26-07-2020, 06:01 AM
এইবার নতুন বৌদি ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বললো (আমি তো ফিরেও তাকাচ্ছিনা ওর দিকে) “দেবরজী, ম্যানেজটা সেদিনই দিতে পারনি | শাড়ির সাথে ব্লাউজ কিনবে, শায়া কিনবে – সবই নতুন বৌদির মাপে মাপে হবে – এতটা বোকামো না করলেই পারতে |”
এইবার ভীষণ দুষ্টু হেসে আমায় বললো, “কখন দেবে ?”
“কালকে সকালে | কাল ২৭ শে সেপ্টেম্বর | তোমার জন্মদিন | আমার মনে আছে |”
“আমার কাছেও কথা গোপন করতে তোমার ভালো লাগে ?”
“পারলাম কই ? হারিয়ে দিলে তো |”
দূরে, নীচে, অন্ধকার পাহাড়ের গা বেয়ে দু একটা গ্রামের আলো ঝিকমিক করছিলো | চারপাশটা কী নিস্তব্ধ | হালকা হালকা ঠান্ডা | আমার গায়ের পাশে, একদম গা ঘেঁষে আমার লিপি বসে আছে | অপূর্ব একটা অনুভূতি হচ্ছিলো | এ মুহুর্তগুলি মনের ভিতরে রয়েই যায় | ছবি না তুললেও |
রাত্তিরের খাওয়া শেষ করে আবার এসে বসলাম আমাদের নিজেদের সেই জায়গাটিতে | নিঝুম রাত, আমরা বসে বসে গল্প করছি | ও বললো “সারাক্ষণ বক বক করলে ভালো লাগেনা | একটু চুপ করে বস |”
“আস্তে আস্তে একটু একটু কথা ? চলতে পারে ?”
“পারে”
“কানে কানে কথা?”
“কি বলবে?” ও আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বললো |
“একটা খেলা খেলবে ?”
“কানে কানে খেলা | একবার এই কানে, একবার ওই কানে |”
“কে বলবে ?”
“তুমি বলবে”
“কি বলবে ?”
“কিচ্ছুনা”
একবার এই কানে, আবার ওই কানে, আবার এই কানে, আবার মুখ ডিঙিয়ে ওই কানে – বারবার | মজা হচ্ছিলো, হেসে লুটোচ্ছিলাম দুজনে | বড্ড বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলো আমাদের খেলাটা ! কানের সাথে মুখ, মুখের সাথে কান – দুইয়ের বদলা বদলিতে বিপত্তিটা ঘটেই গেলো |
আমি পারলামনা | হেরে গেলাম | ঠোঁটের সাথে ঠোঁট – মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো | আমার লিপির ঠোঁটে আমার প্রথম চুম্বন | নিঃশ্বাস এর সাথে নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে, ঠোঁটের স্পর্শের আদ্রতা মিলে যাচ্ছে – মিলেমিশে একটাই সিক্ততা এনে দিয়েছে সেই অনাবিল অন্তরঙ্গতার আচমকা ঢেউ এ | সব ভয়ডর, দ্বিধাদন্দ, বৈধতা-অবৈধতা সব গলে প্রেমের জোয়ারে, পাল তোলা নৌকোর মতন ভেসে চলেছে | নিজের বুকের হৃদকম্পন নিজে শুনতে পাচ্ছি – ঢক, ঢক, ঢক | আমি যেন একটা চুম্বকের আকর্ষণ থেকে নিজেকে আর ছাড়িয়ে নিতে পারছিনা |
“নতুন বৌদি | আমায় ক্ষমা করো, নতুন বৌদি | আমি আর পারলামনা | তোমার কাছে আসতে আসতে আর সামলাতে পারলামনা | তোমাকে যে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আমি |”
ওর মুখে কথা নেই | আমায় আঁকড়ে রেখে ও আমায় তখনো আদর করে চলেছে |
অনুভূতির পরশ, আরাম আর ভোরবেলা থেকে জেগে থাকবার ক্লান্তি –সব মিলিয়ে আমার চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছে | ওর গায়ে মাথা এলিয়ে দিয়েছি |
“এভাবে পারবেনা, ব্যথা লেগে যাবে | ঘাড়ে টান পরবে | শুয়ে পড়, ঘরে গিয়ে | সেই কোন সকালে উঠতে হয়েছিল বলত ?”
ঘরে এলাম | ও একটু নিজের ঘর থেকে এলো |
“ঘুমাও নি এখনো ?”
“একটু থাকো আমার পাশে |”
“আমি তো আছি, একদম তোমারি পাশে |” আমার পাশে এসে বসলো লিপি | নিজেই বুকের মধ্যে আমার মাথাটা টেনে নিলো | ওর আঁচল দিয়ে আমার মুখটা ঢাকা | মনে হলো,
“তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি |
মম দুঃখ বেদন, মম সকল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম |”
ঘুমের আগে ওর কাছে গান শোনবার আবদার করেছিলাম | ও গাইছিলো,
“কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে, রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে,
তুমি সাধ ক’রে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রং বক্ষে নিও
এই হৃদ্কমলের রাঙা রেনু, রাঙাবে ওই উত্তরীয় ||”
এক সময়ে দেখলাম, ভোর হতে আসছে | আবছা আলোয় ওকে ভীষণ মিষ্টি লাগছিলো | ও শুয়ে ছিল, চোখটা বন্ধ করে |
আজ ২৭ শে সেপ্টেম্বর | নতুন বৌদির ২৭ বছরের জন্মদিন | প্রকৃতি ওকে একগুচ্ছ ভোরের আলো পাঠিয়ে দিলো, জন্মদিনের উপহার হিসাবে |
অষ্টম পর্ব
সকালে উঠে নতুন বৌদি চলে গেলো নিজের ঘরে | আমি মুখ ধোব বলে বাথরুমের বেসিনের সামনে এলাম | আয়নায় নিজেকে দেখলাম | আমার ঠোঁটে নিজেরই আঙ্গুল ছোঁয়ালাম | সেখানে কি এখনো লেগে রয়েছে কাল রাতের ওই হঠাত হাওয়ায় ভেসে আসা আনন্দময় মুহুর্তটির ছোঁয়া ? এখনো কি পাওয়া যাচ্ছেনা প্রেমে, উত্তাপে সিক্ত নিবিড় অন্তরঙ্গতার স্বাদ আর গন্ধটুকু ? কোন পুন্যে এই পুরস্কার পেয়েছি ?কেন ? কেন এভাবে ভালোবেসেছি ? ভালো যদি বেসেইছি তো এর পর কি ? এর পর কি হবে ? জলে ভেসে যাচ্ছিলো দু চোখ, কল থেকে পরা জল চোখে দেবার আগেই, যখন মনের মধ্যে ফিরে ফিরে বাজছিলো ওর গাওয়া কাল রাতের ওই গানের কলিটা –
কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে, রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে
এ ভাবে ভালোবাসলে তার চরম আকাঙ্খা একটাই – হৃদয়ে, শরীরের অনুতে, পরমানুতে, সব টুকু পাওয়া | যদি পাইও, তারপর ? যে আমার হৃদয়ে ইতিমধ্যেই মিশে গেছে, যাকে আরো কাছে পাবার জন্য আমি ব্যাকুল থেকে ব্যাকুলতর হয়ে উঠছি, সে বিবাহিতা, আমারি অগ্রজের স্ত্রী | এতটা ভালোবেসে কেমন করে জেনেশুনে তাকে কলঙ্কিনী করতে পারি, মেজদার সাথে এতটা ছলনা করতে পারি, যে বিশ্বাসে ও আমাদের দুজনকে এখানে আসতে দিয়েছে সে বিশ্বাস ভেঙ্গে ওর সাথে প্রতারণা করতে পারি ? না, না, না – এ আমি পারবনা, আমায় দূরে সরতেই হবে | নিজের মনে জোর করেই প্রতিজ্ঞাটা করলাম |
স্নান সেরে dress করলাম, তখনি দুই ঘরের ভিতরের দরজাটা খুলে গেলো | লিপি বেরোলো | আমি এক মনে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে | আমারি দেওয়া ওই কালো প্রিন্টেড সিল্কের শাড়িটা পরে | শুধু একটিই কথা মুখ দিয়ে বেরোলো –“কি করে এত সুন্দর হলে লিপি ?” জন্মদিনের থেকেই লিপি হয়ে গেলো আমার দেওয়া বহু নামের আর একটি নাম | অদম্য ইচ্ছা হলো এক্ষুনি ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে | একটু আগেই নিজেকে নিজের করা প্রতিজ্ঞাটা স্মরণ করে আর এগোলামনা | ও হাতটা মেলে ধরলো, তখন নিজেরই করা প্রতিজ্ঞা চুরমার করে ভেঙ্গে ফেলে ছুটে গেলাম ওর দিকে | জড়িয়ে ধরে আদর করলাম, প্রাণ ভরে আদর খেলাম | কোনটা যে বেশি ভালো – আদর করা না কি আদর খাওয়া, তা বলা মুশকিল | কি ভাগ্য যে লিপস্টিক তখনো লাগায়নি |
দুজনে একসাথে বেরোবো আজকে | সারাদিন ঘুরবো পাহাড়ে পাহাড়ে | আমাদের গাড়ি তৈরিই ছিল |
মহাবালেশ্বর থেকে প্রতাপগড় এর দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার | ছত্রপতি শিবাজীর একটি দূর্গ, এখানে একটি পাহাড়ের মাথায় | সারাটা পথে আমাদের সঙ্গী সহ্যাদ্রি, আর নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাবিত্রী নদী | ভুবনমোহিনী দৃশ্য, সে কোনদিনও ভোলার নয় | আমাদের পথ চলায়, কখনো পেরিয়ে চলেছি উচু উচু পাথর, কথাও বা সিঁড়ি | মন্দিরের উপর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের বিশাল বিস্তৃতি আর নীচের ভ্যালি | সারাটা দিন ঘুরেছি দুজনে | দুপুরে ঘুরেছি মহাবালেশ্বরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি | লুডউইক্ পয়েন্ট, কেটস পয়েন্ট, এল্ফিন্সটন পয়েন্ট, টাইগার স্প্রিং এবং সেখান থেকে আর একটু এগিয়েই মহাবালেশ্বরের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আর্থার সীট | আর্থার সীট থেকে নীচে তাকাতে ভীষণ ভয় করে | মনে হয়, একবার গড়িয়ে পড়লে একেবারে কয়েক হাজার ফিট নীচে তলিয়ে যাবো | দুজনে একসঙ্গে যদি তলিয়ে যাই ? সে মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনা |
আমি ওর ছবি তুলছিলাম | আমার থেকে অল্প একটু বড় হবেন এক ভদ্রলোক আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড়াতে বললেন, আমাদের ছবি তুলে দেবেন বলে | শুধু পাশাপাশি দাঁড়ালেই হবেনা, ক্লোজ হতে হবে | দুজনকেই সমানে ইঙ্গিত করছেন ক্লোজ হতে, নইলে ছবি রোম্যান্টিক হবেই বা কি করে ? ভদ্রলোক এক রকম দৃঢ় ধারনাই করে নিয়েছেন যে আমরা নববিবাহিত দম্পতি | দুজনে বেদম উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা |
পথচলার মাঝে কোনো কোনো জায়গা একটু বেশি উচুনীচু | একটু কষ্ট হলে কোনো বড় পাথর পেলে বসে নিচ্ছি, সামনের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের টানে আবার এগুচ্ছি | নতুন বৌদির চেহারায় একটা মুক্তির ছাপ – কতদিন পর একটু যেন খোলা আকাশে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, প্রতিদিনের একঘেয়েমির একটুখানি বাইরে এসে |
-“ওইখানে যাবে ?” পাহাড়ের ধারের একটা পাথরে বসে আমি জিজ্ঞেস করলাম |
-“কোথায় ?”
-“ওই দূরের পাহাড়টায় ? একটা ছোট ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছে ?”
-“কোথায় ?”
-“বায়নাকুলার টা নিয়ে দেখো |”
একটুক্ষণ বাইনোকুলার নিয়ে নাড়াচারা করবার পর ও দেখতে পেলো |
-“ওম্মা, কি সুন্দর !”
-“আমি বলছি, ওইখানটায় যাবো |”
-“কি ভাবে শুনি ? উড়ে উড়ে |”
-“না, সুরে সুরে |” আমি উত্তর করলাম |
-“সুর মিলিয়ে ?”
-“ওখানে পৌছে গিয়ে গলা খুলে গাইবো দুজনে”
-“কি গাইবে ?”
-“চিরনূতনের গানটা-
“আপনারে দেয় ঝরনা আপন ত্যাগরসে উচ্ছলি-
লহরে লহরে নুতন নুতন অর্ঘ্যের অঞ্জলী”
একটু থেমে আমি বললাম, “কেন গলা খুলে গাইবো, সেটা জিজ্ঞাসা করলে না তো ?”
