05-03-2019, 03:01 PM
আমি বেরিয়ে পড়লাম। আজ গাড়ি বলা ছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে ওই সেকন্ড বডি গার্ডের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললাম “ইট মারার সাহস দেখালে, পাটকেল খেয়ে সেটা হজম করারও সাহস থাকা দরকার।” ভদ্রলোক একবার আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল “সেটা সবারই মনে রাখা দরকার।” আমি মনে মনে হাসলাম। এই নাটকটাকে কি লোকটা পাটকেল ভেবে নিয়েছে? এই বুদ্ধি নিয়ে ...।
গাড়িতে উঠতে না উঠতেই দোলনের ফোন। “কি রে সুস্থ আছিস?” বললাম “আমার আবার কি হল? ও হ্যাঁ। পিঠে একটু ব্যথা আছে। ব্যস। এর থেকে বেশী কিছু নয়। “ বলল “আচ্ছা তাহলে আজ কি আমাদের সাথে আসছিস?” জিজ্ঞেস করলাম “আমাদের সাথে মানে?” ও খিল খিল করে হেঁসে বলল “বললাম না কাল? পার্টি! আর আমাদের সাথে আসবি না তো কি আমার একার সাথে আসবি? লাইন মারার চেষ্টা ছেড়ে দে। শোন মোটামুটি সবাই তোর চেনা। শুধু দুই তিনজন অচেনা পাবি। আলাপ হয়ে যাবে। ফুর্তি হবে ভালো।” বললাম “কোথায় হচ্ছে এই পার্টি?” বলল “শুরুতে প্ল্যান ছিল বাড়িতে। কিন্তু সেটা আর হবে না। মম আর ড্যাড ও বাড়িতে আজ পার্টি থ্রো করেছে। তাই আমরা একটা ডিস্কে যাব। নাচ গান হবে। ও হ্যাঁ, তুই দারু খাস তো?” বললাম “আমি পিপে। কিন্তু আজ যেতে পারব কি না সেটা এখনই বলতে পারছি না। ও হ্যাঁ, কটায় শুরু হবে এই ব্যাপারটা।” ও পাশে কারোর সাথে কথা বলে বলল “ সন্ধ্যে সাড়ে আটটার মধ্যে নাইট ব্লুর সামনে চলে আয়। ফুর্তি হবে।” মনে মনে বললাম হুম্মম। ফোন কেটে গেল।
সাড়ে আঁটটায় নাইত ব্লুতে পৌঁছাতে পারব কি না সেটা সত্যি এখনও জানি না। যেখানে যাব সেখানে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগবে। সুতরাং কানে হেড সেটটা লাগিয়ে নিয়ে ভালো মোবাইলটাতে গুঁজে দিলাম। কোথাও ভালো গান বাজছে কি? না সব স্টেশন কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে রয়েছে। একের পর এক স্টেশন সার্ফ করেই চললাম বারবার এই আশায় যদি কোথাও আমার মনের মতন একটাও গান পাওয়া যায়। কিন্তু না। প্রায় চল্লিশ মিনিট এই স্টেশন ওই স্টেশন করে কাটিয়ে দেওয়ার পর অবশেষে একটা মোটামুটি মনের মতন গান পেলাম। এদিকে আমিও গন্তব্য স্থলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এমন রহস্য করে বলার অবশ্য কোনও মানে হয় না। বাবার হয়ে টাকা কালেক্ট করে একজনের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। ভদ্রলোকের বাড়ি থেকেই গিয়ে টাকা ওঠাতে হবে।
দুপুর দুটো বেজে দশ মিনিট। সকালের সব কাজ মিটে গেছে, তবে খুব ভালো ভাবে মিটেছে সেটা স্বীকার করতে পারিনা। আজ ঠিক করেই রেখেছিলাম যে কোনও একটা বড় বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের লাঞ্চটা সারব। হোটেলের কিছুটা দূরে একটা বড় বাঙালি রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম। শীততাপনিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্ট। মেনু দেখে বুঝলাম দামটা বেশ চড়ার দিকে এখানে। তাই হয়ত ভিড়টা একদম কম। তবে মনে হয় খাবার কোয়ালিটি খারাপ হবে না। হোটেলে বাঙালি খাবার অর্ডার করে তেমন একটা তৃপ্তি পাইনি, ওখানে কাবাব, রুটি মাংস, ফ্রাই ইত্যাদি খুব ভালো পাওয়া যায়, কিন্তু বাঙালি খাবার একদম বাজে। তাই আজকের এই প্ল্যান। ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, পুড় দিয়ে পটল ভাজা, ইলিশ ভাপে আর সব শেষে মাটন ডাক বাংলো- এই হল আজকের মেনু।
অর্ডার দিতে না দিতেই আমার ঠিক পাশের টেবিলে এসে বসল একটা অল্প বয়সী কাপল। ওরা আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওদের যেটুকু কথা বার্তা আমার কানে ঢুকেছে তা থেকেই বুঝতে পেরেছি যে ওদের মধ্যে চাপা ঝগড়া হচ্ছে। বিবাহিত কাপল বলে মনে হল না। আমার ধারণা ডেটিঙে এসেছে। তবে এখন আমার মাথায় আরও অনেক চিন্তা ঘুরছে তাই ওদের দিকে আর বেশী খেয়াল করা হল না। আজকের সব কাজ মিটেছে বটে, কিন্তু ওই যে বললাম, খুব ভালো ভাবে মেটেনি। বাবাকে মুখ দেখাবো কি করে? এটা বড় আর দামি রেস্টুরেন্ট বটে, কিন্তু টেবিলগুলো বড্ড গায়ে গায়ে। পাশে বসা দুজনের প্রায় সব কথা আমার কানে আসছে।
বলাই বাহুল্য যে তাতে আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটছে, বড্ড বিরক্তি লাগছে। এই রেস্টুরেন্টে যারা খেতে আসবে তারা মোটামুটি অবস্থাপন্নদের দলে পড়ে। সুতরাং আর সংকোচ না করে সেই ভয়ানক মোবাইলটা বের করে চট করে তাতে হেড সেটটা লাগিয়ে দিয়ে সেটাকে আবার পকেটে চালান করে দিলাম। এফ এম টা অবশ্য অন করে দিয়েছি। এখন হেড সেট থেকেই স্টেশন চেঞ্জ করা যাবে। না বরাতটাই খারাপ আজ। সকালে হোটেলে যা হল তাতে মনে হয়েছিল যে দিনটা বেশ ভালো কাটবে। মানে ওই লোকগুলোকে নাকাল করতে পেরে ভেবেছিলাম সব প্ল্যান মাফিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। সেরকম হচ্ছে না । আর এখন? একটাও ভালো গান নেই রেডিওতে। মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না, ভালো গান না চালিয়ে শুধু অযথা আর অহেতুক বক বক করার জন্য রেডিও স্টেশন খুলে বসার কারণ কি?
