06-03-2019, 12:39 PM
৭৭
‘আমার মেয়ে আর দীপ্তির ছেলে ছোটবেলার বন্ধু। একই সঙ্গে বড় হয়েছে। এখন ওরা প্রায় অ্যাডাল্ট। এই বয়সের যা স্বভাব, ওই একটু ক্লোজনেস-টেস আর কি – ওদের মধ্যে আছে। কাল রাতে আমার স্ত্রীকে একটা অদ্ভূত কথা জানিয়েছে মেয়ে। ও আর অভি নাকি নিজেদের মধ্যে খুব পার্সোনাল কিছু ছবি এক্সজেঞ্জ করেছিল – বুঝতেই পারছেন কীধরনের ছবি – সেগুলো নাকি কোনও পর্ণ সাইটে চলে গেছে – ওদের মেসেঞ্জার হ্যাক করে,’ একটানা কথাগুলো বলে একটু থামল দীপ্ত।
দীপ্তিকে থানায় আসার আগে এত ডিটেলসে বলে নি শ্রী। শুধু বলেছে ওদের ছেলে মেয়েরা একটা বড় ঝামেলায় পড়েছে। সব থানায় গিয়েই শুনতে পাবে ও।
শ্রী শুরু করল এবার, “এছাড়াও আমার মেয়ে মনি আরও একটা কথা জানিয়েছে। অভিকে কোনও মহিলা নাকি বাড়িতে ডেকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে দিয়ে খারাপ কাজ করেছে আর সেটার ভিডিয়ো-ও ওই সব বাজে সাইটে তুলে দিয়েছে। ওই মহিলার স্বামীও নাকি তখন বাড়িতে ছিলেন। তবে কনিকা নামের ওই মহিলা নাকি অলরেডি স্বামী বরে পরিচয় দেওয়া ওই লোকটাকে আপনাদের দিয়ে অ্যারেস্ট করিয়েছে। কীসব ঝামেলায় পড়লাম বলুন তো।‘
দীপ্তি অবাক হয়ে শুনছিল শ্রী-র কথা গুলো।
‘তুই এসব কী বলছিস শ্রী? আমি তো এসব বিন্দুবিসর্গও জানি না! অবাক হয়ে কেটে কেটে কথাগুলো বলল দীপ্তি।
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ খুললেন ও সি সাহেব। ‘আপনার অবাক হওয়ার এখনও বাকি আছে দীপ্তি দেবী।‘
দীপ্ত আর শ্রীর দিকে তাকিয়ে ও সি সাহেব বললেন, ‘একটা বড় গ্যাঙ অপারেট করছে এই পর্ন ভিডিয়ো তৈরীর কাজে। দীপ্তি দেবীর ছেলের ব্যাপারে যার নাম বললেন, কনিকা – উনি এগিয়ে না এলে এর হদিশই পেতাম না আমরা। উনাকে ব্ল্যাকমেল করে এইসব করাচ্ছিল কয়েকজন। বিরাট কীর্তি এদের। সবটা আমরাও এখনও জানি না। তবে দীপ্তি দেবী – এর একটা বড় মাথা হল আপনাদের এন জি ও-র বড় সাহেব সিং।‘
এবার শ্রী আর দীপ্তর অবাক হওয়ার পালা। দীপ্তি আবারও মনে মনে ও সি সাহেবকে ধন্যবাদ দিলেন যে ওই সিংয়ের ফ্ল্যাটেই যে ও-ও ছিল সেটা বন্ধু আর তার বরের সামনে প্রকাশ না করার জন্য।
তবে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল দীপ্তি, ‘কী বলছেন মি. সিং এসবে জড়িত?’
‘বললাম না দীপ্তি দেবী, অবাক হওয়ার এখনও অনেক বাকি আছে। কেসটা প্রথমে যখন পেলাম আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আর ইনভেস্টিগেশন যত এগোচ্ছে, ততই অবাক হচ্ছি। এরা যে কতদূর কী জাল ছড়িয়েছে, তার হদিস পেতে অনেক দেরী – সম্ভবত। তবে আপনারা যে এগিয়ে এসে একটা নতুন ইনফরমেশন দিলেন, অনেক ধন্যবাদ। এই টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো আমি একেবারেই বুঝি না। এরজন্য একজন অন্য অফিসার আছে। ও চলে আসবে একটু পরেই। ও এলে আমি আবার আপনাদের সঙ্গে বসব। ডিটেলস কথা হবে। এখন একটু চা খান। তবে চিন্তা করবেন না, এদের তল আমি খুঁজে বার করবই। বাই দ্য ওয়ে দীপ্তি দেবী – আপনাদের অফিসের যে ভদ্রমহিলা একটু আগে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কী কাল রাতে আপনার কোনও কথা হয়েছে?’ শেষ প্রশ্নটা দীপ্তির দিকে তাকিয়ে করা।
‘হ্যাঁ। আমি ফোন করেছিলাম বাড়ি গিয়ে,’ কথাটা বলতে বলতে মাথা নামিয়ে নিল দীপ্তি।
শ্রী আর ওর বরের সামনে আর কিছু বলল না – ওরা তো এখনও জানে অফিসের গাড়ির ড্রাইভার অসভ্যতা করেছিল। কিন্তু মি. সিংকে যে পুলিশ নিয়ে গেছে, সেটা তো ও-ই সুমনাকে জানিয়েছিল।
‘হুম। আপনারা কাইন্ডলি একটু বাইরে বসুন। আপনাদের ছেলে মেয়েদের একটু পাঠিয়ে দিন। আপনাদের সামনে হয়তো সব কথা খোলাখুলি বলতে কমফর্টেবল ফীল করবে না ওরা। আপনাদের চা বাইরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি,’ বললেন ও সি।
দীপ্তি, দীপ্ত আর শ্রী বেরিয়ে যাওয়ার সেকেন্ড তিরিশেকের মধ্যেই ছেলেমেয়ে দুটি ঢুকল ঘরে।
‘বোসো,’ সামনের চেয়ারগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন ও সি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ অবজার্ভ করলেন ও সি সাহেব ওদের দুজনকে।
‘বলো শুনি তোমাদের কী সমস্যা হয়েছে,’ ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করতে বললেন ও সি।
‘স্যার আমি কাল আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার বেশ কিছুক্ষণ পরেও মা বাড়ি ফিরছিল না দেখে আমাদের এক কমন বন্ধুকে ফোন করি, সেখান থেকে মনি জানতে পারে। ও তারপরে আমাদের বাড়িতে এসেছিল ও আসার একটু পরে আমি ওকে আপনার ফোন আসার কথা, থানায় আসার কথাগুলো বলি। ও তো আমার ছোটবেলার বন্ধু।‘
মনি শুরু করল, ‘এর আগে কাল সকালে কলেজে গিয়ে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারি যে আমার বেশ কিছু ছবি পর্ণ সাইটে চলে গেছে.. সেটা তখন আর...’
‘কী ধরণের ছবি?’ ও সি জানতে চাইলেন।
‘স্যার সেটা বলতে পারব না। খুব খুব পার্সোনাল ছবি,’ মনি বলল।
‘আমার কাছে কথা লুকলে কী করে হবে? দেখ মা তোমরা আমার ছেলেমেয়ের বয়সী। আবার আমাদের এত সব নোংরা ঘাঁটতে হয় যে ভাবতেও পারবে না। তবুও বলছি দ্বিধা না করে বলে ফেল। চিন্তা নেই,’ অভয় দিলেন ও সি।
মনি আর অভি দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর অভি মুখ খুলল, ‘স্যার ন্যুড ছবি।‘
‘হুম.. তা কলেজে তোমার বন্ধুটি দেখল কী করে? পর্ণ দেখার অভ্যেস আছে বুঝি?’
‘স্যার সেটা জানি না, অত জিগ্যেসও করি নি। কলেজে ঢুকেই ওই ছবি দেখে তো আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আরও একজনের ন্যুড ছবি ছিল –আমার আর অভিরই পরিচিত – মধুমিতাদি – অভিদের সিনিয়র,’ বলল মনি।
‘মধুরিমা আবার কে?’
‘স্যার আমাদের কলেজেই পড়ে দুবছরের সিনিয়র,’ জবাব দিল অভি।
‘তার সঙ্গেও ওইসব ছবি এক্সচেঞ্জ করেছিলে না কি ভাই অভি? তুমি তো জিনিয়াস!’ মন্তব্য করলেন ও সি সাহেব।
অভি আর মনি মাথা নামিয়ে নিল।
‘তা এই মধুমিতা মেয়েটি কোথায় থাকে?’ জিগ্যেস করলেন ও সি সাহেব।
‘স্যার কাছেই বাড়ি মধুদির,’ বলল অভি।
‘ডাকো ওকে ফোন করে।‘
অভি মধুমিতার নম্বরে ডায়াল করল মোবাইল থেকে।
‘স্পিকারটা অন করে দাও,’ আদেশ ও সি-র।
ওপার থেকে সাড়া এল, ‘হ্যাঁ বল অভি? তোরা কি থানায় পৌঁছে গেছিস? আমি বাবা-মার সঙ্গে আসছি।‘
ও সি ভুরুটা কোঁচকালেন একটু। ওই মেয়েটিরও যে থানায় আসার কথা রয়েছে, সেটা তো বলে নি এরা!
