14-07-2020, 09:30 AM
||চৌদ্দ||
বিজলী তাকিয়ে দেখল দুলাল বসু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন, আর এবার আড়চোখে ওর বুকটাকে নজর করছেন।
কবীর এল, ঠিক চল্লিশ মিনিট পরে। ওর সাথে অরুন ঝা। থানায় বসে বিজলী অস্থির হচ্ছিল এতক্ষণ বসে। অফিসারের বকবকানি থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাওয়া গেছে, উনি এখন অন্য কিসব কাজ করছেন বসে বসে। অরুন ঝা ভেতরে ঢ়ুকেই বিজলীকে বলল, "হাই বিজলী, কেমন আছ?"
ডিউটি অফিসার মুখটা তুলে তাকালেন ওদের দুজনের দিকে। কবীর স্মার্টলি হাতটা বাড়িয়ে দিল ওনার দিকে।
- "হ্যালো, আমি কবীর ঘোষ, কি হয়েছে?"
-- "আমরা ওনার এগেন্স্টে একটা কেস ফাইল করতে যাচ্ছি একটু পরে, আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"
কবীর তাকালো একবার বিজলীর দিকে, বলল, "কেন কি হয়েছে? কিছু সমস্যা?"
ডিউটি অফিসার বললেন, "উনি রঞ্জিত বলে একটি ছেলের সাথে ছিলেন একটু আগে। ছেলেটি বিষ খেয়ে সুইসাইড করেছে, আমরা তাই কেস ফাইল রেডী করছি, মামলা কোর্টে উঠবে, ততদিন....."
কবীর একটু চেঁচিয়ে বলল, "কি বলছেন আপনি? বিজলী তো আমার সাথেই ছিল। ছেলেটাই তো ওকে জোড় করে নিয়ে গেল। আমরা তখন পিটার ক্যাটে বসেছিলাম। রঞ্জিত এসে ঢুকলো, তারপর বিজলীকে বলল, তোমার সাথে খুব দরকার আছে, চলো আমার সঙ্গে। প্রায় জোড় করেই নিয়ে গেল, আমিও বাঁধা দিতে পারলাম না। আর এখন এসে শুনছি এসব কি হয়েছে?"
ডিউটি অফিসার বিজলীর দিতে তাকিয়ে বললেন, "সেটাই তো বলছি, উনি যেহেতু রঞ্জিতের সাথে ছিলেন, পুরোপুরি তদন্ত না করে আমরা ওনাকে এমনি এমনি তো ছেড়ে দিতে পারি না? তাছাড়া ছেলেটির বাড়ীর লোকেরাও এখানে নেই। ওনারা যদি এসে আমাদের ওপর চাপ দেন?"
কবীর বলল, "বাট ইট ইজ এ সুইসাইড কেস। আপনারা এর জন্য বিজলীকে কেন হ্যারাস করছেন?"
ডিউটি অফিসার এবার সবার দিকেই তাকালেন একবার করে। কবীরকে বললেন, "ছেলেটি একটা নোট লিখে গেছে বিষ খাওয়ার আগে, তাতে ওনার নাম আছে।"
- "ওয়াট?"
কবীর চমকে তাকালো অফিসারের দিকে। - "কি বলছেন স্যার? পাগল নাকি? ও ছেলেটার মাথা খারাপ আছে। ওই বিজলীকে অকারণে জড়িয়েছে, এখানে বিজলীর কোন দোষই নেই। আমিতো চিনি ওকে। সি ইজ এ গুড গার্ল।"
ডিউটি অফিসার এবার তাকালেন, অরুন ঝার দিকে। -- "আপনার পরিচয়?"
অরুন হাসতে হাসতে বলল, "আমি অরুন ঝা। আমিও চিনি ওকে। বিজলী ভাল মেয়ে।"
-- "আপনারা দুজনেই কি বিজনেস ম্যান?"
