19-07-2020, 06:08 PM
দুপুরে দারুন খাওয়া দাওয়া হলো. রিমির মায়ের রান্নার হাত অসাধারণ. কিন্তু অভি বেশি কিছু নিচ্ছিলোনা. ওর মাও অবাক হলো. ছেলে তো এমনিতে এর থেকে বেশি খায়. হয়তো অন্য জায়গা বলে হয়তো.
দীপালি দেবী বললেন : একি অভি.... তুমি তো নিচ্ছই না কিছু.... আরেকটা মাছ দি?
অভি হেসে বলল : না কাকিমা.... ঠিক আছে...
উনি হেসে বললেন : আরে লজ্জা পেয়েওনা তো... নিজের বাড়ি মনে করো. বাবলি.... ওকে মাংস দেতো.
রিমি নিজেই এবারে ওর পাতে তিন পিস মাংস দিলো. আর প্রায় আদেশের সুরে বললো : খাও.
অভি আর না বলতে পারলোনা. খেতে লাগলো. ঠিক ওর উল্টোদিকেই সে বসে আছে আর কাকিমা মানে অভির মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে খাচ্ছে.
মজার ব্যাপার হলো যে খাবোনা.. খাবোনা বলছিলো.... সে আরও অনেকটা খেয়ে ফেললো.
এবারে একটু ঘুমোনোর পালা. এমনিতে কে কোথায় সবে সব ঠিক হয়ে গেছে. অভিষেক শোবে অর্কর ঘরে, ঝিলমিল তো রিমি দিদিকে ছাড়বেই না. খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর সাথে. তাই রিমি ওকে ওর ঘরে নিয়ে গেলো. আর দুজনেরই বাবা নিচের গেস্ট রুমে শোবে আর ওদের মায়েরা আর অন্যান্য মহিলারা আর শোবেনা. গল্প করেই দুপুরটা কাটাবে. ওরা নিচেই ড্রয়িং রুমে গল্প করতে লাগলো.
অভি আর অর্ক শুয়ে পড়েছে. আগেই জামা পাল্টে ও অন্য জামা প্যান্ট পরে নিয়েছে. চুপচাপ শুয়ে রইলো অভি. অর্ক মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে. কিন্তু অভির চোখে ঘুম নেই. অভি ভাবছে এখান থেকে চলে যাই.... আর থাকতে ইচ্ছে করছেনা.. . কেন এলো এখানে? না আসলেই তো ভালো ছিল. ধুর..... এ কেমন সিচুয়েশন রে বাবা? না পারছে এগোতে না পারছে পিছোতে.
সত্যি.. একদিনেই যেভাবে রিমি অভির বাবা মাকে, ওর ছোট বোনকে আপন করে নিলো, খুব ভালো মেয়েটা. এমনকি অভিষেকের ওপরেও যেভাবে অধিকার ফলিয়ে জোর করে তখন মাংস খেতে বললো, ওর ওপর সিগারেটের ব্যাপার নিয়ে রেগে গেলো. আশ্চর্য....ওরা তো চেনেনা একে অপরকে.... তাহলে এই অধিকার কেন?
সত্যি..... কিশোর কুমার ঠিকই গেয়ে গেছিলেন. নারী চরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবেনা, এরা লোন ল মানে না..... তাই ওদের নাম ললনা .
কিন্তু গানের একটা লাইন হঠাৎ ওর মাথায় এলো "তোমার ওপর যখন ওরা ভীষণ রকম রাগ করে... বুঝবে ভালোবাসার লক্ষণ"
তাহলে কি............ ধুর ! যত্তসব.... কি সব যে ভাবছে অভি. ওটা একটা গান. শুধুই গান. হাসি পেয়েও গেলো অভির. চোখে বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো অভি. একসময় ঘুমিয়ে পড়লো সে.
