25-07-2020, 02:08 AM
(আগের পর্বের পরে)
রঞ্জিত বাবু : আমার মেয়ের সাথেই এমন হতে হলো?
অভির বাবা : আহা.... এমন করে ভাবছিস কেন? এটাতো জাস্ট এনগেজমেন্ট ছিল. আর তাছাড়া একদিক দিয়ে ভেবে দেখ এটাই কি ভালো হলোনা? ওই হতচ্ছাড়ার সাথে রিমির বিয়ে হলে কি হতো বুঝতে পারছিস?
রঞ্জিত বাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে : হুম..... তা ঠিক. কিন্তু যাই হোক.... সব কিছু এমন ভাবে....... ভেস্তে গেলো..... মানে এমন একটা ধাক্কা.....
অভির বাবা : আমিও এক মেয়ের বাবা রাজু...... আমি বুঝছি তোর ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে.... কিন্তু তোকে তো শক্ত থাকতে হবে. নইলে ওই মেয়েটাকে কে সামলাবে বলতো? ও যদি তোকে এইভাবে দেখে তাহলে ওর কি হবে ভাবতো?
অভি আর ওসব শুনলনা. এমন একটা খবর বন্ধুকে তো জানাতেই হবে বস. উফফফফ.... রাস্তা ক্লিয়ার.
সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো ওপরে অনিলকে কল করতে করতে. ভেবেছিলো ছাদে গিয়ে সব বলবে অনিলকে. কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠে রিমির ঘর পার করার সময় ওর নজর পড়লো ঘরের ভেতরে. ভেতরে অভির মা, রিমির মা বসে. আর ওদের মাঝে রিমি. মুখটা নামানো. অভি দাঁড়িয়ে গেলো হটাত. ও দেখলো রিমির দিকে. খুবই শান্ত লাগছে মেয়েটাকে. হঠাৎ করে অভি লক্ষ্য করলো এক বিন্দু জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো রিমির চোখ থেকে নীচে মাটিতে. রিমি কাঁদছে.
বুকে এই প্রথম তীব্র ধাক্কা লাগলো অভিষেকের. এ কি করছিলো সে? স্বার্থপরের মতো নিজের খুশির কথা ভাবছিলো এতক্ষন.... এমন একটা পরিস্থিতিকে উপভোগ করছিলো অভি? একটা মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া এমন একটা মুহূর্তকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো সে?
ছি : নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে অভির. এতটা পাষান হৃদয় কবে থেকে হলো ওর? অভি তো এমন নয়. যেন কিছুক্ষনের জন্য শয়তান ভর করেছিল ওর ওপর. একটা মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া এমন একটা ব্যাপার কখনোই আনন্দের হতে পারেনা. বিশেষ করে যে মেয়েটাকে অভি সেই সেদিন থেকে মনে মনে ভালোবেসে এসেছে তার দুঃখকে অভি এইভাবে উপভোগ করতে পারেনা. মুখ নামিয়ে নিলো অভিষেক. মনে মনে রিমিকে সরি বললো অভি.
ওদিকে ফোনে অনিল হ্যালো হ্যালো করেই চলেছে. অভি ফোনটা ধরে ছাদে চলে এলো. ফাঁকা ছাদ. আলতো হাওয়া স্পর্শ করে যাচ্ছে ওর শরীরটা. দোলনাটাতে এসে বসলো অভি.
অনিল : কিরে? নিজেই ফোন করে চুপ করে ছিলি কেন?
অভি : সরি.. ওই একটু....
অনিল : তুই ঠিক আছিস তো?
অভি : হ্যা...... না.....
অনিল : কি হ্যা না বলছিস? এই ভাই কি হয়েছে বলতো? তুই কি এখনও ওকে নিয়ে ভাবছিস?
অভি : হ্যা..... তবে তুই যা ভাবছিস সেইভাবে নয়.....এখন আমি ওকে নিয়েই ভাবছি. কিন্তু অন্যভাবে.... অন্যকথা
অনিল : হ্যা? ভাই তুই কি বলছিস আমি কিছুই......
অভি : ওর এনগেজমেন্ট ক্যানসেল হয়ে গেছে. (অনিলের কথা শেষ হবার আগেই অভিষেক বলে দিলো কথাটা)
ওপাশ থেকে : কি !!!! কি বলছিস তুই? সত্যি?
