05-03-2019, 03:59 PM
ছেলেটা একটু দম নিয়ে শুরু করল। এখন আর ওর গলায় সেই জড়ানো ভাবটা নেই। পরিষ্কার গলা। “স্যার সংকেতের ক্লাসে র্যাগিং করতে গেছিল কয়েকজন। তাদের মধ্যে একজন ছিল দীপকের গার্লফ্রেন্ড। ভুল করে সংকেত ওর গায়ে পড়ে যায়। তারপর দীপকের কানে কথাটা যায়। ও চটে যায়। দীপক খুব ভালো বক্সার জানেন তো! দীপক ঠিক করল কলেজের পর সংকেতকে নিজের রুমে নিয়ে এসে আচ্ছাসে ধোলাই করবে। তারপর মুখে আলকাতরা মাখিয়ে হোস্টেল থেকে বের করে দেবে। সব তৈরি ছিল স্যার। ক্লাস শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে দীপকের ঘরে ওকে নিয়ে এলাম। দীপক সবাইকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলল। আমরা দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম দীপক ছেলেটাকে উত্তম মধ্যম দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দীপক ছেলেটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। আলকাতরা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তৈরি ছিলাম। কিন্তু দীপক বলল যে ছেলেটা অনিচ্ছাকৃত ভুলটা করেছে। ও দীপকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। ওকে দীপক মাপ করে দিয়েছে। ছেলেটা শিখার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেল।
সেদিন রাতে মদ খেতে বসে আমি দীপককে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেন ও সংকেতকে এত সহজে ছেড়ে দিল। ছেলেরা একটু ভয় পেলে ভোট আদায় করতে সুবিধা হয় জানেনই তো। তখন ঘরে আরও দুই তিন জন ছেলে ছিল। দীপক ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল যে ছেড়ে দিলাম কারণ এর থেকে বেশী ক্যালালে ছেলেটা প্রানে মরে যেত। তাহলে আবার অন্য আরেক কেস। এমনিতেই তো জানিস পার্টির সাথে আমার ঝামেলা চলছে। তাই ছেড়ে দিলাম। আর এই সব ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করার কোনও মানে নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর বাকি ছেলেগুলো বিদায় নিলে আবার কথায় কথায় সংকেতের প্রসঙ্গ ওঠে। দুজনেই তখন নেশায় চুড় হয়ে আছি। ওকে বললাম যাই বলো না কেন বস তোমার হাত কিন্তু হেভি ভারী। বাইরে থেকে শব্দ পাচ্ছিলাম। দীপক হঠাৎ করে ভেঙ্গে পড়ল। ও তক্ষুনি আমাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলল। বেচারা তখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। স্যার সত্যি বলছি দীপককে কোনও দিনও কাঁদতে দেখিনি। ও গেঞ্জি খুলে পিছন ফিরে দাঁড়াল। স্যার। বিশ্বাস করবেন না। পুরো পিঠে কালশিটে পড়ে গেছে। ও ওই অবস্থাতেই বসে পড়ে বলল যে ও খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। সংকেত ঘরে ঢোকার পর আমরা বেরিয়ে যাই। তারপর দীপক সংকেতের মুখোমুখি হতেই সংকেত ওর মাথার দুপাশে দুই হাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে বাড়ি মারে। দীপক চোখে অন্ধকার দেখে। দীপকের ভাষায় যেন শক্ত লোহার রড দিয়ে ওর মাথার দুপাশে বাড়ি মারা হয়েছে। তারপর ওর মাথার চুল ধরে ওকে নিচু করে ওর পিঠে দুমাদ্দুম বসিয়ে চলে। আমরা বাইরে থেকে যে শব্দগুলো শুনছিলাম, সেইগুলো দীপকের পিঠে পড়ছিল। দীপক কয়েক সেকন্ডের মধ্যে জ্ঞান হারায়। ওকে সংকেত উঠিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ পরিষ্কার করে আসতে বলে।
সংকেত নাকি ওকে বলেছিল যে ও একজন প্রফেশনল অ্যাসাসিন। ও যদি একটু এধার ওধার ঘুষিগুলো বসাত তো এক ঘুষিতেই দীপকের প্রাণ বেরিয়ে যেতে পারত। দীপক নিজে বক্সার, স্যার। ও বুঝেছিল যে সংকেত সত্যি কথাই বলেছে। আর সংকেত এও জানিয়ে দিয়েছিল যে এর পর থেকে ওর চরেরা দীপকের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখবে। একটুও বেচাল দেখলে ওকে মেরে ফেলে দেবে। তারপর দীপককে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। আমাদের মিনিস্টার রঞ্জন মুখার্জি পার্টির লোকের সাথে বসে মিটিং করছে। খুব সম্ভবত বাড়িতে। ওখানে দীপককে নিয়ে কথা হচ্ছে। খুব শিগগির দীপককে সরিয়ে অন্য লোক আনতে হবে, এই ওদের কথা বার্তার টপিক। দীপক জিজ্ঞেস করেছিল যে এই ক্লিপ সংকেতের কাছে এলো কি করে। তাতে নাকি সংকেত বলেছিল যে ও যত্র তত্র সর্বত্র বিরাজ করে। দীপককে ও বলে যে শান্তনু মুখার্জি আমেরিকা থেকে কাল দেশে ফিরছে। রঞ্জন মুখার্জির ঝাল ওর ছেলের ওপর দিয়ে মেটালে সংকেত দীপককে ২০ হাজার টাকা দেবে। ১০ হাজার আগাম। ১০ হাজার কাজ শেষের পর। দীপক প্রথমে রাজি হয়নি। সংকেত তাতে ওকে বলেছিল যে এখন ও জেনে গেছে সংকেত শান্তনু মুখার্জিকে খুন করাতে চায়। সুতরাং ওর হাতে এখন দুটোই রাস্তা। হয় সংকেতের কথা মেনে চলা। অথবা... ও তো আর সারাদিন এই ঘরের মধ্যে পড়ে থাকতে পারবে না স্যার। বাইরে বেরলেই খতম হয়ে যাবে। সংকেতের শাখা প্রশাখা কতদূর ছড়িয়ে আছে সেটা কল্পনা করাও কঠিন। ভয় পেয়ে দীপক রাজি হয়।
সংকেত নাকি ১০ হাজার টাকা দিয়ে ওকে বলেছিল যে কবে কখন কিভাবে মারতে হবে সেই উপায় সংকেতই ওকে বাতলে দেবে। আর এই বলে দীপককে শাসিয়ে দিয়ে যায় যে বাইরে কোনও কিছু লিক হলেও ওর আয়ু শেষ। আর কাজ ঠিক মতন হলে আরও টাকা পাবে। দীপক ওকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল কেন ও শান্তনু মুখার্জিকে খুন করাতে চায়। সংকেত সে কথার কোনও উত্তর দেয়নি। এর থেকে বেশী আমি আর কিছু জানি না স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার। আর প্লীজ সংকেত যেন জানতে না পারে যে আমি আপনাদের ওর ব্যাপারে বলেছি। ছেলেটা ডেঞ্জারাস। দীপকের মতন একটা লাশকে যে এইভাবে পেটাতে পারে... “ কথাগুলো যখন হচ্ছিল তখন লাহিড়ী ফিসফিস করে জানিয়ে দিল যে দীপকের পিঠের ওই ঘায়ের দাগ ওরাও দেখেছে। রিপোর্টেও লেখা আছে। ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার বেরা ফোন কেটে দিলেন। সব কথা রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছে।
৪৩
ফোন কেটেই আরিফ উঠে দাঁড়িয়েছেন। “স্যার এইবার ওয়ারেন্ট বের করুন।” মিস্টার বেরা একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন “ হেয়ার সে র ওপর ভিত্তি করে, সরি পরোক্ষ হেয়ার সে র ওপর ভিত্তি করে কাউকে গ্রেফতার করে কোর্টে হাসির খোরাক হতে চাও। এখনও বুঝতে পারছ না যে ও জানত যে কখনও না কখনও এই সব কিছু আমরা জানতে পারব। কিন্তু তবুও আমরা কিছু করতে পারব না। কোর্টে কেস উঠলে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে ও। ওর বিরুদ্ধে এই ছেলেটার দেওয়া জবানবন্দি গ্রাহ্যই হবে না। কোর্টে হেয়ার সে-ই গ্রাহ্য হয় না। আর এটা তো আবার পরোক্ষ হেয়ার সে। আর তাছাড়া ভুলে যেও না সংকেত একা নয়। ওর অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ আছে। কাজের জিনিসগুলো কার কাছে আছে সেটাও আমরা জানি না। ওদের সবাইকে একসাথে ধরতে হবে। নইলে আসল জিনিসটা বেহাত হয়ে যাবে। চলো এইবার কাজের কথায় ফেরা যাক। ২৩ নম্বর পয়েন্টটা আরেকবার গুছিয়ে নেওয়া যাক।
২৩… আপাত ভাবে সংকেতের কথা শুনে সবার মনে হয়েছিল যে সংকেত দীপককে মিস্টার মুখার্জির লোকদের থেকে সাবধান করে দিচ্ছে। কিন্তু দীপক সংকেতের কথার আসল মানে বুঝতে পারল। ও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে দীপক বাইরে বেরোলে সংকেত বা সংকেতের লোক ওকে মেরে ফেলবে। তার থেকে বেটার সুইসাইড করে নেওয়া। সেই ইঙ্গিতই সংকেত দীপককে দিয়ে এসেছিল।