অভি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ মধুদি আমরা রয়েছি। আমার মা আর মনির বাবা মা দুজনেই আছে। ও সি সাহেবকে তোমার কথা বলতে তিনিই বললেন ফোন করতে।‘
‘ও। আসছি আমরা এক্ষুনি।‘
অভি চোখ তুলে ও সি র দিকে তাকাল পরের নির্দেশ কী, সেটা জানতেই বোধহয়।
ও সি ইশারা করলেন ফোন রেখে দেওয়ার জন্য
অভি বলল, ‘ঠিক আছে তোমরা এস।‘
ও সি জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে আসার আগে তোমাদের সঙ্গে ওই মেয়েটির কথা হয়েছে, সেটা আগে বললে না তো!’
‘স্যার আপনি তো বললেন ফোন করতে! আর আমরা থানায় আসব বলেছিলাম মধুদিকে, ও আসবে জানতাম না,’ জবাব দিল মনি।
‘হুম। তা তোমরা ওইসব ছবি কী দিয়ে এক্সচেঞ্জ করেছিলে?’
দুজনে প্রায় একসঙ্গেই বলল, ফেসবুক মেসেঞ্জার।
‘হুম।‘
‘স্যার আপনি যখন আমাকে কাল ফোন করে কনিকাদির কথা বললেন, থানায় আসতে বললেন, তার একটু পরেই মনি এসেছিল বাড়িতে। তখনই ওকে ব্যাপারটা বলি আমি। তারপর ও কাল কলেজে যেসব ছবি দেখেছে ওর নিজের আর মধুদির, সেগুলো দেখায় আমাকে,’ একটানা কথাগুলো বলে থামল অভি।
এবার মনি শুরু করল, ‘তখনই আমরা ডিসিশান নিই যে আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি আমার মাকে বাড়ি এসে সব কিছু জানাই। তারপর মা বাবা আলোচনা করে এখানে এসেছে।‘
‘তোমার মা জানেন ব্যাপারটা?’ অভির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন ও সি।
‘আমি ঠিক জানি না। শ্রীমাসি, মানে মনির মা বলেছে কী না জানি না। কাল অত রাতে বাড়ি ফিরেছে, ওরকম একটা ঘটনার পরে, আমি বলি নি কিছু আর,’ জবাব দিল অভি।
‘শোনো একটু ডিটেলসে বলি তোমাদের। একটা কোনও বড় র্যা কেট কাজ করছে এখানে – যারা বিভিন্নভাবে ছবি, ভিডিয়ো তুলে পর্ণ সাইটে দিচ্ছে। বিরাট ব্যবসা। আমরা কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করেছি। তা তোমার ওই কনিকা বৌদি এগিয়ে না এলে কিন্তু আমরা ব্যাপারটা জানতেই পারতাম না। তুমি যেদিন উনার বাড়িতে গিয়েছিলে, সেদিন কনিকার স্বামীর নাম করে একজন ছিল সেখানে, তাই না?’
‘হ্যাঁ স্যার। তবে আমার জ্ঞান হওয়ার পরে আর উনাকে দেখি নি,’ বলল অভি।
‘কনিকা আর ওর আসল স্বামী আসবে একটু পরেই। তোমাদের সব আই ডি গুলো আমাদের এক টেকনিক্যাল অফিসারকে দিয়ে দেবে। মনে হচ্ছে কোনওভাবে তোমার ফেসবুক আই ডি হ্যাক করা হয়েছে। তোমার কাছে যা যা ছবি আসছে – ওদের যেগুলো দরকার – সব তুলে নিচ্ছে। ভেব না। তোমাদের যা ব্যাপার, তার থেকেও বড় সমস্যা রয়েছে এই কেসে,’ ও সি অভয় দিলেন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটিকে।
‘স্যার আমরা বুঝতে পারি নি ব্যাপারটা এরকম হয়ে যেতে পারে। আসলে আমরা একটু মজা করার জন্য করেছিলাম,’ বলল মনি।
‘ঠিক আছে ঠিক আছে বাবা। ভুল হয়। এবার থেকে শিখে নাও – ইন্টারনেটের যা দুনিয়া। কত যে অপরাধী ওঁত পেতে বসে আছে এখানে! এখন যাও বাইরে গিয়ে বস। আমাদের টেকনিক্যাল অফিসার তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন একটু পরে। আর তোমার মা-কে পাঠিয়ে দাও তো একটু,’ বললেন ও সি ।
ওরা বেরিয়ে গেল। বাইরে তখন দীপ্ত, শ্রী আর দীপ্তির পাশে এক তরুণ অফিসার বসে কথা বলছিলেন। মাকে যখন বলতে যাবে অভি যে তোমাকে ও সি সাহেব ডাকছেন, তখনই থানার গেটে গাড়ি থেকে নামল মধুমিতা, ওর বাবা আর মা। কিছুটা উদভ্রান্ত চেহারা সকলেরই।
অভি গলা নামিয়ে দীপ্তিকে বলল, ‘তোমাকে ও সি সাহেব ডাকছেন ভেতরে।‘
দীপ্তি বলল, ‘একা যাব?’
অসহায়ের মতো শ্রীর দিকে তাকাল দীপ্তি।
বন্ধুর হাতে একটা চাপ দিয়ে বলল শ্রী, ‘কিছু হবে না। আমরা এখানেই তো আছি।‘
দীপ্তি ভেতরে চলে গেল।
মধুমিতা এগিয়ে এসে মনিকে জড়িয়ে ধরল। ওর বাবা মা পেছনে।
মধু আলাপ করিয়ে দিল, ‘আমার বাবা মা – এটা অভি, আমাদের কলেজে পড়ে ফার্স্ট ইয়ার, এটা মনি – ওর বন্ধু।‘
কথাটা বলে বেঞ্চে বসে থাকা মনির বাবা-মায়ের দিকে তাকাল মধু।
মনি বলল, ‘আমার বাবা-মা’
শ্রী একটু অবাক হয়ে তাকাল। মনে মনে ভাবল, এই মেয়েটি আবার কে? অভির কলেজে পড়ে? সে থানায় কেন?
মধুমিতার বাবা মা একটু উদভ্রান্ত। ওর মা শ্রীর পাশে বসতে বসতে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো ভাই! মেয়ে আজ সকালে বলল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না এ কি আবার সম্ভব নাকি?’
শ্রী বলল, ‘আমি নিজেও জানি না দিদি কীভাবে কী সম্ভব। তবে আজকাল যা হচ্ছে, কিছুই বোধহয় অসম্ভব নয়।‘
শ্রী মেয়ে আর অভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের সঙ্গে কী কথা হল? বললি সব?’
‘হুম’ জবাব দিল মনি।
‘তোমরা একটু আমার সঙ্গে পাশের ঘরে এস। সব টেকনিক্যাল ডিটেলসগুলো জানতে হবে কে কোথা থেকে হ্যাক করল তোমাদের আই ডি,’ বললেন টেকনিক্যাল অফিসার।
পাশের ঘরে গিয়ে আরও ডিটেলসে সব তথ্য জানাল ওরা দুজন। অনেক নোটস নিচ্ছিলেন অফিসার।
কথার মধ্যেই মধুমিতার প্রসঙ্গ আসায় ওকেও ডেকে নিলেন অফিসার।
কী একটা ভাবতে ভাবতে মনিকে বললেন, ‘তোমার আর মধুমিতার বাবা-মাকে একটু ভেতরে আসতে বল তো! তোমরা তিনজন বাইরেই বস একটু।‘
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে পকেট থেকে একটা লিস্ট বার করলেন অফিসার। কয়েকটা জায়গায় পেনের দাগ দিলেন। ঠিকই সন্দেহ করেছেন উনি।
দীপ্তি তখনও ও সি-র ঘরে। দীপ্ত, শ্রী আর মধুমিতার বাবা মা এই ঘরে ঢুকলেন।
‘বসুন প্লিজ,’ সামনের চেয়ারগুলো দেখিয়ে দিলেন তরুণ অফিসার। শ্রী বেশ কয়েকবার তাকাল ছেলেটির দিকে। বেশ হ্যান্ডসাম! চেহারাটাও পেটানো। মনে মনে বলল শ্রী। ওর গালে একটু হাল্কা লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল?
‘আপনাদের ছেলে মেয়েরা একটা বড়সড় র্যাাকেটে ফেঁসে গেছে।‘ শুরু করলেন অফিসার।
মধুমিতার বাবা মা প্রথম থেকেই একটু উদভ্রান্ত ছিলেন।
বললেন, ‘র্যা -কে-ট? কীসের র্যা কেট স্যার?’