অভি : হুম...
অনিল : আরে গুরু...গুরু.... তোর কি ভাগ্য মাইরি! তোর রাস্তা তো পুরো ফাঁকা. এবারে ফাঁকা মাঠে গোল করেদে ভাই. দেরি করিসনা.
অভি রাগী স্বরে : ইয়ার্কি মারিসনা তো..... এসব আমার ভালো লাগে না.
অনিল : যা বাবা ইয়ার্কি কেন মারবো.... ভাই সুযোগ যখন পেয়েছিস তখন আর দেরি করিসনা.... ওর কাছে গিয়ে বস, ওর সাথে কথা বল, বন্ধুত্ব কর ওর এই পরিস্থিতে পাশে থাক.... ওর মনটা জয় করার চেষ্টা কর. আমি বলছি দেখ.. এই মুহূর্তে তোকে পাশে পেলে ও দেখবি তোর প্রতি ফীল করা শুরু করবে.
অভি : মানে বলতে চাইছিস ওর এমন একটা পরিস্থিতির, এমন একটা সময়ের ফায়দা তুলবো আমি? ওকে পটানোর চেষ্টা করবো? ওকে পাবার জন্য মিথ্যে মিথ্যে ওকে এনকারেজ করবো? নিজের স্বার্থে? এতটা স্বার্থপর ভাবিস আমায়?
অনিল : আরে তা কেন? তুই তো ওকে চাস...... তাই ভাবলাম সুযোগ যখন এসেছে তার সৎ ব্যাবহার কর. তাছাড়া তুই তো ওকে পছন্দ করিস, ভালো বাসিস.
অভিষেক : ভালোবাসি বলেই তো আরও এটা করতে পারবোনা. নিজেকে নিজের কাছে এত ছোট করতে পারবোনা. যে মানুষটাকে আমি মনে মনে ভালোবাসি তার এমন একটা দুর্বল মুহূর্তের ফায়দা আমি তুলতে পারবোনা অনিল. আমি ওরকম ছেলে না. একমুহূর্তের জন্য আমার মাথাতেও এমন একটা খেয়াল এসেছিলো কিন্তু.......... কিন্তু ওই ভেজা চোখ দুটো দেখে বুঝতে পারলাম কি ভুল করছিলাম আমি.
অনিল : মানে? ও কি......
অভি : কাঁদছে......
অনিল : ওহ.... সরি রে.... আমি আসলে তোর কথা ভেবে... তোর জন্যই...
অভি : আমি জানি অনিল. তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড. তুই আমার ভালোর জন্যই ওগুলো বলছিলি. কিন্তু তুই তো আমায় ভালো করেই চিনিস. আমি পারবোনা রে....... আমি পারবোনা. আমি ওতো নীচে নামতে পারবোনা.
অনিল : তুই ভেবে বলছিস তো?
অভি হেসে : হ্যা..... ভেবেই বলছি. ওকে যদি শুধু পছন্দ হতো তাহলে হয়তো আমি চেষ্টা করে দেখতাম. কিন্তু আমি যে ওকে ভালোবাসি রে........ ওকে ঠকাতে পারবোনা. এইভাবে ওই মেয়েটার এমন দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ আমি নিতে পারবোনা. আমি জানি আমি আবার ওর থেকে দূরে সরে যাবো. আবার হারিয়ে ফেলবো ওকে. কিন্তু অন্তত নিজেকে নিয়ে কোনো ঘৃণা থাকবেনা আমার.
অনিল সব শুনে বললো : তুই তো সত্যিই ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিস রে...... এই ভালোবাসাটা এইভাবে হারাতে দিবি?
অভি : ওই যে তোকে বললাম.... আমি পারবোনা. হয়তো আমি হেরো. কোনোদিনই কোনো মেয়েকে মনের কথা বলতে পারিনি. এবারেও পারলাম না. কিন্তু একটা খুশি তো থাকবে. আমি কোনোদিন ভুল করিনি.
অনিল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো : তা.... এবারে কি করবি?
অভিষেক : ওর কাছেই যাবো.... ওর পাশে গিয়ে ওর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবো. কিন্তু সেই বন্ধুত্বে কোনো স্বার্থ থাকবেনা. আমি সত্যি ওর মুখে হাসি ফোটাতে চাই. তাছাড়া....