যখন ইলিশ ভাপের ডিশটা শেষ করলাম, তখনই ঠিক করে ফেললাম যে আজ সন্ধ্যায় নাইট ব্লুতে গিয়ে হাজির হওয়া যাক। ডিস্ক কেমন হয় সেটা আমার অজানা নয়। তাই সেখানে যাওয়ার কোনও বাড়তি টান বা কৌতূহল আমি অনুভব করছি না। তবে সদ্য আলাপ হওয়া ছেলে মেয়েগুলোর আরেকটা রূপ ওখানে দেখতে পাব। আর তাছাড়া...যাই হোক। আজ সেজে গুঁজে ওদের দলে ভিড়ে যাব। হোটেলে ফিরে গিয়ে একটা ছোট ঘুম দিয়ে নিতে হবে।
অবশ্য হোটেলে ফেরার আগে দুটো বড় বড় মদের বোতল কিনতে হবে। মালিনীর বরের জন্য যে কিছু একটা কিনতে হবে সেটা আমার মাথা থেকে বেড়িয়ে যায়নি এত চিন্তার মধ্যেও। যদিও মালিনী গোটা ব্যাপারটায় ভয় পাচ্ছে তবে আমাকে একটা চেষ্টা করতেই হবে। মালিনীর বরকে মাতাল বানিয়ে তার সামনে মালিনীকে ভোগ করার দৃশ্যটা কল্পনা করেই গাটা কেমন গরম হয়ে উঠল। হাত চালিয়ে বাকি খাবারটা শেষ করে, দু বোতল মদ কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকেই একটা জরুরি কল সেরে নিলাম। ঘুম লাগানোর আগে হেড সেটটা কানে গুঁজে নিতে ভুললাম না অবশ্য। তবে এখন ঘুমের মধ্যে স্টেশন চেঞ্জ করা সম্ভব নয়, তাই সব থেকে ফেভারিট স্টেশনে টিউন করে চোখ বুজলাম।
চোখ প্রায় বুজে এসেছে এমন সময় হঠাত ঘুম ছুটে গেল। বাহ বেশ ভালো গান চালিয়েছে ফাইনালি। ঘড়িটা দেখে নিয়ে কান থেকে হেড সেটটা খুলে ফেললাম। মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে দিয়ে আরেকবার শুয়ে পড়লাম। ঠিক বিকেল পৌনে ছয়টার সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। নাইট ব্লুতে যাব নিশ্চই তবে এই রকম বেশ ভুষায় ওখানে যাওয়া যায় না। ওখানে যাওয়ার আগে আরেকবার ফিরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে। আপাতত একটা শস্তা মেসের সন্ধানে বেরোতে হবে। আজ সকাল বেলাতেই একজন দালালের সাথে মেস দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর যাওয়া হয়নি। কারণ অন্যান্য কাজগুলোতে এত ফেঁসে গেছিলাম যে ওই মেস দেখতে যাবার অ্যাঁপয়েন্টমেন্টটা ঘেঁটে গেল।
এইবার আর সেই বিশেষ গেস্ট বা তার কোনও সাঙ্গপাঙ্গকে দেখতে পাইনি। নো স্মোকিং বোর্ডটা আবার যথাস্থানে চলে এসেছে। এইবার আর লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাইনি। এখন বাওয়াল করার সময় নেই। হোটেল থেকে বেড়িয়ে সোজা চলে গেলাম কলেজের দিকে। কলেজ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা যেতে হবে। ওইখানেই সেই দালালের সাথে মিট করার কথা। একবার ফোন করে নিয়েছি লোকটাকে। লোকটার আসতে এখনও একটু সময় আছে।
আমি অনেক আগেই পৌঁছে গেছি ওখানে। সামনে একটা বাজার। সন্ধ্যে বেলায় বসে এই বাজারটা। বাজারে লোকের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। গিয়ে দাঁড়ালাম ঠিক বাজারের মুখে। বার বার ঘড়ি দেখতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ রাতে নাইট ব্লুতে যাবার ব্যাপারটা আমাকে এখন চুম্বকের মতন টানছে। সেক্সি দোলনের শরীরের দোলন দেখার আকর্ষণ সময়ের সাথে সাথে দুর্নিবার হয়ে উঠছে আমার ভেতরে। হঠাতই একটা পরিচিত গলার ডাক শুনলাম।
একি! সঞ্চিতা ম্যাডাম। দুই হাতে ভারী বাজারের থলি। বুঝলাম উইক এন্ডে, শনিবারের সন্ধ্যায় সারা সপ্তাহের বাজার করে ফিরছেন ম্যাডাম। আমাকে বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আওয়াজ দিয়েছেন। আমি দৌড়ে ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওনার হাত থেকে বাজারের থলি দুটো নিয়ে নিলাম। হুম দুটো থলিই বেশ ভারী। উনি অবশ্য কিছুতেই দিতে চাইছিলেন না, কিন্তু আমার জোরাজুরিতে অবশেষে আমার হাতে বাজারের থলি দুটো দিয়ে দিলেন। ওনার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে মুখটা একটু মুছে নিলেন।
সাদা রঙের ঢিলে কামিজটা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে একদম সেঁটে গেছে। গলার কাছটা ভিজে কালো হয়ে গেছে। বগলের কাছটাও ঘামে ভিজে কালচে হয়ে আছে। একটা হালকা পারফিউম আর ঘামে মেশানো গন্ধ আসছে ওনার গা থেকে। একটা ঢিলে মেরুন রঙের শালোয়ার পরেছেন নিচে। সালোয়ার কামিজে একটু অন্য রকম লাগছে ম্যাডামকে। ম্যাডাম রুমাল দিয়ে নিজের মুখ থেকে ঘাম মুছে নিয়ে বললেন “আমার বাড়ি একদম সামনে। এসো। একটু জিরিয়ে চা খেয়ে যাও। আর এই হেল্পের জন্য থ্যঙ্কস।” রাস্তার উল্টো ফুটে এসে মিনিট দুয়েক হাঁটতে না হাঁটতেই ওনার বাড়ি চলে এল। পথে আমাদের দুজনের মধ্যে প্রায় কোনও কথা হল না। পাশাপাশি নিরবে হেঁটে চললাম। ম্যাডাম মাঝে মাঝে এই বিচ্ছিরি হিউমিড ওয়েদারের নামে গালি দিচ্ছিলেন, অবশ্য ভীষণ ভদ্র ভাষায়, মানে ঠিক গালি বলতে যা বোঝায় তেমন নয়।
বাড়ির বাইরে একটা বড় গেট। সেটা খোলা। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে ওনাদের বাড়ি। উনি দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে আমাকে থলি দুটো নামিয়ে রাখতে বললেন এক পাশে। আমি তখনই বেড়িয়ে আসতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু উনি আমাকে জোড় করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ফ্রিজ থেকে একটা বোতল জল বের করে ঢক ঢক করে কিছুটা জল গলা দিয়ে ঢেলে নিলেন।ওনার বৈঠক খানাটা বেশ সাজানো। রুচির ছাপ স্পষ্ট সব কিছুর মধ্যে। এক দিকে একটা উঁচু বইয়ের র্যােক। তার পাশে বেশ কয়েকটা ছবি সারি বদ্ধ ভাবে দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে। কয়েকটা ওনার, কয়েকটা বোধহয় ওনার স্বামীর। আর কয়েকটাতে উনি আর ওনার স্বামী এক সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি কাঁচের গ্লাসে খানিকটা ঠাণ্ডা জল ঢেলে নিয়ে এলেন আমার কাছে। গ্লাসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। বাড়িটা দ্বিতল। রান্না ঘরটা এক তলার পূর্ব দিকে। এক তলার এক ধারে একটা সিঁড়ির সারি ওপরে উঠে গেছে। ওপরে নিশ্চই ওনাদের বেডরুম। যাকগে। রান্নাঘরের আলো জ্বলে উঠল। চা বানানো হচ্ছে।
আমি চুপ চাপ বসে থাকতে পারি না। গ্লাসের জলটা গলা দিয়ে ঢেলে দিয়ে সেটা উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বইয়ের র্যা কের দিকে এগিয়ে গেলাম। না এইগুলো ইঞ্জিনিয়ারিঙের বই না। অধিকাংশ গল্পের বই। ইংরেজি আর বাঙলা বইয়ের সম্ভার। ম্যাডামের গল্পের বইয়ের কালেকশন বেশ ভালো!। কয়েকটা বাচ্চাদের গল্পের বইও চোখে পড়ল। আর বাকি বই গুলো হয় উপন্যাস, বা গোয়েন্দা কাহিনী বা অন্যান্য বিষয়ের বই। দুটো রান্নার বইও চোখে পড়েছে। তবে তৃতীয় তাকে একটা বইয়ের ওপর চোখ আটকে গেছে আমার। মাঝারি গোছের মোটা একটা বই। বিস্তর বইয়ের সারির ঠিক মাঝখানে এমন ভাবে বইটাকে গোঁজা আছে যে চট করে চোখে পড়ার কথা নয়। বইয়ের নাম “প্র্যাক্টিকাল সেক্স গাইড”। পিছনে ফিরে রান্নাঘরের দরজার মুখটা দেখে নিয়ে বইটা একটু বের করে বইয়ের কভারের সামনেটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। কভারে লেখা আছে “ গোপন শারীরিক মুহূর্তগুলোকে আরও আনন্দঘন করে তোলার মেডিসি-কামিনী পাবলিশার্স।” কভারটা উল্টাতেই প্রথম পাতায় বইয়ের মালকিনের নাম চোখে পড়ল-”সঞ্চিতা”। বইটাকে আবার র্যাকে গুঁজে দিতেই ম্যাডাম বেরিয়ে এলেন।
১৩
