26-07-2020, 06:00 AM
পঞ্চম পর্ব
একটি একটি করে দিন এগিয়ে চলেছে | জুলাই এর শেষ দিন, যেদিন আনন্দে বিভোর হয়ে আমরা সবাই গাইছিলাম, “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে”, সে তো পেরিয়েই এসেছি | অগাস্ট মাসের শেষার্ধ ও দেখতে দেখতে চলে এলো | একটা দিন এগিয়ে যাওয়া, মানে একটা করে দিন ফুরিয়েও আসা | যখন ওই সুরটা আস্তে আস্তে মনের মধ্যে ঘুরতে শুরু করলো, “নাই নাই নাই যে বাকি সময় আমার”, মনে হচ্ছিলো ঠেলা দিয়ে ফিরে যাবার দিনটিকে সরিয়ে রাখি | কিন্তু সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরবে, নিজের অক্ষরেখা ধরেও আবার পাঁক খাবেই, দিন এগোবেই | সবই তো প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে যায়, আমরা কেউ তাকে বাধা দিতে পারবনা |
বাংলা মাসের হিসাবে শ্রাবন মাস সবে শেষ হয়ে গেছে, তবু বর্ষার বিরাম নেই | সকালে খবরের কাগজে বর্ষণের মোট হিসাবটা আগ্রহ সহকারে পড়তাম | যখন এসেছিলাম, তখন স্কোর বোর্ডে দেখতাম তিনশো | ধাপে ধাপে, কখনো বা লাফিয়ে লাফিয়ে, স্কোর পেরোলো পাঁচশো, হাজার, দেড় হাজার, দু হাজার – এবং still going strong !
মেজদা কাজের মধ্যে ডুবে গেছে | কোম্পানি নয়ডায় নতুন ইউনিট খুলছে তখন, তাই দিল্লি যেতে হচ্ছে বারবার | একটা বিরাট কন্ট্রাক্ট নাকি আসতে চলেছে ওদের | বোম্বেতে অগাস্ট মাসে বেশ কয়েকটা ছুটি পড়ে | স্বাধীনতা দিবস ছাড়াও জন্মাষ্টমী, মুম্বাইবাসীর অতি প্রিয় গণপতি, আরো একটা দুটো কি আমি হয়তো miss করে যাচ্ছি | আর ছুটি মানেই তো সারাটা দিন নতুন বৌদি | গল্প, গান, চা, VCR এ ছবি দেখা, এটা ওটা খাবার বানিয়ে দেবার অর্ডার – এইই চলতো | আর মেজদা নেই, তাই খাবার পরেও ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা চলতো দেওর-বৌদিতে মিলে |
সেদিন রাতে শুতে এসে দেখি বৃষ্টি হয়েই চলেছে | মনে হচ্ছিলো, “আমার প্রিয়ার ছায়া, আকাশে আজ ভাসে |” ইচ্ছা করছিলো, লিপি’র সাথে দেখা হলে ওকে ওই গানটা শোনাবো, “এমন দিনে তারে বলা যায়” | কিন্তু আমি যে গানটার সুর ভালো করে জানিনা, প্রথম দিকটা করতে পারবো, কিন্তু না শিখলে সুরে এদিক ওদিক বিচ্যুতি ঘটবে | আমায় কে শেখাবে গানটা ?
“নতুন বৌদি, এসোনা একটু”
“কি চাই ছোট ঠাকুরপো ?”
“একটা গান শিখিয়ে দেবে ?”
“এই মেরেছে, এই মাঝ রাত্তিরে ? লোক জন ঘুমিয়ে পড়েছে যে | এখন গান শুনলে সবাই ধরে পেটাবে | কাল হবে’খন |”
“না না নতুন বৌদি, এখনি | খুব আস্তে আস্তে গাও, আমি তুলে নেবো তোমার সাথে সাথে |”
“কোন গান ?”
“এমন দিনে তারে বলা যায়”
“গাও”
“আগে তোমার কাছ থেকে পুরোটা শুনবো |”
“শোনো তাহলে, খুব ধীরে গাইতে হয় –
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়
এমন মনস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় ||
গানটা তুলবো কেমন করে? আমি তো ডুবে গিয়েছিলাম সুরে, বাণীতে | পুরো গানটা হয়ে গেলে নতুন বৌদি বললো, “এবার আমার সঙ্গে সঙ্গে গাও” বলে আবার আরম্ভ করলো গানটা | প্রথম ছত্র তুলিয়ে দিয়ে আমায় বললো পরেরটার সাথে গলা মেলাতে,
সে কথা শুনিবেনা কেহ আর
নিভৃত নির্জন চারি ধার
দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুখে দুখি
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর ||
“আবার করো, সে কথা শুনিবেনা কেহ আর থেকে”
আবার ওর সাথে গেয়ে নিয়ে পরের জায়গাটা শিখতে লাগলাম,
সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব |
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব
আঁধারে মিশে গেছে আর সব ||
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার |
শ্রাবন বরিষণে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার ||
“শেষেরটা আর একবার একটু শুনিয়ে দাও না নতুন বৌদি,”
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেলো মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় ||
গাইতে গিয়ে গলাটা ধরে আসছিলো |
নতুন বৌদি আবার ফিরে এলো গানের আরম্ভে | তারপর ছেড়ে দিলো | আমাকে একা গাইতে হবে, প্রথম থেকে | আর ত্রুটির সংশোধন করে দেবেন আমার শিক্ষয়িত্রী |
“হলনা, এটা এরকম করে গাইতে হবে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব (সুরে)
গাও, আবার”
হৃদয় দিয়ে গাওয়া, সে কি অতই সোজা ?
“অনুভব (সুরে) – শোনো – অনুভব (সুরে)- ভুল করনা”
যাবতীয় ত্রুটি সংশোধনের পর্ব শেষ করে বলে, “এবার পুরোটা গাও, আরম্ভ থেকে”
বারবার গাওয়া হচ্ছিলো | সেদিন সারাটা রাত ফুরিয়ে গিয়েছিলো শুধু গানে, কথায় আর গল্পে | কেন ফুরালো ?
সারা রাতের বৃষ্টিতে কি অবস্থা বাড়ির সামনে ! থৈ থৈ জল |
“সাবধানে যেও ছোট ঠাকুরপো |” এ কথাটা রোজই শুনি | না শোনা অবধি বেরোতেই পারিনা কাজে |
থানে স্টেশনে এলাম | রাতের প্রবল বর্ষণে ট্রেন থেমে গেছে | প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছে লোক, কখন আবার ট্রেন চলবার announcement হয় সেই অপেক্ষায় | ধুত্তর, নিকুচি করেছে announcement | আমি সটান ফিরে এলাম |
কি মজা ! আজ আমাদের ছুটি রে ভাই, আজ আমাদের ছুটি | অফিস যেতে পারবনা | বাড়ির সামনে জল জমেই আছে | প্যান্ট গুটিয়ে, জুতো হাতে নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম | নতুন বৌদি দেখে হেসে লুটোপুটি |
“বেশ হয়েছে | আচ্ছা জব্দ আজকে | বাড়ি বসে থাকো |”
“এই নতুন বৌদি, খিচুরী চাপাও | আর আলুভাজা, মাছভাজা |”
“বয়ে গেছে আমার |”
“করবেনা না তো, আড়ি, যাও” খুব গম্ভীর মুখ করলাম |
“বাবুর আজকাল কথায় কথায় রাগ হয়, তাই না ? লিপি আসুক, তখন রাগ কোথায় যায় দেখবো |”
নতুন বৌদি’র হাতটা জোরে চেপে ধরলাম |
“ছাড়ো”
“ছাড়বনা | আগে বলো খিচুরী হবে”
“হবে”
এবারও হাতটা ছাড়িনি | হাতের পাতাটা টেনে এনে আমার বুকে রাখলাম | কাঁধে হাত দিয়ে টেনে আনলাম ওকে আমার কাছে | তারপর হাতের পাতায় খুব আলতো করে, ঠিক ওর নরম চামড়ার মতন নরম করে একটা চুমো খেলাম | “ধ্যাত” বলেই ও পালিয়ে গেলো |
“পাজী কোথাকার, রাত দিন আমায় জ্বালিয়ে মারে |” এই বলে রান্নাঘরে ঢুকলো | আমিও এলাম, পিছন পিছন | গ্যাসের প্ল্যাটফর্মের গায়ে ঠ্যাস দিয়ে নতুন বৌদি’র সাথে গল্প করে গেলাম |
“আমার জন্য একটা কিচ্ছু কাজ করেনা পাজিটা | এই, পেঁয়াজটা কেটে দেবে ? ভীষণ চোখটা জলছে |”
পাজি আর পেয়াঁজ ! প আর জ এর সম্মিলিত অনুপ্রাসটি মন্দ নয় | বাধ্য ছেলের মতন ঘসঘস করে পেয়াঁজ কেটে দিলাম | বললাম, “তাকাও, তো | চোখটা দেখি – আর জ্বলছে না তো?”