অনিল : তাছাড়া কি?
অভি : আমি ওকে সবসময় হাসতে দেখেছি..... ওর হাসি মুখটাই আমার মনে আঁকা আছে.... এই জল ভরা চোখের মেয়েটাকে আমি চিনিনা. আমি তো এই রিমিকে ভালোবাসিনি. তাই ওকে আবার এই রিমি থেকে আগের রিমি বানাতে চাই আমি.
অনিল : all the best bro........আমি জানি তুই পারবি. পারলে.... শুধু তুই পারবি. যা..... ওর কাছে যা.
অভি ফোনটা রেখে একবার খোলা আকাশের দিকে তাকালো. আকাশ ভরা তারা গুলো দেখে মুচকি হাসলো আর চোখের জলটা আটকালো.
নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে ছাদ থেকে নীচে নেমে এলো অভি. রিমির ঘরের কাছে এসে দেখলো ওর মা আর কাকিমা বেরোচ্ছে. অভিকে দেখে ওর মা বললো -
অভির মা : বাবু... জানা... ওর কাছে গিয়ে বোস.. বসে গল্প কর. ওর মাথা থেকে এসব চিন্তা বার করা উচিত. তুই যা বোস. আমরা নীচে যাচ্ছি.
ওরা যেতে লাগলো. যেতে যেতেও অভিষেক শুনতে পেলো রিমির মা বলছে..
রিমির মা : কি হলো বলুনতো দিদি? আমাদের সাথেই এরকম হতে হলো?
অভির মা : তুমি বেশি চিন্তা কোরোনাতো.... ঠাকুর যা করেছে ভালোর জন্যই করেছে. অমন একটা ছেলের হাত থেকে তোমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন. ওর সাথে বিয়ে হলে কি হতো ভাবতে পারছো?
রিমির মা : তা ঠিক..
ওরা কথা বলতে বলতে চলে গেলো নীচে. অভি ওর ঘরে ঢুকলো. ঘরে রিমির সাথে অর্ক, ঝিলমিল দুজনেই আছে. মেয়েটা চুপচাপ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল. মায়েরা চলে যেতেই ও উঠে বারান্দায় চলে গেলো. অভি একবার মুখ ঘুরিয়ে টেবিলে রাখা ওই হাসিমুখের মেয়েটার ছবি দেখে নিজেও এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে. ঝিলমিল ভেবেছিলো দাদার সাথে যাবে কিন্তু দাদা ইশারায় বারণ করে দিলো. ওরা দুজন ওখানেই বসে রইলো.
অভিষেক বারান্দায় গেলো. অন্ধকার বারান্দা. সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রিমি. বাইরে তাকিয়ে. অভি এগিয়ে গিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটার. রেলিঙে হাত রেখে অভিও বাইরে দেখতে লাগলো. বাইরের জগৎটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে. কোনো পরিবর্তন নেই. সেই দোকানের ভিড়, সেই রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হর্নের শব্দ, গাছ পালা পরিবেশ সব যেন ঠিক আগের মতোই. যেন ওদের কোনো যায় আসেনা. ওরা ওদের মতোই রয়েছে.
- তুমি প্লিস এসব নিয়ে বেশি ভেবোনা.
অভি হটাত বললো রিমিকে. ও একবারের জন্যও তাকায়নি মেয়েটার দিকে. অভির কথা শুনে রিমি ভেজা চোখে মুচকি হাসলো একটু. অভি এবারে তাকালো ওর দিকে.
রিমি বাইরে তাকিয়ে থেকেই বললো : জানো..... কলেজে আমার একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল. ওর নাম অয়ন. খুব ভালো ছিল পড়াশোনাতে. ওর আর আমার সম্পর্ক দিনে দিনে গাঢ় হয়ে ওঠে. কিন্তু একসময় ও আমাকে প্রায় ডমিনেট করতে শুরু করে. এই ড্রেস কেন পড়েছো? এমন ভাবে অন্য ছেলেদের সাথে ছবি তুলেছো কেন? আমি এত কেয়ারলেস কেন? সব সময় আমায় কন্ট্রোল করতে চাইতো. ওকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলাম যে ওর সব কথা মেনে নিতাম. ভাবতাম ও আমায় ভালোবাসে বলেই কন্ট্রোল করতে চাইতো. কিন্তু.....