‘চিন্তা করবেন না। এটা আকছার হচ্ছে আজকাল। ফেসবুক বা মেইল আই ডি হ্যাক করে ছবি বা ইনফরমেশন বার করে নিচ্ছে ক্রিমিনালরা। তবে এই ব্যাপারটা একটু আলাদা। আপনাদের বুঝিয়ে বলি। যতটা আমরা ইনভেস্টিগেশান করে পেয়েছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে এটা একটা পর্ণ র্যা কেট। এরা পর্ণ ফিল্মের ব্যবসা করে। এখনও আমাদের অনেক কিছু জানতে বাকি। তবে আপনাদের চিন্তার কারণ নেই। কয়েকজন চাঁই অ্যারেস্ট হয়েছে। সামলে নেব। তবে একটা কথা বলুন তো গত বছর খানেকের মধ্যে আপনাদের বাড়িতে ইলেট্রিকের কোনও কাজ হয়েছে?’ জানতে চাইলেন অফিসার।
দীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ, হয়েছে তো। রঘু আমাদের পাড়ার মিস্ত্রী। ও-ই সব কাজ করে। মাস ছয়েক আগে এ সি লাগিয়েছি, তখন ওয়্যারিং তো ও-ই করেছে।‘
‘রঘু আপনাদের বাড়িতেও কাজ করে নাকি? ও তো আমাদের ওখানে থাকে,’ ঝট করে জবাব দিলেন মধুমিতার বাবা।
‘হুম। আপনাদের দুজনদের বাড়িতেই একটু যাওয়া দরকার দাদা,’ বললেন অফিসার।
সঙ্গে আবার বলে দিলেন, ‘চিন্তার কারণ নেই। সিভিল ড্রেসে যাব। পাড়ার কেউ বুঝতে পারবে না যে পুলিশ গেছে বাড়িতে!’ একটু হেসে বললেন অফিসার।
‘কেন স্যার?’ মধুমিতার মা জানতে চাইলেন।
‘একটু দেখার দরকার আছে। এখানের কাজ মিটে যাবে বোধহয় আপনাদের। তারপর যাব,’ ছোট্ট জবাব অফিসারের।
****
৭৮
ও সি-র ঘরে পাখা চলছে ফুল স্পীডে, কিন্তু দীপ্তি দরদর করে ঘামছে। ওর পিঠে ঘাম নেমে চলেছে শিরদাঁড়া বেয়ে – ব্লাউজের ভেতর দিয়ে, ব্রায়ের হুক পেরিয়ে ওর শাড়ি জড়ানো কোমরের কাছ অবধি।
ও সি একটু একটু কথা বলছেন আর দীপ্তিকে বেশী বলতে দিচ্ছেন – বিশেষত কাল সিংয়ের ফ্ল্যাটে যা যা হয়েছে।
একেবারে প্রথম থেকে – সেই কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার পর থেকেই ওর শরীরের অস্বস্তি, বাথরুমে যাওয়া সবই বলল। তারপরের অনেকটা অংশ – যেখানে সিংয়ের সঙ্গে ও পাগলের মতো রমন করছিল, সেই অংশটা খুব কম কথায় সেরে ফেলল – তবে বাইরের ঘরের এসে যে একবার ও স্মার্টফোনে ওর বাথরুমে যাওয়া আর তার পরের ভিডিয়োটা দেখেছিল, সেটা উল্লেখ করতে ভুলল না দীপ্তি।
‘আপনি কি কিছুই জানতেন না দীপ্তি দেবী? একজন স্বল্পপরিচিত লোকের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন সন্ধ্যেবেলায়?’ ও সি জিগ্যেস করলেন।
‘বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিচ্ছু জানতাম না। ইনফ্যাক্ট আমি ওকে এই প্রথম দেখছি। একটা রিপোর্ট নিয়ে উনি যেতে বলেছিলেন, সেজন্যই গিয়েছিলাম। আর সুমনা যখন বলল, তখন আরও কিছু সন্দেহ করি নি।‘
‘ঠিক আছে আপনি আসুন এখন।‘
ও সি এবার সুতনু আর দীপ্তনুদের নিয়ে বসবে। তারপর ধরবে সিংকে।
তার আগে টেকনিক্যাল অফিসারকে ডেকে নিলেন। ও কী কী জানতে পারল জেনে নেওয়া দরকার।
সে ব্রিফিং করার পরে ও সি অনুমতি দিলেন অভি, মনি আর মধুমিতার বাড়িতে সরেজমিনে ঘুরে আসার জন্য। আর তারপর আলিপুরের ফ্ল্যাটে যাবেন, সেটাও জানিয়ে দিলেন ও সি।
‘তবে এখন তুমি আমার ঘরেই বস। সুতনু আর দীপ্তনুকে গ্রিল করতে হবে। ও মালগুলো টেকনিক্যাল ছেলে, আমাকে ঘোল খাইয়ে দেবে।‘
বেল দিলেন ও সি । একজন কনস্টেবলকে বললেন দীপ্তনু আর সুতনুকে নিয়ে এস এখানে।
ওদের যে ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে যখন দু তিনজন কনস্টেবল ওদের নিয়ে এসে ও সি-র ঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন হঠাৎই মধুমিতা আঁতকে উঠল।
‘সুতনুউউউউ... তু--- মি?’
ওর বাবা মা আগে খেয়াল করেন নি। মেয়ের গলা পেয়ে তাকিয়ে দেখেন, ‘আরে সুতনু.. তুমি? কী হয়েছে? তুমি এখানে কেন?’
সুতনু মাথা নামিয়ে নিয়েছে। সঙ্গের পুলিশ কনস্টেবল একটু ঠেলা দিয়ে বলল, ‘চলুন চলুন।‘
মধুমিতা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে, সঙ্গে ওর উদভ্রান্ত বাবা-মা-ও। যে ছেলেকে জামাই করার কথা ভাবনা চিন্তা করছিলেন, সে থানায়... পুলিশ ধরে রেখেছে!
ওদের পেছন পেছন মধুমিতাও ও সি-র ঘরে ঢুকল। সঙ্গে ওর বাবা মা-ও।
ততক্ষনে ও সি-র ঘরের একপাশে দাঁড় করানো হয়েছে ওদের। ও সি হঠাৎ আরও তিনজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়াতে বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনারা কে? কী ব্যাপার?’
তরুণ টেকনিক্যাল অফিসার বললেন, ‘ওই মধুমিতা নামের মেয়েটি। ওর বাবা মা।‘
‘ও। আপনারা বাইরে বসুন। পরে কথা বলছি।‘
‘স্যার সুতনু এখানে কেন? মধুমিতার বাবা জিগ্যেস করলেন – এখনও উদভ্রান্ত।
ভুরু কোঁচকালেন ও সি সাহেব।
‘চেনেন নাকি একে?’ অবাক ও সি।
‘স্যার অনেক দিন ধরে। প্রায় দু বছর। মেয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ও। ওর কী হয়েছে? এখানে কেন ও?’ কোনওমতে বললেন মধুমিতার মা।
মধুমিতা গোটা সময়টাই সুতনুর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। উত্তেজনায় ওর বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে। টেকনিক্যাল অফিসার আড়চোখে দেখে নিলেন সেটা।
ততক্ষনে ও সির ঘরের দরজায় দীপ্ত-শ্রী-দীপ্তি-অভি-মনি সবাই এসে দাঁড়িয়েছে।
দীপ্তনু একটু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সুতনুর মাথা মেঝের দিকে।
ও সি একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘যে কেসের ব্যাপারে আপনারা এসেছেন, ওকেও সেইজন্যই আনা হয়েছে। তবে আপনাদের আর ওর রোলটা ডিফারেন্ট। আপনারা ভিকটিম আর ওরা দুই ভাই ক্রিমিনাল। এখন প্লিজ বাইরে যান। পরে কথা বলছি।‘
মধুমিতা হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, দীপ্ত পেছন থেকে ধরে ফেলল মেয়েটিকে।
তারপর সবাই মিলে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দেওয়া হল। ও যখন চোখ খুলল, তখন দেখল ওর মায়ের চোখে জল। বাবা আগের থেকেও বেশী উদভ্রান্ত!
***
৭৯
তনিমা ওরফে সাবিনা যে ঘরটায় বসেছিল, সেখানে এখনও একজন মহিলা কনস্টেবল। সে-ই তাকে সকালে চা, জলখাবার এনে দিয়েছে। সেসব খেয়ে সাবিনা মনে মনে ভাবছিল ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
ওর বরের অ্যাক্সিডেন্টের আগের কথা, সিংয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা, উনার সঙ্গে সেক্স করার অসাধারণ উত্তেজনাময় মুহুর্তগুলোর কথা, তারপরে সুতনুর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার কথা – সবই মনে পড়ছিল ওর। সিংয়ের সঙ্গে প্রথম প্রথম যেগুলো করেছিল, সেগুলো তো নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু তারপরে যখন ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করল লোকটা, তখন থেকে ও আর সেক্স স্বাভাবিকভাবেই এঞ্জয় করতে পারত না। শুধু মুখ বুজে, লোকলজ্জার ভয়ে মেনে নিত। সেই সময়ে যখন সিং ওর ভেতরে ঢোকাতেন, তখন ভেতরটা আর ভিজত না। শুকনো গুদে বাঁড়া দিয়ে গুঁতো খেতে খেতে ওর চোখে জল এসে যেত।
তবে সুতনুর সঙ্গে ও বরাবরই এঞ্জয় করত সেক্সটা। কম বয়স, স্বামীহারা, শরীরের খিদে তো থাকবেই। তারপর একই বাড়িতে দিনের পর দিন থাকছে একটা যুবকের সঙ্গে !