কবীর, অরুন দুজনেই বলল, "হ্যাঁ স্যার, আমরা দুজনেই বিজনেস করি।"
ঘুসখোর পুলিশ অফিসারের মতন মাথায় পোকাগুলো কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কতক্ষণে দাওটা মারবে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অফিসার বললেন, "তা খরচাপাতি তো কিছু করতে হবে। এমনি এমনি তো আর ছেড়ে দেওয়া যায় না?"
কবীর অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, "কত?"
ডিউটি অফিসার স্মার্টলি বললেন, "চল্লিশ হাজার টাকা মতন, এই সব খরচাটরচা ধরে।"
কবীর, অরুন দুজনেই একবার পরষ্পরের মুখোমুখি তাকালো। টাকার অঙ্কটা অনেক, এই মূহূর্তে ওদের দুজনের পকেটেই এত টাকা নেই।
বিজলী দেখলো, অরুন ঝা কাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছে, হয়তো টাকার জন্য। দেবদূতের মতই ওরা দুজন এসে হাজির হয়েছে যাদবপুর থানাতে। এই মূহূর্তে বিজলীর জন্য পকেট থেকে এত টাকা বার করে দেখাবার ঔদ্ধত্ব, উদারতা ওরা ছাড়া আর কেউই দেখাতে পারবে না।
কবীর তখনও অফিসারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, "স্যার একটু কম হলে ভাল হত না? এত টাকা?"
ডিউটি অফিসার ভ্রুক্ষেপ হীন। টাকার অঙ্ক কমিয়ে অত সহজে বোকা হওয়ার পাত্র উনি নন।
অরুন ঝা কাকে ফোন করে অনেক্ষণ ধরে কথা বলতে লাগল তার সাথে। পাক্কা দশ মিনিট তার সাথে কথা বলে, ডিউটি অফিসার আর কবীরকে, দুজনকেই বলল, "কাজ হয়েছে, দুলালদা টাকা নিয়ে এক্ষুনি আসছে।"
বিজলীর মনে পড়ছিল, এই সেই দুলালদা, যার কথা অরুন ঝা ওকে বলেছিল। সিনেমার নায়িকা হওয়ার সুযোগ করিয়ে দেবে, তার জন্য সারাজীবন, বিজলীকে কেপ্ট বানিয়ে রেখে দিতে চায়। তিন তিনটে দিওয়ানা আজ ওরজন্য থানায় এসে জড়ো হচ্ছে, এত টাকার বিনিময়ে শরীরটাকে তারমানে আবার উজাড় করে দিতে হবে এই দুলালদার জন্য। বিজলী একটু চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়েই তাকালো কবীরের দিকে। - "কবীর আমি?"
কবীর বলল, "ডোন্ট ওয়ারী বিজলী। আমরা আছি না তোমার সঙ্গে। দুলালদা টাকা নিয়ে আসছে, সব সমস্যা মিটে যাবে। কিছু চিন্তা কোরো না তুমি।"
ঠিক তার একঘন্টা পরেই দুলাল বসু এসে ঢুকলেন। স্বনামধন্য প্রযোজক, পরিচালক। থানায় ঢুকে বিজলীর শরীরটাকে দেখলেন খুটিয়ে খুটিয়ে। কড়কড়ে চল্লিশ হাজার টাকা, এটিএম থেকে তুলে নিয়ে এসেছেন। ডিউটি অফিসারের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, "আমি দুলাল বসু। বাংলা ছবি প্রোডিউস ও ডাইরেক্ট করি। এই মেয়েটাকে ছেড়ে দিন, আমরা ওকে চিনি।"
অবাক বিজলী। যে লোকটা ওকে কোনদিন দেখেনি, সে চিনে গেল এক নিমেষে। নারী লোভি পুরুষমানুষের বুদ্ধিটা যেন এমনই প্রখর হয়।