নতুন বৌদি বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকালো | আমি গাইলাম,
“ও গো কাজল নয়না হরিণী”
“ধ্যাত, ফাজিল কোথাকার | খালি বিরক্ত করে | সব ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে কিসের পর কি দেবো | খিচুরী আজকে খেতে পারবেনা বলে দিলাম ”
“খিচুরী খেতে না পারলে আর কিছু খেয়ে নেবো তোমার কাছ থেকে | চেয়ে নয়, একদম কেড়ে |”
চড় চাপড়, কানমলা সব পুরনো হয়ে গেছে | কাটা পেয়াঁজটা তেলে ছেড়ে একেবারে খুন্তি হাতেই তাড়া করলো ঘর অবধি |
দ্বিতীয় মাসের মাইনেও পেয়ে গেলাম | এখন আমি confirmed শেঠ | সেই সঙ্গে ওরা জানিয়ে দিলো যে ২৫ শে সেপ্টেম্বর ট্রেনিং লেকচার শেষ হয়ে যাবে | তারপর ট্রেনিং রিপোর্ট HR এ জমা করে ব্যাঙ্গালোরে চলে যেতে হবে | মনটা দিনের থেকে দিন খারাপ হয়ে আসছে যখনি ফিরে যাবার কথা ভাবতে হচ্ছে | আর সেই মনখারাপ কাটাবার জন্য যতটা সময় পেতাম, নতুন বৌদি’র সাথে খুনশুটি করে কাটাতাম | একদিন ভি-টি তে গিয়ে রেলের টিকিটও কেটে আনলাম | টিকিটটা যখন drawer এ রাখছি, নতুন বৌদি পিছনে ছিল | বললো, “কবে যাবে ?” চোখটা ছলছল করছিলো ওর | “7th October” | “না, ছোট ঠাকুরপো না | আমি কি নিয়ে থাকবো তখন ?” বলে অঝোরে কেঁদে ফেললো আমায় জড়িয়ে ধরে | “এই দ্যাখো আমার নতুন বৌদি | বলেছিনা, একদম কাঁদবেনা | একদম বোকা তুমি | আমি আবার চলে আসবো | ছুটি পেলে তোমায় এসে জ্বালিয়ে যাবো | আর বোম্বেতে আমাদের হেড অফিস | কাজের ছুতো করেই চলে আসবো |”
ষষ্ঠ পর্ব
“আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে”
এখন আর নতুন বৌদিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়তে ইচ্ছাই করেনা | মাঝে মাঝেই ওর হাতটা ধরে ফেলি, চুল ধরে টানি, গলায় সুরসুরি দিই, আচমকা চিমটি কাটি, ও খেয়াল না করলে চুল খুলে ফেলি | রান্না ঘরে থাকলে পিছন থেকে আচমকা এসে এসে ওকে জড়িয়ে ধরি | মাঝে মাঝে আমাকে মারতে আসে, পালায়, আবার অনেক সময়তে রয়েও যায় |যখন পালিয়ে যায়, দৃষ্টি এড়ায়, তখন কি ও “ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে” ? যখন রয়ে যায়, সে কি আমার দুষ্টুমির আকর্ষণে ? মনে হয়, “আমায় এ তুমি কি করে দিলে নতুন বৌদি ? কেন আমায় দিনের থেকে দিন তোমার জন্য পাগল করে দিচ্ছ ?” বলতামনা, বললে আবার যদি ওর চোখের থেকে জল পড়ে ? তাহলে আমার ভীষণ কষ্ট হবে যে |
শনিবারে আমি আর ও বাড়ি থাকি | নতুন বৌদি স্নানে ঢুকলে অনেকক্ষণ লাগে, আগেই বলেছি | সে সময়টা আমার ভীষণ একা একা লাগে | খুব রাগ হয় ওর উপরে | আর দুষ্টুমির বাসনাটাও বেড়ে যায় |
একদিন স্নানঘরে সবে জল ভরার আওয়াজ পাচ্ছি, গান তখনো শুরু হয়নি | আমি দরজায় গিয়ে টক টক করে টোকা মারলাম | ও আমার কথা শুনবার জন্য কলটা বন্ধ করতে আমি ফিসফিস করে বললাম বাইরে থেকে,
“মহারানী, এখনো কি আপনি অনাবৃতা নন ? আপনার সঙ্গীত শ্রবন করিনা কেন ?”
ও দরজার ছিটকিনিটা খুলে, এক চিল্থে ফাঁক করে উদলো কাঁধ আর মাথাটা বার করে মগ দেখিয়ে বললো, “মগের বারি খাবে ?”
“এ কি মগের মুলুক নাকি ? হ্যা, খাবো | তুমি মারবার জন্য বাইরে বেরবে না কি আমি তোমার কাছে মার খাবার জন্য ভিতরে ঢুকবো ?”
আমার কাছ থেকে এহেন উত্তর পেলে ও আর কি প্রত্যুত্তর দেবে ? খুব চিত্কার করে “পালাও এখান থেকে বলছি”, বলে ও আমার মুখের উপরে দরজাটা জোরে বন্ধ করে দিলো |
“আচ্ছা অভদ্র তো তুমি ? মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছ ?”
ততক্ষণে নিজেকে সংযত রাখবার জন্য লজ্জিত হয়ে নিজেকে বোঝাতাম – না, সীমারেখার মর্যাদা করাটা একান্তই প্রয়োজন | না হলে ভীষণ বিপদ !!
নতুন বৌদি সেদিন গাড়িতে বসে মেজদার কাছে বলছিলো, ওর পাহাড়ে যেতে ভীষণ ইচ্ছা করে | বম্বের কাছেই অনেক পাহাড়ি জায়গা – লোনাভলা-খান্ডালা , মহাবালেশ্বর-পঞ্চগনি, মাথেরান | ওর এখনো যাওয়া হয়নি | ভীষণ ইচ্ছা করলো যদি আমরা তিনজন মিলে একটু বেড়িয়ে আসি দু-চারটে দিন | মেজদার গাড়িতে – ইইস, কি মজাই না হবে ?
ব্রেকফাস্টের সময়ে মেজদাকে বললাম | মেজদা খবরের কাগজ থেকে চোখটা ক্যালেন্ডারের দিকে সরিয়ে বললো, “কবে যেতে চাস ?”
“আমার ট্রেনিং লেকচার 25th September শেষ হয়ে যাচ্ছে | চলোনা, তার পরদিনই বেরই | ২৬, ২৭, ২৮ – তিনটে দিন মহাবালেশ্বর এ কাটিয়ে ২৯ যদি ফিরে আসি |”
“হু | তার আগের week এ AGM, কিন্তু ওই week এ নেদারল্যান্ড delegation, দাঁড়া, আমি schedule টা দেখে বলছি |”
“শোনো মেজদা, তুমি দেখি বললে তো হবেনা, হোটেল বুক না করলে পাহাড়ে গিয়ে অনেক ঝামেলায় পরতে হয় | আজে বাজে জায়গায় আমরা থাকতে পারবনা | মহালয়ার পর কলকাতা থেকে টুরিস্ট আসতে আরম্ভ করবে | আমি দুটো রুম বুক করে দিতে চাই |”
“আরে রুম বুক করে দে, তারপর দেখি |”
“আমি কিন্তু যাবো | সে তুমি যেতে পারো কি না পারো তোমার ব্যাপার | চার বছরে এক বারের জন্যও যাইনি | ছোট ঠাকুরপো চলে গেলে যাওয়া হবেওনা আর |” নতুন বৌদি বললো |
“সে ঠিক আছে, নিশ্চয়ই যাবে | আর দেখি, আমি ম্যানেজ করতে চেষ্টা করবো |”
শেষ অবধি মেজদা পারেনি | সেই নেদারল্যান্ডের দল, তাদের সাথেই মেজদার কোম্পানির কন্ট্রাক্ট হবে, আলাপ আলোচনা চলবে তাজ হোটেলে | নতুন বৌদি’র মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো |
“তুমি মেজদার উপরে এত রাগ করছে কেন ? ও কি করবে ? বিদেশী দল, ওরা ওদের সুবিধা মতন আসবে, মেজদার কথায় থোড়াই ওদের দিন পাল্টাবে ?”
