05-03-2019, 03:10 PM
উনি একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন “ না না। আমি তোমাকে কেন হঠাত করে সন্দেহ করতে যাব। বলছি না এরকম আগেও হয়েছে, আর তখন তো তুমি এখানে ছিলে না।” আমি আরও অনেক হিসাব দিতে পারতাম যে শ্যামাদি আর কি কি সরিয়েছে এই বাড়ি থেকে। কিন্তু সেগুলো বললে ম্যাডাম উল্টে আমাকে সন্দেহ করতে পারেন। কিন্তু আমি খুব ভালো করে জানি যে ও এই বাড়ি থেকে আর কি কি সরিয়েছে। যাই হোক প্রত্যক্ষ প্রমান দিয়ে যেটুকু বলা যায় সেটুকু বললেই চলবে আপাতত। উনি শ্যামাদিকে তাড়ান বা নাই তাড়ান সেটা নিয়ে আমার কোনও মাথা ব্যাথা নেই। আমার শুধু এইটুকু লক্ষ্য ছিল যে ম্যাডামের মনে শ্যামাদির ব্যাপারে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া যাতে উনি আর ভবিষ্যতে শ্যামাদির কথার ওপর (অন্তত আমার ব্যাপারে বলা কথার ওপর) তেমন আমল না করেন। কাজ হয়ে গেছে। উঠে পড়লাম। আমার প্লেটটা টেবিলে থেকে ওঠাতে যাব এমন সময় ম্যাডাম বললেন “রেখে দাও। ও তোমাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি নিয়ে যাব। বাই দা অয়ে, এখন কি করবে?” বললাম “তেমন কিছু না। একটু জামা কাপড় বই পত্র গুছিয়ে রাখব।” উনি বললেন “ ওয়ারড্রবটা খালি করে দিয়েছি। ওখানে রেখো জামা কাপড়।” আমি মাথা নেড়ে সিঁড়ির দিকে যাত্রা শুরতে করতে যাব, এমন সময় কি একটা মনে হওয়ায় দাঁড়িয়ে হিপ পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করে তার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে সযত্নে রেখে দিলাম টেবিলের ওপর। ম্যাডাম ব্যস্ত হয়ে বললেন “এত তাড়াহুড়ার কি আছে?” বললাম “দায়িত্ব মিটিয়ে নিলাম। এইবার স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারব। আসি? ও হ্যাঁ, আজ বিকালের দিকে একটু বেরব।”
ওনার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে এলাম। ঘর গোছাতে লাগল ঠিক দশ মিনিট। মানে সব জিনিস বের করার তো মানে নেই। শুধু কাজের জিনিসগুলো বের করে সাজিয়ে রাখলাম। ঘরে ঢুকে অবশ্য দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন একটা ঘুম দিতে হবে। মোবাইলটা এতক্ষন সাইলেন্ট করে রাখা ছিল। সেটা বের করে দেখলাম তাতে চারটে মেসেজ এসেছে। নাহ মালিনী একটাও মেসেজ করেনি। বোধহয় এখনও ঘুমাচ্ছে। জানি না ঘুম থেকে ওঠার পর আজ কি হবে ওর। একটা মেসেজ কোথা থেকে এসেছে সেটা বলার কোনও মানে দাঁড়াচ্ছে না। একটা মেসেজ এসেছে রাকার কাছ থেকে, সারমর্ম হল আমি যেন ভুলে না যাই যে ওর সাথে আজ আমার দেখা করার কথা। একটা মেসেজ এসেছে দোলনের কাছ থেকে, সারমর্ম হল এই যে ওর কিছু কথা বলার আছে। আরেকটা মেসেজ এসেছে খুব অপ্রত্যাশিত একজনের কাছ থেকে। শিখাদি। সারমর্মঃ ওরও নাকি আমার সাথে কিছু কথা আছে। রাকা আর দোলন আমার সাথে কি কথা বলবে সেটা মোটামুটি বুঝতে পারছি, কিন্তু শিখাদি? হতে পারে সেদিন যে ওর সেন্সলেস হওয়ার সুযোগ নিয়ে ওকে আমি ;., করেছি সেই নিয়ে সরাসরি কথা বলে আমাকে ধমকি দিতে চায়। আমাকে দেবে ধমকি! ভালো! মজা হবে বেশ। আপাতত একটা লম্বা ঘুম। দুপুরে উঠে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে তারপর এইসব ভাবা যাবে। আমি শুধু রাকার মেসেজটার রিপ্লাই দিলাম “মনে আছে। দেখা হবে। তবে দেরী করিস না। “ ইচ্ছে করেই দোলনকে কোনও রিপ্লাই দিলাম না। আর শিখার মেসেজের রিপ্লাই দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। কানে হেডফোন গুজে সেই বিখ্যাত দামি মোবাইলে একটা ভালো রেডিও স্টেশন চালিয়ে চোখ বুজলাম।
ঘুম ভাঙল একটা ফোনে। মোবাইলটা বাজছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে বারোটা। মালিনী! দুই বার ভালো করে গলা খাঁকড়িয়ে ঘুমের আমেজটা কাটিয়ে নিয়ে ফোন ধরলাম। ওই দিক থেকে গলার প্রথম আওয়াজটা ভেসে আসতেই বুঝতে পারলাম যে ওই দিকে ভয় করার মতন কিছু ঘটেনি, অর্থাৎ রনি গতকাল রাতের কোনও কথাই মনে করতে পারেনি। আমি বললাম “ডার্লিং, এতক্ষনে ওঠা হল ঘুম থেকে? অবশ্য ফুল শয্যার পরের দিন মেয়েরা দেরী করে না উঠলে বরের অপমান।” ও মিষ্টি হেসে বলল “আমি এখন কাউন্টারে আছি। এই মাত্র এলাম। এখন এইসব বলবে না। না ওর কিছু মনে নেই। তবে প্রচুর হ্যাং ওভার আছে। কিন্তু বাসের সময় হয়ে যাচ্ছে বলে রেডি হয়ে বেরিয়ে যাবে একটু পরে। তোমার খবর নিচ্ছিল। বলেছে আবার তোমার সাথে বসে পার্টি করবে! আমি ওকে বলেছি যে এরকম ভাবে মদ খেয়ে আউট হয়ে বমি করলে আর কারোর সাথে তোমার আলাপ করাব না। কারণ তাতে আমার প্রেস্টিজ হ্যাম্পারড হচ্ছে। যাই হোক, যে কারণে ফোন করলাম সেটা হল, “ আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম “হ্যাঁ, ঘরে ফেরার পর ঘুম আসছিল না তাই শিফট করে নিলাম। এতক্ষন ধরে ঘর গোছাচ্ছি। কোথায় নতুন বউ ঘর গোছায়, কিন্তু এখানে…(একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম) কি আর করব। পোড়া কপাল আমার। তবে এক দিক থেকে ভালো হল। সামনের সপ্তাহ থেকে বাইরে দেখা করতে পারব যখন তোমার ডিউটি থাকবে না। আর এটা শুনে শান্তি পেলাম যে তোমার ভোঁদাই বরটার গতকালের ব্যাপারে কিছুই মনে নেই। ভালো থেকো। “ ওর কাউন্টারে বোধহয় কেউ একজন এসেছে। ও আমাকে সংক্ষেপে বলল “ পরে কথা হবে। এখন রাখছি। কাজ আছে। “ আমি হেসে ফোন কেটে দিলাম।
উঠে পড়লাম। ব্রাশ, পেস্ট, রেজার ক্রিম, শাওয়ার জেল, শ্যাম্পু আর একটা তোয়ালে নিয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। একটাই সমস্যা এখানে, সব জামা কাপড়, সব কিছু নিজেকেই কাচাকাচি করতে হবে। তাও আবার কোনও অয়াশিং মেশিন ছাড়া, মেঝেতে বসে ধোপাদের মতন কাপড় কাচতে হবে রোজ। যাই হোক, কয়েক দিন এই ভাবেই না হয় কাটিয়ে নেওয়া যাক। ঘুম ভাঙার পর একটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে হ্যাংওভার কেটে গেছে। এখন শরীর পুরো ঝরঝরে। ভালো ভাবে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে জানলার নিচটা একবার দেখে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। জানলার দিকটা বাড়ির পেছন দিক। পেছন দিকের বিশাল পাঁচিল আর বাড়ির দেওয়ালের মাঝে একটা ছোট বাগান আছে। তবে দেখে মনে হল যে পরিচর্যার অভাবে অধিকাংশ গাছের অবস্থা খুব খারাপ। ফুল প্রায় নেই বললেই চলে। জল না দিলে গাছ গুলো আর বেশী দিন বাঁচবে বলে মনে হয় না। অবশ্য বৃষ্টি হলে অন্য ব্যাপার। খবরে শুনেছি যে নিম্নচাপের একটা সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে গাছগুলো প্রানে বেঁচে গেলেও যেতে পারে। সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আরও কিছুক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাঁচিলের উল্টো দিকে একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে বলে মনে হল। তার ঠিক পরেই একটা ডোবা। আর তার পরেই একটা ছোট বস্তি আছে। সেখানে কিছু লোকজনের চলা ফেরা দেখতে পাচ্ছি। কয়েকটা দোকান পাটও আছে। হুঁশ ফিরল, দরজায় কেউ নক করছে। জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। ম্যাডাম।
