14-07-2020, 07:30 PM
(This post was last modified: 04-04-2021, 03:56 PM by kumdev. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
।।৭০।।
যথারীতি সকাল হল অন্যান্য দিনের মত। ছুটির দিন ব্যস্ততা নেই কোনো। কিন্তু এহসান মঞ্জিলের সকাল আলাদা। ঘুম ভেঙ্গেও যেন জড়তা কাটতে চায় না। মামুন আর একবার নিজের জিনিসপত্র দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। করিম ঘোরে ফেরে চোরা চোখে ভাইয়ারে দেখে। কবে এ বাড়িতে কাজে লেগেছে সাল হিসেব করতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মামুনের অবাক লাগে সবাই এমন করছে কেন,সে তো চিরকালের জন্য যাচ্ছে না। বন্ধুরা মুখে শুভকামনা জানালেও চোখে দেখেছিল ঈর্ষার ঝলক বেশ উপভোগ করেছে মামুন। কিন্তু মাকে নিয়ে হয়েছে সমস্যা। মুখে বলছে সাবধানে থাকিস বাবা চোখের ভাষা আলাদা। আব্বু এই দিক দিয়ে একেবারে ফিট। দেখা হলেই কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে তো? মন দিয়া পড়াশুনা করিস।
বাইরে কার ডাকে করিম ছুটে গেল ফিরে এল একটা চিঠি হাতে।
— কিরে কার চিঠি?
— আমি কি করে বলবো পিয়ন বলল কি গুলমাল না কি?
আবার কিসের গোলমাল? ড.রিয়াজ এগিয়ে গিয়ে করিমের হাত থেকে চিঠি নিয়ে দেখে বলেন,হারামজাদা তুই অপার নাম জানিস না?
— মণ্টি। জানবো না কেন?
— ওইটা ডাক নাম,ভাল নাম গুলনার এহসান মণ্টি।
— আমি ঐসব গুলমাল-টাল কইতে পারবো না,চিরকাল অপা কইছি অপাই কমু।
— কিসের চিঠি? নাদিয়া বেগম জিজ্ঞেস করেন। আসল কথা না কইয়া উনি করিমের পিছনে লাগছেন।
গুলনার আসতে ড.রিয়াজ মেয়ের দিকে চিঠি এগিয়ে দিলেন। গুলনার চিঠি খুলে দেখলেন,কলেজ থেকে এসেছে। মঞ্জুর হয়েছে তার পদত্যাগ পত্র। একদিন গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে আসতে বলেছে।
— শেষ পর্যন্ত চাকরী ছেড়ে দিলি? তোর মা এত করে বলেছিল শুনিস নি। আজ কেন মা তোর সুমতি হল?
নাদিয়া বেগম স্বামীর কাছ ঘেষে গিয়ে ফিসফিস করে বলেন,বুড়া হইতে চললেন আপনের কবে বুদ্ধি হইবো? কদিন পর বাচ্চা হইবো,বাচ্চা ফেলাইয়া চাকরি করতে যাইবো নাকি?
ড.রিয়াজ হো-হো করে ঘর কাপিয়ে হেসে উঠলেন।
গুলনার মনে মনে ভাবে অযত্নে লোহা ফেলে রাখতে চাই না।
জয়নাল দারোগার প্রোমোশন হয়ে এখন সিআই হয়েছেন। হোটেলে জানলার ধারে বসে নানাকথা মনে আসছে। বলার ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। চুরির দায়ে এসেছিল থানায়। বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। লোকটার প্রতি মায়া বশত রাশেদকে বলে কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। বদলি হয়ে এল নবাবগঞ্জে। অচেনা জায়গা কোথায় থাকবে ভেবে চিঠি লিখে দিলেন রিজানুর রহমানের কাছে। রিজানুর ছিলেন বড়ভাইয়ের মত।বড়ভাই যে বেঁচে নেই খবরটা তখন জানতেন না। জানলে হয়তো চিঠি লিখতেন না। নুসরতের কাছে শুনেছেন,কিভাবে ড.রিয়াজের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হয়। এরেই বলে নসিব। কি সুন্দর স্মার্ট দেখতে হয়েছে এখন। শিক্ষা অনেকটা উর্দির মত। যেই গায়ে দিবা অমনি আলাদা ব্যক্তিত্ব। সইদুল এখন সাব-ইন্সপেকটার,মন লাগায়ে কাজ করতে পারলে ইন্সপেক্টার হতে কতক্ষন। রাশেদ আছে নুসরতের পরিচিত জেনিফার আলম যদি একটু সাপোর্ট দেয় তাহলে কথাই নাই। বিবাহটা ভালয় ভালয় মিটলে হয়। অধ্যাপকরেও নেওতা দেওয়া যাইতে পারে। কারে দিয়া কি হয় কে বলতে পারে।
একটু সকাল সকাল এসে পড়েছে বিমান বন্দরে। মুস্তাক নিয়ে এসেছে নাদিয়া বেগম মণ্টি দেব আর মামুনকে। মামুন আজ ড্রাইভ করে নাই। নাদিয়া বেগমের দুই পাশে বসেছিল মেয়ে আর ছেলে,দেব বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। পরে আসছেন ড.রিয়াজ, সঙ্গে করিমেরও আসার কথা। দেরী আছে চেকিংযের সময়।
মামুন নেমে জিজ্ঞেস করে, দুলাভাই কফি খাইবেন নাকি?