অভি : কিন্তু কি?
রিমি আবার মুচকি হেসে : একদিন জানতে পারলাম যে মানুষটা আমাকে নিজের কট্রলে রাখতে চাইতো সে নিজেকেই কন্ট্রোলে রাখতে অক্ষম. ওর আরও...
এইটুকু বলেই থেমে গেলো রিমি. অভিও বুঝে গেলো বাকিটা.
রিমি কিছুক্ষন পর আবার বললো : যার ভালোবাসার জন্য আমি তার সব কথা মানতাম, যাকে সবসময় খুশি রাখার চেষ্টা করতাম সে আমার ভালোবাসাল এইভাবে অপমান করলো যে সেই ব্যাথাটা আজও আমার ভিতরে আছে. আবার আজকে এই ঘটনা. জানো আজ আবার একটা জিনিস জানলাম. শুধু পড়াশোনাতে ভালো হলেই, ভালো চাকরি করলেই যে সে চরিত্রেও ভালো হবে সেটা নাও হতে পারে. মা বাবা তো আমার জন্যে খুব ভালো পাত্রই বেছে ছিল. কত শিক্ষিত ভালো পরিবারের... কিন্তু কি হলো সেও অয়নের মতোই......মজার ব্যাপার তাইনা?
অভি তাকিয়ে আছে মেয়েটার মুখের দিকে. ওই মুখে হাসি থাকলেও ভেতরে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে বুঝতে পারলো অভিষেক.
রিমি অভির দিকে তাকিয়ে বললো : কি ভাবছো?
অভি : হুমম? না কিছুনা....
আবার সব শান্ত কোনো কথা নেই দুজনেতে. একটু বিরতি নিয়ে অভি আবার বললো : রিমি.......সব মানুষ সমান হয়না. তুমি ভেবোনা. একদিন দেখবে তুমি এমন একজনকে নিজের পাশে পাবে যে সত্যিকারের ভালোবাসবে তোমাকে, তোমার বন্ধু হবে সে, তোমাকে কখনো আর দুঃখ পেতেই দেবেনা. তোমার মনের সব খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দেবে সে.
রিমি অভির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো : তাই? তা.... কবে আসবেন তিনি?
অভি : এমন একজনকে পেতে হলে তো একটু অপেক্ষা করতে হবে ম্যাডাম...... ভালো জিনিসের জন্য তো একটু অপেক্ষা করতেই হয়. ওই যে হিন্দিতে একটা কথা আছে- Der ayega par Durusth ayega.
শুনে সামান্য হাসলো রিমি. নকল হাসি বুঝলো অভি তবু অভিও হাসলো. যাক মেয়েটা মুখে একটু হলেও হাসি ফুটছে. অভিষেক এবারে একটু এগিয়ে এলো রিমির কাছে. ওর হাতে হাত রেখে বললো : রিমি...... ভুলে যাও আজকের ব্যাপারটা...... ঐরকম একটা মানুষ কখনোই তোমার যোগ্য ছিলোনা. যা হয়েছে ভালোই হয়েছে. আর যা হবে ভালোই হবে. তোমাকে এইভাবে দেখলে তোমার বাবা মায়ের কি ভালো লাগবে? কিসের জন্য এই চোখের জল? ওই মানুষ গুলোর জন্য? যারা মেয়েদের শুধু নিজের অধীনে রাখতে ভালোবাসে? যারা মেয়েদের মন নয় অন্য কিছু পেতে চায়..... তাদের মতো মানুষের কথা ভেবে চোখে জল আনছো? এই জলের যোগ্যও ওরা নয়.
একটানা চোখে চোখ রেখে কথা গুলো বলে গেলো অভিষেক. না.... আজ আর একটুও ভয় লাগেনি ওর, একবারও তোতলায়নি ও, স্পষ্ট ভাবে নিজের কথাগুলো বলেছে সে. রিমির অশ্রু ভরা চোখ দুটো দেখে ওর হাত যে কখন রিমির চোখের কাছে পৌঁছে গেছে নিজেও জানেনা অভিষেক. অভি নিজেই ওর চোখে দুটো মুছে দিলো. বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে মেয়েটার চোখের কোণটা মুছে দিলো অভি.
