05-03-2019, 03:03 PM
সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করার আগেই একটা এস এম এস ঢুকল। দোলন। “আই লাভ ইউ টু মাই পুচু সোনা। থ্যাংকস ফর ইওর কনসার্ন অ্যাঁবাউট মি। অনেক অনেক কিসি এই সময় পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তুই যা বোঝাতে চেয়েছিস সেটা আমি বুঝেছি। তুই আমার কনসোলেশন প্রাইজ নস। তুই আমার অ্যাঞ্জেল। মুয়ায়ায়ায়াহ। দীপকের ব্যাপারটা আমারও সন্দেহজনক লাগছে। পরে কল করব সোনা। টেক কেয়ার।” সিগারেটটা শেষ করে একটা ট্যাক্সি ধরতে যাব ঠিক সেই সময় দোলনের কল। “কি ব্যাপার।” ও বলল “ তুই কি বেরিয়ে গেছিস? রাকার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা আমি পুলিশকে গোপনে জানিয়েছি। তুই এসে একবার কথা বলতে পারবি?” আমি শান্ত গলায় বললাম “কেন পারব না। তোর জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। লাভ ইউ। আমি আসছি।”
লিফটের সামনে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারলাম যে ওপরে কিছু একটা হয়েছে। দৌড়া দৌড়ী শুরু হয়ে গেছে। লিফটে ওঠা আর আমার হল না। সিঁড়ি ভেঙ্গে চার তলায় উঠে যা দেখলাম তাতে এক নিমেষে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রঞ্জন বাবু যেই বেঞ্চে বসে ছিলেন সেখানেই লুটিয়ে পরে ছেন। ওনার মুখ দিয়ে গ্যাঁজা বেরোচ্ছে। মুখ পুরো নীল হয়ে গেছে। একজন ডাক্তার এসে ঝুঁকে পরে ওনাকে পরীক্ষা করছেন। এক কথায় উনি মারা গেছেন। ডাক্তারের সন্দেহ বিষক্রিয়া। মনে মনে বলতে বাধ্য হলাম হোয়াট দা হেল। এইবার বেলা মুখার্জি কে দেখে মনে হল যে ফাইনালি উনি বিচলিত হয়েছেন স্বামীর এই আকস্মিক মৃত্যুতে। ওনার চোখে জল। এবং এইবার দেখে মনে হল যে সেটা মেকি কান্না নয়। দোলনের কথা আর বলার নয়। ইতি মধ্যে সবাই জেনে গেছে যে দোলন সন্দেহ করে দীপককে। আরেকটা কথা আমি জানতে পারলাম, সেটা হল এই যে, দীপক আগে যদিও রঞ্জন বাবুর জন্য কাজ করত, কিন্তু ইদানিং নাকি ওর বেপরোয়া ভাবের জন্য রঞ্জন বাবুর সাথে ওর কিছু ঝামেলা হয়েছে। রঞ্জন বাবুর বডিটা কোনও মতে ভিড় ঠেলে পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হল। যেই গ্লাস থেকে উনি জল খেয়েছেন সেটাও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। গ্লাসে এখনও কয়েক ফোঁটা জল অবশিষ্ট। সেটা নাকি পরীক্ষা করে দেখা হবে। স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস।
একজন পুলিশ আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল “তুমি সংকেত?” বললাম “হ্যাঁ।” বলল “একটু আমাদের সাথে এসো।” আমাকে দীপকের ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম দোলন যে দীপক কে সন্দেহ করে সেটা জানার পরই দীপকের চামচাগুলো একে একে সরে পরে ছে। এখনও যদিও দুই একজন অবশিষ্ট আছে। আরেকটা ব্যাপার না বলে পারছি না, দীপকের বাড়ির কোনও লোককে দেখতে পেলাম না। ওরা কি জানে না যে দীপকের এই দুর্ঘটনার কথা? দোলন রাকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে। আমাকে পুলিশ জিজ্ঞেস করল “দীপকের সামনেই তুমি খুলে বলবে যে কেন তোমাদের সন্দেহ দীপক এটা করতে পারে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা?” আমি একটা লম্বা দম নিয়ে গতকাল যা হয়েছে আবার বলে চললাম পুলিশের সামনে। মাঝে দোলন বলল “ বাবার সাথে অনেক দিন ধরেই দীপকের অনেক ঝামেলা চলছে। বাড়িতে এসে শাসিয়েও গেছে কয়েক দিন আগে। এই শুয়োরটাই গতকাল আমার দাদাকে মেরেছে, আর আজ ওরই কোনও লোক যে বাইরে ঘুর ঘুর করছিল, সুযোগ বুঝে বাবাকে বিষ…” আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ও।
দীপক কোনও মতে উঠে বসেছে। ওকে দেখে মনে হবে যেন ও কিছুই বুঝতে পারছে না। আমার বয়ান শেষ হলে আমাকে যেতে বলা হল। আমি বেরিয়ে ই আসছিলাম। কিন্তু কি মনে হতে আমি একবার থেমে গেলাম। ওই পুলিশের সামনেই এগিয়ে গেলাম দীপকের দিকে। পাশে শিখা দাঁড়িয়ে আছে। দীপকের চোখে চোখ রেখে বললাম “দীপকদা তুমি যদি সত্যিই এই দুটো মৃত্যুর পেছনে থাকো তো আমার সাজেশন নাও। সত্যি কথা স্বীকার করে নাও। একজন মিনিস্টারকে মেরে তুমি বা তোমার লোক পার পাবে না। তুমি ওনাকে শাসিয়ে এসেছ? এটা পুলিশের চোখে একটা ভাইটাল এভিডেন্স। ভুলে যেও না রঞ্জন বাবু ভোটে জিতে মিনিস্টার হয়েছেন। ওনার অনেক লোক আছে, যারা বাইরে তোমাকে পেলেই... কথাটা ভালো ভাবে মনের ভেতর গেঁথে নাও।” একটু থেমে বললাম “আমি তোমার জায়গায় থাকলে সুই সাইড করে নিতাম। এই অবস্থায় বেঁচে থাকলে আরও অনেক ভুগতে হবে। তুমি বিছানায় পরে থাকা অবস্থায় বাইরে তোমার কোনও লোক সুযোগ বুঝে রঞ্জন বাবুকে বিষ দিতে পারবে না সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এখানে তোমার বিছানায় পরে থাকার অ্যাঁলিবাইটাই তোমার এগেনস্টে যাবে ইনভেস্টিগেশন হলে।” আমি বেরিয়ে গেলাম ঝড়ের মতন। লক্ষ্য করলাম দীপকদা শিখাদির দিকে করুণ মুখে চেয়ে আছে। আর বাকিরা সবাই দীপকদার দিকে তাকিয়ে আছে…
এক সাথে অনেক ঘটনা ঘটে গেলে মাথাটা কেমন যেন ভো ভো করে। আজ সেই রকম অবস্থা। ভোর রাতে এত গুলো ছেলে মেয়ের মৃত্যু। তারপর রঞ্জন বাবুর আকস্মিক মৃত্যু, যেটা শিওরলি খুন। আর হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে আরেকটা খবর পেলাম। এইবার এস এম এস নয়। কল। রাকা। দীপকের ঘরের বাইরে পুলিশ বসিয়ে সবাই বেরিয়ে এসেছিল। হঠাত উপরে একটা দুম করে শব্দ পেয়ে সবাই ছুটে ওপরে গিয়ে দেখে যে দীপক একটা চালু বাজারে পিস্তল দিয়ে সুই সাইড করে নিয়েছে। ঘটনাটা যখন ঘটে তখন ঘরে দীপক একা ছিল। সবার ধারণা শিখাদির সাথে কোনও পিস্তল ছিল না। আর তাছাড়া শিখাদি বেশ কিছুক্ষণ আগেই পুলিশের সামনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরেকজন ছেলে দীপকদার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই ছেলেটাকে পুলিশ আটক করেছে। আপাতত অনুমান করা হচ্ছে যে দীপক ওই ছেলেটার কাছ থেকে পিস্তলটা ধার করেছে, আর ঘর খালি হলে সেই পিস্তল দিয়েই সুই সাইড করেছে। ওই ছেলেটা যে একটা মার্কা মারা গুন্ডা সেটা সবাই জানে। রাজনৈতিক কারনে এতদিন ছেলেটার গায়ে হাত দেওয়া যায় নি। কিন্তু আজ যখন মিনিস্টার নিজেই ভিক্টিম, তখন আর রাজনৈতিক গুণ্ডার জীবনের কি দাম!
খবরটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকে বেরিয়ে গেল। মনটা কেমন যেন বিষাদে ভরে গেছে এতগুলো মৃত্যুতে। ঘরে ঢুকেই কানে হেড ফোন গুঁজে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জামা কাপড় খোলার কথাও মাথায় এলো না। আজ এই সময় আমার মালিনীর ঘরে গিয়ে ওর বরের সামনে ওকে ভোগ করার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে মাথায় শুধু ঘুরছে মৃত্যু, দোলন, দীপক ...এইসব। এখন মালিনীর সাথে এই সব করার কোনও মানে দাঁড়ায় না। কে জানে কখন আবার থানায় ছুটতে হয়। আমি মালিনী কে একটা এস এম এস করে জানিয়ে দিলাম যে ক্লাসের একজনের হঠাত মৃত্যু হওয়ায় সব গোলমাল হয়ে গেছে। এখন তোমার সাথে দেখা করা হবে না। একটু একা থেকে ভাবতে হবে অনেক কিছু। মালিনীর উত্তর এলো মিনিট দুয়েকের মধ্যে। “ কিছু চিন্তা করো না সোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে হোটেলে শান্তনু আর রঞ্জন বাবুর খবর পৌঁছে গেছে। রেস্ট নাও। আর মনে করে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দাও।”
আর লাঞ্চ! একটা রেডিও ষ্টেশনে টিউন ইন করে আবার শুয়ে পড়লাম। দেখলাম কয়েকটা মেইলও এসেছে। সেগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। মামুলি মেইল যত সব। স্প্যাম। অবশ্য একটা মেল খুব কাজের। লোকাল দালালের কাছ থেকে এসেছে। বাড়ির খবর আছে। ও হ্যাঁ সঞ্চিতা ম্যাডামের সাথে দেখা করার কথা বিকালে। ওনাকে ওই হাসপাতালে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু কথা বলার সুযোগ পাইনি। ম্যাডাম কে কি ফোন করে জানিয়ে দেব যে আজকের বদলে আগামীকাল ওনার সাথে দেখা করলে কেমন হয়? আমাদের সবার ওপর দিয়েই আজ অনেক ঝড় ঝাঁপটা চলে গেছে। আজ আর বাড়ির খোঁজে যেতে মন চাইছে না। আরেকটা জিনিস পথে আসতে আসতে জানতে পেরেছিলাম। এটাও জেনেছি একটা এস এম এস থেকে। কলেজের ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে এসেছে এই এস এম এসটা। সারমর্ম হল ঃ সুনীল আর বিশালের মৃত্যুর শোকে আগামীকাল কলেজ বন্ধ। কখন যে চোখ বুজে গিয়েছিল সেটা সঠিক ভাবে বলতে পারব না। ঘুম ভাঙল মোবাইলের রিঙে। এটা রাকা। ঘড়ি বলছে এখন বাজে বিকেল সোয়া দুটো। কল রিসিভ করতেই রাকা এক ধার থেকে অসংলগ্ন ভাবে অনেক কথা বলে যেতে শুরু করল। ওকে আমি থামিয়ে বললাম “দাঁড়া দাঁড়া, এই ভাবে বললে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। একটু থেমে থেমে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট বল যে আবার কি হয়েছে বা কি জানা গেছে?” ও কয়েক সেকন্ডের জন্য একটু চুপ করে রইল। বুঝলাম মনের ভেতরের চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিচ্ছে।
তারপর শুরু করলঃ “ এখন অব্দি পুলিশের কাছ থেকে যা জানা গেছে তা হল এই মতন ঃ
১। দোলন এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে।
২। রঞ্জনবাবু যে বিষের প্রয়োগেই মারা গেছেন সেই বিষয়ে পুলিশ মোটামুটি নিঃসন্দেহ। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে। তাহলে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে।
৩। দীপকের ঘরে কোনও ক্যামেরা লাগানো ছিল না। তাই সেই ছেলেটাই দীপককে ওই পিস্তলটা দিয়েছিল কি না সেই বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না। তবে সন্দেহ ওই ছেলেটার ওপরেই। ছেলেটা যদিও দীপক কে পিস্তল দেওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করছে। পিস্তলটা পুলিশ ল্যাবে পাঠিয়েছে।
৪। পিস্তল, জলের গ্লাস, জল সব কিছু ল্যাবে পাঠানো হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য।
৫। যে গাড়িতে দুর্ঘটনা হয়েছে সেই গাড়িটাও পাঠানো হয়েছে পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
৬। হাসপাতাল থেকে যত গুলো সি সি টিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
৭। কোলাঘাটের কাছেই একটা চেক পয়েন্ট থেকে সিসিটিভি ফুটেজ আনিয়েছে এখানকার পুলিশ।
৮। যেহেতু একজন ভি আই পি মারা গেছেন তাই সব পরীক্ষা নিরীক্ষা যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে করা হচ্ছে। আশা করা যায় যে বিকালের পর থেকে একে একে সব রিপোর্ট আসতে শুরু করে দেবে।
৯। বডি পুলিশের হাত থেকে ছাড়া হলে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে অনেক লোক ভিড় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। রাজ্যের মিনিস্টার বলে কথা।
কথা আর এগোল না। কল কেটে আবার শুয়ে পড়লাম। তিনটে বাজতে না বাজতেই আবার কল এলো। এবারও রাকা। “শোন তোকে এক্ষুনি একবার থানায় আসতে হবে?” আমি ঢোক গিলে বললাম “কেন? আমি আবার কি করেছি?” রাকা বলল “সেটা ফোনে বলতে পারছি না। তুই কিছু করিসনি কিন্তু পুলিশ একবার তোর সাথে কথা বলতে চাইছে। ভয় পাস না। একবার তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
পাঁচ মিনিটের ভেতর বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি ধরে থানায় পৌঁছাতে লাগল ঠিক কুড়ি মিনিট। ভেতরে ঢুকে দেখলাম দোলন আর বেলা মুখার্জিও সেখানে উপস্থিত। দোলন যেন আমাকে দেখেও দেখল না। সকালের সেই পুলিশ অফিসারও আছেন। আমাকে বসতে বলা হল। বসলাম। সেই অফিসার প্রায় কোনও ভনিতা না করেই শুরু করলেন। “ হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ আমরা চেক করেছি। রঞ্জন বাবুর জন্য যিনি জল আনতে গেছিলেন তিনি অনেক দিন ধরে হাসপাতালে কাজ করছেন। যেখানে উনি গ্লাসে জল ঢেলেছিলেন সেখান থেকে ওপরে আসা অব্দি প্রায় পুরো সময়টা বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখতে পেলাম যে উপরে আসার পর একজনের সাথে উনি ধাক্কা খান, লিফটের ঠিক বাইরে। সে কে?” আমি চিন্তা না করেই উত্তর দিলাম “আমার সাথেই উনি ধাক্কা খেয়েছিলেন।” অফিসার বলে চললেন “ তুমি ক্ষণিকের জন্য হলেও জলের ট্রেতা ওনার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিলে। রাইট?” মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম হ্যাঁ। “সেই সময় তুমি সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিলে। জলের ট্রেটা দেখা যাচ্ছিল না। তোমার হাত থেকে ট্রেটা ফেরত নিয়েই উনি দৌড় মারলেন রঞ্জনবাবুর দিকে। রঞ্জনবাবু ওনার কাছ থেকে জল নিয়ে জল খেলেন। তার কিছুক্ষনেইর মধ্যেই ওনার মৃত্যু। “
ঘরের সবাই চুপ। আমার চোয়াল ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠেছে। বলতে কি চায় লোকটা? অফিসার বললেন “সেই কয়েক সেকন্ডের জন্যই সিসিটিভিতে গ্লাসটা আমরা দেখতে পাইনি, যখন জিনিসটা ছিল তোমার হাতে। আর তুমি এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ একজন অচেনা লোক। তুমি এমন একজন যার ব্যাক গ্রাউন্ডের ব্যাপারে আমরা এখনও কিছুই জানি না। এইবার তোমাকে খোলা খুলি একটা প্রশ্ন করছি, আশা করছি তুমি ঠিক ঠিক জবাব দেবে। অবশ্য তুমি চাইলে আইনি পরামর্শ নিতে পার এবং এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পার। কিন্তু তবুও প্রশ্নটা আমি করছি ফর আওয়ার রেকর্ড, উত্তর দেওয়া না দেওয়া তোমার ব্যাপার।” আমি বললাম “প্রশ্ন করুণ। এই আইন আমার অজানা নয়।” পুলিশের ঠোঁটের কোনায় একটা হাসির ঝিলিক খেলে গেল।
১৬
“তুমি কি রঞ্জনবাবুর গ্লাসে বিষ দিয়েছিলে?” আমি হেসে বললাম “এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।” অফিসার আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “আবারও জিজ্ঞেস করছি গ্লাসে কি তুমি বিষ মিশিয়েছিলে?” আমি আবার একই জবাব দিলাম। উনি একটা হুম্ম মতন শব্দ করে বললেন “সবার সামনে আপনার এই স্টেটমেন্ট রেকর্ড করা হল। আপনার আইনি অধিকার আছে আমাদের কোনও প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার। আপনি যখন আপনার উকিলের সাথে কথা না বলে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না, তখন আপনাকে আমি অনুরোধ করব, এক্ষুনি আপনার উকিলকে কল করে এখানে আসতে বলুন। উনি যতক্ষণ না এখানে আসছেন ততক্ষণ আপনাকে এখানে বসে থাকতে হবে।”
আমি মোবাইলে বের করার কোনও তাগিদ অনুভব করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম “স্যার একটু জল পাওয়া যাবে? খাব।” একজন এসে আমার হাতে একটা জলের গ্লাস ধরিয়ে দিল। ইসস কি তেতো জল। লোকে খায় কি করে! দোলনের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কেঁদে কেঁদে মুখ ফুলে গেছে। দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। রাকার চোখে এক রাশ বিস্ময়। বেলা মুখার্জির মুখের মেক আপ উঠে গেছে। মহিলা সুন্দরী তাতে সন্দেহ নেই। মুখের চামড়ায় এক ফোঁটা ভাঁজ পরে নি কোথাও।