২৪। সবাই তখন দীপকের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ব্যস্ত ভাবে। সবাই দীপকের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে। কি লাহিড়ী ঠিক বলছি কি না? (লাহিড়ী নিরবে মাথা নাড়াল।) এটাই স্বাভাবিক। তখন তোমরা কেউ সংকেতের হাতের দিকে খেয়াল করেছিলে? (লাহিড়ী মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল যে আমার হাতের দিকে ও লক্ষ্য করেনি) সংকেত যখন দীপকের বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখনই কোনও এক সময় ফাঁকে পিস্তলটা ওর চাদরের নিচে গুঁজে দিয়ে চলে আসে। এছাড়া আর কোনও সমাধান হতেই পারে না। ওই ছেলেটাকে তোমরা বেকার এতদিন ধরে আটকে রেখেছ।
২৫। সংকেতের ভয় দীপককে তখন সম্পূর্ণ ভাবে গ্রাস করেছে। সংকেতের লোকেদের হাতে মরতে হলে মরবার আগে ওকে আর কোন কোন যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে কে জানে। তার থেকে এই ভালো। সংকেতের দেওয়া পিস্তল দিয়ে সুইসাইড করল। সাথে সাথে শান্তনু মুখার্জির চ্যাপটারও ক্লোস হয়ে গেল। সংকেত যে এই কাণ্ডের হোতা সেই ব্যাপারে আর একটাও প্রত্যক্ষদর্শী রইল না। অর্থাৎ দীপক নেমে গেল সংকেতের ঘাড় থেকে।
২৬। শান্তনু মুখার্জি মারা গেল, তার কয়েক ঘণ্টা পর সংকেতের প্ল্যান অনুযায়ী রঞ্জন মুখার্জিও মারা গেল। মিস্টার মেহেরা এখন সংকেতের চোখের সামনে। আমার বাড়িতে ঢোকার সব বন্দবস্ত মোটামুটি পাকা। সুতরাং শেষ কাজটা যেটা বাকি রইল সেটা হল মিস্টার মুখার্জির বাড়ি থেকে ফাইলটা… সরি ফাইলগুলো হাতিয়ে নেওয়া। দোলন মুখার্জি সংকেতের বন্ধু। রঞ্জন মুখার্জির মৃত্যুর পর সংকেত যে ওদের বাড়িতে যাতায়াত করবে সেটা তো বলাই বাহুল্য। আর সেই সময়ই কোনও এক সুযোগে… অবশ্য হোটেল ছেড়ে বেরনোর আগে ওই জানতে পারে যে ওইদিনই ফিউসটা এসে মিস্টার মেহেরার হাতে পৌঁছেছে। ভোর রাতে বাকি ফাইলগুলোর সাথে সেটাকে ও সরিয়ে নিল।
২৭। সংকেত যেমনটা চেয়েছিল সব তেমন তেমনই হয়ে গেল। শুধু আমার বাড়িতে যে কারণে প্রবেশ করেছিল সেটা করে উঠতে পারল না। এতগুলো ফাইলের র্যাকের মধ্যে থেকে শুধু ওই ফাইলগুলো খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগবে। ফাইল খোঁজার সময় সঞ্চিতার হাতে ধরা পড়ে গেলে তো কথাই নেই। কিন্তু এদিকে জানতে পেরেছে আমি ফিরে আসছি। সুতরাং যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। সংকেত চলে গেল কলেজে। ওর এক সাকরেদ এসে হানা দিল আমার কাজের ঘরে। ঠিক সেই সময় আমি ফিরে এলাম। আর … (নিজের মাথার ব্যান্ডেজের দিকে ইশারা করে বাকি কথাগুলো উনি অসমাপ্ত রাখলেন) তবে যা খুঁজতে এসেছিল, সেগুলো নিয়ে লোকটা সরে পড়েছে। সুতরাং এই টার্গেটও অ্যাচিভড।
২৮। আর গতকাল আমি ফিরে আসছি জেনেই ও ১৫ই আগস্ট গিয়ে একজন মস্ত বড় উকিলের সাথে আগে ভাগে দেখা করে এলো। মিস্টার সত্যজিৎ ধর। আজ খেয়াল করেছিলেন নিশ্চই, মিস্টার ধর তার পুরো টিম নিয়ে থানার ক্যাম্পাসের বাইরে গোটা সময়টা দাঁড়িয়েছিল? বেচাল কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন ওকে ওখানে দেখে আমি কারণ ঠিক বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি। মিস্টার ধরকে আগে ভাগেই সংকেত বুক করে এসেছিল ১৫ তারিখ সকালে গিয়ে। তার চাক্ষুষ প্রমান ওর গোটা ফ্যামিলি। সংকেত ওর সাথে খুব মিস বিহেভ করেছে সেটাও ওনার মিসেস আমাদের লোককে বলেছে। মাথায় নাকি এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছিল ঘুম কাটানোর জন্য। আর ফর সাম রিসন মিস্টার ধর সংকেতকে খুব ভয় পায়। এটাও ওর স্ত্রী আমাদের জানিয়েছে।
মিস্টার বেরা ফাইনালি থামলেন। মিস্টার রাহাকে জিজ্ঞেস করলেন “বলুন এইবার। কিছু অ্যাড বা মাইনাস করতে চান? আর কিছু ভুল বললে সেটাও বলতে পারেন।” মিস্টার রাহা একটু চিন্তা করে বললেন “ কেন জানি মনে হচ্ছে এখনও কয়েকটা জিনিস জানা বাকি রয়ে গেল। মোটের ওপর এই হাইপোথিসিস ঠিক। কিন্তু স্টিল কয়েকটা খটকা আছে। দীপকের বন্ধুর কাছ থেকে যেমন ওই ইনফরমেশনটা ক্লিয়ার কাট পাওয়া গেল তেমনই আরও কয়েকটা ইনফরমেশন ক্লিয়ার কাট পেলে ভালো লাগত।”
মিস্টার বেরা বললেন “আপনি কোন কোন জিনিসের কথা বলছেন ঠিক জানি না। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমাকেও ভাবাচ্ছে। রঞ্জন মুখার্জির মৃত্যুর আগে সংকেত কিভাবে সেই ভিডিও ক্লিপটা পেল। বা ওদের কথা বার্তা রেকর্ডই বা করল কি করে? আমি যতদূর দেখেছি সংকেতের সিম লোকেশন অনুযায়ী ও রঞ্জন মুখার্জির মৃত্যুর দিন বিকাল বেলায় প্রথমবার মিস্টার মুখার্জির বাড়ি গেছে। “ পাশে বসে থাকা অফিসার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। মিস্টার আরিফ খান বললেন “স্যার, এটা তো সংকেতের কোনও সাকরেদের কাজও হতে পারে। তাই না?” মিস্টার বেরা আর মিস্টার রাহা দুজনেই এক সাথে মাথা নাড়লেন। মিস্টার রাহা বললেন “অ্যান এমফাটিক নো মিস্টার খান। মিস্টার বেরার বাড়ি আর মিস্টার মুখার্জির বাড়ি এক নয়। মিস্টার মুখার্জির জীবদ্দশায় ওই বাড়ির চারপাশে সারাক্ষন সিকিউরিটি মোতায়েন থাকত, সে উনি বাড়িতে থাকুন বা নাই থাকুন। মিস্টার খান,ব্যাপারটাকে এত সহজ ভাবলে চলবে না। আর তাছাড়া মিস্টার খান, আমি আপনাকে একটা কোশ্চেন মার্ক লিখতে বলেছিলাম মনে আছে? সেই পয়েন্টটা একবার পড়ে শোনাবেন?” মিস্টার খান বললেন “মিস্টার বেরার হাইপোথিসিস অনুযায়ী মালিনীর কাছ থেকে কোনও মতে ও (সংকেত) জানতে পারল যে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা কাজ করে না।” মিস্টার রাহা বললেন “আমার প্রশ্ন কি করে জানতে পারল?”
মিস্টার বেরা বললেন “ হতে পারে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের সময়, বা মন ভোলানো কথা বলার সময় কোনও ভাবে মালিনীর পেট থেকে সেই কথা বের করে নিয়েছে। আমরা তো জানি মালিনীর সাথে সংকেতের একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল। ওদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ছিল কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও, কিছুটা ঘনিষ্ঠতা তো ছিলই।” মিস্টার রাহা বললেন “ তাহলে মালিনী কেন সম্পূর্ণ ভাবে জিনিসটা অস্বীকার করল ওর ম্যানেজারের সামনে? মালিনী নিজের ম্যানেজারকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। আর সব সময় এরকম ভাবার কারণ নেই যে মালিনী নিজের অজান্তে ভুল করেছে। অন্য দিক থেকেও ব্যাপারটা ভাবা যেতে পারে। একটু মন দিয়ে আমার কথা গুলো এইবার শুনুন। ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা অন থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার, নয় কি? এই নিয়ে কথা বলারই বা কি আছে? সংকেত হঠাৎ করে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরার প্রসঙ্গ ওঠাতে যাবেই বা কেন? আর এটাও মোটামুটি মেনে নেওয়া যেতে পারে যে কোনও রুম বয়কে হাত করে সংকেত এই তথ্য বের করতে পারবে না। কারণ রুম বয়দের কেউ ব্যাপারটা জানতই না। ওরা ভি আই পি দের আগমনের ব্যাপারে কথা চালাচালি করলেও করতে পারে, কিন্তু ক্যামেরা অফ, সেটা কি করে জানবে?”
সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে দেখে মিস্টার রাহা বললেন “ ইনফ্যাকট সংকেত যে জাতের ধুরন্ধর তাতে ওর যদি ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা নিয়ে কোনও বক্তব্য থাকতও, তবুও সে সেটা মালিনীর সামনে বলত না, আমার বিশ্বাস মালিনী কেন কারোর সামনেই বলত না। কারণ তাতে মালিনীর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। এই জাতের ক্রিমিনালরা একটাও ভুল করে না মিস্টার বেরা। তার নজির তো দেখতেই পাচ্ছেন। সব বুঝতে পারছি, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছি যে এইসব তথ্য নিয়ে কোর্টে যেতে পারব না। একটু অন্য ভাবে ভাবা দরকার বইকি।” মিস্টার বেরা নিজের গ্লাসে পানীয় ঢালতে ঢালতে বললেন “ আপনার এই ব্যাপারে কিছু বক্তব্য থাকলে বলে ফেলুন।” মিস্টার রাহা বললেন “আপনার মতন পয়েন্ট বাই পয়েন্ট বলার দরকার নেই। কিন্তু শুরু থেকে সংকেতের কাজ কর্মের যা প্যাটার্ন, সেটা দেখেই আমার মনে হয়েছে এখানেও কোনও না কোনও ভাবে স্পাই ক্যাম আর মাইক্রোফোনের কেরামতি আছে। দেখুন সংকেত যেখানে যেখানে নিজের পায়ের ধুলো রেখেছে তার অধিকাংশ জায়গায় এই সব সেট করে রেখে দিয়ে গেছে। হতে পারে এই দুই ক্ষেত্রেও…আর তাছাড়া শিখার মৃত্যুর ব্যাপারটা? সব বুঝেও অনেকগুলো ফাঁক থেকে গেছে, তাই না? বাট আই সাপোর্ট ইওর হাইপোথিসিস। ”
মিস্টার বেরা চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। সত্যি আর মাথা কাজ করছে না। মিস্টার রাহা এক মনে নিজের খালি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। ওনার পাশে বসা মিসেস রাহা টেবিলের ওপর মাথা রেখে কখন যে ঘুমের কোলে ঢোলে পড়েছেন কে জানে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে পাশে বসে থাকা সেই অফিসারটি চেঁচিয়ে উঠল “ইউরেকা” । এর উৎসাহের সত্যি কোনও সীমা পরিসীমা নেই। এত জোরে ও চেঁচিয়ে উঠেছে যে মিসেস রাহাও ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসেছেন। মিস্টার বেরা বললেন “আআআআহ। একটু আসতে। মিসেস রাহা একটু রেস্ট নিচ্ছিলেন। কি পেয়েছ?” ওই অফিসারের চোখ জ্বলছে, ঠোঁটের কোণে বিজয়ীর হাসি। সবাই ধড়ফড় করে উঠে ওই অফিসারের ল্যাপটপের উপরে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। সবার ব্রেন টায়ার্ড আর চোখের সামনে একগুচ্ছ নাম্বার আর লোকেশন। কেউ কিছুই বুঝতে পারল না।
মিস্টার বেরা বললেন “তুমি ওই হোয়াইট বোর্ডে গিয়ে তোমার পয়েন্ট গুলো একটু জট ডাউন করো, আমি ততক্ষণে একটু হালকা হয়ে আসছি। আরিফ দরজাটা বন্ধ করে দাও। থানায় বসে মদ খাচ্ছি, এই খবর মিডিয়া জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। উনি বেরিয়ে গেলেন। ওনার ফিরতে একটু সময় লাগলো। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর বুঝতে পারলেন যে সত্যি কিছু ঘটে গেছে এই কয়েক মিনিটে। সবাই আবার নিজেদের পানীয় ঢালতে ব্যস্ত। এমনকি মিসেস রাহাও নিজের গ্লাসে পানীয় ঢালছেন। উনি রুমাল দিয়ে চোখের কোটরটা ভালো করে পরিষ্কার করে হোয়াইট বোর্ডের দিকে চেয়ে দেখলেন। এইগুলো হাইপোথিসিস নয়। জলজ্যান্ত প্রমান।
১। ওই দুর্ঘটনার রাতে(যেদিন শান্তনু মুখার্জি মারা যায়) আমি যে শিখার বাড়ি গেছিলাম সেটা রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট… (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃএটা জানা তথ্য)
২। ওই দুর্ঘটনার রাতে দোলন, রাকা আর আমি যে মধ্য রাত্রি অব্দি জল বিহার করেছিলাম সেই তথ্য আবিষ্কৃত। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ এত রাতে এরা কি করছিল। সেখানে কি হয়েছিল জানা দরকার। রাকা, দোলনকে ডাকতে হবে)
৩। ১৫ইআগস্ট, দুপুর ২.৪৫। এটা ওই ১৫০ টা অচেনা নাম্বারের মধ্যে একটা নাম্বারের ব্যাপারে রিপোর্ট। সিকয়েন্স কিছুটা এরকমঃ-
--অচেনা নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে একটা এস এম এস আসে। আমার মোবাইল লোকেশন তখন ওর লোকেশনের খুব কাছে।
--মিনিট দশেকের মধ্যে আমার সিমের লোকেশন আর ওই নাম্বারের লোকেশন এক হয়ে যায়। মিনিট দশেক দুটো সিমের লোকেশন এক ছিল। এবং একই জায়গায়। দুটোই স্থির।
-- তারপর আবার দুটো সিম দু-দিকে মুভ করে। আমার সিমটা চলে যায় দোলনের বাড়ির দিকে। আর অন্য সিমটা চলে যায় শিখার বাড়ির দিকে। শিখার বাড়ির লোকেশনে পৌঁছে ওই মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে একটা কল আসে। আর তারপরেই সিমটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ মোবাইল থেকে সিমটা খুলে ফেলা হয়। যে মোবাইল সেট থেকে এই কলটা এসেছিল সেটাও একই সাথে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
-- ঠিক সেই সময় আরেকটা নাম্বার (ওই ১৫০ টা অচেনা নাম্বারের মধ্যেই একটা নাম্বার) অন্য আরেকটা আই এম ই আই থেকে জেগে ওঠে শিখার বাড়ির লোকেশনে। সেই সিমটা অনেক রাত অব্দি চালু ছিল এবং ওই একই লোকেশনে স্থির হয়ে ছিল।
-- নাম্বার চালু হওয়ার কিছুক্ষণ পর ওই মোবাইল/সিম থেকে প্রথম এস এম এস ঢোকে আমার মোবাইলে।
-- মাঝ রাত পার করে সিমটা আবার মুভ করা শুরু করে। ঠিক তখনই ওই সিম থেকে আমার মোবাইলে আরেকটা এস এম এস ঢোকে। ব্যস তারপরেই এই সিম আর এই মোবাইলটা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ খুব জরুরি তথ্য। আমাদের হাইপোথিসিস কি?)
৪। শিখা যেদিন মারা যায় সেদিনও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। সেই ১৫০ টা অচেনা নাম্বারের মধ্যে থেকে একটা অন্য নাম্বার একটা নতুন মোবাইল সেটে জেগে ওঠে শিখার বাড়ির ঠিক সামনে। সেই নাম্বার থেকে দুটো পর পর এস এম এস ঢোকে আমার মোবাইলে। তার পর গোটা রাত সব চুপচাপ। ঠিক ভোর ছটার দিকে আমার মোবাইলে আরেকটা এস এম এস ঢোকে ওই নাম্বার থেকে। তারপর একটা ১৫ সেকন্ডের কল আসে ওই সিম থেকে আমার সিমে। সিমটা ৮.০৫ মিনিটে ওই লোকেশন থেকে মুভ করতে শুরু করে। তারপরেই সিম আর মোবাইল একসাথে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ খুব জরুরি তথ্য। আমাদের হাইপোথিসিস কি?)
৫। আমার মোবাইলে সব থেকে বেশী এস এম এস করেছে রাকা। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ রাকার সাথে সংকেতের কি এত কথা? অন্য দিকে মালিনীও তো আছে?)
৬। দোলনও মাঝে সাঝে এস এম এস করেছে। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ দোলনের সাথে সংকেতের কি এত কথা? অন্য দিকে মালিনীও তো আছে?)
৭। মালিনীও মাঝে সাঝে এস এম এস করেছে। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃএটা জানা তথ্য)
৮। রঞ্জন মুখার্জি যেদিন মারা যান ঠিক তার দুদিন পরের ঘটনা। দুটো সিমের মধ্যে বিকাল থেকে এস এম এসের আদান প্রদান হয়। আমার সিম আর রাকার সিম অনেকক্ষণ ধরে লেকের (সেই লেক) মধ্যে একই লোকেশনে ছিল। এর পর দুটো সিমই পর পর লেকের বাইরে বেরিয়ে আসে। অল্প কিছুদূর গিয়ে সিম দুটো আবার স্থির হয়ে যায়। অনেক রাত অব্দি সিম দুটো একই লোকেশনে ছিল। পরে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ সেদিন গোটা শহর বিকালের পর বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল। রাকা আর সংকেত ওই লেকের ভেতর বসে কি করছিল?)
৯। ১৪ই আগস্ট বেলা মুখার্জির কাছ থেকে আমার সিমে একটা কল আসে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ মিসেস মুখার্জির সংকেতের সাথে কি দরকার থাকতে পারে? ১৫ই আগস্ট ওদের বাড়িতে নিয়ম ভাঙ্গার কাজ ছিল সেটা জানি। কিন্তু সেক্ষেত্রে মেয়ের বন্ধুকে নেমন্তন্ন করতে হলে সচরাচর মেয়েকেই কল করতে বলা হয়। অন্তত মেয়েকে কল করতে বলে, মেয়ের মোবাইল থেকেই মায়েরা মেয়ের বন্ধুর সাথে কথা বলে। বেলা মুখার্জি নিজে কেন সংকেতকে কল করতে গেলেন?)
