05-03-2019, 03:58 PM
হঠাৎ কিছু একটা মনে করে উনি মিস্টার মণ্ডলকে বললেন “ মণ্ডল, তোমাদের এখানে সব থেকে বেকার হাবিলদার কে আছে? মানে একদম বোগাস লোক কে আছে?” মিস্টার লাহিড়ী এগিয়ে এসে বললেন “স্যার অনেকেই আছে। “ মিস্টার বেরা জিজ্ঞেস করলেন “তাদের কেউ এখন থানায় আছে?” মিস্টার লাহিড়ী গিয়ে একজন সাদা মাটা হাবিলদারকে ধরে নিয়ে এলেন। মিস্টার বেরা ওই হাবিলদারের হাতে একটা ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে বললেন “ এই ঠিকানায় যাও। এখনই যাও। শ্যামা নস্করের জন্য খোঁজ করবে। কি জানতে পারো এসে জানাও। কুইক।” আরিফ জিজ্ঞেস করলেন “স্যার আপনাদের কাজের মহিলা মিসিং হয়ে যাওয়ার সাথে এই কেসের কোনও লিঙ্ক আছে বলে মনে করছেন?” মিস্টার বেরা বললেন “ শিখার মৃত্যুর সাথেও কি এই কেসের সরাসরি কোনও লিঙ্ক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? কিছুই না।
কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে হঠাৎ করেই চারপাশে অনেক অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে কোনটা যে কেসের সাথে লিঙ্কড আর কোনটা যে লিঙ্কড নয় সেটা বোঝার সময় এখনও আসেনি। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া …” মিস্টার রাহা শান্ত গলায় বললেন “ মিস্টার বেরা, এমন হতে পারে যে এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো একে ওপরের সাথে লিঙ্কড হয়েও লিঙ্কড নয়।” মিস্টার বেরা বললেন “প্লীজ ক্লারিফাই।” মিস্টার রাহা বললেন “ ধরুন একই গ্রুপের লোকের কীর্তিকলাপের জন্যই চারপাশে হঠাৎ করে এত সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে চলেছে। আবার সেই গ্রুপটাই অ্যাকচুয়াল কেসের সাথে লিঙ্কড। তারা এই বাকি কাণ্ডগুলো করছে জাস্ট টু ক্রিয়েট…” হেসেবাকি কথা অসমাপ্ত রেখেই মিস্টার রাহা থেমে গেলেন।
মিস্টার বেরা শেষ করলেন ওনার না বলা কথাগুলো “ diversionary tactic. আমরা আজে বাজে জিনিস নিয়ে মেতে থাকব, আর ওইদিকে বাবাজী নিজের কাজ হাসিল করে কেটে পড়বে। হতেও পারে। তবুও খুঁটিয়ে দেখা ছাড়া এখন আর অন্য কোনও রাস্তা নেই। সংকেত আমাদের সাসপেক্ট আর সে হঠাৎ করে আমাদের বাড়িতে এসে উঠেছে আর হঠাৎ করে আমাদের বাড়ির কাজের লোক মিসিং। পুরোটাই কি কাকতালীয়? হতেও পারে। এদিকে আরও কয়েকটা জিনিস ক্লিয়ার হয়ে গেছে। সংকেতের বয়ান আর ওর মোবাইল লোকেশন ম্যাচ করছে। শুধু দুই একটা জিনিস নিয়ে খটকা আছে। তবে খুব মাইনর খটকা। বাট, মোটের ওপর সংকেতের সঠিক অ্যালিবাই আছে।“ পাশ থেকে রবিনবাবু বলে উঠলেন “ স্যার, সেই সাথে সংকেতের প্রচুর টাকাও আছে। আর সেই সাথে এখন সংকেতকে সিরিয়াসলি নেওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।”
৪২
মিস্টার বেরা বললেন “ প্লীজ, গো অ্যাহেড উইথ দা গুড নিউস। “ রবিন বাবু বললেন “ স্যার সংকেতের ঘর থেকে যে ল্যাপটপটার ছবি আমরা তুলে এনেছি, খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই ল্যাপটপ ইন্ডিয়ায় পাওয়াই যায় না। আমেরিকায় মাস দুয়েক আগে সেটা লঞ্চ হয়েছে। মজার জিনিস হচ্ছে আমেরিকার বাইরে আর কোথাও এই ল্যাপটপ এখনও ওরা ছারেনি। আর এই ল্যাপটপ জেনেরাল ইউসের জন্য তৈরি করাও হয়নি। এই ল্যাপটপে গোটা পঞ্চাশেক এমন সব ফিচার আছে যেগুলো শুধু ডিফেন্সের বা সিকিউরিটির কাজ কর্মের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে। তাই এর দামও অনেক। আমেরিকায় সাধারণ লোক সেই ল্যাপটপ কিনতে পারবে না। কিনতে হলে গভমেন্টের কাছ থেকে আর আর্মির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর ল্যাপটপের দাম শুনলে আপনি পড়ে যাবেন। ভারতীয় মুদ্রায় এর দাম সাড়ে চার লাখের কিছু বেশী। আর ...” মিস্টার রাহা এইবার সোজা হয়ে বসেছেন “ আর আমি যতদূর জানি ফার্স্ট লটে এই মডেলের যতগুলো প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছিল তার মধ্যে একটা প্রোডাক্ট মিসিং হয়েছে।” মিস্টার বেরা বললেন “ মানে? প্লীজ ক্লারিফাই।”
মিস্টার রাহা বললেন “ ২০ দিন মতন আগে আমি আমেরিকায় গেছিলাম একটা কনফারেন্সে। ওখানে আমার চেনা একজন খুব বড় ক্রিমিনাল সাইকলজিস্ট আছেন। জন রাসেল। ওর শ্যালক জো ক্লেটন পেন্টাগনে কাজ করে। একদিন মদের ঠেকে ওর ওই শ্যালকের সাথে আমার আলাপ হয়। জানতে পারি যে মাস কয়েক আগে একটা বড় হার্ডওয়্যার কোম্পানির সাথে পেন্টাগনের কিছু ডিল সাইন হয়। ওদের অনুরোধে, ওদের আর ওদের মতন কিছু সংস্থার কাজের কথা মাথায় রেখে সেই কোম্পানি এই মডেলের ল্যাপটপ তৈরি করে। স্যাটালাইট ট্র্যাকিং, ডিভাইস ট্র্যাকিং, অ্যাডভানসড জিপিএস এরকম অনেক টেকনোলজি আছে এই ল্যাপটপে। কথা হয়েছিল অর্ডার হলে তবেই এই মডেলের ল্যাপটপ ম্যানুফাকচার করা হবে। ফার্স্ট লটের অর্ডার ছিল ৭ টা। ওরা বানিয়েছিল। কিন্তু হ্যান্ডওভার করার আগেই সেই কোম্পানির কাছ থেকে একটা ল্যাপটপ চুরি হয়ে যায়। আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে নাকি প্রচুর গোলমাল চলছিল। কারণ ভুল লোকের হাতে এই ল্যাপটপ পড়ে গেলে নাকি জিনিসটা ভালো হবে না। তাই সেটাকে উদ্ধার করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে মিডল ইস্টের কোনও একটা দেশে নাকি ল্যাপটপটা চোরা পথে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। কোন দেশ, কোন কোম্পানি, কতজন সাসপেক্ট ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই। কারণ ওই ছেলেটা আমাকে সেই নিয়ে কিছু বলেনি। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ গোপনীয়। আর ল্যাপটপের মডেল নাম্বার -xxxx-xx-xxxxxx। কি তাই তো? স্মরণশক্তিটা এখনও ভালোই আছে তাহলে। “ মিস্টার বেরা বললেন “আর সেই সাথে এটাও প্রমান হয়ে গেল যে আমার দুটো হাইপোথিসিস অন্তত ঠিক। এক। ছেলেটা ভীষণ গোলমেলে। দুই। ছেলেটা জেনে বুঝে লাই ডিটেক্টর মেশিনটাকে বিট করেছে। একটা প্রশ্নের উত্তরে ও বলেছিল যে ওদের টাকা নেই। অর্থাৎ ওরা গরীব, অন্তত গরীব না হলেও তেমন বড়লোক নয়। তাহলে এত দামি ল্যাপটপ ওর কাছে এলো কি করে! “
মিস্টার বেরা আবার চেয়ার থেকে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। “সেই সাথে আরও কয়েকটা জিনিস ক্লিয়ার হয়ে গেল। আরিফ কালো ডাইরিটাতে নোট করে নাও তো। “
১। সংকেত লাই ডিটেক্টর মেশিনের সামনে বসে কোনটা সত্যি কথা বলেছে আর কোনটা মিথ্যা কথা বলেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। হতে পারে ম্যাক্সিমাম উত্তরই মিথ্যা। অন্তত একটা মিথ্যা কথা যে ও বলেছে আর মেশিন সেটা ধরতে পারেনি তার প্রমান এখন আমাদের কাছে আছে।
২। আমি সিওর সংকেত ওর আসল নাম নয়। অর্থাৎ ওর বাড়ির ঠিকানাও ভুয়ো বা জালি।
৩। আমি এখন সিওর যে ১০৭ নম্বর রুমের বুকিঙটা কাকতালীয় নয়। আগেই বোঝা গেছিল যে ওটা কাকতালীয় নয়, কিন্তু এখন মোটামুটি ভাবে সিওর হয়ে বলা যায় যে ১০৯,১১০ নম্বর রুম বুক হওয়ার পরই ও ১০৭ নম্বর রুমটা বুকে করে পারপাসফুলি।
৪। গরীব সেজে আমার বাড়িতে এসে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকাটাও এখন আর কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।
৫। রঞ্জন মুখার্জির ডেথ, মিসিং ফাইল যে একই সুতোয় গাঁথা সেটা আমরা আগেই বুঝেছি।
গোটা ঘরে একটা থমথমে ভাব। মিস্টার বেরা আবার মুখ খুললেন “ তার থেকেও একটা সিরিয়াস প্রশ্ন আছে। কিন্তু ...“ উনি ঘরময় পায়চারি করছেন আর বারবার এক হাত দিয়ে অন্য হাতের চেটোতে ঘুষি মেরে চলেছেন। একসময় নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বললেন “ সংকেত হোটেলে চেকইনের টাইমে কি একটা লোকাল ঠিকানা দিয়েছিল বলে রেজিস্টারে দেখেছিলাম। আরিফ ওই ঠিকানায় লোক পাঠিয়ে দাও। একটা সমস্যা কি জানো আরিফ, একটা চুরি করা ল্যাপটপ ওর কাছে আছে বা ও বড়লোক বলে ওকে আমি জেলে ঢোকাতে পারব না। সব কিছু বুঝতে পারছি কিন্তু তবুও জেলে ভরতে পারব না এত সহজে। “ আরিফ বললেন “কেন? চোরাই ল্যাপটপটা ওর কাছে থাকা সত্ত্বেও...”
মিস্টার বেরার হঠাৎ করে যেন কিছু একটা মনে পড়েছে। উনি রবিন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “ এই একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। লাস্ট টাইম আমি মুম্বাইতে গেছিলাম না, ওখানে একটা ভালো মোবাইল সেট গিফট পেয়েছি। দাম ৩৬ হাজার টাকা। তোমাকে আমি ২৫ হাজারে ছেড়ে দেব। তুমি বাজারে যা মোবাইল পাও তার থেকে ঢের ভালো সেট। এখনও ইউস করিনি। লাগলে বলতে পারো। তবে ফ্রিতে ছাড়ব না।” রবিন বাবু খুশি হয়ে বললেন “স্যার জানেনই তো এই একটা ব্যাপারে আমার দুর্বলতা একটু বেশী। স্পেকটা বলতে পারবেন?” মিস্টার বেরা স্পেক বললেন। রবিন বাবু লাফিয়ে উঠে বললেন “স্যার ওটা আমি এখনই বুক করে দিলাম। কাল আপনাকে নেট ট্রান্সফার করে দেব।” মিস্টার বেরা লাফিয়ে উঠে বললেন “ব্যস। আরিফ, রবিনকে গ্রেফতার করে জেলে ভরো।” আরিফ বললেন “মানে?” মিস্টার বেরা বললেন “ ধরে নাও মোবাইলটা চুরি করেছি আমি। এখন ওকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করলাম। এখন মোবাইলের মালিক রবিন। বলাই বাহুল্য এর কোনও রসিদ নেই। কিন্তু ওর কাছ থেকেই মোবাইলটা উদ্ধার হবে। তাই তো? “ আরিফ বললেন “কিন্তু স্যার...ওর কাছে চোরাই জিনিসটা থাকার মানেই যে ও কোনও খারাপ কাজ করেছে সেটা আপনি কি করে ধরে নিচ্ছেন।”
মিস্টার বেরা বললেন “ এইবার তুমি পথে এসেছ। সংকেতের কাছে চোরাই ল্যাপটপ থাকার মানেই সংকেত দোষী, এটাই বা তুমি কি করে ধরে নিচ্ছ? আর এই কথাটা আমি বলছি না, আদালতে দাঁড়িয়ে এই কথাটাই বলবে সংকেতের উকিল। আর সেই সাথে ওর উকিল এও বলে দেবে যে কার কাছ থেকে মোবাইলটা ও কিনেছে। তাকে ধরতে গিয়ে দেখবে সেই লোক অনেক আগে মার্কেট থেকে সরে পড়েছে। আচ্ছা…” একটু থেমে বললেন “ লাহিড়ী। সংকেতের মোবাইল লোকেশনের রিপোর্টটা নাও। এখন অনেক রাত জানি। আর সেটাই আমাদের প্লাস পয়েন্ট। সংকেতের একটা বড় ছবি নিয়ে দুইজন অফিসারকে পাঠাও। ১৫ই আগস্ট সকাল বেলায় সংকেত যেখানে যেখানে নিজের পায়ের ধুলো ফেলেছে ওই সব কটা লোকেশনে গিয়ে সবাই কে জিজ্ঞেস করো ছবি দেখিয়ে। দরকার আছে। দেরী করো না। “ মিস্টার লাহিড়ী মাথা চুলকে বললেন “স্যার মাথা মুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এত রাতে গিয়ে কাকে জিজ্ঞেস করব? কেই বা আমাদের হেল্প করবে? স্যার দিনের বেলায় এটা করলে ভালো হত না?”