“কি ঘুমাচ্ছিলে?” মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম যে ওনার অনুমান নির্ভুল। এখনও ওনার পরিধানে সেই একই নাইটি যেটা পরে উনি সকালে আমার সামনে এসেছিলেন। মুখে সেই হাসি খুশি ভাবটা থাকলেও ওনাকে দেখে বুঝতে পারলাম যে সম্প্রতি উনি কোনও কারণে চিন্তায় পরে ছেন। সম্প্রতি বলতে মানে বিগত কয়েক মিনিটের মধ্যে। আগের দিনও ওনার মোবাইলে সেই মেসেজটা আসার পর ওনার মুখে ঠিক এমনই একটা টেন্সড ভাব দেখেছিলাম। উনি অন্যমনস্ক ভাবে ঘরের ভেতর ঢুকে টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। উনি অবশ্য বিছানার দিকে মুখ করে বসেছেন, টেবিলের দিকে মুখ করে নয়। সময়ের সাথে সাথে ওনার মুখের ওপর চিন্তার ছাপটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঘরে লাইট অন করার দরকার পরে নি কারণ বাইরে প্রচুর আলো। তবে পর্দা টেনে রাখায় ঘরের আলো এখন কিছুটা হলেও কম। আমি চুপচাপ ওনার সামনে বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়লাম। দুজনেই চুপ। উনি ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছেন অন্যমনস্কভাবে, চোখের দৃষ্টিতে একটা অসহায় ভয়ার্ত ভাব ফুটে আছে আবছা ভাবে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে যাওয়ার পর আমি একটু গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে বললাম “কিছু বলবেন? আমার এখানে আসায় যদি আপনার কোনও প্রবলেম থাকে তাহলে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। আপনার কোনও অসুবিধা হোক এমন অভিপ্রায় আমার নেই।” উনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “ না না তুমি আসাতে আমি একটু নিশ্চিন্ত হয়েছি। আসলে আমার বর তো বাইরে বাইরে থাকে। “ একটু থেমে অন্যমনস্ক ভাবেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “ তুমি বেরোবে বলছিলে না তখন?” বললাম “হ্যাঁ।” বললেন “কটায় বেরোবে?” বললাম “তিনটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।” উনি সাথে সাথে প্রশ্ন করলেন “ কোথায় যাচ্ছ?” উত্তর আমার ঠিক করাই ছিল, কিন্তু উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হল না। উনি নিজেই বললেন “না না তোমার পার্সোনাল ব্যাপারে কোনও নাক গলানোর ইচ্ছে আমার নেই। শুধু পড়াশুনার ব্যাপারটা…” আবার উনি অন্যমনস্ক ভাবে থেমে গেলেন। দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ ধরে। বললাম “আসলে কয়েকটা জিনিস জেরক্স করার আছে। বই কিনে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ দুই একটা গল্পের বই কেনার প্ল্যান করছি। একটু এই দিকের রাস্তা ঘাট গুলো ঘুরে দেখব। আর একজনের সাথে দেখা করার কথা। আমাদের গ্রামের লোক। কোলকাতায় এসেছেন।” উনি যেন আমার কথা শুনেও শুনলেন না। জিজ্ঞেস করলেন “কটার মধ্যে ফিরবে?” বললাম “ কেন আপনার কি কোনও কাজ আছে? আমার হেল্প লাগলে বলুন। “ উনি অন্যমনস্ক ভাবটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললেন “ না না। এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম। আসলে… সেই চোর আসার ব্যাপারটার পর থেকে একা থাকতে একটু ভয় লাগে। তেমন কিছু না। তুমি তোমার কাজ সেরে এসো।” আমি বললাম “আমি সাড়ে সাতটার ভেতর ফিরে আসব আর কোনও বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি চোরের আগমন সচরাচর হয় বলে শুনিনি।” ইচ্ছে ছিল জিজ্ঞেস করি যে আপনার বর কখন ফিরবে, কিন্তু ওই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না জেনে বুঝে। উনি ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
উনি যখন দরজার একদম মুখে গিয়ে পৌঁছেছেন, আমি বললাম “ম্যাডাম, চিন্তা করবেন না। এর পর চোর এলে এমন উত্তম মধ্যম দেব যে সে আর এই মুখো সাত জন্মে হবে না।” উনি একবার ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মুখে জোড় করে একটা হাসি আনার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, তারপর আবার বাইরে যেতে যেতে বললেন “চোর হলে এতটা চিন্তিত হতাম না…” বাকি কথাগুলো ওনার সাথেই মিলিয়ে গেল। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম উনি অন্যমনস্ক ভাবে প্রায় টলতে টলতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলেছেন। বললাম “ম্যাডাম, লাঞ্চের সময় বলবেন। “ উনি আমার দিকে ফিরেও দেখলেন না। শুধু মাথা নেড়ে নিচে নেমে গেলেন। তবে ঘরে ঢোকার আগে নিচ থেকে ওনার গলার স্বর কানে এলো। “আর এক ঘণ্টা পর খেতে বসব। চলে এসো।”
আমি ঘরে ঢুকে জরুরি কয়েকটা ফোন সেরে নিলাম। পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসে চোখ বুজলাম। এই বেলা একটু ধ্যান করে নেওয়া দরকার। ধ্যান করলে শুধু কনসেন্ট্রেশন বাড়ে না, অনেক সময় মনের অনেক জট পরিষ্কার হয়ে যায়। আর মেডিটেশানে বসলে সময়টা খুব শান্ত ভাবে কেটে যায়। মনের জট কাটল কি না বলতে পারি না, তবে, ছোট মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে ওঠায় পদ্মাসন ভেঙ্গে উঠে পড়লাম। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েও ধরালাম না। এত শান্ত মন নিয়ে সিগারেট খাবার টান খুব একটা থাকে না। দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। নিচে নেমে দেখলাম ম্যাডাম টিভি চালিয়ে বসে আছেন। সামনে কিছু একটা নিউজ চলছে। তবে ওনার সেই দিকে কোনও খেয়াল নেই। উনি ওনার স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছেন। দুই হাতের আঙুলগুলো টাচ স্ক্রিনের ওপর অবিশ্রাম নড়ে চলেছে। কাকে উনি এত মেসেজ করে চলেছেন?