নতুন বৌদি কোনো কথা বললনা | বললো, “আর তোমার মেজদাকে রেঁধে দেবার জন্য আমি রয়ে যাবো ?”
“আরে, আমার তো লাঞ্চ, ডিনার – সব তাজে তখন | তুমি ঘুরে এস ক’টা দিন বাবুর সাথে | ভালো লাগবে |” ছোট ভাইয়ের উপরে মেজদা ভরসা করে |
দুজনেই চেয়েছিলাম মেজদা সঙ্গে থাকুক | সেটা হলনা | গেলে নতুন বৌদির ভালো লাগবে, তাই গেলাম |
বম্বে থেকে মহাবালেশ্বর পুনে হয়েও যাওয়া যায়, আবার সোজা যাবার বাস রুট আছে | আমরা পুনে অবধি ট্রেনে গিয়ে তারপর বাসে যাবো বলে ঠিক করলাম | বম্বে থেকে সকালের ট্রেন ডেকান কুইন যায় পুনেতে | পথটা ভারী সুন্দর | কার্জাতের পর ট্রেন ওঠে পশ্চিমঘাট পাহাড় বেয়ে | বেশি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রেল পথ তৈরী করেনি ব্রিটিশরা | টানেলের পর টানেল পেরিয়ে উঠে যায় ট্রেন | দুটো ইঞ্জিনে ধীরে ধীরে টানতে থাকে | পশ্চিম ঘাটে চড়ে লোনাভলা, খন্ডলা, তারপর আরো বেশ কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে পুনে | উপভোগ করবার দৃশ্য কার্জত থেকে লোনাভলা |
নতুন বৌদির আর আমার ছিল পাশাপাশি সিট | আমি ওকে জানালার ধারে বসতে দিলাম | সকাল সকাল বেরোতে হয়েছে বাড়ি থেকে, তাই নতুন বৌদির খুব ঘুম পাচ্ছিলো | ট্রেনের দুলুনিতে ওর ঘুম আসে | আমার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে চোখটা বন্ধ করলো | কালো রঙের ওপর প্রিন্ট শাড়ি | ভীষণ মানায় ওকে | চুলটা উড়লে ওর অস্বস্তি লাগে, জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলাম | মাথাটা বেশি ঝুঁকে গেলে ওর ঘাড়ে ব্যথা করবে, ও কষ্ট পাবে | আলতো করে ওর চুলে হাত রেখে চেষ্টা করলাম মাথাটা যেন হেলে না যায় | ওর ঘুম এসে গেছে | আসে পাশের যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ঘুমোচ্ছে | এক অল্পবয়সী দম্পতি, সেই মেয়েটিও মাথা এলিয়ে দিয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটির ঘাড়ে | ভীষণ ইচ্ছা করলো নতুন বৌদি’র মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে | তাই করলাম | আরামে ওর ঘুমটা একটু গভীর হলো | একের পর এক ঝর্ণা পেরিয়ে চলেছি | সদ্য সদ্য বর্ষাকাল শেষ হয়েছে, তাই ঝর্নাধারায় তেজ আছে | ইইস, নতুন বৌদি দেখছেনা, বেরসিকের মতন ঘুমাচ্ছে ? ঘাড়ে টোকা মারলাম, ওকে জাগাতে | ট্রেনটা ঠিক তখনি থেমে গেলো | চারপাশে আওয়াজ নেই, শুধু সামনের ঝর্ণাটার কলকল আওয়াজ |
-“দ্যাখো” ওকে বললাম |
-“ও মা, কি সুন্দর | এই, আমায় আগে ডাকলেনা কেন ?”
-“এই তো আস্তে আস্তে উঠছি, বুঝতে পারছনা ? আরো কত ঝর্ণা, পাহাড় পাবে |”
-“দ্যাখো তো, এত সুন্দর জায়গাগুলি ! একবারও আমায় নিয়ে আসেনি তোমার মেজদা |”
-“miss করছো মেজদাকে ?”
-“বয়ে গেছে”
-“তার মানে করছো |”
-“কি করে জানলে ?”
-“তোমরা উল্টোটা বলো |”
-“তোমরা মানে ?”
-“মানে মেয়েরা |”
-“কটা মেয়ে দেখলে শুনি ?”
-“দুটো”
-“কে ?”
-“একটা লিপি, একটা তুমি |”
নতুন বৌদি হাসলো |
-“হাসলে কেন ?”
-“বলবনা | হাসি পাচ্ছে, তাই হাসলাম |”
ইচ্ছা করছিলো আমি আর ও দৌড়ে গিয়ে ঝর্নার জলটা ধরি |
ভাবতে ভাবতেই “পুঁ” করে জোর আওয়াজ | ট্রেনটা আস্তে আস্তে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে চললো |
আবার টানেল | অন্ধকার | ওকে কাছে টানলাম একটু | আবার আলো, বাইরেটা | এবার অন্য রকমের পাহাড় | আবার টানেল, আবার আলো | ঠিক যেন লুকোচুরি খেলা চলেছে |
সপ্তম পর্ব
পুনে থেকে বাসে চড়লাম | পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে বাস আওয়াজ করে ধীরে ধীরে উঠে চলেছে | সদ্য সদ্য বর্ষা শেষ হয়েছে, চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ | এ দিকটায় বর্ষাকালে বৃষ্টিও প্রচুর হয় | ঝোপঝাড়ের আবডাল দিয়ে কখনো দেখছি পাহাড় সোজা নেমে গিয়েছে খাদে, কত নীচে, কত গভীরে | ভয় লাগে হঠাত করে নিচে তাকাতে, আবার একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য পাই পথের নানান জায়গায় | শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে সকলেরই সুযোগ খোজা উচিত প্রকৃতির অফুরন্ত শোভার সামান্য একটুখানি হলেও সেটুকুই উপভোগ করতে বেরিয়ে পরবার | যাঁরা করেন, জীবনে তাঁরা অনেক বেশি আনন্দ খুঁজে নিতে পারেন | যাঁরা কাজ কাজ করে পাগল, সুযোগ খুঁজে নিতে জানেননা, তাঁরা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত | নতুন বৌদি থেকে থেকেই মেজদার কথা বলছিলো |
অনেক উপরে উঠে গেছি | কত কথা বলেছি দুজনে, আবার এক এক সময়ে চুপ করেও উপভোগ করেছি | কথা বললে ভাষা, কথা না বললেও তার একটা ভাষা আছে |
শরত এসে গেছে | ৭ ই অক্টোবর আসতে শুধু এগারোটা দিন বাকি | শরত আসার পর থেকে প্রতিদিনই শারদপ্রাতে শুনছি বিদায়গাথা| কেউ যেন আমায় টেনে ধরে বলছে “না”, “না’, “না” |
এই “না” কথাটা কতরকম ভাবে ব্যক্ত করা যায় | “এটা করো না”, “এটা বলো না” – এই একটা “না” বোঝায় অসম্মতি | একটা বারণ | বারণ মানতেও পারি, নাও মানতে পারি | যদি বলি “না না” – দুইবার, তাহলে মনে হয়না কি একটা আদেশের মতন ? যদি তিনবার না বলি ? “না না না”, সেই না তে একটা আকুতি, জেদ | মানতেই হবে | একটা ছোট্ট বাচ্চার সাথে যদি খুব খেলি, তারপর তাকে এক সময়ে বলি, “টা টা”, তাহলে সে আমাদের মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, না, না – তুমি যাবেনা |” বেশি জেদী হলে সে হাতটা ধরে টেনে রাখবে | এই না না না – এটা সেরকমই | যত বলি “এবার যে যেতে হবে”, দুয়ার আগলে বলে যাবে “না না না |” আঁখি ফিরালেই “না না না” | যত বলি “রাত ফুরিয়ে এলো, বাতি মলিন হয়ে গেলো”, আমার মুখের দিকে চেয়ে তবু বলে যাবে “না না না”| মিলনপিয়াসী হলে তখনও তিনটে না দিয়েই তাকে ধরে রাখা, মাঝে একটু একটু করে কথা জুড়ে দিয়েই “না যেও না, যেও না কো ”| যদি তিনবার না বলেই উত্তরটা দিয়ে দেওয়া যেত, “না না গো না, করোনা ভাবনা | যদি বা নিশি যায়, যাবনা যাবনা |” তাই কি হয় নাকি ?