“কেন ?”
-“ঝর্ণার জলে লুকিয়ে লুকিয়ে তুমি আর আমি স্নান করবো একসঙ্গে, কেউ দেখতে পাবেনা আমাদের |”
প্রেমিকার সাথে এহেন দুরন্ত কল্পনাটি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক যুবককে কি করতে পারে তা সহজেই অনুমেয় |
ও লজ্জায় মুখ লাল করে ফেললো –“যাঃ, কি অসভ্য না তুমি |”
“মগের বারি টা তো খেতে হবেনা |”
ও চিমটি কেটে বললো, “ওঠ এখন” |
হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে গড়িয়ে গেছে | আবার বসেছি আমাদের একান্ত নিভৃত সেই জায়গাটিতে | ছেলেটিকে চা দিতে বলে দুজনে বসে গল্প করে চলেছি, অস্তগামী সূর্যকে সাক্ষী রেখে |
-“কাল তোমায় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করবো ভেবেছিলাম | এমন রেগে গেলে যে করতেই পারলামনা |”
-“আচ্ছা, আর রাগ করবনা | বলো ?”
-“কবে থেকে লেখো ?”
-“খুব ছোটবেলাতে | তখন সবে ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’ পড়েছি, ছোটদের শারদীয়াগুলি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে হাস্যকৌতুক গুলি পড়েছি – ভীষণ ইচ্ছা হত নিজেও একটু লিখি | লিখেও ফেলেছিলাম, সবাইকে তখন দেখাই | জানি, খুব হাস্যকর হিজিবিজি কিছুই নিশ্চই লিখেছি, একটা শিশু আর কিই বা লিখবে ? সবাই পরিহাস করেছিলো | নিজের অতি সামান্য সৃষ্টিতে অপমান একটা শিশুরও ভালো লাগেনা | আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম লেখা থেকে, এমন কি সাহিত্য থেকেও | বাড়িতে দাদা দিদিরা ভালো লেখেন, তাঁদের শব্দ ভান্ডার আমার চেয়ে কয়েক গুন বেশি, আমি সারা জীবন চেষ্টা করে গেলেও তাঁদের পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করতে পারবনা জানতাম | আমার ভাষা দুর্বল, বাংলা খাতা লাল দাগে দাগে ভরে যায় – আমি কিনা লিখবো ?
বাড়ির সন্ধ্যার আড্ডায় কত গুরুগম্ভীর প্রসঙ্গ আসতো – রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা | লেখাও হত, লেখা পড়াও হত, সে শব্দের ভান্ডারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে দম বন্ধ লাগতো, বাক্যের কোথায় আরম্ভ, কোথায় তার শেষ, আমার সীমিত ক্ষমতায় তার হিসাব নিকাশ করতেও ছিলাম অক্ষম |”
-“এত অভিমানে সব ছেড়ে দিলে ?”
-“হ্যা, তাই | তখন মনে হয় সেভেন বা এইটে পড়ি | বাংলা সেকেন্ড পেপার এর পরীক্ষা চলছে | রচনা এসেছে, রচনা বই দেখে কিছু মুখস্ত করাও নেই | আমি নিজের মতন করে লিখছি, কথার ভাষার মতন করেই আমার লেখার ভাষা চলছিলো, কঠিন কিছুই নেই | জানি, ২০ র মধ্যে ১০ পেলেই আমি ধন্য | পাশে এসে আমাদের স্যার দাঁড়ালেন | ভীষণ অস্বস্তি হয় তখন | টুকছিনা, কিছুনা – আমার পাশে এসে দাঁড়াবার দরকারটা কি স্যারের ? আমি লিখছিলাম | স্যার চুপ করে দাঁড়িয়ে | উনি বাংলার শিক্ষকও নন | কিছুতেই নড়ছেন না পাশের থেকে | আমি বারবার স্যারের দিকে তাকাচ্ছিলাম দেখে উনিও বুঝতে পারলেন আমার অস্বস্তি | সরে গেলেন | খাতাটা জমা নেওয়ার সময়ে স্যার আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “ভারী সুন্দর লিখিস তো তুই |” রচনাতে নম্বর কত পেয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু সেদিন স্যারের ওই কথা শুনে আমার চোখে জল এসেছিলো, নতুন বৌদি |”
ও আমার হাতটা চেপে ধরলো | বললো, “তারপর ?”
“একটু লিখেছি | কলেজে দুজন ভীষণ ভালো বন্ধু ছিল | লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কে আমার লেখা পড়াতাম | জানি, অত্যন্ত অপরিনত লেখা, কোনো অর্থবাহী লেখাই নয়, কিন্তু আমার দুই বন্ধুর খুব ভালো লাগতো পড়তে, অন্ততঃ ওরা তাই বলতো আমায় | কলেজে পৌছালেই জিজ্ঞাসা করতো, লেখা কই রে ? ভারী ভালো লাগতো তখন |”
“বাড়ির কেউ জানেন তুমি লেখো ?”
“না”
“আমায় কাকিমা বলেছিলেন তোমার চিঠি নাকি piece of literature?”
আমি চুপ করেই ছিলাম |
“ছাত্রজীবনে প্রেম করনি ? প্রেম করলে দেখতে লেখা আরো কত সুন্দর হত !” নতুন বৌদি বললো |
“প্রেম করলাম কই ?”
“হাসলে যে ?”
“কিছু না, ভীষণ ছোট্ট একটা encounter, একটু ভালো লাগা, লাগতে না লাগতেই ছেড়ে যাওয়া – সেটা প্রেম ছিলনা | Just a collection of few innocent sweet moments |”
“লেখনি সেটা ?”