অবশ্য ফেসবুক আর হোয়াটসআপের যুগে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আমি অবশ্য খবরের সারমর্মটা বুঝতে পেরেছি। সেই নিম্নচাপ আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই যেকোনো সময়ে এসে আছড়ে পড়বে কোলকাতার ওপর। অবশ্য এর প্রবল প্রকোপ দেখতে পাওয়া যাবে সমুদ্রে, তাই যারা মাছ ধরতে যাবে তাদের কে সরকার এই খবরের মাধ্যমে সতর্ক করে দিচ্ছে। তবে কোলকাতাও এই নিম্নচাপের ধাক্কায় ভেসে যেতে পারে, অন্তত খবরে তাই বলা হয়েছে। আমি ম্যাডামের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার পায়ের শব্দ শুনতে পাননি। এখনও এক মনে মেসেজ করে চলেছেন। আবারও গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ আহহ, আপনি বুঝি খুব নিউজ দেখেন?” আর কি বলব সেটা জানি না। উনি আমার গলার আওয়াজ পেয়ে যেন চমকে উঠলেন। মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়েই মোবাইলের গায়ের সুইচটা চেপে মোবাইলের স্ক্রিনটা অন্ধকার করে দিলেন, মানে মোবাইলটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম যে ওনার কোনও ধারণাই নেই যে এখন ১ টা বেজে ৪৫ মিনিট হয়ে গেছে। উনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মোবাইলটাকে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেলেন। আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা হল না। খাবার টেবিলের ওপর সাজানোই ছিল। উনি রান্নাঘর থেকে দুটো থালা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলেন। আমি অবশ্য এরই মধ্যে আমার জন্য নির্দিষ্ট করা চেয়ারে বসে পরে ছি। আমাকে ভাত বেড়ে দিয়ে উনি আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন ভাত নিয়ে। পুরো লাঞ্চের সময়টা নিরবে কাটল। শুধু দুই একবার উনি জিজ্ঞেস করেছেন যে আমার আর কিছু লাগবে কি না। তেল কইটা যদি ম্যাডাম নিজেই বানিয়ে থাকেন তো মানতে হবে যে ওনার রান্নার হাত বেশ ভালো।
দেওয়াল ঘড়িতে এখন ২.৩০ মিনিট। এইবার আর ম্যাডামের বাধা শুনলাম না। আমি আমাদের দুজনের থালা তুলে নিয়ে গিয়ে বেসিনে রেখে দিলাম। উপরে উঠে বেরনোর জন্য রেডি হয়ে নিলাম। হাতে সময় আর নেই। ম্যাডাম কে একটা মিষ্টি “বাই” করে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ধেয়ে চললাম দোলনের বাড়ির দিকে।
আমি অবশ্য ল্যাপটপের ব্যাগটা সাথে নিয়ে নিয়েছি। সেটার ভেতর দুটো বই ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝ পথে ট্যাক্সি থামিয়ে একটা বড় জেরক্সের দোকানে বই দুটো রেখে তার কয়েকটা পাতা জেরক্স করার জন্য নির্দেশ দিয়ে, দোকানের মালিককে আগাম কিছু দিয়ে আবার ছুটে চললাম দোলনের বাড়ির দিকে। দোলনের বাড়ির দরজা খোলা। বুঝতে পারলাম যে কিছু লোক এসেছে শোক জ্ঞাপন করতে। আমি দারোয়ানকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম দোলন আর মিসেস মুখার্জি একটা সোফায় পাশা পাশি বসে আছে। চারপাশে অনেক লোক। এদের কাউকে আমি চিনি না। চেনার কোনও মানে হয় না। দোলন আমাকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে। ও আমাকে ইশারায় দোতলায় উঠিয়ে নিয়ে গেল। উঠতে উঠতে আমি জিজ্ঞেস করলাম “ রাকা কাল তোর সাথে ছিল না?” ও বলল “হ্যাঁ। সকালে চলে গেছে।” দোলন আমাকে ওর নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। দরজা বন্ধ করে আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল। আমি পাথরের মতন নিরুত্তাপ। ও বালিশের নিচ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে সেখান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল “আমি তোকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু…” আমি বললাম “ কিন্তু কি?” ও কিছুক্ষণ চুপ। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে, আর বেশ জোড়ের সাথে। বলল “ পুলিশ হঠাত করে তোর ওপর সন্দেহ করল কেন?” আমি বললাম “ ফুটেজ দেখে ওদের সন্দেহ হয়েছে, তাছাড়া আমি বাইরের ছেলে, আমিও ওদের জায়গায় থাকলে হয়ত…” ও বলল “বেশ মেনে নিলাম সেটা। কিন্তু কাল পুলিশ স্টেশনে তোর হাবভাব দেখে কিন্তু আমারও কিছুটা সন্দেহ হয়েছে। পরে অবশ্য বুঝতে পারলাম যে তাদের সন্দেহ অমূলক। কিন্তু আবার বলছি গতকাল কেন জানি না আমার তোর হাব ভাব দেখে বার বার মনে হচ্ছিল যে তুই সব কিছু জানিস, কিন্তু কেমন যেন গা ছাড়া ভাবে গা ঢাকা দিয়ে আছিস, বা নিজের গা বাঁচিয়ে চলছিস।”
আমি বললাম “ এই ব্যাপার! গা বাঁচিয়ে চলছি বইকি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে এরকম একটা বাজে কেসে ফেঁসে গেলে কি হবে বুঝতে পারছিস? পড়াশুনা ছেড়ে দে, জেলে ফেলে রেখে দেবে। পুলিশের সামনে ভয় পেয়ে বারবার চমকে চমকে উঠলে পুলিশ সচরাচর তোর মাথার ওপর চেপে বসবে। তাই যে ব্যাপারের সাথে আমার কোনও রকম সম্পর্ক নেই, সেই রকম ব্যাপার নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলে আমাকে একটু বেপরোয়া ভাব দেখাতে হবে বইকি। কিন্তু এই নিয়ে তোর এত চিন্তার কি আছে বুঝতে পারিনি এখনও।” ও কি যেন চিন্তা করে নিয়ে বলল “ আমার সন্দেহের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আজ শিখাদি আমাকে মেসেজ করেছে।” বললাম “ তার দাবি কি?” ও পোড়া সিগারেটটা জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল “ এক কথায় ও নিজেও তোকে সন্দেহ করে।” আমি ওর বিছানায় বসে পড়লাম হতাশ হয়ে। বললাম “তাহলে এখন ওই শিখাদির কথাও তোর…” ও বলল “এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়। ও আমাকে বলেছে যে ও আমার সাথে দেখা করে কিছু জিনিস বলতে চায়। ওর ধারণা তুই এর মধ্যে আছিস। “ আমি বললাম “ বেশ মেনে নিলাম। কিন্তু এখানে আমার মোটিভ?” ও বলল “ সেই দিন মদ খেতে খেতে তুই বলে ফেলেছিলিস যে তোর বাবা কিং মেকার। ইউ পি তে অন্য পার্টির সরকার। এখানে অন্য। সুতরাং…” আমি হেসে ফেললাম “আমি বলেছি কিং মেকার। কোন পার্টি গেস করলি কিভাবে?” ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। বললাম “ কিং মেকারদের ক্ষমতা ভালোই থাকে এটা সত্যি। কিন্তু আমাদের পার্টিই যে ক্ষমতায় থাকবে সেটা কে বলেছে? খুব বেশী হলে ওই সিটগুলো জিততে পারে। গ্রো আপ। অবশ্য সিটগুলো না জিতলেও ক্ষমতা ক্ষমতার জায়গাতেই থাকে।” ও বলল “শিখাদি তোর ব্যাপারে কি এমন জানে যে এমন কথা বলছে।” আমি বললাম “সেটা তুই ওকে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস কর। আমি জানি না যে ও কি জানে। “ ও বলল “সেটা আমি আজ করেছি।” বললাম “তাহলে তো তুই জেনেই গেছিস যে আমি কেন তোর বাবাকে খুন করতে চেয়েছি!” ও বলল “সেটা জানতে পারলে তুই আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতিস না। কিন্তু ও ঠিক কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু আমি জানি যে ও অনেক কিছু বলতে চাইছিল। দীপকের আত্মহত্যার পর ও ভেঙ্গে পরে ছে। ও আমাকে বলল যে ওর একটু সময় চাই। আরেকটু ভেবে গুছিয়ে আরেক দিন ভালো করে এই সব কথা জানাবে। কিন্তু ও আমাকে ফেস টু ফেস বলেছে যে ওর বিশ্বাস এসব কিছুর মধ্যে শুধু তুই আছিস। আর শুধুই তুই আছিস। ও আমাকে বলেছে যে ওর কাছে প্রমান আছে। ” আমি বললাম “বেশ সেই কথাটা পুলিশে গিয়ে জানিয়ে দিতে বল। আমি এর থেকে বেশী কিছুই বলতে পারি না। “ দোলন একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বলল “ তুই যে এর মধ্যে নেই সেটা আমি বিশ্বাস করতেই চাইছি। কিন্তু পারছি না। প্রথমে পুলিশ, এর পর শিখা। আর সত্যি বলতে কি শিখাদির কথা শুনে আমার আজ মনে হয়েছে যে ও সত্যি কিছু জানে। আর সত্যি কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু কিছু একটা ভয়ে বলতে পারছে না। “