১০। ১৫ ই আগস্ট রাত। আমার সিম ৮.১৮ তে মিসেস মুখার্জির বাড়ির লোকেশনে গিয়ে পৌঁছায়। তার আগে অব্দি অবশ্য আমার সিমটা মিস্টার বেরার বাড়ির চারপাশে এধার ওধার ঘুরে বেরিয়েছে। তিনটে সিম মধ্য রাত্রি অব্দি একই লোকেশনে ছিল। আমার সিম, সুধা সান্যালের সিম আর বেলা মুখার্জির সিম। (একই লোকেশন মানে একই বাড়ি নাও হতে পারে… প্লীজ খেয়াল রাখবেন।)
(মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ সংকেত সেদিন মিস্টার মুখার্জির বাড়ি গেছে সেটা আমাকে সঞ্চিতা জানিয়ে ছিল। সুধা সান্যালও যতদূর শুনেছি সেদিন ওই বাড়িতেই ছিলেন মিসেস মুখার্জির একাকীত্ব দূর করার জন্য। সংকেতকে খাবার জন্য নেমন্তন্ন করলে অত লেট হবে কেন? তিন জন মিলে এত রাত অব্দি কি করেছে? ফাইলটা কি সেদিনই সরিয়েছে? এমন ভাবার কারণ এই যে বাকি অন্য দিন গুলোতে যখন সংকেত ওদের বাড়ি গেছে তখন ওদের বাড়ির কাজের ব্যাপারে হেল্প করতে গেছে। আর সব সময় সংকেতের চারপাশে অনেক লোক ছিল। সংকেত প্রায় একাই সব জোগাড়যন্ত্র করেছে...বাকিদের বয়ান থেকে এই তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এইদিন বাড়িতে ছিল মাত্র তিন জন আর হয়ত চাকর বাকর। এত রাত অব্দি ওরা কি করছিল? )
১১। আমি প্রায় রোজ ভোরে যে মর্নিং ওয়াকে যাই, তার তথ্য এটা। যেই লেকের ধারে গিয়ে বসি, তার উল্লেখ আছে এখানে। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ আগামিকাল কুকুর নিয়ে গিয়ে এই লেকের চারপাশের জমির তল্লাশি নিতে হবে। )
এই অব্দি বোর্ডে লেখা আছে। মিস্টার বেরা ওই অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন “ইউ ডিসার্ভ অ্যা পার্টি মাই বয়। সত্যি অনেক গুলো লিঙ্ক খুঁজে বের করেছ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সবাই আরেকবার চিয়ার্স করে নতুন উদ্যমে মদ্যপান শুরু করতে যাচ্ছিল এই ভোর রাতে, কিন্তু মিস্টার বেরা ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের গ্লাস নামিয়ে রেখে দিলেন। “তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চাও।” ছেলেটা এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ও আরও কিছু বলতে চায়, কিন্তু সাহস করতে পারছে না। ছেলেটা কিছু একটা বলতে গিয়েও কথাটা গিলে নিয়ে বলল “না স্যার। তেমন কিছু নয়। “
মিস্টার রাহা বললেন “তোমার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুমি কিছু একটা চেপে যাচ্ছ হয় ভয়ে বা সংকোচে। যে সংকেত আমাদের এত বড় ক্ষতি করে এখনও ভালো মানুষ সেজে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে আর আমরা এখানে বসে মাথা ঠুকে মরছি তার ব্যাপারে প্লীজ কিছু গোপন করো না। যা বুঝতে পেরেছ বলে ফেলো। ইনফ্যাকট কারোর যদি আরও কিছু অ্যাড করার থাকে সেটা করে ফেলো। দুটো জিনিস মনে রেখো। সংকেতের যা দরকার সেটা ওর হাতে চলে এসেছে। আমাদের হাতে ওকে হাজতে ধরে রাখার মতন কোনও প্রমান নেই। ও নিখুঁত ভাবে দাবার গুঁটি সাজিয়েছে। আমি সিওর এখনও অনেক কিছু আমাদের জানা বাকি। এই কেসে বিস্ময়ের সীমা নেই। কিন্তু সেই সাথে এখন যেটা সব থেকে সিরিয়াস হয়ে উঠেছে সেটা হল ও এইবার একে একে ওর এক্সিট প্ল্যানগুলো এক্সিকিউট করবে। ও যে কি করবে বোঝা যাচ্ছে না। এত দিন ও আমাদের থেকে ১ নয় ১০ পা এগিয়ে ছিল। এখন আমরা সবাই ওকে ঘিরে ধরেছি, আর ও একা। এখনও কি আমরা পারব না ওকে বিট করতে? তাই যার যা মনে আছে, সব খুলে বলে ফেলো। ভুল হলে হোক। সে পরে ভেবে দেখা যাবে। বাট চেষ্টায় ত্রুটি রাখা যাবে না।” ছেলেটা ধীরে ধীরে বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একবার পিছনে ফিরে মিস্টার বেরার দিকে তাকিয়ে দেখল। ওনার ভুরু কুঁচকে রয়েছে। ছেলেটা লেখা শুরু করল।
১২। ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত্রির পর (মানে ইংরেজি মতে আফটার ১২ am, ১৫ই আগস্ট) মিসেস বেরার মোবাইল থেকে সংকেতের মোবাইলে পর পর দুটো এস এম এস ঢোকে। সংকেত তার রিপ্লাইও করে। প্রায় ভোর রাতের দিকে একটা নাম্বার থেকে মিসেস বেরার মোবাইলে একটা কল আসে। কলটা বেশ খানিকক্ষণ চলে। কলটা কাটার পর সেই একই নাম্বার থেকে সংকেতের মোবাইলে আরেকটা এস এম এস ঢোকে। এই সিমটা ১৪ই আগস্ট সন্ধ্যা থেকে মিস্টার বেরার বাড়ির পিছন দিকে যে বস্তিটা আছে সেই লোকেশনে ছিল। সংকেতকে এস এম এস করার পরের মুহূর্তেই সিম সমেত মোবাইল ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এখানে একটা কথা বলা দরকার। সিমটা চালু হয় সংকেত এখানে আসার ঠিক দিন দুয়েক পরে। সিমটা সব সময় আপনার বাড়ির আশে পাশেই ঘোরা ফেরা করত। ১৪ই আগস্টই ফার্স্ট ওর লোকেশন চেঞ্জ হয়। ওই বস্তিতে যায়। সেখানেই ছিল ভোর রাত অব্দি। তারপর সেই শেষ এস এম এসের পর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় পারমানেন্টলি। বলাই বাহুল্য এই নম্বর যে নামে বা ঠিকানায় রেজিস্টার্ড সেগুলো সব জালি।
(মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ সঞ্চিতা আর সংকেত এত রাতে এস এম এস করছিল কেন? ওরা জেগে থাকতে পারে। কিন্তু ছিল তো পাশা পাশি দুটো ঘরে। এস এম এস করে কথা বলার কি দরকার পড়ল? আর এই নাম্বার থেকে এত রাতে কলই বা এলো কেন? সঞ্চিতাকে ডাকতে হবে। ওই বাজার অঞ্চলে খোঁজ করে দেখতে হবে। বাড়ির পিছনে বস্তিতেও খোঁজ করে দেখতে হবে। খুবই জরুরি তথ্য।)
৪৪
উনি ওই অফিসারের দিকে ফিরে বললেন “এখানে আমার সিমও যদি কোনও ভাবে ইনভলভড বলে মনে হয়, সেটাও লোকাবে না। এটা আগেই লিখতে পারতে। আমি কিছু মনে করতাম না। এইবার চিয়ার্স। কোথায় কোথায় খোঁজ নিতে হবে মোটামুটি লেখা হয়ে গেছে। এইবার চটপট আমাদের হাইপোথিসিসগুলো সাজিয়ে ফেলি। মানে, যেগুলো নিয়ে আমরা কিছু সিদ্ধান্তে আসতে পারছি সেইগুলো নিয়ে।”
মিস্টার বেরা বললেন “ ৩ নম্বর অবসারভেশনের ব্যাপারে মিস্টার রাহা কিছু বলুন। এইবার আপনিই বলুন, আমি শুনব। “ মিস্টার রাহা বললেন “ ১২ই আগস্ট দুপুর বেলা …”। মিস্টার বেরা বাঁধা দিয়ে বললেন “তার আগে একটা জিনিস বলে দেওয়া ভালো। ওই দিনই দুপুর বেলা সংকেত আমার সাথেই বাড়ি থেকে লাঞ্চ সেরে বেরোয়। আমি গাড়ি ধরব। সংকেত মিস্টার মুখার্জির বাড়ি যাবে। আমার লাগেজ ও গাড়ি অব্দি এগিয়ে দিতে এসেছিল জল ভেঙ্গে। এক হাঁটুর ওপর জল ছিল বাড়ির সামনে। আমার সিম লোকেশন চেক করলে বুঝতে পারতে কিছুক্ষণ আগে অব্দি সংকেতের সিম আর আমার সিম একই জায়গায় ছিল। যা হয়েছে আমি ওখান থেকে গাড়ি চড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর হয়েছে। আর যে লোকেশনের কথা লেখা হয়েছে সেটা একটা খালি জায়গা, দোকান পাট ওখানে খুব একটা আছে বলে কোনও দিন দেখিনি। সুতরাং … নাউ ক্যারি অন।”