“চেষ্টা করেছিলাম | লিখতে গিয়ে শুধু গান আর গান মনে আসতো | গানের চোটে গল্প আর এগুচ্ছিলো কই ? কিন্তু, পরে দেখলাম, এতো মজা মন্দ নয় ? রবীন্দ্রনাথের গানের মতন এত সুন্দর ন্যাশনাল হাইওয়ে থাকলে আর চিন্তা কোথায় ? একটু স্টিয়ারিং টা ধরে রাখলেই গাড়ি এগিয়ে যাবে |”
একটু থেমে বলছিলাম “একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানো, নতুন বৌদি ? যখন গাইতে বসি, তখন লেখা মনে হয়, যখন লিখতে বসি তখন খালি গান মনে হয় | কোনটাই হয়তো ঠিক করে পারিনা, সুর রাখলে তাল হারায়, আর লেখা ? জানিনা | আজ তুমি নিজের থেকে জিজ্ঞেস করলে, তাই এতগুলি কথা বললাম | কোনদিন তো কাউকে বলিনি |”
“ছোট ঠাকুরপো, তোমার জীবন তো শুরুই হয়নি এখনো | কত কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে – স্ত্রী, সন্তান, প্রতিষ্ঠা সব তুমি এক এক করে পাবে | আমার মতন বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ বয়ে, মরুপথে হারিয়ে যাওয়া নদীর মতন থেমে যেতে হবেনা”
কত রাত অবধি গল্প করছিলাম | খোলা আকাশের নীচে একটু একটু ঠান্ডা লাগছিলো, নতুন বৌদি নাক টানছিলো, তাই ঘরে চলে এলাম | ও নিজের কথা বলছিলো | কখনো বলেনা | আমার কাছে বলে যদি একটু হালকা হয় | একটা কথা মনে ভীষণ বাজলো, “মানুষ রয়ে গিয়েও কিরকম হারিয়ে যায়, তাই না ?”
আমি ওকে নিজের একদম কাছে টেনে আমার বুকের মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরলাম | আজ সকালের প্রতিজ্ঞাটা রাখতে সারাদিন দূরে দূরেই ছিলাম | জোর করে, নিজের সাথে প্রত্যেক মুহুর্তে লড়াই করেই ছিলাম |
“চিরনূতন, আর যেই হারিয়ে যাক না কেন, তোমার জীবন থেকে আমি কোনদিন হারিয়ে যেতে পারবনা | যে তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, সে নিজেরই সব কিছু হারাবে |”
“কেন – অর্থ, প্রতিষ্ঠা সব ই তো থাকবে |”
“থাকলেও সে হারাবে | হয়তো জানবেও না, কি হারিয়েছে |”
ও আমার বুকের মধ্যে মাথাটা গুঁজে ছিল | আমার দিকে তাকিয়ে অভিমান ভরে বললো, “আজ সারাদিনে, সকালের পরে একবারও তো আমাকে কাছে টানোনি ?”
“জানি, নিজের প্রতিজ্ঞার সাথে নিজের লড়াই |”
“কিসের লড়াই ?”
“তুমি বিবাহিতা, আমারই মেজদার সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ | সকালে ভেবেছিলাম, তোমার সাথে এভাবে নিজেকে লতায়, পাতায় জড়িয়ে রাখবনা | আর একদিকে তোমার সাথে ভালোবাসার স্রোতে বাঁধনহারা হয়ে খেলে বেড়াবার একটা অদম্য বাসনা | লড়াইটা এই দুটোরই মধ্যে |”
“কার জিত চাও ?” ও আমায় জিজ্ঞাসা করলো |
“আমি কথায় বলতে পারছিনা, তুমি বুঝে নিতে পারবে না ?”
“তুমি যা চাইবে, তাই পাবে | জীবনে এই দুটো তিনটে দিন আমার মুক্তি, তারপর আমি বন্দী, বরাবরের মতন | তুমিও চলে যাবে |”
“পাবো ?” ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম | আমার সমস্ত মন, প্রাণ, শরীর কামনার উন্মাদনায় কাঁপছে |
ও চোখটা বন্ধ করে আমায় আরো জোরে নিজের সাথে আঁকড়ে নিলো |
কালকের পর আর একবার আমার ঠোঁটের সাথে ওর ঠোঁট মিলিয়ে দিলাম | আজ আমাদের নিঃশ্বাস গতকালের চেয়েও উত্তপ্ত, আরো ঘন ঘন পড়ছে | ভিতরের সেই ধক ধক | আজ যেন দামামার মতন বেজে চলেছে | এ বন্ধ হবার নয় |
ওর হাতটা আমার বুকের মধ্যে চেপে রেখে ফিসফিস করে বললাম, “বুঝতে পারছো ?”
“পারছি, সব পারছি |” বলে জোরে জোরে ওর মাথাটা আমার বুকের সাথে ঘষতে থাকলো |
“লিপি! কি করছো আমায় ?”
“আমি সব দিতে রাজী |”
প্রেমের কত রূপ আছে ! কখনো শান্ত, স্নিগ্ধ, মধুর, কখনো বা সে উত্তপ্ত, দুরন্ত – যেন ঘুর্নির মতো করে ধেয়ে আসে | সব উড়িয়ে নিয়ে যায়, বৈশাখী ঝড়ের মতন বেড়া ভেঙ্গে উদ্দাম উল্লাসে সে আসে | প্রকৃতির সাথে মানুষের চাওয়া পাওয়ার ও যে এতটাই সাদৃশ্য, সে রাতের আগে জানতামনা | সে জন্যই বুঝি প্রকৃতির সবটুকু উজাড় করে ঢেলে দেওয়া আছে নারীর শরীরে ?
ঝড় আসবার জন্য কত প্রতীক্ষা | তাই তো আমরা ঝড়কে বরণ করি বারবার | নইলে গাই কেন, “ঝড় কে পেলেম সাথী?” আবার,
“ঝড় কে আমি করবো মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে –
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি ||”
আরো,
“ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে”
ঘরে আবছা আলো, সেখানে তখনো যেন ঝড় বয়ে চলেছে | দুই অনাবৃত শরীরকে একসঙ্গে আড়াল করে রাখার জন্য যে সাদা চাদর ছিল, সেটাও উড়ে যেতে চাইছে স্পর্শে স্পর্শে আবিষ্কারের নেশায়, পরিপূর্ণ পরিচয়টুকুর অপেক্ষায় আর উন্মাদনায় | প্রতিটি মুহূর্ত এগোচ্ছে, ছন্দে ছন্দে তালে তালে পূর্ণতা পাচ্ছে মিলনের লগ্ন, আরো যেন চাই, আরো, আরো | ঝড়ের সাথে সাথে যেন দেখতে পাচ্ছি বিদ্যুতের ঝলকানি | ভালোলাগায়, ভালোবাসায় লিপি চোখটাকে বন্ধ করে ফেলেছে | এবার বোধ হয় বৃষ্টি আসছে | কঠিনতা আর কোমলতার মেলবন্ধন গলে বয়ে চলেছে স্রোতের ধারা |
সে ঝড় এক সময়তে থেমে গেছে | ফিরে এসেছে প্রেমের স্নিগ্ধতা | ঘরে চাঁদের আলো ঢুকেছিলো | তাতেও ওর লজ্জা | চাদরটা দিয়ে আবার আমাদের ঢেকে নিয়েছিলাম, ওকে আড়াল করতে |
এইবার ভীষণ দুষ্টু হেসে আমায় বললো, “কখন দেবে ?”