৬ টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো ওর. বেশ অন্ধকার অন্ধকার হয়ে এসেছে. অভি পাশে ফিরে দেখলো. অর্ক ঘুমিয়ে. ওকে না জাগিয়ে আস্তে করে উঠলো অভিষেক. হাতে মোবাইলটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আস্তে করে দরজা খুলে. পাশের ঘরের দরজা দেওয়া. এক পলক ওই দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অভি. তারপরে ভাবলো একটু অনিলের সাথে কথা বলা যাক. সেই ভেবে ও দেখলো সিঁড়ির দরজা খোলা. ও ভাবলো ছাদে গিয়ে কিছুক্ষন একান্তে সময় কাটাবে. সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো অভি. ছাদের দরজার সামনে এসেই চমকে উঠলো অভি. ছাদের মাঝখানে রাখা দোলনায় বসে দুলছে রিমি. মুখ অন্যদিকে তাই অভিকে দেখতে পায়নি ও.
অভিষেক ভাবলো আর দাড়াবেনা চলে যাবে. সেই ভেবে নামার জন্য পা বাড়িয়েছে এমন সময় পেছন থেকে ডাকলো রিমি.
রিমি : উঠে পড়েছো?
পেছন ফিরে তাকালো অভি. অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে হেসে বললো : হ্যা.....তুমিও উঠে পড়েছো.
রিমি কোনো জবাব দিলোনা. শুধু একটু হাসলো. ওকে ভেতরে আসতে বললো. অভি কি আর করবে. যেতেই হলো ছাদে. অভি এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলো. ছাদটা বেশ সুন্দর. গাছ ফুলে ভর্তি. সেগুলোই দেখছে. বা বলা যেতে পারে ছাদের ওই মাঝখানটায় তাকাবেনা বলেই এদিক ওদিক দেখার অভিনয় করছে.
অভি : বাহ্..... খুব সুন্দর সাজিয়েছে ছাদটা. কে করেছে?
রিমি : আমি আর বাবা.
অভি : ওহ... বাহ্... খুব সুন্দর.
রিমি : এসো.... বসনা...
অভি : ও.... ও... ওখানে?
রিমি অভির ওই ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে হেসে বললো : হ্যা... এই দোলনায়... কেন... ভয় লাগে নাকি?
অভি হেসে : না না ভয়.... ভয় কিসের...
রিমি : তাহলে বসো.
অভিষেক এগিয়ে গিয়ে বসলো দোলনায়. কিন্তু যতটা সম্ভব রিমির থেকে দূরে. একেবারে ওপাশে সেটে. রিমি ওকে এইভাবে দেখে মুচকি হেসে বললো : রিলাক্স হয়ে বসো.
অভি : না... ঠিকাছে. অভি আসলে এড়িয়ে যেতে চাইছে ওকে. এটাই হয়তো ওর এখন একমাত্র উপায়.
রিমি আবার দুলতে লাগলো. খুবই নিচু স্বরে ও একটা গান গাইছে. অভির মনে হলো রবীন্দ্রসংগীত.
কিছুক্ষন দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই. হঠাৎ করে রিমি বললো : আমি ঘুমোই নি.
অভি : হ্যা.... কি?
রিমি হেসে : তখন আমায় জিজ্ঞেস করলেনা... উঠে পড়েছি কিনা.... আমি উঠেই ছিলাম. ঘুম আসছিলোনা.... তাই ভাবলাম এখানে এসে বসি.
অভি : ওহ..... (তারপরে কিছুক্ষন থেমে ও বললো ) আমিও ঘুমোয়নি.... মানে.... ঘুম আসছিলোনা.
রিমি ওর দিকে না তাকিয়েই হেসে বললো : তোমার আর আমার ঘুম না আসার কারণ কিন্তু ভিন্ন.
অভি : তাই? কেমন শুনি?
রিমি : তোমার ঘুম না আসার কারণ নতুন জায়গা, নতুন লোকজন, নতুন ঘর, বিছানা বালিশ....... আর আমার ঘুম না আসার কারণ আমার পুরোনো এই বাড়ি, ঘর, বিছানা বালিশ, লোকজন সবাইকে ছেড়ে একেবারে অন্য একটা জায়গায় চলে যেতে হবে কিছুদিন পর. সেখানে আবার নতুন জায়গা, নতুন লোকজন, নতুন বিছানা, বালিশ..... এইগুলো ভেবেই কেমন একটা ভয় ভয় লাগছে. তখন তো আমি আর চাইলেই আর এই ছাদে চলে আসতে পারবোনা.... পারবোনা এই ফুলগুলোতে জল দিতে, পারবোনা ওদের গন্ধ শুকতে. পারবোনা বাবা মাকে দেখতে.