— কারে কি জিগাস? তর দুলাভাই খাওনের ব্যাপারে কখনো আপত্তি করচে? গুলনার হেসে বলেন।
নাদিয়া বেগম মেয়েকে ধমক দেন, আমার জামাইরে তুই খাওনের খোটা দিবি না, বইলা রাখলাম।
— কি আপনে কিছু কন না? দেবকে জিজ্ঞেস করেন গুলনার।
— একসাথে সবাই কথা বলতে নেই। দেব বলে।
— বলা তোর স্বামী না? স্বামীর লগে কেউ এইভাবে কথা হয়?
গুলনার কিছু বলেন না। মনে মনে ভাবে দেব যে তার স্বামী না সন্তান সেইটাই এখনো ঠিক করতে পারলেন না। কেউ না থাকলে গাড়ি থেকে নেমে ওকে একটা চুমু দিতেন। পায়চারি করছে দেব। মামুন কফি আনতে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে গুলনার দেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনে আমার উপর রাগ করছেন?
— কেমন করে রাগ করে সেইটা শিখতে পারলাম না। আমার মায়ে বলতো বলা ক্রোধে বোধ নষ্ট হয়।
গুলনার ভাবেন কেমন সুন্দর করে কথা বলে দেব। মাটি দিয়ে নিজের মত করে গড়ে নিয়েছে। ছিঃ এমন মানুষকে কেউ সন্দেহ করে? নিজের উপর রাগ হয়। নিজের গড়া পুতুলকে মাঝে মাঝে নিজেই চিনতে পারেন না। চারদিকে লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটু দূরে একটা জটলা ক্রমশ ভারী হতে থাকে। কোন ভিআইপি হবে হয়তো। দেব দূরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন গুলনার। মামুন আসছে পিছনে ট্রে হাতে একজন বয়। গাড়িতে মাকে দিয়ে ছেলেটি তাদের কাছে আসে। ট্রের উপর দু-কাপ কফি আর দুটো ফিসফ্রাই। গুলনার কফি নিয়ে বলেন,ফ্রাই দুইটা আপনে নেন।
— না আমি একটা খাবো।
— তার মানে রাগ করছেন? কাদো কাদো ভাবে জিজ্ঞেস করেন গুলনার।স্বামীর লগে একটু মস্করা করতে পারুম না।
মণ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেয়ে যায়, দেব বলে,নিতে পারি যদি তুমি হাতে করে খাইয়ে দাও।
— ইস আমার বইয়া গ্যাছে। গুলনার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিস ফ্রাই তুলে দেবের মুখের কাছে তুলতে দেব এক কামড়ে প্রায় অর্ধেকটা কেটে নিল। আবার মুখ এগিয়ে আনতে গুলনার টুপ করে বাকিটা নিজের মুখে পুরে দিলেন।
একটি মেয়ে এসে বলদেবকে বলল,স্যর আপনাকে ডাকছেন। বলেই দৌড়ে ভীড়ের দিকে চলে গেল। দেব আর গুলনার চোখাচুখি করে।চলুন দেখি কে ডাকছে। দেব এগিয়ে যেতে লাগল,মণ্টি তার পিছু ছাড়েনা।ভীড়ের মাঝে মনে হচ্ছে ড মৌসম। ভীড়ের কাছাকাছি হতে ড.মৌসম বলেন,হাই সোম।
বলদেব হাই বলে হাসল।মনে হচ্ছে ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎ ডাকলো কেন?
