05-03-2019, 02:47 PM
বেড়িয়ে আসার সময়ই জানলা দিয়ে দেখে নিয়েছিলাম যে রাস্তা জনমুখর হতে শুরু করে দিয়েছে। সুতরাং একটা ট্যাক্সি পাওয়া বোধহয় খুবই সোজা হবে। মেইন গেট দিয়ে সিকিউরিটির সেলুট হজম করে বাইরে বেড়িয়ে আসতে না আসতেই অবশ্য হুঁশ করে দুটো ট্যাক্সি আমার নাকের সমানে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু ওগুলোকে আটকালাম না। হোটেলের উল্টো ফুটে একটু দূরে একটা বড় পান সিগারেটের দোকান আসার সময়ই দেখেছিলাম। এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। একটা বড় ক্লাসিকের প্যাকেট কিনে পকেটে চালান করে দিয়ে ট্যাক্সির খোঁজে এগিয়ে গেলাম। হ্যাঁ আমার বয়স কুড়ি হলেও আমি একজন চেইন স্মোকার। সজ্ঞানে থেকে ড্রিঙ্কও করতে পারি প্রচুর। অবশ্য এমন নয় যে মদ আর সিগারেট ছাড়া আমার পাগল পাগল লাগে। দিনের পর দিন সিগারেট আর মদ ছাড়াও কাটাতে আমার বিন্দু মাত্র অসুবিধা হয় না। সবই কন্ট্রোল আর অভ্যেস। তবে নেশা যে করি সেটা অস্বীকার করব না। একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করালাম। চালক একজন বয়স্ক সর্দারজি। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাব। বললাম “অনেক জায়গায় যেতে হবে। আর একটু তাড়া আছে। “ আমার বয়স অল্প বলেই বোধহয় সর্দারজি কোথায় যাব সেটা আরও জোড় দিয়ে জানতে চাইল। আমিও একই রকম গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিলাম “ধর্মতলা যাব, সেখান থেকে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি আসব, সেখান থেকে যাদবপুর যাব, সেখান থেকে হাতে সময় থাকলে খিদিরপুর যাব।” লোকটা আমার এই বিচিত্র প্ল্যান শুনে বলল “তাহলে প্রথমে খিদির পুরেই চলুন।” আমি মাথা নেড়ে বললাম “না হে সর্দারজি। এখন খিদিরপুরে গিয়ে কোনও লাভ নেই। ওখানে গিয়ে কোনও কাজ হবে না। সময়ের আগে কোথাও গিয়ে কি লাভ!” ওর মতামতের জন্য অপেক্ষা না করেই আমি পেছনের দরজা খুলে উঠে ওর দিকে একটা ক্লাসিক সিগারেট এগিয়ে দিলাম। বললাম “ইয়ে লিজিয়ে। আর চলুন। ৫০ টাকা বাড়তি দেব। “ শেষ কথাটায় কাজ হয়ে গেল। কারণ গাড়ি গড়িয়ে চলল সামনের দিকে। সর্দারজি হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে ও সিগারেট খায় না। আমি বললাম “আমি সিগারেট খেলে সমস্যা নেই তো?” সর্দারজি বয়সে আমার থেকে অনেক অনেক বড়, মাথার সব চুল পাকা। কিন্তু তাও অচেনা বয়স্ক লোকের সামনে সিগারেট খেতে আমার কোনও লজ্জা হয় না। মফস্বল হলে অবশ্য অন্য ব্যাপার ছিল। কিন্তু এত বড় শহরে এত কিছু মেনে চলার কোনও মানে হয় না। সর্দারজি আমাকে জানিয়ে দিল যে ওর সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি। আমি উত্তরে বললাম “ধর্মতলায় আমার আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। তখন নাস্তা করে নিও খন।” ব্যস এর পর আমাদের মধ্যে আর কোনও কথা হয় নি। আগেই বলেছি, প্রয়োজনের থেকে বেশী কথা বলা বা কাজ করা আমি পছন্দ করি না। নিরবে শহরের রাস্তা ঘাট মুখস্থ করতে করতে এগিয়ে চললাম ধর্মতলার দিকে।
ধর্মতলায় গন্তব্য স্থলে যখন পৌছালাম সূর্য তখন মাথার ওপরে। ট্যাক্সি ওয়ালাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম “ ওই যে বলেছিলাম এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা দেব, সেটা দিয়ে দিলাম। আপনি খেয়ে নিন। আমার কিছুক্ষণ সময় লাগবে।” যে বাড়িটায় ঢুকলাম সেটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি বোধহয়। সেকেলে চেহারা। ভয় হয় একটু জোড়ে হাওয়া দিলেই হয়ত ইট পাথর সমেত পুরো ইমারতটাই ধ্বসে পড়বে। আমাকে যেতে হবে তিন তলায়। বাবার তেজারতির একটা কারবার চলে এখান থেকে। যে চালায় তাকে আমি চিনি। আগে আমাদের প্রতিবেশী ছিল। কাজ না পেয়ে বেশ কিছু দিন বসে ছিল বলে বাবা এখানে কাজের ভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশ বিশ্বস্ত লোক তাতে সন্দেহ নেই। বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই। তিন কূলে কেউ নেই। শুনেছি যে খুব অল্প বয়সে একবার বিয়ে করেছিল, কিন্তু পোয়াতি বউকে হাঁসপাতালে নিয়ে যেতে দেরী হওয়ায় রাস্তাতেই ওর বউ ওর ওর বউয়ের পেটের ভিতরে বাচ্চাটা শেষ হয়ে গেছে। নাম হরিপদ। আমরা হরিদা বলেই সবাই ডাকি। হরিদার কাছ থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আরেকজনকে দিতে হবে। হরিদা হয়ত নিজেই গিয়ে দিয়ে আসত, কিন্তু এই গদি ছেড়ে যাওয়ার জো নেই তার। দেখলাম সব কিছু তৈরি করেই রেখেছিল ও। আমাকে এক কাপ চা খাইয়েই একটা বড় ক্যাম্বিশের ব্যাগে সব জিনিস হস্তান্তরিত করে দিল। আমি ব্যাগের চেনটা খুলে জিনিস গুলো ভেতর থেকেই একবার নেড়ে ঘেঁটে দেখে নিলাম। সব ঠিক আছে। ভেতরে একটা লেদারের ব্যাগও দেখলাম। ওটাকেও একবার খুলে ভেতরে কি কাগজ পত্র আছে উপর উপর দেখে নিলাম। তেজারতির কারবারের ঝুঁকি তো আছেই, আর তার অপর বিষ ফোঁড়ার মতন আছে এক গাদা হিসেব নিকেশ। এখানকার কাজ মিটেছে। ওর ঘুপচির মতন ঘরের জানলা দিয়ে একবার বাইরে রাস্তার দিকে উঁকি মারলাম। উল্টো ফুটে আমার ট্যাক্সির চালককে দেখলাম কব্জি ডুবিয়ে মুড়ি আর ঘুগনি খাচ্ছে। এখনও খাওয়া বাকি। রাস্তাটা গাড়ি ঘোড়া আর লোক জনে ভরে গেছে। সবাই ব্যস্ত। আমার ল্যাপটপের ব্যাগটা থেকে আমার সেই মোবাইলটা বের করে সেটাকে অন করলাম। এটাকে আমি এমনিতে অফ করেই রাখি। ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নয়। এমনি রাখি। এর ব্যাটারি একবার ফুল চার্জ দিলে তিন দিনেও শেষ হয় না। হরিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে ট্যাক্সিটার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা হাঁসি হাঁসি মুখে সেলফি নিলাম। ওই যে বললাম বিপদ, পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছিল সবাই আমার হাতের মোবাইলটার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাতে তাকাতে গেল। সময় নষ্ট না করে ফেসবুকে লগ ইন করে সদ্য তোলা ছবিটা আপলোড করে দিলাম। ক্যাপশন দিলাম “ কোলকাতায় প্রথম দিন। জমজমাট ঐতিহাসিক ধর্মতলা… বেশ ভালো লাগলো… (পাঁচটা স্মাইলি)” । আসলে নতুন জায়গায় এসে একটাও সেলফি তুলে পোস্ট না করলে চলে? সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো! মোবাইলটা আবার অফ করে ব্যাগের ভিতর চালান দিয়ে দিলাম সযত্নে। অবশ্য অফ করার আগে কয়েকটা জিনিস চেক করতে ভুললাম না। কাজের কিছু নেই।