“কালকে সকালে | কাল ২৭ শে সেপ্টেম্বর | তোমার জন্মদিন | আমার মনে আছে |”
“আমার কাছেও কথা গোপন করতে তোমার ভালো লাগে ?”
“পারলাম কই ? হারিয়ে দিলে তো |”
দূরে, নীচে, অন্ধকার পাহাড়ের গা বেয়ে দু একটা গ্রামের আলো ঝিকমিক করছিলো | চারপাশটা কী নিস্তব্ধ | হালকা হালকা ঠান্ডা | আমার গায়ের পাশে, একদম গা ঘেঁষে আমার লিপি বসে আছে | অপূর্ব একটা অনুভূতি হচ্ছিলো | এ মুহুর্তগুলি মনের ভিতরে রয়েই যায় | ছবি না তুললেও |
রাত্তিরের খাওয়া শেষ করে আবার এসে বসলাম আমাদের নিজেদের সেই জায়গাটিতে | নিঝুম রাত, আমরা বসে বসে গল্প করছি | ও বললো “সারাক্ষণ বক বক করলে ভালো লাগেনা | একটু চুপ করে বস |”
“আস্তে আস্তে একটু একটু কথা ? চলতে পারে ?”
“পারে”
“কানে কানে কথা?”
“কি বলবে?” ও আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বললো |
“একটা খেলা খেলবে ?”
“কানে কানে খেলা | একবার এই কানে, একবার ওই কানে |”
“কে বলবে ?”
“তুমি বলবে”
“কি বলবে ?”
“কিচ্ছুনা”
একবার এই কানে, আবার ওই কানে, আবার এই কানে, আবার মুখ ডিঙিয়ে ওই কানে – বারবার | মজা হচ্ছিলো, হেসে লুটোচ্ছিলাম দুজনে | বড্ড বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলো আমাদের খেলাটা ! কানের সাথে মুখ, মুখের সাথে কান – দুইয়ের বদলা বদলিতে বিপত্তিটা ঘটেই গেলো |
আমি পারলামনা | হেরে গেলাম | ঠোঁটের সাথে ঠোঁট – মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো | আমার লিপির ঠোঁটে আমার প্রথম চুম্বন | নিঃশ্বাস এর সাথে নিঃশ্বাস মিশে যাচ্ছে, ঠোঁটের স্পর্শের আদ্রতা মিলে যাচ্ছে – মিলেমিশে একটাই সিক্ততা এনে দিয়েছে সেই অনাবিল অন্তরঙ্গতার আচমকা ঢেউ এ | সব ভয়ডর, দ্বিধাদন্দ, বৈধতা-অবৈধতা সব গলে প্রেমের জোয়ারে, পাল তোলা নৌকোর মতন ভেসে চলেছে | নিজের বুকের হৃদকম্পন নিজে শুনতে পাচ্ছি – ঢক, ঢক, ঢক | আমি যেন একটা চুম্বকের আকর্ষণ থেকে নিজেকে আর ছাড়িয়ে নিতে পারছিনা |
“নতুন বৌদি | আমায় ক্ষমা করো, নতুন বৌদি | আমি আর পারলামনা | তোমার কাছে আসতে আসতে আর সামলাতে পারলামনা | তোমাকে যে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আমি |”
ওর মুখে কথা নেই | আমায় আঁকড়ে রেখে ও আমায় তখনো আদর করে চলেছে |
অনুভূতির পরশ, আরাম আর ভোরবেলা থেকে জেগে থাকবার ক্লান্তি –সব মিলিয়ে আমার চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে আসছে | ওর গায়ে মাথা এলিয়ে দিয়েছি |
“এভাবে পারবেনা, ব্যথা লেগে যাবে | ঘাড়ে টান পরবে | শুয়ে পড়, ঘরে গিয়ে | সেই কোন সকালে উঠতে হয়েছিল বলত ?”
ঘরে এলাম | ও একটু নিজের ঘর থেকে এলো |
“ঘুমাও নি এখনো ?”
“একটু থাকো আমার পাশে |”
“আমি তো আছি, একদম তোমারি পাশে |” আমার পাশে এসে বসলো লিপি | নিজেই বুকের মধ্যে আমার মাথাটা টেনে নিলো | ওর আঁচল দিয়ে আমার মুখটা ঢাকা | মনে হলো,
“তব অঞ্চল ছায়া মোরে রহিবে ঢাকি |
মম দুঃখ বেদন, মম সকল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম |”
ঘুমের আগে ওর কাছে গান শোনবার আবদার করেছিলাম | ও গাইছিলো,
“কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে, রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে,
তুমি সাধ ক’রে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রং বক্ষে নিও
এই হৃদ্কমলের রাঙা রেনু, রাঙাবে ওই উত্তরীয় ||”
এক সময়ে দেখলাম, ভোর হতে আসছে | আবছা আলোয় ওকে ভীষণ মিষ্টি লাগছিলো | ও শুয়ে ছিল, চোখটা বন্ধ করে |
আজ ২৭ শে সেপ্টেম্বর | নতুন বৌদির ২৭ বছরের জন্মদিন | প্রকৃতি ওকে একগুচ্ছ ভোরের আলো পাঠিয়ে দিলো, জন্মদিনের উপহার হিসাবে |
অষ্টম পর্ব
সকালে উঠে নতুন বৌদি চলে গেলো নিজের ঘরে | আমি মুখ ধোব বলে বাথরুমের বেসিনের সামনে এলাম | আয়নায় নিজেকে দেখলাম | আমার ঠোঁটে নিজেরই আঙ্গুল ছোঁয়ালাম | সেখানে কি এখনো লেগে রয়েছে কাল রাতের ওই হঠাত হাওয়ায় ভেসে আসা আনন্দময় মুহুর্তটির ছোঁয়া ? এখনো কি পাওয়া যাচ্ছেনা প্রেমে, উত্তাপে সিক্ত নিবিড় অন্তরঙ্গতার স্বাদ আর গন্ধটুকু ? কোন পুন্যে এই পুরস্কার পেয়েছি ?কেন ? কেন এভাবে ভালোবেসেছি ? ভালো যদি বেসেইছি তো এর পর কি ? এর পর কি হবে ? জলে ভেসে যাচ্ছিলো দু চোখ, কল থেকে পরা জল চোখে দেবার আগেই, যখন মনের মধ্যে ফিরে ফিরে বাজছিলো ওর গাওয়া কাল রাতের ওই গানের কলিটা –
কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে, রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে
এ ভাবে ভালোবাসলে তার চরম আকাঙ্খা একটাই – হৃদয়ে, শরীরের অনুতে, পরমানুতে, সব টুকু পাওয়া | যদি পাইও, তারপর ? যে আমার হৃদয়ে ইতিমধ্যেই মিশে গেছে, যাকে আরো কাছে পাবার জন্য আমি ব্যাকুল থেকে ব্যাকুলতর হয়ে উঠছি, সে বিবাহিতা, আমারি অগ্রজের স্ত্রী | এতটা ভালোবেসে কেমন করে জেনেশুনে তাকে কলঙ্কিনী করতে পারি, মেজদার সাথে এতটা ছলনা করতে পারি, যে বিশ্বাসে ও আমাদের দুজনকে এখানে আসতে দিয়েছে সে বিশ্বাস ভেঙ্গে ওর সাথে প্রতারণা করতে পারি ? না, না, না – এ আমি পারবনা, আমায় দূরে সরতেই হবে | নিজের মনে জোর করেই প্রতিজ্ঞাটা করলাম |
স্নান সেরে dress করলাম, তখনি দুই ঘরের ভিতরের দরজাটা খুলে গেলো | লিপি বেরোলো | আমি এক মনে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে | আমারি দেওয়া ওই কালো প্রিন্টেড সিল্কের শাড়িটা পরে | শুধু একটিই কথা মুখ দিয়ে বেরোলো –“কি করে এত সুন্দর হলে লিপি ?” জন্মদিনের থেকেই লিপি হয়ে গেলো আমার দেওয়া বহু নামের আর একটি নাম | অদম্য ইচ্ছা হলো এক্ষুনি ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে | একটু আগেই নিজেকে নিজের করা প্রতিজ্ঞাটা স্মরণ করে আর এগোলামনা | ও হাতটা মেলে ধরলো, তখন নিজেরই করা প্রতিজ্ঞা চুরমার করে ভেঙ্গে ফেলে ছুটে গেলাম ওর দিকে | জড়িয়ে ধরে আদর করলাম, প্রাণ ভরে আদর খেলাম | কোনটা যে বেশি ভালো – আদর করা না কি আদর খাওয়া, তা বলা মুশকিল | কি ভাগ্য যে লিপস্টিক তখনো লাগায়নি |
দুজনে একসাথে বেরোবো আজকে | সারাদিন ঘুরবো পাহাড়ে পাহাড়ে | আমাদের গাড়ি তৈরিই ছিল |
মহাবালেশ্বর থেকে প্রতাপগড় এর দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার | ছত্রপতি শিবাজীর একটি দূর্গ, এখানে একটি পাহাড়ের মাথায় | সারাটা পথে আমাদের সঙ্গী সহ্যাদ্রি, আর নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাবিত্রী নদী | ভুবনমোহিনী দৃশ্য, সে কোনদিনও ভোলার নয় | আমাদের পথ চলায়, কখনো পেরিয়ে চলেছি উচু উচু পাথর, কথাও বা সিঁড়ি | মন্দিরের উপর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের বিশাল বিস্তৃতি আর নীচের ভ্যালি | সারাটা দিন ঘুরেছি দুজনে | দুপুরে ঘুরেছি মহাবালেশ্বরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি | লুডউইক্ পয়েন্ট, কেটস পয়েন্ট, এল্ফিন্সটন পয়েন্ট, টাইগার স্প্রিং এবং সেখান থেকে আর একটু এগিয়েই মহাবালেশ্বরের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আর্থার সীট | আর্থার সীট থেকে নীচে তাকাতে ভীষণ ভয় করে | মনে হয়, একবার গড়িয়ে পড়লে একেবারে কয়েক হাজার ফিট নীচে তলিয়ে যাবো | দুজনে একসঙ্গে যদি তলিয়ে যাই ? সে মৃত্যুকে আমি ভয় পাইনা |
আমি ওর ছবি তুলছিলাম | আমার থেকে অল্প একটু বড় হবেন এক ভদ্রলোক আমাদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড়াতে বললেন, আমাদের ছবি তুলে দেবেন বলে | শুধু পাশাপাশি দাঁড়ালেই হবেনা, ক্লোজ হতে হবে | দুজনকেই সমানে ইঙ্গিত করছেন ক্লোজ হতে, নইলে ছবি রোম্যান্টিক হবেই বা কি করে ? ভদ্রলোক এক রকম দৃঢ় ধারনাই করে নিয়েছেন যে আমরা নববিবাহিত দম্পতি | দুজনে বেদম উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা |
পথচলার মাঝে কোনো কোনো জায়গা একটু বেশি উচুনীচু | একটু কষ্ট হলে কোনো বড় পাথর পেলে বসে নিচ্ছি, সামনের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের টানে আবার এগুচ্ছি | নতুন বৌদির চেহারায় একটা মুক্তির ছাপ – কতদিন পর একটু যেন খোলা আকাশে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, প্রতিদিনের একঘেয়েমির একটুখানি বাইরে এসে |
-“ওইখানে যাবে ?” পাহাড়ের ধারের একটা পাথরে বসে আমি জিজ্ঞেস করলাম |
-“কোথায় ?”
-“ওই দূরের পাহাড়টায় ? একটা ছোট ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছে ?”
-“কোথায় ?”
-“বায়নাকুলার টা নিয়ে দেখো |”
একটুক্ষণ বাইনোকুলার নিয়ে নাড়াচারা করবার পর ও দেখতে পেলো |
-“ওম্মা, কি সুন্দর !”
-“আমি বলছি, ওইখানটায় যাবো |”
-“কি ভাবে শুনি ? উড়ে উড়ে |”
-“না, সুরে সুরে |” আমি উত্তর করলাম |
-“সুর মিলিয়ে ?”
-“ওখানে পৌছে গিয়ে গলা খুলে গাইবো দুজনে”
-“কি গাইবে ?”
-“চিরনূতনের গানটা-
“আপনারে দেয় ঝরনা আপন ত্যাগরসে উচ্ছলি-
লহরে লহরে নুতন নুতন অর্ঘ্যের অঞ্জলী”
একটু থেমে আমি বললাম, “কেন গলা খুলে গাইবো, সেটা জিজ্ঞাসা করলে না তো ?”
“কেন ?”