মিস্টার রাহা আবার শুরু করলেন “ মিস্টার বেরার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সংকেত মিস্টার মুখার্জির বাড়ির দিকে এগিয়ে পড়ে। রাস্তায় কোথাও একটা ওই অচেনা নাম্বার ধারীর সাথে দেখা করে। ওদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তারপর অচেনা নাম্বারের সিম নিয়ে একজন চলে যায় শিখার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর সংকেতের সিম নিয়ে একজন চলে যায় লেট মিস্টার মুখার্জির বাড়ির উদ্দেশ্য।” এখানে রবিন বাবু বলে উঠলেন “অর্থাৎ সংকেত ওই লোকের সাথে দেখা করে। দিয়ে সংকেত চলে যায় মিস্টার মুখার্জির বাড়ির দিকে আর সেই লোকটা চলে যায় শিখার বাড়ির দিকে। আমরা জানি সিম লোকেশন একই জায়গা দেখালেও সব সময় একই বাড়ি নাও হতে পারে, স্টিল, এই লোকেশনে খুব একটা কিছু বাড়ি ঘর বা দোকান পাট আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং আমরা ওখানে গিয়ে খোঁজ খবর নিতে পারি! “ মিস্টার বেরা হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন “ লাভ হবে না। তুমি মিস্টার রাহার কথার মানে ধরতে পারনি, বা বুঝতে পারোনি, বা এই অল্প খেয়েই তোমার চড়ে গেছে। আরিফ বুঝিয়ে দাও।” মিস্টার খান একটু নড়ে চড়ে বসে সামান্য একটু উসখুস করে চুপ মেরে গেলেন। বোঝা গেল, ঘরের কেউ ঠিক ব্যাপারটা ধরতে পারেনি।
সেদিন রাতে মদ খেতে বসে আমি দীপককে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেন ও সংকেতকে এত সহজে ছেড়ে দিল। ছেলেরা একটু ভয় পেলে ভোট আদায় করতে সুবিধা হয় জানেনই তো। তখন ঘরে আরও দুই তিন জন ছেলে ছিল। দীপক ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল যে ছেড়ে দিলাম কারণ এর থেকে বেশী ক্যালালে ছেলেটা প্রানে মরে যেত। তাহলে আবার অন্য আরেক কেস। এমনিতেই তো জানিস পার্টির সাথে আমার ঝামেলা চলছে। তাই ছেড়ে দিলাম। আর এই সব ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করার কোনও মানে নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর বাকি ছেলেগুলো বিদায় নিলে আবার কথায় কথায় সংকেতের প্রসঙ্গ ওঠে। দুজনেই তখন নেশায় চুড় হয়ে আছি। ওকে বললাম যাই বলো না কেন বস তোমার হাত কিন্তু হেভি ভারী। বাইরে থেকে শব্দ পাচ্ছিলাম। দীপক হঠাৎ করে ভেঙ্গে পড়ল। ও তক্ষুনি আমাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলল। বেচারা তখন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। স্যার সত্যি বলছি দীপককে কোনও দিনও কাঁদতে দেখিনি। ও গেঞ্জি খুলে পিছন ফিরে দাঁড়াল। স্যার। বিশ্বাস করবেন না। পুরো পিঠে কালশিটে পড়ে গেছে। ও ওই অবস্থাতেই বসে পড়ে বলল যে ও খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে। সংকেত ঘরে ঢোকার পর আমরা বেরিয়ে যাই। তারপর দীপক সংকেতের মুখোমুখি হতেই সংকেত ওর মাথার দুপাশে দুই হাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে বাড়ি মারে। দীপক চোখে অন্ধকার দেখে। দীপকের ভাষায় যেন শক্ত লোহার রড দিয়ে ওর মাথার দুপাশে বাড়ি মারা হয়েছে। তারপর ওর মাথার চুল ধরে ওকে নিচু করে ওর পিঠে দুমাদ্দুম বসিয়ে চলে। আমরা বাইরে থেকে যে শব্দগুলো শুনছিলাম, সেইগুলো দীপকের পিঠে পড়ছিল। দীপক কয়েক সেকন্ডের মধ্যে জ্ঞান হারায়। ওকে সংকেত উঠিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ পরিষ্কার করে আসতে বলে।
সংকেত নাকি ওকে বলেছিল যে ও একজন প্রফেশনল অ্যাসাসিন। ও যদি একটু এধার ওধার ঘুষিগুলো বসাত তো এক ঘুষিতেই দীপকের প্রাণ বেরিয়ে যেতে পারত। দীপক নিজে বক্সার, স্যার। ও বুঝেছিল যে সংকেত সত্যি কথাই বলেছে। আর সংকেত এও জানিয়ে দিয়েছিল যে এর পর থেকে ওর চরেরা দীপকের ওপর সর্বক্ষণ নজর রাখবে। একটুও বেচাল দেখলে ওকে মেরে ফেলে দেবে। তারপর দীপককে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়। আমাদের মিনিস্টার রঞ্জন মুখার্জি পার্টির লোকের সাথে বসে মিটিং করছে। খুব সম্ভবত বাড়িতে। ওখানে দীপককে নিয়ে কথা হচ্ছে। খুব শিগগির দীপককে সরিয়ে অন্য লোক আনতে হবে, এই ওদের কথা বার্তার টপিক। দীপক জিজ্ঞেস করেছিল যে এই ক্লিপ সংকেতের কাছে এলো কি করে। তাতে নাকি সংকেত বলেছিল যে ও যত্র তত্র সর্বত্র বিরাজ করে। দীপককে ও বলে যে শান্তনু মুখার্জি আমেরিকা থেকে কাল দেশে ফিরছে। রঞ্জন মুখার্জির ঝাল ওর ছেলের ওপর দিয়ে মেটালে সংকেত দীপককে ২০ হাজার টাকা দেবে। ১০ হাজার আগাম। ১০ হাজার কাজ শেষের পর। দীপক প্রথমে রাজি হয়নি। সংকেত তাতে ওকে বলেছিল যে এখন ও জেনে গেছে সংকেত শান্তনু মুখার্জিকে খুন করাতে চায়। সুতরাং ওর হাতে এখন দুটোই রাস্তা। হয় সংকেতের কথা মেনে চলা। অথবা... ও তো আর সারাদিন এই ঘরের মধ্যে পড়ে থাকতে পারবে না স্যার। বাইরে বেরলেই খতম হয়ে যাবে। সংকেতের শাখা প্রশাখা কতদূর ছড়িয়ে আছে সেটা কল্পনা করাও কঠিন। ভয় পেয়ে দীপক রাজি হয়।
সংকেত নাকি ১০ হাজার টাকা দিয়ে ওকে বলেছিল যে কবে কখন কিভাবে মারতে হবে সেই উপায় সংকেতই ওকে বাতলে দেবে। আর এই বলে দীপককে শাসিয়ে দিয়ে যায় যে বাইরে কোনও কিছু লিক হলেও ওর আয়ু শেষ। আর কাজ ঠিক মতন হলে আরও টাকা পাবে। দীপক ওকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল কেন ও শান্তনু মুখার্জিকে খুন করাতে চায়। সংকেত সে কথার কোনও উত্তর দেয়নি। এর থেকে বেশী আমি আর কিছু জানি না স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার। আর প্লীজ সংকেত যেন জানতে না পারে যে আমি আপনাদের ওর ব্যাপারে বলেছি। ছেলেটা ডেঞ্জারাস। দীপকের মতন একটা লাশকে যে এইভাবে পেটাতে পারে... “ কথাগুলো যখন হচ্ছিল তখন লাহিড়ী ফিসফিস করে জানিয়ে দিল যে দীপকের পিঠের ওই ঘায়ের দাগ ওরাও দেখেছে। রিপোর্টেও লেখা আছে। ছেলেটার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্টার বেরা ফোন কেটে দিলেন। সব কথা রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছে।
৪৩
ফোন কেটেই আরিফ উঠে দাঁড়িয়েছেন। “স্যার এইবার ওয়ারেন্ট বের করুন।” মিস্টার বেরা একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন “ হেয়ার সে র ওপর ভিত্তি করে, সরি পরোক্ষ হেয়ার সে র ওপর ভিত্তি করে কাউকে গ্রেফতার করে কোর্টে হাসির খোরাক হতে চাও। এখনও বুঝতে পারছ না যে ও জানত যে কখনও না কখনও এই সব কিছু আমরা জানতে পারব। কিন্তু তবুও আমরা কিছু করতে পারব না। কোর্টে কেস উঠলে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে ও। ওর বিরুদ্ধে এই ছেলেটার দেওয়া জবানবন্দি গ্রাহ্যই হবে না। কোর্টে হেয়ার সে-ই গ্রাহ্য হয় না। আর এটা তো আবার পরোক্ষ হেয়ার সে। আর তাছাড়া ভুলে যেও না সংকেত একা নয়। ওর অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ আছে। কাজের জিনিসগুলো কার কাছে আছে সেটাও আমরা জানি না। ওদের সবাইকে একসাথে ধরতে হবে। নইলে আসল জিনিসটা বেহাত হয়ে যাবে। চলো এইবার কাজের কথায় ফেরা যাক। ২৩ নম্বর পয়েন্টটা আরেকবার গুছিয়ে নেওয়া যাক।
২৩… আপাত ভাবে সংকেতের কথা শুনে সবার মনে হয়েছিল যে সংকেত দীপককে মিস্টার মুখার্জির লোকদের থেকে সাবধান করে দিচ্ছে। কিন্তু দীপক সংকেতের কথার আসল মানে বুঝতে পারল। ও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে দীপক বাইরে বেরোলে সংকেত বা সংকেতের লোক ওকে মেরে ফেলবে। তার থেকে বেটার সুইসাইড করে নেওয়া। সেই ইঙ্গিতই সংকেত দীপককে দিয়ে এসেছিল।