আমি সোফায় ফিরে গিয়ে বললাম “ আপনার তো অনেক বই আছে ম্যাডাম।” উনি জবাব দিলেন “হ্যাঁ। বই পড়তে আমার বেশ ভালো লাগে।” আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে একটা বিস্কুটের প্লেট নিচে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে উনি পাশের সোফাটায় গিয়ে বসলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “বাজার করতে এসেছিলে?” চায়ের কাপটা আমার মুখে ধরে থাকায় জবাব দিতে একটু দেরী হল। উনি বললেন “নাকি কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলে?” ওনার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাঁসির রেখা খেলে গেল। হাসলে ওনাকে বেশ মিষ্টি লাগে! শেষ কথায় উনি কি ইঙ্গিত করেছে সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইনের বুদ্ধি লাগে না। আমি চায়ের কাপটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বললাম “ হ্যাঁ অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু একজন বাড়ির এজেন্টের জন্য।”
উনি বললেন “এজেন্ট?” বললাম “হ্যাঁ। এখানে একটা ধর্মশালায় উঠেছি। বুঝতেই তো পারছেন, যতই শস্তা হোক না কেন, বেশী দিন ওখানে থাকতে হলে টাকা শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া খাওয়া দাওয়াও ভালো নয়। তাই একটা শস্তা মেস খুঁজছিলাম। খাওয়া দাওয়া একটু ভালো হলেই আমার চলে যাবে। আর একটু হাইজিনিক।” ম্যাডাম চায়ের কাপে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন “ কিন্তু এখানে তো অনেক হোস্টেল। তোমার তো মেস খুজে পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নেই। এখানে এসেই তো সেরকম একটা মেস খুঁজে নিতে পারতে। এত দেরী করলে কেন?” বললাম “হ্যাঁ পাঁচ ছয়টা মেস দেখেছি। কিন্তু ঠিক পছন্দ হয় নি। ঠিক ছাত্রদের মেস বলতে যা বোঝায় তেমন নয় ওগুলো। “ উনি একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে বললাম “ বেশির ভাগ মেসে দুজন ছাত্র তো দুজন চাকুরেদার লোক। হই হট্টগোল লেগেই আছে। পড়াশুনা খুব একটা হবে বলে মনে হয় না। কলেজের হোস্টেলটা পেয়ে গেলে ভালো হত। কিন্তু এখন একটু ঠাণ্ডা গোছের কিছু একটা খুঁজতে হচ্ছে। “
ম্যাডাম একটু হেঁসে বললেন “ বাড়িতে কে কে আছেন?” আমি বাবা , মা সবার ব্যাপারে বললাম। গ্রামে আমাদের বাড়ির রান্না খুব ভালো সেটাও বললাম, কারণ ওনার বোঝা উচিৎ কেন আমার খাবার দাবারের ব্যাপারে এত খুঁতখুঁতে ভাব। উনি হেঁসে বললেন “শোনো সংকেত, তুমি উইকএন্ডে এসে আমাদের এখানে খেয়ে যেও। বাড়ির মতন ভালো রান্না মেসেও পাবে না। অবশ্য আরেকটা জিনিস না বলে পারছি না। এটা কোলকাতা। এখানে ছেলে মেয়েরা একটু হইহুল্লোড় পছন্দ করে। তাই তুমি যেমন খুঁজছ তেমন মেস পাওয়া বেশ শক্ত। “ আমার চা পান শেষ। উনি কি যেন একটু ভেবে বললেন “বাই দা ওয়ে, তোমার বাজেট কেমন? কিছু মনে করো না, জিজ্ঞেস করছি, কারণ বাজেট ম্যাচ করলে আমি হয়ত তোমাকে কিছু খোঁজ দিতে পারি, বা সাহায্য করতে পারি।”
আমি মনে মনে হিসাব করে নিলাম - “(কাল্পনিক ধর্মশালায়) আমার দৈনিক পড়ে ২০০ টাকা, সুতরাং মাসে পড়বে ৬০০০ টাকা, তার সাথে খাওয়া দাওয়ার জন্য দিনে আরও ৫০ টাকা করে নিচ্ছে, সুতরাং মাসে দাঁড়াচ্ছে ১৫০০ টাকা। সমস্যা হল, এতে লাঞ্চ পাওয়া যায় না। শুধু ডিনার আর ব্রেকফাস্টেই সবটা বেড়িয়ে যায়। দুপুরে লাঞ্চ করতে হলে আরও বেশী লাগবে। কলেজের ক্যান্টিনের দাম অনেক চরা, মানে আমাদের যা বাজেট সেই অনুপাতে। তাই ইদানিং দুপুর বেলায় কিছু খাওয়া হচ্ছে না। এখানে সবাই টিফিন নিয়ে আসে, কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন যে আমার তেমন সুবিধা নেই। এইভাবে তো বেশী দিন চলতে পারে না। তাই কলেজের ধারে কাছে একটা শস্তা মেস খুঁজছি যাতে দুবেলার খাবার পাওয়া যাবে। আর কলেজের কাছে থাকায়, চট করে গিয়ে খেয়ে চলে আসতে পারব। “
উনি খুব করুণ মুখ করে আমার সব কাল্পনিক গল্প শুনে আমাকে বললেন “তোমার বাবা কি করেন?” বললাম “সমাজসেবী। তবে যা আয় হয় সবই এখানে ওখানে দিয়ে দেন। তাই বেশী চাপ দেওয়া যায় না বাবার ওপর।” উনি একটু কি যেন ভেবে নিয়ে বললেন “আচ্ছা এইবার খোলা খুলি বলোতো তোমার বাজেট কেমন মাসে?” আমি একটুও না ভেবে বললাম “সত্যি বলতে কি শুরুতে আমার আইডিয়া ছিল যে চার হাজারের মধ্যে চলে যাবে। কিন্তু এখন সাড়ে চার হাজার অব্দি উঠতে বাধ্য হচ্ছি। “ উনি বললেন “চার হাজারে কিন্তু ভালো মেস পেয়ে যাবে।” আমি অসহায় ভাবে বললাম “তার থেকেও অনেক কমে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওগুলো হয় ভীষণ নোংরা বা এত হইচই দেখলাম যে সাহসে কুলাল না। বাবা পড়াশুনার ব্যাপারে ভীষণ কড়া। রেজাল্ট খারাপ হলে আমার পিঠের চামড়া…” বাকি কথাটা শেষ করলাম না।
বোধহয় ম্যাডাম বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এই জমানাতেও কোনও প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে তার বাবাকে এমন সমীহ করে চলে। উনি আমার কাছ থেকে আমার মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে নিলেন। আমি ওঠার আগে আবারও বললাম “এখন মাসে শুধু থাকা আর খাওয়াতে ৭৫০০ এর ওপর বেড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এই শহরে থাকতে গেলে আরও ৫০০-৬০০ টাকা এদিক ওদিক খরচ হয়েই যায়। কি যে করি… খুব দুশ্চিন্তায় আছি। এমনিতেই এখানে পড়তে পাঠানোর সময় অনেক খরচ করেছেন বাবা। এখন আর মুখ ফুটে বেশী টাকা চাইতে খারাপ লাগে।” ম্যাডামের মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম যে উনি আমার অসহায় অবস্থা দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
আমার ভালোমানুষি ভাবটাও যে ওনাকে ভেতরে ভেতরে ছুঁয়ে গেছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে ওনার মুখ দেখে। আমি উঠে পড়লাম। দরজার কাছে এসে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার র্যাছঙ্ক কত ছিল জয়েন্টে?” বললাম। বেড়িয়ে পড়লাম। পিছন থেকে ওনার গলার আওয়াজ পেলাম “দেখি একটু ভেবে। তোমাকে কল করে জানাচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি। “ ফোন করে জানতে পারলাম যে আমার দালালের আসতে এখনও দেরী আছে। সুতরাং আর দেরী করার কোনও মানে নেই। কারণ ও কখন আসবে জানি না। তার পর আবার দুটো মেস দেখতে যাব। সেগুলো কোথায় সেটাও জানা নেই। আপাতত আমি হোটেলে ফিরে চললাম। একটু সময় নিয়ে সাজ গোজ করতে হবে।
হাতে সময় নিয়েই বেরলাম যাতে নাইট ব্লুতে ঠিক সময়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারি। পথে অবশ্য অন্য একটা কাজ সেরে নেওয়ার দরকার ছিল। সেটা ভালো ভাবেই মিটেছে। সাড়ে আঁটটায় টাইম দেওয়া আছে। তার আগে পৌঁছানোর কোনও মানে নেই। কারণ যাদের সাথে যাচ্ছি তাড়া বড়লোক বাপের সন্তান। তাদের সময় জ্ঞান খুব বেশী হবে বলে মনে হয় না। ওদের আগে পৌঁছে গেলে ভাবতেই পারে যে গাইয়া ভূতটার ডিস্কে যাওয়ার তর সইছে না। নাইট ব্লু একটা বড় বার।
আমি যখন পৌছালাম তার আগেই অবশ্য ওরা সবাই পৌঁছে গেছে। পথে দুবার কল পেয়েছি দোলনের কাছ থেকে। বারবার বলেছে যে আমি যেন দেরী না করি। পথে অবশ্য আরেকটা কল পেয়েছি। সেটা এসেছে সঞ্চিতা ম্যাডামের কাছ থেকে। আমি ওনাকে বললাম যে আমি মেস দেখছি। ধর্মশালায় ফিরে ওনাকে কল করব। এটুকু মিথ্যা না বললেই নয়। নাইট ব্লুর সামনে যাদের দেখলাম তাদের ব্যাপারে দু-এক কথা বলে দেওয়া দরকার।