আমি অফিসারকে বললাম “একটা কাগজ আর পেন পাওয়া যাবে?” ভদ্রলোক একটা প্যাডের কাগজ এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ওনার সামনে টেবিলের ওপর অনেকগুলো পেন সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। হাত দিয়ে সেই দিকে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। আমি চেয়ার থেকে উঠে ওরই মধ্যে থেকে একটা পেন উঠিয়ে নিলাম। অফিসারের ঠোঁটের কোনায় হাসি । উনি কি ভাবছেন যে আমি বসে বসে আমার জবানবন্দি লিপিব্দধ করছি? পাগল না ছাগল। অফিসার বললেন “যা লেখার ডিটেইলে লিখবে।” আমি একটু হেসে আবার কাগজের দিকে মননিবেশ করলাম। প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেছে, এখনও আমি খসখস করেই চলেছি কাগজের ওপর। অফিসার আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। উঠে পড়লেন টেবিলের ওপাশ থেকে। আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়লেন কাগজের ওপর।
“হোয়াট? তুমি বসে বসে মিসেস বেলা মুখার্জির ছবি আঁকছ?” বললাম “আর পাঁচ মিনিট। হয়ে এসেছে প্রায়।” ভদ্রলোক কি বলবেন ভেবে পেলেন না। আড়চোখে গোটা ঘরের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারলাম যে সবাই আমার দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে আছে। উনি আবার ফিরে গেলেন নিজের সিটে। এবার ওনার গলার স্বরে এক রাশ বিরক্তি। “আপনি আপনার উকিলকে ফোন করুণ। এখানে সবার সময়ের অনেক দাম আছে। আগে আপনার উকিল আসুক, তারপর আপনার ব্যাপারে একটা হিল্লে হোক, তারপর আপনি জেলে বসে বসে যত খুশি যার খুশি ছবি আঁকতে পারবেন।” আমার ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। পেনটা উঠে আবার যথাস্থানে রেখে দিলাম। কাগজটা দোলনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম “এটা তোমার মায়ের জন্য।” কয়েক সেকন্ড সব চুপ।
তারপর ধীরে ধীরে ও আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিল। কাগজটা কয়েক মুহূর্তের ভেতর চলে গেল মিসেস মুখার্জির হাতে। এইবার আমি অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললাম “ আমি বলেছি আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। একবারও বলিনি যে উকিলি পরামর্শ না নিয়ে জবাব দেব না। বলেছি একেবারেই দেব না।” অফিসার যেন আমার দিকে তেড়ে আসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই আমি ধীর গলায় বললাম “ জবাব দেব না কারণ জবাব দেওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না। বাই দা ওয়ে, আপনাদের সব রিপোর্ট এসে গেছে?” উনি বললেন “ না। কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে বলে এক্সপেক্ট করছি।” আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম “তাহলে আর কি? অপেক্ষা করুণ। রিপোর্ট আসার পরও যদি আপনার বা আপনাদের আমার ওপর কোনও সন্দেহ থাকে তবে আমি নিশ্চয় জবাব দেব। তবে আবারও বলছি, জবাব দিচ্ছি না কারণ জবাব দেওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না।”
আমি উঠে পড়লাম। “কাইন্ডলি কাউকে আমার সাথে বাইরে আসতে বলবেন? সিগারেট খাব। আপনারা হয়ত ভাববেন যে এই সুযোগে আমি পালিয়ে যাব। তাই কাউকে সঙ্গে দিলে খুব ভালো হয়।” উনি বললেন “ক্যাম্পাসের বাইরে যাবে না। আর পালিয়ে যাবেই বা কোথায়?” আমি বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। কিন্তু এই থানার ক্যাম্পাসের ভেতর কোনও খাওয়ার দোকান নেই। ভেতরে ঢুকে দেখলাম অফিসার ফোনে কথা বলছেন। আর খস খস করে কিসব লিখে চলেছেন। প্রায় পাঁচ মিনিট কথা বলার পর ফোন রেখে বললেন “সংকেত, (আপনি থেকে তুমি তে নেমে গেছেন এই পাঁচ মিনিটে) তোমাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য আমি দুঃখিত। রিপোর্ট এসে গেছে।”
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন “
১। গ্লাসের জলে কোনও রকম বিষ পাওয়া যায় নি। পিওর এইচ টু ও। গ্লাসের জল খেয়ে ওনার মৃত্যু হয়নি সেই ব্যাপারে আমাদের ফরেনসিক বিভাগ নিঃসন্দেহ।
২। গ্লাসের গায়ে শুধু ওই হাসপাতালের কর্মচারী আর রঞ্জনবাবুর হাতের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। জলের ট্রে তে অবশ্য আরেকজন অজানা তৃতীয় ব্যক্তির আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। (বলাই বাহুল্য আমার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে)
৩। পিস্তলে দীপক ছাড়া আর কারোর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় নি।
৪। পিস্তলটা বাজারে পিস্তল। চোরাবাজারিদের কাছ থেকে কেনা। কারও নামে রেজিস্টার্ড নয়।
৫। গাড়ির যে স্ক্রুগুলো লুস করে রাখা হয়েছিল তাতে আর গাড়ির চাকায় দীপকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এমনকি গাড়ির ভেতরের কিছু পার্টসেও অপ্রত্যাশিত ভাবে দীপকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।
৬। কোলাঘাটের কাছ থেকে যে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে সেইগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে। শান্তনুদের গাড়ি ওই চেক পোস্ট ক্রস করার ত্রিশ মিনিট আগে থেকে ত্রিশ মিনিট পর অব্দি গুনে গুনে ঠিক ছটা গাড়ি চেকপোস্ট ক্রস করেছে। প্রত্যেকটা গাড়ির নাম্বার নোট করে নেওয়া হয়েছে। পাঁচটা গাড়ির মালিকের সাথে ইতি মধ্যে কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু একটা কালো রঙের স্যান্ট্রোর মালিকের সাথে এখনও কন্ট্যাক্ট করা যায়নি। কারণ গাড়ির নাম্বারটা জালি। (দীপক বলেছিল দুর্ঘটনার পর একটা কালো রঙের গাড়ি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল।)
৭। আকস্মিক জোরে ব্রেক দেওয়ার ফলে চাকা স্থানচ্যুত হয়ে যায়, যার ফলে এই দুর্ঘটনা হয়।
আপাতত এই অব্দি জানা গেছে। বডি পরীক্ষাও হয়ে গেছে। রিপোর্ট এই এলো বলে। “
উনি থামলেন। রাদার থামতে বাধ্য হলেন, কারণ তখনই একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে পরে ছেন। অফিসারের কানে গিয়ে কি সব ফিসফিস করে বলে ওনার হাতে একটা কাগজের খাম ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অফিসার খাম খুলে এক তাড়া কাগজ বের করে মন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই কাগজের লেখা গুলো পড়লেন। পাতা উলটিয়ে উলটিয়ে পড়লেন। ওনার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম যে উনি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। কাগজের তাড়াটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে উপরে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে প্রায় মিনিট খানেক চুপ করে বসে কি যেন ভাবলেন। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে পরে বললেন “ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে।”
আবার চুপ করে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। বুঝতে পারছি উনি কোনও একটা ব্যাপার ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, বা ভাবনার তল পাচ্ছেন না। আবার শুরু করলেন। “ বিষের জন্যই ওনার মৃত্যু হয়েছে। একটা বিশেস ধরণের বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। কোলকাতায় সচরাচর এই বিষ পাওয়া যায় না। বিষের ক্রিয়া হতে সময় লাগে ঠিক কুড়ি মিনিট। মিস্টার মুখার্জির বডিতে অ্যালকোহল থাকায় বিষের ক্রিয়া কিছু আগেই শুরু হয়ে যায়। সেপসিস হয়ে গেছিল। আর, হার্ট বন্ধ হয়ে গেছিল। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা গেছেন মিস্টার মুখার্জি। সব থেকে আশ্চর্য হল কিভাবে বিষটা ওনার শরীরে ঢোকানো হয়েছে। “ একটু থেমে আবার উনি বলতে শুরু করলেন “মিস্টার মুখার্জির কোমরের ঠিক নিচে একটা মাইক্রো নিডল, কেউ ওনার শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই নিডলের গায়েই মাখানো ছিল বিষ। আর তাতেই মৃত্যু। নিডলটা ওনার শরীরের একদম গভীরে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু... প্রশ্ন হল মিস্টার মুখার্জি যেখানে বসেছিলেন সেখানটা পুরোটা দেখা যাচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজে। ওনার বডি গার্ড ছাড়া আর কেউ সেই সময় ওনাকে ছোঁয়নি। তাহলে কিভাবে সেই মাইক্র নিডলটা ওনার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করল?”