২৪। সবাই তখন দীপকের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ব্যস্ত ভাবে। সবাই দীপকের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে। কি লাহিড়ী ঠিক বলছি কি না? (লাহিড়ী নিরবে মাথা নাড়াল।) এটাই স্বাভাবিক। তখন তোমরা কেউ সংকেতের হাতের দিকে খেয়াল করেছিলে? (লাহিড়ী মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল যে আমার হাতের দিকে ও লক্ষ্য করেনি) সংকেত যখন দীপকের বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখনই কোনও এক সময় ফাঁকে পিস্তলটা ওর চাদরের নিচে গুঁজে দিয়ে চলে আসে। এছাড়া আর কোনও সমাধান হতেই পারে না। ওই ছেলেটাকে তোমরা বেকার এতদিন ধরে আটকে রেখেছ।
২৫। সংকেতের ভয় দীপককে তখন সম্পূর্ণ ভাবে গ্রাস করেছে। সংকেতের লোকেদের হাতে মরতে হলে মরবার আগে ওকে আর কোন কোন যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে কে জানে। তার থেকে এই ভালো। সংকেতের দেওয়া পিস্তল দিয়ে সুইসাইড করল। সাথে সাথে শান্তনু মুখার্জির চ্যাপটারও ক্লোস হয়ে গেল। সংকেত যে এই কাণ্ডের হোতা সেই ব্যাপারে আর একটাও প্রত্যক্ষদর্শী রইল না। অর্থাৎ দীপক নেমে গেল সংকেতের ঘাড় থেকে।
২৬। শান্তনু মুখার্জি মারা গেল, তার কয়েক ঘণ্টা পর সংকেতের প্ল্যান অনুযায়ী রঞ্জন মুখার্জিও মারা গেল। মিস্টার মেহেরা এখন সংকেতের চোখের সামনে। আমার বাড়িতে ঢোকার সব বন্দবস্ত মোটামুটি পাকা। সুতরাং শেষ কাজটা যেটা বাকি রইল সেটা হল মিস্টার মুখার্জির বাড়ি থেকে ফাইলটা… সরি ফাইলগুলো হাতিয়ে নেওয়া। দোলন মুখার্জি সংকেতের বন্ধু। রঞ্জন মুখার্জির মৃত্যুর পর সংকেত যে ওদের বাড়িতে যাতায়াত করবে সেটা তো বলাই বাহুল্য। আর সেই সময়ই কোনও এক সুযোগে… অবশ্য হোটেল ছেড়ে বেরনোর আগে ওই জানতে পারে যে ওইদিনই ফিউসটা এসে মিস্টার মেহেরার হাতে পৌঁছেছে। ভোর রাতে বাকি ফাইলগুলোর সাথে সেটাকে ও সরিয়ে নিল।
২৭। সংকেত যেমনটা চেয়েছিল সব তেমন তেমনই হয়ে গেল। শুধু আমার বাড়িতে যে কারণে প্রবেশ করেছিল সেটা করে উঠতে পারল না। এতগুলো ফাইলের র্যাকের মধ্যে থেকে শুধু ওই ফাইলগুলো খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগবে। ফাইল খোঁজার সময় সঞ্চিতার হাতে ধরা পড়ে গেলে তো কথাই নেই। কিন্তু এদিকে জানতে পেরেছে আমি ফিরে আসছি। সুতরাং যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। সংকেত চলে গেল কলেজে। ওর এক সাকরেদ এসে হানা দিল আমার কাজের ঘরে। ঠিক সেই সময় আমি ফিরে এলাম। আর … (নিজের মাথার ব্যান্ডেজের দিকে ইশারা করে বাকি কথাগুলো উনি অসমাপ্ত রাখলেন) তবে যা খুঁজতে এসেছিল, সেগুলো নিয়ে লোকটা সরে পড়েছে। সুতরাং এই টার্গেটও অ্যাচিভড।
২৮। আর গতকাল আমি ফিরে আসছি জেনেই ও ১৫ই আগস্ট গিয়ে একজন মস্ত বড় উকিলের সাথে আগে ভাগে দেখা করে এলো। মিস্টার সত্যজিৎ ধর। আজ খেয়াল করেছিলেন নিশ্চই, মিস্টার ধর তার পুরো টিম নিয়ে থানার ক্যাম্পাসের বাইরে গোটা সময়টা দাঁড়িয়েছিল? বেচাল কিছু হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন ওকে ওখানে দেখে আমি কারণ ঠিক বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি। মিস্টার ধরকে আগে ভাগেই সংকেত বুক করে এসেছিল ১৫ তারিখ সকালে গিয়ে। তার চাক্ষুষ প্রমান ওর গোটা ফ্যামিলি। সংকেত ওর সাথে খুব মিস বিহেভ করেছে সেটাও ওনার মিসেস আমাদের লোককে বলেছে। মাথায় নাকি এক বালতি জল ঢেলে দিয়েছিল ঘুম কাটানোর জন্য। আর ফর সাম রিসন মিস্টার ধর সংকেতকে খুব ভয় পায়। এটাও ওর স্ত্রী আমাদের জানিয়েছে।
মিস্টার বেরা ফাইনালি থামলেন। মিস্টার রাহাকে জিজ্ঞেস করলেন “বলুন এইবার। কিছু অ্যাড বা মাইনাস করতে চান? আর কিছু ভুল বললে সেটাও বলতে পারেন।” মিস্টার রাহা একটু চিন্তা করে বললেন “ কেন জানি মনে হচ্ছে এখনও কয়েকটা জিনিস জানা বাকি রয়ে গেল। মোটের ওপর এই হাইপোথিসিস ঠিক। কিন্তু স্টিল কয়েকটা খটকা আছে। দীপকের বন্ধুর কাছ থেকে যেমন ওই ইনফরমেশনটা ক্লিয়ার কাট পাওয়া গেল তেমনই আরও কয়েকটা ইনফরমেশন ক্লিয়ার কাট পেলে ভালো লাগত।”
মিস্টার বেরা বললেন “আপনি কোন কোন জিনিসের কথা বলছেন ঠিক জানি না। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমাকেও ভাবাচ্ছে। রঞ্জন মুখার্জির মৃত্যুর আগে সংকেত কিভাবে সেই ভিডিও ক্লিপটা পেল। বা ওদের কথা বার্তা রেকর্ডই বা করল কি করে? আমি যতদূর দেখেছি সংকেতের সিম লোকেশন অনুযায়ী ও রঞ্জন মুখার্জির মৃত্যুর দিন বিকাল বেলায় প্রথমবার মিস্টার মুখার্জির বাড়ি গেছে। “ পাশে বসে থাকা অফিসার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। মিস্টার আরিফ খান বললেন “স্যার, এটা তো সংকেতের কোনও সাকরেদের কাজও হতে পারে। তাই না?” মিস্টার বেরা আর মিস্টার রাহা দুজনেই এক সাথে মাথা নাড়লেন। মিস্টার রাহা বললেন “অ্যান এমফাটিক নো মিস্টার খান। মিস্টার বেরার বাড়ি আর মিস্টার মুখার্জির বাড়ি এক নয়। মিস্টার মুখার্জির জীবদ্দশায় ওই বাড়ির চারপাশে সারাক্ষন সিকিউরিটি মোতায়েন থাকত, সে উনি বাড়িতে থাকুন বা নাই থাকুন। মিস্টার খান,ব্যাপারটাকে এত সহজ ভাবলে চলবে না। আর তাছাড়া মিস্টার খান, আমি আপনাকে একটা কোশ্চেন মার্ক লিখতে বলেছিলাম মনে আছে? সেই পয়েন্টটা একবার পড়ে শোনাবেন?” মিস্টার খান বললেন “মিস্টার বেরার হাইপোথিসিস অনুযায়ী মালিনীর কাছ থেকে কোনও মতে ও (সংকেত) জানতে পারল যে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা কাজ করে না।” মিস্টার রাহা বললেন “আমার প্রশ্ন কি করে জানতে পারল?”
মিস্টার বেরা বললেন “ হতে পারে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের সময়, বা মন ভোলানো কথা বলার সময় কোনও ভাবে মালিনীর পেট থেকে সেই কথা বের করে নিয়েছে। আমরা তো জানি মালিনীর সাথে সংকেতের একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল। ওদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক ছিল কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও, কিছুটা ঘনিষ্ঠতা তো ছিলই।” মিস্টার রাহা বললেন “ তাহলে মালিনী কেন সম্পূর্ণ ভাবে জিনিসটা অস্বীকার করল ওর ম্যানেজারের সামনে? মালিনী নিজের ম্যানেজারকেও যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। আর সব সময় এরকম ভাবার কারণ নেই যে মালিনী নিজের অজান্তে ভুল করেছে। অন্য দিক থেকেও ব্যাপারটা ভাবা যেতে পারে। একটু মন দিয়ে আমার কথা গুলো এইবার শুনুন। ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা অন থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার, নয় কি? এই নিয়ে কথা বলারই বা কি আছে? সংকেত হঠাৎ করে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরার প্রসঙ্গ ওঠাতে যাবেই বা কেন? আর এটাও মোটামুটি মেনে নেওয়া যেতে পারে যে কোনও রুম বয়কে হাত করে সংকেত এই তথ্য বের করতে পারবে না। কারণ রুম বয়দের কেউ ব্যাপারটা জানতই না। ওরা ভি আই পি দের আগমনের ব্যাপারে কথা চালাচালি করলেও করতে পারে, কিন্তু ক্যামেরা অফ, সেটা কি করে জানবে?”