তারপর ভীড় ছেড়ে কাছে এসে বলেন,তুমি এখানে? উনি তোমার ওয়াইফ? আলাপ করিয়ে দেবে না?
অগত্যা দেব মণ্টির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
— তোমার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগলো। রিয়ালি শি ইজ এঞ্জেল। নিজে নিজে খিল খিল করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে বললেন,তোমাদের ভার্সিটি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমার কথা আমি ড.আইয়ুবকে বলেছি। তুমি ইচ্ছে করলে ওর আণ্ডারে থিসিস করতে পারো।
কিছুক্ষন তাকিয়ে গুলনারকে দেখলেন। তারপর গুলনারের কাছে গিয়ে বললেন,ম্যাডাম এক মিনিট একটা প্রাইভেট কথা আছে।
ওরা দুজনে একটু দূরে সরে গেল।ভীড়ের একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বলদেবকে জিজ্ঞেস করে,স্যার উনি গুলনার বেগম?
বলদেব বুঝতে পারে টিভিতে দেখেছে হয়তো বলল,হ্যা তুমি চেনো?
--চিনি না ওনার গান শুনেছি।ভীড়কে লক্ষ্য করে বলল,কিরে বললাম না।
গুলনারের হাত ধরে মৃদু স্বরে বললেন,চমৎকার মানিয়েছে। আমি বিনি সুতোর বাঁধন দেখতে পাইনি তাই দড়ি দিয়ে বাঁধতে গেছিলাম। অ্যাম সরি। তারপর দেবের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বললেন,বাই সোম। মৌসম আবার ভীড়ে মিশে গেলেন।
গুলনার ভদ্রমহিলার নাম শুনেছিলেন আজ প্রথম দেখলেন। দেবের থেকে কম করে বছর পনেরোর বড় হবেন। দেব এর পাল্লায় পড়েছিল? এতো ওকে চিবিয়ে ছিবড়ে করে দিত। দড়ি দিয়ে বাধতে গেছিল আবার আইলে এমন বাড়ি দিমু জ্বালা জুড়াইয়া যাইবো। দেবের হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে গুলনার বলেন,হা করে দেখেন কি? চলেন,আব্বু আইসা পড়ছে।এই রাক্ষুসীর খপ্পরে পড়ছিলেন?
--ভাল করে না জেনে কারো সম্পর্কে মন্তব্য করতে নাই।
--আর একটা কথা বলবেন না।দড়ি দিয়া বাধতে গেছিলাম,মুখ ফুইটা কইতে লজ্জা হয়না।দেবের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে।
দূরে দেখা গেল আরেকটা গাড়ি এসেছে। ওরা তাড়াতাড়ি পা চালালো। মামুন ভিতরে যাবার জন্য প্রস্তুত। গুলনার কাছে যেতে জড়িয়ে ধরে মামুন ধরা গলায় বলল,অপা আসি? তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমি মামা হইলে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিবা।
ভাইকে জড়িয়ে ধরে গুলনার কেদে ফেলে,খুব ফাজিল হইছস?
— অপা ছাড় কি পাগলামি করো? মামুনের চোখ ঝাপসা।
দেব এগিয়ে গিয়ে বলে,শোন মামুন একলা যাচ্ছো একলা ফিরবে,মামী নিয়ে আসবে না। লাজুক হেসে দেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে দেব বাধা দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,সময় পেলে আম্মুকে ফোন কোরো। মামুন মায়েরে প্রণাম করে সংরক্ষিত অঞ্চলে ঢুকে গেল।
ফেরার পথে গাড়িতে কেবল গুলনার আর দেব। অপর গাড়িতে ড.রিয়াজ নাদিয়া বেগম আর করিম।নাম শুনেছে অনেকবার আজ স্বচক্ষে দেখল।বেহায়া বড় মুখ করে বলে কিনা দড়ি দিয়া বাধতে গেছিলাম। রহম দিল আল্লা নাইলে দেবরে খাইয়া ফেলাইত।পাশে বসা দেবকে দেখে কেমন নির্বিকার।সামনে মুস্তাক তাই কিছু বলতে পারেনা।
--সারাক্ষন এত কি ভাবেন বলেন তো?