আমরা সবাই চুপ করে বসে আছি। উনি যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন “ বাকি দের পোস্টমর্টেম রিপোর্টও এসে গেছে। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই সেগুলোতে। আপনারা এখন যেতে পারেন। বডি রিলিস করে দেওয়া হয়েছে। ওনার বডি ওনার বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শান্তনু মুখার্জির বডিও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
আমরা উঠে পড়লাম। অফিসার থানার বাইরে অব্দি এলেন বেলা মুখার্জিকে ছেড়ে দিতে। দোলন আর বেলা মুখার্জি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আমার সাথে দোলনের আর চোখা চুখি হয়নি এর মধ্যে। সত্যি আশ্চর্য মৃত্যু। অগত্যা সামনের একটা দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা এগ রোল অর্ডার করলাম। দেখলাম থানার সেই অফিসার পায়ে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসেছেন। বললাম “স্যার সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আর চারপাশে যা চলছে। আপনি খাবেন?” উনি বললেন “শুধু চা।” আমিও ওনার সাথে এক কাপ চা নিলাম। কারোর মুখে কোনও কথা নেই। আমি নিরবতা ভেঙ্গে বললাম “স্যার ব্যাপারটা কিন্তু ধীরে ধীরে বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।” উনি হেসে বললেন “এতেই ঘাবড়ে গেছ? এর থেকে ঢের জটিল রহস্য আমাদের শলভ করতে হয়। চিন্তা করো না। এই রহস্যের সমাধানও হয়ে যাবে। তবে দীপক যে এই ব্যাপারের মধ্যে আছে সেটা মোটামুটি ক্লিয়ার। কিন্তু …” উনি চুপ করে গেলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করি যে ছেলেটাকে আটক করে রেখেছেন তার সাথে কি করবেন, কিন্তু অজথা কথা বলার সময় এটা নয়। সময় খুব দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে হাতের বাইরে
ট্যাক্সিতে উঠেই কল করলাম সঞ্চিতা ম্যাডাম কে। “এখন চলে আসব ম্যাডাম? একটু দেরী হয়ে গেছে বলে সরি।” উনি বললেন “চলে এসো। সমস্যা নেই।”
কলিং বেল বাজার একটু পরে ম্যাডাম এসে দরজা খুলে দিলেন। উনি কিছু বলার আগেই আমি বললাম “থানা থেকে আসছি। অনেক হুজ্জুতি গেছে।” ভেতরে ঢুকলাম। ম্যাডাম কে আজ আরও অন্য রকম লাগছে। একটা ঢিলে সালোয়ার আর হাতকাটা একটা কামিজ পরেছেন। ওড়না দিয়ে অবশ্য বুক আর হাতের ওপরের দিকের অনাবৃত অংশগুলো ঢাকা। সদর দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি তোলার সময় ওড়নাটা কাঁধের ওপর থেকে সরে যাওয়াতেই বুঝতে পারলাম যে উনি হাতকাটা কামিজ পরেছেন, নইলে এমনিতে বোঝার কোনও উপায় নেই। হাতের উপরের দিকটা যেন আরও বেশী ফরসা।
আমাকে বসতে বলে খাবার জল নিয়ে এলেন। এক ঢোকে জল খেয়ে থানায় কি কি হয়েছে সব কথা বললাম। গতকালের পার্টির ব্যাপারটাও গোপন করলাম না। ম্যাডাম পাখা ছেড়ে দিয়েছেন। ওনার চোখগুলো একটু ফোলা ফোলা, মনে হয় এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। উনি সোফায় বসে বললেন “সংকেত, তুমি বাইরের ছেলে। তোমাকে একটা সাজেশন দিচ্ছি। মানা না মানা তোমার ব্যাপার। তোমাদের বয়সে সবাই জীবন ভোগ করতে চায়। কিন্তু এই সব ছেলে মেয়েদের সাথে তোমার মতন ছেলের বেশী না মেশাই ভালো। এদের সাথে মিশে তোমার কোনও লাভ হবে না, বরং এইসব হাবি যাবি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে বারবার। “
আমি বললাম “সেটা ম্যাম হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ আজ অব্দি থানার পথ মাড়ায়নি। শেষ অব্দি কিনা আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।” ম্যাডাম শান্ত ভাবে হেসে বললেন “যাক সে সব কথা। তবে মনে হয় এখন আর তোমাকে কেউ জ্বালাবে না। যা হওয়ার আপাতত হয়ে গেছে। এইবার কাজের কথায় আসা যাক।” আমার কান খাড়া। “তুমি কি এখন অব্দি কোনও মেসের বন্দবস্ত করতে পেরেছ?” আমি বললাম “কখন আর সময় পেলাম ম্যাম। দুই দিন ধরে যা চলছে। কেন যে মরতে কাল ওদের দলে গিয়ে ভিড়েছিলাম…”
ম্যাডাম বললেন “ আমার এক মাসতুতো বোন আছে। আর তার দুজন বন্ধুও আছে। জয়েন্টে বসবে সামনের বছর। মাসে ৬০০ টাকা করে দিতে রাজি হয়েছে প্রত্যেকে। অঙ্ক পড়াতে হবে। সপ্তাহে দুই দিন টাইম দিতে হবে কারণ তিনজনেই অঙ্কে কাঁচা। মাসে ১৮০০ টাকা কিন্তু কম নয়। পারবে পড়াতে?” আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা হিসাবের বাইরে ছিল। ম্যাডাম বললেন “ এইবার তুমি আমায় বল যে সপ্তাহে দু-দিন পড়ানোর জন্য কত নিতে চাও?” আমি বললাম “না না, আপনার কথাই ফাইনাল। টিউশনি পেলে তো ভালোই হয়। তবে কোথায় পড়াতে হবে?” ম্যাডাম বললেন “শোনো সংকেত কোলকাতায় টিকতে হলে একটু দরদাম করা শেখ। এটা তোমাদের গ্রাম নয়। এখানে সবাই তোমাকে ঠকাতে চাইবে। “ একটু থেমে বললেন “ কথা হয়েছে ৭০০ টাকায় সপ্তাহে দুই দিন। আর পড়াবে এই বাড়িতে বসে। এই যেখানে বসে আছ সেখানে বসে।”
আমি বললাম “ফ্যান্টাস্টিক।” আমি উঠতে যাচ্ছিলাম ম্যাডাম আবার আমাকে বসতে ইশারা করলেন। বসে পড়লাম। “ তোমার এখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে কত পড়ছে?” বললাম “৭৫০০ এরও বেশী।” ম্যাডাম বললেন “ তুমি ৪৫০০ অব্দি উঠবে বলেছিলে, তাই না?” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। ম্যাডাম বললেন “ দেখো এখন তোমার তিনটে টিউশনিও আছে। এখন কি তুমি ৫০০০ অব্দি উঠতে পারবে? লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট, থাকা সব মিলিয়ে? ভেবে দেখে বল।”
এতে ভাবার কিছুই নেই। বললাম “হ্যাঁ, আমার তো লাভই হয়। তবে হাইজিনিক হতে হবে জায়গাটা।” ম্যাডাম বললেন “নেশা করো?” এই প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। কে জানে হাসপাতালের বাইরে কে কে আমাকে সিগারেট খেতে দেখেছে। আর কাল যে পার্টিতে গিয়ে মদ খেয়েছি সেটা কি আর ওনার অজানা। হাসপাতালে ঢুকতে না ঢুকতেই বোধহয় সেই খবর ওনার কানে পৌঁছে গেছে। আমি চুপ করে বসে রইলাম।