অভিষেক : তা কেন..... সেতো তুমি ভিডিও কল করেই কথা বলতে পারবে ওদের সাথে.
রিমি : হ্যা.. দেখতে হয়তো পাবো.... কিন্তু ছুঁতে কি পারবো? পারবো মায়ের হাত ধরতে? বাবার কাঁধে মাথা রাখতে? ভাইয়ের কান ধরতে? পারবোনা....
অভি এবারে সোজা তাকালো রিমির মুখের দিকে. এ এক নতুন রিমিকে দেখছে অভি. এই রিমি কে অভি চেনেনা. খুব ইচ্ছে করছে রিমির হাতে হাত রাখতে কিন্তু নিজেকে আটকে নিলো অভি.
রিমি মুচকি হেসে বললো : জানি এসব ছেলেমানুষি...... এখন এসব মনে হচ্ছে... আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে....... কিন্তু..... কিন্তু আমি যা ভাবছি... সেগুলো ভুল তো কিছু নয়.
অভিষেক : না...... একটুও নয়. বাবা মা সন্তানের কাছে কি সেটা বলে বোঝানো যায়না... আমরা হয়তো বাবা মায়ের সাথে সবসময় থাকি বলে বুঝতে পারিনা ওদের ভালোবাসা. কখনো ঝগড়া হলে তাদের ওপর রেগে যাই... কিন্তু.... কিন্তু ওদের থেকে কখনো দূরে গেলে বুঝতে পারি বাবার মায়ের টান কি. তুমি মোটেও ছেলেমানুষি করছোনা রিমি..... এটাই ন্যাচারাল.
রিমি তাকালো অভির দিকে. সেই দৃষ্টি যেন সামনে বসে থাকা ছেলেটার মুখ দেখে কিছু পড়ার চেষ্টা করছে. ওই চোখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলোনা অভিষেক. মুখ ঘুরিয়ে নিলো সামনে.
অভি : তা..... কতদিনের পরিচয় তোমাদের? মানে কতবার দেখা করেছো তোমরা?
রিমি : এক
অভি : কি? মাত্র একবার?
রিমি : ওর কাজের নাকি খুব চাপ..... দেখা করার সময় হচ্ছেনা....
অভি : মাত্র একদিনের দেখাতে তুমি কি বুঝলে ওর সম্বন্ধে?
রিমি : কি আবার? ভালো... ভদ্র শিক্ষিত একটা ছেলে.
অভি : ওহ..... একবারের আলাপেই তুমি বুঝে গেলে সে খুবই ভদ্র, ভালো ছেলে তাইতো? একবারের আলাপেই বুঝি বোঝা যায় কে কেমন?
রিমি হেসে : না তা অবশ্যই নয়... কিন্তু ওকে যতটা দেখলাম, কথা বললাম তাতে বুঝেছি ও খারাপ নয়.... আর যাই হোক.... হটাত করে একজনকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবা কি ঠিক? এই যে আমি তোমাকে দেখলাম. তা আমার কি উচিত তোমার সম্বন্ধে প্রথমেই খারাপ কিছু ভেবে নেয়া? তাছাড়া মেসোমশাই দের পরিচিত. বাবার মায়ের দুজনেরই ওকে অনেক ভালো লাগলো. ভাইয়েরও ওকে ভালো লাগলো..
অভি ওর কথার মাঝেই রিমিকে জিজ্ঞেস করলো : আর তোমার?
রিমি এবারে তাকালো অভিষেকের দিকে. অভিষেক সোজা তাকিয়ে রিমির দিকে. মুখটা কঠোর. এবারে রিমি পারলোনা ওই চোখে তাকিয়ে থাকতে. এবারে ও মুখ সরিয়ে নিলো.
নিচ থেকে ডাক শুনলো ওরা.
বাবলি চা খবিতো?
হ্যা মা.... করো আসছি..
আচ্ছা...
রিমি বললো : চলো.... নীচে যাই..
অভিষেক : আমি আমার জবাবটা কিন্তু পেলাম না.
রিমি এড়িয়ে যাবে ভেবেছিলো কিন্তু অভিকে এড়াতে পারলোনা ও. অভি এখনও তাকিয়ে ওর দিকে.
রিমি হেসে বললো : ভা... ভা ভালোই তো. খুব ভালো লাগলো ওকে.