ধেয়ে চললাম বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে। পৌঁছাতে বেশ সময় লাগলো। ট্রাফিক বড্ড বেশী। আজ আমার কলেজের প্রথম দিন। মনে হয় ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রথম দিন খুব একটা কিছু পড়াশুনা হবে বলে মনে হয় না। এখানে একটা সাইবার ক্যাফের মালিকের সাথে কাজ। ভদ্রলোক এক যুগ আগে বাবার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। সেই টাকা আর ফেরত দেয় নি। অনেক দিন জোরাজুরি করার পর অবশেষে লোকটা বাবার কাছে দোকানটা বেচে দিয়েছে। বাবা কিন্তু লোকটাকে তাড়িয়ে দেয় নি। বাবার মন এই সব দিক থেকে ভীষণ উদার। বাবা এখন এই ক্যাফের মালিক। লোকটা ম্যানেজারির কাজ করে। আমরা সবাই একে শুভদা বলে ডাকি। উত্তর প্রদেশ থেকে বাবার সাথে এর চেনাশুনা। বাঙালি হলেও কথা বার্তায় এখনও একটা হিন্দি হিন্দি ছাপ রয়ে গেছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। অফিসের ভেতরে একটা লকার আছে। সেখানে থেকে আরেকটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। শালা, এই বাবার চক্করে পড়ে পড়াশুনা মাথায় উঠবে। এখানে এসে তোলাবাজির কারবারে যোগ দিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ব্যাগের ভেতরটা দেখে নিলাম। শুভদা বলল “সামনে ধাবা আছে। কিছু খাবে না কি?” আমি মাথা নেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ট্যাক্সিটা দেখলাম কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে এক মিনিট দাঁড়াতে বললাম। সেই মোবাইলটা বের করে জানলার একদম ধার ঘেঁসে বসে রাস্তার দিকে তাক করে চারপাশের দৃশ্য সমেত নিজের আরেকটা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দিলাম। ক্যাপশন “ রমরমা বালিগঞ্জ। সামনের ধাবাতে একবার আসতে হচ্ছে… বেশ ভালো লাগলো।” আগের ছবিটায় দেখলাম কয়েকজন কমেন্ট দিয়েছে। কিছু সেসব পড়ার সময় এখন নয়। গাড়ি এগিয়ে চলল আর আমার মোবাইলটা আবার ব্যাগের ভিতর চালান হয়ে গেল। বালিগঞ্জ থেকে যাদবপুর পৌঁছাতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগলো। পথে অবশ্য একটা ফোন করে একজনকে জানিয়ে দিলাম যে আমি আসছি। থানার ঠিক সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ধর্মতলা আর বালিগঞ্জ থেকে কালেক্ট করা ব্যাগ দুটো এক জনের হাতে তুলে দিলাম। এর নাম বাবুয়া। ফোনে কোথায় থাকবে, কি পরে এসেছে এইসব কথা হয়েই গেছিল। লোকটা বোকা বোকা মুখে একটা ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি থানার সামনেই তাকে দাঁড় করালাম। সর্দারজি থানার সামনে এতক্ষন ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাখায় গাঁই গুই করছিল, পুলিশের ভয় আর কি, কেস দেবে! কিন্তু আমি কোনও পাত্তাই দিলাম না। এই বাবুয়াকে দেখে খুব সরল মনে হয়েছে আমার। এর সাথে একটা সেলফি না তুললেই নয়। হ্যাঁ, সেলফি তোলাটা আমার একটা নেশা। শুধু সেলফি নয়, ছবি তোলাও আমার একটা নেশা। থানাটাকে ব্যাক গ্রাউন্ডে রেখে ওর সাথে আমার একটা সেলফি তুললাম। একটা পুলিশ আমাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল সেটা দেখেছি, কিন্তু ওকেও পাত্তা দিলাম না। প্রথম দিন কোলকাতায় এসে গোটা পাঁচেক সেলফি না তুললে আর কি কারণে ফেসবুক করি। ওকে ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকে আপলোড করলাম, ক্যাপশনঃ “ কোলকাতার প্রথম বন্ধু বাবুয়া...মন্দ লাগলো না।” সময় দেখে ঠিক করলাম খিদিরপুর আজই যাব। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। না কোনও কেস খাই নি আমরা।
এখানে যার সাথে দেখা করব তার নাম আব্দুল। লোকটার বয়স খুব বেশী হলে ৩২। আর বেশ শক্ত পোক্ত। চা খেয়ে এর সাথে অনেক গল্প হল। ওর কাছ থেকে দুটো কাগজ ভর্তি হিসাবের ব্যাগ নিয়ে আমার ল্যাপটপের ব্যাগের ভেতর পুড়ে রওয়ানা হলাম। ঠিক হল সামনের শনিবার এসে ওর কাছ থেকে একটা বড় লেন্স কিনব। এটা আমার অনেক দিনের সখ। বাবা কে এই লেন্সের কথা আগেই বলে রেখেছিলাম। আর আব্দুলের দোকান থেকে কিনব বলেই ঠিক করা ছিল কারণ আব্দুলকেও আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। বাবারও লেন্সের আর ক্যামেরার সখ ছিল একটা বয়সে। তবে সেযুগে এত অত্যাধুনিক লেন্স বা ক্যামেরা ছিল না। বাজারে কিনতে গেলে এই লেন্সের দাম যে কত পড়বে তার কোনও ঠিক নেই। বাবা আমাকে অবশ্য একটা ভীষণ ভালো ক্যামেরা আগেই কিনে দিয়েছিল। তবে লেন্স ছিল না। বেশ একটা টেলিস্কোপিক লেন্স না থাকলে এত ভালো ক্যামেরা দিয়ে কি হবে। তবে অনেক রকমের লেন্স হয় এই জগতে। ধীরে ধীরে জমাতে হবে। হ্যাঁ আমি বড়লোক বাপের একটি মোটামুটি বিগ্রে যাওয়া ছেলে হয়ে গেছি তাতে সন্দেহ নেই। কোলকাতার বিষাক্ত বায়ুর ভেতরে এতক্ষন ঘেমে নেয়ে আর কলেজে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে হচ্ছিল না। আর হ্যাঁ ট্যাক্সিতে ওঠার আগে ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করতে ভুললাম না, এইবারের ক্যাপশনঃ এই নাকি সেই খিদিরপুর, কি ভিড়রে বাবা। তবে...বেশ ভালো লাগলো…” জানি বোকা বোকা ক্যাপশন, কিন্তু এছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম “চলিয়ে। যেখান থেকে আমাকে উঠিয়েছিলে সেখানেই গিয়ে আবার আমাকে ছেড়ে দাও।” ট্যাক্সির ড্রাইভার যে এই গরমে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ট্যাক্সির মিটার যা উঠেছে সেটা দেখেই বোধহয় মুখে কিছু বলছে না। হোটেলের কিছু আগেই আমি ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলাম। তবে যাত্রা শেষে যখন ট্যাক্সির ভাড়াটা মেটাচ্ছিলাম তখন মনে মনে বললাম সর্দারজি, বোধহয় সারা সপ্তাহের সওয়ারির ভাড়া আজ এক বেলাতে পেয়ে গেলে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম কলেজের দিকে। হোটেল থেকে কলেজ পায়ে হেঁটে খুব বেশী হলে ১০ মিনিট। আমার হাঁটতে খারাপ লাগে না। আর গরম যতই বেশী হোক না কেন, এই গরম আর ঘাম সহ্য করার যথেষ্ট অভ্যেস আমার আছে। এখানে রিক্সা ধরার কোনও মানে নেই। তবে আমি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটি। তাই দশ মিনিটের রাস্তাটা যেতে আমার লাগলো ঠিক সাড়ে চার মিনিট।
সোজা চলে গেলাম কলেজের অ্যাঁকাউন্টস সেকশনে। কাউন্টার খালি দেখে কলেজ ফি জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে, আমার ডিপার্টমেন্টে এসে ফর্ম ফিল আপ করে সব মিটিয়ে যখন ক্লাসে পৌছালাম তখন সেকন্ড হাফের ফার্স্ট ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। প্রায় পনের মিনিট পরে ক্লাসে আসায় আর তাও প্রথম দিন, স্যার যারপরনাই বিরক্ত হলেন সেটা আর বলে দিতে লাগে না। “এত লেট কেন? আর প্রথম দিনেই এই অবস্থা। তোমার তো লেজ গজাতে বেশী সময় লাগবে না হে। মনে রেখো পাশ ফেল এখানে সব আমাদের হাতে। “ আমি মাটির দিকে মুখ নামিয়ে রেখে ওনার সব তিরস্কার সহ্য করলাম। অবশ্য এখানে একটা কথা বলে রাখি, তাড়াহুড়ায় বলতে ভুলে গেছিলাম। সব ব্যাপার মিটিয়ে ক্লাসে আসার ঠিক আগে বাথরুমে গেছিলাম। সেখানে একটা আনঅকুপাইড ল্যাট্রিনের কেবিনে ঢুকে দরজা দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ধবধবে সাদা ফুল হাতা শার্ট আর কালো ফরম্যাল প্যান্ট বের করে চেঞ্জ করে নিলাম। শু পরেই বেড়িয়ে ছিলাম। পরনের স্টাইলিশ জিন্স আর টি শার্ট টা ব্যাগে চালান করে দিলাম। এরকম জিন্স আর টি শার্ট পরে এখানকার ছেলে মেয়েরা কলেজে আসতে পারে, কিন্তু আমার রুচিতে সেটা বাঁধে। যাইহোক স্যারের তিরস্কার শেষ হলে মাটির দিকে তাকিয়েই খুব নরম কিন্তু পরিষ্কার ভাবে বললাম “স্যার, ভুল হয়ে গেছে। আসলে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসছি। ট্রেন অনেকক্ষণ লেট ছিল। এই পৌছালাম। কোনও মতে একটা ধর্মশালায় জিনিস রেখে রিক্সা ধরে এসেছি। আর এখানকার অ্যাঁকাউন্টসেও যা লাইন…” স্যারের বোধহয় একটু মায়া হল, “ঠিক আছে, যাও। পরের দিন থেকে লেট হলে অ্যাঁটেনড্যান্স পাবে না। নাম কি?” বললাম । স্যার একটা হুম মতন শব্দ করলেন শুধু। আমি চুপ চাপ গিয়ে একটা খালি সিট দেখে বসে পড়লাম। দরজা থেকে সিট অব্দি একবারও মাটির ওপর থেকে চোখ তুলিনি। ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর পেন বের করে রেডি হলাম। স্যার বললেন “তোমার রোল হল ছাব্বিশ।” উঠে দাঁড়িয়ে বললাম “ওকে স্যার।” বসে পড়লাম। এত ভদ্রতা বোধহয় এখানকার শহুরে ছাত্র দের কাছ থেকে স্যারেরা এক্সপেক্ট করেন না। আমার হাবভাব দেখে বোধহয় এরা সবাই আমাকে একটা গাইয়া ভুত বলেই ধরে নিয়েছে। তাতে আমার কি বা এলো গেলো। ক্লাসে তেমন কিছুই হল না। কারণ এখন শুধু সিলেবাস দিচ্ছে। খেয়াল করলাম আমি যেমন আড়চোখে মোটামুটি সবাইকে একবার দেখে নিলাম, তেমনি অনেকেই আমাকেও ঘুরে ঘুরে আড়চোখে লক্ষ্য করছে। কারণ বোধহয় একটাই, এরকম ভদ্র ভাবে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে আর কেউ আসেনি। ভাগ্যিস আসার আগে মাথায় তেল ঢেলে স্নান করে আসিনি, তাহলে আর দেখতে হত না। এখানে একটা কথা বলে রাখি, গোপালবাজার না বলে উত্তরপ্রদেশ বলার কারণ একটাই। গোপালবাজার কোলকাতার তাও কাছে। বলা যায় না যদি আমারই মতন সেখান থেকে কেউ ট্রেনে এসে থাকে। তাহলে কেস খেয়ে যাব। উত্তর প্রদেশ থেকে কেউ এসেছে সেটা বিশ্বাস হয় না। আশা করছি স্যার টিকিট দেখতে চাইবেন না কোনও দিনও। চাইলে বলব চেকারের কাছে দিয়ে দিয়েছি ষ্টেশন ছাড়ার আগে।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক সময় পেয়েছিলাম। এইবার একটু সাবলীল ভাবে সবার মুখের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। বেশ কয়েকজনের সাথে সরাসরি চোখাচুখিও হল। সবার কথা বলার এখন কোনও মানে নেই। তবে দু একটা জিনিস চোখে পড়ল। ক্লাসে মোটামুটি একটা গ্রুপ আছে খুব বড়লোক ছেলে মেয়ের। তাদের বেশভূষাই সে কথার জানান দিচ্ছে। গ্রুপ বললাম কারণ তাদের মধ্যে এই প্রথম দিনেই যে রকম ইয়ার্কি ফাজলামি হচ্ছে আর তাও বেশ জোড়ে জোড়ে সেটা থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে এরা হয় আগে থেকেই নিজেদের চেনে, অথবা, একই গোত্রীয় রক্ত বলে প্রথম দিনেই এদের মধ্যে একটা ভাব হয়ে গেছে। যাদের বেশ ভুষা সাধারণ, তারা কেমন একটা সিটিয়ে আছে প্রথম দিন বলে। আর দুই তিন জন ছেলে আর মেয়ের মুখে বেশ একটা দাদা দিদি মার্কা ভাব...মানে ইতিমধ্যে ওরা নিজেদেরকে ক্লাসের লিডার বলে ধরে নিয়েছে। পরের ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমার পাশে বসা ছেলেটা আমার সাথে আলাপ করল যেচে। যদিও আমি প্রয়োজন ছাড়া কারোর সাথে কথা বলি না, তবুও একসাথে পড়তে গেলে কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে হবে বই কি। আর সেটা খুব দরকারিও বটে। ওকে আমি আগেই লক্ষ্য করেছি। পরনে একটা ঢিলা ফতুয়া মার্কা শার্ট আর জিন্স। একদম সাধারণ বেশ ভুষা। কথা বার্তাও সরল। চোখে মুখে একটা সারল্য আছে। সোজাসুজি আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল “আমার নাম কুন্তল রাহা।” আমার নামটা এই ক্লাসের সকলের ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে। ও ভীষণ গলা নামিয়ে কথা বলছে, যেন একটা ভীষণ ভয় ওকে চেপে ধরে রেখেছে। বলল “একা এসেছ?” বললাম “হ্যাঁ। বাবা গোপালবাজারে থাকে। কিন্তু এখনও দেখা হয় নি। ওর কাজের চাপ চলছে।” ও বলল “ইউপির কোথায় বাড়ি?” বললাম “মিরাট।” বলল “ সেকন্ড হাফে এসে ভালোই করেছ। টিফিনের সময় যা হল সেটা বলার নয়।” বললাম “কিরকম?” বলল “র্যাগিং।” হ্যাঁ এইটাও আমার অজানা নয়। আর এই ব্যাপারটা কি সেটা দেখার জন্য আমার ভীষণ কৌতূহলও আছে। বলল “কাল আবার হবে। টানা এক মাস ধরে হবে। “ ওর মুখটা সরল আর গোলগাল, বেশ একটু মোটার দিকেই পড়ে, শরীরটা বেশ ভারী, কারণ বেঞ্চের ওপর যখন নড়াচড়া করছে তখন প্রায় পুরো বেঞ্চটাই যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর বুঝতে পারলাম কেমন জানি একঘরে হয়ে রয়েছে ছেলেটা। কারণ এই ক্লাসরুমে বেঞ্চে দুজন করে বসার জায়গা। ও বসে আছে থার্ড রো তে , কিন্তু ওর পাশে আমার আগে এসে কেউ বসে নি। কেন কে জানে। হতে পারে ভুল্লু টাইপের ছেলের সাথে যেচে পড়তে কেউ আলাপ করতে চায় না। তবে ছেলেটাকে আমার খারাপ মনে হল না। তবে আর একটু আলাপ জমানোর আগেই স্যার এসে উপস্থিত হলেন। তবে এই স্যার বেশ মিশুকে আর ভালো। সবার নাম ধাম একে একে জিজ্ঞেস করলেন। আগে কোথায় পড়তাম, কি হবি সব একে একে জিজ্ঞেস করলেন। বাড়িতে কে কে আছে, বাবা মা ভাই বোন দাদা বৌদি, এমনকি ঠাকুরদা ঠাকুমা কারোর ব্যাপারেই খোঁজ নিতে উনি বাকি রাখলেন না। এতে আমার দুটো লাভ হল। সবার বাড়ির হাঁড়ির খবর আমার জানা হয়ে গেল। একটু আগে আমার সহপাঠীদের দিকে তাকিয়ে আমার যে ধারণাটা হয়েছিল সেটা যে একদম ঠিক সেটা বুঝতে পারলাম। আর তাছাড়া খবর জোগাড় করে রাখা সব সময়ই ভালো, বলা তো যায় না কখন কোন খবরটা কাজে লেগে যায়। এই “বিশেষ” লাভটা ছাড়াও আরেকটা লাভ হল আর সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য। পৃথিবী যে গোল সেটা যে বলেছিল সে খুব ভুল বলেনি। আর গোল মানে পুরো গোল সেটা বুঝতে পারলাম যখন আমার পাশে বসে থাকা কুন্তল ওর পরিচয় দিল। “স্যার, আমার নাম কুন্তল রাহা। বাবার নাম বিনয় রাহা। মার নাম রাধিকা রাহা। বাবা শরীর ভেঙ্গে যাওয়ায় রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছেন। এখন একটা মুদির দোকান দিয়েছেন। আগে কলকাতা দমকল বিভাগে ছিলেন। মা হোম মেকার। এক দিদি আছে। নাম মালিনী রাহা। বিয়ে হয়ে গেছে। দিদি একটা বড় হোটেলে কাজ করে। হবি ছবি আঁকা আর গল্পের বই পড়া। এন্ট্রান্সে র্যাঙ্ক…” স্যার অবশ্য ওকে জিজ্ঞেস করলেন যে “ কেমন ধরণের গল্পের বই পড়ার অভ্যেস। ইংরেজি না বাংলা। “ এরকম আরও কিছু। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে দিদির নাম মালিনী রাহা, বড় হোটেলে চাকরি করে। এটা কি সংযোগ না অন্য কিছু। হয়ত পরে জানতে পারব ওর দিদির বিয়ের পর পদবী হয়েছে ব্যানার্জি বা মুখার্জি। ব্যস তাহলেই হয়ে গেল। আর হোটেলের নামও বোধহয় অন্য। তাও এটা একবার বাজিয়ে দেখা দরকার। ওকে স্যার বললেন তোমার আঁকা ছবি আমি অবশ্যই একবার দেখব। ও বসল আর আমি উঠে দাঁড়ালাম। “নাম সংকেত রায়।” সাথে সাথে প্রশ্ন এলো, “কিসের সংকেত।” এই প্রশ্ন শুনে শুনে আমি বোর হয়ে গেছি। হেঁসে বললাম “স্যার মুক্তির সংকেত।” স্যার বললেন “কিসের থেকে মুক্তি?” বললাম “ তা জানি না কারণ সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আমার জন্মের পর আমার মায়ের বাতের ব্যথা ছেড়ে গেছিল। তো…” সবাই হেঁসে উঠল। বললেন “বেশ বাতের ব্যথা থেকে মুক্তির সংকেত!” বললাম “শুধু তা কেন, খারাপ জিনিস থেকে মুক্তি। বাবার নাম…” আমার পর্বও শেষ হল। অনেকের হাঁড়ির খবর মাথায় ছেপে গেছে আমার। কিন্তু আমি এখন বিশেষ ভাবে ইন্টারেস্টেড এই কুন্তলের দিদির ব্যাপারে জানতে। ক্লাস শেষ হতেই সবাই প্রায় হুড়মুড় করে বেড়িয়ে গেল। কারণটা অবশ্য বুঝতে বাকি নেই আর। র্যাগিং এর ভয়। পাছে কোনও সিনিওরের সামনে পড়ে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নাকাল হতে হয়।