উনি বললেন “তুমি বলছ থাকা খাওয়ার টানাটানি অথচ পার্টি করে বেড়াচ্ছ বন্ধু দের সাথে?” এই প্রশ্নের উত্তর আমার ঠোঁটের ডগায় ছিল। বললাম “ ম্যাম, একজন পার্টি দেবে বলেছিল তাই গেছিলাম। বলেছিল যে আমাকে ধর্মশালা অব্দি ড্রপ করে দেবে। নইলে কি যেতাম? তবে হ্যাঁ, মিথ্যে বলব না সিগারেট খাই। পয়সা জমিয়ে কিনতে হয়।” উনি বললেন “ অত ডিটেলে বলতে হবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলেদের কি কি গুন বদগুণ থাকে সব আমার জানা। সিগারেট খেলে ঘরের জানলা খুলে খাবে। আর মদ খেয়ে এসে মাতলামি করা আমি টলারেট করব না একেবারে।” আমি একটা ঢোক গিলে বললাম “ আমি সিগারেট খাই বটে, কিন্তু আপনার বাড়িতে পড়ানোর সময় আমি সিগারেট খাব না। আর মদ…” কি যে বলব বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক। ম্যাডাম বললেন “ এসো। “ উনি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে শুরু করলেন, পেছনে আমি, নাহ ম্যাডামের পাছার আকারটা মন্দ নয়। একবার খামচে ধরতে পারলে…
লিফটের সামনে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারলাম যে ওপরে কিছু একটা হয়েছে। দৌড়া দৌড়ী শুরু হয়ে গেছে। লিফটে ওঠা আর আমার হল না। সিঁড়ি ভেঙ্গে চার তলায় উঠে যা দেখলাম তাতে এক নিমেষে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। রঞ্জন বাবু যেই বেঞ্চে বসে ছিলেন সেখানেই লুটিয়ে পরে ছেন। ওনার মুখ দিয়ে গ্যাঁজা বেরোচ্ছে। মুখ পুরো নীল হয়ে গেছে। একজন ডাক্তার এসে ঝুঁকে পরে ওনাকে পরীক্ষা করছেন। এক কথায় উনি মারা গেছেন। ডাক্তারের সন্দেহ বিষক্রিয়া। মনে মনে বলতে বাধ্য হলাম হোয়াট দা হেল। এইবার বেলা মুখার্জি কে দেখে মনে হল যে ফাইনালি উনি বিচলিত হয়েছেন স্বামীর এই আকস্মিক মৃত্যুতে। ওনার চোখে জল। এবং এইবার দেখে মনে হল যে সেটা মেকি কান্না নয়। দোলনের কথা আর বলার নয়। ইতি মধ্যে সবাই জেনে গেছে যে দোলন সন্দেহ করে দীপককে। আরেকটা কথা আমি জানতে পারলাম, সেটা হল এই যে, দীপক আগে যদিও রঞ্জন বাবুর জন্য কাজ করত, কিন্তু ইদানিং নাকি ওর বেপরোয়া ভাবের জন্য রঞ্জন বাবুর সাথে ওর কিছু ঝামেলা হয়েছে। রঞ্জন বাবুর বডিটা কোনও মতে ভিড় ঠেলে পোস্ট মর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হল। যেই গ্লাস থেকে উনি জল খেয়েছেন সেটাও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। গ্লাসে এখনও কয়েক ফোঁটা জল অবশিষ্ট। সেটা নাকি পরীক্ষা করে দেখা হবে। স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস।
একজন পুলিশ আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল “তুমি সংকেত?” বললাম “হ্যাঁ।” বলল “একটু আমাদের সাথে এসো।” আমাকে দীপকের ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম দোলন যে দীপক কে সন্দেহ করে সেটা জানার পরই দীপকের চামচাগুলো একে একে সরে পরে ছে। এখনও যদিও দুই একজন অবশিষ্ট আছে। আরেকটা ব্যাপার না বলে পারছি না, দীপকের বাড়ির কোনও লোককে দেখতে পেলাম না। ওরা কি জানে না যে দীপকের এই দুর্ঘটনার কথা? দোলন রাকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে। আমাকে পুলিশ জিজ্ঞেস করল “দীপকের সামনেই তুমি খুলে বলবে যে কেন তোমাদের সন্দেহ দীপক এটা করতে পারে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা?” আমি একটা লম্বা দম নিয়ে গতকাল যা হয়েছে আবার বলে চললাম পুলিশের সামনে। মাঝে দোলন বলল “ বাবার সাথে অনেক দিন ধরেই দীপকের অনেক ঝামেলা চলছে। বাড়িতে এসে শাসিয়েও গেছে কয়েক দিন আগে। এই শুয়োরটাই গতকাল আমার দাদাকে মেরেছে, আর আজ ওরই কোনও লোক যে বাইরে ঘুর ঘুর করছিল, সুযোগ বুঝে বাবাকে বিষ…” আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল ও।
দীপক কোনও মতে উঠে বসেছে। ওকে দেখে মনে হবে যেন ও কিছুই বুঝতে পারছে না। আমার বয়ান শেষ হলে আমাকে যেতে বলা হল। আমি বেরিয়ে ই আসছিলাম। কিন্তু কি মনে হতে আমি একবার থেমে গেলাম। ওই পুলিশের সামনেই এগিয়ে গেলাম দীপকের দিকে। পাশে শিখা দাঁড়িয়ে আছে। দীপকের চোখে চোখ রেখে বললাম “দীপকদা তুমি যদি সত্যিই এই দুটো মৃত্যুর পেছনে থাকো তো আমার সাজেশন নাও। সত্যি কথা স্বীকার করে নাও। একজন মিনিস্টারকে মেরে তুমি বা তোমার লোক পার পাবে না। তুমি ওনাকে শাসিয়ে এসেছ? এটা পুলিশের চোখে একটা ভাইটাল এভিডেন্স। ভুলে যেও না রঞ্জন বাবু ভোটে জিতে মিনিস্টার হয়েছেন। ওনার অনেক লোক আছে, যারা বাইরে তোমাকে পেলেই... কথাটা ভালো ভাবে মনের ভেতর গেঁথে নাও।” একটু থেমে বললাম “আমি তোমার জায়গায় থাকলে সুই সাইড করে নিতাম। এই অবস্থায় বেঁচে থাকলে আরও অনেক ভুগতে হবে। তুমি বিছানায় পরে থাকা অবস্থায় বাইরে তোমার কোনও লোক সুযোগ বুঝে রঞ্জন বাবুকে বিষ দিতে পারবে না সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এখানে তোমার বিছানায় পরে থাকার অ্যাঁলিবাইটাই তোমার এগেনস্টে যাবে ইনভেস্টিগেশন হলে।” আমি বেরিয়ে গেলাম ঝড়ের মতন। লক্ষ্য করলাম দীপকদা শিখাদির দিকে করুণ মুখে চেয়ে আছে। আর বাকিরা সবাই দীপকদার দিকে তাকিয়ে আছে…
এক সাথে অনেক ঘটনা ঘটে গেলে মাথাটা কেমন যেন ভো ভো করে। আজ সেই রকম অবস্থা। ভোর রাতে এত গুলো ছেলে মেয়ের মৃত্যু। তারপর রঞ্জন বাবুর আকস্মিক মৃত্যু, যেটা শিওরলি খুন। আর হোটেলে ঢুকতে ঢুকতে আরেকটা খবর পেলাম। এইবার এস এম এস নয়। কল। রাকা। দীপকের ঘরের বাইরে পুলিশ বসিয়ে সবাই বেরিয়ে এসেছিল। হঠাত উপরে একটা দুম করে শব্দ পেয়ে সবাই ছুটে ওপরে গিয়ে দেখে যে দীপক একটা চালু বাজারে পিস্তল দিয়ে সুই সাইড করে নিয়েছে। ঘটনাটা যখন ঘটে তখন ঘরে দীপক একা ছিল। সবার ধারণা শিখাদির সাথে কোনও পিস্তল ছিল না। আর তাছাড়া শিখাদি বেশ কিছুক্ষণ আগেই পুলিশের সামনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আরেকজন ছেলে দীপকদার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সেই ছেলেটাকে পুলিশ আটক করেছে। আপাতত অনুমান করা হচ্ছে যে দীপক ওই ছেলেটার কাছ থেকে পিস্তলটা ধার করেছে, আর ঘর খালি হলে সেই পিস্তল দিয়েই সুই সাইড করেছে। ওই ছেলেটা যে একটা মার্কা মারা গুন্ডা সেটা সবাই জানে। রাজনৈতিক কারনে এতদিন ছেলেটার গায়ে হাত দেওয়া যায় নি। কিন্তু আজ যখন মিনিস্টার নিজেই ভিক্টিম, তখন আর রাজনৈতিক গুণ্ডার জীবনের কি দাম!
খবরটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকে বেরিয়ে গেল। মনটা কেমন যেন বিষাদে ভরে গেছে এতগুলো মৃত্যুতে। ঘরে ঢুকেই কানে হেড ফোন গুঁজে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জামা কাপড় খোলার কথাও মাথায় এলো না। আজ এই সময় আমার মালিনীর ঘরে গিয়ে ওর বরের সামনে ওকে ভোগ করার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে মাথায় শুধু ঘুরছে মৃত্যু, দোলন, দীপক ...এইসব। এখন মালিনীর সাথে এই সব করার কোনও মানে দাঁড়ায় না। কে জানে কখন আবার থানায় ছুটতে হয়। আমি মালিনী কে একটা এস এম এস করে জানিয়ে দিলাম যে ক্লাসের একজনের হঠাত মৃত্যু হওয়ায় সব গোলমাল হয়ে গেছে। এখন তোমার সাথে দেখা করা হবে না। একটু একা থেকে ভাবতে হবে অনেক কিছু। মালিনীর উত্তর এলো মিনিট দুয়েকের মধ্যে। “ কিছু চিন্তা করো না সোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে হোটেলে শান্তনু আর রঞ্জন বাবুর খবর পৌঁছে গেছে। রেস্ট নাও। আর মনে করে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দাও।”
আর লাঞ্চ! একটা রেডিও ষ্টেশনে টিউন ইন করে আবার শুয়ে পড়লাম। দেখলাম কয়েকটা মেইলও এসেছে। সেগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। মামুলি মেইল যত সব। স্প্যাম। অবশ্য একটা মেল খুব কাজের। লোকাল দালালের কাছ থেকে এসেছে। বাড়ির খবর আছে। ও হ্যাঁ সঞ্চিতা ম্যাডামের সাথে দেখা করার কথা বিকালে। ওনাকে ওই হাসপাতালে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু কথা বলার সুযোগ পাইনি। ম্যাডাম কে কি ফোন করে জানিয়ে দেব যে আজকের বদলে আগামীকাল ওনার সাথে দেখা করলে কেমন হয়? আমাদের সবার ওপর দিয়েই আজ অনেক ঝড় ঝাঁপটা চলে গেছে। আজ আর বাড়ির খোঁজে যেতে মন চাইছে না। আরেকটা জিনিস পথে আসতে আসতে জানতে পেরেছিলাম। এটাও জেনেছি একটা এস এম এস থেকে। কলেজের ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে এসেছে এই এস এম এসটা। সারমর্ম হল ঃ সুনীল আর বিশালের মৃত্যুর শোকে আগামীকাল কলেজ বন্ধ। কখন যে চোখ বুজে গিয়েছিল সেটা সঠিক ভাবে বলতে পারব না। ঘুম ভাঙল মোবাইলের রিঙে। এটা রাকা। ঘড়ি বলছে এখন বাজে বিকেল সোয়া দুটো। কল রিসিভ করতেই রাকা এক ধার থেকে অসংলগ্ন ভাবে অনেক কথা বলে যেতে শুরু করল। ওকে আমি থামিয়ে বললাম “দাঁড়া দাঁড়া, এই ভাবে বললে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। একটু থেমে থেমে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট বল যে আবার কি হয়েছে বা কি জানা গেছে?” ও কয়েক সেকন্ডের জন্য একটু চুপ করে রইল। বুঝলাম মনের ভেতরের চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিচ্ছে।
তারপর শুরু করলঃ “ এখন অব্দি পুলিশের কাছ থেকে যা জানা গেছে তা হল এই মতন ঃ
১। দোলন এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে।
২। রঞ্জনবাবু যে বিষের প্রয়োগেই মারা গেছেন সেই বিষয়ে পুলিশ মোটামুটি নিঃসন্দেহ। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে। তাহলে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে।
৩। দীপকের ঘরে কোনও ক্যামেরা লাগানো ছিল না। তাই সেই ছেলেটাই দীপককে ওই পিস্তলটা দিয়েছিল কি না সেই বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না। তবে সন্দেহ ওই ছেলেটার ওপরেই। ছেলেটা যদিও দীপক কে পিস্তল দেওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাবে অস্বীকার করছে। পিস্তলটা পুলিশ ল্যাবে পাঠিয়েছে।
৪। পিস্তল, জলের গ্লাস, জল সব কিছু ল্যাবে পাঠানো হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য।
৫। যে গাড়িতে দুর্ঘটনা হয়েছে সেই গাড়িটাও পাঠানো হয়েছে পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
৬। হাসপাতাল থেকে যত গুলো সি সি টিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
৭। কোলাঘাটের কাছেই একটা চেক পয়েন্ট থেকে সিসিটিভি ফুটেজ আনিয়েছে এখানকার পুলিশ।
৮। যেহেতু একজন ভি আই পি মারা গেছেন তাই সব পরীক্ষা নিরীক্ষা যুদ্ধকালীন তৎপরতার সাথে করা হচ্ছে। আশা করা যায় যে বিকালের পর থেকে একে একে সব রিপোর্ট আসতে শুরু করে দেবে।
৯। বডি পুলিশের হাত থেকে ছাড়া হলে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে অনেক লোক ভিড় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। রাজ্যের মিনিস্টার বলে কথা।
কথা আর এগোল না। কল কেটে আবার শুয়ে পড়লাম। তিনটে বাজতে না বাজতেই আবার কল এলো। এবারও রাকা। “শোন তোকে এক্ষুনি একবার থানায় আসতে হবে?” আমি ঢোক গিলে বললাম “কেন? আমি আবার কি করেছি?” রাকা বলল “সেটা ফোনে বলতে পারছি না। তুই কিছু করিসনি কিন্তু পুলিশ একবার তোর সাথে কথা বলতে চাইছে। ভয় পাস না। একবার তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
পাঁচ মিনিটের ভেতর বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি ধরে থানায় পৌঁছাতে লাগল ঠিক কুড়ি মিনিট। ভেতরে ঢুকে দেখলাম দোলন আর বেলা মুখার্জিও সেখানে উপস্থিত। দোলন যেন আমাকে দেখেও দেখল না। সকালের সেই পুলিশ অফিসারও আছেন। আমাকে বসতে বলা হল। বসলাম। সেই অফিসার প্রায় কোনও ভনিতা না করেই শুরু করলেন। “ হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ আমরা চেক করেছি। রঞ্জন বাবুর জন্য যিনি জল আনতে গেছিলেন তিনি অনেক দিন ধরে হাসপাতালে কাজ করছেন। যেখানে উনি গ্লাসে জল ঢেলেছিলেন সেখান থেকে ওপরে আসা অব্দি প্রায় পুরো সময়টা বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখতে পেলাম যে উপরে আসার পর একজনের সাথে উনি ধাক্কা খান, লিফটের ঠিক বাইরে। সে কে?” আমি চিন্তা না করেই উত্তর দিলাম “আমার সাথেই উনি ধাক্কা খেয়েছিলেন।” অফিসার বলে চললেন “ তুমি ক্ষণিকের জন্য হলেও জলের ট্রেতা ওনার হাত থেকে নিয়ে নিয়েছিলে। রাইট?” মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম হ্যাঁ। “সেই সময় তুমি সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিলে। জলের ট্রেটা দেখা যাচ্ছিল না। তোমার হাত থেকে ট্রেটা ফেরত নিয়েই উনি দৌড় মারলেন রঞ্জনবাবুর দিকে। রঞ্জনবাবু ওনার কাছ থেকে জল নিয়ে জল খেলেন। তার কিছুক্ষনেইর মধ্যেই ওনার মৃত্যু। “
ঘরের সবাই চুপ। আমার চোয়াল ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠেছে। বলতে কি চায় লোকটা? অফিসার বললেন “সেই কয়েক সেকন্ডের জন্যই সিসিটিভিতে গ্লাসটা আমরা দেখতে পাইনি, যখন জিনিসটা ছিল তোমার হাতে। আর তুমি এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ একজন অচেনা লোক। তুমি এমন একজন যার ব্যাক গ্রাউন্ডের ব্যাপারে আমরা এখনও কিছুই জানি না। এইবার তোমাকে খোলা খুলি একটা প্রশ্ন করছি, আশা করছি তুমি ঠিক ঠিক জবাব দেবে। অবশ্য তুমি চাইলে আইনি পরামর্শ নিতে পার এবং এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পার। কিন্তু তবুও প্রশ্নটা আমি করছি ফর আওয়ার রেকর্ড, উত্তর দেওয়া না দেওয়া তোমার ব্যাপার।” আমি বললাম “প্রশ্ন করুণ। এই আইন আমার অজানা নয়।” পুলিশের ঠোঁটের কোনায় একটা হাসির ঝিলিক খেলে গেল।
১৬
“তুমি কি রঞ্জনবাবুর গ্লাসে বিষ দিয়েছিলে?” আমি হেসে বললাম “এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।” অফিসার আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “আবারও জিজ্ঞেস করছি গ্লাসে কি তুমি বিষ মিশিয়েছিলে?” আমি আবার একই জবাব দিলাম। উনি একটা হুম্ম মতন শব্দ করে বললেন “সবার সামনে আপনার এই স্টেটমেন্ট রেকর্ড করা হল। আপনার আইনি অধিকার আছে আমাদের কোনও প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ার। আপনি যখন আপনার উকিলের সাথে কথা না বলে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না, তখন আপনাকে আমি অনুরোধ করব, এক্ষুনি আপনার উকিলকে কল করে এখানে আসতে বলুন। উনি যতক্ষণ না এখানে আসছেন ততক্ষণ আপনাকে এখানে বসে থাকতে হবে।”
আমি মোবাইলে বের করার কোনও তাগিদ অনুভব করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম “স্যার একটু জল পাওয়া যাবে? খাব।” একজন এসে আমার হাতে একটা জলের গ্লাস ধরিয়ে দিল। ইসস কি তেতো জল। লোকে খায় কি করে! দোলনের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কেঁদে কেঁদে মুখ ফুলে গেছে। দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। রাকার চোখে এক রাশ বিস্ময়। বেলা মুখার্জির মুখের মেক আপ উঠে গেছে। মহিলা সুন্দরী তাতে সন্দেহ নেই। মুখের চামড়ায় এক ফোঁটা ভাঁজ পরে নি কোথাও।