মিস্টার বেরা চেঁচিয়ে উঠলেন “মূর্খ, রাতে খোঁজ খবর করাই আমাদের প্লাস পয়েন্ট। দিনের বেলায় খোঁজ খবর করতে গেলে সংকেতের চরও ব্যাপারটা জেনে যাবে। এখন যে আমরা ওর খোঁজ করছি সেটা বোধহয় ওরা ভাবতে পারবে না। তাই যা করার এখনই করতে হবে। তার আগে দাঁড়াও। সার্চটা আরেকটু স্পেসিফিক করতে হবে। এই দেখো, এই লোকেশন গুলো তে লোক পাঠানোর দরকার নেই। কারণ সময়টা লক্ষ্য করো। এইসময় ও আমার গিন্নীর সাথে বাড়ি থেকে কিছু দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মর্নিং ওয়াক। যার ছবি ফেসবুকে তোলা আছে। এইবার এই রেকর্ডটা দেখো। এটা একদম আমার বাড়ির লোকেশন। এইবার খেয়াল করো, ১০.৪০ এর পর ওর মোবাইল আবার মুভ করা শুরু করেছে। তার আগে ওর মোবাইল লোকেশন চেঞ্জ করছে না। ১১.১০ এ দেখো একটা ফিক্সড লোকেশনে গিয়ে মোবাইলটা মিনিট দশেক একই জায়গায় ছিল। তারপর আবার মোবাইল মুভ করছে। বাকি কয়েকটা রেকর্ড দেখে বুঝতে পারবে যে সংকেত ১১.২০ নাগাদ আবার আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে। আমি জানতে চাই ১১.১০ থেকে ১১.২০ এর মধ্যে সংকেত কোথায় কোথায় ছিল? আমি যতদূর জানি এটা একটা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। খোঁজ নিয়ে দেখো।” লাহিড়ী তখনও দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছে দেখে আরিফ বললেন “ ওই খানে যতগুলো বাড়ি আছে, সব কটা বাড়ির লোক কে ঘুম থেকে ওঠাও। ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করো। দোকান দেখলে দরজায় ধাক্কা মেরে জাগাও। যদি কোনও দোকান খালি থাকে, মানে ভেতরে কেউ নেই, তাহলে সেই দোকানের নাম আর ঠিকানা নোট করে নেবে। কাল সকালে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করবে। সে বাড়ি হোক আর দোকানই হোক, সব দরজায় কড়া নেড়ে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে। আর একটা স্পাইক্যাম লাগিয়ে রাখো। এখান থেকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব আমরা দেখতে চাই। বুঝতেই পারছ খুব ফিক্সড লোকেশন। সুতরাং খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। “
দুজন দুঁদে অফিসার তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল। আরিফ বললেন “স্যার আপনি হঠাৎ করে এই লোকেশন নিয়ে এত মাতামাতি করছেন কেন? এটা তো আর শিখার বাড়ির লোকেশন নয়…” মিস্টার বেরা বললেন “ মাতামাতি করছি না। বটম আপ অ্যাপ্রচে দেখতে চাইছি এই সংকেত বাবাজীবন কোথায় কোথায় নিজের পায়ের ধুলো রেখেছেন। সেই সাথে এটাও জানতে চাইছি যে এই শহরে আর কে কে আছে যারা সংকেতকে চেনে। “ ওরা লোকেশনে গিয়ে পৌঁছে ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু করুক। তার আগে আমাদের অন্য আরেকটা জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে। অনেকক্ষণ ধরেই মনের ভেতরটা কেমন জানি খচ খচ করছে। “ উনি মোবাইল উঠিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে একটা ফোন করলেন। ম্যাডাম ফোন ওঠালেন। ঘুমে জড়ানো গলা। “ ফিরছ কখন।” স্যার বললেন “ ঘুম কাটাও, সোজা হয়ে উঠে বসে পড়ো। আমি তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু কথা লিখব। তার উত্তর দাও।” কল কেটে দিলেন।
(সঃ হল স্যার। আর মঃ হল ম্যাম)
সঃ সংকেতের বিরুদ্ধে কিছু বাজে প্রমান আমাদের হাতে এসেছে। আরেকটা জিনিস বলে রাখছি, কেসটা শিখার মার্ডার কেস নয়। তাই বাজে প্রশ্ন না করে উত্তর দাও ঠিক করে। গোটা দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে যদি আমাদের কিছু ভুল হয়।
মঃ তোমরা তো ওর ঘর সার্চ করে কিছুই পেলে না।
সঃ যা পাওয়ার পেয়ে গেছি। সংকেতকে আমাদের পেয়িং গেস্ট বানানোর ডিসিশনটা কি করে নিলে পুরোটা খুলে বলবে এইবার?
মঃ (ম্যাডাম অসংলগ্ন ভাবে অনেক কিছু লিখে গেলেন যেগুলো সাজালে এরকম দাঁড়ায়।)
১। স্যার কাজের জন্য প্রায়ই বাইরে বাইরে থাকেন। ম্যাডাম কে একা থাকতে হয়।
২। পাড়ায় চুরি চামারি লেগেই আছে। তাই এত বড় বাড়িতে একটা থাকতে ম্যাডামের অনেক দিন থেকেই ভয় ভয় করত। আর স্যারের সাথে অসংখ্য বার এই নিয়ে কথাও বলেছেন তিনি। স্যার যখন বাড়িতে ছিলেন তখনও বলেছেন স্যার যখন বাইরে ছিলেন তখনও ফোনে এই নিয়ে কথা বলেছেন।
৩। ওনাদের বেডরুমের পাশে একটা ঘর খালি পড়ে আছে সেই বহুদিন থেকে। সেখানে একটা পেয়িং গেস্ট রাখলে ম্যাডাম অনেকটা নিরাপদ ফিল করবেন। এটা নিয়েও স্যারের সাথে বহুবার ফেস টু ফেস আর ফোনে কথা হয়েছে। পেয়িং গেস্ট রাখতে না পারলে রাতে অন্তত একজন পাহারাদার রাখতে হবে। পেয়িং গেস্ট বা পাহারাদার রাখার ব্যাপারে এই লাস্ট কয়েকদিনে ওনাদের মধ্যে বহুবার আলোচনা হয়েছে। কারণ ম্যাডামের একটা থাকতে ভয় করে।
৪। তারপর একদিন ওনাদের বাড়িতে চোর এলো। এটাও উনি তক্ষুনি ফোন করে স্যার কে জানিয়েছেন।
৫। বাড়িতে চোর আসার পরে উনি আরও উঠে পড়ে লাগেন একজন পেয়িং গেস্ট রাখার ব্যাপারে। স্যারই ম্যাডামকে বলেছিলেন যে পাহারাদার রাখলে বেকার কিছু পয়সা বেরিয়ে যাবে। তাই প্রথমে পেয়িং গেস্ট খুঁজে দেখা যাক। নিতান্তই না পাওয়া গেলে তখন পাহারাদারের বন্দবস্ত দেখা যাবে। বাট পেয়িং গেস্ট অয়াস দা ফার্স্ট প্রেফারেন্স।
৬। এটা যেদিন ডিসাইড হল, ঠিক তার পরের দিনই সকাল বেলায় স্যার কাজে আবার বাইরে বেরিয়ে গেলেন দিন দুয়েকের জন্য। আর ঠিক সেইদিন কাকতালীয় ভাবে ম্যাডাম আমাকে বাজারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন।
৭। আমি ওনাকে হেল্প করি। উনি আমার প্রব্লেমের কথা শুনে আমাকে ওনাদের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকার কথা বলেন। অবশ্য তখনই বলেননি। বলেছেন এক দিন পর।
৮। আমি ওনাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই।
সঃ আমরা যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখতে চাই এই নিয়ে আর কে কে জানত?
মঃ কাউকে কিছু জানানোর আগেই তো সংকেতকে পেয়ে গেলাম।
সঃ তুমি একদম ঠিক জানো যে গল্পের ছলেও তুমি কাউকে এটা বলোনি যে তুমি পেয়িং গেস্ট খুঁজছ?
মঃ না। একদম না।
সঃ শ্যামাদিকে বলেছিলে? বা তোমার কোনও কলিগকে?
মঃ শ্যামাদির সাথে এই নিয়ে আমার কোনও দিনও কোনও কথা হয়নি। আর আমার কোনও কলিগও এই ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না।
সঃ আর তুমি বলছ যেদিন তুমি একদম বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠলে যে এইবার একটা পেয়িং গেস্ট না রাখলেই নয়, ঠিক তার পরের দিনই সংকেতকে পেয়ে গেলে কাকতালীয় ভাবে?
মঃ একই কথা আর কতবার বলাবে আমাকে দিয়ে। পেয়িং গেস্ট রাখার ব্যাপারে তো আমাদের মধ্যে রোজই কথা হত। চোর আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আরও সিরিয়াস হলাম। এই যা। কিন্তু পাড়ার যা অবস্থা, তাতে বাড়িতে একা থাকতে যে আমার ভয় লাগে সেটা তো তুমি জানতেই। আর কিছু? নাকি এইবার আমি ঘুমাতে যাব?
সঃ গুড নাইট। একটু আলার্ট থেকো।
স্যার মোবাইলটা আরিফের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ওই দিকে ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু হয়ে গেছে।
একদিকে আরিফ মন দিয়ে চ্যাটের লেখাগুলো পড়ে চলেছেন আর অন্য দিকে দুজন অফিসার মাঝ রাতে এক এক করে বাড়িতে নক করে লোকের ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমার ছবি দেখিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করছে। সত্যিই পুলিশ চাইলে পারে না এমন জিনিস হতেই পারে না। প্রায় এক ডজন বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর একটা বাড়ির কড়া নাড়তে একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে দরজা খুলে আমার ছবি দেখে আমাকে চিনতে পেরেছেন। ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে সেট কন্ট্রোল রুম থেকে বসে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। কল কনফারেন্স চলছে সেই অনেকক্ষণ ধরে। আর স্পাই ক্যামতো আছেই। মেয়েটার বয়ান নোট করে দুজন অফিসার আরও কয়েকটা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে ফাইনালি থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। আরিফের হাত থেকে মোবাইলটা ইতিমধ্যে সবার হাত ঘুরে আবার মিস্টার বেরার হাতে ফিরে এসেছে। মিস্টার রাহা বললেন “ অর্জুন , গোটা ব্যাপারটাই তো গটআপ বলে মনে হচ্ছে!” মিস্টার বেরা চেয়ার ছেড়ে আবার উঠে পড়েছেন। “আরিফ ডাইরিতে লেখো।”
১। সংকেত জানলো কি করে যে সঞ্চিতা একজন পেয়িং গেস্ট খুঁজছে?