আমি হেঁটেই হোটেলে ফিরব। কুন্তল একটা বাস ধরবে। আমি ওর সাথেই বেড়িয়ে এসেছি। রাস্তায় বেড়িয়ে ও যেন কেমন একটা মুক্তি লাভের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝলাম এই বেচারার ওপর দিয়ে আজ র্যাগিঙ্গের নামে অনেক ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেছে। তবে কয়েকজনের মধ্যে দেখলাম বেশ ঢিলেঢালা ভাব। পরে অবশ্য এই দুরকম অবস্থার কারণ বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, রাস্তায় বেড়িয়ে ও আমাকে বলল “দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়েছে?” বললাম “না।” ও কলেজের গেট থেকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কাঁধের শস্তা ব্যাগটা খুলে একটা টিফিন বক্স বের করল। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই বক্সটা খুলে ফেলল। দেখলাম ভেতরে চারটে হাতে করা রুটি আর তার সাথে একটা বেগুন ভাজা আর অল্প আলুর তরকারি। টিফিন বক্সটা খুলতেই একটা বাসী খাবারের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল। ও এক টুকরো মুখে পুড়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল “যাক নষ্ট হয়ে যায় নি। যা গরম পড়েছে। ভাগ্যিস ফ্রেশ ফ্রেশ বানিয়ে দিয়েছিল। এই নে…সরি নাও...” আমার দিকে টিফিন বাক্সটা এগিয়ে দিল। আমি ওকে বললাম “না তুইই ঠিক আছে। তুমিতে আমারও আপত্তি, তাও যখন একই ক্লাসে পড়ি। কিন্তু তুই এতক্ষন খাস নি কেন?” বলল “র্যাগিঙ্গের সময় খাওয়া যায় নাকি? আর তাছাড়া চারপাশে সবাই এমন সব টিফিন নিয়ে এসেছে, মানে বুঝতেই তো পারছিস, পিজ্জা, চাউমিন, ফ্রাইড রাইস, আরও কত কি। সেখানে বসে বাড়ির রুটি খেতে একটু লজ্জা লাগে আর কি?” একটু বিরক্ত হয়েই বললাম “তাতে কি হয়েছে? এটাও তো খাবার। খেয়ে দেখলে হয়ত দেখা যাবে এতে যা ফুড ভ্যালু আছে সেটা ওই খাবার গুলোতে নেই। আর সবাই নিশ্চই ওই রকম দামী দামী খাবার নিয়ে আসেনি। “ কথাটা মুখে বললাম বটে তবে আমি জানি ও কি বলতে চেয়েছে। এটাকে বলে কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্স যা বুঝেছি তিন ধরণের। এক নিজেকে ছোট বা গরীব ভাবার কমপ্লেক্স, দুই, নিজেকে অন্যের থেকে বড় ভাবার কমপ্লেক্স, আর তিন কোনও কিছুই গা না করার কমপ্লেক্স। আমি অবশ্য নিজে তৃতীয় দলে পড়ি কারণ আমার কারোর কোনও কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আমি আছি আমার মতন। কোথাও ডাল গললে ভালো, আর না গললে অপেক্ষা করব পরের বার ডাল গলানোর জন্য। বললাম “ট্রেনে অনেক খেয়েছি। তুই ই খেয়ে নে। তোর মা এত কষ্ট করে বানিয়েছে।” ও বোধহয় ভাবতে পারে যে আমি এই সাধারণ খাবার খেতে চাইছি না, তাই দুই টুকরো রুটি আর একটু আলুর তরকারি মুখে দিয়ে বললাম “কাল থেকে আর বাসী করিস না। আমাকে এখানে রেঁধে খাওয়ানোর মতন কেউ নেই। এইভাবে খাবার নষ্ট করার থেকে আমাকে দিয়ে দিস। আমি পিজ্জার পাশের টেবিলে বসে আনন্দে খেয়ে নেব তোর টিফিন। “ বাকিটা ও খেয়ে নিল চক্ষের নিমেষে, বুঝলাম ওর খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, শুধু ভদ্রতার খাতিরে আমাকে অফার করেছিল।
একটু ধীরে সুস্থে বললাম “তোর বাড়ি এখান থেকে কত দূর?” বলল “এই তো বাস ধরে দুটো স্টপ। কেন বল তো?” একটু ভেবে বললাম “একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম আজ। “ দেখলাম ও জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। হেঁসে বললাম “আরে দূর তেমন কিছু নয়… মনে হয় কোইন্সিডেন্স। তবু জিজ্ঞেস করছি, তোর দিদির কি যেন নাম বললি তখন?” বলল “মালিনী।” বললাম “বিয়ের পর তো আর মালিনী রাহা নেই? না কি আছে?” ও হেঁসে বলল “আরে, এই কথা , বিয়ের পর মালিনী সরকার।” আমি হেঁসেই ফেললাম। ও যেন একটু ঘাবড়ে গেল। বললাম “তোর দিদি কি বাই এনি চান্স প্যারাডাইস ইনন এ চাকরি করে?” ও যেন অবিশ্বাসের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। বললাম “তোর দিদির কি নাইট শিফট থাকে?” ওর বিস্ময় আর এক ধাপ উঠে গেল। বুঝলাম ওর মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না। বললাম “এখন কি বাড়ি ফিরবি? না কি দিদির সাথে দেখা করে তবে ফিরবি? তোর দিদির শিফট শুরু হয় কখন?” আমতা আমতা করে বলল “রাত ৮ টা থেকে ভোর ৬ টা। তবে, পরের শিফটের লোক না আসা অব্দি ওয়েট করতে হয়। তবে নেক্সট উইকে দিদির নাইট শিফট নেই। এক সপ্তাহ করে থাকে।” বললাম “তো এই সপ্তাহে তো আছে। তো যাবি না কি দেখা করতে?” ও একটু অবিশ্বাসের সুরেই বলল “দূর জানি না তুই আমার দিদিকে কি ভাবে চিনিস। তবে হোটেলটা খুব একটা দূরে নয়। তবে সেখানে গেলে ডিউটির সময় বাড়ির লোক অ্যাঁলাউ করে না।” বললাম “ চল চল, কোথাও গিয়ে বসে একটু চা খাওয়া যাক। আমারও একটু ক্ষিদে পেয়েছে। একটু ঝালমুড়ি গোছের কিছু খাওয়া যাক। তারপর এদিকে ওদিক একটু ঘুরে আটটার দিকে হোটেলে ঢুকব।” ও বলল “তোকে হোটেলে ঢুকতে দেবে? হোটেলেটা নেহাত ছোট খাটো ধর্মশালা নয়। “ ওহ এইবার বুঝলাম, সেই যে বলেছিলাম ধর্মশালায় মাল রেখে এসেছি, কুন্তল এখনও সেখানেই পড়ে আছে। ওর ভুল ভাঙানোর কোনও মানে হয় না এখন। কুন্তল ছেলেটা ভীষণই যে সরল সেটা ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারলাম। ওর দিদির পারিবারিক অশান্তির কথাও আমাকে বলে দিল। ওর জামাইবাবু কাথিতে পোস্টেড। বিমা কোম্পানির এজেন্ট। অনেকবার ট্র্যান্সফারের জন্য বলেছে কিন্তু পায় নি। সপ্তাহে শনিবার করে আসে, দিয়ে সোমবার ফিরে যায়। কিন্তু সেই সময় যদি ওর দিদির নাইট শিফট চলে, মানে যেটা এক সপ্তাহ অন্তর চলে, তাহলে বাড়িতে ভীষণ অশান্তি হয়। কারণ সেই সময় দিদি জামাই বাবুকে সময় দিতে পারে না। মনে মনে হেঁসে ফেললাম, সপ্তাহে দুই দিন চোদার জন্য পায়, আর সেই দুদিন যদি বউ বাড়ি না থাকে তো হতাশা আসতে বাধ্য। বললাম “হুম বুঝলাম। কিন্তু তোর দিদি তো কাথিতে গিয়ে থাকতে পারে।” ও গলা নামিয়ে বলল “জামাই বাবু খুব সিনিওর কিছু নয়। জুনিয়র এজেন্টের কাজ করে। দিদির এখানে একটা ফিক্সড ইনকাম আছে। যেই মাসে জামাই বাবুর তেমন ক্লায়েন্ট জোটে না তখন বাড়িতে ভালোই টানাটানি চলে। আর কাথিতে তো জামাইবাবু একটা মেসে থাকে। দিদি থাকবে কোথায়। এখানে দিদি কোনও মতে একা চালিয়ে নেয় একটা ছোট মেয়েদের মেসে থেকে। বিয়ের পর তো আর বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারে না। “ বুঝলাম মেয়েটার সম্মান বোধ ভালোই। ও কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে ওর দিদির কথা বলতে বলতে, তার পর একটু দুঃখী দুঃখী গলায় বলল “ এখন ওদের সম্পর্ক ভালো নয়। ওদের কথা চিন্তা করে আমার বাবার একবার হার্ট অ্যাঁটাক হয়ে গেছে। জামাইবাবু অলরেডি ডিভোর্সের ভয় দেখিয়েছে। বুঝতেই পারছিস আমাদের মতন ছাপোষা পরিবারে এইসব শুনলে কত ভয় পেয়ে যাবে। তবে আমি জানি তেমন কিছু হবে না। কারণ দিদিকে খোরপোষ দেওয়ার মতন টাকা জামাইবাবুর নেই। আর তাছাড়া দিদি অনেকবার জামাইবাবুকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। তবে হ্যাঁ, দিদি, খুব মন খারাপ করে থাকে সব সময়। বাড়িতে অশান্তি থাকলে আর কি করবে বল? সারা সপ্তাহ বরকে কাছে পায় না, আর যেদিন পায় সেদিন নাইট শিফট থাকুক না থাকুক অশান্তি লেগেই আছে। “ একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “এই তুই কিন্তু কাউকে এইসব কথা বলতে যাস না। আর দিদিকে তুই চিনিস কিভাবে সেটাই তো বললি না। আর দিদির সাথে দেখা করতে হলে ওই যে বললাম হোটেলের সিকিউরিটির ঝামেলা। সেটা ভেবে দেখেছিস? “ আবারও আমি এই কথার কোনও উত্তর দিলাম না। পকেট থেকে ক্লাসিক সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ওর সামনে এগিয়ে ধরলাম। ও সিগারেট খায় না। সুতরাং আমি নিজেই একটা লম্বা সিগারেট ঠোঁটে ধরে তাতে অগ্নি সংযোগ করে একটা সজোরে টান মারলাম। বললাম “সে দেখা যাবে। চাইলে আমি যেতে পারি না এমন জায়গা খুব কম আছে। তবু তোর দিদির যখন ব্যাপার তখন আজই একটা চেষ্টা দেখতে হচ্ছে, তবে রেখে ঢেকে আর হোটেলের সব নিয়ম কানুন মেনে। “
ধর্মতলায় গন্তব্য স্থলে যখন পৌছালাম সূর্য তখন মাথার ওপরে। ট্যাক্সি ওয়ালাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম “ ওই যে বলেছিলাম এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা দেব, সেটা দিয়ে দিলাম। আপনি খেয়ে নিন। আমার কিছুক্ষণ সময় লাগবে।” যে বাড়িটায় ঢুকলাম সেটা ব্রিটিশ আমলে তৈরি বোধহয়। সেকেলে চেহারা। ভয় হয় একটু জোড়ে হাওয়া দিলেই হয়ত ইট পাথর সমেত পুরো ইমারতটাই ধ্বসে পড়বে। আমাকে যেতে হবে তিন তলায়। বাবার তেজারতির একটা কারবার চলে এখান থেকে। যে চালায় তাকে আমি চিনি। আগে আমাদের প্রতিবেশী ছিল। কাজ না পেয়ে বেশ কিছু দিন বসে ছিল বলে বাবা এখানে কাজের ভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশ বিশ্বস্ত লোক তাতে সন্দেহ নেই। বয়স পঞ্চাশ ছুই ছুই। তিন কূলে কেউ নেই। শুনেছি যে খুব অল্প বয়সে একবার বিয়ে করেছিল, কিন্তু পোয়াতি বউকে হাঁসপাতালে নিয়ে যেতে দেরী হওয়ায় রাস্তাতেই ওর বউ ওর ওর বউয়ের পেটের ভিতরে বাচ্চাটা শেষ হয়ে গেছে। নাম হরিপদ। আমরা হরিদা বলেই সবাই ডাকি। হরিদার কাছ থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আরেকজনকে দিতে হবে। হরিদা হয়ত নিজেই গিয়ে দিয়ে আসত, কিন্তু এই গদি ছেড়ে যাওয়ার জো নেই তার। দেখলাম সব কিছু তৈরি করেই রেখেছিল ও। আমাকে এক কাপ চা খাইয়েই একটা বড় ক্যাম্বিশের ব্যাগে সব জিনিস হস্তান্তরিত করে দিল। আমি ব্যাগের চেনটা খুলে জিনিস গুলো ভেতর থেকেই একবার নেড়ে ঘেঁটে দেখে নিলাম। সব ঠিক আছে। ভেতরে একটা লেদারের ব্যাগও দেখলাম। ওটাকেও একবার খুলে ভেতরে কি কাগজ পত্র আছে উপর উপর দেখে নিলাম। তেজারতির কারবারের ঝুঁকি তো আছেই, আর তার অপর বিষ ফোঁড়ার মতন আছে এক গাদা হিসেব নিকেশ। এখানকার কাজ মিটেছে। ওর ঘুপচির মতন ঘরের জানলা দিয়ে একবার বাইরে রাস্তার দিকে উঁকি মারলাম। উল্টো ফুটে আমার ট্যাক্সির চালককে দেখলাম কব্জি ডুবিয়ে মুড়ি আর ঘুগনি খাচ্ছে। এখনও খাওয়া বাকি। রাস্তাটা গাড়ি ঘোড়া আর লোক জনে ভরে গেছে। সবাই ব্যস্ত। আমার ল্যাপটপের ব্যাগটা থেকে আমার সেই মোবাইলটা বের করে সেটাকে অন করলাম। এটাকে আমি এমনিতে অফ করেই রাখি। ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নয়। এমনি রাখি। এর ব্যাটারি একবার ফুল চার্জ দিলে তিন দিনেও শেষ হয় না। হরিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে ট্যাক্সিটার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা হাঁসি হাঁসি মুখে সেলফি নিলাম। ওই যে বললাম বিপদ, পাশ দিয়ে যারা যাচ্ছিল সবাই আমার হাতের মোবাইলটার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাতে তাকাতে গেল। সময় নষ্ট না করে ফেসবুকে লগ ইন করে সদ্য তোলা ছবিটা আপলোড করে দিলাম। ক্যাপশন দিলাম “ কোলকাতায় প্রথম দিন। জমজমাট ঐতিহাসিক ধর্মতলা… বেশ ভালো লাগলো… (পাঁচটা স্মাইলি)” । আসলে নতুন জায়গায় এসে একটাও সেলফি তুলে পোস্ট না করলে চলে? সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো! মোবাইলটা আবার অফ করে ব্যাগের ভিতর চালান দিয়ে দিলাম সযত্নে। অবশ্য অফ করার আগে কয়েকটা জিনিস চেক করতে ভুললাম না। কাজের কিছু নেই।
ধেয়ে চললাম বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে। পৌঁছাতে বেশ সময় লাগলো। ট্রাফিক বড্ড বেশী। আজ আমার কলেজের প্রথম দিন। মনে হয় ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তবে প্রথম দিন খুব একটা কিছু পড়াশুনা হবে বলে মনে হয় না। এখানে একটা সাইবার ক্যাফের মালিকের সাথে কাজ। ভদ্রলোক এক যুগ আগে বাবার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। সেই টাকা আর ফেরত দেয় নি। অনেক দিন জোরাজুরি করার পর অবশেষে লোকটা বাবার কাছে দোকানটা বেচে দিয়েছে। বাবা কিন্তু লোকটাকে তাড়িয়ে দেয় নি। বাবার মন এই সব দিক থেকে ভীষণ উদার। বাবা এখন এই ক্যাফের মালিক। লোকটা ম্যানেজারির কাজ করে। আমরা সবাই একে শুভদা বলে ডাকি। উত্তর প্রদেশ থেকে বাবার সাথে এর চেনাশুনা। বাঙালি হলেও কথা বার্তায় এখনও একটা হিন্দি হিন্দি ছাপ রয়ে গেছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। অফিসের ভেতরে একটা লকার আছে। সেখানে থেকে আরেকটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। শালা, এই বাবার চক্করে পড়ে পড়াশুনা মাথায় উঠবে। এখানে এসে তোলাবাজির কারবারে যোগ দিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ব্যাগের ভেতরটা দেখে নিলাম। শুভদা বলল “সামনে ধাবা আছে। কিছু খাবে না কি?” আমি মাথা নেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ট্যাক্সিটা দেখলাম কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে এক মিনিট দাঁড়াতে বললাম। সেই মোবাইলটা বের করে জানলার একদম ধার ঘেঁসে বসে রাস্তার দিকে তাক করে চারপাশের দৃশ্য সমেত নিজের আরেকটা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে দিলাম। ক্যাপশন “ রমরমা বালিগঞ্জ। সামনের ধাবাতে একবার আসতে হচ্ছে… বেশ ভালো লাগলো।” আগের ছবিটায় দেখলাম কয়েকজন কমেন্ট দিয়েছে। কিছু সেসব পড়ার সময় এখন নয়। গাড়ি এগিয়ে চলল আর আমার মোবাইলটা আবার ব্যাগের ভিতর চালান হয়ে গেল। বালিগঞ্জ থেকে যাদবপুর পৌঁছাতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগলো। পথে অবশ্য একটা ফোন করে একজনকে জানিয়ে দিলাম যে আমি আসছি। থানার ঠিক সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ধর্মতলা আর বালিগঞ্জ থেকে কালেক্ট করা ব্যাগ দুটো এক জনের হাতে তুলে দিলাম। এর নাম বাবুয়া। ফোনে কোথায় থাকবে, কি পরে এসেছে এইসব কথা হয়েই গেছিল। লোকটা বোকা বোকা মুখে একটা ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি থানার সামনেই তাকে দাঁড় করালাম। সর্দারজি থানার সামনে এতক্ষন ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাখায় গাঁই গুই করছিল, পুলিশের ভয় আর কি, কেস দেবে! কিন্তু আমি কোনও পাত্তাই দিলাম না। এই বাবুয়াকে দেখে খুব সরল মনে হয়েছে আমার। এর সাথে একটা সেলফি না তুললেই নয়। হ্যাঁ, সেলফি তোলাটা আমার একটা নেশা। শুধু সেলফি নয়, ছবি তোলাও আমার একটা নেশা। থানাটাকে ব্যাক গ্রাউন্ডে রেখে ওর সাথে আমার একটা সেলফি তুললাম। একটা পুলিশ আমাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল সেটা দেখেছি, কিন্তু ওকেও পাত্তা দিলাম না। প্রথম দিন কোলকাতায় এসে গোটা পাঁচেক সেলফি না তুললে আর কি কারণে ফেসবুক করি। ওকে ছেড়ে দিয়ে ফেসবুকে আপলোড করলাম, ক্যাপশনঃ “ কোলকাতার প্রথম বন্ধু বাবুয়া...মন্দ লাগলো না।” সময় দেখে ঠিক করলাম খিদিরপুর আজই যাব। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। না কোনও কেস খাই নি আমরা।
এখানে যার সাথে দেখা করব তার নাম আব্দুল। লোকটার বয়স খুব বেশী হলে ৩২। আর বেশ শক্ত পোক্ত। চা খেয়ে এর সাথে অনেক গল্প হল। ওর কাছ থেকে দুটো কাগজ ভর্তি হিসাবের ব্যাগ নিয়ে আমার ল্যাপটপের ব্যাগের ভেতর পুড়ে রওয়ানা হলাম। ঠিক হল সামনের শনিবার এসে ওর কাছ থেকে একটা বড় লেন্স কিনব। এটা আমার অনেক দিনের সখ। বাবা কে এই লেন্সের কথা আগেই বলে রেখেছিলাম। আর আব্দুলের দোকান থেকে কিনব বলেই ঠিক করা ছিল কারণ আব্দুলকেও আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। বাবারও লেন্সের আর ক্যামেরার সখ ছিল একটা বয়সে। তবে সেযুগে এত অত্যাধুনিক লেন্স বা ক্যামেরা ছিল না। বাজারে কিনতে গেলে এই লেন্সের দাম যে কত পড়বে তার কোনও ঠিক নেই। বাবা আমাকে অবশ্য একটা ভীষণ ভালো ক্যামেরা আগেই কিনে দিয়েছিল। তবে লেন্স ছিল না। বেশ একটা টেলিস্কোপিক লেন্স না থাকলে এত ভালো ক্যামেরা দিয়ে কি হবে। তবে অনেক রকমের লেন্স হয় এই জগতে। ধীরে ধীরে জমাতে হবে। হ্যাঁ আমি বড়লোক বাপের একটি মোটামুটি বিগ্রে যাওয়া ছেলে হয়ে গেছি তাতে সন্দেহ নেই। কোলকাতার বিষাক্ত বায়ুর ভেতরে এতক্ষন ঘেমে নেয়ে আর কলেজে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে হচ্ছিল না। আর হ্যাঁ ট্যাক্সিতে ওঠার আগে ফেসবুকে একটা ছবি আপলোড করতে ভুললাম না, এইবারের ক্যাপশনঃ এই নাকি সেই খিদিরপুর, কি ভিড়রে বাবা। তবে...বেশ ভালো লাগলো…” জানি বোকা বোকা ক্যাপশন, কিন্তু এছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম “চলিয়ে। যেখান থেকে আমাকে উঠিয়েছিলে সেখানেই গিয়ে আবার আমাকে ছেড়ে দাও।” ট্যাক্সির ড্রাইভার যে এই গরমে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ট্যাক্সির মিটার যা উঠেছে সেটা দেখেই বোধহয় মুখে কিছু বলছে না। হোটেলের কিছু আগেই আমি ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিলাম। তবে যাত্রা শেষে যখন ট্যাক্সির ভাড়াটা মেটাচ্ছিলাম তখন মনে মনে বললাম সর্দারজি, বোধহয় সারা সপ্তাহের সওয়ারির ভাড়া আজ এক বেলাতে পেয়ে গেলে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে দিতে বড় রাস্তা ধরে হেঁটে চললাম কলেজের দিকে। হোটেল থেকে কলেজ পায়ে হেঁটে খুব বেশী হলে ১০ মিনিট। আমার হাঁটতে খারাপ লাগে না। আর গরম যতই বেশী হোক না কেন, এই গরম আর ঘাম সহ্য করার যথেষ্ট অভ্যেস আমার আছে। এখানে রিক্সা ধরার কোনও মানে নেই। তবে আমি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটি। তাই দশ মিনিটের রাস্তাটা যেতে আমার লাগলো ঠিক সাড়ে চার মিনিট।
সোজা চলে গেলাম কলেজের অ্যাঁকাউন্টস সেকশনে। কাউন্টার খালি দেখে কলেজ ফি জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে, আমার ডিপার্টমেন্টে এসে ফর্ম ফিল আপ করে সব মিটিয়ে যখন ক্লাসে পৌছালাম তখন সেকন্ড হাফের ফার্স্ট ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। প্রায় পনের মিনিট পরে ক্লাসে আসায় আর তাও প্রথম দিন, স্যার যারপরনাই বিরক্ত হলেন সেটা আর বলে দিতে লাগে না। “এত লেট কেন? আর প্রথম দিনেই এই অবস্থা। তোমার তো লেজ গজাতে বেশী সময় লাগবে না হে। মনে রেখো পাশ ফেল এখানে সব আমাদের হাতে। “ আমি মাটির দিকে মুখ নামিয়ে রেখে ওনার সব তিরস্কার সহ্য করলাম। অবশ্য এখানে একটা কথা বলে রাখি, তাড়াহুড়ায় বলতে ভুলে গেছিলাম। সব ব্যাপার মিটিয়ে ক্লাসে আসার ঠিক আগে বাথরুমে গেছিলাম। সেখানে একটা আনঅকুপাইড ল্যাট্রিনের কেবিনে ঢুকে দরজা দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা ধবধবে সাদা ফুল হাতা শার্ট আর কালো ফরম্যাল প্যান্ট বের করে চেঞ্জ করে নিলাম। শু পরেই বেড়িয়ে ছিলাম। পরনের স্টাইলিশ জিন্স আর টি শার্ট টা ব্যাগে চালান করে দিলাম। এরকম জিন্স আর টি শার্ট পরে এখানকার ছেলে মেয়েরা কলেজে আসতে পারে, কিন্তু আমার রুচিতে সেটা বাঁধে। যাইহোক স্যারের তিরস্কার শেষ হলে মাটির দিকে তাকিয়েই খুব নরম কিন্তু পরিষ্কার ভাবে বললাম “স্যার, ভুল হয়ে গেছে। আসলে উত্তরপ্রদেশ থেকে আসছি। ট্রেন অনেকক্ষণ লেট ছিল। এই পৌছালাম। কোনও মতে একটা ধর্মশালায় জিনিস রেখে রিক্সা ধরে এসেছি। আর এখানকার অ্যাঁকাউন্টসেও যা লাইন…” স্যারের বোধহয় একটু মায়া হল, “ঠিক আছে, যাও। পরের দিন থেকে লেট হলে অ্যাঁটেনড্যান্স পাবে না। নাম কি?” বললাম । স্যার একটা হুম মতন শব্দ করলেন শুধু। আমি চুপ চাপ গিয়ে একটা খালি সিট দেখে বসে পড়লাম। দরজা থেকে সিট অব্দি একবারও মাটির ওপর থেকে চোখ তুলিনি। ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর পেন বের করে রেডি হলাম। স্যার বললেন “তোমার রোল হল ছাব্বিশ।” উঠে দাঁড়িয়ে বললাম “ওকে স্যার।” বসে পড়লাম। এত ভদ্রতা বোধহয় এখানকার শহুরে ছাত্র দের কাছ থেকে স্যারেরা এক্সপেক্ট করেন না। আমার হাবভাব দেখে বোধহয় এরা সবাই আমাকে একটা গাইয়া ভুত বলেই ধরে নিয়েছে। তাতে আমার কি বা এলো গেলো। ক্লাসে তেমন কিছুই হল না। কারণ এখন শুধু সিলেবাস দিচ্ছে। খেয়াল করলাম আমি যেমন আড়চোখে মোটামুটি সবাইকে একবার দেখে নিলাম, তেমনি অনেকেই আমাকেও ঘুরে ঘুরে আড়চোখে লক্ষ্য করছে। কারণ বোধহয় একটাই, এরকম ভদ্র ভাবে সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে আর কেউ আসেনি। ভাগ্যিস আসার আগে মাথায় তেল ঢেলে স্নান করে আসিনি, তাহলে আর দেখতে হত না। এখানে একটা কথা বলে রাখি, গোপালবাজার না বলে উত্তরপ্রদেশ বলার কারণ একটাই। গোপালবাজার কোলকাতার তাও কাছে। বলা যায় না যদি আমারই মতন সেখান থেকে কেউ ট্রেনে এসে থাকে। তাহলে কেস খেয়ে যাব। উত্তর প্রদেশ থেকে কেউ এসেছে সেটা বিশ্বাস হয় না। আশা করছি স্যার টিকিট দেখতে চাইবেন না কোনও দিনও। চাইলে বলব চেকারের কাছে দিয়ে দিয়েছি ষ্টেশন ছাড়ার আগে।