ডিউটি অফিসার টাকাটা গুনে গুনে এমন ভাবে ড্রয়ারে ঢোকালেন, যেন সারা মাসের খোরাকটা ওনার একদিনেই এসে গেছে, দুলাল বসুর সৌজন্যে।
রাত দুপুরে চা পানির ব্যবস্থা হল, চারজনকে বসিয়ে রেখে একটু খাতির যত্নও হল। মিনিট কুড়ি কথা বার্তা বলে তিনজনে বিজলীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল থানা থেকে। কবীর বলল, "আমরা সবাই এখন দুলালদার বাড়ীতে যাব, উনি গাড়ী নিয়ে এসেছেন, চলো এবার ওঠা যাক গাড়ীর মধ্যে।"
দুলাল বসু যেন ছটফট করছেন, একেবারে বিজলীর পাশে বসবেন বলে। গাড়ীতে পেছনের সীটে উঠল কবীর, বিজলী উঠল তার পাশে, তারপর উঠলেন দুলাল বসু। সামনে ড্রাইভারের পাশে অরুন ঝা। গাড়ী চলতে আরম্ভ করল। বিজলীকে মাঝখানে বসিয়ে দুলাল বসু আর কবীর ওর শরীরটাকে নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে তাড়িয়ে তাড়িয়ে।
-- "ছেলেটা কে ছিল? হঠাৎ সুইসাইড"
দুলাল বসুই কথাটা তুললেন প্রথমে।
বিজলী প্রথমে চুপ করে থেকে তারপর বলল, "রঞ্জিত। জানি না কেন সুইসাইড করেছে।"
-- "তুমি কি ওর সাথে ছিলে?"
এবার জবাব দিল কবীর, বলল, "হ্যাঁ দুলালদা। আমরা পার্কস্ট্রীটে পিটার ক্যাটে দুজন বসেছিলাম, অরুন এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, ওকে রিসিভ করতে গেছি, এসে দেখি, রঞ্জিত ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আমাকে আর আটকানোর সুযোগ দিল না।"
দুলাল বসু মুখটা নীচু করে এমন ভাবে বিজলীর দিকে তাকালেন, যেন কতকাল ধরে ওকে চেনেন।
-- "আর ইউ আপসেট? খুব খারাপ লাগছে? পুলিশের হাতে হেনস্থা হতে হল বলে।"
বিজলী বলল, "আমার জন্য আপনাদের অনেক হ্যাপা পোয়াতে হল।"
-- "কিসের হ্যাপা?"
- "এই এতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল আমার জন্য।"
একটা দরদী হাসি দিলেন দুলাল বসু। বললেন, "তাতে কি হয়েছে? ও আমি পুষিয়ে নেব।"
বিজলী একবার তাকালো কবীরের দিকে। দেখলো কবীরও দুলাল বসুর কথা শুনে হাসছে।
ও বললো - "মাঝখান থেকে আমারও দশহাজার টাকা বেরিয়ে গেল।"
-- "সেকী তুমিও টাকা দিয়েছ নাকি?"
দুজনেই বিজলীকে জিজ্ঞাসা করল।
বিজলী বলল, "দিই নি। ওটা ভ্যানিটি ব্যাগে ছিল, আমার ব্যাগ সার্চ করে পেয়েছে। আসবার সময় ব্যাগটা ফেরত দিল, কিন্তু টাকাটা আর ফেরত দিল না।"
অরুন ঝা বলল, "তুমি চাইলে না কেন?"
দুলাল বসু সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা দিয়ে বলল, "না না চায়নি, ভালই হয়েছে, নইলে আবার সমস্যা খাড়া করত। শুধু শুধু দশহাজার টাকার মায়া করে লাভ নেই। ওরকম টাকা পরে আরও আসবে। কি বলো বিজলী?"
বিজলী তাকিয়ে দেখল দুলাল বসু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন, আর এবার আড়চোখে ওর বুকটাকে নজর করছেন।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!