কলকাতায় আসার পরে প্রথম বেশ কিছুদিন ও সবসময়ে মন মরা হয়েই থাকত। একদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে হঠাৎই সুতনু পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে।
প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল সাবিনা। সিংয়ের কাছে ধোঁকা খেয়ে ওর তখন পুরুষজাতিটার প্রতিই বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল।
সুতনু পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে যখন নিজের কোমরটা ওর পেছনে চেপে ধরেছিল, তখনই ঘুরে ঠাস করে একটা চড় মেরেছিল। তখনও বাংলা বলতে পারে না ও। হিন্দীতেই একটা গাল দিয়েছিল সুতনুকে।
ছেলেটাও রোজ রোজ বাড়িতে একটা একা যুবতী পেয়ে ভেবেছিল নিজের চাহিদা পূরণ করে নেবে।
চড় খেয়ে একটু ঘাবড়ে সেদিন চলে গিয়েছিল সুতনু।
সেই রাতে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সাবিনা। ওর স্বামীর ওপরে ভীষন রাগ হচ্ছিল সেই রাতে। হঠাৎ করে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল সে!
বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে কাঁদছিল। সুতনু ঘরে এসে ঢুকেছিল অনেক পরে। বাইরে থেকে ওর হাল্কা কান্নার শব্দ পেয়ে।
সাবিনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল ধীরে ধীরে।
হাতের ছোঁয়া পেয়ে ও বুঝেছিল কে এসেছে, তবে এবার আর বাধা দেয় নি সুতনুকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতেই ও ঠিক করে নিয়েছিল, ওর ভবিষ্যতটা তো গেছেই সিংয়ের হাতে। শরীরের চাহিদা কেন মিটিয়ে নেবে না!
ওর কান্না ধীরে ধীরে থেমে এসেছিল সেরাতে। তারপর থেকে ওরা দুজনেই দুজনকে উপভোগ করত নিয়মিত।
সেই সবই আজ সাবিনার মনে পড়ছিল থানায় বসে।
তবে ও যে নিজের মনের জোরে ওই জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, এর জন্য ওর নিজেকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
সাবিনা যখন এইসব ভাবছিল, তখনই মধুমিতাকে ধরাধরি করে ও সি-র ঘরের বাইরে নিয়ে আসছিল দীপ্ত আর অভি।
মধুমিতাকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরে পেছন পেছন তরুণ টেকিনিক্যাল অফিসারও গেল ও সি-র ঘরের বাইরে।
শ্রী ঘটনা পরম্পরায় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল।
দীপ্তি আর মনি দুজনে এক বোতল জল যোগাড় করে আনল। মধুমিতাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল বেঞ্চে। ওর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিলেন ওর মা। দীপ্তি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
ধীরে ধীরে মধুমিতা চোখ খুলল।
চোখের সামনে সবাইকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল। তারপরে নিজেকে সামলে নিল ও। একটু লজ্জাও পেল।
‘আমি ঠিক আছি। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল বোধহয়,’ খুব ধীরে শুধু এটুকুই বলতে পারল মধুমিতা।
***
৮০
শ্রীকান্ত কাপুর আবারও মোবাইলটা হাতে তুলল। সকাল থেকে এই নিয়ে এগারো বার হল। রিং হয়ে কেটে গেল, কেউ তুলল না ফোনটা। কাল রাত থেকেই এক অবস্থা! না হলেও ৫০-৬০ বার চেষ্টা করেছেন মি. কাপুর – ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরে নি।
কাল রাত থেকেই মনে একটা অস্বস্তি কাজ করছে – ফোনটা কেউ ধরছে না কেন!
এদিকে বিকেল চারটের সময়ে দুবাইয়ের ফ্লাইট। এখন সাড়ে বারোটা বাজতে চলল। এবার হোটেল থেকে বেরনো উচিত উনার। এর আগের বারও যখন ম্যাঙ্গালোর থেকে দুবাই গেলেন মি. কাপুর, সেবারও প্রায় ফ্লাইট মিস হয়ে যায় – এত ট্র্যাফিক জ্যাম হয় আজকাল এয়ারপোর্টের রাস্তায়।
মি. কাপুর হোটেলের ঘরের সোফা থেকে উঠলেন। বড় বড় সুটকেশ দুটো খুলে একবার দেখে নিলেন সব ঠিক আছে কী না। নিশ্চিন্ত হয়ে রিসেপশনে ফোন করলেন একটা বয় পাঠানোর জন্য। একটা ট্যাক্সিও যে লাগবে, সেটাও জানালেন। হোটেলের টাকাপয়সা আগেই মেটানো হয়ে গেছে।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই বয়টা চলে এলো। দুটো বড় সুটকেস সে নিল, আর ছোট হাতব্যাগটা নিজের কাছেই রাখলেন মি. কাপুর।
বয়টাই জানালো যে ট্যাক্সি চলে আসবে এক্ষুনি।
রিসেপশানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে কোট-টাই পড়ে থাকা ছেলেটি বলল, ‘নেক্সট কবে আসছেন স্যার? এবার তো বেশ কিছুদিন পরে এলেন!’
‘দেখি কবে আসা হয়। দুবাই থেকে ফিরতে পারি কবে, সেটা আগে দেখি। ওখানে এখন অনেক কাজ,’ রিসেপশানের ছেলেটিকে জবাব দিলেন হোটেলের অনেক পুরণো কাস্টমার মি. কাপুর।
মুম্বই থেকে দুবাই যাওয়ার জন্য তিনি সবসময়ে ম্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টই ব্যবহার করেন। মুম্বইতে ঝামেলা বেশী।
ট্যাক্সিতে যখন বড় সুটকেস দুটো তুলছে বয়টা, তখনই মোবাইল বেজে উঠল।
তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মি. কাপুর দেখলেন কলকাতার কোনও ল্যান্ডলাইন নম্বর। বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বললেন মি. কাপুর।
ট্যাক্সির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে দারোয়ান। কিন্তু মি. কাপুরের পা আর নড়ছে না। ঘামতে শুরু করেছেন তিনি।
ফোনটা পকেটে পুরে একটা সিগারেট ধরালেন। একটু দ্রুত ভেবে নিতে হবে।
এয়ারপোর্ট দিয়ে দুবাই যাওয়া এখন কতটা উচিত হবে, সেটাই ভেবে নিতে চাইছেন উনি।
তাহলে কি কোচিন চলে যাব? নায়ারের কাছে? মনে মনে হিসাব কষছেন কাপুর।
যা ঠিক করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। এক বার যখন এরা ফোন নম্বর পেয়ে গেছে, তখন খুঁজে বার করতে খুব বেশী সময় লাগবে না ওদের। কয়েকটা ফোন করলেই ওদের কাজ শেষ।
আর তাহলেই কাপুরের ব্যবসাও শেষ – এতদিন ধরে তিল তিল করে যেটা গড়ে তুলেছিলেন ছোটবেলার বন্ধু আর সব রকমের বদ কাজের সঙ্গীর সঙ্গে।
রিসেপশানে ফিরে এলেন কাপুর।
ছেলেটিকে জিগ্যেস করলেন, ‘গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে খুব তাড়াতাড়ি? আমাকে হঠাৎ একটা কাজে কোচিন যেতে হবে।‘
রিসেপশানের ছেলেটি বলল, ‘এক মিনিট স্যার। ফোন করে জেনে নিচ্ছি।‘
এক মিনিটের আগেই সে ফোনের রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার পাওয়া যাবে। এখনই আসতে বলব?’
কাপুর মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই সে ফোনে নির্দেশ দিল গাড়ি পাঠানোর।
‘স্যার আপনি বসুন একটু। গাড়ি চলে আসবে।‘
বয়টার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যারের সুটকেসগুলো নামিয়ে আনো আর ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দাও।‘
কাপুর রিসেপশানের সামনের সোফায় বসে সিগারেট ধরালেন আবারও একটা। ফোনটা বার করতে গিয়ে কী ভেবে রেখে দিলেন।
নায়ারের ফোন নম্বরটা উনার মুখস্ত। রিসেপশানে গিয়ে বললেন, ‘আমার মোবাইলে সিগনাল পাচ্ছি না। তোমাদের ফোনটা ব্যবহার করতে পারি?’
‘হ্যাঁ স্যার করুন না, কি আছে?’
নায়ারের নম্বর ডায়াল করলেন কাপুর।
খুব কম কথায় জানালেন যে তাঁকে যেতে হচ্ছে নায়ারের আশ্রয়ে। অনেকদিনের পুরণো ব্যবসার সঙ্গী নায়ারের ভরসা পেয়ে কিছুটা যেন টেনশন কাটল কাপুরের।
ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই বাইরে দেখলেন একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
রিসেপশানের ছেলেটি বলল, ‘স্যার আপনার গাড়ি এসে গেছে। এদের গ্যারাজ একেবারে পাশেই। হ্যাপি জার্নি স্যার।‘
কাপুর হোটেলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ড্রাইভারের সঙ্গে মালিকও এসেছে ভাড়া নিয়ে কথা বলতে। এগারো-বারো ঘন্টার রাস্তা - দশ হাজার টাকা ভাড়া চাইল লোকটা।
রাজি হয়ে গেলেন কাপুর।
বেশী সময় নষ্ট না করে কাপুর রওনা দিলেন হোটেল থেকে।
মাঝপথেই একটা পুলিশের জীপ দেখলেন কাপুর। উনি যে রাস্তা দিয়ে এসেছেন, সেদিকেই চলে গেল জীপটা।
একটু বেশী তাড়াতাড়িই গেল না জীপটা!
ধুর ফালতু টেনশন করছি আমি, মনে মনে বললেন উনি। কোথায় না কোথায় গেল জীপটা আর উনার মনে হচ্ছে হোটেলের দিকেই যাচ্ছে!