দুপুর গড়িয়ে যাবার পর আমরা মহাবালেশ্বর পৌছলাম | একটু একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বাতাসে | টাউন থেকে হোটেলটা একটু দূরে | অল্প কয়েকটা ঘর, location টা ভারী সুন্দর | ওখানে বসে সারাটা দিন কেটে যাবে পাহাড় আর নীচে বয়ে যাওয়া নীল রঙের নদী দেখে |
ঘর চাওয়ার সময় হোটেলের রিসেপশনের লোকটি একটু অবাকই হলো | দুজন মানুষ অথচ দুটো ঘর বুক করা আছে কেন ?
“আপ দোন রুম বুক কিলেলে ?”অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো |
এ সব মারাঠি হিন্দি | এখানে ওরকমই চলে, বিশুদ্ধ হিন্দি বললে চলবেইনা |
ভদ্রলোককে বোঝানো হলো টাকাপয়সা যখন দেওয়া আছে, আপনার “দোন” রুম দিতে অসুবিধা কোথায় ?
-“নেই নেই, আপুনকো প্রবলেম কা আহে ? বিন্দাস রহ না দোন রুম লেকে |” বলে চাবি দিয়ে একটা ছেলেকে ডেকে বললো ঘরে নিয়ে যেতে |
দুটো ঘর, একটায় ঢুকলো নতুন বৌদির সুটকেস, আর একটায় আমার | দুটো ঘর পাশাপাশি, মাঝে একটা দরজা | ভিতর দিয়েই অন্য ঘরে যাওয়া যায় | নতুন বৌদিকে বললাম, “আড়ি হলে দরজাটা বন্ধ থাকবে, ভাব হলে খোলা | কি বলো ?”
“হু , বুঝলাম | এই মুহুর্তে একদম আড়ি | আমি একটু চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসি |”
আমিও নিজে ফ্রেশ হয়ে নিলাম | নতুন বৌদি একটু পরে পরিষ্কার হয়ে বেরোলো | দরজাটা খুলে আমার ঘরে আসতেই বললাম, “ব্যাস, এবার ভাব তো ?”
“না | আগে চা এর কথা বলে এস তো একটু | রোজ তো ‘নতুন বৌদি, চা’, ‘নতুন বৌদি, চা’ বলে বলে আমায় বিরক্ত করো | এ কয়দিন তুমি চা আনিয়ে খাওয়াবে |”
আমি ওই ছেলেটিকে চা এর কথা বললাম | ফিরে এসে দেখি নতুন বৌদি উধাও | গেলটা কোথায় ? হোটেলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নানান নাম ধরে ধরে ডেকে চলেছি, “এই নতুন বৌদি, এই মলি, আমার মল্লিকা বন, বনমল্লিকা, ও গো চিরনূতন”
“এই, কি আরম্ভ করেছ বলত ? লোকজন কি ভাববে ?”
দেখি কয়েকটা ধাপ নেমে একটা ভীষণ সুন্দর জায়গা |দুটো চেয়ার আর একটা ছোট্ট টেবিল পাতা | সামনেই খোলা অফুরন্ত পাহাড় | সেখানে নতুন বৌদি রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে |
“কি ভাববে ? এখানে আপুনকো, কিলেলে, দিলেলে – এ সবই বুঝবে লোকে |”
“আর বাঙ্গালী টুরিস্ট থাকলে ?”
হাওয়া দিচ্ছিলো | ওর চুলগুলি উড়ছিল মুখের সামনে | চুল উড়লে মেয়েদের ভীষণ ভালো দ্যাখায় | আর এত বিরক্ত হয় ওরা যে বারবার চুলটা সরায় | এতে আরো ভালো লাগে, যতবার সরাবে, ততবার ভালো লাগবে | পাশে এসে দাঁড়ালাম |
“ছেলেটা ঘরে চা নিয়ে আসবে | আগে রুমে যাই চলো |”
“কোত্থাও যাবনা | কি অপূর্ব জায়গাটা | ছেলেটাকে বলো, এখানে চা নিয়ে আসবে |”
প্রায় সূর্যাস্ত হয়ে আসছে | চা এর খালি কাপ প্লেটগুলি পড়ে আছে, ছেলেটা এসে নিয়ে যায়নি এখনো | সূর্যাস্তের ছটা নতুন বৌদির মুখে এসে পরেছে | পড়ন্ত রোদের সাথে ওর গায়ের রংটা কি সুন্দর মানিয়েছে |
“তোমার রংটা মোটেও কালো নয় | এখন যে রংটা দেখছি, সেটাই তোমার রং |”
“ধ্যাত, কালো |সবাই বলে |”
“না, অস্তগামী সূর্যের রং এর মতন |”
“মোটেও না | ঠিক সন্ধ্যার রংটা আমার গায়ে |”
সূর্যটা ডুবে আসছে | আবার কাল আসবে | সাঁঝের রঙে হৃদয়্গগনে আমার সব কিছু রঙিয়ে যাচ্ছে | আলো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে |ওকে একটু কাছে টেনে চোখের দিকে চোখ রেখে গাইলাম,
“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শুন্য গগনবিহারী ||
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীম গগনবিহারী ||”
শুন্য গগনবিহারীকে অসীম গগনবিহারী করবার মাঝে একটা উত্তরণ ঘটে গেছে | তোমাকে আমার করে নিতে হয়েছে |
একসাথে যখন গাইছিলাম শেষটা, অন্তরের গভীরে কাঁপছিলো সব কিছু,
“মম সংগীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে,
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম জীবনমরণবিহারী ||”
না না না, মরণ শব্দটাকে বাদ দেবো, মরণে যে আমার ভীষণ ভয় | জোর করে আঁকড়ে ধরে রইলাম ওকে | অঙ্গে অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে গান গেয়ে যাবো আমরা |
-“কবে থেকে লেখো ?” হঠাত করেই নতুন বৌদি প্রশ্নটা করলো |
-“কি লিখি ?”
-“এই যে এত সুন্দর করে গল্প লেখো”
-“নতুন বৌদি, তুমি কি করে জানলে ?”আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম |
-“জানবনা কেন ? তুমি অসাবধানে খাতা ফেলে রেখে অফিসে চলে যাবে, আর আমি ঘর গোছাতে এসে হাতের কাছে লেখা পেলেও চোখটা বন্ধ করে থাকবো, তাইনা ?”
-“এটা কিন্তু ভীষণ খারাপ | আমি চাইনা কেউ আমার লেখা পড়ুক | Intrusion of privacy | কেন করলে এমন ?” আমি খুব গম্ভীর হয়ে বললাম |
একটুক্ষণ ঝগরা করে মেজাজটা খারাপ করে ফেললাম | আর নতুন বৌদি বেশ তর্কও করে | মাঝে মাঝে এঁড়ে তর্ক |
-“তোমার লেখা কাউকে পড়াও নি বলতে চাও ? লিপিকেও না ?”
-“না, লিপিকেও না | দেবোও না কোনদিন |” খুব বিরক্ত হয়ে বললাম | কথাই বলতে ইচ্ছা করছিলনা নতুন বৌদির সাথে আর |
-“শাড়িটাও দেবেনা ? পাহাড়ী রাস্তা বয়ে, নিজের সুটকেস ভারী করে নিয়ে এসেও ওকে দেবেনা ?”
-“মানে, তুমি জানো আমার সুটকেসে কি আছে ?” আমি রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলাম |
-“তুমি তোমার খাটে প্যাকেট রেখে জিনিস গোছাতে গোছাতে বার বার আমার কাছে এসে এসে বলবে নতুন বৌদি এটা কই, নতুন বৌদি ওটা কই আর আমি একবারের জন্যও ঘরে যেতে গিয়ে দেখে ফেলবনা, এতটা বোকা আমায় না ভাবলেই পারতে | এবারও বলো intrusion of privacy ? মুখে বড় বড় বুলি বলতে তো আটকায়না বাবুর |”
কি আর বলবো ? হাতে নাতে ধরা পড়ে গিয়ে আমার কি অবস্থা !