অভির বাবা : আহা.... এমন করে ভাবছিস কেন? এটাতো জাস্ট এনগেজমেন্ট ছিল. আর তাছাড়া একদিক দিয়ে ভেবে দেখ এটাই কি ভালো হলোনা? ওই হতচ্ছাড়ার সাথে রিমির বিয়ে হলে কি হতো বুঝতে পারছিস?
রঞ্জিত বাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে : হুম..... তা ঠিক. কিন্তু যাই হোক.... সব কিছু এমন ভাবে....... ভেস্তে গেলো..... মানে এমন একটা ধাক্কা.....
অভির বাবা : আমিও এক মেয়ের বাবা রাজু...... আমি বুঝছি তোর ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে.... কিন্তু তোকে তো শক্ত থাকতে হবে. নইলে ওই মেয়েটাকে কে সামলাবে বলতো? ও যদি তোকে এইভাবে দেখে তাহলে ওর কি হবে ভাবতো?
অভি আর ওসব শুনলনা. এমন একটা খবর বন্ধুকে তো জানাতেই হবে বস. উফফফফ.... রাস্তা ক্লিয়ার.
সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলো ওপরে অনিলকে কল করতে করতে. ভেবেছিলো ছাদে গিয়ে সব বলবে অনিলকে. কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠে রিমির ঘর পার করার সময় ওর নজর পড়লো ঘরের ভেতরে. ভেতরে অভির মা, রিমির মা বসে. আর ওদের মাঝে রিমি. মুখটা নামানো. অভি দাঁড়িয়ে গেলো হটাত. ও দেখলো রিমির দিকে. খুবই শান্ত লাগছে মেয়েটাকে. হঠাৎ করে অভি লক্ষ্য করলো এক বিন্দু জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো রিমির চোখ থেকে নীচে মাটিতে. রিমি কাঁদছে.
বুকে এই প্রথম তীব্র ধাক্কা লাগলো অভিষেকের. এ কি করছিলো সে? স্বার্থপরের মতো নিজের খুশির কথা ভাবছিলো এতক্ষন.... এমন একটা পরিস্থিতিকে উপভোগ করছিলো অভি? একটা মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া এমন একটা মুহূর্তকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলো সে?
ছি : নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে অভির. এতটা পাষান হৃদয় কবে থেকে হলো ওর? অভি তো এমন নয়. যেন কিছুক্ষনের জন্য শয়তান ভর করেছিল ওর ওপর. একটা মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া এমন একটা ব্যাপার কখনোই আনন্দের হতে পারেনা. বিশেষ করে যে মেয়েটাকে অভি সেই সেদিন থেকে মনে মনে ভালোবেসে এসেছে তার দুঃখকে অভি এইভাবে উপভোগ করতে পারেনা. মুখ নামিয়ে নিলো অভিষেক. মনে মনে রিমিকে সরি বললো অভি.
ওদিকে ফোনে অনিল হ্যালো হ্যালো করেই চলেছে. অভি ফোনটা ধরে ছাদে চলে এলো. ফাঁকা ছাদ. আলতো হাওয়া স্পর্শ করে যাচ্ছে ওর শরীরটা. দোলনাটাতে এসে বসলো অভি.
অনিল : কিরে? নিজেই ফোন করে চুপ করে ছিলি কেন?
অভি : সরি.. ওই একটু....
অনিল : তুই ঠিক আছিস তো?
অভি : হ্যা...... না.....
অনিল : কি হ্যা না বলছিস? এই ভাই কি হয়েছে বলতো? তুই কি এখনও ওকে নিয়ে ভাবছিস?
অভি : হ্যা..... তবে তুই যা ভাবছিস সেইভাবে নয়.....এখন আমি ওকে নিয়েই ভাবছি. কিন্তু অন্যভাবে.... অন্যকথা
অনিল : হ্যা? ভাই তুই কি বলছিস আমি কিছুই......
অভি : ওর এনগেজমেন্ট ক্যানসেল হয়ে গেছে. (অনিলের কথা শেষ হবার আগেই অভিষেক বলে দিলো কথাটা)
ওপাশ থেকে : কি !!!! কি বলছিস তুই? সত্যি?
অভি : হুম...