-“ঝর্ণার জলে লুকিয়ে লুকিয়ে তুমি আর আমি স্নান করবো একসঙ্গে, কেউ দেখতে পাবেনা আমাদের |”
প্রেমিকার সাথে এহেন দুরন্ত কল্পনাটি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক যুবককে কি করতে পারে তা সহজেই অনুমেয় |
ও লজ্জায় মুখ লাল করে ফেললো –“যাঃ, কি অসভ্য না তুমি |”
“মগের বারি টা তো খেতে হবেনা |”
ও চিমটি কেটে বললো, “ওঠ এখন” |
হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে গড়িয়ে গেছে | আবার বসেছি আমাদের একান্ত নিভৃত সেই জায়গাটিতে | ছেলেটিকে চা দিতে বলে দুজনে বসে গল্প করে চলেছি, অস্তগামী সূর্যকে সাক্ষী রেখে |
-“কাল তোমায় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করবো ভেবেছিলাম | এমন রেগে গেলে যে করতেই পারলামনা |”
-“আচ্ছা, আর রাগ করবনা | বলো ?”
-“কবে থেকে লেখো ?”
-“খুব ছোটবেলাতে | তখন সবে ‘রামের সুমতি’, ‘বিন্দুর ছেলে’ পড়েছি, ছোটদের শারদীয়াগুলি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি, রবীন্দ্র রচনাবলী থেকে হাস্যকৌতুক গুলি পড়েছি – ভীষণ ইচ্ছা হত নিজেও একটু লিখি | লিখেও ফেলেছিলাম, সবাইকে তখন দেখাই | জানি, খুব হাস্যকর হিজিবিজি কিছুই নিশ্চই লিখেছি, একটা শিশু আর কিই বা লিখবে ? সবাই পরিহাস করেছিলো | নিজের অতি সামান্য সৃষ্টিতে অপমান একটা শিশুরও ভালো লাগেনা | আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম লেখা থেকে, এমন কি সাহিত্য থেকেও | বাড়িতে দাদা দিদিরা ভালো লেখেন, তাঁদের শব্দ ভান্ডার আমার চেয়ে কয়েক গুন বেশি, আমি সারা জীবন চেষ্টা করে গেলেও তাঁদের পর্যায়ে নিজেকে উন্নীত করতে পারবনা জানতাম | আমার ভাষা দুর্বল, বাংলা খাতা লাল দাগে দাগে ভরে যায় – আমি কিনা লিখবো ?
বাড়ির সন্ধ্যার আড্ডায় কত গুরুগম্ভীর প্রসঙ্গ আসতো – রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা | লেখাও হত, লেখা পড়াও হত, সে শব্দের ভান্ডারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে দম বন্ধ লাগতো, বাক্যের কোথায় আরম্ভ, কোথায় তার শেষ, আমার সীমিত ক্ষমতায় তার হিসাব নিকাশ করতেও ছিলাম অক্ষম |”
-“এত অভিমানে সব ছেড়ে দিলে ?”
-“হ্যা, তাই | তখন মনে হয় সেভেন বা এইটে পড়ি | বাংলা সেকেন্ড পেপার এর পরীক্ষা চলছে | রচনা এসেছে, রচনা বই দেখে কিছু মুখস্ত করাও নেই | আমি নিজের মতন করে লিখছি, কথার ভাষার মতন করেই আমার লেখার ভাষা চলছিলো, কঠিন কিছুই নেই | জানি, ২০ র মধ্যে ১০ পেলেই আমি ধন্য | পাশে এসে আমাদের স্যার দাঁড়ালেন | ভীষণ অস্বস্তি হয় তখন | টুকছিনা, কিছুনা – আমার পাশে এসে দাঁড়াবার দরকারটা কি স্যারের ? আমি লিখছিলাম | স্যার চুপ করে দাঁড়িয়ে | উনি বাংলার শিক্ষকও নন | কিছুতেই নড়ছেন না পাশের থেকে | আমি বারবার স্যারের দিকে তাকাচ্ছিলাম দেখে উনিও বুঝতে পারলেন আমার অস্বস্তি | সরে গেলেন | খাতাটা জমা নেওয়ার সময়ে স্যার আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “ভারী সুন্দর লিখিস তো তুই |” রচনাতে নম্বর কত পেয়েছিলাম মনে নেই, কিন্তু সেদিন স্যারের ওই কথা শুনে আমার চোখে জল এসেছিলো, নতুন বৌদি |”
ও আমার হাতটা চেপে ধরলো | বললো, “তারপর ?”
“একটু লিখেছি | কলেজে দুজন ভীষণ ভালো বন্ধু ছিল | লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কে আমার লেখা পড়াতাম | জানি, অত্যন্ত অপরিনত লেখা, কোনো অর্থবাহী লেখাই নয়, কিন্তু আমার দুই বন্ধুর খুব ভালো লাগতো পড়তে, অন্ততঃ ওরা তাই বলতো আমায় | কলেজে পৌছালেই জিজ্ঞাসা করতো, লেখা কই রে ? ভারী ভালো লাগতো তখন |”
“বাড়ির কেউ জানেন তুমি লেখো ?”
“না”
“আমায় কাকিমা বলেছিলেন তোমার চিঠি নাকি piece of literature?”
আমি চুপ করেই ছিলাম |
“ছাত্রজীবনে প্রেম করনি ? প্রেম করলে দেখতে লেখা আরো কত সুন্দর হত !” নতুন বৌদি বললো |
“প্রেম করলাম কই ?”
“হাসলে যে ?”
“কিছু না, ভীষণ ছোট্ট একটা encounter, একটু ভালো লাগা, লাগতে না লাগতেই ছেড়ে যাওয়া – সেটা প্রেম ছিলনা | Just a collection of few innocent sweet moments |”
“লেখনি সেটা ?”
“চেষ্টা করেছিলাম | লিখতে গিয়ে শুধু গান আর গান মনে আসতো | গানের চোটে গল্প আর এগুচ্ছিলো কই ? কিন্তু, পরে দেখলাম, এতো মজা মন্দ নয় ? রবীন্দ্রনাথের গানের মতন এত সুন্দর ন্যাশনাল হাইওয়ে থাকলে আর চিন্তা কোথায় ? একটু স্টিয়ারিং টা ধরে রাখলেই গাড়ি এগিয়ে যাবে |”
একটু থেমে বলছিলাম “একটা অদ্ভুত ব্যাপার জানো, নতুন বৌদি ? যখন গাইতে বসি, তখন লেখা মনে হয়, যখন লিখতে বসি তখন খালি গান মনে হয় | কোনটাই হয়তো ঠিক করে পারিনা, সুর রাখলে তাল হারায়, আর লেখা ? জানিনা | আজ তুমি নিজের থেকে জিজ্ঞেস করলে, তাই এতগুলি কথা বললাম | কোনদিন তো কাউকে বলিনি |”
“ছোট ঠাকুরপো, তোমার জীবন তো শুরুই হয়নি এখনো | কত কিছু তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে – স্ত্রী, সন্তান, প্রতিষ্ঠা সব তুমি এক এক করে পাবে | আমার মতন বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ বয়ে, মরুপথে হারিয়ে যাওয়া নদীর মতন থেমে যেতে হবেনা”
কত রাত অবধি গল্প করছিলাম | খোলা আকাশের নীচে একটু একটু ঠান্ডা লাগছিলো, নতুন বৌদি নাক টানছিলো, তাই ঘরে চলে এলাম | ও নিজের কথা বলছিলো | কখনো বলেনা | আমার কাছে বলে যদি একটু হালকা হয় | একটা কথা মনে ভীষণ বাজলো, “মানুষ রয়ে গিয়েও কিরকম হারিয়ে যায়, তাই না ?”