একটি একটি করে দিন এগিয়ে চলেছে | জুলাই এর শেষ দিন, যেদিন আনন্দে বিভোর হয়ে আমরা সবাই গাইছিলাম, “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে”, সে তো পেরিয়েই এসেছি | অগাস্ট মাসের শেষার্ধ ও দেখতে দেখতে চলে এলো | একটা দিন এগিয়ে যাওয়া, মানে একটা করে দিন ফুরিয়েও আসা | যখন ওই সুরটা আস্তে আস্তে মনের মধ্যে ঘুরতে শুরু করলো, “নাই নাই নাই যে বাকি সময় আমার”, মনে হচ্ছিলো ঠেলা দিয়ে ফিরে যাবার দিনটিকে সরিয়ে রাখি | কিন্তু সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরবে, নিজের অক্ষরেখা ধরেও আবার পাঁক খাবেই, দিন এগোবেই | সবই তো প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে যায়, আমরা কেউ তাকে বাধা দিতে পারবনা |
বাংলা মাসের হিসাবে শ্রাবন মাস সবে শেষ হয়ে গেছে, তবু বর্ষার বিরাম নেই | সকালে খবরের কাগজে বর্ষণের মোট হিসাবটা আগ্রহ সহকারে পড়তাম | যখন এসেছিলাম, তখন স্কোর বোর্ডে দেখতাম তিনশো | ধাপে ধাপে, কখনো বা লাফিয়ে লাফিয়ে, স্কোর পেরোলো পাঁচশো, হাজার, দেড় হাজার, দু হাজার – এবং still going strong !
মেজদা কাজের মধ্যে ডুবে গেছে | কোম্পানি নয়ডায় নতুন ইউনিট খুলছে তখন, তাই দিল্লি যেতে হচ্ছে বারবার | একটা বিরাট কন্ট্রাক্ট নাকি আসতে চলেছে ওদের | বোম্বেতে অগাস্ট মাসে বেশ কয়েকটা ছুটি পড়ে | স্বাধীনতা দিবস ছাড়াও জন্মাষ্টমী, মুম্বাইবাসীর অতি প্রিয় গণপতি, আরো একটা দুটো কি আমি হয়তো miss করে যাচ্ছি | আর ছুটি মানেই তো সারাটা দিন নতুন বৌদি | গল্প, গান, চা, VCR এ ছবি দেখা, এটা ওটা খাবার বানিয়ে দেবার অর্ডার – এইই চলতো | আর মেজদা নেই, তাই খাবার পরেও ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা চলতো দেওর-বৌদিতে মিলে |
সেদিন রাতে শুতে এসে দেখি বৃষ্টি হয়েই চলেছে | মনে হচ্ছিলো, “আমার প্রিয়ার ছায়া, আকাশে আজ ভাসে |” ইচ্ছা করছিলো, লিপি’র সাথে দেখা হলে ওকে ওই গানটা শোনাবো, “এমন দিনে তারে বলা যায়” | কিন্তু আমি যে গানটার সুর ভালো করে জানিনা, প্রথম দিকটা করতে পারবো, কিন্তু না শিখলে সুরে এদিক ওদিক বিচ্যুতি ঘটবে | আমায় কে শেখাবে গানটা ?
“নতুন বৌদি, এসোনা একটু”
“কি চাই ছোট ঠাকুরপো ?”
“একটা গান শিখিয়ে দেবে ?”
“এই মেরেছে, এই মাঝ রাত্তিরে ? লোক জন ঘুমিয়ে পড়েছে যে | এখন গান শুনলে সবাই ধরে পেটাবে | কাল হবে’খন |”
“না না নতুন বৌদি, এখনি | খুব আস্তে আস্তে গাও, আমি তুলে নেবো তোমার সাথে সাথে |”
“কোন গান ?”
“এমন দিনে তারে বলা যায়”
“গাও”
“আগে তোমার কাছ থেকে পুরোটা শুনবো |”
“শোনো তাহলে, খুব ধীরে গাইতে হয় –
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষায়
এমন দিনে মন খোলা যায়
এমন মনস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় ||
গানটা তুলবো কেমন করে? আমি তো ডুবে গিয়েছিলাম সুরে, বাণীতে | পুরো গানটা হয়ে গেলে নতুন বৌদি বললো, “এবার আমার সঙ্গে সঙ্গে গাও” বলে আবার আরম্ভ করলো গানটা | প্রথম ছত্র তুলিয়ে দিয়ে আমায় বললো পরেরটার সাথে গলা মেলাতে,
সে কথা শুনিবেনা কেহ আর
নিভৃত নির্জন চারি ধার
দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুখে দুখি
আকাশে জল ঝরে অনিবার –
জগতে কেহ যেন নাহি আর ||
“আবার করো, সে কথা শুনিবেনা কেহ আর থেকে”
আবার ওর সাথে গেয়ে নিয়ে পরের জায়গাটা শিখতে লাগলাম,
সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব |
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব
আঁধারে মিশে গেছে আর সব ||
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার |
শ্রাবন বরিষণে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার ||
“শেষেরটা আর একবার একটু শুনিয়ে দাও না নতুন বৌদি,”
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেলো মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় ||
গাইতে গিয়ে গলাটা ধরে আসছিলো |
নতুন বৌদি আবার ফিরে এলো গানের আরম্ভে | তারপর ছেড়ে দিলো | আমাকে একা গাইতে হবে, প্রথম থেকে | আর ত্রুটির সংশোধন করে দেবেন আমার শিক্ষয়িত্রী |
“হলনা, এটা এরকম করে গাইতে হবে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব (সুরে)
গাও, আবার”
হৃদয় দিয়ে গাওয়া, সে কি অতই সোজা ?
“অনুভব (সুরে) – শোনো – অনুভব (সুরে)- ভুল করনা”
যাবতীয় ত্রুটি সংশোধনের পর্ব শেষ করে বলে, “এবার পুরোটা গাও, আরম্ভ থেকে”
বারবার গাওয়া হচ্ছিলো | সেদিন সারাটা রাত ফুরিয়ে গিয়েছিলো শুধু গানে, কথায় আর গল্পে | কেন ফুরালো ?
সারা রাতের বৃষ্টিতে কি অবস্থা বাড়ির সামনে ! থৈ থৈ জল |
“সাবধানে যেও ছোট ঠাকুরপো |” এ কথাটা রোজই শুনি | না শোনা অবধি বেরোতেই পারিনা কাজে |
থানে স্টেশনে এলাম | রাতের প্রবল বর্ষণে ট্রেন থেমে গেছে | প্ল্যাটফর্মে গিজগিজ করছে লোক, কখন আবার ট্রেন চলবার announcement হয় সেই অপেক্ষায় | ধুত্তর, নিকুচি করেছে announcement | আমি সটান ফিরে এলাম |
কি মজা ! আজ আমাদের ছুটি রে ভাই, আজ আমাদের ছুটি | অফিস যেতে পারবনা | বাড়ির সামনে জল জমেই আছে | প্যান্ট গুটিয়ে, জুতো হাতে নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম | নতুন বৌদি দেখে হেসে লুটোপুটি |
“বেশ হয়েছে | আচ্ছা জব্দ আজকে | বাড়ি বসে থাকো |”
“এই নতুন বৌদি, খিচুরী চাপাও | আর আলুভাজা, মাছভাজা |”
“বয়ে গেছে আমার |”
“করবেনা না তো, আড়ি, যাও” খুব গম্ভীর মুখ করলাম |
“বাবুর আজকাল কথায় কথায় রাগ হয়, তাই না ? লিপি আসুক, তখন রাগ কোথায় যায় দেখবো |”
নতুন বৌদি’র হাতটা জোরে চেপে ধরলাম |
“ছাড়ো”
“ছাড়বনা | আগে বলো খিচুরী হবে”
“হবে”
এবারও হাতটা ছাড়িনি | হাতের পাতাটা টেনে এনে আমার বুকে রাখলাম | কাঁধে হাত দিয়ে টেনে আনলাম ওকে আমার কাছে | তারপর হাতের পাতায় খুব আলতো করে, ঠিক ওর নরম চামড়ার মতন নরম করে একটা চুমো খেলাম | “ধ্যাত” বলেই ও পালিয়ে গেলো |
“পাজী কোথাকার, রাত দিন আমায় জ্বালিয়ে মারে |” এই বলে রান্নাঘরে ঢুকলো | আমিও এলাম, পিছন পিছন | গ্যাসের প্ল্যাটফর্মের গায়ে ঠ্যাস দিয়ে নতুন বৌদি’র সাথে গল্প করে গেলাম |
“আমার জন্য একটা কিচ্ছু কাজ করেনা পাজিটা | এই, পেঁয়াজটা কেটে দেবে ? ভীষণ চোখটা জলছে |”
পাজি আর পেয়াঁজ ! প আর জ এর সম্মিলিত অনুপ্রাসটি মন্দ নয় | বাধ্য ছেলের মতন ঘসঘস করে পেয়াঁজ কেটে দিলাম | বললাম, “তাকাও, তো | চোখটা দেখি – আর জ্বলছে না তো?”