‘আমার মেয়ে আর দীপ্তির ছেলে ছোটবেলার বন্ধু। একই সঙ্গে বড় হয়েছে। এখন ওরা প্রায় অ্যাডাল্ট। এই বয়সের যা স্বভাব, ওই একটু ক্লোজনেস-টেস আর কি – ওদের মধ্যে আছে। কাল রাতে আমার স্ত্রীকে একটা অদ্ভূত কথা জানিয়েছে মেয়ে। ও আর অভি নাকি নিজেদের মধ্যে খুব পার্সোনাল কিছু ছবি এক্সজেঞ্জ করেছিল – বুঝতেই পারছেন কীধরনের ছবি – সেগুলো নাকি কোনও পর্ণ সাইটে চলে গেছে – ওদের মেসেঞ্জার হ্যাক করে,’ একটানা কথাগুলো বলে একটু থামল দীপ্ত।
দীপ্তিকে থানায় আসার আগে এত ডিটেলসে বলে নি শ্রী। শুধু বলেছে ওদের ছেলে মেয়েরা একটা বড় ঝামেলায় পড়েছে। সব থানায় গিয়েই শুনতে পাবে ও।
শ্রী শুরু করল এবার, “এছাড়াও আমার মেয়ে মনি আরও একটা কথা জানিয়েছে। অভিকে কোনও মহিলা নাকি বাড়িতে ডেকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে দিয়ে খারাপ কাজ করেছে আর সেটার ভিডিয়ো-ও ওই সব বাজে সাইটে তুলে দিয়েছে। ওই মহিলার স্বামীও নাকি তখন বাড়িতে ছিলেন। তবে কনিকা নামের ওই মহিলা নাকি অলরেডি স্বামী বরে পরিচয় দেওয়া ওই লোকটাকে আপনাদের দিয়ে অ্যারেস্ট করিয়েছে। কীসব ঝামেলায় পড়লাম বলুন তো।‘
দীপ্তি অবাক হয়ে শুনছিল শ্রী-র কথা গুলো।
‘তুই এসব কী বলছিস শ্রী? আমি তো এসব বিন্দুবিসর্গও জানি না! অবাক হয়ে কেটে কেটে কথাগুলো বলল দীপ্তি।
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ খুললেন ও সি সাহেব। ‘আপনার অবাক হওয়ার এখনও বাকি আছে দীপ্তি দেবী।‘
দীপ্ত আর শ্রীর দিকে তাকিয়ে ও সি সাহেব বললেন, ‘একটা বড় গ্যাঙ অপারেট করছে এই পর্ন ভিডিয়ো তৈরীর কাজে। দীপ্তি দেবীর ছেলের ব্যাপারে যার নাম বললেন, কনিকা – উনি এগিয়ে না এলে এর হদিশই পেতাম না আমরা। উনাকে ব্ল্যাকমেল করে এইসব করাচ্ছিল কয়েকজন। বিরাট কীর্তি এদের। সবটা আমরাও এখনও জানি না। তবে দীপ্তি দেবী – এর একটা বড় মাথা হল আপনাদের এন জি ও-র বড় সাহেব সিং।‘
এবার শ্রী আর দীপ্তর অবাক হওয়ার পালা। দীপ্তি আবারও মনে মনে ও সি সাহেবকে ধন্যবাদ দিলেন যে ওই সিংয়ের ফ্ল্যাটেই যে ও-ও ছিল সেটা বন্ধু আর তার বরের সামনে প্রকাশ না করার জন্য।
তবে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল দীপ্তি, ‘কী বলছেন মি. সিং এসবে জড়িত?’
‘বললাম না দীপ্তি দেবী, অবাক হওয়ার এখনও অনেক বাকি আছে। কেসটা প্রথমে যখন পেলাম আমি নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আর ইনভেস্টিগেশন যত এগোচ্ছে, ততই অবাক হচ্ছি। এরা যে কতদূর কী জাল ছড়িয়েছে, তার হদিস পেতে অনেক দেরী – সম্ভবত। তবে আপনারা যে এগিয়ে এসে একটা নতুন ইনফরমেশন দিলেন, অনেক ধন্যবাদ। এই টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো আমি একেবারেই বুঝি না। এরজন্য একজন অন্য অফিসার আছে। ও চলে আসবে একটু পরেই। ও এলে আমি আবার আপনাদের সঙ্গে বসব। ডিটেলস কথা হবে। এখন একটু চা খান। তবে চিন্তা করবেন না, এদের তল আমি খুঁজে বার করবই। বাই দ্য ওয়ে দীপ্তি দেবী – আপনাদের অফিসের যে ভদ্রমহিলা একটু আগে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কী কাল রাতে আপনার কোনও কথা হয়েছে?’ শেষ প্রশ্নটা দীপ্তির দিকে তাকিয়ে করা।
‘হ্যাঁ। আমি ফোন করেছিলাম বাড়ি গিয়ে,’ কথাটা বলতে বলতে মাথা নামিয়ে নিল দীপ্তি।
শ্রী আর ওর বরের সামনে আর কিছু বলল না – ওরা তো এখনও জানে অফিসের গাড়ির ড্রাইভার অসভ্যতা করেছিল। কিন্তু মি. সিংকে যে পুলিশ নিয়ে গেছে, সেটা তো ও-ই সুমনাকে জানিয়েছিল।
‘হুম। আপনারা কাইন্ডলি একটু বাইরে বসুন। আপনাদের ছেলে মেয়েদের একটু পাঠিয়ে দিন। আপনাদের সামনে হয়তো সব কথা খোলাখুলি বলতে কমফর্টেবল ফীল করবে না ওরা। আপনাদের চা বাইরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি,’ বললেন ও সি।
দীপ্তি, দীপ্ত আর শ্রী বেরিয়ে যাওয়ার সেকেন্ড তিরিশেকের মধ্যেই ছেলেমেয়ে দুটি ঢুকল ঘরে।
‘বোসো,’ সামনের চেয়ারগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন ও সি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ অবজার্ভ করলেন ও সি সাহেব ওদের দুজনকে।
‘বলো শুনি তোমাদের কী সমস্যা হয়েছে,’ ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করতে বললেন ও সি।
‘স্যার আমি কাল আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলার বেশ কিছুক্ষণ পরেও মা বাড়ি ফিরছিল না দেখে আমাদের এক কমন বন্ধুকে ফোন করি, সেখান থেকে মনি জানতে পারে। ও তারপরে আমাদের বাড়িতে এসেছিল ও আসার একটু পরে আমি ওকে আপনার ফোন আসার কথা, থানায় আসার কথাগুলো বলি। ও তো আমার ছোটবেলার বন্ধু।‘
মনি শুরু করল, ‘এর আগে কাল সকালে কলেজে গিয়ে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারি যে আমার বেশ কিছু ছবি পর্ণ সাইটে চলে গেছে.. সেটা তখন আর...’
‘কী ধরণের ছবি?’ ও সি জানতে চাইলেন।
‘স্যার সেটা বলতে পারব না। খুব খুব পার্সোনাল ছবি,’ মনি বলল।
‘আমার কাছে কথা লুকলে কী করে হবে? দেখ মা তোমরা আমার ছেলেমেয়ের বয়সী। আবার আমাদের এত সব নোংরা ঘাঁটতে হয় যে ভাবতেও পারবে না। তবুও বলছি দ্বিধা না করে বলে ফেল। চিন্তা নেই,’ অভয় দিলেন ও সি।
মনি আর অভি দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর অভি মুখ খুলল, ‘স্যার ন্যুড ছবি।‘
‘হুম.. তা কলেজে তোমার বন্ধুটি দেখল কী করে? পর্ণ দেখার অভ্যেস আছে বুঝি?’
‘স্যার সেটা জানি না, অত জিগ্যেসও করি নি। কলেজে ঢুকেই ওই ছবি দেখে তো আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আরও একজনের ন্যুড ছবি ছিল –আমার আর অভিরই পরিচিত – মধুমিতাদি – অভিদের সিনিয়র,’ বলল মনি।
‘মধুরিমা আবার কে?’
‘স্যার আমাদের কলেজেই পড়ে দুবছরের সিনিয়র,’ জবাব দিল অভি।
‘তার সঙ্গেও ওইসব ছবি এক্সচেঞ্জ করেছিলে না কি ভাই অভি? তুমি তো জিনিয়াস!’ মন্তব্য করলেন ও সি সাহেব।
অভি আর মনি মাথা নামিয়ে নিল।
‘তা এই মধুমিতা মেয়েটি কোথায় থাকে?’ জিগ্যেস করলেন ও সি সাহেব।
‘স্যার কাছেই বাড়ি মধুদির,’ বলল অভি।
‘ডাকো ওকে ফোন করে।‘
অভি মধুমিতার নম্বরে ডায়াল করল মোবাইল থেকে।
‘স্পিকারটা অন করে দাও,’ আদেশ ও সি-র।
ওপার থেকে সাড়া এল, ‘হ্যাঁ বল অভি? তোরা কি থানায় পৌঁছে গেছিস? আমি বাবা-মার সঙ্গে আসছি।‘
ও সি ভুরুটা কোঁচকালেন একটু। ওই মেয়েটিরও যে থানায় আসার কথা রয়েছে, সেটা তো বলে নি এরা!