আমি ওকে নিজের একদম কাছে টেনে আমার বুকের মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরলাম | আজ সকালের প্রতিজ্ঞাটা রাখতে সারাদিন দূরে দূরেই ছিলাম | জোর করে, নিজের সাথে প্রত্যেক মুহুর্তে লড়াই করেই ছিলাম |
“চিরনূতন, আর যেই হারিয়ে যাক না কেন, তোমার জীবন থেকে আমি কোনদিন হারিয়ে যেতে পারবনা | যে তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে, সে নিজেরই সব কিছু হারাবে |”
“কেন – অর্থ, প্রতিষ্ঠা সব ই তো থাকবে |”
“থাকলেও সে হারাবে | হয়তো জানবেও না, কি হারিয়েছে |”
ও আমার বুকের মধ্যে মাথাটা গুঁজে ছিল | আমার দিকে তাকিয়ে অভিমান ভরে বললো, “আজ সারাদিনে, সকালের পরে একবারও তো আমাকে কাছে টানোনি ?”
“জানি, নিজের প্রতিজ্ঞার সাথে নিজের লড়াই |”
“কিসের লড়াই ?”
“তুমি বিবাহিতা, আমারই মেজদার সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ | সকালে ভেবেছিলাম, তোমার সাথে এভাবে নিজেকে লতায়, পাতায় জড়িয়ে রাখবনা | আর একদিকে তোমার সাথে ভালোবাসার স্রোতে বাঁধনহারা হয়ে খেলে বেড়াবার একটা অদম্য বাসনা | লড়াইটা এই দুটোরই মধ্যে |”
“কার জিত চাও ?” ও আমায় জিজ্ঞাসা করলো |
“আমি কথায় বলতে পারছিনা, তুমি বুঝে নিতে পারবে না ?”
“তুমি যা চাইবে, তাই পাবে | জীবনে এই দুটো তিনটে দিন আমার মুক্তি, তারপর আমি বন্দী, বরাবরের মতন | তুমিও চলে যাবে |”
“পাবো ?” ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম | আমার সমস্ত মন, প্রাণ, শরীর কামনার উন্মাদনায় কাঁপছে |
ও চোখটা বন্ধ করে আমায় আরো জোরে নিজের সাথে আঁকড়ে নিলো |
কালকের পর আর একবার আমার ঠোঁটের সাথে ওর ঠোঁট মিলিয়ে দিলাম | আজ আমাদের নিঃশ্বাস গতকালের চেয়েও উত্তপ্ত, আরো ঘন ঘন পড়ছে | ভিতরের সেই ধক ধক | আজ যেন দামামার মতন বেজে চলেছে | এ বন্ধ হবার নয় |
ওর হাতটা আমার বুকের মধ্যে চেপে রেখে ফিসফিস করে বললাম, “বুঝতে পারছো ?”
“পারছি, সব পারছি |” বলে জোরে জোরে ওর মাথাটা আমার বুকের সাথে ঘষতে থাকলো |
“লিপি! কি করছো আমায় ?”
“আমি সব দিতে রাজী |”
প্রেমের কত রূপ আছে ! কখনো শান্ত, স্নিগ্ধ, মধুর, কখনো বা সে উত্তপ্ত, দুরন্ত – যেন ঘুর্নির মতো করে ধেয়ে আসে | সব উড়িয়ে নিয়ে যায়, বৈশাখী ঝড়ের মতন বেড়া ভেঙ্গে উদ্দাম উল্লাসে সে আসে | প্রকৃতির সাথে মানুষের চাওয়া পাওয়ার ও যে এতটাই সাদৃশ্য, সে রাতের আগে জানতামনা | সে জন্যই বুঝি প্রকৃতির সবটুকু উজাড় করে ঢেলে দেওয়া আছে নারীর শরীরে ?
ঝড় আসবার জন্য কত প্রতীক্ষা | তাই তো আমরা ঝড়কে বরণ করি বারবার | নইলে গাই কেন, “ঝড় কে পেলেম সাথী?” আবার,
“ঝড় কে আমি করবো মিতে, ডরব না তার ভ্রূকুটিতে –
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি ||”
আরো,
“ওরে ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে”
ঘরে আবছা আলো, সেখানে তখনো যেন ঝড় বয়ে চলেছে | দুই অনাবৃত শরীরকে একসঙ্গে আড়াল করে রাখার জন্য যে সাদা চাদর ছিল, সেটাও উড়ে যেতে চাইছে স্পর্শে স্পর্শে আবিষ্কারের নেশায়, পরিপূর্ণ পরিচয়টুকুর অপেক্ষায় আর উন্মাদনায় | প্রতিটি মুহূর্ত এগোচ্ছে, ছন্দে ছন্দে তালে তালে পূর্ণতা পাচ্ছে মিলনের লগ্ন, আরো যেন চাই, আরো, আরো | ঝড়ের সাথে সাথে যেন দেখতে পাচ্ছি বিদ্যুতের ঝলকানি | ভালোলাগায়, ভালোবাসায় লিপি চোখটাকে বন্ধ করে ফেলেছে | এবার বোধ হয় বৃষ্টি আসছে | কঠিনতা আর কোমলতার মেলবন্ধন গলে বয়ে চলেছে স্রোতের ধারা |
সে ঝড় এক সময়তে থেমে গেছে | ফিরে এসেছে প্রেমের স্নিগ্ধতা | ঘরে চাঁদের আলো ঢুকেছিলো | তাতেও ওর লজ্জা | চাদরটা দিয়ে আবার আমাদের ঢেকে নিয়েছিলাম, ওকে আড়াল করতে |


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)