সবাই এর ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে দেখে মিস্টার রাহা বললেন “ ইনফ্যাকট সংকেত যে জাতের ধুরন্ধর তাতে ওর যদি ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা নিয়ে কোনও বক্তব্য থাকতও, তবুও সে সেটা মালিনীর সামনে বলত না, আমার বিশ্বাস মালিনী কেন কারোর সামনেই বলত না। কারণ তাতে মালিনীর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। এই জাতের ক্রিমিনালরা একটাও ভুল করে না মিস্টার বেরা। তার নজির তো দেখতেই পাচ্ছেন। সব বুঝতে পারছি, কিন্তু এটাও বুঝতে পারছি যে এইসব তথ্য নিয়ে কোর্টে যেতে পারব না। একটু অন্য ভাবে ভাবা দরকার বইকি।” মিস্টার বেরা নিজের গ্লাসে পানীয় ঢালতে ঢালতে বললেন “ আপনার এই ব্যাপারে কিছু বক্তব্য থাকলে বলে ফেলুন।” মিস্টার রাহা বললেন “আপনার মতন পয়েন্ট বাই পয়েন্ট বলার দরকার নেই। কিন্তু শুরু থেকে সংকেতের কাজ কর্মের যা প্যাটার্ন, সেটা দেখেই আমার মনে হয়েছে এখানেও কোনও না কোনও ভাবে স্পাই ক্যাম আর মাইক্রোফোনের কেরামতি আছে। দেখুন সংকেত যেখানে যেখানে নিজের পায়ের ধুলো রেখেছে তার অধিকাংশ জায়গায় এই সব সেট করে রেখে দিয়ে গেছে। হতে পারে এই দুই ক্ষেত্রেও…আর তাছাড়া শিখার মৃত্যুর ব্যাপারটা? সব বুঝেও অনেকগুলো ফাঁক থেকে গেছে, তাই না? বাট আই সাপোর্ট ইওর হাইপোথিসিস। ”
মিস্টার বেরা চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। সত্যি আর মাথা কাজ করছে না। মিস্টার রাহা এক মনে নিজের খালি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। ওনার পাশে বসা মিসেস রাহা টেবিলের ওপর মাথা রেখে কখন যে ঘুমের কোলে ঢোলে পড়েছেন কে জানে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে পাশে বসে থাকা সেই অফিসারটি চেঁচিয়ে উঠল “ইউরেকা” । এর উৎসাহের সত্যি কোনও সীমা পরিসীমা নেই। এত জোরে ও চেঁচিয়ে উঠেছে যে মিসেস রাহাও ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসেছেন। মিস্টার বেরা বললেন “আআআআহ। একটু আসতে। মিসেস রাহা একটু রেস্ট নিচ্ছিলেন। কি পেয়েছ?” ওই অফিসারের চোখ জ্বলছে, ঠোঁটের কোণে বিজয়ীর হাসি। সবাই ধড়ফড় করে উঠে ওই অফিসারের ল্যাপটপের উপরে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। সবার ব্রেন টায়ার্ড আর চোখের সামনে একগুচ্ছ নাম্বার আর লোকেশন। কেউ কিছুই বুঝতে পারল না।
মিস্টার বেরা বললেন “তুমি ওই হোয়াইট বোর্ডে গিয়ে তোমার পয়েন্ট গুলো একটু জট ডাউন করো, আমি ততক্ষণে একটু হালকা হয়ে আসছি। আরিফ দরজাটা বন্ধ করে দাও। থানায় বসে মদ খাচ্ছি, এই খবর মিডিয়া জানতে পারলে আর রক্ষে থাকবে না। উনি বেরিয়ে গেলেন। ওনার ফিরতে একটু সময় লাগলো। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর বুঝতে পারলেন যে সত্যি কিছু ঘটে গেছে এই কয়েক মিনিটে। সবাই আবার নিজেদের পানীয় ঢালতে ব্যস্ত। এমনকি মিসেস রাহাও নিজের গ্লাসে পানীয় ঢালছেন। উনি রুমাল দিয়ে চোখের কোটরটা ভালো করে পরিষ্কার করে হোয়াইট বোর্ডের দিকে চেয়ে দেখলেন। এইগুলো হাইপোথিসিস নয়। জলজ্যান্ত প্রমান।
১। ওই দুর্ঘটনার রাতে(যেদিন শান্তনু মুখার্জি মারা যায়) আমি যে শিখার বাড়ি গেছিলাম সেটা রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট… (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃএটা জানা তথ্য)
২। ওই দুর্ঘটনার রাতে দোলন, রাকা আর আমি যে মধ্য রাত্রি অব্দি জল বিহার করেছিলাম সেই তথ্য আবিষ্কৃত। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ এত রাতে এরা কি করছিল। সেখানে কি হয়েছিল জানা দরকার। রাকা, দোলনকে ডাকতে হবে)
৩। ১৫ইআগস্ট, দুপুর ২.৪৫। এটা ওই ১৫০ টা অচেনা নাম্বারের মধ্যে একটা নাম্বারের ব্যাপারে রিপোর্ট। সিকয়েন্স কিছুটা এরকমঃ-
--অচেনা নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে একটা এস এম এস আসে। আমার মোবাইল লোকেশন তখন ওর লোকেশনের খুব কাছে।
--মিনিট দশেকের মধ্যে আমার সিমের লোকেশন আর ওই নাম্বারের লোকেশন এক হয়ে যায়। মিনিট দশেক দুটো সিমের লোকেশন এক ছিল। এবং একই জায়গায়। দুটোই স্থির।
-- তারপর আবার দুটো সিম দু-দিকে মুভ করে। আমার সিমটা চলে যায় দোলনের বাড়ির দিকে। আর অন্য সিমটা চলে যায় শিখার বাড়ির দিকে। শিখার বাড়ির লোকেশনে পৌঁছে ওই মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে একটা কল আসে। আর তারপরেই সিমটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ মোবাইল থেকে সিমটা খুলে ফেলা হয়। যে মোবাইল সেট থেকে এই কলটা এসেছিল সেটাও একই সাথে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
-- ঠিক সেই সময় আরেকটা নাম্বার (ওই ১৫০ টা অচেনা নাম্বারের মধ্যেই একটা নাম্বার) অন্য আরেকটা আই এম ই আই থেকে জেগে ওঠে শিখার বাড়ির লোকেশনে। সেই সিমটা অনেক রাত অব্দি চালু ছিল এবং ওই একই লোকেশনে স্থির হয়ে ছিল।
-- নাম্বার চালু হওয়ার কিছুক্ষণ পর ওই মোবাইল/সিম থেকে প্রথম এস এম এস ঢোকে আমার মোবাইলে।
-- মাঝ রাত পার করে সিমটা আবার মুভ করা শুরু করে। ঠিক তখনই ওই সিম থেকে আমার মোবাইলে আরেকটা এস এম এস ঢোকে। ব্যস তারপরেই এই সিম আর এই মোবাইলটা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ খুব জরুরি তথ্য। আমাদের হাইপোথিসিস কি?)
৪। শিখা যেদিন মারা যায় সেদিনও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। সেই ১৫০ টা অচেনা নাম্বারের মধ্যে থেকে একটা অন্য নাম্বার একটা নতুন মোবাইল সেটে জেগে ওঠে শিখার বাড়ির ঠিক সামনে। সেই নাম্বার থেকে দুটো পর পর এস এম এস ঢোকে আমার মোবাইলে। তার পর গোটা রাত সব চুপচাপ। ঠিক ভোর ছটার দিকে আমার মোবাইলে আরেকটা এস এম এস ঢোকে ওই নাম্বার থেকে। তারপর একটা ১৫ সেকন্ডের কল আসে ওই সিম থেকে আমার সিমে। সিমটা ৮.০৫ মিনিটে ওই লোকেশন থেকে মুভ করতে শুরু করে। তারপরেই সিম আর মোবাইল একসাথে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ খুব জরুরি তথ্য। আমাদের হাইপোথিসিস কি?)
৫। আমার মোবাইলে সব থেকে বেশী এস এম এস করেছে রাকা। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ রাকার সাথে সংকেতের কি এত কথা? অন্য দিকে মালিনীও তো আছে?)
৬। দোলনও মাঝে সাঝে এস এম এস করেছে। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ দোলনের সাথে সংকেতের কি এত কথা? অন্য দিকে মালিনীও তো আছে?)
৭। মালিনীও মাঝে সাঝে এস এম এস করেছে। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃএটা জানা তথ্য)
৮। রঞ্জন মুখার্জি যেদিন মারা যান ঠিক তার দুদিন পরের ঘটনা। দুটো সিমের মধ্যে বিকাল থেকে এস এম এসের আদান প্রদান হয়। আমার সিম আর রাকার সিম অনেকক্ষণ ধরে লেকের (সেই লেক) মধ্যে একই লোকেশনে ছিল। এর পর দুটো সিমই পর পর লেকের বাইরে বেরিয়ে আসে। অল্প কিছুদূর গিয়ে সিম দুটো আবার স্থির হয়ে যায়। অনেক রাত অব্দি সিম দুটো একই লোকেশনে ছিল। পরে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ সেদিন গোটা শহর বিকালের পর বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল। রাকা আর সংকেত ওই লেকের ভেতর বসে কি করছিল?)
৯। ১৪ই আগস্ট বেলা মুখার্জির কাছ থেকে আমার সিমে একটা কল আসে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ মিসেস মুখার্জির সংকেতের সাথে কি দরকার থাকতে পারে? ১৫ই আগস্ট ওদের বাড়িতে নিয়ম ভাঙ্গার কাজ ছিল সেটা জানি। কিন্তু সেক্ষেত্রে মেয়ের বন্ধুকে নেমন্তন্ন করতে হলে সচরাচর মেয়েকেই কল করতে বলা হয়। অন্তত মেয়েকে কল করতে বলে, মেয়ের মোবাইল থেকেই মায়েরা মেয়ের বন্ধুর সাথে কথা বলে। বেলা মুখার্জি নিজে কেন সংকেতকে কল করতে গেলেন?)