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম “এত সন্দেহ নিয়ে থাকার মানে হয় না। রিলেশন শুরুর প্রথম দিনেই এত সন্দেহ?” ও বলল “ আবারও বলছি তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু যারা মারা গেছে তাদেরও আমি ভালবাসতাম। একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। “ বললাম “বলে ফেল। সন্দেহ কাটিয়ে ফেল। কারণ এই সব জিনিস ভীষণ ঘোড়েল হয়। আবার কিছু কথা শুনে বা দেখে তোর মনে হবে আমিই কালপ্রিট। তাই এটা খুব দরকার যে তুই তোর মনের সন্দেহটা আগে ভালো করে মুছে ফেল। আর সেটা মুছে ফেলার জন্য যা করার সেটাই কর। আমি তোর সাথে আছি। “ ওর চেহারায় কোনও নরম ভাব এলো না। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল “ এর পর যদি পুলিশ তোর কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা চায় তাহলে তুই…” আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম “আরেকবার বলছি, তোর সন্দেহ দূর করার জন্য কি করতে হবে বল, আমি সব করতে রাজি আছি। তবে একটা জিনিস প্র্যাকটিকালই বলছি। যদি দেখি আইনত বাঁশ খেতে চলেছি, তাহলে আমি আইনের সাহায্য নেব। তবে কোনও রকম অসহযোগিতা করব না। পাশে একটা উকিল রেখে সব রকম হেল্প করব যাতে তোর সন্দেহ দূর হয়। আর এতেও তোর মন না ভরলে, আই উইল রাদার সে যে এখানেই আমাদের ইতি টেনে দেওয়া উচিৎ।” আমি দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই ও ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে। “পুচু আই লাভ ইউ। কিন্তু ভেঙ্গে পরে ছি। তার মধ্যে এই শিখাদি এসে হঠাত করে…” আমি বললাম “এই সব পলিটিকাল মার্ডারে স্কেপ গোট খোঁজা হয়। এরকম সময় সবাই বলবে যে যদি কিছুই না থাকে তো কেন বার বার একেই ধরা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল যাকে ধরা হচ্ছে সে হয়ত কিছুই জানে না। জাস্ট অ্যাঁ স্কেপ গোট। তাই বলছি।” ও আমাকে ছারেনি এখনও। বলল “ সেটা দেখা যাক। কিন্তু তুই সহযোগিতা করলে আমার …” কথা শেষ হল না ঘর কাঁপিয়ে ওর মোবাইল বেজে উঠল।
ও ফোন তুলে কয়েকবার হ্যাঁ না বলে কেটে দিল। বলল “ পুলিশ এখনও বাবার ডেথের ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারছে না। “ আমি বললাম “জিনিসটা যে জটিল সেটা পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকেই বোঝা যাচ্ছে। যাই হোক আমি এইবার আসি। তুই আমাকে জানাস যে কি করলে তোর সন্দেহ দূর হবে। আর যদি তোর মনে হয় যে তুই কোনও দিনও সন্দেহ দূর করতে পারবি না, তো আমি এখানেই ইতি টেনে দেব।” ও বলল “ বার বার ইতি টানার ভয় দেখাস না। বললাম না, তেমন কোনও প্রমান থাকলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সামনে কথা বলতে পারতিস না। তোকে ভালোবাসি বলেই তোকে এত গুলো কথা বললাম।” আমি একটু হেসে ওর দিকে ফিরে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম “একটা সত্যি কথা বলি? আমিও ভালোবাসি বলেই বলছি। “ ওর চোখে জল। বলল “বলে ফেল।” বললাম “ তুইও আমাকে বার বার ভয় দেখাস না যে তোর হাতে প্রমান থাকলে আমি এখানে এসে দাঁড়াতে পারতাম না । কোন প্রমান ঠিক আর কোন প্রমান ভুল সেটা নির্ধারণ করার তুই বা আমি কেউ নই। আমার বাবাকে ছেড়ে দে, আমি নিজে চাইলে যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি, আর যখন ইচ্ছে তখন দাঁড়াতে পারি। আজ অব্দি কেউ আটকাতে পারেনি, কালও পারবে না। আমার রাগ তুই এখনও দেখিসনি। এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করিস না যে আমার মুখোশ খুলে গিয়ে আমার ভেতরের রাগ বাইরে বেরিয়ে পরে । সেই রুদ্ররূপ তুই বা তোদের এই সরকার হ্যান্ডেল করতে পারবে না। অ্যান্ড আই গ্যারান্টি দ্যাট।” হঠাত করে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখে বড়লোক বাপের বিগ্রে যাওয়া মেয়েটা কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে। ওর চোখের চাহুনিই জানান দিচ্ছে সেটা। আমি আর দাঁড়ালাম না। বেরিয়ে পড়লাম। দোলনের সাথে ভাঁট বকে আর কত সময় নষ্ট করা যায়। ঘড়িতে দেখলাম এখন বাজে ৪ টে। অনেকক্ষণ হয়েছে। অনেকগুলো কাজ আছে। বেরনোর আগে অবশ্য নিচে নেমে বেলা মুখার্জিকে হাত জোড় করে একটা নমস্কার করলাম। উনি দাঁড়িয়ে বললেন “ তোমার দেওয়া ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে। এখন সময় নেই। পরে একদিন বাড়িতে এসো। তোমার সাথে কথা বলা যাবে। আর গতকাল থানায় যা হয়েছে তার জন্য আমি সত্যিই খুব ল…” পিছন থেকে দোলনের কড়া আওয়াজ এলো “ লজ্জিত হওয়ার মতন কিছু নেই মম। এরকম কেসে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েই থাকে। ও পুলিশের সাথে সব রকম সহযোগিতা করবে বলে আমাকে বলেছে। কি সংকেত? আমি ঠিক বলছি...তাই তো?” আমি ওর দিকে ফিরে বললাম “কোনও সন্দেহ আছে?” ও বলল “ একদম নেই। আগে সবার (কথাটা বেশ জোড় দিয়ে বলল) সহযোগিতায় সব কিছু ক্লিয়ার হোক। তারপর না হয় ও বাড়িতে এসে আমাদের সাথে গল্প করবে।” বললাম “বেশ তাই হোক।“ বেরিয়ে পড়লাম। রাকাকে সময় দিয়েছি ৫ টা। তার আগে দুটো কাজ সারতে হবে।
দোলনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসেই একটা সিগারেট ধরালাম। একটা চিন্তা অনেকক্ষণ ধরেই মাথায় ঘোরা ফেরা করছে। শিখাদি কি এমন জানে যে সেটা থেকে ওর ধারণা যে এর মধ্যে আমি আছি, আর শুধুই আমি আছি! স্ট্রেঞ্জ। আরেকটা বড় সমস্যা হল, শিখাদি কি দোলনকে শুধু এই মার্ডারের ব্যাপারেই কথা বলার জন্য মেসেজ করেছিল, নাকি ও সেদিন আমি যে ওর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ওর শরীরটাকে ভোগ করেছি সেটাও দোলনের সামনে বলে দিতে চায়। একবার মনে হল যে শিখাদির জন্য মার্ডার ইত্যাদি সব ফালতু, ও শুধু চায় ওর রেপের গল্পটা দোলনের সামনে তুলে ধরে আমার ইমেজ খারাপ করতে। আর সেটা যদি করতে পারে তো পুলিশের হ্যাপাও পোহাতে হবে। চাপের ব্যাপার! কারণ রেপ ব্যাপারটা তো আর সাধারণ ব্যাপার নয়। পড়াশুনা ইত্যাদি সব মাথায় উঠবে, উল্টে যদি সত্যিই কিছু প্রমাণিত হয় তো আমাকে হাজতবাস করতে হবে। আর সেটা হলে বাবা মা যে কি ভাববে সেটা এখন বলে কাজ নেই। রেপের ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু পরেও ভাবলে চলবে, কিন্তু আপাতত, হঠাত করে কেন যে মার্ডারের ব্যাপারে এরকম বিশ্রী ভাবে জড়িয়ে পড়লাম সেটাই মাথায় ঢুকছে না। সেদিন ওদের সাথে পার্টিতে না গেলেই বোধহয় ভালো করতাম। ড্রাইভারের আওয়াজে চেতনা ফিরে এলো। গাড়ি থেকে নেমে সেই জেরক্সের দোকান থেকে কাগজগুলো কালেক্ট করে বাকি টাকা মিটিয়ে আবার ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম। দ্বিতীয় কাজটা আর সারা হল না। একটা সিগন্যালে এসে প্রায় আধা ঘণ্টা গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। গাড়ির বাইরে একজন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। তাকে হাত নেড়ে ডেকে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। সেই আমাকে বলল যে কোনও এক ভি আই পি নাকি ক্রস করবে, তাই কারোর গাড়ি এগোতে দেওয়া হচ্ছে না। কে এই ভি আই পি ইত্যাদি নিয়ে এই পুলিশের সাথে আরও অনেকক্ষণ গ্যাজালাম। তবে ওর কাছ থেকে তেমন কোনও তথ্য পেলাম না। শুধু জানতে পারলাম যে রাজ্য সরকারের কোনও এক বিশেষ অতিথি। ওর বুকে লাগানো ব্যাচটা দেখে অবশ্য ওর নামটা আমার শুরুতেই জানা হয়ে গেছে। অফিসারের নাম “পুলক হালদার”।
গাড়ি ছাড়ার আগেই মার্ডারের প্রসঙ্গটা আবার ফিরে এলো মাথার ভেতর। তবে একটা জিনিস দোলনের সাথে কথা বলার সময়ই ঠিক করে ফেলেছিলাম। দোলন আমার জন্য এমন জরুরি কিছু নয় যে যার জন্য আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ছিনিমিনি খেলব। দোলন যদি আমাকে চাপে রেখে মাথায় চড়ে বসার চেষ্টা করে বা আমাকে ডোমিনেট করার চেষ্টা করে তো কিছুটা সহ্য করতে হবে বইকি কারণ ওর শরীরটা বেশ ডাঁশা, কিন্তু লিমিট ক্রস করলেই ওকে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নর্দমায় ফেলে দিতে আমার বেশীক্ষণ লাগবে না। শিখা কি জানে সেটা শিখার সাথে দেখা করার আগে জানা যাবে না। কিন্তু একথা পরিষ্কার যে শিখা ওকে কিছু বলতে গিয়েও বলেনি। খুনের ব্যাপারটা ছেড়েই দিলাম। কারণ সেই ব্যাপার নিয়ে শিখার সন্দেহ নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করার কোনও মানে হয় না। তবে রেপের ব্যাপারটা তো ও দোলনকে বলে দিতে পারত। কিন্তু সেটাও ও দোলনকে বলেনি। আর সেই সাথে আমাকেও মেসেজ করে দেখা করতে বলেছে। শিখার ঘর দোর দেখে একটা জিনিস পরিষ্কার যে শিখার অবস্থা ভালো নয়। দীপক যত দিন বেঁচেছিল তত দিন হয়ত দীপকই শিখার ফুর্তির জন্য খরচ করত। কিন্তু এখন দীপক নেই। সুতরাং ওর অবস্থা এখন খুব টাইট। তাছাড়া শিখা মেয়েটা দোলনদের ভাষায় একটা রেন্ডি টাইপের মেয়ে। এটা যদি সত্যি হয় তো ওকে দীপক ভোগ করল না অন্য কেউ সেটা নিয়ে ওর সত্যিই কোনও মাথা ব্যথা থাকার কথা নয়। অবশ্য মাথা ব্যথা আছে কি না সেটা জানা নেই আপাতত। সেই ক্ষেত্রে নিজের হাত খরচা চালানর জন্য আর ফুর্তির খরচা ওঠানোর জন্য ও যে কোনও সহজ পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করবে। ব্ল্যাক মেইল করবে আমাকে? মনে মনে না হেসে পারলাম না। তবে একটা ব্যাপার এখানে মেলানো যাচ্ছে না কিছুতেই। হোয়াই দোলন?