২। সংকেত কোলকাতায় আসার আগে থেকেই ও পেয়িং গেস্ট খুঁজছিল। কারণ পাড়ার অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু আমার বাড়িতে আজ অব্দি কোনও দিন চোর আসার সাহস করেনি। চোর আসার পর সঞ্চিতা মরিয়া হয়ে উঠল পেয়িং গেস্ট রাখার জন্য। কিন্তু এই চোরটা কে?
৩। আমার বাড়ি থেকে যে ফাইলগুলো চুরি হয়েছে সেটা নিয়ে চোর কি করবে?
৪। সংকেত জানলো কি করে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা অফ করে রাখা আছে? এটা আমাকে এখন আরও বেশী করে ভাবাচ্ছে।
৫। ১৫ই আগস্ট মিস্টার ধরের বাড়ি যাওয়ার কারণ? ব্যস এই অব্দি থাক।
“আরিফ এই সব কটা প্রশ্নের উত্তর এক্ষুনি ভেবে বের করতে হবে। তুমি একজন অফিসারকে এক্ষুনি নিয়ে আসো যার নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। অন্তত আমার বাড়ির লোকেশনে কি হচ্ছে না হচ্ছে এই নিয়ে যে সব থেকে বেশী খবর দিতে পারবে। কুইক আরিফ। সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। “
কথামতন কাজ হল। একজন অফিসার এসে হাজির হল। তাকে নির্দেশ দিতেই সে বেরিয়ে গেলো। বলে দিয়ে গেলো, ৩০ মিনিটের মধ্যে এসে ব্রিফিং করবে। একজন অফিসার একটা ল্যাপটপের সামনে বসে বসে কল রেকর্ড দেখেই চলেছে। বাকিরা ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা শুরু করল। মিস্টার বেরা বললেন “মিস্টার রাহা। আপনি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলুন। আপনার হাইপোথিসিস। তারপর আমরা বাকিরা সেই নিয়ে ক্রস করতে শুরু করব। “ মিস্টার রাহা ডাইরির প্রশ্নগুলোর দিকে একমনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন “মিস্টার বেরা। আমাদের ব্রেনটাকে রেস্ট দেওয়া দরকার। একটু রিল্যাক্স করে নেওয়া যাক। আগে ওই অফিসার ফিরে আসুন। তারপর বাকি সব ভাবা যাবে। আরেকটা জিনিস, আপনার বাড়ির কাজের লোকের ব্যাপারে যে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলেন সেটার কি হল? আর মালিনী বলে মেয়েটার ব্যাপারে যে খোঁজ খবর নিতে পাঠিয়েছিলেন, তার কি হল? সেইগুলো একটু হাতে আসা দরকার। “ মিস্টার বেরা বললেন “ বেশ। একটু রেস্ট নেওয়া যাক। “ মালিনীর খবর ব্রিফ করা হল। মালিনীর ব্যাপারে আমি যতদূর জানি তার থেকে বেশী কিছু ওনারা সংগ্রহ করতে পারেননি। কল রেকর্ড এখনও ঘাঁটা হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে কয়েকটা অবসারভেশন করা গেছে। উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলো হলঃ
১। এই সিমটা চালু হয় আমি কোলকাতায় আসার ঠিক এক দিন আগে। অন্য একটা আই এম ই আই থেকে সিমটা চালু করা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে চালু করেই সিমটা খুলে ফেলা হয়। পরে সিমটা আমার মোবাইলে ঢোকানো হয়েছে। আই এম ই আই টাকে আর ট্র্যাক করা যাচ্ছে না। সিম চালু করার সময় সিমের লোকেশন ছিল বালিগঞ্জ ফাঁড়ি।
২। এই সিম থেকে প্রথম কল করি আমি, কোলকাতায় পৌঁছে। বোঝাই যাচ্ছে, তখন মোবাইলের লোকেশন হাওড়া স্টেশন।
৩। শিখা, রাকা, দোলন, বেলা আনটি, কুন্তল, মালিনী,সঞ্চিতা ম্যাডাম ইত্যাদি পরিচিত লোকজন ছাড়া আমার মোবাইলে এই অব্দি প্রায় ১৫০ ওর ওপর বিভিন্ন নাম্বারের সিম আর আই এম ই আই থেকে কল আর এস এম এস এসেছে।
৪। এই নাম্বার গুলোর একটাও এখন আর অ্যাকটিভ নেই। একটা কি দুটো কল করেই সিম খুলে নেওয়া হয়েছে। ওই আই এম ই আই গুলোও আর ট্র্যাক করা যাচ্ছে না।
৫। সিমগুলো তোলার সময় যে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছিল, যেমন, নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি, সেগুলো সব জালি।
আমার সিমটা যার নামে ওঠানো হয়েছে তার নাম সংকেত রায়। বাবার নাম সুবীর রায়। ঠিকানাঃ ব্লু রিসোর্ট হোটেল। রুম নাম্বার ১০৭। ওই ১৫০ টা সিমের লোকেশন রিপোর্ট বের করা হচ্ছে। মানে সিমগুলো যখন চালু ছিল তখনকার লোকেশন রিপোর্ট। মোটের ওপর এই। আচ্ছা ইতিমধ্যে ১০৭ নম্বর রুম সার্চ করে অফিসাররা ফিরে এসে ব্রিফিং করে দিয়েছে। নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। মিস্টার বেরার অনুমানই ঠিক। গোটা ঘরে একটাও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। দুটো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো হোটেলের দুজন রুমবয়ের আঙুলের ছাপ। অলরেডি মিলিয়ে দেখা হয়েছে। আমার চেকআউট করার পর এরাই ১০৭ নম্বর ঘরটা পরিষ্কার করেছিল। আরেকটা তথ্য একই সাথে দিয়ে রাখছি। ১০৭ নম্বর ঘরের মতন ১০৯ আর ১১০ নম্বর ঘরও সার্চ করা হয়েছে। ওই ঘর দুটোতে অবশ্য অনেকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে আমার আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। তাতে অবশ্য মিস্টার বেরা খুব একটা আশ্চর্য হননি। কারণ ওনার ধারণা যেই মিস্টার মেহেরার ঘরে ঢুকে থাকুক না কেন তার হাতে নিশ্চই দস্তানা পরা ছিল। কারণ নিজের আঙুলের ছাপ ছেড়ে যাওয়ার মতন বোকা লোক সে নয়। ফোর্থ ফ্লোরের যেই ঘরে আমি সেদিন রনির সামনে মালিনীর সাথে ফুলশয্যা করেছিলাম সেই ঘরও খুব ভালো ভাবে সার্চ করা হয়েছে। ওখানেও আমার ফিঙ্গারপ্রিন্টের হদিশ মেলেনি। মিস্টার বেরা বললেন আরিফ আরও তিনটে প্রশ্ন অ্যাড করো। আগের হাইপোথিসিস গুলো কে এইবার সত্যি ভেবে এগিয়ে পড়তে হবে। পথে বাঁধা পেলে তখন অন্য কিছু ভাবা যাবে।
৬। সংকেতের সাথে মালিনীর এত মাখামাখি কেন? রেকর্ড থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বেশ কয়েকবার ওদের মধ্যে ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি ওদের মধ্যে মেসেজ আদান প্রদানও হয়েছে। নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে কি এমন বলার থাকতে পারে যে ঘন ঘন ওর ঘরে গিয়ে সময় কাটাতে হয়? আর ফোনে এত কথা বলারই বা কি আছে? আর মেসেজ আদানপ্রদানই বা কেন?
৭। যদি ধরে নি সংকেত মিস্টার মেহেরার সাথে ধাক্কা লাগার ভান করে ওনার পকেট থেকে চাবিটা সরিয়ে নিয়েছিল, তাহলে সেই চাবিটা দিয়ে সংকেত পরের ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে কি করেছে?
৮। সংকেত কি করে জানতে পারল যে মিস্টার মুখার্জির ডিজাইন মাফিক একটা ফিউস তৈরি করে মিস্টার মেহেরার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে?