অভিষেক : তাই? সত্যি? তোমার মুখ দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছেনা... .
রিমি : কি... কি বলছো? ধ্যাৎ চলো নীচে.
অভি : রিমি..... হ্যা আমরা আজই হয়তো একে ওপরের সাথে পরিচিত হলাম, হয়তো আজই চিনলাম একে ওপরের সাথে. কিন্তু তোমার একজন বন্ধু হিসেবেই জিজ্ঞেস করছি..... তুমি খুশি তো?
দেখো বিয়েটা তোমার... সারা জীবন তুমি কাটাবে তার সাথে. আমি কখনোই বলছিনা যে অপরিচিত মানেই সে খারাপ মানুষ. হতে পারে তাকেও তোমাকে ভালো লেগেছে, হতে পারে সে তোমাকে ভালোবাসে, সারা জীবন খুশি রাখবে... . হতে পারে সেও তোমাকে প্রথমবার দেখে আমার মতো....
এইটুকু বলেই নিজেকে সামলে নিলো অভিষেক.
রিমি : কি? কি বললে?
অভি : না... কিছুনা... ছাড়ো... চলো
রিমি : দাড়াও...... কি বলছিলে বলো.
অভিষেক আবার তাকালো ওর দিকে. রিমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ওর দিকে. অভির বুকটা আবার ধুক ধুক করছে... আবার বুকে একটা চাপ অনুভব করছে ও.
অভি বললো : আচ্ছা ধরো...... হঠাৎ করে তোমার একজনকে খুব ভালো লেগে গেলো...... তুমি হয়তো তাকে চেনোনা জানোনা... কিছুই জানোনা তার সম্বন্ধে.... কিন্তু তোমার মনে হতো লাগলো... এই.... এই সেই মানুষটা যাকে আমি এতদিন খুঁজেছি. আজ তাকে পেলাম. তোমার হবু স্বামীকে দেখে কি এই অনুভূতিটা তোমার মধ্যে এসেছিলো? মনে হয়েছিল একে ছাড়া থাকাটা সম্ভব নয়? সবসময় ওই মুখটা চোখের সামনে ভাসছিলো? মনে হচ্ছিলো বুকের বাঁ দিকটা কেমন ব্যাথা হচ্ছে?
অভি খুব কাছে চলে এসেছে রিমির. রিমি অভিষেকের চোখে তাকিয়ে সব শুনছে.
অভি : বলোনা? এর একটাও মনে হয়েছে? মনে হয়েছে একে পেলে নিজের সব কিছু দিয়ে ভালোবাসবো..... কোনোদিন কোনো ক্ষতি হতে দেবোনা ওর.... বলোনা? মনে হয়েছে?
রিমি : আম... আমি.... আ... আ ... আমি মানে......
কি অদ্ভুত তাইনা? যে ছেলেটা মেয়েদের সামনে কথা বলতে ভয় পেতো, তোতলাতে..... আজ সে একটানে এতগুলো কথা বলে ফেললো আর আজ এই প্রথমবার সামনের মানুষটার মুখে কোনো উত্তর নেই.
এমন কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর জানা যায়না.... বা জানলেও অনেক সময় উত্তর দেওয়া যায়না. রিমির কাছে কোনো জবাব ছিলোনা অভিষেকের প্রশ্নের. বা হয়তো ছিল কিন্তু পারছিলোনা উত্তর দিতে. এমন সময় নিচ থেকে আওয়াজ এলো...
আয়.... চা নিয়ে যা... আর ভাইকে ডাক... উঠতে বল ওকে. অভিকে চা দিয়ে আয়.
রিমি : আমি.... আমি যাই... মা ডাকছে. (বলেই চলে যাচ্ছিলো ও.)
অভি : আমার উত্তরটা?
রিমি যেতে যেতে থামলো. অভির দিকে না ঘুরেই বললো : সব প্রশ্নের উত্তর হয়না অভিষেক.
রিমি আর দাড়ালোনা. নেমে গেলো সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে. অভিষেক মনে মনে হাসলো আর পেছন ফিরে ওই বাগানের ফুল গুলো দেখে নিজেকে নিজেই বললো : আবার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয়না..... বুঝে নিতে হয়.......... বুঝে নিয়েছি.