ওনার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে এলাম। ঘর গোছাতে লাগল ঠিক দশ মিনিট। মানে সব জিনিস বের করার তো মানে নেই। শুধু কাজের জিনিসগুলো বের করে সাজিয়ে রাখলাম। ঘরে ঢুকে অবশ্য দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এখন একটা ঘুম দিতে হবে। মোবাইলটা এতক্ষন সাইলেন্ট করে রাখা ছিল। সেটা বের করে দেখলাম তাতে চারটে মেসেজ এসেছে। নাহ মালিনী একটাও মেসেজ করেনি। বোধহয় এখনও ঘুমাচ্ছে। জানি না ঘুম থেকে ওঠার পর আজ কি হবে ওর। একটা মেসেজ কোথা থেকে এসেছে সেটা বলার কোনও মানে দাঁড়াচ্ছে না। একটা মেসেজ এসেছে রাকার কাছ থেকে, সারমর্ম হল আমি যেন ভুলে না যাই যে ওর সাথে আজ আমার দেখা করার কথা। একটা মেসেজ এসেছে দোলনের কাছ থেকে, সারমর্ম হল এই যে ওর কিছু কথা বলার আছে। আরেকটা মেসেজ এসেছে খুব অপ্রত্যাশিত একজনের কাছ থেকে। শিখাদি। সারমর্মঃ ওরও নাকি আমার সাথে কিছু কথা আছে। রাকা আর দোলন আমার সাথে কি কথা বলবে সেটা মোটামুটি বুঝতে পারছি, কিন্তু শিখাদি? হতে পারে সেদিন যে ওর সেন্সলেস হওয়ার সুযোগ নিয়ে ওকে আমি ;., করেছি সেই নিয়ে সরাসরি কথা বলে আমাকে ধমকি দিতে চায়। আমাকে দেবে ধমকি! ভালো! মজা হবে বেশ। আপাতত একটা লম্বা ঘুম। দুপুরে উঠে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে তারপর এইসব ভাবা যাবে। আমি শুধু রাকার মেসেজটার রিপ্লাই দিলাম “মনে আছে। দেখা হবে। তবে দেরী করিস না। “ ইচ্ছে করেই দোলনকে কোনও রিপ্লাই দিলাম না। আর শিখার মেসেজের রিপ্লাই দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। কানে হেডফোন গুজে সেই বিখ্যাত দামি মোবাইলে একটা ভালো রেডিও স্টেশন চালিয়ে চোখ বুজলাম।
ঘুম ভাঙল একটা ফোনে। মোবাইলটা বাজছে। ঘড়িতে এখন সাড়ে বারোটা। মালিনী! দুই বার ভালো করে গলা খাঁকড়িয়ে ঘুমের আমেজটা কাটিয়ে নিয়ে ফোন ধরলাম। ওই দিক থেকে গলার প্রথম আওয়াজটা ভেসে আসতেই বুঝতে পারলাম যে ওই দিকে ভয় করার মতন কিছু ঘটেনি, অর্থাৎ রনি গতকাল রাতের কোনও কথাই মনে করতে পারেনি। আমি বললাম “ডার্লিং, এতক্ষনে ওঠা হল ঘুম থেকে? অবশ্য ফুল শয্যার পরের দিন মেয়েরা দেরী করে না উঠলে বরের অপমান।” ও মিষ্টি হেসে বলল “আমি এখন কাউন্টারে আছি। এই মাত্র এলাম। এখন এইসব বলবে না। না ওর কিছু মনে নেই। তবে প্রচুর হ্যাং ওভার আছে। কিন্তু বাসের সময় হয়ে যাচ্ছে বলে রেডি হয়ে বেরিয়ে যাবে একটু পরে। তোমার খবর নিচ্ছিল। বলেছে আবার তোমার সাথে বসে পার্টি করবে! আমি ওকে বলেছি যে এরকম ভাবে মদ খেয়ে আউট হয়ে বমি করলে আর কারোর সাথে তোমার আলাপ করাব না। কারণ তাতে আমার প্রেস্টিজ হ্যাম্পারড হচ্ছে। যাই হোক, যে কারণে ফোন করলাম সেটা হল, “ আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম “হ্যাঁ, ঘরে ফেরার পর ঘুম আসছিল না তাই শিফট করে নিলাম। এতক্ষন ধরে ঘর গোছাচ্ছি। কোথায় নতুন বউ ঘর গোছায়, কিন্তু এখানে…(একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম) কি আর করব। পোড়া কপাল আমার। তবে এক দিক থেকে ভালো হল। সামনের সপ্তাহ থেকে বাইরে দেখা করতে পারব যখন তোমার ডিউটি থাকবে না। আর এটা শুনে শান্তি পেলাম যে তোমার ভোঁদাই বরটার গতকালের ব্যাপারে কিছুই মনে নেই। ভালো থেকো। “ ওর কাউন্টারে বোধহয় কেউ একজন এসেছে। ও আমাকে সংক্ষেপে বলল “ পরে কথা হবে। এখন রাখছি। কাজ আছে। “ আমি হেসে ফোন কেটে দিলাম।
উঠে পড়লাম। ব্রাশ, পেস্ট, রেজার ক্রিম, শাওয়ার জেল, শ্যাম্পু আর একটা তোয়ালে নিয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। একটাই সমস্যা এখানে, সব জামা কাপড়, সব কিছু নিজেকেই কাচাকাচি করতে হবে। তাও আবার কোনও অয়াশিং মেশিন ছাড়া, মেঝেতে বসে ধোপাদের মতন কাপড় কাচতে হবে রোজ। যাই হোক, কয়েক দিন এই ভাবেই না হয় কাটিয়ে নেওয়া যাক। ঘুম ভাঙার পর একটা জিনিস বুঝতে পারলাম যে হ্যাংওভার কেটে গেছে। এখন শরীর পুরো ঝরঝরে। ভালো ভাবে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে জানলার নিচটা একবার দেখে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। জানলার দিকটা বাড়ির পেছন দিক। পেছন দিকের বিশাল পাঁচিল আর বাড়ির দেওয়ালের মাঝে একটা ছোট বাগান আছে। তবে দেখে মনে হল যে পরিচর্যার অভাবে অধিকাংশ গাছের অবস্থা খুব খারাপ। ফুল প্রায় নেই বললেই চলে। জল না দিলে গাছ গুলো আর বেশী দিন বাঁচবে বলে মনে হয় না। অবশ্য বৃষ্টি হলে অন্য ব্যাপার। খবরে শুনেছি যে নিম্নচাপের একটা সম্ভাবনা আছে। সেটা হলে গাছগুলো প্রানে বেঁচে গেলেও যেতে পারে। সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আরও কিছুক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাঁচিলের উল্টো দিকে একটা কাঁচা রাস্তা চলে গেছে বলে মনে হল। তার ঠিক পরেই একটা ডোবা। আর তার পরেই একটা ছোট বস্তি আছে। সেখানে কিছু লোকজনের চলা ফেরা দেখতে পাচ্ছি। কয়েকটা দোকান পাটও আছে। হুঁশ ফিরল, দরজায় কেউ নক করছে। জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। ম্যাডাম।
“কি ঘুমাচ্ছিলে?” মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম যে ওনার অনুমান নির্ভুল। এখনও ওনার পরিধানে সেই একই নাইটি যেটা পরে উনি সকালে আমার সামনে এসেছিলেন। মুখে সেই হাসি খুশি ভাবটা থাকলেও ওনাকে দেখে বুঝতে পারলাম যে সম্প্রতি উনি কোনও কারণে চিন্তায় পরে ছেন। সম্প্রতি বলতে মানে বিগত কয়েক মিনিটের মধ্যে। আগের দিনও ওনার মোবাইলে সেই মেসেজটা আসার পর ওনার মুখে ঠিক এমনই একটা টেন্সড ভাব দেখেছিলাম। উনি অন্যমনস্ক ভাবে ঘরের ভেতর ঢুকে টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। উনি অবশ্য বিছানার দিকে মুখ করে বসেছেন, টেবিলের দিকে মুখ করে নয়। সময়ের সাথে সাথে ওনার মুখের ওপর চিন্তার ছাপটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঘরে লাইট অন করার দরকার পরে নি কারণ বাইরে প্রচুর আলো। তবে পর্দা টেনে রাখায় ঘরের আলো এখন কিছুটা হলেও কম। আমি চুপচাপ ওনার সামনে বিছানার ওপর গিয়ে বসে পড়লাম। দুজনেই চুপ। উনি ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছেন অন্যমনস্কভাবে, চোখের দৃষ্টিতে একটা অসহায় ভয়ার্ত ভাব ফুটে আছে আবছা ভাবে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে যাওয়ার পর আমি একটু গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে বললাম “কিছু বলবেন? আমার এখানে আসায় যদি আপনার কোনও প্রবলেম থাকে তাহলে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। আপনার কোনও অসুবিধা হোক এমন অভিপ্রায় আমার নেই।” উনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “ না না তুমি আসাতে আমি একটু নিশ্চিন্ত হয়েছি। আসলে আমার বর তো বাইরে বাইরে থাকে। “ একটু থেমে অন্যমনস্ক ভাবেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “ তুমি বেরোবে বলছিলে না