অভি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ মধুদি আমরা রয়েছি। আমার মা আর মনির বাবা মা দুজনেই আছে। ও সি সাহেবকে তোমার কথা বলতে তিনিই বললেন ফোন করতে।‘
‘ও। আসছি আমরা এক্ষুনি।‘
অভি চোখ তুলে ও সি র দিকে তাকাল পরের নির্দেশ কী, সেটা জানতেই বোধহয়।
ও সি ইশারা করলেন ফোন রেখে দেওয়ার জন্য
অভি বলল, ‘ঠিক আছে তোমরা এস।‘
ও সি জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে আসার আগে তোমাদের সঙ্গে ওই মেয়েটির কথা হয়েছে, সেটা আগে বললে না তো!’
‘স্যার আপনি তো বললেন ফোন করতে! আর আমরা থানায় আসব বলেছিলাম মধুদিকে, ও আসবে জানতাম না,’ জবাব দিল মনি।
‘হুম। তা তোমরা ওইসব ছবি কী দিয়ে এক্সচেঞ্জ করেছিলে?’
দুজনে প্রায় একসঙ্গেই বলল, ফেসবুক মেসেঞ্জার।
‘হুম।‘
‘স্যার আপনি যখন আমাকে কাল ফোন করে কনিকাদির কথা বললেন, থানায় আসতে বললেন, তার একটু পরেই মনি এসেছিল বাড়িতে। তখনই ওকে ব্যাপারটা বলি আমি। তারপর ও কাল কলেজে যেসব ছবি দেখেছে ওর নিজের আর মধুদির, সেগুলো দেখায় আমাকে,’ একটানা কথাগুলো বলে থামল অভি।
এবার মনি শুরু করল, ‘তখনই আমরা ডিসিশান নিই যে আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমি আমার মাকে বাড়ি এসে সব কিছু জানাই। তারপর মা বাবা আলোচনা করে এখানে এসেছে।‘
‘তোমার মা জানেন ব্যাপারটা?’ অভির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন ও সি।
‘আমি ঠিক জানি না। শ্রীমাসি, মানে মনির মা বলেছে কী না জানি না। কাল অত রাতে বাড়ি ফিরেছে, ওরকম একটা ঘটনার পরে, আমি বলি নি কিছু আর,’ জবাব দিল অভি।
‘শোনো একটু ডিটেলসে বলি তোমাদের। একটা কোনও বড় র্যা কেট কাজ করছে এখানে – যারা বিভিন্নভাবে ছবি, ভিডিয়ো তুলে পর্ণ সাইটে দিচ্ছে। বিরাট ব্যবসা। আমরা কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করেছি। তা তোমার ওই কনিকা বৌদি এগিয়ে না এলে কিন্তু আমরা ব্যাপারটা জানতেই পারতাম না। তুমি যেদিন উনার বাড়িতে গিয়েছিলে, সেদিন কনিকার স্বামীর নাম করে একজন ছিল সেখানে, তাই না?’
‘হ্যাঁ স্যার। তবে আমার জ্ঞান হওয়ার পরে আর উনাকে দেখি নি,’ বলল অভি।
‘কনিকা আর ওর আসল স্বামী আসবে একটু পরেই। তোমাদের সব আই ডি গুলো আমাদের এক টেকনিক্যাল অফিসারকে দিয়ে দেবে। মনে হচ্ছে কোনওভাবে তোমার ফেসবুক আই ডি হ্যাক করা হয়েছে। তোমার কাছে যা যা ছবি আসছে – ওদের যেগুলো দরকার – সব তুলে নিচ্ছে। ভেব না। তোমাদের যা ব্যাপার, তার থেকেও বড় সমস্যা রয়েছে এই কেসে,’ ও সি অভয় দিলেন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুটিকে।
‘স্যার আমরা বুঝতে পারি নি ব্যাপারটা এরকম হয়ে যেতে পারে। আসলে আমরা একটু মজা করার জন্য করেছিলাম,’ বলল মনি।
‘ঠিক আছে ঠিক আছে বাবা। ভুল হয়। এবার থেকে শিখে নাও – ইন্টারনেটের যা দুনিয়া। কত যে অপরাধী ওঁত পেতে বসে আছে এখানে! এখন যাও বাইরে গিয়ে বস। আমাদের টেকনিক্যাল অফিসার তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন একটু পরে। আর তোমার মা-কে পাঠিয়ে দাও তো একটু,’ বললেন ও সি ।
ওরা বেরিয়ে গেল। বাইরে তখন দীপ্ত, শ্রী আর দীপ্তির পাশে এক তরুণ অফিসার বসে কথা বলছিলেন। মাকে যখন বলতে যাবে অভি যে তোমাকে ও সি সাহেব ডাকছেন, তখনই থানার গেটে গাড়ি থেকে নামল মধুমিতা, ওর বাবা আর মা। কিছুটা উদভ্রান্ত চেহারা সকলেরই।
অভি গলা নামিয়ে দীপ্তিকে বলল, ‘তোমাকে ও সি সাহেব ডাকছেন ভেতরে।‘
দীপ্তি বলল, ‘একা যাব?’
অসহায়ের মতো শ্রীর দিকে তাকাল দীপ্তি।
বন্ধুর হাতে একটা চাপ দিয়ে বলল শ্রী, ‘কিছু হবে না। আমরা এখানেই তো আছি।‘
দীপ্তি ভেতরে চলে গেল।
মধুমিতা এগিয়ে এসে মনিকে জড়িয়ে ধরল। ওর বাবা মা পেছনে।
মধু আলাপ করিয়ে দিল, ‘আমার বাবা মা – এটা অভি, আমাদের কলেজে পড়ে ফার্স্ট ইয়ার, এটা মনি – ওর বন্ধু।‘
কথাটা বলে বেঞ্চে বসে থাকা মনির বাবা-মায়ের দিকে তাকাল মধু।
মনি বলল, ‘আমার বাবা-মা’
শ্রী একটু অবাক হয়ে তাকাল। মনে মনে ভাবল, এই মেয়েটি আবার কে? অভির কলেজে পড়ে? সে থানায় কেন?
মধুমিতার বাবা মা একটু উদভ্রান্ত। ওর মা শ্রীর পাশে বসতে বসতে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো ভাই! মেয়ে আজ সকালে বলল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না এ কি আবার সম্ভব নাকি?’
শ্রী বলল, ‘আমি নিজেও জানি না দিদি কীভাবে কী সম্ভব। তবে আজকাল যা হচ্ছে, কিছুই বোধহয় অসম্ভব নয়।‘
শ্রী মেয়ে আর অভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের সঙ্গে কী কথা হল? বললি সব?’
‘হুম’ জবাব দিল মনি।
‘তোমরা একটু আমার সঙ্গে পাশের ঘরে এস। সব টেকনিক্যাল ডিটেলসগুলো জানতে হবে কে কোথা থেকে হ্যাক করল তোমাদের আই ডি,’ বললেন টেকনিক্যাল অফিসার।
পাশের ঘরে গিয়ে আরও ডিটেলসে সব তথ্য জানাল ওরা দুজন। অনেক নোটস নিচ্ছিলেন অফিসার।
কথার মধ্যেই মধুমিতার প্রসঙ্গ আসায় ওকেও ডেকে নিলেন অফিসার।
কী একটা ভাবতে ভাবতে মনিকে বললেন, ‘তোমার আর মধুমিতার বাবা-মাকে একটু ভেতরে আসতে বল তো! তোমরা তিনজন বাইরেই বস একটু।‘
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে পকেট থেকে একটা লিস্ট বার করলেন অফিসার। কয়েকটা জায়গায় পেনের দাগ দিলেন। ঠিকই সন্দেহ করেছেন উনি।
দীপ্তি তখনও ও সি-র ঘরে। দীপ্ত, শ্রী আর মধুমিতার বাবা মা এই ঘরে ঢুকলেন।
‘বসুন প্লিজ,’ সামনের চেয়ারগুলো দেখিয়ে দিলেন তরুণ অফিসার। শ্রী বেশ কয়েকবার তাকাল ছেলেটির দিকে। বেশ হ্যান্ডসাম! চেহারাটাও পেটানো। মনে মনে বলল শ্রী। ওর গালে একটু হাল্কা লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল?
‘আপনাদের ছেলে মেয়েরা একটা বড়সড় র্যাাকেটে ফেঁসে গেছে।‘ শুরু করলেন অফিসার।
মধুমিতার বাবা মা প্রথম থেকেই একটু উদভ্রান্ত ছিলেন।
বললেন, ‘র্যা -কে-ট? কীসের র্যা কেট স্যার?’