দোলন আর রাকাকে আগে থেকেই চিনি। এদের ব্যাপারে আর কি বলব। বিশাল সিং এসেছে, আর তার সাথে এসেছে আরেকজন দীর্ঘকায় ছেলে। জানতে পারলাম তার নাম শুভ। এই হল বিশালের সেই বিখ্যাত দাদা। শুভ বারবার ঘড়ি দেখছে, যেন কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। আরেকজন এসেছে, সুনীল সরকার। বেচারা কুন্তল যদি জানতে পারত যে ওর বন্ধু এই ভিলেন সুনীলের সাথে পার্টি করতে ঢুকছে তাহলে বোধহয় মর্মাহত হয়ে পড়ত। মালিনীর কথা ছেড়েই দিলাম। আরেকজন মেয়ে এসেছে, জানলাম তার নাম হল সুচেতা। বাহ। বেশ মিষ্টি মেয়েটা। সুচেতার বয়স মনে হল বিশালের সমান। এটাও দেখে মনে হল যে সুচেতা আর বিশালের মধ্যে কেমন যেন একটু ইয়ে ইয়ে ব্যাপার আছে। কিন্তু আরেকটা জিনিসও আমার চোখ এরায়নি। দেখে মনে হল সুচেতা আর শুভর মধ্যেও একটা ইয়ে ইয়ে ব্যাপার আছে।
আগেই বলেছি যে বিশাল আর রাকা একে ওপরের পূর্ব পরিচিত। অবশ্য আজ এই অবস্থায় দেখে মনে হল যে বিশালের রাকার ব্যাপারে তেমন কোনও ছুঁক ছুঁক ভাব না থাকলেও, রাকার বিশালের ওপর একটা অদৃশ্য টান আছে। অবশ্য বাইরে থেকে রাকার হাব ভাব দেখে সেটা বোঝা শক্ত। বিশালের সাথে কথা বলার সময় একদম সাধারান ভাবে কথা বলছে, ভাব খানা এমন যেন বিশালের প্রতি ওর তেমন কোনও অনুভূতি নেই। কিন্তু বিশালের সুচেতার সাথে মাখা মাখিটা যে ও সহজ ভাবে মেনে নিতে পারছে না সেটা ওকে একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলেই ধরা যায়।
ব্যাপারটা কি একটু বেশীই জটিল বানিয়ে ফেলেছি? তাহলে সহজ ভাবে বলি। বিশাল সুচেতাকে পছন্দ করে, আর প্রকাশ্যে হাবে ভাবে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটা বেশী রকম গায়ে পড়া ভাব। সুচেতা বিশালকে ঠ্যাকা দিয়ে চললেও বোঝা যায় যে ওর আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্ধু হল শুভ। শুভ যে কার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা বলা শক্ত। আর এই দিকে আমাদের ক্লাসের রাকা বিশালের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। মোটের ওপর এই। দোলন হঠাত বলে উঠল “এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। শুভ, চলো ভেতরে ঢুকে পড়ি। লেটস এনজয়।”
শুভ বলল “সে তো ঠিকই বলছিস। কিন্তু যে পার্টি দেবে বলেছে সেই না এলে বিলটা কে মেটাবে শুনি?” সবাই হেঁসে উঠল। আমি হাঁসতে পারলাম না, কারণ আমি জানি না যে কে এই পার্টিটা থ্রো করেছে। দোলন আর সুনীল এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আমরা ঢিলে ঢালা তালে ওর পিছু নিলাম। হোটেলের ভেতরটা আলো আধারিতে ভরা। বিভিন্ন রঙ বেরঙের আলো এদিক ওদিক ঠিকরে পড়ছে বেশ কয়েকটা গোলাকৃতি বস্তুর ভেতর থেকে। উচ্চস্বরে মিউজিক চলছে। গানের তালে তালে, বা বলা ভালো মিউজিকের তালে তালে সেই গোলাকৃতি পিণ্ডটার থেকে রঙ বেরঙের আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে চতুর্দিকে। সিট নাকি রিজার্ভ করা আছে। তবে সিট অব্দি পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হল। কারণ, অন্ধকারে, এতগুলো নৃত্যরত বিভিন্ন বয়সের উন্মাদ নরনারীর ধাক্কা সামলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ।
তবে সিট অব্দি পৌঁছাতে হল না, তার আগেই, একটা ব্যাপার দেখে থমকে না গিয়ে পারলাম না। আমি দোলনের হাতটা চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “দীপকদাও কি জয়েন করবে নাকি?” ও যেন একটু আশ্চর্য হয়েই চারপাশটা একবার দেখে নিল। তার পর গলা তুলে বলল “কেন?” বললাম “ওই যে দেখ।” এত শব্দের জন্য আমাদের সবাইকে গলা তুলে কথা বলতে হচ্ছে। আমি জানি না আমাদের সিট কোথায়। কিন্তু একটু দূরে দেখতে পেলাম যে দীপক আর আরেকটা মেয়ে গায়ে ঢলাঢলি করে বসে আছে। অন্ধকারে আরেকটু চোখ সয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ইনি আমাদের পূর্ব পরিচিতা শিখাদি।
ওদের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল “শালা রাখেল নিয়ে এসেছে।” বিভিন্ন কারণে দীপকের ব্যাপারে দোলন যদিও কলেজে কোনও রকম মুখ খুলতে পারে না প্রকাশ্যে, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম যে দীপক আর শিখার ব্যাপারে ওর ধারণা কেমন। আমি ওকে একটা চোখ মেরে বললাম “কথাটা কি সত্যি?” দোলন বলল “ না তো কি?” রাকাও দেখেছে দীপক আর শিখা কে। আমাদের জন্য একটা বড় টেবিল বুক করা ছিল। আমি টেবিলে পৌঁছেই ওদের বললাম “এক্সিউজ মি। আমি একটু আসছি।”
সবাই আমার দিকে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম “ দীপকদার সাথে এই গতকাল আলাপ হল। আরেকবার দেখা করে আসি।” ওদের মুখে চাপা বিরক্তির ভাব। কেউ যে ওদের সহ্য করতে পারে না সেটা আরও স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেয়ে গেল ওদের হাবে ভাবে। আমি বললাম “আমি বাইরের ছেলে। ওর সাথে একটু দোস্তি রেখে চললে পরের কয়েকটা বছর এখানে শান্তিতে কাটাতে পারব।”
কিন্তু আমার যাওয়া হল না। কারণ ওদের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, দোলন আমার একটা হাত চেপে ধরে বলল “চুপ করে বস। ওকে অত মাথায় তোলার দরকার নেই। “ কথাটা ও মিথ্যে বলেনি। অগত্যা। আমি বসে পড়লাম। শুভ বসেই মোবাইলে কি একটা দেখতে শুরু করে দিয়েছে। দোলন, রাকা, সুচেতা সবার গায়েই একটা করে শাঙ্ক বা জ্যাকেটের মতন জিনিস পরা ছিল। সিটে বসার আগে গায়ের জ্যাকেটগুলো সবাই খুলে সিটের পেছনে মেলে দিল।
উফফ এক লাফে আমার বাঁড়াটা খাড়া হয়ে গেল। তিনটে মেয়েই যেন একে ওপরের সাথে আলোচনা করে একই রকম ম্যাচিং ড্রেস পরে এসেছে। তিন জনের পরনেই কালো রঙের একদম একই রকমের পোশাক। এগুলোকে বলে টিউব ড্রেস। যারা জানে না কেমন দেখতে হয় এমন পোশাক তাদের জন্য একটু বুঝিয়ে রাখা ভালো। স্ট্র্যাপ বিহীন চামড়ার তৈরি এক ধরণের পোশাক যেটা বুকের ঠিক ওপর থেকে শুরু করে থাইয়ের মাঝ অব্দি নেমে এসেছে শরীরটাকে গোল ভাবে জড়িয়ে রেখে। স্তনের ওপর থেকে গলা অব্দি, আর থাইয়ের নিচ থেকে গোড়ালি সবটাই নগ্ন। তিন জনেরই গলায় একটা করে সরু সোনার চেন। সোনার চেনটা যেন ওদের শারীরিক সৌন্দর্য আরও দশ গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। সমস্যা হল, অন্য জায়গা হলে এতক্ষন মাগীগুলোকে চোখ দিয়ে গিলে খেতাম। কিন্তু এখানে ওদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা যাবে না। হায় রে আমার পোড়া কপাল।
অবশ্য এই পরিবেশে এই রকম পোশাক খুবই সাধারণ। দোলন বলল “পাঁচ মিনিট ওয়েট করা যাক। তারপর, আর নয়। অর্ডার দিয়ে দেব তারপর। “ সবাই সম্মতি জানালাম। তবে পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে হল না। এরই মধ্যে শুভর কাছে একটা কল এলো। শুভ গলা চড়িয়ে ঠিক কি বলল সেটা এই চড়া মিউজিকের জন্য শুনতে পেলাম না, কিন্তু মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দেখলাম একটা মাঝারি উচ্চতার ছেলে এসে হাজির হয়েছে আমার টেবিলে। গায়ের রঙ ফর্সা, স্বাস্থ্য ভালো। আলাপ হতে জানলাম, এর নাম শান্তনু মুখার্জি। ইনি দোলনের সেই আমেরিকান দাদা। ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য এসেছে কলকাতায়, আর এরই অনারে আজ এই পার্টি। আর ইনিই আজকের পার্টির বিল মেটাবে।
ও আসতেই ড্রিঙ্কস আর খাবার দাবারের অর্ডার দিয়ে দেওয়া হল। শান্তনু গিয়ে বসেছে শুভর পাশে। আর শুভর আরেক পাশে বসেছে সুচেতা। আর সুচেতার পাশে বিশাল। ওই দিকে আর জায়গা না থাকায়, দোলন আর রাকা বসেছে আমার দুপাশে, আর রাকার পাশে বসেছে সুনীল। মদের গ্লাসে প্রথম চুমুক দিতে না দিতেই শুভ শান্তনুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “তাহলে মিস্টার এন আর এই, আমাদের আজকের প্রোগ্রাম ফাইনাল তো?”