--ভাবছি এতক্ষনে মামুন মাটি ছেড়ে আকাশে।
--ঐ মৌসম নাকি সেওতো আকাশে।
বলদেব মুখ ঘুরিয়ে মণ্টির দিকে তাকিয়ে হাসল।
--হাসেন কেন?
--তোমার অনেক ফ্যান।এখানেও তোমাকে অনেকে চেনে।
গুলনার ভ্রু কুচকে তাকায়।বলদেব বলল,ঐ মেয়েগুলো তোমাকে নিয়ে আলোচনা করছিল।
--আমাকে ডেকে নিয়ে কি বলল অধ্যাপিকা জানতে ইচ্ছা হয়না?
--প্রাইভেট কথা কেন জানতে চাইব?
কিছুটা যাবার পর গুলনার জিজ্ঞেস করেন, মুস্তাক কফি খেয়েছো।
— জ্বি আমি ভাজা খেয়েছি,কফি খাইতে তিতা লাগে,আমি চা খাই।
— তুমি গাড়ি দাড় করাও।
মুস্তাক ঘাবড়ে গিয়ে গাড়ি থামায়। গুলনার বলেন,নামো কোথাও গিয়া চা খাইয়া আসো। যাও।
— পরে খামুনে– ।
— না অখনই যাইবা। বাধ্য হয়ে মুস্তাককে যেতে হয়। জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখেন গুলনার,মুস্তাক হাটতে হাটতে চায়ের দোকান খুজতে অনেক দূর চলে যাচ্ছে। মণ্টি ইচ্ছে করেই মুস্তাককে চা খেতে পাঠিয়েছেন বলদেব বুঝতে পারেনি।
মণ্টির অদ্ভুত ব্যবহারে দেব হতচকিত। মুস্তাক চলে যেতেই গুলনার দেবকে বলেন, প্রাইভেট কথা আপনার বিবির সাথে আপনার জানতে ইচ্ছা হয়না?
--তুমি তো বলেই দিয়েছো দড়ি দিয়া বাধতে চায়।
গুলনার হেসে,‘ওরে আমার বলদারে’ বলে দেবের মাথা নিজের দিকে টেনে এনে ঠোট জোড়া মুখে পুরে নিল যেন শেষ বিন্দু শুষে নেবে।
। । সমাপ্ত । ।
যথারীতি সকাল হল অন্যান্য দিনের মত। ছুটির দিন ব্যস্ততা নেই কোনো। কিন্তু এহসান মঞ্জিলের সকাল আলাদা। ঘুম ভেঙ্গেও যেন জড়তা কাটতে চায় না। মামুন আর একবার নিজের জিনিসপত্র দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। করিম ঘোরে ফেরে চোরা চোখে ভাইয়ারে দেখে। কবে এ বাড়িতে কাজে লেগেছে সাল হিসেব করতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মামুনের অবাক লাগে সবাই এমন করছে কেন,সে তো চিরকালের জন্য যাচ্ছে না। বন্ধুরা মুখে শুভকামনা জানালেও চোখে দেখেছিল ঈর্ষার ঝলক বেশ উপভোগ করেছে মামুন। কিন্তু মাকে নিয়ে হয়েছে সমস্যা। মুখে বলছে সাবধানে থাকিস বাবা চোখের ভাষা আলাদা। আব্বু এই দিক দিয়ে একেবারে ফিট। দেখা হলেই কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে তো? মন দিয়া পড়াশুনা করিস।
বাইরে কার ডাকে করিম ছুটে গেল ফিরে এল একটা চিঠি হাতে।
— কিরে কার চিঠি?
— আমি কি করে বলবো পিয়ন বলল কি গুলমাল না কি?
আবার কিসের গোলমাল? ড.রিয়াজ এগিয়ে গিয়ে করিমের হাত থেকে চিঠি নিয়ে দেখে বলেন,হারামজাদা তুই অপার নাম জানিস না?
— মণ্টি। জানবো না কেন?
— ওইটা ডাক নাম,ভাল নাম গুলনার এহসান মণ্টি।
— আমি ঐসব গুলমাল-টাল কইতে পারবো না,চিরকাল অপা কইছি অপাই কমু।
— কিসের চিঠি? নাদিয়া বেগম জিজ্ঞেস করেন। আসল কথা না কইয়া উনি করিমের পিছনে লাগছেন।
গুলনার আসতে ড.রিয়াজ মেয়ের দিকে চিঠি এগিয়ে দিলেন। গুলনার চিঠি খুলে দেখলেন,কলেজ থেকে এসেছে। মঞ্জুর হয়েছে তার পদত্যাগ পত্র। একদিন গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে আসতে বলেছে।
— শেষ পর্যন্ত চাকরী ছেড়ে দিলি? তোর মা এত করে বলেছিল শুনিস নি। আজ কেন মা তোর সুমতি হল?