ক্লাস শেষ হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক সময় পেয়েছিলাম। এইবার একটু সাবলীল ভাবে সবার মুখের উপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। বেশ কয়েকজনের সাথে সরাসরি চোখাচুখিও হল। সবার কথা বলার এখন কোনও মানে নেই। তবে দু একটা জিনিস চোখে পড়ল। ক্লাসে মোটামুটি একটা গ্রুপ আছে খুব বড়লোক ছেলে মেয়ের। তাদের বেশভূষাই সে কথার জানান দিচ্ছে। গ্রুপ বললাম কারণ তাদের মধ্যে এই প্রথম দিনেই যে রকম ইয়ার্কি ফাজলামি হচ্ছে আর তাও বেশ জোড়ে জোড়ে সেটা থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে এরা হয় আগে থেকেই নিজেদের চেনে, অথবা, একই গোত্রীয় রক্ত বলে প্রথম দিনেই এদের মধ্যে একটা ভাব হয়ে গেছে। যাদের বেশ ভুষা সাধারণ, তারা কেমন একটা সিটিয়ে আছে প্রথম দিন বলে। আর দুই তিন জন ছেলে আর মেয়ের মুখে বেশ একটা দাদা দিদি মার্কা ভাব...মানে ইতিমধ্যে ওরা নিজেদেরকে ক্লাসের লিডার বলে ধরে নিয়েছে। পরের ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমার পাশে বসা ছেলেটা আমার সাথে আলাপ করল যেচে। যদিও আমি প্রয়োজন ছাড়া কারোর সাথে কথা বলি না, তবুও একসাথে পড়তে গেলে কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে হবে বই কি। আর সেটা খুব দরকারিও বটে। ওকে আমি আগেই লক্ষ্য করেছি। পরনে একটা ঢিলা ফতুয়া মার্কা শার্ট আর জিন্স। একদম সাধারণ বেশ ভুষা। কথা বার্তাও সরল। চোখে মুখে একটা সারল্য আছে। সোজাসুজি আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল “আমার নাম কুন্তল রাহা।” আমার নামটা এই ক্লাসের সকলের ইতিমধ্যে জানা হয়ে গেছে। ও ভীষণ গলা নামিয়ে কথা বলছে, যেন একটা ভীষণ ভয় ওকে চেপে ধরে রেখেছে। বলল “একা এসেছ?” বললাম “হ্যাঁ। বাবা গোপালবাজারে থাকে। কিন্তু এখনও দেখা হয় নি। ওর কাজের চাপ চলছে।” ও বলল “ইউপির কোথায় বাড়ি?” বললাম “মিরাট।” বলল “ সেকন্ড হাফে এসে ভালোই করেছ। টিফিনের সময় যা হল সেটা বলার নয়।” বললাম “কিরকম?” বলল “র্যাগিং।” হ্যাঁ এইটাও আমার অজানা নয়। আর এই ব্যাপারটা কি সেটা দেখার জন্য আমার ভীষণ কৌতূহলও আছে। বলল “কাল আবার হবে। টানা এক মাস ধরে হবে। “ ওর মুখটা সরল আর গোলগাল, বেশ একটু মোটার দিকেই পড়ে, শরীরটা বেশ ভারী, কারণ বেঞ্চের ওপর যখন নড়াচড়া করছে তখন প্রায় পুরো বেঞ্চটাই যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর বুঝতে পারলাম কেমন জানি একঘরে হয়ে রয়েছে ছেলেটা। কারণ এই ক্লাসরুমে বেঞ্চে দুজন করে বসার জায়গা। ও বসে আছে থার্ড রো তে , কিন্তু ওর পাশে আমার আগে এসে কেউ বসে নি। কেন কে জানে। হতে পারে ভুল্লু টাইপের ছেলের সাথে যেচে পড়তে কেউ আলাপ করতে চায় না। তবে ছেলেটাকে আমার খারাপ মনে হল না। তবে আর একটু আলাপ জমানোর আগেই স্যার এসে উপস্থিত হলেন। তবে এই স্যার বেশ মিশুকে আর ভালো। সবার নাম ধাম একে একে জিজ্ঞেস করলেন। আগে কোথায় পড়তাম, কি হবি সব একে একে জিজ্ঞেস করলেন। বাড়িতে কে কে আছে, বাবা মা ভাই বোন দাদা বৌদি, এমনকি ঠাকুরদা ঠাকুমা কারোর ব্যাপারেই খোঁজ নিতে উনি বাকি রাখলেন না। এতে আমার দুটো লাভ হল। সবার বাড়ির হাঁড়ির খবর আমার জানা হয়ে গেল। একটু আগে আমার সহপাঠীদের দিকে তাকিয়ে আমার যে ধারণাটা হয়েছিল সেটা যে একদম ঠিক সেটা বুঝতে পারলাম। আর তাছাড়া খবর জোগাড় করে রাখা সব সময়ই ভালো, বলা তো যায় না কখন কোন খবরটা কাজে লেগে যায়। এই “বিশেষ” লাভটা ছাড়াও আরেকটা লাভ হল আর সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য। পৃথিবী যে গোল সেটা যে বলেছিল সে খুব ভুল বলেনি। আর গোল মানে পুরো গোল সেটা বুঝতে পারলাম যখন আমার পাশে বসে থাকা কুন্তল ওর পরিচয় দিল। “স্যার, আমার নাম কুন্তল রাহা। বাবার নাম বিনয় রাহা। মার নাম রাধিকা রাহা। বাবা শরীর ভেঙ্গে যাওয়ায় রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিয়েছেন। এখন একটা মুদির দোকান দিয়েছেন। আগে কলকাতা দমকল বিভাগে ছিলেন। মা হোম মেকার। এক দিদি আছে। নাম মালিনী রাহা। বিয়ে হয়ে গেছে। দিদি একটা বড় হোটেলে কাজ করে। হবি ছবি আঁকা আর গল্পের বই পড়া। এন্ট্রান্সে র্যাঙ্ক…” স্যার অবশ্য ওকে জিজ্ঞেস করলেন যে “ কেমন ধরণের গল্পের বই পড়ার অভ্যেস। ইংরেজি না বাংলা। “ এরকম আরও কিছু। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে দিদির নাম মালিনী রাহা, বড় হোটেলে চাকরি করে। এটা কি সংযোগ না অন্য কিছু। হয়ত পরে জানতে পারব ওর দিদির বিয়ের পর পদবী হয়েছে ব্যানার্জি বা মুখার্জি। ব্যস তাহলেই হয়ে গেল। আর হোটেলের নামও বোধহয় অন্য। তাও এটা একবার বাজিয়ে দেখা দরকার। ওকে স্যার বললেন তোমার আঁকা ছবি আমি অবশ্যই একবার দেখব। ও বসল আর আমি উঠে দাঁড়ালাম। “নাম সংকেত রায়।” সাথে সাথে প্রশ্ন এলো, “কিসের সংকেত।” এই প্রশ্ন শুনে শুনে আমি বোর হয়ে গেছি। হেঁসে বললাম “স্যার মুক্তির সংকেত।” স্যার বললেন “কিসের থেকে মুক্তি?” বললাম “ তা জানি না কারণ সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে আমার জন্মের পর আমার মায়ের বাতের ব্যথা ছেড়ে গেছিল। তো…” সবাই হেঁসে উঠল। বললেন “বেশ বাতের ব্যথা থেকে মুক্তির সংকেত!” বললাম “শুধু তা কেন, খারাপ জিনিস থেকে মুক্তি। বাবার নাম…” আমার পর্বও শেষ হল। অনেকের হাঁড়ির খবর মাথায় ছেপে গেছে আমার। কিন্তু আমি এখন বিশেষ ভাবে ইন্টারেস্টেড এই কুন্তলের দিদির ব্যাপারে জানতে। ক্লাস শেষ হতেই সবাই প্রায় হুড়মুড় করে বেড়িয়ে গেল। কারণটা অবশ্য বুঝতে বাকি নেই আর। র্যাগিং এর ভয়। পাছে কোনও সিনিওরের সামনে পড়ে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নাকাল হতে হয়।