সবার মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারলাম যে দোলন ছাড়া সবার মুখেই একটা বিস্ময়ের ছায়া। মানে দোলন, শান্তনু আর শুভ ছাড়া এই ব্যাপারে কেউই কিছু জানে না। শুভ সবার মুখের এই কৌতূহলী ভাবটা লক্ষ্য করেই বোধহয় ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলল। “ আরে শান্তনুর সাথে অনেক দিন ধরে প্ল্যান করেছিলাম যে এই বার ও ইন্ডিয়ায় এলে দুই তিন দিনের জন্য মন্দারমনির দিকে ঢু মারব। এদিকে নেক্সট উইক থেকে আমাকে একটু কাজের ব্যাপারে বাইরে বাইরে থাকতে হবে। আর …” শান্তনু বাকি কথাটা শেষ করল “ আর আমাকেও নেক্সট উইক থেকে এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়াতে হবে। জত্ত সব। যাই হোক। তাই খুব সম্ভবত আর সময় পাওয়া যাবে না। তাই আজকেই …”
গ্লাসে আরেকটা চুমুক মেরে বলল “ বাই দা অয়ে, তোরা কেউ জয়েন করতে চাইলে এখনই বল। কারণ লোক বেশী হলে সেই মতন গাড়ির ব্যবস্থাও করতে হবে।” শুভ বলল “ইয়েস। তবে আমাদের গাড়িতে এখনও জায়গা আছে। “ দিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল “কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি এসে পড়বে। কেউ যেতে চাইলে এখনই বলতে হবে। “ দোলন জানিয়ে দিল যে ওর যাওয়া হবে না। রাকারও যাওয়া হবে না। আমার যে যাওয়া হবে না সেটা বলাই বাহুল্য। মাঝখান থেকে দেখলাম সুনীল ওদের দলে ভিড়ে গেল।
বিশাল প্রথমে ওদের সাথে যেতে চাইছিল না। কিন্তু, সুচেতা হঠাত করে ওদের দলে ভিড়ে যেতেই দেখলাম বিশালও নিজের মত পাল্টে ওদের দলে ভিড়ে পড়ল। সুচেতা যাবে বলেই যে বিশাল ওদের সাথে যেতে রাজি হয়েছে সেটা জলের মতন পরিষ্কার। এই দিকে বিশাল সুচেতার সাথে যাচ্ছে জেনে রাকার চোখ মুখের কি অবস্থা হল সেটা আর দেখতে পেলাম না। রাকা আমার পাশে না বসে সামনে বসলে ভালো করে ওর রিয়েকশনটা উপভোগ করতে পারতাম। হেহে। কিন্তু ও যে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে সেটা প্রকাশ পেল ওর পরের কথাতেই।
গাড়িতে উঠতে না উঠতেই দোলনের ফোন। “কি রে সুস্থ আছিস?” বললাম “আমার আবার কি হল? ও হ্যাঁ। পিঠে একটু ব্যথা আছে। ব্যস। এর থেকে বেশী কিছু নয়। “ বলল “আচ্ছা তাহলে আজ কি আমাদের সাথে আসছিস?” জিজ্ঞেস করলাম “আমাদের সাথে মানে?” ও খিল খিল করে হেঁসে বলল “বললাম না কাল? পার্টি! আর আমাদের সাথে আসবি না তো কি আমার একার সাথে আসবি? লাইন মারার চেষ্টা ছেড়ে দে। শোন মোটামুটি সবাই তোর চেনা। শুধু দুই তিনজন অচেনা পাবি। আলাপ হয়ে যাবে। ফুর্তি হবে ভালো।” বললাম “কোথায় হচ্ছে এই পার্টি?” বলল “শুরুতে প্ল্যান ছিল বাড়িতে। কিন্তু সেটা আর হবে না। মম আর ড্যাড ও বাড়িতে আজ পার্টি থ্রো করেছে। তাই আমরা একটা ডিস্কে যাব। নাচ গান হবে। ও হ্যাঁ, তুই দারু খাস তো?” বললাম “আমি পিপে। কিন্তু আজ যেতে পারব কি না সেটা এখনই বলতে পারছি না। ও হ্যাঁ, কটায় শুরু হবে এই ব্যাপারটা।” ও পাশে কারোর সাথে কথা বলে বলল “ সন্ধ্যে সাড়ে আটটার মধ্যে নাইট ব্লুর সামনে চলে আয়। ফুর্তি হবে।” মনে মনে বললাম হুম্মম। ফোন কেটে গেল।
সাড়ে আঁটটায় নাইত ব্লুতে পৌঁছাতে পারব কি না সেটা সত্যি এখনও জানি না। যেখানে যাব সেখানে পৌঁছাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগবে। সুতরাং কানে হেড সেটটা লাগিয়ে নিয়ে ভালো মোবাইলটাতে গুঁজে দিলাম। কোথাও ভালো গান বাজছে কি? না সব স্টেশন কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে রয়েছে। একের পর এক স্টেশন সার্ফ করেই চললাম বারবার এই আশায় যদি কোথাও আমার মনের মতন একটাও গান পাওয়া যায়। কিন্তু না। প্রায় চল্লিশ মিনিট এই স্টেশন ওই স্টেশন করে কাটিয়ে দেওয়ার পর অবশেষে একটা মোটামুটি মনের মতন গান পেলাম। এদিকে আমিও গন্তব্য স্থলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এমন রহস্য করে বলার অবশ্য কোনও মানে হয় না। বাবার হয়ে টাকা কালেক্ট করে একজনের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। ভদ্রলোকের বাড়ি থেকেই গিয়ে টাকা ওঠাতে হবে।
দুপুর দুটো বেজে দশ মিনিট। সকালের সব কাজ মিটে গেছে, তবে খুব ভালো ভাবে মিটেছে সেটা স্বীকার করতে পারিনা। আজ ঠিক করেই রেখেছিলাম যে কোনও একটা বড় বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের লাঞ্চটা সারব। হোটেলের কিছুটা দূরে একটা বড় বাঙালি রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম। শীততাপনিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্ট। মেনু দেখে বুঝলাম দামটা বেশ চড়ার দিকে এখানে। তাই হয়ত ভিড়টা একদম কম। তবে মনে হয় খাবার কোয়ালিটি খারাপ হবে না। হোটেলে বাঙালি খাবার অর্ডার করে তেমন একটা তৃপ্তি পাইনি, ওখানে কাবাব, রুটি মাংস, ফ্রাই ইত্যাদি খুব ভালো পাওয়া যায়, কিন্তু বাঙালি খাবার একদম বাজে। তাই আজকের এই প্ল্যান। ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, পুড় দিয়ে পটল ভাজা, ইলিশ ভাপে আর সব শেষে মাটন ডাক বাংলো- এই হল আজকের মেনু।
অর্ডার দিতে না দিতেই আমার ঠিক পাশের টেবিলে এসে বসল একটা অল্প বয়সী কাপল। ওরা আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওদের যেটুকু কথা বার্তা আমার কানে ঢুকেছে তা থেকেই বুঝতে পেরেছি যে ওদের মধ্যে চাপা ঝগড়া হচ্ছে। বিবাহিত কাপল বলে মনে হল না। আমার ধারণা ডেটিঙে এসেছে। তবে এখন আমার মাথায় আরও অনেক চিন্তা ঘুরছে তাই ওদের দিকে আর বেশী খেয়াল করা হল না। আজকের সব কাজ মিটেছে বটে, কিন্তু ওই যে বললাম, খুব ভালো ভাবে মেটেনি। বাবাকে মুখ দেখাবো কি করে? এটা বড় আর দামি রেস্টুরেন্ট বটে, কিন্তু টেবিলগুলো বড্ড গায়ে গায়ে। পাশে বসা দুজনের প্রায় সব কথা আমার কানে আসছে।
বলাই বাহুল্য যে তাতে আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটছে, বড্ড বিরক্তি লাগছে। এই রেস্টুরেন্টে যারা খেতে আসবে তারা মোটামুটি অবস্থাপন্নদের দলে পড়ে। সুতরাং আর সংকোচ না করে সেই ভয়ানক মোবাইলটা বের করে চট করে তাতে হেড সেটটা লাগিয়ে দিয়ে সেটাকে আবার পকেটে চালান করে দিলাম। এফ এম টা অবশ্য অন করে দিয়েছি। এখন হেড সেট থেকেই স্টেশন চেঞ্জ করা যাবে। না বরাতটাই খারাপ আজ। সকালে হোটেলে যা হল তাতে মনে হয়েছিল যে দিনটা বেশ ভালো কাটবে। মানে ওই লোকগুলোকে নাকাল করতে পেরে ভেবেছিলাম সব প্ল্যান মাফিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। সেরকম হচ্ছে না । আর এখন? একটাও ভালো গান নেই রেডিওতে। মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না, ভালো গান না চালিয়ে শুধু অযথা আর অহেতুক বক বক করার জন্য রেডিও স্টেশন খুলে বসার কারণ কি?
যখন ইলিশ ভাপের ডিশটা শেষ করলাম, তখনই ঠিক করে ফেললাম যে আজ সন্ধ্যায় নাইট ব্লুতে গিয়ে হাজির হওয়া যাক। ডিস্ক কেমন হয় সেটা আমার অজানা নয়। তাই সেখানে যাওয়ার কোনও বাড়তি টান বা কৌতূহল আমি অনুভব করছি না। তবে সদ্য আলাপ হওয়া ছেলে মেয়েগুলোর আরেকটা রূপ ওখানে দেখতে পাব। আর তাছাড়া...যাই হোক। আজ সেজে গুঁজে ওদের দলে ভিড়ে যাব। হোটেলে ফিরে গিয়ে একটা ছোট ঘুম দিয়ে নিতে হবে।
অবশ্য হোটেলে ফেরার আগে দুটো বড় বড় মদের বোতল কিনতে হবে। মালিনীর বরের জন্য যে কিছু একটা কিনতে হবে সেটা আমার মাথা থেকে বেড়িয়ে যায়নি এত চিন্তার মধ্যেও। যদিও মালিনী গোটা ব্যাপারটায় ভয় পাচ্ছে তবে আমাকে একটা চেষ্টা করতেই হবে। মালিনীর বরকে মাতাল বানিয়ে তার সামনে মালিনীকে ভোগ করার দৃশ্যটা কল্পনা করেই গাটা কেমন গরম হয়ে উঠল। হাত চালিয়ে বাকি খাবারটা শেষ করে, দু বোতল মদ কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকেই একটা জরুরি কল সেরে নিলাম। ঘুম লাগানোর আগে হেড সেটটা কানে গুঁজে নিতে ভুললাম না অবশ্য। তবে এখন ঘুমের মধ্যে স্টেশন চেঞ্জ করা সম্ভব নয়, তাই সব থেকে ফেভারিট স্টেশনে টিউন করে চোখ বুজলাম।