অনিল : আরে গুরু...গুরু.... তোর কি ভাগ্য মাইরি! তোর রাস্তা তো পুরো ফাঁকা. এবারে ফাঁকা মাঠে গোল করেদে ভাই. দেরি করিসনা.
অভি রাগী স্বরে : ইয়ার্কি মারিসনা তো..... এসব আমার ভালো লাগে না.
অনিল : যা বাবা ইয়ার্কি কেন মারবো.... ভাই সুযোগ যখন পেয়েছিস তখন আর দেরি করিসনা.... ওর কাছে গিয়ে বস, ওর সাথে কথা বল, বন্ধুত্ব কর ওর এই পরিস্থিতে পাশে থাক.... ওর মনটা জয় করার চেষ্টা কর. আমি বলছি দেখ.. এই মুহূর্তে তোকে পাশে পেলে ও দেখবি তোর প্রতি ফীল করা শুরু করবে.
অভি : মানে বলতে চাইছিস ওর এমন একটা পরিস্থিতির, এমন একটা সময়ের ফায়দা তুলবো আমি? ওকে পটানোর চেষ্টা করবো? ওকে পাবার জন্য মিথ্যে মিথ্যে ওকে এনকারেজ করবো? নিজের স্বার্থে? এতটা স্বার্থপর ভাবিস আমায়?
অনিল : আরে তা কেন? তুই তো ওকে চাস...... তাই ভাবলাম সুযোগ যখন এসেছে তার সৎ ব্যাবহার কর. তাছাড়া তুই তো ওকে পছন্দ করিস, ভালো বাসিস.
অভিষেক : ভালোবাসি বলেই তো আরও এটা করতে পারবোনা. নিজেকে নিজের কাছে এত ছোট করতে পারবোনা. যে মানুষটাকে আমি মনে মনে ভালোবাসি তার এমন একটা দুর্বল মুহূর্তের ফায়দা আমি তুলতে পারবোনা অনিল. আমি ওরকম ছেলে না. একমুহূর্তের জন্য আমার মাথাতেও এমন একটা খেয়াল এসেছিলো কিন্তু.......... কিন্তু ওই ভেজা চোখ দুটো দেখে বুঝতে পারলাম কি ভুল করছিলাম আমি.
অনিল : মানে? ও কি......
অভি : কাঁদছে......
অনিল : ওহ.... সরি রে.... আমি আসলে তোর কথা ভেবে... তোর জন্যই...
অভি : আমি জানি অনিল. তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড. তুই আমার ভালোর জন্যই ওগুলো বলছিলি. কিন্তু তুই তো আমায় ভালো করেই চিনিস. আমি পারবোনা রে....... আমি পারবোনা. আমি ওতো নীচে নামতে পারবোনা.
অনিল : তুই ভেবে বলছিস তো?
অভি হেসে : হ্যা..... ভেবেই বলছি. ওকে যদি শুধু পছন্দ হতো তাহলে হয়তো আমি চেষ্টা করে দেখতাম. কিন্তু আমি যে ওকে ভালোবাসি রে........ ওকে ঠকাতে পারবোনা. এইভাবে ওই মেয়েটার এমন দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ আমি নিতে পারবোনা. আমি জানি আমি আবার ওর থেকে দূরে সরে যাবো. আবার হারিয়ে ফেলবো ওকে. কিন্তু অন্তত নিজেকে নিয়ে কোনো ঘৃণা থাকবেনা আমার.
অনিল সব শুনে বললো : তুই তো সত্যিই ওকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিস রে...... এই ভালোবাসাটা এইভাবে হারাতে দিবি?
অভি : ওই যে তোকে বললাম.... আমি পারবোনা. হয়তো আমি হেরো. কোনোদিনই কোনো মেয়েকে মনের কথা বলতে পারিনি. এবারেও পারলাম না. কিন্তু একটা খুশি তো থাকবে. আমি কোনোদিন ভুল করিনি.
অনিল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো : তা.... এবারে কি করবি?
অভিষেক : ওর কাছেই যাবো.... ওর পাশে গিয়ে ওর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবো. কিন্তু সেই বন্ধুত্বে কোনো স্বার্থ থাকবেনা. আমি সত্যি ওর মুখে হাসি ফোটাতে চাই. তাছাড়া....
অনিল : তাছাড়া কি?