নাদিয়া বেগম স্বামীর কাছ ঘেষে গিয়ে ফিসফিস করে বলেন,বুড়া হইতে চললেন আপনের কবে বুদ্ধি হইবো? কদিন পর বাচ্চা হইবো,বাচ্চা ফেলাইয়া চাকরি করতে যাইবো নাকি?
ড.রিয়াজ হো-হো করে ঘর কাপিয়ে হেসে উঠলেন।
গুলনার মনে মনে ভাবে অযত্নে লোহা ফেলে রাখতে চাই না।
জয়নাল দারোগার প্রোমোশন হয়ে এখন সিআই হয়েছেন। হোটেলে জানলার ধারে বসে নানাকথা মনে আসছে। বলার ব্যাপারটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। চুরির দায়ে এসেছিল থানায়। বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে। লোকটার প্রতি মায়া বশত রাশেদকে বলে কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। বদলি হয়ে এল নবাবগঞ্জে। অচেনা জায়গা কোথায় থাকবে ভেবে চিঠি লিখে দিলেন রিজানুর রহমানের কাছে। রিজানুর ছিলেন বড়ভাইয়ের মত।বড়ভাই যে বেঁচে নেই খবরটা তখন জানতেন না। জানলে হয়তো চিঠি লিখতেন না। নুসরতের কাছে শুনেছেন,কিভাবে ড.রিয়াজের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হয়। এরেই বলে নসিব। কি সুন্দর স্মার্ট দেখতে হয়েছে এখন। শিক্ষা অনেকটা উর্দির মত। যেই গায়ে দিবা অমনি আলাদা ব্যক্তিত্ব। সইদুল এখন সাব-ইন্সপেকটার,মন লাগায়ে কাজ করতে পারলে ইন্সপেক্টার হতে কতক্ষন। রাশেদ আছে নুসরতের পরিচিত জেনিফার আলম যদি একটু সাপোর্ট দেয় তাহলে কথাই নাই। বিবাহটা ভালয় ভালয় মিটলে হয়। অধ্যাপকরেও নেওতা দেওয়া যাইতে পারে। কারে দিয়া কি হয় কে বলতে পারে।
একটু সকাল সকাল এসে পড়েছে বিমান বন্দরে। মুস্তাক নিয়ে এসেছে নাদিয়া বেগম মণ্টি দেব আর মামুনকে। মামুন আজ ড্রাইভ করে নাই। নাদিয়া বেগমের দুই পাশে বসেছিল মেয়ে আর ছেলে,দেব বসেছিল ড্রাইভারের পাশে। পরে আসছেন ড.রিয়াজ, সঙ্গে করিমেরও আসার কথা। দেরী আছে চেকিংযের সময়।
মামুন নেমে জিজ্ঞেস করে, দুলাভাই কফি খাইবেন নাকি?
— কারে কি জিগাস? তর দুলাভাই খাওনের ব্যাপারে কখনো আপত্তি করচে? গুলনার হেসে বলেন।
নাদিয়া বেগম মেয়েকে ধমক দেন, আমার জামাইরে তুই খাওনের খোটা দিবি না, বইলা রাখলাম।
— কি আপনে কিছু কন না? দেবকে জিজ্ঞেস করেন গুলনার।
— একসাথে সবাই কথা বলতে নেই। দেব বলে।
— বলা তোর স্বামী না? স্বামীর লগে কেউ এইভাবে কথা হয়?
গুলনার কিছু বলেন না। মনে মনে ভাবে দেব যে তার স্বামী না সন্তান সেইটাই এখনো ঠিক করতে পারলেন না। কেউ না থাকলে গাড়ি থেকে নেমে ওকে একটা চুমু দিতেন। পায়চারি করছে দেব। মামুন কফি আনতে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে গুলনার দেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনে আমার উপর রাগ করছেন?