চোখ প্রায় বুজে এসেছে এমন সময় হঠাত ঘুম ছুটে গেল। বাহ বেশ ভালো গান চালিয়েছে ফাইনালি। ঘড়িটা দেখে নিয়ে কান থেকে হেড সেটটা খুলে ফেললাম। মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে দিয়ে আরেকবার শুয়ে পড়লাম। ঠিক বিকেল পৌনে ছয়টার সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। একটু ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। নাইট ব্লুতে যাব নিশ্চই তবে এই রকম বেশ ভুষায় ওখানে যাওয়া যায় না। ওখানে যাওয়ার আগে আরেকবার ফিরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে। আপাতত একটা শস্তা মেসের সন্ধানে বেরোতে হবে। আজ সকাল বেলাতেই একজন দালালের সাথে মেস দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর যাওয়া হয়নি। কারণ অন্যান্য কাজগুলোতে এত ফেঁসে গেছিলাম যে ওই মেস দেখতে যাবার অ্যাঁপয়েন্টমেন্টটা ঘেঁটে গেল।
এইবার আর সেই বিশেষ গেস্ট বা তার কোনও সাঙ্গপাঙ্গকে দেখতে পাইনি। নো স্মোকিং বোর্ডটা আবার যথাস্থানে চলে এসেছে। এইবার আর লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাইনি। এখন বাওয়াল করার সময় নেই। হোটেল থেকে বেড়িয়ে সোজা চলে গেলাম কলেজের দিকে। কলেজ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা যেতে হবে। ওইখানেই সেই দালালের সাথে মিট করার কথা। একবার ফোন করে নিয়েছি লোকটাকে। লোকটার আসতে এখনও একটু সময় আছে।
আমি অনেক আগেই পৌঁছে গেছি ওখানে। সামনে একটা বাজার। সন্ধ্যে বেলায় বসে এই বাজারটা। বাজারে লোকের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। গিয়ে দাঁড়ালাম ঠিক বাজারের মুখে। বার বার ঘড়ি দেখতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ রাতে নাইট ব্লুতে যাবার ব্যাপারটা আমাকে এখন চুম্বকের মতন টানছে। সেক্সি দোলনের শরীরের দোলন দেখার আকর্ষণ সময়ের সাথে সাথে দুর্নিবার হয়ে উঠছে আমার ভেতরে। হঠাতই একটা পরিচিত গলার ডাক শুনলাম।
একি! সঞ্চিতা ম্যাডাম। দুই হাতে ভারী বাজারের থলি। বুঝলাম উইক এন্ডে, শনিবারের সন্ধ্যায় সারা সপ্তাহের বাজার করে ফিরছেন ম্যাডাম। আমাকে বাজারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আওয়াজ দিয়েছেন। আমি দৌড়ে ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওনার হাত থেকে বাজারের থলি দুটো নিয়ে নিলাম। হুম দুটো থলিই বেশ ভারী। উনি অবশ্য কিছুতেই দিতে চাইছিলেন না, কিন্তু আমার জোরাজুরিতে অবশেষে আমার হাতে বাজারের থলি দুটো দিয়ে দিলেন। ওনার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে মুখটা একটু মুছে নিলেন।
সাদা রঙের ঢিলে কামিজটা ঘামে ভিজে শরীরের সাথে একদম সেঁটে গেছে। গলার কাছটা ভিজে কালো হয়ে গেছে। বগলের কাছটাও ঘামে ভিজে কালচে হয়ে আছে। একটা হালকা পারফিউম আর ঘামে মেশানো গন্ধ আসছে ওনার গা থেকে। একটা ঢিলে মেরুন রঙের শালোয়ার পরেছেন নিচে। সালোয়ার কামিজে একটু অন্য রকম লাগছে ম্যাডামকে। ম্যাডাম রুমাল দিয়ে নিজের মুখ থেকে ঘাম মুছে নিয়ে বললেন “আমার বাড়ি একদম সামনে। এসো। একটু জিরিয়ে চা খেয়ে যাও। আর এই হেল্পের জন্য থ্যঙ্কস।” রাস্তার উল্টো ফুটে এসে মিনিট দুয়েক হাঁটতে না হাঁটতেই ওনার বাড়ি চলে এল। পথে আমাদের দুজনের মধ্যে প্রায় কোনও কথা হল না। পাশাপাশি নিরবে হেঁটে চললাম। ম্যাডাম মাঝে মাঝে এই বিচ্ছিরি হিউমিড ওয়েদারের নামে গালি দিচ্ছিলেন, অবশ্য ভীষণ ভদ্র ভাষায়, মানে ঠিক গালি বলতে যা বোঝায় তেমন নয়।
বাড়ির বাইরে একটা বড় গেট। সেটা খোলা। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে ওনাদের বাড়ি। উনি দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে আমাকে থলি দুটো নামিয়ে রাখতে বললেন এক পাশে। আমি তখনই বেড়িয়ে আসতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু উনি আমাকে জোড় করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ফ্রিজ থেকে একটা বোতল জল বের করে ঢক ঢক করে কিছুটা জল গলা দিয়ে ঢেলে নিলেন।ওনার বৈঠক খানাটা বেশ সাজানো। রুচির ছাপ স্পষ্ট সব কিছুর মধ্যে। এক দিকে একটা উঁচু বইয়ের র্যােক। তার পাশে বেশ কয়েকটা ছবি সারি বদ্ধ ভাবে দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে। কয়েকটা ওনার, কয়েকটা বোধহয় ওনার স্বামীর। আর কয়েকটাতে উনি আর ওনার স্বামী এক সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি কাঁচের গ্লাসে খানিকটা ঠাণ্ডা জল ঢেলে নিয়ে এলেন আমার কাছে। গ্লাসটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। বাড়িটা দ্বিতল। রান্না ঘরটা এক তলার পূর্ব দিকে। এক তলার এক ধারে একটা সিঁড়ির সারি ওপরে উঠে গেছে। ওপরে নিশ্চই ওনাদের বেডরুম। যাকগে। রান্নাঘরের আলো জ্বলে উঠল। চা বানানো হচ্ছে।
আমি চুপ চাপ বসে থাকতে পারি না। গ্লাসের জলটা গলা দিয়ে ঢেলে দিয়ে সেটা উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বইয়ের র্যা কের দিকে এগিয়ে গেলাম। না এইগুলো ইঞ্জিনিয়ারিঙের বই না। অধিকাংশ গল্পের বই। ইংরেজি আর বাঙলা বইয়ের সম্ভার। ম্যাডামের গল্পের বইয়ের কালেকশন বেশ ভালো!। কয়েকটা বাচ্চাদের গল্পের বইও চোখে পড়ল। আর বাকি বই গুলো হয় উপন্যাস, বা গোয়েন্দা কাহিনী বা অন্যান্য বিষয়ের বই। দুটো রান্নার বইও চোখে পড়েছে। তবে তৃতীয় তাকে একটা বইয়ের ওপর চোখ আটকে গেছে আমার। মাঝারি গোছের মোটা একটা বই। বিস্তর বইয়ের সারির ঠিক মাঝখানে এমন ভাবে বইটাকে গোঁজা আছে যে চট করে চোখে পড়ার কথা নয়। বইয়ের নাম “প্র্যাক্টিকাল সেক্স গাইড”। পিছনে ফিরে রান্নাঘরের দরজার মুখটা দেখে নিয়ে বইটা একটু বের করে বইয়ের কভারের সামনেটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। কভারে লেখা আছে “ গোপন শারীরিক মুহূর্তগুলোকে আরও আনন্দঘন করে তোলার মেডিসি-কামিনী পাবলিশার্স।” কভারটা উল্টাতেই প্রথম পাতায় বইয়ের মালকিনের নাম চোখে পড়ল-”সঞ্চিতা”। বইটাকে আবার র্যাকে গুঁজে দিতেই ম্যাডাম বেরিয়ে এলেন।
১৩
আমি সোফায় ফিরে গিয়ে বললাম “ আপনার তো অনেক বই আছে ম্যাডাম।” উনি জবাব দিলেন “হ্যাঁ। বই পড়তে আমার বেশ ভালো লাগে।” আমার হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে একটা বিস্কুটের প্লেট নিচে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে উনি পাশের সোফাটায় গিয়ে বসলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “বাজার করতে এসেছিলে?” চায়ের কাপটা আমার মুখে ধরে থাকায় জবাব দিতে একটু দেরী হল। উনি বললেন “নাকি কারোর জন্য অপেক্ষা করছিলে?” ওনার ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাঁসির রেখা খেলে গেল। হাসলে ওনাকে বেশ মিষ্টি লাগে! শেষ কথায় উনি কি ইঙ্গিত করেছে সেটা বোঝার জন্য আইনস্টাইনের বুদ্ধি লাগে না। আমি চায়ের কাপটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বললাম “ হ্যাঁ অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু একজন বাড়ির এজেন্টের জন্য।”
উনি বললেন “এজেন্ট?” বললাম “হ্যাঁ। এখানে একটা ধর্মশালায় উঠেছি। বুঝতেই তো পারছেন, যতই শস্তা হোক না কেন, বেশী দিন ওখানে থাকতে হলে টাকা শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া খাওয়া দাওয়াও ভালো নয়। তাই একটা শস্তা মেস খুঁজছিলাম। খাওয়া দাওয়া একটু ভালো হলেই আমার চলে যাবে। আর একটু হাইজিনিক।” ম্যাডাম চায়ের কাপে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে বললেন “ কিন্তু এখানে তো অনেক হোস্টেল। তোমার তো মেস খুজে পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নেই। এখানে এসেই তো সেরকম একটা মেস খুঁজে নিতে পারতে। এত দেরী করলে কেন?” বললাম “হ্যাঁ পাঁচ ছয়টা মেস দেখেছি। কিন্তু ঠিক পছন্দ হয় নি। ঠিক ছাত্রদের মেস বলতে যা বোঝায় তেমন নয় ওগুলো। “ উনি একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে বললাম “ বেশির ভাগ মেসে দুজন ছাত্র তো দুজন চাকুরেদার লোক। হই হট্টগোল লেগেই আছে। পড়াশুনা খুব একটা হবে বলে মনে হয় না। কলেজের হোস্টেলটা পেয়ে গেলে ভালো হত। কিন্তু এখন একটু ঠাণ্ডা গোছের কিছু একটা খুঁজতে হচ্ছে। “