তখন?” বললাম “হ্যাঁ।” বললেন “কটায় বেরোবে?” বললাম “তিনটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ব।” উনি সাথে সাথে প্রশ্ন করলেন “ কোথায় যাচ্ছ?” উত্তর আমার ঠিক করাই ছিল, কিন্তু উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হল না। উনি নিজেই বললেন “না না তোমার পার্সোনাল ব্যাপারে কোনও নাক গলানোর ইচ্ছে আমার নেই। শুধু পড়াশুনার ব্যাপারটা…” আবার উনি অন্যমনস্ক ভাবে থেমে গেলেন। দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ ধরে। বললাম “আসলে কয়েকটা জিনিস জেরক্স করার আছে। বই কিনে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ দুই একটা গল্পের বই কেনার প্ল্যান করছি। একটু এই দিকের রাস্তা ঘাট গুলো ঘুরে দেখব। আর একজনের সাথে দেখা করার কথা। আমাদের গ্রামের লোক। কোলকাতায় এসেছেন।” উনি যেন আমার কথা শুনেও শুনলেন না। জিজ্ঞেস করলেন “কটার মধ্যে ফিরবে?” বললাম “ কেন আপনার কি কোনও কাজ আছে? আমার হেল্প লাগলে বলুন। “ উনি অন্যমনস্ক ভাবটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললেন “ না না। এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম। আসলে… সেই চোর আসার ব্যাপারটার পর থেকে একা থাকতে একটু ভয় লাগে। তেমন কিছু না। তুমি তোমার কাজ সেরে এসো।” আমি বললাম “আমি সাড়ে সাতটার ভেতর ফিরে আসব আর কোনও বাড়িতে এত তাড়াতাড়ি চোরের আগমন সচরাচর হয় বলে শুনিনি।” ইচ্ছে ছিল জিজ্ঞেস করি যে আপনার বর কখন ফিরবে, কিন্তু ওই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না জেনে বুঝে। উনি ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
উনি যখন দরজার একদম মুখে গিয়ে পৌঁছেছেন, আমি বললাম “ম্যাডাম, চিন্তা করবেন না। এর পর চোর এলে এমন উত্তম মধ্যম দেব যে সে আর এই মুখো সাত জন্মে হবে না।” উনি একবার ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মুখে জোড় করে একটা হাসি আনার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, তারপর আবার বাইরে যেতে যেতে বললেন “চোর হলে এতটা চিন্তিত হতাম না…” বাকি কথাগুলো ওনার সাথেই মিলিয়ে গেল। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম উনি অন্যমনস্ক ভাবে প্রায় টলতে টলতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে চলেছেন। বললাম “ম্যাডাম, লাঞ্চের সময় বলবেন। “ উনি আমার দিকে ফিরেও দেখলেন না। শুধু মাথা নেড়ে নিচে নেমে গেলেন। তবে ঘরে ঢোকার আগে নিচ থেকে ওনার গলার স্বর কানে এলো। “আর এক ঘণ্টা পর খেতে বসব। চলে এসো।”
আমি ঘরে ঢুকে জরুরি কয়েকটা ফোন সেরে নিলাম। পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসে চোখ বুজলাম। এই বেলা একটু ধ্যান করে নেওয়া দরকার। ধ্যান করলে শুধু কনসেন্ট্রেশন বাড়ে না, অনেক সময় মনের অনেক জট পরিষ্কার হয়ে যায়। আর মেডিটেশানে বসলে সময়টা খুব শান্ত ভাবে কেটে যায়। মনের জট কাটল কি না বলতে পারি না, তবে, ছোট মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে ওঠায় পদ্মাসন ভেঙ্গে উঠে পড়লাম। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়েও ধরালাম না। এত শান্ত মন নিয়ে সিগারেট খাবার টান খুব একটা থাকে না। দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম বাইরে। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। নিচে নেমে দেখলাম ম্যাডাম টিভি চালিয়ে বসে আছেন। সামনে কিছু একটা নিউজ চলছে। তবে ওনার সেই দিকে কোনও খেয়াল নেই। উনি ওনার স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছেন। দুই হাতের আঙুলগুলো টাচ স্ক্রিনের ওপর অবিশ্রাম নড়ে চলেছে। কাকে উনি এত মেসেজ করে চলেছেন?
অবশ্য ফেসবুক আর হোয়াটসআপের যুগে এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। আমি অবশ্য খবরের সারমর্মটা বুঝতে পেরেছি। সেই নিম্নচাপ আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই যেকোনো সময়ে এসে আছড়ে পড়বে কোলকাতার ওপর। অবশ্য এর প্রবল প্রকোপ দেখতে পাওয়া যাবে সমুদ্রে, তাই যারা মাছ ধরতে যাবে তাদের কে সরকার এই খবরের মাধ্যমে সতর্ক করে দিচ্ছে। তবে কোলকাতাও এই নিম্নচাপের ধাক্কায় ভেসে যেতে পারে, অন্তত খবরে তাই বলা হয়েছে। আমি ম্যাডামের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি আমার পায়ের শব্দ শুনতে পাননি। এখনও এক মনে মেসেজ করে চলেছেন। আবারও গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ আহহ, আপনি বুঝি খুব নিউজ দেখেন?” আর কি বলব সেটা জানি না। উনি আমার গলার আওয়াজ পেয়ে যেন চমকে উঠলেন। মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়েই মোবাইলের গায়ের সুইচটা চেপে মোবাইলের স্ক্রিনটা অন্ধকার করে দিলেন, মানে মোবাইলটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম যে ওনার কোনও ধারণাই নেই যে এখন ১ টা বেজে ৪৫ মিনিট হয়ে গেছে। উনি দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মোবাইলটাকে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেলেন। আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা হল না। খাবার টেবিলের ওপর সাজানোই ছিল। উনি রান্নাঘর থেকে দুটো থালা নিয়ে এসে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলেন। আমি অবশ্য এরই মধ্যে আমার জন্য নির্দিষ্ট করা চেয়ারে বসে পরে ছি। আমাকে ভাত বেড়ে দিয়ে উনি আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন ভাত নিয়ে। পুরো লাঞ্চের সময়টা নিরবে কাটল। শুধু দুই একবার উনি জিজ্ঞেস করেছেন যে আমার আর কিছু লাগবে কি না। তেল কইটা যদি ম্যাডাম নিজেই বানিয়ে থাকেন তো মানতে হবে যে ওনার রান্নার হাত বেশ ভালো।
দেওয়াল ঘড়িতে এখন ২.৩০ মিনিট। এইবার আর ম্যাডামের বাধা শুনলাম না। আমি আমাদের দুজনের থালা তুলে নিয়ে গিয়ে বেসিনে রেখে দিলাম। উপরে উঠে বেরনোর জন্য রেডি হয়ে নিলাম। হাতে সময় আর নেই। ম্যাডাম কে একটা মিষ্টি “বাই” করে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ধেয়ে চললাম দোলনের বাড়ির দিকে।