অভির চোখে জল চলে এলো. উত্তরের অপেক্ষায় নাকি পেয়েও হারিয়ে ফেলার দুঃখে.... তা জানেনা ও.
দীপালি দেবী বললেন : একি অভি.... তুমি তো নিচ্ছই না কিছু.... আরেকটা মাছ দি?
অভি হেসে বলল : না কাকিমা.... ঠিক আছে...
উনি হেসে বললেন : আরে লজ্জা পেয়েওনা তো... নিজের বাড়ি মনে করো. বাবলি.... ওকে মাংস দেতো.
রিমি নিজেই এবারে ওর পাতে তিন পিস মাংস দিলো. আর প্রায় আদেশের সুরে বললো : খাও.
অভি আর না বলতে পারলোনা. খেতে লাগলো. ঠিক ওর উল্টোদিকেই সে বসে আছে আর কাকিমা মানে অভির মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে খাচ্ছে.
মজার ব্যাপার হলো যে খাবোনা.. খাবোনা বলছিলো.... সে আরও অনেকটা খেয়ে ফেললো.
এবারে একটু ঘুমোনোর পালা. এমনিতে কে কোথায় সবে সব ঠিক হয়ে গেছে. অভিষেক শোবে অর্কর ঘরে, ঝিলমিল তো রিমি দিদিকে ছাড়বেই না. খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর সাথে. তাই রিমি ওকে ওর ঘরে নিয়ে গেলো. আর দুজনেরই বাবা নিচের গেস্ট রুমে শোবে আর ওদের মায়েরা আর অন্যান্য মহিলারা আর শোবেনা. গল্প করেই দুপুরটা কাটাবে. ওরা নিচেই ড্রয়িং রুমে গল্প করতে লাগলো.
অভি আর অর্ক শুয়ে পড়েছে. আগেই জামা পাল্টে ও অন্য জামা প্যান্ট পরে নিয়েছে. চুপচাপ শুয়ে রইলো অভি. অর্ক মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে. কিন্তু অভির চোখে ঘুম নেই. অভি ভাবছে এখান থেকে চলে যাই.... আর থাকতে ইচ্ছে করছেনা.. . কেন এলো এখানে? না আসলেই তো ভালো ছিল. ধুর..... এ কেমন সিচুয়েশন রে বাবা? না পারছে এগোতে না পারছে পিছোতে.
সত্যি.. একদিনেই যেভাবে রিমি অভির বাবা মাকে, ওর ছোট বোনকে আপন করে নিলো, খুব ভালো মেয়েটা. এমনকি অভিষেকের ওপরেও যেভাবে অধিকার ফলিয়ে জোর করে তখন মাংস খেতে বললো, ওর ওপর সিগারেটের ব্যাপার নিয়ে রেগে গেলো. আশ্চর্য....ওরা তো চেনেনা একে অপরকে.... তাহলে এই অধিকার কেন?
সত্যি..... কিশোর কুমার ঠিকই গেয়ে গেছিলেন. নারী চরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবেনা, এরা লোন ল মানে না..... তাই ওদের নাম ললনা .
কিন্তু গানের একটা লাইন হঠাৎ ওর মাথায় এলো "তোমার ওপর যখন ওরা ভীষণ রকম রাগ করে... বুঝবে ভালোবাসার লক্ষণ"
তাহলে কি............ ধুর ! যত্তসব.... কি সব যে ভাবছে অভি. ওটা একটা গান. শুধুই গান. হাসি পেয়েও গেলো অভির. চোখে বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো অভি. একসময় ঘুমিয়ে পড়লো সে.
৬ টা নাগাদ ঘুম ভাঙলো ওর. বেশ অন্ধকার অন্ধকার হয়ে এসেছে. অভি পাশে ফিরে দেখলো. অর্ক ঘুমিয়ে. ওকে না জাগিয়ে আস্তে করে উঠলো অভিষেক. হাতে মোবাইলটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আস্তে করে দরজা খুলে. পাশের ঘরের দরজা দেওয়া. এক পলক ওই দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অভি. তারপরে ভাবলো একটু অনিলের সাথে কথা বলা যাক. সেই ভেবে ও দেখলো সিঁড়ির দরজা খোলা. ও ভাবলো ছাদে গিয়ে কিছুক্ষন একান্তে সময় কাটাবে. সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলো অভি. ছাদের দরজার সামনে এসেই চমকে উঠলো অভি. ছাদের মাঝখানে রাখা দোলনায় বসে দুলছে রিমি. মুখ অন্যদিকে তাই অভিকে দেখতে পায়নি ও.