ম্যাডাম একটু হেঁসে বললেন “ বাড়িতে কে কে আছেন?” আমি বাবা , মা সবার ব্যাপারে বললাম। গ্রামে আমাদের বাড়ির রান্না খুব ভালো সেটাও বললাম, কারণ ওনার বোঝা উচিৎ কেন আমার খাবার দাবারের ব্যাপারে এত খুঁতখুঁতে ভাব। উনি হেঁসে বললেন “শোনো সংকেত, তুমি উইকএন্ডে এসে আমাদের এখানে খেয়ে যেও। বাড়ির মতন ভালো রান্না মেসেও পাবে না। অবশ্য আরেকটা জিনিস না বলে পারছি না। এটা কোলকাতা। এখানে ছেলে মেয়েরা একটু হইহুল্লোড় পছন্দ করে। তাই তুমি যেমন খুঁজছ তেমন মেস পাওয়া বেশ শক্ত। “ আমার চা পান শেষ। উনি কি যেন একটু ভেবে বললেন “বাই দা ওয়ে, তোমার বাজেট কেমন? কিছু মনে করো না, জিজ্ঞেস করছি, কারণ বাজেট ম্যাচ করলে আমি হয়ত তোমাকে কিছু খোঁজ দিতে পারি, বা সাহায্য করতে পারি।”
আমি মনে মনে হিসাব করে নিলাম - “(কাল্পনিক ধর্মশালায়) আমার দৈনিক পড়ে ২০০ টাকা, সুতরাং মাসে পড়বে ৬০০০ টাকা, তার সাথে খাওয়া দাওয়ার জন্য দিনে আরও ৫০ টাকা করে নিচ্ছে, সুতরাং মাসে দাঁড়াচ্ছে ১৫০০ টাকা। সমস্যা হল, এতে লাঞ্চ পাওয়া যায় না। শুধু ডিনার আর ব্রেকফাস্টেই সবটা বেড়িয়ে যায়। দুপুরে লাঞ্চ করতে হলে আরও বেশী লাগবে। কলেজের ক্যান্টিনের দাম অনেক চরা, মানে আমাদের যা বাজেট সেই অনুপাতে। তাই ইদানিং দুপুর বেলায় কিছু খাওয়া হচ্ছে না। এখানে সবাই টিফিন নিয়ে আসে, কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন যে আমার তেমন সুবিধা নেই। এইভাবে তো বেশী দিন চলতে পারে না। তাই কলেজের ধারে কাছে একটা শস্তা মেস খুঁজছি যাতে দুবেলার খাবার পাওয়া যাবে। আর কলেজের কাছে থাকায়, চট করে গিয়ে খেয়ে চলে আসতে পারব। “
উনি খুব করুণ মুখ করে আমার সব কাল্পনিক গল্প শুনে আমাকে বললেন “তোমার বাবা কি করেন?” বললাম “সমাজসেবী। তবে যা আয় হয় সবই এখানে ওখানে দিয়ে দেন। তাই বেশী চাপ দেওয়া যায় না বাবার ওপর।” উনি একটু কি যেন ভেবে নিয়ে বললেন “আচ্ছা এইবার খোলা খুলি বলোতো তোমার বাজেট কেমন মাসে?” আমি একটুও না ভেবে বললাম “সত্যি বলতে কি শুরুতে আমার আইডিয়া ছিল যে চার হাজারের মধ্যে চলে যাবে। কিন্তু এখন সাড়ে চার হাজার অব্দি উঠতে বাধ্য হচ্ছি। “ উনি বললেন “চার হাজারে কিন্তু ভালো মেস পেয়ে যাবে।” আমি অসহায় ভাবে বললাম “তার থেকেও অনেক কমে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওগুলো হয় ভীষণ নোংরা বা এত হইচই দেখলাম যে সাহসে কুলাল না। বাবা পড়াশুনার ব্যাপারে ভীষণ কড়া। রেজাল্ট খারাপ হলে আমার পিঠের চামড়া…” বাকি কথাটা শেষ করলাম না।
বোধহয় ম্যাডাম বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে এই জমানাতেও কোনও প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে তার বাবাকে এমন সমীহ করে চলে। উনি আমার কাছ থেকে আমার মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে নিলেন। আমি ওঠার আগে আবারও বললাম “এখন মাসে শুধু থাকা আর খাওয়াতে ৭৫০০ এর ওপর বেড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এই শহরে থাকতে গেলে আরও ৫০০-৬০০ টাকা এদিক ওদিক খরচ হয়েই যায়। কি যে করি… খুব দুশ্চিন্তায় আছি। এমনিতেই এখানে পড়তে পাঠানোর সময় অনেক খরচ করেছেন বাবা। এখন আর মুখ ফুটে বেশী টাকা চাইতে খারাপ লাগে।” ম্যাডামের মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম যে উনি আমার অসহায় অবস্থা দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
আমার ভালোমানুষি ভাবটাও যে ওনাকে ভেতরে ভেতরে ছুঁয়ে গেছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে ওনার মুখ দেখে। আমি উঠে পড়লাম। দরজার কাছে এসে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার র্যাছঙ্ক কত ছিল জয়েন্টে?” বললাম। বেড়িয়ে পড়লাম। পিছন থেকে ওনার গলার আওয়াজ পেলাম “দেখি একটু ভেবে। তোমাকে কল করে জানাচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি। “ ফোন করে জানতে পারলাম যে আমার দালালের আসতে এখনও দেরী আছে। সুতরাং আর দেরী করার কোনও মানে নেই। কারণ ও কখন আসবে জানি না। তার পর আবার দুটো মেস দেখতে যাব। সেগুলো কোথায় সেটাও জানা নেই। আপাতত আমি হোটেলে ফিরে চললাম। একটু সময় নিয়ে সাজ গোজ করতে হবে।
হাতে সময় নিয়েই বেরলাম যাতে নাইট ব্লুতে ঠিক সময়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারি। পথে অবশ্য অন্য একটা কাজ সেরে নেওয়ার দরকার ছিল। সেটা ভালো ভাবেই মিটেছে। সাড়ে আঁটটায় টাইম দেওয়া আছে। তার আগে পৌঁছানোর কোনও মানে নেই। কারণ যাদের সাথে যাচ্ছি তাড়া বড়লোক বাপের সন্তান। তাদের সময় জ্ঞান খুব বেশী হবে বলে মনে হয় না। ওদের আগে পৌঁছে গেলে ভাবতেই পারে যে গাইয়া ভূতটার ডিস্কে যাওয়ার তর সইছে না। নাইট ব্লু একটা বড় বার।
আমি যখন পৌছালাম তার আগেই অবশ্য ওরা সবাই পৌঁছে গেছে। পথে দুবার কল পেয়েছি দোলনের কাছ থেকে। বারবার বলেছে যে আমি যেন দেরী না করি। পথে অবশ্য আরেকটা কল পেয়েছি। সেটা এসেছে সঞ্চিতা ম্যাডামের কাছ থেকে। আমি ওনাকে বললাম যে আমি মেস দেখছি। ধর্মশালায় ফিরে ওনাকে কল করব। এটুকু মিথ্যা না বললেই নয়। নাইট ব্লুর সামনে যাদের দেখলাম তাদের ব্যাপারে দু-এক কথা বলে দেওয়া দরকার।
দোলন আর রাকাকে আগে থেকেই চিনি। এদের ব্যাপারে আর কি বলব। বিশাল সিং এসেছে, আর তার সাথে এসেছে আরেকজন দীর্ঘকায় ছেলে। জানতে পারলাম তার নাম শুভ। এই হল বিশালের সেই বিখ্যাত দাদা। শুভ বারবার ঘড়ি দেখছে, যেন কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। আরেকজন এসেছে, সুনীল সরকার। বেচারা কুন্তল যদি জানতে পারত যে ওর বন্ধু এই ভিলেন সুনীলের সাথে পার্টি করতে ঢুকছে তাহলে বোধহয় মর্মাহত হয়ে পড়ত। মালিনীর কথা ছেড়েই দিলাম। আরেকজন মেয়ে এসেছে, জানলাম তার নাম হল সুচেতা। বাহ। বেশ মিষ্টি মেয়েটা। সুচেতার বয়স মনে হল বিশালের সমান। এটাও দেখে মনে হল যে সুচেতা আর বিশালের মধ্যে কেমন যেন একটু ইয়ে ইয়ে ব্যাপার আছে। কিন্তু আরেকটা জিনিসও আমার চোখ এরায়নি। দেখে মনে হল সুচেতা আর শুভর মধ্যেও একটা ইয়ে ইয়ে ব্যাপার আছে।
আগেই বলেছি যে বিশাল আর রাকা একে ওপরের পূর্ব পরিচিত। অবশ্য আজ এই অবস্থায় দেখে মনে হল যে বিশালের রাকার ব্যাপারে তেমন কোনও ছুঁক ছুঁক ভাব না থাকলেও, রাকার বিশালের ওপর একটা অদৃশ্য টান আছে। অবশ্য বাইরে থেকে রাকার হাব ভাব দেখে সেটা বোঝা শক্ত। বিশালের সাথে কথা বলার সময় একদম সাধারান ভাবে কথা বলছে, ভাব খানা এমন যেন বিশালের প্রতি ওর তেমন কোনও অনুভূতি নেই। কিন্তু বিশালের সুচেতার সাথে মাখা মাখিটা যে ও সহজ ভাবে মেনে নিতে পারছে না সেটা ওকে একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলেই ধরা যায়।
ব্যাপারটা কি একটু বেশীই জটিল বানিয়ে ফেলেছি? তাহলে সহজ ভাবে বলি। বিশাল সুচেতাকে পছন্দ করে, আর প্রকাশ্যে হাবে ভাবে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটা বেশী রকম গায়ে পড়া ভাব। সুচেতা বিশালকে ঠ্যাকা দিয়ে চললেও বোঝা যায় যে ওর আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্ধু হল শুভ। শুভ যে কার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা বলা শক্ত। আর এই দিকে আমাদের ক্লাসের রাকা বিশালের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। মোটের ওপর এই। দোলন হঠাত বলে উঠল “এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। শুভ, চলো ভেতরে ঢুকে পড়ি। লেটস এনজয়।”