আমি অবশ্য ল্যাপটপের ব্যাগটা সাথে নিয়ে নিয়েছি। সেটার ভেতর দুটো বই ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝ পথে ট্যাক্সি থামিয়ে একটা বড় জেরক্সের দোকানে বই দুটো রেখে তার কয়েকটা পাতা জেরক্স করার জন্য নির্দেশ দিয়ে, দোকানের মালিককে আগাম কিছু দিয়ে আবার ছুটে চললাম দোলনের বাড়ির দিকে। দোলনের বাড়ির দরজা খোলা। বুঝতে পারলাম যে কিছু লোক এসেছে শোক জ্ঞাপন করতে। আমি দারোয়ানকে পাত্তা না দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম দোলন আর মিসেস মুখার্জি একটা সোফায় পাশা পাশি বসে আছে। চারপাশে অনেক লোক। এদের কাউকে আমি চিনি না। চেনার কোনও মানে হয় না। দোলন আমাকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছে। ও আমাকে ইশারায় দোতলায় উঠিয়ে নিয়ে গেল। উঠতে উঠতে আমি জিজ্ঞেস করলাম “ রাকা কাল তোর সাথে ছিল না?” ও বলল “হ্যাঁ। সকালে চলে গেছে।” দোলন আমাকে ওর নিজের ঘরে নিয়ে এসেছে। দরজা বন্ধ করে আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির ভাবে তাকিয়ে রইল। আমি পাথরের মতন নিরুত্তাপ। ও বালিশের নিচ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে সেখান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল “আমি তোকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু…” আমি বললাম “ কিন্তু কি?” ও কিছুক্ষণ চুপ। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছে, আর বেশ জোড়ের সাথে। বলল “ পুলিশ হঠাত করে তোর ওপর সন্দেহ করল কেন?” আমি বললাম “ ফুটেজ দেখে ওদের সন্দেহ হয়েছে, তাছাড়া আমি বাইরের ছেলে, আমিও ওদের জায়গায় থাকলে হয়ত…” ও বলল “বেশ মেনে নিলাম সেটা। কিন্তু কাল পুলিশ স্টেশনে তোর হাবভাব দেখে কিন্তু আমারও কিছুটা সন্দেহ হয়েছে। পরে অবশ্য বুঝতে পারলাম যে তাদের সন্দেহ অমূলক। কিন্তু আবার বলছি গতকাল কেন জানি না আমার তোর হাব ভাব দেখে বার বার মনে হচ্ছিল যে তুই সব কিছু জানিস, কিন্তু কেমন যেন গা ছাড়া ভাবে গা ঢাকা দিয়ে আছিস, বা নিজের গা বাঁচিয়ে চলছিস।”
আমি বললাম “ এই ব্যাপার! গা বাঁচিয়ে চলছি বইকি। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে এরকম একটা বাজে কেসে ফেঁসে গেলে কি হবে বুঝতে পারছিস? পড়াশুনা ছেড়ে দে, জেলে ফেলে রেখে দেবে। পুলিশের সামনে ভয় পেয়ে বারবার চমকে চমকে উঠলে পুলিশ সচরাচর তোর মাথার ওপর চেপে বসবে। তাই যে ব্যাপারের সাথে আমার কোনও রকম সম্পর্ক নেই, সেই রকম ব্যাপার নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলে আমাকে একটু বেপরোয়া ভাব দেখাতে হবে বইকি। কিন্তু এই নিয়ে তোর এত চিন্তার কি আছে বুঝতে পারিনি এখনও।” ও কি যেন চিন্তা করে নিয়ে বলল “ আমার সন্দেহের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আজ শিখাদি আমাকে মেসেজ করেছে।” বললাম “ তার দাবি কি?” ও পোড়া সিগারেটটা জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল “ এক কথায় ও নিজেও তোকে সন্দেহ করে।” আমি ওর বিছানায় বসে পড়লাম হতাশ হয়ে। বললাম “তাহলে এখন ওই শিখাদির কথাও তোর…” ও বলল “এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়। ও আমাকে বলেছে যে ও আমার সাথে দেখা করে কিছু জিনিস বলতে চায়। ওর ধারণা তুই এর মধ্যে আছিস। “ আমি বললাম “ বেশ মেনে নিলাম। কিন্তু এখানে আমার মোটিভ?” ও বলল “ সেই দিন মদ খেতে খেতে তুই বলে ফেলেছিলিস যে তোর বাবা কিং মেকার। ইউ পি তে অন্য পার্টির সরকার। এখানে অন্য। সুতরাং…” আমি হেসে ফেললাম “আমি বলেছি কিং মেকার। কোন পার্টি গেস করলি কিভাবে?” ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। বললাম “ কিং মেকারদের ক্ষমতা ভালোই থাকে এটা সত্যি। কিন্তু আমাদের পার্টিই যে ক্ষমতায় থাকবে সেটা কে বলেছে? খুব বেশী হলে ওই সিটগুলো জিততে পারে। গ্রো আপ। অবশ্য সিটগুলো না জিতলেও ক্ষমতা ক্ষমতার জায়গাতেই থাকে।” ও বলল “শিখাদি তোর ব্যাপারে কি এমন জানে যে এমন কথা বলছে।” আমি বললাম “সেটা তুই ওকে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস কর। আমি জানি না যে ও কি জানে। “ ও বলল “সেটা আমি আজ করেছি।” বললাম “তাহলে তো তুই জেনেই গেছিস যে আমি কেন তোর বাবাকে খুন করতে চেয়েছি!” ও বলল “সেটা জানতে পারলে তুই আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতিস না। কিন্তু ও ঠিক কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু আমি জানি যে ও অনেক কিছু বলতে চাইছিল। দীপকের আত্মহত্যার পর ও ভেঙ্গে পরে ছে। ও আমাকে বলল যে ওর একটু সময় চাই। আরেকটু ভেবে গুছিয়ে আরেক দিন ভালো করে এই সব কথা জানাবে। কিন্তু ও আমাকে ফেস টু ফেস বলেছে যে ওর বিশ্বাস এসব কিছুর মধ্যে শুধু তুই আছিস। আর শুধুই তুই আছিস। ও আমাকে বলেছে যে ওর কাছে প্রমান আছে। ” আমি বললাম “বেশ সেই কথাটা পুলিশে গিয়ে জানিয়ে দিতে বল। আমি এর থেকে বেশী কিছুই বলতে পারি না। “ দোলন একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বলল “ তুই যে এর মধ্যে নেই সেটা আমি বিশ্বাস করতেই চাইছি। কিন্তু পারছি না। প্রথমে পুলিশ, এর পর শিখা। আর সত্যি বলতে কি শিখাদির কথা শুনে আমার আজ মনে হয়েছে যে ও সত্যি কিছু জানে। আর সত্যি কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু কিছু একটা ভয়ে বলতে পারছে না। “
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম “এত সন্দেহ নিয়ে থাকার মানে হয় না। রিলেশন শুরুর প্রথম দিনেই এত সন্দেহ?” ও বলল “ আবারও বলছি তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু যারা মারা গেছে তাদেরও আমি ভালবাসতাম। একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। “ বললাম “বলে ফেল। সন্দেহ কাটিয়ে ফেল। কারণ এই সব জিনিস ভীষণ ঘোড়েল হয়। আবার কিছু কথা শুনে বা দেখে তোর মনে হবে আমিই কালপ্রিট। তাই এটা খুব দরকার যে তুই তোর মনের সন্দেহটা আগে ভালো করে মুছে ফেল। আর সেটা মুছে ফেলার জন্য যা করার সেটাই কর। আমি তোর সাথে আছি। “ ওর চেহারায় কোনও নরম ভাব এলো না। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল “ এর পর যদি পুলিশ তোর কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা চায় তাহলে তুই…” আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম “আরেকবার বলছি, তোর সন্দেহ দূর করার জন্য কি করতে হবে বল, আমি সব করতে রাজি আছি। তবে একটা জিনিস প্র্যাকটিকালই বলছি। যদি দেখি আইনত বাঁশ খেতে চলেছি, তাহলে আমি আইনের সাহায্য নেব। তবে কোনও রকম অসহযোগিতা করব না। পাশে একটা উকিল রেখে সব রকম হেল্প করব যাতে তোর সন্দেহ দূর হয়। আর এতেও তোর মন না ভরলে, আই উইল রাদার সে যে এখানেই আমাদের ইতি টেনে দেওয়া উচিৎ।” আমি দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই ও ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল পিছন থেকে। “পুচু আই লাভ ইউ। কিন্তু ভেঙ্গে পরে ছি। তার মধ্যে এই শিখাদি এসে হঠাত করে…” আমি বললাম “এই সব পলিটিকাল মার্ডারে স্কেপ গোট খোঁজা হয়। এরকম সময় সবাই বলবে যে যদি কিছুই না থাকে তো কেন বার বার একেই ধরা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল যাকে ধরা হচ্ছে সে হয়ত কিছুই জানে না। জাস্ট অ্যাঁ স্কেপ গোট। তাই বলছি।” ও আমাকে ছারেনি এখনও। বলল “ সেটা দেখা যাক। কিন্তু তুই সহযোগিতা করলে আমার …” কথা শেষ হল না ঘর কাঁপিয়ে ওর মোবাইল বেজে উঠল।