১০। ১৫ ই আগস্ট রাত। আমার সিম ৮.১৮ তে মিসেস মুখার্জির বাড়ির লোকেশনে গিয়ে পৌঁছায়। তার আগে অব্দি অবশ্য আমার সিমটা মিস্টার বেরার বাড়ির চারপাশে এধার ওধার ঘুরে বেরিয়েছে। তিনটে সিম মধ্য রাত্রি অব্দি একই লোকেশনে ছিল। আমার সিম, সুধা সান্যালের সিম আর বেলা মুখার্জির সিম। (একই লোকেশন মানে একই বাড়ি নাও হতে পারে… প্লীজ খেয়াল রাখবেন।)
(মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ সংকেত সেদিন মিস্টার মুখার্জির বাড়ি গেছে সেটা আমাকে সঞ্চিতা জানিয়ে ছিল। সুধা সান্যালও যতদূর শুনেছি সেদিন ওই বাড়িতেই ছিলেন মিসেস মুখার্জির একাকীত্ব দূর করার জন্য। সংকেতকে খাবার জন্য নেমন্তন্ন করলে অত লেট হবে কেন? তিন জন মিলে এত রাত অব্দি কি করেছে? ফাইলটা কি সেদিনই সরিয়েছে? এমন ভাবার কারণ এই যে বাকি অন্য দিন গুলোতে যখন সংকেত ওদের বাড়ি গেছে তখন ওদের বাড়ির কাজের ব্যাপারে হেল্প করতে গেছে। আর সব সময় সংকেতের চারপাশে অনেক লোক ছিল। সংকেত প্রায় একাই সব জোগাড়যন্ত্র করেছে...বাকিদের বয়ান থেকে এই তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এইদিন বাড়িতে ছিল মাত্র তিন জন আর হয়ত চাকর বাকর। এত রাত অব্দি ওরা কি করছিল? )
১১। আমি প্রায় রোজ ভোরে যে মর্নিং ওয়াকে যাই, তার তথ্য এটা। যেই লেকের ধারে গিয়ে বসি, তার উল্লেখ আছে এখানে। (মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ আগামিকাল কুকুর নিয়ে গিয়ে এই লেকের চারপাশের জমির তল্লাশি নিতে হবে। )
এই অব্দি বোর্ডে লেখা আছে। মিস্টার বেরা ওই অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললেন “ইউ ডিসার্ভ অ্যা পার্টি মাই বয়। সত্যি অনেক গুলো লিঙ্ক খুঁজে বের করেছ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সবাই আরেকবার চিয়ার্স করে নতুন উদ্যমে মদ্যপান শুরু করতে যাচ্ছিল এই ভোর রাতে, কিন্তু মিস্টার বেরা ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের গ্লাস নামিয়ে রেখে দিলেন। “তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চাও।” ছেলেটা এর ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ও আরও কিছু বলতে চায়, কিন্তু সাহস করতে পারছে না। ছেলেটা কিছু একটা বলতে গিয়েও কথাটা গিলে নিয়ে বলল “না স্যার। তেমন কিছু নয়। “
মিস্টার রাহা বললেন “তোমার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুমি কিছু একটা চেপে যাচ্ছ হয় ভয়ে বা সংকোচে। যে সংকেত আমাদের এত বড় ক্ষতি করে এখনও ভালো মানুষ সেজে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে আর আমরা এখানে বসে মাথা ঠুকে মরছি তার ব্যাপারে প্লীজ কিছু গোপন করো না। যা বুঝতে পেরেছ বলে ফেলো। ইনফ্যাকট কারোর যদি আরও কিছু অ্যাড করার থাকে সেটা করে ফেলো। দুটো জিনিস মনে রেখো। সংকেতের যা দরকার সেটা ওর হাতে চলে এসেছে। আমাদের হাতে ওকে হাজতে ধরে রাখার মতন কোনও প্রমান নেই। ও নিখুঁত ভাবে দাবার গুঁটি সাজিয়েছে। আমি সিওর এখনও অনেক কিছু আমাদের জানা বাকি। এই কেসে বিস্ময়ের সীমা নেই। কিন্তু সেই সাথে এখন যেটা সব থেকে সিরিয়াস হয়ে উঠেছে সেটা হল ও এইবার একে একে ওর এক্সিট প্ল্যানগুলো এক্সিকিউট করবে। ও যে কি করবে বোঝা যাচ্ছে না। এত দিন ও আমাদের থেকে ১ নয় ১০ পা এগিয়ে ছিল। এখন আমরা সবাই ওকে ঘিরে ধরেছি, আর ও একা। এখনও কি আমরা পারব না ওকে বিট করতে? তাই যার যা মনে আছে, সব খুলে বলে ফেলো। ভুল হলে হোক। সে পরে ভেবে দেখা যাবে। বাট চেষ্টায় ত্রুটি রাখা যাবে না।” ছেলেটা ধীরে ধীরে বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একবার পিছনে ফিরে মিস্টার বেরার দিকে তাকিয়ে দেখল। ওনার ভুরু কুঁচকে রয়েছে। ছেলেটা লেখা শুরু করল।
১২। ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত্রির পর (মানে ইংরেজি মতে আফটার ১২ am, ১৫ই আগস্ট) মিসেস বেরার মোবাইল থেকে সংকেতের মোবাইলে পর পর দুটো এস এম এস ঢোকে। সংকেত তার রিপ্লাইও করে। প্রায় ভোর রাতের দিকে একটা নাম্বার থেকে মিসেস বেরার মোবাইলে একটা কল আসে। কলটা বেশ খানিকক্ষণ চলে। কলটা কাটার পর সেই একই নাম্বার থেকে সংকেতের মোবাইলে আরেকটা এস এম এস ঢোকে। এই সিমটা ১৪ই আগস্ট সন্ধ্যা থেকে মিস্টার বেরার বাড়ির পিছন দিকে যে বস্তিটা আছে সেই লোকেশনে ছিল। সংকেতকে এস এম এস করার পরের মুহূর্তেই সিম সমেত মোবাইল ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এখানে একটা কথা বলা দরকার। সিমটা চালু হয় সংকেত এখানে আসার ঠিক দিন দুয়েক পরে। সিমটা সব সময় আপনার বাড়ির আশে পাশেই ঘোরা ফেরা করত। ১৪ই আগস্টই ফার্স্ট ওর লোকেশন চেঞ্জ হয়। ওই বস্তিতে যায়। সেখানেই ছিল ভোর রাত অব্দি। তারপর সেই শেষ এস এম এসের পর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় পারমানেন্টলি। বলাই বাহুল্য এই নম্বর যে নামে বা ঠিকানায় রেজিস্টার্ড সেগুলো সব জালি।
(মিস্টার বেরা এই পয়েন্টের পাশে লিখলেনঃ সঞ্চিতা আর সংকেত এত রাতে এস এম এস করছিল কেন? ওরা জেগে থাকতে পারে। কিন্তু ছিল তো পাশা পাশি দুটো ঘরে। এস এম এস করে কথা বলার কি দরকার পড়ল? আর এই নাম্বার থেকে এত রাতে কলই বা এলো কেন? সঞ্চিতাকে ডাকতে হবে। ওই বাজার অঞ্চলে খোঁজ করে দেখতে হবে। বাড়ির পিছনে বস্তিতেও খোঁজ করে দেখতে হবে। খুবই জরুরি তথ্য।)
৪৪
উনি ওই অফিসারের দিকে ফিরে বললেন “এখানে আমার সিমও যদি কোনও ভাবে ইনভলভড বলে মনে হয়, সেটাও লোকাবে না। এটা আগেই লিখতে পারতে। আমি কিছু মনে করতাম না। এইবার চিয়ার্স। কোথায় কোথায় খোঁজ নিতে হবে মোটামুটি লেখা হয়ে গেছে। এইবার চটপট আমাদের হাইপোথিসিসগুলো সাজিয়ে ফেলি। মানে, যেগুলো নিয়ে আমরা কিছু সিদ্ধান্তে আসতে পারছি সেইগুলো নিয়ে।”
মিস্টার বেরা বললেন “ ৩ নম্বর অবসারভেশনের ব্যাপারে মিস্টার রাহা কিছু বলুন। এইবার আপনিই বলুন, আমি শুনব। “ মিস্টার রাহা বললেন “ ১২ই আগস্ট দুপুর বেলা …”। মিস্টার বেরা বাঁধা দিয়ে বললেন “তার আগে একটা জিনিস বলে দেওয়া ভালো। ওই দিনই দুপুর বেলা সংকেত আমার সাথেই বাড়ি থেকে লাঞ্চ সেরে বেরোয়। আমি গাড়ি ধরব। সংকেত মিস্টার মুখার্জির বাড়ি যাবে। আমার লাগেজ ও গাড়ি অব্দি এগিয়ে দিতে এসেছিল জল ভেঙ্গে। এক হাঁটুর ওপর জল ছিল বাড়ির সামনে। আমার সিম লোকেশন চেক করলে বুঝতে পারতে কিছুক্ষণ আগে অব্দি সংকেতের সিম আর আমার সিম একই জায়গায় ছিল। যা হয়েছে আমি ওখান থেকে গাড়ি চড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর হয়েছে। আর যে লোকেশনের কথা লেখা হয়েছে সেটা একটা খালি জায়গা, দোকান পাট ওখানে খুব একটা আছে বলে কোনও দিন দেখিনি। সুতরাং … নাউ ক্যারি অন।”
মিস্টার রাহা আবার শুরু করলেন “ মিস্টার বেরার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সংকেত মিস্টার মুখার্জির বাড়ির দিকে এগিয়ে পড়ে। রাস্তায় কোথাও একটা ওই অচেনা নাম্বার ধারীর সাথে দেখা করে। ওদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তারপর অচেনা নাম্বারের সিম নিয়ে একজন চলে যায় শিখার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর সংকেতের সিম নিয়ে একজন চলে যায় লেট মিস্টার মুখার্জির বাড়ির উদ্দেশ্য।” এখানে রবিন বাবু বলে উঠলেন “অর্থাৎ সংকেত ওই লোকের সাথে দেখা করে। দিয়ে সংকেত চলে যায় মিস্টার মুখার্জির বাড়ির দিকে আর সেই লোকটা চলে যায় শিখার বাড়ির দিকে। আমরা জানি সিম লোকেশন একই জায়গা দেখালেও সব সময় একই বাড়ি নাও হতে পারে, স্টিল, এই লোকেশনে খুব একটা কিছু বাড়ি ঘর বা দোকান পাট আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং আমরা ওখানে গিয়ে খোঁজ খবর নিতে পারি! “ মিস্টার বেরা হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন “ লাভ হবে না। তুমি মিস্টার রাহার কথার মানে ধরতে পারনি, বা বুঝতে পারোনি, বা এই অল্প খেয়েই তোমার চড়ে গেছে। আরিফ বুঝিয়ে দাও।” মিস্টার খান একটু নড়ে চড়ে বসে সামান্য একটু উসখুস করে চুপ মেরে গেলেন। বোঝা গেল, ঘরের কেউ ঠিক ব্যাপারটা ধরতে পারেনি।