৯। সংকেত কি করে জানতে পারল যে সেই দিনই মিস্টার মেহেরার হাতে ফিউসের ফার্স্ট মডেলটা এসে পৌঁছেছে? ( কেন মিস্টার বেরার ধারণা আমাকে দুটো ফাইল আর ফিউসটাকে একসাথে চুরি করতে হল? বা অন্য ভাষায় বলতে গেলে কেন আমাকে ফিউসটা মিস্টার মেহেরার হাতে আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হয়েছে? কেন শুধু দুটো ফাইল নিয়েই আমি কেটে পড়িনি? এগুলো সবই ওনার হাইপোথিসিস। এইসব ব্যাপারে আগেই ডিটেলে লেখা হয়েছে।)
কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে হঠাৎ করেই চারপাশে অনেক অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যে কোনটা যে কেসের সাথে লিঙ্কড আর কোনটা যে লিঙ্কড নয় সেটা বোঝার সময় এখনও আসেনি। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া …” মিস্টার রাহা শান্ত গলায় বললেন “ মিস্টার বেরা, এমন হতে পারে যে এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো একে ওপরের সাথে লিঙ্কড হয়েও লিঙ্কড নয়।” মিস্টার বেরা বললেন “প্লীজ ক্লারিফাই।” মিস্টার রাহা বললেন “ ধরুন একই গ্রুপের লোকের কীর্তিকলাপের জন্যই চারপাশে হঠাৎ করে এত সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে চলেছে। আবার সেই গ্রুপটাই অ্যাকচুয়াল কেসের সাথে লিঙ্কড। তারা এই বাকি কাণ্ডগুলো করছে জাস্ট টু ক্রিয়েট…” হেসেবাকি কথা অসমাপ্ত রেখেই মিস্টার রাহা থেমে গেলেন।
মিস্টার বেরা শেষ করলেন ওনার না বলা কথাগুলো “ diversionary tactic. আমরা আজে বাজে জিনিস নিয়ে মেতে থাকব, আর ওইদিকে বাবাজী নিজের কাজ হাসিল করে কেটে পড়বে। হতেও পারে। তবুও খুঁটিয়ে দেখা ছাড়া এখন আর অন্য কোনও রাস্তা নেই। সংকেত আমাদের সাসপেক্ট আর সে হঠাৎ করে আমাদের বাড়িতে এসে উঠেছে আর হঠাৎ করে আমাদের বাড়ির কাজের লোক মিসিং। পুরোটাই কি কাকতালীয়? হতেও পারে। এদিকে আরও কয়েকটা জিনিস ক্লিয়ার হয়ে গেছে। সংকেতের বয়ান আর ওর মোবাইল লোকেশন ম্যাচ করছে। শুধু দুই একটা জিনিস নিয়ে খটকা আছে। তবে খুব মাইনর খটকা। বাট, মোটের ওপর সংকেতের সঠিক অ্যালিবাই আছে।“ পাশ থেকে রবিনবাবু বলে উঠলেন “ স্যার, সেই সাথে সংকেতের প্রচুর টাকাও আছে। আর সেই সাথে এখন সংকেতকে সিরিয়াসলি নেওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে।”
৪২
মিস্টার বেরা বললেন “ প্লীজ, গো অ্যাহেড উইথ দা গুড নিউস। “ রবিন বাবু বললেন “ স্যার সংকেতের ঘর থেকে যে ল্যাপটপটার ছবি আমরা তুলে এনেছি, খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই ল্যাপটপ ইন্ডিয়ায় পাওয়াই যায় না। আমেরিকায় মাস দুয়েক আগে সেটা লঞ্চ হয়েছে। মজার জিনিস হচ্ছে আমেরিকার বাইরে আর কোথাও এই ল্যাপটপ এখনও ওরা ছারেনি। আর এই ল্যাপটপ জেনেরাল ইউসের জন্য তৈরি করাও হয়নি। এই ল্যাপটপে গোটা পঞ্চাশেক এমন সব ফিচার আছে যেগুলো শুধু ডিফেন্সের বা সিকিউরিটির কাজ কর্মের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়েছে। তাই এর দামও অনেক। আমেরিকায় সাধারণ লোক সেই ল্যাপটপ কিনতে পারবে না। কিনতে হলে গভমেন্টের কাছ থেকে আর আর্মির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর ল্যাপটপের দাম শুনলে আপনি পড়ে যাবেন। ভারতীয় মুদ্রায় এর দাম সাড়ে চার লাখের কিছু বেশী। আর ...” মিস্টার রাহা এইবার সোজা হয়ে বসেছেন “ আর আমি যতদূর জানি ফার্স্ট লটে এই মডেলের যতগুলো প্রডাক্ট ম্যানুফ্যাকচার করা হয়েছিল তার মধ্যে একটা প্রোডাক্ট মিসিং হয়েছে।” মিস্টার বেরা বললেন “ মানে? প্লীজ ক্লারিফাই।”
মিস্টার রাহা বললেন “ ২০ দিন মতন আগে আমি আমেরিকায় গেছিলাম একটা কনফারেন্সে। ওখানে আমার চেনা একজন খুব বড় ক্রিমিনাল সাইকলজিস্ট আছেন। জন রাসেল। ওর শ্যালক জো ক্লেটন পেন্টাগনে কাজ করে। একদিন মদের ঠেকে ওর ওই শ্যালকের সাথে আমার আলাপ হয়। জানতে পারি যে মাস কয়েক আগে একটা বড় হার্ডওয়্যার কোম্পানির সাথে পেন্টাগনের কিছু ডিল সাইন হয়। ওদের অনুরোধে, ওদের আর ওদের মতন কিছু সংস্থার কাজের কথা মাথায় রেখে সেই কোম্পানি এই মডেলের ল্যাপটপ তৈরি করে। স্যাটালাইট ট্র্যাকিং, ডিভাইস ট্র্যাকিং, অ্যাডভানসড জিপিএস এরকম অনেক টেকনোলজি আছে এই ল্যাপটপে। কথা হয়েছিল অর্ডার হলে তবেই এই মডেলের ল্যাপটপ ম্যানুফাকচার করা হবে। ফার্স্ট লটের অর্ডার ছিল ৭ টা। ওরা বানিয়েছিল। কিন্তু হ্যান্ডওভার করার আগেই সেই কোম্পানির কাছ থেকে একটা ল্যাপটপ চুরি হয়ে যায়। আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে নাকি প্রচুর গোলমাল চলছিল। কারণ ভুল লোকের হাতে এই ল্যাপটপ পড়ে গেলে নাকি জিনিসটা ভালো হবে না। তাই সেটাকে উদ্ধার করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত জানা যায় যে মিডল ইস্টের কোনও একটা দেশে নাকি ল্যাপটপটা চোরা পথে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। কোন দেশ, কোন কোম্পানি, কতজন সাসপেক্ট ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই। কারণ ওই ছেলেটা আমাকে সেই নিয়ে কিছু বলেনি। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই ভীষণ গোপনীয়। আর ল্যাপটপের মডেল নাম্বার -xxxx-xx-xxxxxx। কি তাই তো? স্মরণশক্তিটা এখনও ভালোই আছে তাহলে। “ মিস্টার বেরা বললেন “আর সেই সাথে এটাও প্রমান হয়ে গেল যে আমার দুটো হাইপোথিসিস অন্তত ঠিক। এক। ছেলেটা ভীষণ গোলমেলে। দুই। ছেলেটা জেনে বুঝে লাই ডিটেক্টর মেশিনটাকে বিট করেছে। একটা প্রশ্নের উত্তরে ও বলেছিল যে ওদের টাকা নেই। অর্থাৎ ওরা গরীব, অন্তত গরীব না হলেও তেমন বড়লোক নয়। তাহলে এত দামি ল্যাপটপ ওর কাছে এলো কি করে! “
মিস্টার বেরা আবার চেয়ার থেকে উঠে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। “সেই সাথে আরও কয়েকটা জিনিস ক্লিয়ার হয়ে গেল। আরিফ কালো ডাইরিটাতে নোট করে নাও তো। “
১। সংকেত লাই ডিটেক্টর মেশিনের সামনে বসে কোনটা সত্যি কথা বলেছে আর কোনটা মিথ্যা কথা বলেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। হতে পারে ম্যাক্সিমাম উত্তরই মিথ্যা। অন্তত একটা মিথ্যা কথা যে ও বলেছে আর মেশিন সেটা ধরতে পারেনি তার প্রমান এখন আমাদের কাছে আছে।
২। আমি সিওর সংকেত ওর আসল নাম নয়। অর্থাৎ ওর বাড়ির ঠিকানাও ভুয়ো বা জালি।
৩। আমি এখন সিওর যে ১০৭ নম্বর রুমের বুকিঙটা কাকতালীয় নয়। আগেই বোঝা গেছিল যে ওটা কাকতালীয় নয়, কিন্তু এখন মোটামুটি ভাবে সিওর হয়ে বলা যায় যে ১০৯,১১০ নম্বর রুম বুক হওয়ার পরই ও ১০৭ নম্বর রুমটা বুকে করে পারপাসফুলি।
৪। গরীব সেজে আমার বাড়িতে এসে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকাটাও এখন আর কাকতালীয় ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।
৫। রঞ্জন মুখার্জির ডেথ, মিসিং ফাইল যে একই সুতোয় গাঁথা সেটা আমরা আগেই বুঝেছি।
গোটা ঘরে একটা থমথমে ভাব। মিস্টার বেরা আবার মুখ খুললেন “ তার থেকেও একটা সিরিয়াস প্রশ্ন আছে। কিন্তু ...“ উনি ঘরময় পায়চারি করছেন আর বারবার এক হাত দিয়ে অন্য হাতের চেটোতে ঘুষি মেরে চলেছেন। একসময় নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বললেন “ সংকেত হোটেলে চেকইনের টাইমে কি একটা লোকাল ঠিকানা দিয়েছিল বলে রেজিস্টারে দেখেছিলাম। আরিফ ওই ঠিকানায় লোক পাঠিয়ে দাও। একটা সমস্যা কি জানো আরিফ, একটা চুরি করা ল্যাপটপ ওর কাছে আছে বা ও বড়লোক বলে ওকে আমি জেলে ঢোকাতে পারব না। সব কিছু বুঝতে পারছি কিন্তু তবুও জেলে ভরতে পারব না এত সহজে। “ আরিফ বললেন “কেন? চোরাই ল্যাপটপটা ওর কাছে থাকা সত্ত্বেও...”