‘চিন্তা করবেন না। এটা আকছার হচ্ছে আজকাল। ফেসবুক বা মেইল আই ডি হ্যাক করে ছবি বা ইনফরমেশন বার করে নিচ্ছে ক্রিমিনালরা। তবে এই ব্যাপারটা একটু আলাদা। আপনাদের বুঝিয়ে বলি। যতটা আমরা ইনভেস্টিগেশান করে পেয়েছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে এটা একটা পর্ণ র্যা কেট। এরা পর্ণ ফিল্মের ব্যবসা করে। এখনও আমাদের অনেক কিছু জানতে বাকি। তবে আপনাদের চিন্তার কারণ নেই। কয়েকজন চাঁই অ্যারেস্ট হয়েছে। সামলে নেব। তবে একটা কথা বলুন তো গত বছর খানেকের মধ্যে আপনাদের বাড়িতে ইলেট্রিকের কোনও কাজ হয়েছে?’ জানতে চাইলেন অফিসার।
দীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ, হয়েছে তো। রঘু আমাদের পাড়ার মিস্ত্রী। ও-ই সব কাজ করে। মাস ছয়েক আগে এ সি লাগিয়েছি, তখন ওয়্যারিং তো ও-ই করেছে।‘
‘রঘু আপনাদের বাড়িতেও কাজ করে নাকি? ও তো আমাদের ওখানে থাকে,’ ঝট করে জবাব দিলেন মধুমিতার বাবা।
‘হুম। আপনাদের দুজনদের বাড়িতেই একটু যাওয়া দরকার দাদা,’ বললেন অফিসার।
সঙ্গে আবার বলে দিলেন, ‘চিন্তার কারণ নেই। সিভিল ড্রেসে যাব। পাড়ার কেউ বুঝতে পারবে না যে পুলিশ গেছে বাড়িতে!’ একটু হেসে বললেন অফিসার।
‘কেন স্যার?’ মধুমিতার মা জানতে চাইলেন।
‘একটু দেখার দরকার আছে। এখানের কাজ মিটে যাবে বোধহয় আপনাদের। তারপর যাব,’ ছোট্ট জবাব অফিসারের।
****
৭৮
ও সি-র ঘরে পাখা চলছে ফুল স্পীডে, কিন্তু দীপ্তি দরদর করে ঘামছে। ওর পিঠে ঘাম নেমে চলেছে শিরদাঁড়া বেয়ে – ব্লাউজের ভেতর দিয়ে, ব্রায়ের হুক পেরিয়ে ওর শাড়ি জড়ানো কোমরের কাছ অবধি।
ও সি একটু একটু কথা বলছেন আর দীপ্তিকে বেশী বলতে দিচ্ছেন – বিশেষত কাল সিংয়ের ফ্ল্যাটে যা যা হয়েছে।
একেবারে প্রথম থেকে – সেই কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার পর থেকেই ওর শরীরের অস্বস্তি, বাথরুমে যাওয়া সবই বলল। তারপরের অনেকটা অংশ – যেখানে সিংয়ের সঙ্গে ও পাগলের মতো রমন করছিল, সেই অংশটা খুব কম কথায় সেরে ফেলল – তবে বাইরের ঘরের এসে যে একবার ও স্মার্টফোনে ওর বাথরুমে যাওয়া আর তার পরের ভিডিয়োটা দেখেছিল, সেটা উল্লেখ করতে ভুলল না দীপ্তি।
‘আপনি কি কিছুই জানতেন না দীপ্তি দেবী? একজন স্বল্পপরিচিত লোকের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন সন্ধ্যেবেলায়?’ ও সি জিগ্যেস করলেন।
‘বিশ্বাস করুন স্যার, আমি কিচ্ছু জানতাম না। ইনফ্যাক্ট আমি ওকে এই প্রথম দেখছি। একটা রিপোর্ট নিয়ে উনি যেতে বলেছিলেন, সেজন্যই গিয়েছিলাম। আর সুমনা যখন বলল, তখন আরও কিছু সন্দেহ করি নি।‘
‘ঠিক আছে আপনি আসুন এখন।‘
ও সি এবার সুতনু আর দীপ্তনুদের নিয়ে বসবে। তারপর ধরবে সিংকে।
তার আগে টেকনিক্যাল অফিসারকে ডেকে নিলেন। ও কী কী জানতে পারল জেনে নেওয়া দরকার।
সে ব্রিফিং করার পরে ও সি অনুমতি দিলেন অভি, মনি আর মধুমিতার বাড়িতে সরেজমিনে ঘুরে আসার জন্য। আর তারপর আলিপুরের ফ্ল্যাটে যাবেন, সেটাও জানিয়ে দিলেন ও সি।
‘তবে এখন তুমি আমার ঘরেই বস। সুতনু আর দীপ্তনুকে গ্রিল করতে হবে। ও মালগুলো টেকনিক্যাল ছেলে, আমাকে ঘোল খাইয়ে দেবে।‘
বেল দিলেন ও সি । একজন কনস্টেবলকে বললেন দীপ্তনু আর সুতনুকে নিয়ে এস এখানে।
ওদের যে ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে যখন দু তিনজন কনস্টেবল ওদের নিয়ে এসে ও সি-র ঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন হঠাৎই মধুমিতা আঁতকে উঠল।
‘সুতনুউউউউ... তু--- মি?’
ওর বাবা মা আগে খেয়াল করেন নি। মেয়ের গলা পেয়ে তাকিয়ে দেখেন, ‘আরে সুতনু.. তুমি? কী হয়েছে? তুমি এখানে কেন?’
সুতনু মাথা নামিয়ে নিয়েছে। সঙ্গের পুলিশ কনস্টেবল একটু ঠেলা দিয়ে বলল, ‘চলুন চলুন।‘
মধুমিতা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে, সঙ্গে ওর উদভ্রান্ত বাবা-মা-ও। যে ছেলেকে জামাই করার কথা ভাবনা চিন্তা করছিলেন, সে থানায়... পুলিশ ধরে রেখেছে!
ওদের পেছন পেছন মধুমিতাও ও সি-র ঘরে ঢুকল। সঙ্গে ওর বাবা মা-ও।
ততক্ষনে ও সি-র ঘরের একপাশে দাঁড় করানো হয়েছে ওদের। ও সি হঠাৎ আরও তিনজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়াতে বিরক্ত হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনারা কে? কী ব্যাপার?’
তরুণ টেকনিক্যাল অফিসার বললেন, ‘ওই মধুমিতা নামের মেয়েটি। ওর বাবা মা।‘
‘ও। আপনারা বাইরে বসুন। পরে কথা বলছি।‘
‘স্যার সুতনু এখানে কেন? মধুমিতার বাবা জিগ্যেস করলেন – এখনও উদভ্রান্ত।
ভুরু কোঁচকালেন ও সি সাহেব।
‘চেনেন নাকি একে?’ অবাক ও সি।
‘স্যার অনেক দিন ধরে। প্রায় দু বছর। মেয়ের খুব ঘনিষ্ঠ ও। ওর কী হয়েছে? এখানে কেন ও?’ কোনওমতে বললেন মধুমিতার মা।
মধুমিতা গোটা সময়টাই সুতনুর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক চোখে। উত্তেজনায় ওর বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে। টেকনিক্যাল অফিসার আড়চোখে দেখে নিলেন সেটা।
ততক্ষনে ও সির ঘরের দরজায় দীপ্ত-শ্রী-দীপ্তি-অভি-মনি সবাই এসে দাঁড়িয়েছে।
দীপ্তনু একটু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সুতনুর মাথা মেঝের দিকে।
ও সি একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘যে কেসের ব্যাপারে আপনারা এসেছেন, ওকেও সেইজন্যই আনা হয়েছে। তবে আপনাদের আর ওর রোলটা ডিফারেন্ট। আপনারা ভিকটিম আর ওরা দুই ভাই ক্রিমিনাল। এখন প্লিজ বাইরে যান। পরে কথা বলছি।‘
মধুমিতা হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল, দীপ্ত পেছন থেকে ধরে ফেলল মেয়েটিকে।
তারপর সবাই মিলে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দেওয়া হল। ও যখন চোখ খুলল, তখন দেখল ওর মায়ের চোখে জল। বাবা আগের থেকেও বেশী উদভ্রান্ত!
***
৭৯
তনিমা ওরফে সাবিনা যে ঘরটায় বসেছিল, সেখানে এখনও একজন মহিলা কনস্টেবল। সে-ই তাকে সকালে চা, জলখাবার এনে দিয়েছে। সেসব খেয়ে সাবিনা মনে মনে ভাবছিল ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
ওর বরের অ্যাক্সিডেন্টের আগের কথা, সিংয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা, উনার সঙ্গে সেক্স করার অসাধারণ উত্তেজনাময় মুহুর্তগুলোর কথা, তারপরে সুতনুর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার কথা – সবই মনে পড়ছিল ওর। সিংয়ের সঙ্গে প্রথম প্রথম যেগুলো করেছিল, সেগুলো তো নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু তারপরে যখন ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করল লোকটা, তখন থেকে ও আর সেক্স স্বাভাবিকভাবেই এঞ্জয় করতে পারত না। শুধু মুখ বুজে, লোকলজ্জার ভয়ে মেনে নিত। সেই সময়ে যখন সিং ওর ভেতরে ঢোকাতেন, তখন ভেতরটা আর ভিজত না। শুকনো গুদে বাঁড়া দিয়ে গুঁতো খেতে খেতে ওর চোখে জল এসে যেত।
তবে সুতনুর সঙ্গে ও বরাবরই এঞ্জয় করত সেক্সটা। কম বয়স, স্বামীহারা, শরীরের খিদে তো থাকবেই। তারপর একই বাড়িতে দিনের পর দিন থাকছে একটা যুবকের সঙ্গে !