আমি অফিসারকে বললাম “একটা কাগজ আর পেন পাওয়া যাবে?” ভদ্রলোক একটা প্যাডের কাগজ এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ওনার সামনে টেবিলের ওপর অনেকগুলো পেন সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। হাত দিয়ে সেই দিকে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। আমি চেয়ার থেকে উঠে ওরই মধ্যে থেকে একটা পেন উঠিয়ে নিলাম। অফিসারের ঠোঁটের কোনায় হাসি । উনি কি ভাবছেন যে আমি বসে বসে আমার জবানবন্দি লিপিব্দধ করছি? পাগল না ছাগল। অফিসার বললেন “যা লেখার ডিটেইলে লিখবে।” আমি একটু হেসে আবার কাগজের দিকে মননিবেশ করলাম। প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেছে, এখনও আমি খসখস করেই চলেছি কাগজের ওপর। অফিসার আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। উঠে পড়লেন টেবিলের ওপাশ থেকে। আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়লেন কাগজের ওপর।
“হোয়াট? তুমি বসে বসে মিসেস বেলা মুখার্জির ছবি আঁকছ?” বললাম “আর পাঁচ মিনিট। হয়ে এসেছে প্রায়।” ভদ্রলোক কি বলবেন ভেবে পেলেন না। আড়চোখে গোটা ঘরের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারলাম যে সবাই আমার দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে আছে। উনি আবার ফিরে গেলেন নিজের সিটে। এবার ওনার গলার স্বরে এক রাশ বিরক্তি। “আপনি আপনার উকিলকে ফোন করুণ। এখানে সবার সময়ের অনেক দাম আছে। আগে আপনার উকিল আসুক, তারপর আপনার ব্যাপারে একটা হিল্লে হোক, তারপর আপনি জেলে বসে বসে যত খুশি যার খুশি ছবি আঁকতে পারবেন।” আমার ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। পেনটা উঠে আবার যথাস্থানে রেখে দিলাম। কাগজটা দোলনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম “এটা তোমার মায়ের জন্য।” কয়েক সেকন্ড সব চুপ।
তারপর ধীরে ধীরে ও আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিল। কাগজটা কয়েক মুহূর্তের ভেতর চলে গেল মিসেস মুখার্জির হাতে। এইবার আমি অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললাম “ আমি বলেছি আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। একবারও বলিনি যে উকিলি পরামর্শ না নিয়ে জবাব দেব না। বলেছি একেবারেই দেব না।” অফিসার যেন আমার দিকে তেড়ে আসতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই আমি ধীর গলায় বললাম “ জবাব দেব না কারণ জবাব দেওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না। বাই দা ওয়ে, আপনাদের সব রিপোর্ট এসে গেছে?” উনি বললেন “ না। কিছুক্ষনের মধ্যেই চলে আসবে বলে এক্সপেক্ট করছি।” আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম “তাহলে আর কি? অপেক্ষা করুণ। রিপোর্ট আসার পরও যদি আপনার বা আপনাদের আমার ওপর কোনও সন্দেহ থাকে তবে আমি নিশ্চয় জবাব দেব। তবে আবারও বলছি, জবাব দিচ্ছি না কারণ জবাব দেওয়ার কোনও প্রয়োজন হবে না।”
আমি উঠে পড়লাম। “কাইন্ডলি কাউকে আমার সাথে বাইরে আসতে বলবেন? সিগারেট খাব। আপনারা হয়ত ভাববেন যে এই সুযোগে আমি পালিয়ে যাব। তাই কাউকে সঙ্গে দিলে খুব ভালো হয়।” উনি বললেন “ক্যাম্পাসের বাইরে যাবে না। আর পালিয়ে যাবেই বা কোথায়?” আমি বেরিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। কিন্তু এই থানার ক্যাম্পাসের ভেতর কোনও খাওয়ার দোকান নেই। ভেতরে ঢুকে দেখলাম অফিসার ফোনে কথা বলছেন। আর খস খস করে কিসব লিখে চলেছেন। প্রায় পাঁচ মিনিট কথা বলার পর ফোন রেখে বললেন “সংকেত, (আপনি থেকে তুমি তে নেমে গেছেন এই পাঁচ মিনিটে) তোমাকে এতক্ষন বসিয়ে রাখার জন্য আমি দুঃখিত। রিপোর্ট এসে গেছে।”
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন “
১। গ্লাসের জলে কোনও রকম বিষ পাওয়া যায় নি। পিওর এইচ টু ও। গ্লাসের জল খেয়ে ওনার মৃত্যু হয়নি সেই ব্যাপারে আমাদের ফরেনসিক বিভাগ নিঃসন্দেহ।
২। গ্লাসের গায়ে শুধু ওই হাসপাতালের কর্মচারী আর রঞ্জনবাবুর হাতের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। জলের ট্রে তে অবশ্য আরেকজন অজানা তৃতীয় ব্যক্তির আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। (বলাই বাহুল্য আমার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে)
৩। পিস্তলে দীপক ছাড়া আর কারোর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় নি।
৪। পিস্তলটা বাজারে পিস্তল। চোরাবাজারিদের কাছ থেকে কেনা। কারও নামে রেজিস্টার্ড নয়।
৫। গাড়ির যে স্ক্রুগুলো লুস করে রাখা হয়েছিল তাতে আর গাড়ির চাকায় দীপকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। এমনকি গাড়ির ভেতরের কিছু পার্টসেও অপ্রত্যাশিত ভাবে দীপকের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে।
৬। কোলাঘাটের কাছ থেকে যে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে সেইগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে। শান্তনুদের গাড়ি ওই চেক পোস্ট ক্রস করার ত্রিশ মিনিট আগে থেকে ত্রিশ মিনিট পর অব্দি গুনে গুনে ঠিক ছটা গাড়ি চেকপোস্ট ক্রস করেছে। প্রত্যেকটা গাড়ির নাম্বার নোট করে নেওয়া হয়েছে। পাঁচটা গাড়ির মালিকের সাথে ইতি মধ্যে কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু একটা কালো রঙের স্যান্ট্রোর মালিকের সাথে এখনও কন্ট্যাক্ট করা যায়নি। কারণ গাড়ির নাম্বারটা জালি। (দীপক বলেছিল দুর্ঘটনার পর একটা কালো রঙের গাড়ি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল।)
৭। আকস্মিক জোরে ব্রেক দেওয়ার ফলে চাকা স্থানচ্যুত হয়ে যায়, যার ফলে এই দুর্ঘটনা হয়।
আপাতত এই অব্দি জানা গেছে। বডি পরীক্ষাও হয়ে গেছে। রিপোর্ট এই এলো বলে। “
উনি থামলেন। রাদার থামতে বাধ্য হলেন, কারণ তখনই একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে পরে ছেন। অফিসারের কানে গিয়ে কি সব ফিসফিস করে বলে ওনার হাতে একটা কাগজের খাম ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অফিসার খাম খুলে এক তাড়া কাগজ বের করে মন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই কাগজের লেখা গুলো পড়লেন। পাতা উলটিয়ে উলটিয়ে পড়লেন। ওনার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম যে উনি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। কাগজের তাড়াটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে উপরে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে প্রায় মিনিট খানেক চুপ করে বসে কি যেন ভাবলেন। তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে পরে বললেন “ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে।”
আবার চুপ করে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। বুঝতে পারছি উনি কোনও একটা ব্যাপার ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, বা ভাবনার তল পাচ্ছেন না। আবার শুরু করলেন। “ বিষের জন্যই ওনার মৃত্যু হয়েছে। একটা বিশেস ধরণের বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। কোলকাতায় সচরাচর এই বিষ পাওয়া যায় না। বিষের ক্রিয়া হতে সময় লাগে ঠিক কুড়ি মিনিট। মিস্টার মুখার্জির বডিতে অ্যালকোহল থাকায় বিষের ক্রিয়া কিছু আগেই শুরু হয়ে যায়। সেপসিস হয়ে গেছিল। আর, হার্ট বন্ধ হয়ে গেছিল। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা গেছেন মিস্টার মুখার্জি। সব থেকে আশ্চর্য হল কিভাবে বিষটা ওনার শরীরে ঢোকানো হয়েছে। “ একটু থেমে আবার উনি বলতে শুরু করলেন “মিস্টার মুখার্জির কোমরের ঠিক নিচে একটা মাইক্রো নিডল, কেউ ওনার শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেই নিডলের গায়েই মাখানো ছিল বিষ। আর তাতেই মৃত্যু। নিডলটা ওনার শরীরের একদম গভীরে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু... প্রশ্ন হল মিস্টার মুখার্জি যেখানে বসেছিলেন সেখানটা পুরোটা দেখা যাচ্ছে সিসিটিভি ফুটেজে। ওনার বডি গার্ড ছাড়া আর কেউ সেই সময় ওনাকে ছোঁয়নি। তাহলে কিভাবে সেই মাইক্র নিডলটা ওনার শরীরের ভেতরে প্রবেশ করল?”