মিস্টার বেরার হঠাৎ করে যেন কিছু একটা মনে পড়েছে। উনি রবিন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন “ এই একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। লাস্ট টাইম আমি মুম্বাইতে গেছিলাম না, ওখানে একটা ভালো মোবাইল সেট গিফট পেয়েছি। দাম ৩৬ হাজার টাকা। তোমাকে আমি ২৫ হাজারে ছেড়ে দেব। তুমি বাজারে যা মোবাইল পাও তার থেকে ঢের ভালো সেট। এখনও ইউস করিনি। লাগলে বলতে পারো। তবে ফ্রিতে ছাড়ব না।” রবিন বাবু খুশি হয়ে বললেন “স্যার জানেনই তো এই একটা ব্যাপারে আমার দুর্বলতা একটু বেশী। স্পেকটা বলতে পারবেন?” মিস্টার বেরা স্পেক বললেন। রবিন বাবু লাফিয়ে উঠে বললেন “স্যার ওটা আমি এখনই বুক করে দিলাম। কাল আপনাকে নেট ট্রান্সফার করে দেব।” মিস্টার বেরা লাফিয়ে উঠে বললেন “ব্যস। আরিফ, রবিনকে গ্রেফতার করে জেলে ভরো।” আরিফ বললেন “মানে?” মিস্টার বেরা বললেন “ ধরে নাও মোবাইলটা চুরি করেছি আমি। এখন ওকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করলাম। এখন মোবাইলের মালিক রবিন। বলাই বাহুল্য এর কোনও রসিদ নেই। কিন্তু ওর কাছ থেকেই মোবাইলটা উদ্ধার হবে। তাই তো? “ আরিফ বললেন “কিন্তু স্যার...ওর কাছে চোরাই জিনিসটা থাকার মানেই যে ও কোনও খারাপ কাজ করেছে সেটা আপনি কি করে ধরে নিচ্ছেন।”
মিস্টার বেরা বললেন “ এইবার তুমি পথে এসেছ। সংকেতের কাছে চোরাই ল্যাপটপ থাকার মানেই সংকেত দোষী, এটাই বা তুমি কি করে ধরে নিচ্ছ? আর এই কথাটা আমি বলছি না, আদালতে দাঁড়িয়ে এই কথাটাই বলবে সংকেতের উকিল। আর সেই সাথে ওর উকিল এও বলে দেবে যে কার কাছ থেকে মোবাইলটা ও কিনেছে। তাকে ধরতে গিয়ে দেখবে সেই লোক অনেক আগে মার্কেট থেকে সরে পড়েছে। আচ্ছা…” একটু থেমে বললেন “ লাহিড়ী। সংকেতের মোবাইল লোকেশনের রিপোর্টটা নাও। এখন অনেক রাত জানি। আর সেটাই আমাদের প্লাস পয়েন্ট। সংকেতের একটা বড় ছবি নিয়ে দুইজন অফিসারকে পাঠাও। ১৫ই আগস্ট সকাল বেলায় সংকেত যেখানে যেখানে নিজের পায়ের ধুলো ফেলেছে ওই সব কটা লোকেশনে গিয়ে সবাই কে জিজ্ঞেস করো ছবি দেখিয়ে। দরকার আছে। দেরী করো না। “ মিস্টার লাহিড়ী মাথা চুলকে বললেন “স্যার মাথা মুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এত রাতে গিয়ে কাকে জিজ্ঞেস করব? কেই বা আমাদের হেল্প করবে? স্যার দিনের বেলায় এটা করলে ভালো হত না?”
মিস্টার বেরা চেঁচিয়ে উঠলেন “মূর্খ, রাতে খোঁজ খবর করাই আমাদের প্লাস পয়েন্ট। দিনের বেলায় খোঁজ খবর করতে গেলে সংকেতের চরও ব্যাপারটা জেনে যাবে। এখন যে আমরা ওর খোঁজ করছি সেটা বোধহয় ওরা ভাবতে পারবে না। তাই যা করার এখনই করতে হবে। তার আগে দাঁড়াও। সার্চটা আরেকটু স্পেসিফিক করতে হবে। এই দেখো, এই লোকেশন গুলো তে লোক পাঠানোর দরকার নেই। কারণ সময়টা লক্ষ্য করো। এইসময় ও আমার গিন্নীর সাথে বাড়ি থেকে কিছু দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। মর্নিং ওয়াক। যার ছবি ফেসবুকে তোলা আছে। এইবার এই রেকর্ডটা দেখো। এটা একদম আমার বাড়ির লোকেশন। এইবার খেয়াল করো, ১০.৪০ এর পর ওর মোবাইল আবার মুভ করা শুরু করেছে। তার আগে ওর মোবাইল লোকেশন চেঞ্জ করছে না। ১১.১০ এ দেখো একটা ফিক্সড লোকেশনে গিয়ে মোবাইলটা মিনিট দশেক একই জায়গায় ছিল। তারপর আবার মোবাইল মুভ করছে। বাকি কয়েকটা রেকর্ড দেখে বুঝতে পারবে যে সংকেত ১১.২০ নাগাদ আবার আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছে। আমি জানতে চাই ১১.১০ থেকে ১১.২০ এর মধ্যে সংকেত কোথায় কোথায় ছিল? আমি যতদূর জানি এটা একটা রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। খোঁজ নিয়ে দেখো।” লাহিড়ী তখনও দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছে দেখে আরিফ বললেন “ ওই খানে যতগুলো বাড়ি আছে, সব কটা বাড়ির লোক কে ঘুম থেকে ওঠাও। ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করো। দোকান দেখলে দরজায় ধাক্কা মেরে জাগাও। যদি কোনও দোকান খালি থাকে, মানে ভেতরে কেউ নেই, তাহলে সেই দোকানের নাম আর ঠিকানা নোট করে নেবে। কাল সকালে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করবে। সে বাড়ি হোক আর দোকানই হোক, সব দরজায় কড়া নেড়ে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবে। আর একটা স্পাইক্যাম লাগিয়ে রাখো। এখান থেকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব আমরা দেখতে চাই। বুঝতেই পারছ খুব ফিক্সড লোকেশন। সুতরাং খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। “
দুজন দুঁদে অফিসার তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেল। আরিফ বললেন “স্যার আপনি হঠাৎ করে এই লোকেশন নিয়ে এত মাতামাতি করছেন কেন? এটা তো আর শিখার বাড়ির লোকেশন নয়…” মিস্টার বেরা বললেন “ মাতামাতি করছি না। বটম আপ অ্যাপ্রচে দেখতে চাইছি এই সংকেত বাবাজীবন কোথায় কোথায় নিজের পায়ের ধুলো রেখেছেন। সেই সাথে এটাও জানতে চাইছি যে এই শহরে আর কে কে আছে যারা সংকেতকে চেনে। “ ওরা লোকেশনে গিয়ে পৌঁছে ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু করুক। তার আগে আমাদের অন্য আরেকটা জিনিস নিয়ে ভাবতে হবে। অনেকক্ষণ ধরেই মনের ভেতরটা কেমন জানি খচ খচ করছে। “ উনি মোবাইল উঠিয়ে সঞ্চিতা ম্যাডামকে একটা ফোন করলেন। ম্যাডাম ফোন ওঠালেন। ঘুমে জড়ানো গলা। “ ফিরছ কখন।” স্যার বললেন “ ঘুম কাটাও, সোজা হয়ে উঠে বসে পড়ো। আমি তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু কথা লিখব। তার উত্তর দাও।” কল কেটে দিলেন।
(সঃ হল স্যার। আর মঃ হল ম্যাম)
সঃ সংকেতের বিরুদ্ধে কিছু বাজে প্রমান আমাদের হাতে এসেছে। আরেকটা জিনিস বলে রাখছি, কেসটা শিখার মার্ডার কেস নয়। তাই বাজে প্রশ্ন না করে উত্তর দাও ঠিক করে। গোটা দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে যদি আমাদের কিছু ভুল হয়।
মঃ তোমরা তো ওর ঘর সার্চ করে কিছুই পেলে না।
সঃ যা পাওয়ার পেয়ে গেছি। সংকেতকে আমাদের পেয়িং গেস্ট বানানোর ডিসিশনটা কি করে নিলে পুরোটা খুলে বলবে এইবার?