নতুন বৌদি বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকালো | আমি গাইলাম,
“ও গো কাজল নয়না হরিণী”
“ধ্যাত, ফাজিল কোথাকার | খালি বিরক্ত করে | সব ভুলভাল হয়ে যাচ্ছে কিসের পর কি দেবো | খিচুরী আজকে খেতে পারবেনা বলে দিলাম ”
“খিচুরী খেতে না পারলে আর কিছু খেয়ে নেবো তোমার কাছ থেকে | চেয়ে নয়, একদম কেড়ে |”
চড় চাপড়, কানমলা সব পুরনো হয়ে গেছে | কাটা পেয়াঁজটা তেলে ছেড়ে একেবারে খুন্তি হাতেই তাড়া করলো ঘর অবধি |
দ্বিতীয় মাসের মাইনেও পেয়ে গেলাম | এখন আমি confirmed শেঠ | সেই সঙ্গে ওরা জানিয়ে দিলো যে ২৫ শে সেপ্টেম্বর ট্রেনিং লেকচার শেষ হয়ে যাবে | তারপর ট্রেনিং রিপোর্ট HR এ জমা করে ব্যাঙ্গালোরে চলে যেতে হবে | মনটা দিনের থেকে দিন খারাপ হয়ে আসছে যখনি ফিরে যাবার কথা ভাবতে হচ্ছে | আর সেই মনখারাপ কাটাবার জন্য যতটা সময় পেতাম, নতুন বৌদি’র সাথে খুনশুটি করে কাটাতাম | একদিন ভি-টি তে গিয়ে রেলের টিকিটও কেটে আনলাম | টিকিটটা যখন drawer এ রাখছি, নতুন বৌদি পিছনে ছিল | বললো, “কবে যাবে ?” চোখটা ছলছল করছিলো ওর | “7th October” | “না, ছোট ঠাকুরপো না | আমি কি নিয়ে থাকবো তখন ?” বলে অঝোরে কেঁদে ফেললো আমায় জড়িয়ে ধরে | “এই দ্যাখো আমার নতুন বৌদি | বলেছিনা, একদম কাঁদবেনা | একদম বোকা তুমি | আমি আবার চলে আসবো | ছুটি পেলে তোমায় এসে জ্বালিয়ে যাবো | আর বোম্বেতে আমাদের হেড অফিস | কাজের ছুতো করেই চলে আসবো |”
ষষ্ঠ পর্ব
“আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে
গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে”
এখন আর নতুন বৌদিকে নিজের কাছ থেকে ছাড়তে ইচ্ছাই করেনা | মাঝে মাঝেই ওর হাতটা ধরে ফেলি, চুল ধরে টানি, গলায় সুরসুরি দিই, আচমকা চিমটি কাটি, ও খেয়াল না করলে চুল খুলে ফেলি | রান্না ঘরে থাকলে পিছন থেকে আচমকা এসে এসে ওকে জড়িয়ে ধরি | মাঝে মাঝে আমাকে মারতে আসে, পালায়, আবার অনেক সময়তে রয়েও যায় |যখন পালিয়ে যায়, দৃষ্টি এড়ায়, তখন কি ও “ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে” ? যখন রয়ে যায়, সে কি আমার দুষ্টুমির আকর্ষণে ? মনে হয়, “আমায় এ তুমি কি করে দিলে নতুন বৌদি ? কেন আমায় দিনের থেকে দিন তোমার জন্য পাগল করে দিচ্ছ ?” বলতামনা, বললে আবার যদি ওর চোখের থেকে জল পড়ে ? তাহলে আমার ভীষণ কষ্ট হবে যে |
শনিবারে আমি আর ও বাড়ি থাকি | নতুন বৌদি স্নানে ঢুকলে অনেকক্ষণ লাগে, আগেই বলেছি | সে সময়টা আমার ভীষণ একা একা লাগে | খুব রাগ হয় ওর উপরে | আর দুষ্টুমির বাসনাটাও বেড়ে যায় |
একদিন স্নানঘরে সবে জল ভরার আওয়াজ পাচ্ছি, গান তখনো শুরু হয়নি | আমি দরজায় গিয়ে টক টক করে টোকা মারলাম | ও আমার কথা শুনবার জন্য কলটা বন্ধ করতে আমি ফিসফিস করে বললাম বাইরে থেকে,
“মহারানী, এখনো কি আপনি অনাবৃতা নন ? আপনার সঙ্গীত শ্রবন করিনা কেন ?”
ও দরজার ছিটকিনিটা খুলে, এক চিল্থে ফাঁক করে উদলো কাঁধ আর মাথাটা বার করে মগ দেখিয়ে বললো, “মগের বারি খাবে ?”
“এ কি মগের মুলুক নাকি ? হ্যা, খাবো | তুমি মারবার জন্য বাইরে বেরবে না কি আমি তোমার কাছে মার খাবার জন্য ভিতরে ঢুকবো ?”
আমার কাছ থেকে এহেন উত্তর পেলে ও আর কি প্রত্যুত্তর দেবে ? খুব চিত্কার করে “পালাও এখান থেকে বলছি”, বলে ও আমার মুখের উপরে দরজাটা জোরে বন্ধ করে দিলো |
“আচ্ছা অভদ্র তো তুমি ? মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছ ?”
ততক্ষণে নিজেকে সংযত রাখবার জন্য লজ্জিত হয়ে নিজেকে বোঝাতাম – না, সীমারেখার মর্যাদা করাটা একান্তই প্রয়োজন | না হলে ভীষণ বিপদ !!
নতুন বৌদি সেদিন গাড়িতে বসে মেজদার কাছে বলছিলো, ওর পাহাড়ে যেতে ভীষণ ইচ্ছা করে | বম্বের কাছেই অনেক পাহাড়ি জায়গা – লোনাভলা-খান্ডালা , মহাবালেশ্বর-পঞ্চগনি, মাথেরান | ওর এখনো যাওয়া হয়নি | ভীষণ ইচ্ছা করলো যদি আমরা তিনজন মিলে একটু বেড়িয়ে আসি দু-চারটে দিন | মেজদার গাড়িতে – ইইস, কি মজাই না হবে ?
ব্রেকফাস্টের সময়ে মেজদাকে বললাম | মেজদা খবরের কাগজ থেকে চোখটা ক্যালেন্ডারের দিকে সরিয়ে বললো, “কবে যেতে চাস ?”
“আমার ট্রেনিং লেকচার 25th September শেষ হয়ে যাচ্ছে | চলোনা, তার পরদিনই বেরই | ২৬, ২৭, ২৮ – তিনটে দিন মহাবালেশ্বর এ কাটিয়ে ২৯ যদি ফিরে আসি |”
“হু | তার আগের week এ AGM, কিন্তু ওই week এ নেদারল্যান্ড delegation, দাঁড়া, আমি schedule টা দেখে বলছি |”
“শোনো মেজদা, তুমি দেখি বললে তো হবেনা, হোটেল বুক না করলে পাহাড়ে গিয়ে অনেক ঝামেলায় পরতে হয় | আজে বাজে জায়গায় আমরা থাকতে পারবনা | মহালয়ার পর কলকাতা থেকে টুরিস্ট আসতে আরম্ভ করবে | আমি দুটো রুম বুক করে দিতে চাই |”
“আরে রুম বুক করে দে, তারপর দেখি |”
“আমি কিন্তু যাবো | সে তুমি যেতে পারো কি না পারো তোমার ব্যাপার | চার বছরে এক বারের জন্যও যাইনি | ছোট ঠাকুরপো চলে গেলে যাওয়া হবেওনা আর |” নতুন বৌদি বললো |
“সে ঠিক আছে, নিশ্চয়ই যাবে | আর দেখি, আমি ম্যানেজ করতে চেষ্টা করবো |”
শেষ অবধি মেজদা পারেনি | সেই নেদারল্যান্ডের দল, তাদের সাথেই মেজদার কোম্পানির কন্ট্রাক্ট হবে, আলাপ আলোচনা চলবে তাজ হোটেলে | নতুন বৌদি’র মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো |
“তুমি মেজদার উপরে এত রাগ করছে কেন ? ও কি করবে ? বিদেশী দল, ওরা ওদের সুবিধা মতন আসবে, মেজদার কথায় থোড়াই ওদের দিন পাল্টাবে ?”