ও ফোন তুলে কয়েকবার হ্যাঁ না বলে কেটে দিল। বলল “ পুলিশ এখনও বাবার ডেথের ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারছে না। “ আমি বললাম “জিনিসটা যে জটিল সেটা পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকেই বোঝা যাচ্ছে। যাই হোক আমি এইবার আসি। তুই আমাকে জানাস যে কি করলে তোর সন্দেহ দূর হবে। আর যদি তোর মনে হয় যে তুই কোনও দিনও সন্দেহ দূর করতে পারবি না, তো আমি এখানেই ইতি টেনে দেব।” ও বলল “ বার বার ইতি টানার ভয় দেখাস না। বললাম না, তেমন কোনও প্রমান থাকলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সামনে কথা বলতে পারতিস না। তোকে ভালোবাসি বলেই তোকে এত গুলো কথা বললাম।” আমি একটু হেসে ওর দিকে ফিরে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম “একটা সত্যি কথা বলি? আমিও ভালোবাসি বলেই বলছি। “ ওর চোখে জল। বলল “বলে ফেল।” বললাম “ তুইও আমাকে বার বার ভয় দেখাস না যে তোর হাতে প্রমান থাকলে আমি এখানে এসে দাঁড়াতে পারতাম না । কোন প্রমান ঠিক আর কোন প্রমান ভুল সেটা নির্ধারণ করার তুই বা আমি কেউ নই। আমার বাবাকে ছেড়ে দে, আমি নিজে চাইলে যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি, আর যখন ইচ্ছে তখন দাঁড়াতে পারি। আজ অব্দি কেউ আটকাতে পারেনি, কালও পারবে না। আমার রাগ তুই এখনও দেখিসনি। এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করিস না যে আমার মুখোশ খুলে গিয়ে আমার ভেতরের রাগ বাইরে বেরিয়ে পরে । সেই রুদ্ররূপ তুই বা তোদের এই সরকার হ্যান্ডেল করতে পারবে না। অ্যান্ড আই গ্যারান্টি দ্যাট।” হঠাত করে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখে বড়লোক বাপের বিগ্রে যাওয়া মেয়েটা কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে। ওর চোখের চাহুনিই জানান দিচ্ছে সেটা। আমি আর দাঁড়ালাম না। বেরিয়ে পড়লাম। দোলনের সাথে ভাঁট বকে আর কত সময় নষ্ট করা যায়। ঘড়িতে দেখলাম এখন বাজে ৪ টে। অনেকক্ষণ হয়েছে। অনেকগুলো কাজ আছে। বেরনোর আগে অবশ্য নিচে নেমে বেলা মুখার্জিকে হাত জোড় করে একটা নমস্কার করলাম। উনি দাঁড়িয়ে বললেন “ তোমার দেওয়া ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে। এখন সময় নেই। পরে একদিন বাড়িতে এসো। তোমার সাথে কথা বলা যাবে। আর গতকাল থানায় যা হয়েছে তার জন্য আমি সত্যিই খুব ল…” পিছন থেকে দোলনের কড়া আওয়াজ এলো “ লজ্জিত হওয়ার মতন কিছু নেই মম। এরকম কেসে জিজ্ঞাসাবাদ হয়েই থাকে। ও পুলিশের সাথে সব রকম সহযোগিতা করবে বলে আমাকে বলেছে। কি সংকেত? আমি ঠিক বলছি...তাই তো?” আমি ওর দিকে ফিরে বললাম “কোনও সন্দেহ আছে?” ও বলল “ একদম নেই। আগে সবার (কথাটা বেশ জোড় দিয়ে বলল) সহযোগিতায় সব কিছু ক্লিয়ার হোক। তারপর না হয় ও বাড়িতে এসে আমাদের সাথে গল্প করবে।” বললাম “বেশ তাই হোক।“ বেরিয়ে পড়লাম। রাকাকে সময় দিয়েছি ৫ টা। তার আগে দুটো কাজ সারতে হবে।
দোলনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসেই একটা সিগারেট ধরালাম। একটা চিন্তা অনেকক্ষণ ধরেই মাথায় ঘোরা ফেরা করছে। শিখাদি কি এমন জানে যে সেটা থেকে ওর ধারণা যে এর মধ্যে আমি আছি, আর শুধুই আমি আছি! স্ট্রেঞ্জ। আরেকটা বড় সমস্যা হল, শিখাদি কি দোলনকে শুধু এই মার্ডারের ব্যাপারেই কথা বলার জন্য মেসেজ করেছিল, নাকি ও সেদিন আমি যে ওর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ওর শরীরটাকে ভোগ করেছি সেটাও দোলনের সামনে বলে দিতে চায়। একবার মনে হল যে শিখাদির জন্য মার্ডার ইত্যাদি সব ফালতু, ও শুধু চায় ওর রেপের গল্পটা দোলনের সামনে তুলে ধরে আমার ইমেজ খারাপ করতে। আর সেটা যদি করতে পারে তো পুলিশের হ্যাপাও পোহাতে হবে। চাপের ব্যাপার! কারণ রেপ ব্যাপারটা তো আর সাধারণ ব্যাপার নয়। পড়াশুনা ইত্যাদি সব মাথায় উঠবে, উল্টে যদি সত্যিই কিছু প্রমাণিত হয় তো আমাকে হাজতবাস করতে হবে। আর সেটা হলে বাবা মা যে কি ভাববে সেটা এখন বলে কাজ নেই। রেপের ব্যাপারটা নিয়ে আরেকটু পরেও ভাবলে চলবে, কিন্তু আপাতত, হঠাত করে কেন যে মার্ডারের ব্যাপারে এরকম বিশ্রী ভাবে জড়িয়ে পড়লাম সেটাই মাথায় ঢুকছে না। সেদিন ওদের সাথে পার্টিতে না গেলেই বোধহয় ভালো করতাম। ড্রাইভারের আওয়াজে চেতনা ফিরে এলো। গাড়ি থেকে নেমে সেই জেরক্সের দোকান থেকে কাগজগুলো কালেক্ট করে বাকি টাকা মিটিয়ে আবার ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম। দ্বিতীয় কাজটা আর সারা হল না। একটা সিগন্যালে এসে প্রায় আধা ঘণ্টা গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। গাড়ির বাইরে একজন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। তাকে হাত নেড়ে ডেকে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। সেই আমাকে বলল যে কোনও এক ভি আই পি নাকি ক্রস করবে, তাই কারোর গাড়ি এগোতে দেওয়া হচ্ছে না। কে এই ভি আই পি ইত্যাদি নিয়ে এই পুলিশের সাথে আরও অনেকক্ষণ গ্যাজালাম। তবে ওর কাছ থেকে তেমন কোনও তথ্য পেলাম না। শুধু জানতে পারলাম যে রাজ্য সরকারের কোনও এক বিশেষ অতিথি। ওর বুকে লাগানো ব্যাচটা দেখে অবশ্য ওর নামটা আমার শুরুতেই জানা হয়ে গেছে। অফিসারের নাম “পুলক হালদার”।
গাড়ি ছাড়ার আগেই মার্ডারের প্রসঙ্গটা আবার ফিরে এলো মাথার ভেতর। তবে একটা জিনিস দোলনের সাথে কথা বলার সময়ই ঠিক করে ফেলেছিলাম। দোলন আমার জন্য এমন জরুরি কিছু নয় যে যার জন্য আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ছিনিমিনি খেলব। দোলন যদি আমাকে চাপে রেখে মাথায় চড়ে বসার চেষ্টা করে বা আমাকে ডোমিনেট করার চেষ্টা করে তো কিছুটা সহ্য করতে হবে বইকি কারণ ওর শরীরটা বেশ ডাঁশা, কিন্তু লিমিট ক্রস করলেই ওকে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নর্দমায় ফেলে দিতে আমার বেশীক্ষণ লাগবে না। শিখা কি জানে সেটা শিখার সাথে দেখা করার আগে জানা যাবে না। কিন্তু একথা পরিষ্কার যে শিখা ওকে কিছু বলতে গিয়েও বলেনি। খুনের ব্যাপারটা ছেড়েই দিলাম। কারণ সেই ব্যাপার নিয়ে শিখার সন্দেহ নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করার কোনও মানে হয় না। তবে রেপের ব্যাপারটা তো ও দোলনকে বলে দিতে পারত। কিন্তু সেটাও ও দোলনকে বলেনি। আর সেই সাথে আমাকেও মেসেজ করে দেখা করতে বলেছে। শিখার ঘর দোর দেখে একটা জিনিস পরিষ্কার যে শিখার অবস্থা ভালো নয়। দীপক যত দিন বেঁচেছিল তত দিন হয়ত দীপকই শিখার ফুর্তির জন্য খরচ করত। কিন্তু এখন দীপক নেই। সুতরাং ওর অবস্থা এখন খুব টাইট। তাছাড়া শিখা মেয়েটা দোলনদের ভাষায় একটা রেন্ডি টাইপের মেয়ে। এটা যদি সত্যি হয় তো ওকে দীপক ভোগ করল না অন্য কেউ সেটা নিয়ে ওর সত্যিই কোনও মাথা ব্যথা থাকার কথা নয়। অবশ্য মাথা ব্যথা আছে কি না সেটা জানা নেই আপাতত। সেই ক্ষেত্রে নিজের হাত খরচা চালানর জন্য আর ফুর্তির খরচা ওঠানোর জন্য ও যে কোনও সহজ পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করবে। ব্ল্যাক মেইল করবে আমাকে? মনে মনে না হেসে পারলাম না। তবে একটা ব্যাপার এখানে মেলানো যাচ্ছে না কিছুতেই। হোয়াই দোলন?