মঃ (ম্যাডাম অসংলগ্ন ভাবে অনেক কিছু লিখে গেলেন যেগুলো সাজালে এরকম দাঁড়ায়।)
১। স্যার কাজের জন্য প্রায়ই বাইরে বাইরে থাকেন। ম্যাডাম কে একা থাকতে হয়।
২। পাড়ায় চুরি চামারি লেগেই আছে। তাই এত বড় বাড়িতে একটা থাকতে ম্যাডামের অনেক দিন থেকেই ভয় ভয় করত। আর স্যারের সাথে অসংখ্য বার এই নিয়ে কথাও বলেছেন তিনি। স্যার যখন বাড়িতে ছিলেন তখনও বলেছেন স্যার যখন বাইরে ছিলেন তখনও ফোনে এই নিয়ে কথা বলেছেন।
৩। ওনাদের বেডরুমের পাশে একটা ঘর খালি পড়ে আছে সেই বহুদিন থেকে। সেখানে একটা পেয়িং গেস্ট রাখলে ম্যাডাম অনেকটা নিরাপদ ফিল করবেন। এটা নিয়েও স্যারের সাথে বহুবার ফেস টু ফেস আর ফোনে কথা হয়েছে। পেয়িং গেস্ট রাখতে না পারলে রাতে অন্তত একজন পাহারাদার রাখতে হবে। পেয়িং গেস্ট বা পাহারাদার রাখার ব্যাপারে এই লাস্ট কয়েকদিনে ওনাদের মধ্যে বহুবার আলোচনা হয়েছে। কারণ ম্যাডামের একটা থাকতে ভয় করে।
৪। তারপর একদিন ওনাদের বাড়িতে চোর এলো। এটাও উনি তক্ষুনি ফোন করে স্যার কে জানিয়েছেন।
৫। বাড়িতে চোর আসার পরে উনি আরও উঠে পড়ে লাগেন একজন পেয়িং গেস্ট রাখার ব্যাপারে। স্যারই ম্যাডামকে বলেছিলেন যে পাহারাদার রাখলে বেকার কিছু পয়সা বেরিয়ে যাবে। তাই প্রথমে পেয়িং গেস্ট খুঁজে দেখা যাক। নিতান্তই না পাওয়া গেলে তখন পাহারাদারের বন্দবস্ত দেখা যাবে। বাট পেয়িং গেস্ট অয়াস দা ফার্স্ট প্রেফারেন্স।
৬। এটা যেদিন ডিসাইড হল, ঠিক তার পরের দিনই সকাল বেলায় স্যার কাজে আবার বাইরে বেরিয়ে গেলেন দিন দুয়েকের জন্য। আর ঠিক সেইদিন কাকতালীয় ভাবে ম্যাডাম আমাকে বাজারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন।
৭। আমি ওনাকে হেল্প করি। উনি আমার প্রব্লেমের কথা শুনে আমাকে ওনাদের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকার কথা বলেন। অবশ্য তখনই বলেননি। বলেছেন এক দিন পর।
৮। আমি ওনাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই।
সঃ আমরা যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট রাখতে চাই এই নিয়ে আর কে কে জানত?
মঃ কাউকে কিছু জানানোর আগেই তো সংকেতকে পেয়ে গেলাম।
সঃ তুমি একদম ঠিক জানো যে গল্পের ছলেও তুমি কাউকে এটা বলোনি যে তুমি পেয়িং গেস্ট খুঁজছ?
মঃ না। একদম না।
সঃ শ্যামাদিকে বলেছিলে? বা তোমার কোনও কলিগকে?
মঃ শ্যামাদির সাথে এই নিয়ে আমার কোনও দিনও কোনও কথা হয়নি। আর আমার কোনও কলিগও এই ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না।
সঃ আর তুমি বলছ যেদিন তুমি একদম বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠলে যে এইবার একটা পেয়িং গেস্ট না রাখলেই নয়, ঠিক তার পরের দিনই সংকেতকে পেয়ে গেলে কাকতালীয় ভাবে?
মঃ একই কথা আর কতবার বলাবে আমাকে দিয়ে। পেয়িং গেস্ট রাখার ব্যাপারে তো আমাদের মধ্যে রোজই কথা হত। চোর আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আরও সিরিয়াস হলাম। এই যা। কিন্তু পাড়ার যা অবস্থা, তাতে বাড়িতে একা থাকতে যে আমার ভয় লাগে সেটা তো তুমি জানতেই। আর কিছু? নাকি এইবার আমি ঘুমাতে যাব?
সঃ গুড নাইট। একটু আলার্ট থেকো।
স্যার মোবাইলটা আরিফের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ওই দিকে ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু হয়ে গেছে।
একদিকে আরিফ মন দিয়ে চ্যাটের লেখাগুলো পড়ে চলেছেন আর অন্য দিকে দুজন অফিসার মাঝ রাতে এক এক করে বাড়িতে নক করে লোকের ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমার ছবি দেখিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করছে। সত্যিই পুলিশ চাইলে পারে না এমন জিনিস হতেই পারে না। প্রায় এক ডজন বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর একটা বাড়ির কড়া নাড়তে একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসে দরজা খুলে আমার ছবি দেখে আমাকে চিনতে পেরেছেন। ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছে সেট কন্ট্রোল রুম থেকে বসে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। কল কনফারেন্স চলছে সেই অনেকক্ষণ ধরে। আর স্পাই ক্যামতো আছেই। মেয়েটার বয়ান নোট করে দুজন অফিসার আরও কয়েকটা বাড়িতে খোঁজ নিয়ে ফাইনালি থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। আরিফের হাত থেকে মোবাইলটা ইতিমধ্যে সবার হাত ঘুরে আবার মিস্টার বেরার হাতে ফিরে এসেছে। মিস্টার রাহা বললেন “ অর্জুন , গোটা ব্যাপারটাই তো গটআপ বলে মনে হচ্ছে!” মিস্টার বেরা চেয়ার ছেড়ে আবার উঠে পড়েছেন। “আরিফ ডাইরিতে লেখো।”
১। সংকেত জানলো কি করে যে সঞ্চিতা একজন পেয়িং গেস্ট খুঁজছে?
২। সংকেত কোলকাতায় আসার আগে থেকেই ও পেয়িং গেস্ট খুঁজছিল। কারণ পাড়ার অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু আমার বাড়িতে আজ অব্দি কোনও দিন চোর আসার সাহস করেনি। চোর আসার পর সঞ্চিতা মরিয়া হয়ে উঠল পেয়িং গেস্ট রাখার জন্য। কিন্তু এই চোরটা কে?
৩। আমার বাড়ি থেকে যে ফাইলগুলো চুরি হয়েছে সেটা নিয়ে চোর কি করবে?