আমি হেঁটেই হোটেলে ফিরব। কুন্তল একটা বাস ধরবে। আমি ওর সাথেই বেড়িয়ে এসেছি। রাস্তায় বেড়িয়ে ও যেন কেমন একটা মুক্তি লাভের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝলাম এই বেচারার ওপর দিয়ে আজ র্যাগিঙ্গের নামে অনেক ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেছে। তবে কয়েকজনের মধ্যে দেখলাম বেশ ঢিলেঢালা ভাব। পরে অবশ্য এই দুরকম অবস্থার কারণ বুঝতে পেরেছিলাম। যাই হোক, রাস্তায় বেড়িয়ে ও আমাকে বলল “দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়েছে?” বললাম “না।” ও কলেজের গেট থেকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কাঁধের শস্তা ব্যাগটা খুলে একটা টিফিন বক্স বের করল। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই বক্সটা খুলে ফেলল। দেখলাম ভেতরে চারটে হাতে করা রুটি আর তার সাথে একটা বেগুন ভাজা আর অল্প আলুর তরকারি। টিফিন বক্সটা খুলতেই একটা বাসী খাবারের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল। ও এক টুকরো মুখে পুড়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল “যাক নষ্ট হয়ে যায় নি। যা গরম পড়েছে। ভাগ্যিস ফ্রেশ ফ্রেশ বানিয়ে দিয়েছিল। এই নে…সরি নাও...” আমার দিকে টিফিন বাক্সটা এগিয়ে দিল। আমি ওকে বললাম “না তুইই ঠিক আছে। তুমিতে আমারও আপত্তি, তাও যখন একই ক্লাসে পড়ি। কিন্তু তুই এতক্ষন খাস নি কেন?” বলল “র্যাগিঙ্গের সময় খাওয়া যায় নাকি? আর তাছাড়া চারপাশে সবাই এমন সব টিফিন নিয়ে এসেছে, মানে বুঝতেই তো পারছিস, পিজ্জা, চাউমিন, ফ্রাইড রাইস, আরও কত কি। সেখানে বসে বাড়ির রুটি খেতে একটু লজ্জা লাগে আর কি?” একটু বিরক্ত হয়েই বললাম “তাতে কি হয়েছে? এটাও তো খাবার। খেয়ে দেখলে হয়ত দেখা যাবে এতে যা ফুড ভ্যালু আছে সেটা ওই খাবার গুলোতে নেই। আর সবাই নিশ্চই ওই রকম দামী দামী খাবার নিয়ে আসেনি। “ কথাটা মুখে বললাম বটে তবে আমি জানি ও কি বলতে চেয়েছে। এটাকে বলে কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্স যা বুঝেছি তিন ধরণের। এক নিজেকে ছোট বা গরীব ভাবার কমপ্লেক্স, দুই, নিজেকে অন্যের থেকে বড় ভাবার কমপ্লেক্স, আর তিন কোনও কিছুই গা না করার কমপ্লেক্স। আমি অবশ্য নিজে তৃতীয় দলে পড়ি কারণ আমার কারোর কোনও কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আমি আছি আমার মতন। কোথাও ডাল গললে ভালো, আর না গললে অপেক্ষা করব পরের বার ডাল গলানোর জন্য। বললাম “ট্রেনে অনেক খেয়েছি। তুই ই খেয়ে নে। তোর মা এত কষ্ট করে বানিয়েছে।” ও বোধহয় ভাবতে পারে যে আমি এই সাধারণ খাবার খেতে চাইছি না, তাই দুই টুকরো রুটি আর একটু আলুর তরকারি মুখে দিয়ে বললাম “কাল থেকে আর বাসী করিস না। আমাকে এখানে রেঁধে খাওয়ানোর মতন কেউ নেই। এইভাবে খাবার নষ্ট করার থেকে আমাকে দিয়ে দিস। আমি পিজ্জার পাশের টেবিলে বসে আনন্দে খেয়ে নেব তোর টিফিন। “ বাকিটা ও খেয়ে নিল চক্ষের নিমেষে, বুঝলাম ওর খুব ক্ষিদে পেয়েছিল, শুধু ভদ্রতার খাতিরে আমাকে অফার করেছিল।
একটু ধীরে সুস্থে বললাম “তোর বাড়ি এখান থেকে কত দূর?” বলল “এই তো বাস ধরে দুটো স্টপ। কেন বল তো?” একটু ভেবে বললাম “একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম আজ। “ দেখলাম ও জিজ্ঞাসু চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। হেঁসে বললাম “আরে দূর তেমন কিছু নয়… মনে হয় কোইন্সিডেন্স। তবু জিজ্ঞেস করছি, তোর দিদির কি যেন নাম বললি তখন?” বলল “মালিনী।” বললাম “বিয়ের পর তো আর মালিনী রাহা নেই? না কি আছে?” ও হেঁসে বলল “আরে, এই কথা , বিয়ের পর মালিনী সরকার।” আমি হেঁসেই ফেললাম। ও যেন একটু ঘাবড়ে গেল। বললাম “তোর দিদি কি বাই এনি চান্স প্যারাডাইস ইনন এ চাকরি করে?” ও যেন অবিশ্বাসের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। বললাম “তোর দিদির কি নাইট শিফট থাকে?” ওর বিস্ময় আর এক ধাপ উঠে গেল। বুঝলাম ওর মুখ দিয়ে কথাই বেরোচ্ছে না। বললাম “এখন কি বাড়ি ফিরবি? না কি দিদির সাথে দেখা করে তবে ফিরবি? তোর দিদির শিফট শুরু হয় কখন?” আমতা আমতা করে বলল “রাত ৮ টা থেকে ভোর ৬ টা। তবে, পরের শিফটের লোক না আসা অব্দি ওয়েট করতে হয়। তবে নেক্সট উইকে দিদির নাইট শিফট নেই। এক সপ্তাহ করে থাকে।” বললাম “তো এই সপ্তাহে তো আছে। তো যাবি না কি দেখা করতে?” ও একটু অবিশ্বাসের সুরেই বলল “দূর জানি না তুই আমার দিদিকে কি ভাবে চিনিস। তবে হোটেলটা খুব একটা দূরে নয়। তবে সেখানে গেলে ডিউটির সময় বাড়ির লোক অ্যাঁলাউ করে না।” বললাম “ চল চল, কোথাও গিয়ে বসে একটু চা খাওয়া যাক। আমারও একটু ক্ষিদে পেয়েছে। একটু ঝালমুড়ি গোছের কিছু খাওয়া যাক। তারপর এদিকে ওদিক একটু ঘুরে আটটার দিকে হোটেলে ঢুকব।” ও বলল “তোকে হোটেলে ঢুকতে দেবে? হোটেলেটা নেহাত ছোট খাটো ধর্মশালা নয়। “ ওহ এইবার বুঝলাম, সেই যে বলেছিলাম ধর্মশালায় মাল রেখে এসেছি, কুন্তল এখনও সেখানেই পড়ে আছে। ওর ভুল ভাঙানোর কোনও মানে হয় না এখন। কুন্তল ছেলেটা ভীষণই যে সরল সেটা ওর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝতে পারলাম। ওর দিদির পারিবারিক অশান্তির কথাও আমাকে বলে দিল। ওর জামাইবাবু কাথিতে পোস্টেড। বিমা কোম্পানির এজেন্ট। অনেকবার ট্র্যান্সফারের জন্য বলেছে কিন্তু পায় নি। সপ্তাহে শনিবার করে আসে, দিয়ে সোমবার ফিরে যায়। কিন্তু সেই সময় যদি ওর দিদির নাইট শিফট চলে, মানে যেটা এক সপ্তাহ অন্তর চলে, তাহলে বাড়িতে ভীষণ অশান্তি হয়। কারণ সেই সময় দিদি জামাই বাবুকে সময় দিতে পারে না। মনে মনে হেঁসে ফেললাম, সপ্তাহে দুই দিন চোদার জন্য পায়, আর সেই দুদিন যদি বউ বাড়ি না থাকে তো হতাশা আসতে বাধ্য। বললাম “হুম বুঝলাম। কিন্তু তোর দিদি তো কাথিতে গিয়ে থাকতে পারে।” ও গলা নামিয়ে বলল “জামাই বাবু খুব সিনিওর কিছু নয়। জুনিয়র এজেন্টের কাজ করে। দিদির এখানে একটা ফিক্সড ইনকাম আছে। যেই মাসে জামাই বাবুর তেমন ক্লায়েন্ট জোটে না তখন বাড়িতে ভালোই টানাটানি চলে। আর কাথিতে তো জামাইবাবু একটা মেসে থাকে। দিদি থাকবে কোথায়। এখানে দিদি কোনও মতে একা চালিয়ে নেয় একটা ছোট মেয়েদের মেসে থেকে। বিয়ের পর তো আর বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারে না। “ বুঝলাম মেয়েটার সম্মান বোধ ভালোই। ও কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে ওর দিদির কথা বলতে বলতে, তার পর একটু দুঃখী দুঃখী গলায় বলল “ এখন ওদের সম্পর্ক ভালো নয়। ওদের কথা চিন্তা করে আমার বাবার একবার হার্ট অ্যাঁটাক হয়ে গেছে। জামাইবাবু অলরেডি ডিভোর্সের ভয় দেখিয়েছে। বুঝতেই পারছিস আমাদের মতন ছাপোষা পরিবারে এইসব শুনলে কত ভয় পেয়ে যাবে। তবে আমি জানি তেমন কিছু হবে না। কারণ দিদিকে খোরপোষ দেওয়ার মতন টাকা জামাইবাবুর নেই। আর তাছাড়া দিদি অনেকবার জামাইবাবুকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে। তবে হ্যাঁ, দিদি, খুব মন খারাপ করে থাকে সব সময়। বাড়িতে অশান্তি থাকলে আর কি করবে বল? সারা সপ্তাহ বরকে কাছে পায় না, আর যেদিন পায় সেদিন নাইট শিফট থাকুক না থাকুক অশান্তি লেগেই আছে। “ একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “এই তুই কিন্তু কাউকে এইসব কথা বলতে যাস না। আর দিদিকে তুই চিনিস কিভাবে সেটাই তো বললি না। আর দিদির সাথে দেখা করতে হলে ওই যে বললাম হোটেলের সিকিউরিটির ঝামেলা। সেটা ভেবে দেখেছিস? “ আবারও আমি এই কথার কোনও উত্তর দিলাম না। পকেট থেকে ক্লাসিক সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে ওর সামনে এগিয়ে ধরলাম। ও সিগারেট খায় না। সুতরাং আমি নিজেই একটা লম্বা সিগারেট ঠোঁটে ধরে তাতে অগ্নি সংযোগ করে একটা সজোরে টান মারলাম। বললাম “সে দেখা যাবে। চাইলে আমি যেতে পারি না এমন জায়গা খুব কম আছে। তবু তোর দিদির যখন ব্যাপার তখন আজই একটা চেষ্টা দেখতে হচ্ছে, তবে রেখে ঢেকে আর হোটেলের সব নিয়ম কানুন মেনে। “