কলকাতায় আসার পরে প্রথম বেশ কিছুদিন ও সবসময়ে মন মরা হয়েই থাকত। একদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে হঠাৎই সুতনু পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে।
প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল সাবিনা। সিংয়ের কাছে ধোঁকা খেয়ে ওর তখন পুরুষজাতিটার প্রতিই বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল।
সুতনু পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে যখন নিজের কোমরটা ওর পেছনে চেপে ধরেছিল, তখনই ঘুরে ঠাস করে একটা চড় মেরেছিল। তখনও বাংলা বলতে পারে না ও। হিন্দীতেই একটা গাল দিয়েছিল সুতনুকে।
ছেলেটাও রোজ রোজ বাড়িতে একটা একা যুবতী পেয়ে ভেবেছিল নিজের চাহিদা পূরণ করে নেবে।
চড় খেয়ে একটু ঘাবড়ে সেদিন চলে গিয়েছিল সুতনু।
সেই রাতে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সাবিনা। ওর স্বামীর ওপরে ভীষন রাগ হচ্ছিল সেই রাতে। হঠাৎ করে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়ে চলে গেল সে!
বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে কাঁদছিল। সুতনু ঘরে এসে ঢুকেছিল অনেক পরে। বাইরে থেকে ওর হাল্কা কান্নার শব্দ পেয়ে।
সাবিনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল ধীরে ধীরে।
হাতের ছোঁয়া পেয়ে ও বুঝেছিল কে এসেছে, তবে এবার আর বাধা দেয় নি সুতনুকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতেই ও ঠিক করে নিয়েছিল, ওর ভবিষ্যতটা তো গেছেই সিংয়ের হাতে। শরীরের চাহিদা কেন মিটিয়ে নেবে না!
ওর কান্না ধীরে ধীরে থেমে এসেছিল সেরাতে। তারপর থেকে ওরা দুজনেই দুজনকে উপভোগ করত নিয়মিত।
সেই সবই আজ সাবিনার মনে পড়ছিল থানায় বসে।
তবে ও যে নিজের মনের জোরে ওই জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পেরেছে, এর জন্য ওর নিজেকেই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
সাবিনা যখন এইসব ভাবছিল, তখনই মধুমিতাকে ধরাধরি করে ও সি-র ঘরের বাইরে নিয়ে আসছিল দীপ্ত আর অভি।
মধুমিতাকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরে পেছন পেছন তরুণ টেকিনিক্যাল অফিসারও গেল ও সি-র ঘরের বাইরে।
শ্রী ঘটনা পরম্পরায় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল।
দীপ্তি আর মনি দুজনে এক বোতল জল যোগাড় করে আনল। মধুমিতাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল বেঞ্চে। ওর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিলেন ওর মা। দীপ্তি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।
ধীরে ধীরে মধুমিতা চোখ খুলল।
চোখের সামনে সবাইকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল। তারপরে নিজেকে সামলে নিল ও। একটু লজ্জাও পেল।
‘আমি ঠিক আছি। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল বোধহয়,’ খুব ধীরে শুধু এটুকুই বলতে পারল মধুমিতা।
***
৮০
শ্রীকান্ত কাপুর আবারও মোবাইলটা হাতে তুলল। সকাল থেকে এই নিয়ে এগারো বার হল। রিং হয়ে কেটে গেল, কেউ তুলল না ফোনটা। কাল রাত থেকেই এক অবস্থা! না হলেও ৫০-৬০ বার চেষ্টা করেছেন মি. কাপুর – ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরে নি।
কাল রাত থেকেই মনে একটা অস্বস্তি কাজ করছে – ফোনটা কেউ ধরছে না কেন!
এদিকে বিকেল চারটের সময়ে দুবাইয়ের ফ্লাইট। এখন সাড়ে বারোটা বাজতে চলল। এবার হোটেল থেকে বেরনো উচিত উনার। এর আগের বারও যখন ম্যাঙ্গালোর থেকে দুবাই গেলেন মি. কাপুর, সেবারও প্রায় ফ্লাইট মিস হয়ে যায় – এত ট্র্যাফিক জ্যাম হয় আজকাল এয়ারপোর্টের রাস্তায়।
মি. কাপুর হোটেলের ঘরের সোফা থেকে উঠলেন। বড় বড় সুটকেশ দুটো খুলে একবার দেখে নিলেন সব ঠিক আছে কী না। নিশ্চিন্ত হয়ে রিসেপশনে ফোন করলেন একটা বয় পাঠানোর জন্য। একটা ট্যাক্সিও যে লাগবে, সেটাও জানালেন। হোটেলের টাকাপয়সা আগেই মেটানো হয়ে গেছে।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই বয়টা চলে এলো। দুটো বড় সুটকেস সে নিল, আর ছোট হাতব্যাগটা নিজের কাছেই রাখলেন মি. কাপুর।
বয়টাই জানালো যে ট্যাক্সি চলে আসবে এক্ষুনি।
রিসেপশানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে কোট-টাই পড়ে থাকা ছেলেটি বলল, ‘নেক্সট কবে আসছেন স্যার? এবার তো বেশ কিছুদিন পরে এলেন!’
‘দেখি কবে আসা হয়। দুবাই থেকে ফিরতে পারি কবে, সেটা আগে দেখি। ওখানে এখন অনেক কাজ,’ রিসেপশানের ছেলেটিকে জবাব দিলেন হোটেলের অনেক পুরণো কাস্টমার মি. কাপুর।
মুম্বই থেকে দুবাই যাওয়ার জন্য তিনি সবসময়ে ম্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টই ব্যবহার করেন। মুম্বইতে ঝামেলা বেশী।
ট্যাক্সিতে যখন বড় সুটকেস দুটো তুলছে বয়টা, তখনই মোবাইল বেজে উঠল।
তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মি. কাপুর দেখলেন কলকাতার কোনও ল্যান্ডলাইন নম্বর। বোতাম টিপে ‘হ্যালো’ বললেন মি. কাপুর।
ট্যাক্সির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে দারোয়ান। কিন্তু মি. কাপুরের পা আর নড়ছে না। ঘামতে শুরু করেছেন তিনি।
ফোনটা পকেটে পুরে একটা সিগারেট ধরালেন। একটু দ্রুত ভেবে নিতে হবে।
এয়ারপোর্ট দিয়ে দুবাই যাওয়া এখন কতটা উচিত হবে, সেটাই ভেবে নিতে চাইছেন উনি।
তাহলে কি কোচিন চলে যাব? নায়ারের কাছে? মনে মনে হিসাব কষছেন কাপুর।
যা ঠিক করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। এক বার যখন এরা ফোন নম্বর পেয়ে গেছে, তখন খুঁজে বার করতে খুব বেশী সময় লাগবে না ওদের। কয়েকটা ফোন করলেই ওদের কাজ শেষ।
আর তাহলেই কাপুরের ব্যবসাও শেষ – এতদিন ধরে তিল তিল করে যেটা গড়ে তুলেছিলেন ছোটবেলার বন্ধু আর সব রকমের বদ কাজের সঙ্গীর সঙ্গে।
রিসেপশানে ফিরে এলেন কাপুর।
ছেলেটিকে জিগ্যেস করলেন, ‘গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে খুব তাড়াতাড়ি? আমাকে হঠাৎ একটা কাজে কোচিন যেতে হবে।‘
রিসেপশানের ছেলেটি বলল, ‘এক মিনিট স্যার। ফোন করে জেনে নিচ্ছি।‘
এক মিনিটের আগেই সে ফোনের রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার পাওয়া যাবে। এখনই আসতে বলব?’
কাপুর মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই সে ফোনে নির্দেশ দিল গাড়ি পাঠানোর।
‘স্যার আপনি বসুন একটু। গাড়ি চলে আসবে।‘
বয়টার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যারের সুটকেসগুলো নামিয়ে আনো আর ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দাও।‘
কাপুর রিসেপশানের সামনের সোফায় বসে সিগারেট ধরালেন আবারও একটা। ফোনটা বার করতে গিয়ে কী ভেবে রেখে দিলেন।
নায়ারের ফোন নম্বরটা উনার মুখস্ত। রিসেপশানে গিয়ে বললেন, ‘আমার মোবাইলে সিগনাল পাচ্ছি না। তোমাদের ফোনটা ব্যবহার করতে পারি?’
‘হ্যাঁ স্যার করুন না, কি আছে?’
নায়ারের নম্বর ডায়াল করলেন কাপুর।
খুব কম কথায় জানালেন যে তাঁকে যেতে হচ্ছে নায়ারের আশ্রয়ে। অনেকদিনের পুরণো ব্যবসার সঙ্গী নায়ারের ভরসা পেয়ে কিছুটা যেন টেনশন কাটল কাপুরের।
ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতেই বাইরে দেখলেন একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো।
রিসেপশানের ছেলেটি বলল, ‘স্যার আপনার গাড়ি এসে গেছে। এদের গ্যারাজ একেবারে পাশেই। হ্যাপি জার্নি স্যার।‘
কাপুর হোটেলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ড্রাইভারের সঙ্গে মালিকও এসেছে ভাড়া নিয়ে কথা বলতে। এগারো-বারো ঘন্টার রাস্তা - দশ হাজার টাকা ভাড়া চাইল লোকটা।
রাজি হয়ে গেলেন কাপুর।
বেশী সময় নষ্ট না করে কাপুর রওনা দিলেন হোটেল থেকে।
মাঝপথেই একটা পুলিশের জীপ দেখলেন কাপুর। উনি যে রাস্তা দিয়ে এসেছেন, সেদিকেই চলে গেল জীপটা।
একটু বেশী তাড়াতাড়িই গেল না জীপটা!
ধুর ফালতু টেনশন করছি আমি, মনে মনে বললেন উনি। কোথায় না কোথায় গেল জীপটা আর উনার মনে হচ্ছে হোটেলের দিকেই যাচ্ছে!