অভি : আমি ওকে সবসময় হাসতে দেখেছি..... ওর হাসি মুখটাই আমার মনে আঁকা আছে.... এই জল ভরা চোখের মেয়েটাকে আমি চিনিনা. আমি তো এই রিমিকে ভালোবাসিনি. তাই ওকে আবার এই রিমি থেকে আগের রিমি বানাতে চাই আমি.
অনিল : all the best bro........আমি জানি তুই পারবি. পারলে.... শুধু তুই পারবি. যা..... ওর কাছে যা.
অভি ফোনটা রেখে একবার খোলা আকাশের দিকে তাকালো. আকাশ ভরা তারা গুলো দেখে মুচকি হাসলো আর চোখের জলটা আটকালো.
নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে ছাদ থেকে নীচে নেমে এলো অভি. রিমির ঘরের কাছে এসে দেখলো ওর মা আর কাকিমা বেরোচ্ছে. অভিকে দেখে ওর মা বললো -
অভির মা : বাবু... জানা... ওর কাছে গিয়ে বোস.. বসে গল্প কর. ওর মাথা থেকে এসব চিন্তা বার করা উচিত. তুই যা বোস. আমরা নীচে যাচ্ছি.
ওরা যেতে লাগলো. যেতে যেতেও অভিষেক শুনতে পেলো রিমির মা বলছে..
রিমির মা : কি হলো বলুনতো দিদি? আমাদের সাথেই এরকম হতে হলো?
অভির মা : তুমি বেশি চিন্তা কোরোনাতো.... ঠাকুর যা করেছে ভালোর জন্যই করেছে. অমন একটা ছেলের হাত থেকে তোমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন. ওর সাথে বিয়ে হলে কি হতো ভাবতে পারছো?
রিমির মা : তা ঠিক..
ওরা কথা বলতে বলতে চলে গেলো নীচে. অভি ওর ঘরে ঢুকলো. ঘরে রিমির সাথে অর্ক, ঝিলমিল দুজনেই আছে. মেয়েটা চুপচাপ বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল. মায়েরা চলে যেতেই ও উঠে বারান্দায় চলে গেলো. অভি একবার মুখ ঘুরিয়ে টেবিলে রাখা ওই হাসিমুখের মেয়েটার ছবি দেখে নিজেও এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে. ঝিলমিল ভেবেছিলো দাদার সাথে যাবে কিন্তু দাদা ইশারায় বারণ করে দিলো. ওরা দুজন ওখানেই বসে রইলো.
অভিষেক বারান্দায় গেলো. অন্ধকার বারান্দা. সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রিমি. বাইরে তাকিয়ে. অভি এগিয়ে গিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটার. রেলিঙে হাত রেখে অভিও বাইরে দেখতে লাগলো. বাইরের জগৎটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে. কোনো পরিবর্তন নেই. সেই দোকানের ভিড়, সেই রাস্তায় গাড়ির ভিড়, হর্নের শব্দ, গাছ পালা পরিবেশ সব যেন ঠিক আগের মতোই. যেন ওদের কোনো যায় আসেনা. ওরা ওদের মতোই রয়েছে.
- তুমি প্লিস এসব নিয়ে বেশি ভেবোনা.
অভি হটাত বললো রিমিকে. ও একবারের জন্যও তাকায়নি মেয়েটার দিকে. অভির কথা শুনে রিমি ভেজা চোখে মুচকি হাসলো একটু. অভি এবারে তাকালো ওর দিকে.
রিমি বাইরে তাকিয়ে থেকেই বললো : জানো..... কলেজে আমার একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল. ওর নাম অয়ন. খুব ভালো ছিল পড়াশোনাতে. ওর আর আমার সম্পর্ক দিনে দিনে গাঢ় হয়ে ওঠে. কিন্তু একসময় ও আমাকে প্রায় ডমিনেট করতে শুরু করে. এই ড্রেস কেন পড়েছো? এমন ভাবে অন্য ছেলেদের সাথে ছবি তুলেছো কেন? আমি এত কেয়ারলেস কেন? সব সময় আমায় কন্ট্রোল করতে চাইতো. ওকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলাম যে ওর সব কথা মেনে নিতাম. ভাবতাম ও আমায় ভালোবাসে বলেই কন্ট্রোল করতে চাইতো. কিন্তু.....