নতুন বৌদি কোনো কথা বললনা | বললো, “আর তোমার মেজদাকে রেঁধে দেবার জন্য আমি রয়ে যাবো ?”
“আরে, আমার তো লাঞ্চ, ডিনার – সব তাজে তখন | তুমি ঘুরে এস ক’টা দিন বাবুর সাথে | ভালো লাগবে |” ছোট ভাইয়ের উপরে মেজদা ভরসা করে |
দুজনেই চেয়েছিলাম মেজদা সঙ্গে থাকুক | সেটা হলনা | গেলে নতুন বৌদির ভালো লাগবে, তাই গেলাম |
বম্বে থেকে মহাবালেশ্বর পুনে হয়েও যাওয়া যায়, আবার সোজা যাবার বাস রুট আছে | আমরা পুনে অবধি ট্রেনে গিয়ে তারপর বাসে যাবো বলে ঠিক করলাম | বম্বে থেকে সকালের ট্রেন ডেকান কুইন যায় পুনেতে | পথটা ভারী সুন্দর | কার্জাতের পর ট্রেন ওঠে পশ্চিমঘাট পাহাড় বেয়ে | বেশি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রেল পথ তৈরী করেনি ব্রিটিশরা | টানেলের পর টানেল পেরিয়ে উঠে যায় ট্রেন | দুটো ইঞ্জিনে ধীরে ধীরে টানতে থাকে | পশ্চিম ঘাটে চড়ে লোনাভলা, খন্ডলা, তারপর আরো বেশ কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে পুনে | উপভোগ করবার দৃশ্য কার্জত থেকে লোনাভলা |
নতুন বৌদির আর আমার ছিল পাশাপাশি সিট | আমি ওকে জানালার ধারে বসতে দিলাম | সকাল সকাল বেরোতে হয়েছে বাড়ি থেকে, তাই নতুন বৌদির খুব ঘুম পাচ্ছিলো | ট্রেনের দুলুনিতে ওর ঘুম আসে | আমার ঘাড়ে মাথা এলিয়ে চোখটা বন্ধ করলো | কালো রঙের ওপর প্রিন্ট শাড়ি | ভীষণ মানায় ওকে | চুলটা উড়লে ওর অস্বস্তি লাগে, জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিলাম | মাথাটা বেশি ঝুঁকে গেলে ওর ঘাড়ে ব্যথা করবে, ও কষ্ট পাবে | আলতো করে ওর চুলে হাত রেখে চেষ্টা করলাম মাথাটা যেন হেলে না যায় | ওর ঘুম এসে গেছে | আসে পাশের যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ঘুমোচ্ছে | এক অল্পবয়সী দম্পতি, সেই মেয়েটিও মাথা এলিয়ে দিয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটির ঘাড়ে | ভীষণ ইচ্ছা করলো নতুন বৌদি’র মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে | তাই করলাম | আরামে ওর ঘুমটা একটু গভীর হলো | একের পর এক ঝর্ণা পেরিয়ে চলেছি | সদ্য সদ্য বর্ষাকাল শেষ হয়েছে, তাই ঝর্নাধারায় তেজ আছে | ইইস, নতুন বৌদি দেখছেনা, বেরসিকের মতন ঘুমাচ্ছে ? ঘাড়ে টোকা মারলাম, ওকে জাগাতে | ট্রেনটা ঠিক তখনি থেমে গেলো | চারপাশে আওয়াজ নেই, শুধু সামনের ঝর্ণাটার কলকল আওয়াজ |
-“দ্যাখো” ওকে বললাম |
-“ও মা, কি সুন্দর | এই, আমায় আগে ডাকলেনা কেন ?”
-“এই তো আস্তে আস্তে উঠছি, বুঝতে পারছনা ? আরো কত ঝর্ণা, পাহাড় পাবে |”
-“দ্যাখো তো, এত সুন্দর জায়গাগুলি ! একবারও আমায় নিয়ে আসেনি তোমার মেজদা |”
-“miss করছো মেজদাকে ?”
-“বয়ে গেছে”
-“তার মানে করছো |”
-“কি করে জানলে ?”
-“তোমরা উল্টোটা বলো |”
-“তোমরা মানে ?”
-“মানে মেয়েরা |”
-“কটা মেয়ে দেখলে শুনি ?”
-“দুটো”
-“কে ?”
-“একটা লিপি, একটা তুমি |”
নতুন বৌদি হাসলো |
-“হাসলে কেন ?”
-“বলবনা | হাসি পাচ্ছে, তাই হাসলাম |”
ইচ্ছা করছিলো আমি আর ও দৌড়ে গিয়ে ঝর্নার জলটা ধরি |
ভাবতে ভাবতেই “পুঁ” করে জোর আওয়াজ | ট্রেনটা আস্তে আস্তে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে চললো |
আবার টানেল | অন্ধকার | ওকে কাছে টানলাম একটু | আবার আলো, বাইরেটা | এবার অন্য রকমের পাহাড় | আবার টানেল, আবার আলো | ঠিক যেন লুকোচুরি খেলা চলেছে |
সপ্তম পর্ব
পুনে থেকে বাসে চড়লাম | পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে বাস আওয়াজ করে ধীরে ধীরে উঠে চলেছে | সদ্য সদ্য বর্ষা শেষ হয়েছে, চতুর্দিকে সবুজের সমারোহ | এ দিকটায় বর্ষাকালে বৃষ্টিও প্রচুর হয় | ঝোপঝাড়ের আবডাল দিয়ে কখনো দেখছি পাহাড় সোজা নেমে গিয়েছে খাদে, কত নীচে, কত গভীরে | ভয় লাগে হঠাত করে নিচে তাকাতে, আবার একটা স্বর্গীয় সৌন্দর্য পাই পথের নানান জায়গায় | শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে সকলেরই সুযোগ খোজা উচিত প্রকৃতির অফুরন্ত শোভার সামান্য একটুখানি হলেও সেটুকুই উপভোগ করতে বেরিয়ে পরবার | যাঁরা করেন, জীবনে তাঁরা অনেক বেশি আনন্দ খুঁজে নিতে পারেন | যাঁরা কাজ কাজ করে পাগল, সুযোগ খুঁজে নিতে জানেননা, তাঁরা এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত | নতুন বৌদি থেকে থেকেই মেজদার কথা বলছিলো |
অনেক উপরে উঠে গেছি | কত কথা বলেছি দুজনে, আবার এক এক সময়ে চুপ করেও উপভোগ করেছি | কথা বললে ভাষা, কথা না বললেও তার একটা ভাষা আছে |
শরত এসে গেছে | ৭ ই অক্টোবর আসতে শুধু এগারোটা দিন বাকি | শরত আসার পর থেকে প্রতিদিনই শারদপ্রাতে শুনছি বিদায়গাথা| কেউ যেন আমায় টেনে ধরে বলছে “না”, “না’, “না” |
এই “না” কথাটা কতরকম ভাবে ব্যক্ত করা যায় | “এটা করো না”, “এটা বলো না” – এই একটা “না” বোঝায় অসম্মতি | একটা বারণ | বারণ মানতেও পারি, নাও মানতে পারি | যদি বলি “না না” – দুইবার, তাহলে মনে হয়না কি একটা আদেশের মতন ? যদি তিনবার না বলি ? “না না না”, সেই না তে একটা আকুতি, জেদ | মানতেই হবে | একটা ছোট্ট বাচ্চার সাথে যদি খুব খেলি, তারপর তাকে এক সময়ে বলি, “টা টা”, তাহলে সে আমাদের মাথা নাড়িয়ে বলে, “না, না, না – তুমি যাবেনা |” বেশি জেদী হলে সে হাতটা ধরে টেনে রাখবে | এই না না না – এটা সেরকমই | যত বলি “এবার যে যেতে হবে”, দুয়ার আগলে বলে যাবে “না না না |” আঁখি ফিরালেই “না না না” | যত বলি “রাত ফুরিয়ে এলো, বাতি মলিন হয়ে গেলো”, আমার মুখের দিকে চেয়ে তবু বলে যাবে “না না না”| মিলনপিয়াসী হলে তখনও তিনটে না দিয়েই তাকে ধরে রাখা, মাঝে একটু একটু করে কথা জুড়ে দিয়েই “না যেও না, যেও না কো ”| যদি তিনবার না বলেই উত্তরটা দিয়ে দেওয়া যেত, “না না গো না, করোনা ভাবনা | যদি বা নিশি যায়, যাবনা যাবনা |” তাই কি হয় নাকি ?