অভিষেক ভাবলো আর দাড়াবেনা চলে যাবে. সেই ভেবে নামার জন্য পা বাড়িয়েছে এমন সময় পেছন থেকে ডাকলো রিমি.
রিমি : উঠে পড়েছো?
পেছন ফিরে তাকালো অভি. অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে হেসে বললো : হ্যা.....তুমিও উঠে পড়েছো.
রিমি কোনো জবাব দিলোনা. শুধু একটু হাসলো. ওকে ভেতরে আসতে বললো. অভি কি আর করবে. যেতেই হলো ছাদে. অভি এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলো. ছাদটা বেশ সুন্দর. গাছ ফুলে ভর্তি. সেগুলোই দেখছে. বা বলা যেতে পারে ছাদের ওই মাঝখানটায় তাকাবেনা বলেই এদিক ওদিক দেখার অভিনয় করছে.
অভি : বাহ্..... খুব সুন্দর সাজিয়েছে ছাদটা. কে করেছে?
রিমি : আমি আর বাবা.
অভি : ওহ... বাহ্... খুব সুন্দর.
রিমি : এসো.... বসনা...
অভি : ও.... ও... ওখানে?
রিমি অভির ওই ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে হেসে বললো : হ্যা... এই দোলনায়... কেন... ভয় লাগে নাকি?
অভি হেসে : না না ভয়.... ভয় কিসের...
রিমি : তাহলে বসো.
অভিষেক এগিয়ে গিয়ে বসলো দোলনায়. কিন্তু যতটা সম্ভব রিমির থেকে দূরে. একেবারে ওপাশে সেটে. রিমি ওকে এইভাবে দেখে মুচকি হেসে বললো : রিলাক্স হয়ে বসো.
অভি : না... ঠিকাছে. অভি আসলে এড়িয়ে যেতে চাইছে ওকে. এটাই হয়তো ওর এখন একমাত্র উপায়.
রিমি আবার দুলতে লাগলো. খুবই নিচু স্বরে ও একটা গান গাইছে. অভির মনে হলো রবীন্দ্রসংগীত.
কিছুক্ষন দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই. হঠাৎ করে রিমি বললো : আমি ঘুমোই নি.
অভি : হ্যা.... কি?
রিমি হেসে : তখন আমায় জিজ্ঞেস করলেনা... উঠে পড়েছি কিনা.... আমি উঠেই ছিলাম. ঘুম আসছিলোনা.... তাই ভাবলাম এখানে এসে বসি.
অভি : ওহ..... (তারপরে কিছুক্ষন থেমে ও বললো ) আমিও ঘুমোয়নি.... মানে.... ঘুম আসছিলোনা.
রিমি ওর দিকে না তাকিয়েই হেসে বললো : তোমার আর আমার ঘুম না আসার কারণ কিন্তু ভিন্ন.
অভি : তাই? কেমন শুনি?
রিমি : তোমার ঘুম না আসার কারণ নতুন জায়গা, নতুন লোকজন, নতুন ঘর, বিছানা বালিশ....... আর আমার ঘুম না আসার কারণ আমার পুরোনো এই বাড়ি, ঘর, বিছানা বালিশ, লোকজন সবাইকে ছেড়ে একেবারে অন্য একটা জায়গায় চলে যেতে হবে কিছুদিন পর. সেখানে আবার নতুন জায়গা, নতুন লোকজন, নতুন বিছানা, বালিশ..... এইগুলো ভেবেই কেমন একটা ভয় ভয় লাগছে. তখন তো আমি আর চাইলেই আর এই ছাদে চলে আসতে পারবোনা.... পারবোনা এই ফুলগুলোতে জল দিতে, পারবোনা ওদের গন্ধ শুকতে. পারবোনা বাবা মাকে দেখতে.
অভিষেক : তা কেন..... সেতো তুমি ভিডিও কল করেই কথা বলতে পারবে ওদের সাথে.