অভি : কিন্তু কি?
রিমি আবার মুচকি হেসে : একদিন জানতে পারলাম যে মানুষটা আমাকে নিজের কট্রলে রাখতে চাইতো সে নিজেকেই কন্ট্রোলে রাখতে অক্ষম. ওর আরও...
এইটুকু বলেই থেমে গেলো রিমি. অভিও বুঝে গেলো বাকিটা.
রিমি কিছুক্ষন পর আবার বললো : যার ভালোবাসার জন্য আমি তার সব কথা মানতাম, যাকে সবসময় খুশি রাখার চেষ্টা করতাম সে আমার ভালোবাসাল এইভাবে অপমান করলো যে সেই ব্যাথাটা আজও আমার ভিতরে আছে. আবার আজকে এই ঘটনা. জানো আজ আবার একটা জিনিস জানলাম. শুধু পড়াশোনাতে ভালো হলেই, ভালো চাকরি করলেই যে সে চরিত্রেও ভালো হবে সেটা নাও হতে পারে. মা বাবা তো আমার জন্যে খুব ভালো পাত্রই বেছে ছিল. কত শিক্ষিত ভালো পরিবারের... কিন্তু কি হলো সেও অয়নের মতোই......মজার ব্যাপার তাইনা?
অভি তাকিয়ে আছে মেয়েটার মুখের দিকে. ওই মুখে হাসি থাকলেও ভেতরে কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে বুঝতে পারলো অভিষেক.
রিমি অভির দিকে তাকিয়ে বললো : কি ভাবছো?
অভি : হুমম? না কিছুনা....
আবার সব শান্ত কোনো কথা নেই দুজনেতে. একটু বিরতি নিয়ে অভি আবার বললো : রিমি.......সব মানুষ সমান হয়না. তুমি ভেবোনা. একদিন দেখবে তুমি এমন একজনকে নিজের পাশে পাবে যে সত্যিকারের ভালোবাসবে তোমাকে, তোমার বন্ধু হবে সে, তোমাকে কখনো আর দুঃখ পেতেই দেবেনা. তোমার মনের সব খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দেবে সে.
রিমি অভির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো : তাই? তা.... কবে আসবেন তিনি?
অভি : এমন একজনকে পেতে হলে তো একটু অপেক্ষা করতে হবে ম্যাডাম...... ভালো জিনিসের জন্য তো একটু অপেক্ষা করতেই হয়. ওই যে হিন্দিতে একটা কথা আছে- Der ayega par Durusth ayega.
শুনে সামান্য হাসলো রিমি. নকল হাসি বুঝলো অভি তবু অভিও হাসলো. যাক মেয়েটা মুখে একটু হলেও হাসি ফুটছে. অভিষেক এবারে একটু এগিয়ে এলো রিমির কাছে. ওর হাতে হাত রেখে বললো : রিমি...... ভুলে যাও আজকের ব্যাপারটা...... ঐরকম একটা মানুষ কখনোই তোমার যোগ্য ছিলোনা. যা হয়েছে ভালোই হয়েছে. আর যা হবে ভালোই হবে. তোমাকে এইভাবে দেখলে তোমার বাবা মায়ের কি ভালো লাগবে? কিসের জন্য এই চোখের জল? ওই মানুষ গুলোর জন্য? যারা মেয়েদের শুধু নিজের অধীনে রাখতে ভালোবাসে? যারা মেয়েদের মন নয় অন্য কিছু পেতে চায়..... তাদের মতো মানুষের কথা ভেবে চোখে জল আনছো? এই জলের যোগ্যও ওরা নয়.
একটানা চোখে চোখ রেখে কথা গুলো বলে গেলো অভিষেক. না.... আজ আর একটুও ভয় লাগেনি ওর, একবারও তোতলায়নি ও, স্পষ্ট ভাবে নিজের কথাগুলো বলেছে সে. রিমির অশ্রু ভরা চোখ দুটো দেখে ওর হাত যে কখন রিমির চোখের কাছে পৌঁছে গেছে নিজেও জানেনা অভিষেক. অভি নিজেই ওর চোখে দুটো মুছে দিলো. বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে মেয়েটার চোখের কোণটা মুছে দিলো অভি.
চলবে.....