আমরা সবাই চুপ করে বসে আছি। উনি যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন “ বাকি দের পোস্টমর্টেম রিপোর্টও এসে গেছে। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই সেগুলোতে। আপনারা এখন যেতে পারেন। বডি রিলিস করে দেওয়া হয়েছে। ওনার বডি ওনার বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শান্তনু মুখার্জির বডিও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
আমরা উঠে পড়লাম। অফিসার থানার বাইরে অব্দি এলেন বেলা মুখার্জিকে ছেড়ে দিতে। দোলন আর বেলা মুখার্জি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আমার সাথে দোলনের আর চোখা চুখি হয়নি এর মধ্যে। সত্যি আশ্চর্য মৃত্যু। অগত্যা সামনের একটা দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা এগ রোল অর্ডার করলাম। দেখলাম থানার সেই অফিসার পায়ে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসেছেন। বললাম “স্যার সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আর চারপাশে যা চলছে। আপনি খাবেন?” উনি বললেন “শুধু চা।” আমিও ওনার সাথে এক কাপ চা নিলাম। কারোর মুখে কোনও কথা নেই। আমি নিরবতা ভেঙ্গে বললাম “স্যার ব্যাপারটা কিন্তু ধীরে ধীরে বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।” উনি হেসে বললেন “এতেই ঘাবড়ে গেছ? এর থেকে ঢের জটিল রহস্য আমাদের শলভ করতে হয়। চিন্তা করো না। এই রহস্যের সমাধানও হয়ে যাবে। তবে দীপক যে এই ব্যাপারের মধ্যে আছে সেটা মোটামুটি ক্লিয়ার। কিন্তু …” উনি চুপ করে গেলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করি যে ছেলেটাকে আটক করে রেখেছেন তার সাথে কি করবেন, কিন্তু অজথা কথা বলার সময় এটা নয়। সময় খুব দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে হাতের বাইরে
ট্যাক্সিতে উঠেই কল করলাম সঞ্চিতা ম্যাডাম কে। “এখন চলে আসব ম্যাডাম? একটু দেরী হয়ে গেছে বলে সরি।” উনি বললেন “চলে এসো। সমস্যা নেই।”
কলিং বেল বাজার একটু পরে ম্যাডাম এসে দরজা খুলে দিলেন। উনি কিছু বলার আগেই আমি বললাম “থানা থেকে আসছি। অনেক হুজ্জুতি গেছে।” ভেতরে ঢুকলাম। ম্যাডাম কে আজ আরও অন্য রকম লাগছে। একটা ঢিলে সালোয়ার আর হাতকাটা একটা কামিজ পরেছেন। ওড়না দিয়ে অবশ্য বুক আর হাতের ওপরের দিকের অনাবৃত অংশগুলো ঢাকা। সদর দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি তোলার সময় ওড়নাটা কাঁধের ওপর থেকে সরে যাওয়াতেই বুঝতে পারলাম যে উনি হাতকাটা কামিজ পরেছেন, নইলে এমনিতে বোঝার কোনও উপায় নেই। হাতের উপরের দিকটা যেন আরও বেশী ফরসা।
আমাকে বসতে বলে খাবার জল নিয়ে এলেন। এক ঢোকে জল খেয়ে থানায় কি কি হয়েছে সব কথা বললাম। গতকালের পার্টির ব্যাপারটাও গোপন করলাম না। ম্যাডাম পাখা ছেড়ে দিয়েছেন। ওনার চোখগুলো একটু ফোলা ফোলা, মনে হয় এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। উনি সোফায় বসে বললেন “সংকেত, তুমি বাইরের ছেলে। তোমাকে একটা সাজেশন দিচ্ছি। মানা না মানা তোমার ব্যাপার। তোমাদের বয়সে সবাই জীবন ভোগ করতে চায়। কিন্তু এই সব ছেলে মেয়েদের সাথে তোমার মতন ছেলের বেশী না মেশাই ভালো। এদের সাথে মিশে তোমার কোনও লাভ হবে না, বরং এইসব হাবি যাবি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে বারবার। “
আমি বললাম “সেটা ম্যাম হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ আজ অব্দি থানার পথ মাড়ায়নি। শেষ অব্দি কিনা আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।” ম্যাডাম শান্ত ভাবে হেসে বললেন “যাক সে সব কথা। তবে মনে হয় এখন আর তোমাকে কেউ জ্বালাবে না। যা হওয়ার আপাতত হয়ে গেছে। এইবার কাজের কথায় আসা যাক।” আমার কান খাড়া। “তুমি কি এখন অব্দি কোনও মেসের বন্দবস্ত করতে পেরেছ?” আমি বললাম “কখন আর সময় পেলাম ম্যাম। দুই দিন ধরে যা চলছে। কেন যে মরতে কাল ওদের দলে গিয়ে ভিড়েছিলাম…”
ম্যাডাম বললেন “ আমার এক মাসতুতো বোন আছে। আর তার দুজন বন্ধুও আছে। জয়েন্টে বসবে সামনের বছর। মাসে ৬০০ টাকা করে দিতে রাজি হয়েছে প্রত্যেকে। অঙ্ক পড়াতে হবে। সপ্তাহে দুই দিন টাইম দিতে হবে কারণ তিনজনেই অঙ্কে কাঁচা। মাসে ১৮০০ টাকা কিন্তু কম নয়। পারবে পড়াতে?” আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা হিসাবের বাইরে ছিল। ম্যাডাম বললেন “ এইবার তুমি আমায় বল যে সপ্তাহে দু-দিন পড়ানোর জন্য কত নিতে চাও?” আমি বললাম “না না, আপনার কথাই ফাইনাল। টিউশনি পেলে তো ভালোই হয়। তবে কোথায় পড়াতে হবে?” ম্যাডাম বললেন “শোনো সংকেত কোলকাতায় টিকতে হলে একটু দরদাম করা শেখ। এটা তোমাদের গ্রাম নয়। এখানে সবাই তোমাকে ঠকাতে চাইবে। “ একটু থেমে বললেন “ কথা হয়েছে ৭০০ টাকায় সপ্তাহে দুই দিন। আর পড়াবে এই বাড়িতে বসে। এই যেখানে বসে আছ সেখানে বসে।”
আমি বললাম “ফ্যান্টাস্টিক।” আমি উঠতে যাচ্ছিলাম ম্যাডাম আবার আমাকে বসতে ইশারা করলেন। বসে পড়লাম। “ তোমার এখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে কত পড়ছে?” বললাম “৭৫০০ এরও বেশী।” ম্যাডাম বললেন “ তুমি ৪৫০০ অব্দি উঠবে বলেছিলে, তাই না?” আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। ম্যাডাম বললেন “ দেখো এখন তোমার তিনটে টিউশনিও আছে। এখন কি তুমি ৫০০০ অব্দি উঠতে পারবে? লাঞ্চ, ডিনার, ব্রেকফাস্ট, থাকা সব মিলিয়ে? ভেবে দেখে বল।”
এতে ভাবার কিছুই নেই। বললাম “হ্যাঁ, আমার তো লাভই হয়। তবে হাইজিনিক হতে হবে জায়গাটা।” ম্যাডাম বললেন “নেশা করো?” এই প্রশ্নের কোনও উত্তর হয় না। কে জানে হাসপাতালের বাইরে কে কে আমাকে সিগারেট খেতে দেখেছে। আর কাল যে পার্টিতে গিয়ে মদ খেয়েছি সেটা কি আর ওনার অজানা। হাসপাতালে ঢুকতে না ঢুকতেই বোধহয় সেই খবর ওনার কানে পৌঁছে গেছে। আমি চুপ করে বসে রইলাম।
উনি বললেন “তুমি বলছ থাকা খাওয়ার টানাটানি অথচ পার্টি করে বেড়াচ্ছ বন্ধু দের সাথে?” এই প্রশ্নের উত্তর আমার ঠোঁটের ডগায় ছিল। বললাম “ ম্যাম, একজন পার্টি দেবে বলেছিল তাই গেছিলাম। বলেছিল যে আমাকে ধর্মশালা অব্দি ড্রপ করে দেবে। নইলে কি যেতাম? তবে হ্যাঁ, মিথ্যে বলব না সিগারেট খাই। পয়সা জমিয়ে কিনতে হয়।” উনি বললেন “ অত ডিটেলে বলতে হবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলেদের কি কি গুন বদগুণ থাকে সব আমার জানা। সিগারেট খেলে ঘরের জানলা খুলে খাবে। আর মদ খেয়ে এসে মাতলামি করা আমি টলারেট করব না একেবারে।” আমি একটা ঢোক গিলে বললাম “ আমি সিগারেট খাই বটে, কিন্তু আপনার বাড়িতে পড়ানোর সময় আমি সিগারেট খাব না। আর মদ…” কি যে বলব বুঝে উঠতে পারছি না ঠিক। ম্যাডাম বললেন “ এসো। “ উনি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে শুরু করলেন, পেছনে আমি, নাহ ম্যাডামের পাছার আকারটা মন্দ নয়। একবার খামচে ধরতে পারলে…