রিমি : হ্যা.. দেখতে হয়তো পাবো.... কিন্তু ছুঁতে কি পারবো? পারবো মায়ের হাত ধরতে? বাবার কাঁধে মাথা রাখতে? ভাইয়ের কান ধরতে? পারবোনা....
অভি এবারে সোজা তাকালো রিমির মুখের দিকে. এ এক নতুন রিমিকে দেখছে অভি. এই রিমি কে অভি চেনেনা. খুব ইচ্ছে করছে রিমির হাতে হাত রাখতে কিন্তু নিজেকে আটকে নিলো অভি.
রিমি মুচকি হেসে বললো : জানি এসব ছেলেমানুষি...... এখন এসব মনে হচ্ছে... আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে....... কিন্তু..... কিন্তু আমি যা ভাবছি... সেগুলো ভুল তো কিছু নয়.
অভিষেক : না...... একটুও নয়. বাবা মা সন্তানের কাছে কি সেটা বলে বোঝানো যায়না... আমরা হয়তো বাবা মায়ের সাথে সবসময় থাকি বলে বুঝতে পারিনা ওদের ভালোবাসা. কখনো ঝগড়া হলে তাদের ওপর রেগে যাই... কিন্তু.... কিন্তু ওদের থেকে কখনো দূরে গেলে বুঝতে পারি বাবার মায়ের টান কি. তুমি মোটেও ছেলেমানুষি করছোনা রিমি..... এটাই ন্যাচারাল.
রিমি তাকালো অভির দিকে. সেই দৃষ্টি যেন সামনে বসে থাকা ছেলেটার মুখ দেখে কিছু পড়ার চেষ্টা করছে. ওই চোখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলোনা অভিষেক. মুখ ঘুরিয়ে নিলো সামনে.
অভি : তা..... কতদিনের পরিচয় তোমাদের? মানে কতবার দেখা করেছো তোমরা?
রিমি : এক
অভি : কি? মাত্র একবার?
রিমি : ওর কাজের নাকি খুব চাপ..... দেখা করার সময় হচ্ছেনা....
অভি : মাত্র একদিনের দেখাতে তুমি কি বুঝলে ওর সম্বন্ধে?
রিমি : কি আবার? ভালো... ভদ্র শিক্ষিত একটা ছেলে.
অভি : ওহ..... একবারের আলাপেই তুমি বুঝে গেলে সে খুবই ভদ্র, ভালো ছেলে তাইতো? একবারের আলাপেই বুঝি বোঝা যায় কে কেমন?
রিমি হেসে : না তা অবশ্যই নয়... কিন্তু ওকে যতটা দেখলাম, কথা বললাম তাতে বুঝেছি ও খারাপ নয়.... আর যাই হোক.... হটাত করে একজনকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবা কি ঠিক? এই যে আমি তোমাকে দেখলাম. তা আমার কি উচিত তোমার সম্বন্ধে প্রথমেই খারাপ কিছু ভেবে নেয়া? তাছাড়া মেসোমশাই দের পরিচিত. বাবার মায়ের দুজনেরই ওকে অনেক ভালো লাগলো. ভাইয়েরও ওকে ভালো লাগলো..
অভি ওর কথার মাঝেই রিমিকে জিজ্ঞেস করলো : আর তোমার?
রিমি এবারে তাকালো অভিষেকের দিকে. অভিষেক সোজা তাকিয়ে রিমির দিকে. মুখটা কঠোর. এবারে রিমি পারলোনা ওই চোখে তাকিয়ে থাকতে. এবারে ও মুখ সরিয়ে নিলো.
নিচ থেকে ডাক শুনলো ওরা.
বাবলি চা খবিতো?
হ্যা মা.... করো আসছি..
আচ্ছা...
রিমি বললো : চলো.... নীচে যাই..
অভিষেক : আমি আমার জবাবটা কিন্তু পেলাম না.
রিমি এড়িয়ে যাবে ভেবেছিলো কিন্তু অভিকে এড়াতে পারলোনা ও. অভি এখনও তাকিয়ে ওর দিকে.
রিমি হেসে বললো : ভা... ভা ভালোই তো. খুব ভালো লাগলো ওকে.
অভিষেক : তাই? সত্যি? তোমার মুখ দেখে কিন্তু তা মনে হচ্ছেনা... .
রিমি : কি... কি বলছো? ধ্যাৎ চলো নীচে.
