘স্যার ছোট থেকেই আমার এই একটা গুণ – একবার কারও গলা শুনলে আমি কখনও ভুলি না। যত কমই শুনি না কেন। বড় সাহেবের গলা আর এই ভদ্রলোকের গলা এক না স্যার।‘
ও সি ভেবেছিলেন কেসটা মিটে গেল। রাতেই পুষ্করকে লক আপ করে দেবেন। কিন্তু একটু আগে যে ফোনটা করেছিল ভিক্টর আর তারপরে সাবিনা যা বলল, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, কেসটা এখনও পুরোপুরি শেষ হয় নি।
ভিক্টর জানিয়েছে যে ওরা যখন ফেরার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে যাচ্ছিল, তখনই লোকাল পুলিশ – যাদের তারা গোটা ব্যাপারটা বেহরমপুরে গিয়েই জানিয়েছিল – তাদেরই এক ইনফর্মার জানিয়েছে যে বাসস্ট্যান্ডে ওই চেহারার লোককে দেখা গেছে।
ভিক্টরের নিয়ে আসা ছবি বেশ কিছু কপি করে নিজেদের ইনফর্মারদের পৌঁছে দিয়েছিল বেহরমপুর পুলিশ।
ভিক্টর লোকাল পুলিশকে নিয়ে দৌড়েছিল বাস স্ট্যান্ডের দিকে। কিন্তু একটু আগেই যে ও সি সাহেব বললেন পুষ্কর বাড়ি ফিরে গেছে, তাহলে বেহরমপুরের বাসস্ট্যান্ডে কী করছে?
ভিক্টরের মন বলছিল এরকম অনেক ভুলভাল খবর ইনফর্মাররা দেয়। এটাও সেরকমই কিছু একটা হবে।
তবে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যে নাটক হল, তার পরে ও নিশ্চিত যে পুষ্কর আর বড় সাহেব এক নয়। বেহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে যাকে ধরা হল সেই বড় সাহেব না হোক অপরাধী তো বটেই। না হলে পুলিশ আসতে দেখেই সে তাড়াতাড়ি হেঁটে বাসস্ট্যান্ডের বাইরের দিকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে কেন, আর ইনফর্মারেরর ছুঁড়ে দেওয়া কলার খোসায় পা পিছলে পড়েও সে কোনও তর্ক না করেই আরও দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করবে কেন!
ভিক্টর আর ওদের দলটা যখন খুব কাছাকাছি, তখনই দৌড়তে শুরু করেছিল লোকটা। কাঁধে একটা ল্যাপটপ ব্যাগ। আর কোনও লাগেজ ছিল না ওর কাছে।
সে চেষ্টা করছিল একটা অটোতে উঠে চলে যাওয়ার। কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে ভিক্টর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর কলারটা টেনে ধরে। অটোচালকও ঝামেলা দেখে অটোটা থামিয়ে রেখেছিল।
বেশ চেঁচামেচি করেছিল ওই লোকটা। কিন্তু ৫-৬ জন পুলিশের সঙ্গে শক্তিতে পেরে ওঠে নি।
বেহরমপুরের পুলিশ দেখা গেল বেশ কড়া দাওয়া দিতে সদা সর্বদা তৈরী। সেদ্ধ করা গরম ডিমও দরকার হয় না তাদের! পুরণো পদ্ধতিতেই ঘন্টা খানেকের চেষ্টায় মুখ থেকে কথা বার করে ফেলল তারা।
থানায় নিয়ে আসার পরেই ও সি-কে ফোন করে খবরটা জানিয়েছিল ভিক্টর।
তারপরেই ও সি সাহেব ধন্দে পড়েছিলেন। বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল সাবিনার কথা।
***