— কেমন করে রাগ করে সেইটা শিখতে পারলাম না। আমার মায়ে বলতো বলা ক্রোধে বোধ নষ্ট হয়।
গুলনার ভাবেন কেমন সুন্দর করে কথা বলে দেব। মাটি দিয়ে নিজের মত করে গড়ে নিয়েছে। ছিঃ এমন মানুষকে কেউ সন্দেহ করে? নিজের উপর রাগ হয়। নিজের গড়া পুতুলকে মাঝে মাঝে নিজেই চিনতে পারেন না। চারদিকে লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটু দূরে একটা জটলা ক্রমশ ভারী হতে থাকে। কোন ভিআইপি হবে হয়তো। দেব দূরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন গুলনার। মামুন আসছে পিছনে ট্রে হাতে একজন বয়। গাড়িতে মাকে দিয়ে ছেলেটি তাদের কাছে আসে। ট্রের উপর দু-কাপ কফি আর দুটো ফিসফ্রাই। গুলনার কফি নিয়ে বলেন,ফ্রাই দুইটা আপনে নেন।
— না আমি একটা খাবো।
— তার মানে রাগ করছেন? কাদো কাদো ভাবে জিজ্ঞেস করেন গুলনার।স্বামীর লগে একটু মস্করা করতে পারুম না।
মণ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেয়ে যায়, দেব বলে,নিতে পারি যদি তুমি হাতে করে খাইয়ে দাও।
— ইস আমার বইয়া গ্যাছে। গুলনার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিস ফ্রাই তুলে দেবের মুখের কাছে তুলতে দেব এক কামড়ে প্রায় অর্ধেকটা কেটে নিল। আবার মুখ এগিয়ে আনতে গুলনার টুপ করে বাকিটা নিজের মুখে পুরে দিলেন।
একটি মেয়ে এসে বলদেবকে বলল,স্যর আপনাকে ডাকছেন। বলেই দৌড়ে ভীড়ের দিকে চলে গেল। দেব আর গুলনার চোখাচুখি করে।চলুন দেখি কে ডাকছে। দেব এগিয়ে যেতে লাগল,মণ্টি তার পিছু ছাড়েনা।ভীড়ের মাঝে মনে হচ্ছে ড মৌসম। ভীড়ের কাছাকাছি হতে ড.মৌসম বলেন,হাই সোম।
বলদেব হাই বলে হাসল।মনে হচ্ছে ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎ ডাকলো কেন?
তারপর ভীড় ছেড়ে কাছে এসে বলেন,তুমি এখানে? উনি তোমার ওয়াইফ? আলাপ করিয়ে দেবে না?
অগত্যা দেব মণ্টির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
— তোমার বউয়ের সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগলো। রিয়ালি শি ইজ এঞ্জেল। নিজে নিজে খিল খিল করে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে বললেন,তোমাদের ভার্সিটি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোমার কথা আমি ড.আইয়ুবকে বলেছি। তুমি ইচ্ছে করলে ওর আণ্ডারে থিসিস করতে পারো।
কিছুক্ষন তাকিয়ে গুলনারকে দেখলেন। তারপর গুলনারের কাছে গিয়ে বললেন,ম্যাডাম এক মিনিট একটা প্রাইভেট কথা আছে।
ওরা দুজনে একটু দূরে সরে গেল।ভীড়ের একটি মেয়ে এগিয়ে এসে বলদেবকে জিজ্ঞেস করে,স্যার উনি গুলনার বেগম?
বলদেব বুঝতে পারে টিভিতে দেখেছে হয়তো বলল,হ্যা তুমি চেনো?
--চিনি না ওনার গান শুনেছি।ভীড়কে লক্ষ্য করে বলল,কিরে বললাম না।
গুলনারের হাত ধরে মৃদু স্বরে বললেন,চমৎকার মানিয়েছে। আমি বিনি সুতোর বাঁধন দেখতে পাইনি তাই দড়ি দিয়ে বাঁধতে গেছিলাম। অ্যাম সরি। তারপর দেবের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বললেন,বাই সোম। মৌসম আবার ভীড়ে মিশে গেলেন।
গুলনার ভদ্রমহিলার নাম শুনেছিলেন আজ প্রথম দেখলেন। দেবের থেকে কম করে বছর পনেরোর বড় হবেন। দেব এর পাল্লায় পড়েছিল? এতো ওকে চিবিয়ে ছিবড়ে করে দিত। দড়ি দিয়ে বাধতে গেছিল আবার আইলে এমন বাড়ি দিমু জ্বালা জুড়াইয়া যাইবো। দেবের হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে গুলনার বলেন,হা করে দেখেন কি? চলেন,আব্বু আইসা পড়ছে।এই রাক্ষুসীর খপ্পরে পড়ছিলেন?