শুভ বলল “সে তো ঠিকই বলছিস। কিন্তু যে পার্টি দেবে বলেছে সেই না এলে বিলটা কে মেটাবে শুনি?” সবাই হেঁসে উঠল। আমি হাঁসতে পারলাম না, কারণ আমি জানি না যে কে এই পার্টিটা থ্রো করেছে। দোলন আর সুনীল এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আমরা ঢিলে ঢালা তালে ওর পিছু নিলাম। হোটেলের ভেতরটা আলো আধারিতে ভরা। বিভিন্ন রঙ বেরঙের আলো এদিক ওদিক ঠিকরে পড়ছে বেশ কয়েকটা গোলাকৃতি বস্তুর ভেতর থেকে। উচ্চস্বরে মিউজিক চলছে। গানের তালে তালে, বা বলা ভালো মিউজিকের তালে তালে সেই গোলাকৃতি পিণ্ডটার থেকে রঙ বেরঙের আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে চতুর্দিকে। সিট নাকি রিজার্ভ করা আছে। তবে সিট অব্দি পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হল। কারণ, অন্ধকারে, এতগুলো নৃত্যরত বিভিন্ন বয়সের উন্মাদ নরনারীর ধাক্কা সামলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাও একটা চ্যালেঞ্জ।
তবে সিট অব্দি পৌঁছাতে হল না, তার আগেই, একটা ব্যাপার দেখে থমকে না গিয়ে পারলাম না। আমি দোলনের হাতটা চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “দীপকদাও কি জয়েন করবে নাকি?” ও যেন একটু আশ্চর্য হয়েই চারপাশটা একবার দেখে নিল। তার পর গলা তুলে বলল “কেন?” বললাম “ওই যে দেখ।” এত শব্দের জন্য আমাদের সবাইকে গলা তুলে কথা বলতে হচ্ছে। আমি জানি না আমাদের সিট কোথায়। কিন্তু একটু দূরে দেখতে পেলাম যে দীপক আর আরেকটা মেয়ে গায়ে ঢলাঢলি করে বসে আছে। অন্ধকারে আরেকটু চোখ সয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, ইনি আমাদের পূর্ব পরিচিতা শিখাদি।
ওদের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল “শালা রাখেল নিয়ে এসেছে।” বিভিন্ন কারণে দীপকের ব্যাপারে দোলন যদিও কলেজে কোনও রকম মুখ খুলতে পারে না প্রকাশ্যে, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম যে দীপক আর শিখার ব্যাপারে ওর ধারণা কেমন। আমি ওকে একটা চোখ মেরে বললাম “কথাটা কি সত্যি?” দোলন বলল “ না তো কি?” রাকাও দেখেছে দীপক আর শিখা কে। আমাদের জন্য একটা বড় টেবিল বুক করা ছিল। আমি টেবিলে পৌঁছেই ওদের বললাম “এক্সিউজ মি। আমি একটু আসছি।”
সবাই আমার দিকে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম “ দীপকদার সাথে এই গতকাল আলাপ হল। আরেকবার দেখা করে আসি।” ওদের মুখে চাপা বিরক্তির ভাব। কেউ যে ওদের সহ্য করতে পারে না সেটা আরও স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেয়ে গেল ওদের হাবে ভাবে। আমি বললাম “আমি বাইরের ছেলে। ওর সাথে একটু দোস্তি রেখে চললে পরের কয়েকটা বছর এখানে শান্তিতে কাটাতে পারব।”
কিন্তু আমার যাওয়া হল না। কারণ ওদের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, দোলন আমার একটা হাত চেপে ধরে বলল “চুপ করে বস। ওকে অত মাথায় তোলার দরকার নেই। “ কথাটা ও মিথ্যে বলেনি। অগত্যা। আমি বসে পড়লাম। শুভ বসেই মোবাইলে কি একটা দেখতে শুরু করে দিয়েছে। দোলন, রাকা, সুচেতা সবার গায়েই একটা করে শাঙ্ক বা জ্যাকেটের মতন জিনিস পরা ছিল। সিটে বসার আগে গায়ের জ্যাকেটগুলো সবাই খুলে সিটের পেছনে মেলে দিল।
উফফ এক লাফে আমার বাঁড়াটা খাড়া হয়ে গেল। তিনটে মেয়েই যেন একে ওপরের সাথে আলোচনা করে একই রকম ম্যাচিং ড্রেস পরে এসেছে। তিন জনের পরনেই কালো রঙের একদম একই রকমের পোশাক। এগুলোকে বলে টিউব ড্রেস। যারা জানে না কেমন দেখতে হয় এমন পোশাক তাদের জন্য একটু বুঝিয়ে রাখা ভালো। স্ট্র্যাপ বিহীন চামড়ার তৈরি এক ধরণের পোশাক যেটা বুকের ঠিক ওপর থেকে শুরু করে থাইয়ের মাঝ অব্দি নেমে এসেছে শরীরটাকে গোল ভাবে জড়িয়ে রেখে। স্তনের ওপর থেকে গলা অব্দি, আর থাইয়ের নিচ থেকে গোড়ালি সবটাই নগ্ন। তিন জনেরই গলায় একটা করে সরু সোনার চেন। সোনার চেনটা যেন ওদের শারীরিক সৌন্দর্য আরও দশ গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। সমস্যা হল, অন্য জায়গা হলে এতক্ষন মাগীগুলোকে চোখ দিয়ে গিলে খেতাম। কিন্তু এখানে ওদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা যাবে না। হায় রে আমার পোড়া কপাল।
অবশ্য এই পরিবেশে এই রকম পোশাক খুবই সাধারণ। দোলন বলল “পাঁচ মিনিট ওয়েট করা যাক। তারপর, আর নয়। অর্ডার দিয়ে দেব তারপর। “ সবাই সম্মতি জানালাম। তবে পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে হল না। এরই মধ্যে শুভর কাছে একটা কল এলো। শুভ গলা চড়িয়ে ঠিক কি বলল সেটা এই চড়া মিউজিকের জন্য শুনতে পেলাম না, কিন্তু মিনিট দুয়েকের মধ্যেই দেখলাম একটা মাঝারি উচ্চতার ছেলে এসে হাজির হয়েছে আমার টেবিলে। গায়ের রঙ ফর্সা, স্বাস্থ্য ভালো। আলাপ হতে জানলাম, এর নাম শান্তনু মুখার্জি। ইনি দোলনের সেই আমেরিকান দাদা। ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য এসেছে কলকাতায়, আর এরই অনারে আজ এই পার্টি। আর ইনিই আজকের পার্টির বিল মেটাবে।
ও আসতেই ড্রিঙ্কস আর খাবার দাবারের অর্ডার দিয়ে দেওয়া হল। শান্তনু গিয়ে বসেছে শুভর পাশে। আর শুভর আরেক পাশে বসেছে সুচেতা। আর সুচেতার পাশে বিশাল। ওই দিকে আর জায়গা না থাকায়, দোলন আর রাকা বসেছে আমার দুপাশে, আর রাকার পাশে বসেছে সুনীল। মদের গ্লাসে প্রথম চুমুক দিতে না দিতেই শুভ শান্তনুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “তাহলে মিস্টার এন আর এই, আমাদের আজকের প্রোগ্রাম ফাইনাল তো?”
সবার মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারলাম যে দোলন ছাড়া সবার মুখেই একটা বিস্ময়ের ছায়া। মানে দোলন, শান্তনু আর শুভ ছাড়া এই ব্যাপারে কেউই কিছু জানে না। শুভ সবার মুখের এই কৌতূহলী ভাবটা লক্ষ্য করেই বোধহয় ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলল। “ আরে শান্তনুর সাথে অনেক দিন ধরে প্ল্যান করেছিলাম যে এই বার ও ইন্ডিয়ায় এলে দুই তিন দিনের জন্য মন্দারমনির দিকে ঢু মারব। এদিকে নেক্সট উইক থেকে আমাকে একটু কাজের ব্যাপারে বাইরে বাইরে থাকতে হবে। আর …” শান্তনু বাকি কথাটা শেষ করল “ আর আমাকেও নেক্সট উইক থেকে এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে বেড়াতে হবে। জত্ত সব। যাই হোক। তাই খুব সম্ভবত আর সময় পাওয়া যাবে না। তাই আজকেই …”
গ্লাসে আরেকটা চুমুক মেরে বলল “ বাই দা অয়ে, তোরা কেউ জয়েন করতে চাইলে এখনই বল। কারণ লোক বেশী হলে সেই মতন গাড়ির ব্যবস্থাও করতে হবে।” শুভ বলল “ইয়েস। তবে আমাদের গাড়িতে এখনও জায়গা আছে। “ দিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল “কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি এসে পড়বে। কেউ যেতে চাইলে এখনই বলতে হবে। “ দোলন জানিয়ে দিল যে ওর যাওয়া হবে না। রাকারও যাওয়া হবে না। আমার যে যাওয়া হবে না সেটা বলাই বাহুল্য। মাঝখান থেকে দেখলাম সুনীল ওদের দলে ভিড়ে গেল।
বিশাল প্রথমে ওদের সাথে যেতে চাইছিল না। কিন্তু, সুচেতা হঠাত করে ওদের দলে ভিড়ে যেতেই দেখলাম বিশালও নিজের মত পাল্টে ওদের দলে ভিড়ে পড়ল। সুচেতা যাবে বলেই যে বিশাল ওদের সাথে যেতে রাজি হয়েছে সেটা জলের মতন পরিষ্কার। এই দিকে বিশাল সুচেতার সাথে যাচ্ছে জেনে রাকার চোখ মুখের কি অবস্থা হল সেটা আর দেখতে পেলাম না। রাকা আমার পাশে না বসে সামনে বসলে ভালো করে ওর রিয়েকশনটা উপভোগ করতে পারতাম। হেহে। কিন্তু ও যে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে সেটা প্রকাশ পেল ওর পরের কথাতেই।