৪। সংকেত জানলো কি করে ফার্স্ট ফ্লোরের ক্যামেরা অফ করে রাখা আছে? এটা আমাকে এখন আরও বেশী করে ভাবাচ্ছে।
৫। ১৫ই আগস্ট মিস্টার ধরের বাড়ি যাওয়ার কারণ? ব্যস এই অব্দি থাক।
“আরিফ এই সব কটা প্রশ্নের উত্তর এক্ষুনি ভেবে বের করতে হবে। তুমি একজন অফিসারকে এক্ষুনি নিয়ে আসো যার নেটওয়ার্ক খুব স্ট্রং। অন্তত আমার বাড়ির লোকেশনে কি হচ্ছে না হচ্ছে এই নিয়ে যে সব থেকে বেশী খবর দিতে পারবে। কুইক আরিফ। সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। “
কথামতন কাজ হল। একজন অফিসার এসে হাজির হল। তাকে নির্দেশ দিতেই সে বেরিয়ে গেলো। বলে দিয়ে গেলো, ৩০ মিনিটের মধ্যে এসে ব্রিফিং করবে। একজন অফিসার একটা ল্যাপটপের সামনে বসে বসে কল রেকর্ড দেখেই চলেছে। বাকিরা ওই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা শুরু করল। মিস্টার বেরা বললেন “মিস্টার রাহা। আপনি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলুন। আপনার হাইপোথিসিস। তারপর আমরা বাকিরা সেই নিয়ে ক্রস করতে শুরু করব। “ মিস্টার রাহা ডাইরির প্রশ্নগুলোর দিকে একমনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন “মিস্টার বেরা। আমাদের ব্রেনটাকে রেস্ট দেওয়া দরকার। একটু রিল্যাক্স করে নেওয়া যাক। আগে ওই অফিসার ফিরে আসুন। তারপর বাকি সব ভাবা যাবে। আরেকটা জিনিস, আপনার বাড়ির কাজের লোকের ব্যাপারে যে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলেন সেটার কি হল? আর মালিনী বলে মেয়েটার ব্যাপারে যে খোঁজ খবর নিতে পাঠিয়েছিলেন, তার কি হল? সেইগুলো একটু হাতে আসা দরকার। “ মিস্টার বেরা বললেন “ বেশ। একটু রেস্ট নেওয়া যাক। “ মালিনীর খবর ব্রিফ করা হল। মালিনীর ব্যাপারে আমি যতদূর জানি তার থেকে বেশী কিছু ওনারা সংগ্রহ করতে পারেননি। কল রেকর্ড এখনও ঘাঁটা হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে কয়েকটা অবসারভেশন করা গেছে। উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলো হলঃ
১। এই সিমটা চালু হয় আমি কোলকাতায় আসার ঠিক এক দিন আগে। অন্য একটা আই এম ই আই থেকে সিমটা চালু করা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে চালু করেই সিমটা খুলে ফেলা হয়। পরে সিমটা আমার মোবাইলে ঢোকানো হয়েছে। আই এম ই আই টাকে আর ট্র্যাক করা যাচ্ছে না। সিম চালু করার সময় সিমের লোকেশন ছিল বালিগঞ্জ ফাঁড়ি।
২। এই সিম থেকে প্রথম কল করি আমি, কোলকাতায় পৌঁছে। বোঝাই যাচ্ছে, তখন মোবাইলের লোকেশন হাওড়া স্টেশন।
৩। শিখা, রাকা, দোলন, বেলা আনটি, কুন্তল, মালিনী,সঞ্চিতা ম্যাডাম ইত্যাদি পরিচিত লোকজন ছাড়া আমার মোবাইলে এই অব্দি প্রায় ১৫০ ওর ওপর বিভিন্ন নাম্বারের সিম আর আই এম ই আই থেকে কল আর এস এম এস এসেছে।
৪। এই নাম্বার গুলোর একটাও এখন আর অ্যাকটিভ নেই। একটা কি দুটো কল করেই সিম খুলে নেওয়া হয়েছে। ওই আই এম ই আই গুলোও আর ট্র্যাক করা যাচ্ছে না।
৫। সিমগুলো তোলার সময় যে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছিল, যেমন, নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি, সেগুলো সব জালি।
আমার সিমটা যার নামে ওঠানো হয়েছে তার নাম সংকেত রায়। বাবার নাম সুবীর রায়। ঠিকানাঃ ব্লু রিসোর্ট হোটেল। রুম নাম্বার ১০৭। ওই ১৫০ টা সিমের লোকেশন রিপোর্ট বের করা হচ্ছে। মানে সিমগুলো যখন চালু ছিল তখনকার লোকেশন রিপোর্ট। মোটের ওপর এই। আচ্ছা ইতিমধ্যে ১০৭ নম্বর রুম সার্চ করে অফিসাররা ফিরে এসে ব্রিফিং করে দিয়েছে। নতুন কিছু পাওয়া যায়নি। মিস্টার বেরার অনুমানই ঠিক। গোটা ঘরে একটাও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি। দুটো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো হোটেলের দুজন রুমবয়ের আঙুলের ছাপ। অলরেডি মিলিয়ে দেখা হয়েছে। আমার চেকআউট করার পর এরাই ১০৭ নম্বর ঘরটা পরিষ্কার করেছিল। আরেকটা তথ্য একই সাথে দিয়ে রাখছি। ১০৭ নম্বর ঘরের মতন ১০৯ আর ১১০ নম্বর ঘরও সার্চ করা হয়েছে। ওই ঘর দুটোতে অবশ্য অনেকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে আমার আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি। তাতে অবশ্য মিস্টার বেরা খুব একটা আশ্চর্য হননি। কারণ ওনার ধারণা যেই মিস্টার মেহেরার ঘরে ঢুকে থাকুক না কেন তার হাতে নিশ্চই দস্তানা পরা ছিল। কারণ নিজের আঙুলের ছাপ ছেড়ে যাওয়ার মতন বোকা লোক সে নয়। ফোর্থ ফ্লোরের যেই ঘরে আমি সেদিন রনির সামনে মালিনীর সাথে ফুলশয্যা করেছিলাম সেই ঘরও খুব ভালো ভাবে সার্চ করা হয়েছে। ওখানেও আমার ফিঙ্গারপ্রিন্টের হদিশ মেলেনি। মিস্টার বেরা বললেন আরিফ আরও তিনটে প্রশ্ন অ্যাড করো। আগের হাইপোথিসিস গুলো কে এইবার সত্যি ভেবে এগিয়ে পড়তে হবে। পথে বাঁধা পেলে তখন অন্য কিছু ভাবা যাবে।
৬। সংকেতের সাথে মালিনীর এত মাখামাখি কেন? রেকর্ড থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বেশ কয়েকবার ওদের মধ্যে ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। এমনকি ওদের মধ্যে মেসেজ আদান প্রদানও হয়েছে। নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে কি এমন বলার থাকতে পারে যে ঘন ঘন ওর ঘরে গিয়ে সময় কাটাতে হয়? আর ফোনে এত কথা বলারই বা কি আছে? আর মেসেজ আদানপ্রদানই বা কেন?
৭। যদি ধরে নি সংকেত মিস্টার মেহেরার সাথে ধাক্কা লাগার ভান করে ওনার পকেট থেকে চাবিটা সরিয়ে নিয়েছিল, তাহলে সেই চাবিটা দিয়ে সংকেত পরের ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে কি করেছে?
৮। সংকেত কি করে জানতে পারল যে মিস্টার মুখার্জির ডিজাইন মাফিক একটা ফিউস তৈরি করে মিস্টার মেহেরার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে?
৯। সংকেত কি করে জানতে পারল যে সেই দিনই মিস্টার মেহেরার হাতে ফিউসের ফার্স্ট মডেলটা এসে পৌঁছেছে? ( কেন মিস্টার বেরার ধারণা আমাকে দুটো ফাইল আর ফিউসটাকে একসাথে চুরি করতে হল? বা অন্য ভাষায় বলতে গেলে কেন আমাকে ফিউসটা মিস্টার মেহেরার হাতে আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হয়েছে? কেন শুধু দুটো ফাইল নিয়েই আমি কেটে পড়িনি? এগুলো সবই ওনার হাইপোথিসিস। এইসব ব্যাপারে আগেই ডিটেলে লেখা হয়েছে।)