--ভাল করে না জেনে কারো সম্পর্কে মন্তব্য করতে নাই।
--আর একটা কথা বলবেন না।দড়ি দিয়া বাধতে গেছিলাম,মুখ ফুইটা কইতে লজ্জা হয়না।দেবের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে।
দূরে দেখা গেল আরেকটা গাড়ি এসেছে। ওরা তাড়াতাড়ি পা চালালো। মামুন ভিতরে যাবার জন্য প্রস্তুত। গুলনার কাছে যেতে জড়িয়ে ধরে মামুন ধরা গলায় বলল,অপা আসি? তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমি মামা হইলে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিবা।
ভাইকে জড়িয়ে ধরে গুলনার কেদে ফেলে,খুব ফাজিল হইছস?
— অপা ছাড় কি পাগলামি করো? মামুনের চোখ ঝাপসা।
দেব এগিয়ে গিয়ে বলে,শোন মামুন একলা যাচ্ছো একলা ফিরবে,মামী নিয়ে আসবে না। লাজুক হেসে দেবের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে দেব বাধা দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,সময় পেলে আম্মুকে ফোন কোরো। মামুন মায়েরে প্রণাম করে সংরক্ষিত অঞ্চলে ঢুকে গেল।
ফেরার পথে গাড়িতে কেবল গুলনার আর দেব। অপর গাড়িতে ড.রিয়াজ নাদিয়া বেগম আর করিম।নাম শুনেছে অনেকবার আজ স্বচক্ষে দেখল।বেহায়া বড় মুখ করে বলে কিনা দড়ি দিয়া বাধতে গেছিলাম। রহম দিল আল্লা নাইলে দেবরে খাইয়া ফেলাইত।পাশে বসা দেবকে দেখে কেমন নির্বিকার।সামনে মুস্তাক তাই কিছু বলতে পারেনা।
--সারাক্ষন এত কি ভাবেন বলেন তো?
--ভাবছি এতক্ষনে মামুন মাটি ছেড়ে আকাশে।
--ঐ মৌসম নাকি সেওতো আকাশে।
বলদেব মুখ ঘুরিয়ে মণ্টির দিকে তাকিয়ে হাসল।
--হাসেন কেন?
--তোমার অনেক ফ্যান।এখানেও তোমাকে অনেকে চেনে।
গুলনার ভ্রু কুচকে তাকায়।বলদেব বলল,ঐ মেয়েগুলো তোমাকে নিয়ে আলোচনা করছিল।
--আমাকে ডেকে নিয়ে কি বলল অধ্যাপিকা জানতে ইচ্ছা হয়না?
--প্রাইভেট কথা কেন জানতে চাইব?
কিছুটা যাবার পর গুলনার জিজ্ঞেস করেন, মুস্তাক কফি খেয়েছো।
— জ্বি আমি ভাজা খেয়েছি,কফি খাইতে তিতা লাগে,আমি চা খাই।
— তুমি গাড়ি দাড় করাও।
মুস্তাক ঘাবড়ে গিয়ে গাড়ি থামায়। গুলনার বলেন,নামো কোথাও গিয়া চা খাইয়া আসো। যাও।
— পরে খামুনে– ।
— না অখনই যাইবা। বাধ্য হয়ে মুস্তাককে যেতে হয়। জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখেন গুলনার,মুস্তাক হাটতে হাটতে চায়ের দোকান খুজতে অনেক দূর চলে যাচ্ছে। মণ্টি ইচ্ছে করেই মুস্তাককে চা খেতে পাঠিয়েছেন বলদেব বুঝতে পারেনি।
মণ্টির অদ্ভুত ব্যবহারে দেব হতচকিত। মুস্তাক চলে যেতেই গুলনার দেবকে বলেন, প্রাইভেট কথা আপনার বিবির সাথে আপনার জানতে ইচ্ছা হয়না?
--তুমি তো বলেই দিয়েছো দড়ি দিয়া বাধতে চায়।
গুলনার হেসে,‘ওরে আমার বলদারে’ বলে দেবের মাথা নিজের দিকে টেনে এনে ঠোট জোড়া মুখে পুরে নিল যেন শেষ বিন্দু শুষে নেবে।
। । সমাপ্ত । ।