দুপুর গড়িয়ে যাবার পর আমরা মহাবালেশ্বর পৌছলাম | একটু একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব বাতাসে | টাউন থেকে হোটেলটা একটু দূরে | অল্প কয়েকটা ঘর, location টা ভারী সুন্দর | ওখানে বসে সারাটা দিন কেটে যাবে পাহাড় আর নীচে বয়ে যাওয়া নীল রঙের নদী দেখে |
ঘর চাওয়ার সময় হোটেলের রিসেপশনের লোকটি একটু অবাকই হলো | দুজন মানুষ অথচ দুটো ঘর বুক করা আছে কেন ?
“আপ দোন রুম বুক কিলেলে ?”অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো |
এ সব মারাঠি হিন্দি | এখানে ওরকমই চলে, বিশুদ্ধ হিন্দি বললে চলবেইনা |
ভদ্রলোককে বোঝানো হলো টাকাপয়সা যখন দেওয়া আছে, আপনার “দোন” রুম দিতে অসুবিধা কোথায় ?
-“নেই নেই, আপুনকো প্রবলেম কা আহে ? বিন্দাস রহ না দোন রুম লেকে |” বলে চাবি দিয়ে একটা ছেলেকে ডেকে বললো ঘরে নিয়ে যেতে |
দুটো ঘর, একটায় ঢুকলো নতুন বৌদির সুটকেস, আর একটায় আমার | দুটো ঘর পাশাপাশি, মাঝে একটা দরজা | ভিতর দিয়েই অন্য ঘরে যাওয়া যায় | নতুন বৌদিকে বললাম, “আড়ি হলে দরজাটা বন্ধ থাকবে, ভাব হলে খোলা | কি বলো ?”
“হু , বুঝলাম | এই মুহুর্তে একদম আড়ি | আমি একটু চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসি |”
আমিও নিজে ফ্রেশ হয়ে নিলাম | নতুন বৌদি একটু পরে পরিষ্কার হয়ে বেরোলো | দরজাটা খুলে আমার ঘরে আসতেই বললাম, “ব্যাস, এবার ভাব তো ?”
“না | আগে চা এর কথা বলে এস তো একটু | রোজ তো ‘নতুন বৌদি, চা’, ‘নতুন বৌদি, চা’ বলে বলে আমায় বিরক্ত করো | এ কয়দিন তুমি চা আনিয়ে খাওয়াবে |”
আমি ওই ছেলেটিকে চা এর কথা বললাম | ফিরে এসে দেখি নতুন বৌদি উধাও | গেলটা কোথায় ? হোটেলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নানান নাম ধরে ধরে ডেকে চলেছি, “এই নতুন বৌদি, এই মলি, আমার মল্লিকা বন, বনমল্লিকা, ও গো চিরনূতন”
“এই, কি আরম্ভ করেছ বলত ? লোকজন কি ভাববে ?”
দেখি কয়েকটা ধাপ নেমে একটা ভীষণ সুন্দর জায়গা |দুটো চেয়ার আর একটা ছোট্ট টেবিল পাতা | সামনেই খোলা অফুরন্ত পাহাড় | সেখানে নতুন বৌদি রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে |
“কি ভাববে ? এখানে আপুনকো, কিলেলে, দিলেলে – এ সবই বুঝবে লোকে |”
“আর বাঙ্গালী টুরিস্ট থাকলে ?”
হাওয়া দিচ্ছিলো | ওর চুলগুলি উড়ছিল মুখের সামনে | চুল উড়লে মেয়েদের ভীষণ ভালো দ্যাখায় | আর এত বিরক্ত হয় ওরা যে বারবার চুলটা সরায় | এতে আরো ভালো লাগে, যতবার সরাবে, ততবার ভালো লাগবে | পাশে এসে দাঁড়ালাম |
“ছেলেটা ঘরে চা নিয়ে আসবে | আগে রুমে যাই চলো |”
“কোত্থাও যাবনা | কি অপূর্ব জায়গাটা | ছেলেটাকে বলো, এখানে চা নিয়ে আসবে |”
প্রায় সূর্যাস্ত হয়ে আসছে | চা এর খালি কাপ প্লেটগুলি পড়ে আছে, ছেলেটা এসে নিয়ে যায়নি এখনো | সূর্যাস্তের ছটা নতুন বৌদির মুখে এসে পরেছে | পড়ন্ত রোদের সাথে ওর গায়ের রংটা কি সুন্দর মানিয়েছে |
“তোমার রংটা মোটেও কালো নয় | এখন যে রংটা দেখছি, সেটাই তোমার রং |”
“ধ্যাত, কালো |সবাই বলে |”
“না, অস্তগামী সূর্যের রং এর মতন |”
“মোটেও না | ঠিক সন্ধ্যার রংটা আমার গায়ে |”
সূর্যটা ডুবে আসছে | আবার কাল আসবে | সাঁঝের রঙে হৃদয়্গগনে আমার সব কিছু রঙিয়ে যাচ্ছে | আলো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে |ওকে একটু কাছে টেনে চোখের দিকে চোখ রেখে গাইলাম,
“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা,
মম শুন্য গগনবিহারী ||
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীম গগনবিহারী ||”
শুন্য গগনবিহারীকে অসীম গগনবিহারী করবার মাঝে একটা উত্তরণ ঘটে গেছে | তোমাকে আমার করে নিতে হয়েছে |
একসাথে যখন গাইছিলাম শেষটা, অন্তরের গভীরে কাঁপছিলো সব কিছু,
“মম সংগীত তব অঙ্গে অঙ্গে দিয়েছি জড়ায়ে জড়ায়ে,
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম জীবনমরণবিহারী ||”
না না না, মরণ শব্দটাকে বাদ দেবো, মরণে যে আমার ভীষণ ভয় | জোর করে আঁকড়ে ধরে রইলাম ওকে | অঙ্গে অঙ্গে জড়ায়ে জড়ায়ে গান গেয়ে যাবো আমরা |
-“কবে থেকে লেখো ?” হঠাত করেই নতুন বৌদি প্রশ্নটা করলো |
-“কি লিখি ?”
-“এই যে এত সুন্দর করে গল্প লেখো”
-“নতুন বৌদি, তুমি কি করে জানলে ?”আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম |
-“জানবনা কেন ? তুমি অসাবধানে খাতা ফেলে রেখে অফিসে চলে যাবে, আর আমি ঘর গোছাতে এসে হাতের কাছে লেখা পেলেও চোখটা বন্ধ করে থাকবো, তাইনা ?”
-“এটা কিন্তু ভীষণ খারাপ | আমি চাইনা কেউ আমার লেখা পড়ুক | Intrusion of privacy | কেন করলে এমন ?” আমি খুব গম্ভীর হয়ে বললাম |
একটুক্ষণ ঝগরা করে মেজাজটা খারাপ করে ফেললাম | আর নতুন বৌদি বেশ তর্কও করে | মাঝে মাঝে এঁড়ে তর্ক |
-“তোমার লেখা কাউকে পড়াও নি বলতে চাও ? লিপিকেও না ?”
-“না, লিপিকেও না | দেবোও না কোনদিন |” খুব বিরক্ত হয়ে বললাম | কথাই বলতে ইচ্ছা করছিলনা নতুন বৌদির সাথে আর |
-“শাড়িটাও দেবেনা ? পাহাড়ী রাস্তা বয়ে, নিজের সুটকেস ভারী করে নিয়ে এসেও ওকে দেবেনা ?”
-“মানে, তুমি জানো আমার সুটকেসে কি আছে ?” আমি রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলাম |
-“তুমি তোমার খাটে প্যাকেট রেখে জিনিস গোছাতে গোছাতে বার বার আমার কাছে এসে এসে বলবে নতুন বৌদি এটা কই, নতুন বৌদি ওটা কই আর আমি একবারের জন্যও ঘরে যেতে গিয়ে দেখে ফেলবনা, এতটা বোকা আমায় না ভাবলেই পারতে | এবারও বলো intrusion of privacy ? মুখে বড় বড় বুলি বলতে তো আটকায়না বাবুর |”
কি আর বলবো ? হাতে নাতে ধরা পড়ে গিয়ে আমার কি অবস্থা !


![[+]](https://xossipy.com/themes/sharepoint/collapse_collapsed.png)