অভি : রিমি..... হ্যা আমরা আজই হয়তো একে ওপরের সাথে পরিচিত হলাম, হয়তো আজই চিনলাম একে ওপরের সাথে. কিন্তু তোমার একজন বন্ধু হিসেবেই জিজ্ঞেস করছি..... তুমি খুশি তো?
দেখো বিয়েটা তোমার... সারা জীবন তুমি কাটাবে তার সাথে. আমি কখনোই বলছিনা যে অপরিচিত মানেই সে খারাপ মানুষ. হতে পারে তাকেও তোমাকে ভালো লেগেছে, হতে পারে সে তোমাকে ভালোবাসে, সারা জীবন খুশি রাখবে... . হতে পারে সেও তোমাকে প্রথমবার দেখে আমার মতো....
এইটুকু বলেই নিজেকে সামলে নিলো অভিষেক.
রিমি : কি? কি বললে?
অভি : না... কিছুনা... ছাড়ো... চলো
রিমি : দাড়াও...... কি বলছিলে বলো.
অভিষেক আবার তাকালো ওর দিকে. রিমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ওর দিকে. অভির বুকটা আবার ধুক ধুক করছে... আবার বুকে একটা চাপ অনুভব করছে ও.
অভি বললো : আচ্ছা ধরো...... হঠাৎ করে তোমার একজনকে খুব ভালো লেগে গেলো...... তুমি হয়তো তাকে চেনোনা জানোনা... কিছুই জানোনা তার সম্বন্ধে.... কিন্তু তোমার মনে হতো লাগলো... এই.... এই সেই মানুষটা যাকে আমি এতদিন খুঁজেছি. আজ তাকে পেলাম. তোমার হবু স্বামীকে দেখে কি এই অনুভূতিটা তোমার মধ্যে এসেছিলো? মনে হয়েছিল একে ছাড়া থাকাটা সম্ভব নয়? সবসময় ওই মুখটা চোখের সামনে ভাসছিলো? মনে হচ্ছিলো বুকের বাঁ দিকটা কেমন ব্যাথা হচ্ছে?
অভি খুব কাছে চলে এসেছে রিমির. রিমি অভিষেকের চোখে তাকিয়ে সব শুনছে.
অভি : বলোনা? এর একটাও মনে হয়েছে? মনে হয়েছে একে পেলে নিজের সব কিছু দিয়ে ভালোবাসবো..... কোনোদিন কোনো ক্ষতি হতে দেবোনা ওর.... বলোনা? মনে হয়েছে?
রিমি : আম... আমি.... আ... আ ... আমি মানে......
কি অদ্ভুত তাইনা? যে ছেলেটা মেয়েদের সামনে কথা বলতে ভয় পেতো, তোতলাতে..... আজ সে একটানে এতগুলো কথা বলে ফেললো আর আজ এই প্রথমবার সামনের মানুষটার মুখে কোনো উত্তর নেই.
এমন কিছু প্রশ্ন থাকে যার উত্তর জানা যায়না.... বা জানলেও অনেক সময় উত্তর দেওয়া যায়না. রিমির কাছে কোনো জবাব ছিলোনা অভিষেকের প্রশ্নের. বা হয়তো ছিল কিন্তু পারছিলোনা উত্তর দিতে. এমন সময় নিচ থেকে আওয়াজ এলো...
আয়.... চা নিয়ে যা... আর ভাইকে ডাক... উঠতে বল ওকে. অভিকে চা দিয়ে আয়.
রিমি : আমি.... আমি যাই... মা ডাকছে. (বলেই চলে যাচ্ছিলো ও.)
অভি : আমার উত্তরটা?
রিমি যেতে যেতে থামলো. অভির দিকে না ঘুরেই বললো : সব প্রশ্নের উত্তর হয়না অভিষেক.
রিমি আর দাড়ালোনা. নেমে গেলো সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে. অভিষেক মনে মনে হাসলো আর পেছন ফিরে ওই বাগানের ফুল গুলো দেখে নিজেকে নিজেই বললো : আবার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয়না..... বুঝে নিতে হয়.......... বুঝে নিয়েছি.
অভির চোখে জল চলে এলো. উত্তরের অপেক্ষায় নাকি পেয়েও হারিয়ে ফেলার দুঃখে.... তা জানেনা ও.
চলবে.....