13-07-2020, 05:56 PM
(This post was last modified: 06-04-2021, 05:06 PM by kumdev. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
।।৬৮।।
গুলনার নীচে নেমে এসে মুস্তাককে জিজ্ঞেস করেন,সাহেব এসেছিলেন? মুস্তাক কিছু বলতে পারে না। গুলনার আবার উপরে উঠে এলেন। কোথায় গেল লোকটা? সব সময় তক্কে তক্কে রাখা যায়? সঙ্গেই তো ছিল। ভাবখানা মা তার ছেলে হারিয়েছেন। ওর জন্য রহিমা বেগমকে দেখতে আসা আর বাবু উধাও? কোথায় যেতে পারে? একজন জুনিয়ার ডাক্তার দেখা হতে জিজ্ঞেস করেন,ম্যম আপনি কি স্যরকে খুজছেন?
স্যর মানে আব্বুর কথা বলছেন,গুলনার বলেন,না কাউকে খুজছি না।
আরে ঐদিকে মনে হচ্ছে নুসরত কার সঙ্গে কথা বলছে। একটু এগিয়ে বুঝতে পারলেন কাধ থেকে ঝুলছে কালো ঝোলা ব্যাগ। ছিঃ শেষ পর্যন্ত নুসরতের সঙ্গে? তার আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। নুসরত জানে দেব বিবাহিত, নিজেকে বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বলেছিল ‘আমরা বন্ধু’ এই কি বন্ধুত্বের নমুনা? কি এত গভীর আলোচনা
হচ্ছে যে তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে না? গুলনার একটা দেওয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে দেখা না গেলেও স্পষ্টশোনা যাচ্ছে প্রেমালাপ।
— তুমি জিজ্ঞেস করছো তোমাকে কেমন লাগতো? দেব বলে।
উঃ এতদুর? গুলনার ভাবেন।
– আমি যদি বলি তোমার প্রতি আমি ছিলাম নিস্পৃহ তাহলে হবে সত্যের অপলাপ। তোমার কথা শুনতে আমার ভাল লাগতো। অপেক্ষা করতাম তুমি কখন আমাকে ডেকে বলবে ‘ দেব এই ফাইলটা দিয়ে এসো…আমার জন্য টিফিন নিয়ে এসো। ‘ তোমার কাজ করতে আমার ভাল লাগতো।
সত্যবাদী যুধিষ্ঠির,আমি বিয়ে না করলে চিরকাল তোমাকে ফাইল বইতে হতো। গুলনার ভাবেন।
— আমারও ইচ্ছে করতো তোমার কথা শুনতে। নুসরত বলে।
— কিন্তু সে ইচ্ছে প্রসারিত হয়নি মানে আমার চাকরি শিক্ষাগত যোগ্যতা ইচ্ছেকে প্রসারিত হতে দেয়নি। একই কারণে আমিও ইচ্ছেকে অবদমিত করেছি। মিষ্টির দোকানে সাজানো মিষ্টি দেখে লালাক্ষরণ হলেও যখন বুঝতেপারি পকেটে পয়সা নেই আমরা ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিইনা।
— তুমি বলছো ঐ ঘটনা ঘটেছিল বলে মণ্টিদি তোমাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল?
বলদেব নিজের মনে হাসল,তারপর আবার শুরু করে,ঐ ঘটনার জন্য জেনিফার আলম অমন প্রস্তাব দিতে সাহসী হয়েছিলেন,আর জেনিফার যদি উদ্যোগী না হতো আমি স্বপ্নেও মণ্টিকে বিবাহের কথা ভাবতাম না। হয়তো অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতাম বা অবিবাহিত জীবন কেটে যেত। কিন্তু আমি মনে করিনা মণ্টি বাধ্য হয়ে বিবাহ করেছে। ওর অসম্ভব মনের জোর তাছাড়া পিছনে ছিল সামাজিক আর্থিক সাপোর্ট।
গুলনার সজাগ তার প্রসঙ্গে কি বলে দেব?
— নুসরত তুমি কিছু মনে কোরনা একটা কথা বলি। তুমি চেয়েছিলে একটি ফিনিশ পুতুল রঙ চং করা চোখ মুখ আঁকা সুন্দর একটি পুতুল কিন্তু মণ্টির অসম্ভব আত্ম প্রত্যয়ের কথা তোমায় বলেছি। নিজের বউ বলে বলছি না ওকে যতটা জেনেছি,ও একতাল মাটি নিয়ে নিজের মত করে নিজ হাতে গড়ে নিয়েছে পুতুল। মণ্টিকে বাদ দিয়ে আমার অস্তিত্ব কল্পনাও করতে পারিনা। ও আমার অক্সিজেন এক মুহূর্ত ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।
— মণ্টীদিকে না পেলে তুমি আত্মহত্যা করতে?
— তোমার কথার শ্লেষ আমি গায়ে মাখছিনা।
গুলনারের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এতো স্তুতি নয়,অকপট স্বীকারোক্তি।
— মানুষ মরণ শীল। ইচ্ছে অনিচ্ছে নিরপেক্ষ,প্রতিদিন আমরা তিল তিল করে এগিয়ে চলেছি অসহায় সেই মৃত্যুর দিকে। কিন্তু ঝড়ের হাত থেকে প্রদীপ শিখার মত চেষ্টা করা উচিত যাতে নিভে না যায়। প্রদীপ শিখা কি জানো? আমাদের মনুষ্যত্ব।শারীরি মৃত্যু না হলেও মনুষ্যত্বের মৃত্যু হতো। একবার পা পিছলে যেতে যেতে বেঁচে গেছি কে আমাকে রক্ষা করেছিল জানো?
— কে মণ্টি?
— না ডাক্তার রিয়াজ আমার শ্বশুর। মণ্টিও তাকে চিনতে পারেনি। তোমরা ড.রিয়াজকে একজন বড় চিকিৎসক হিসেবে জানো আমার কাছে আব্বু একজন বড় মানুষ।
আর আড়ালে থাকা সম্ভব হয় না,চোখে জল মুছে গুলনার যেন হঠাৎ ওদের আবিষ্কার করেন,একী আপনি এখানে? ওদিকে আপনার আম্মু আপনার জন্য হেদিয়ে মরছেন।
বলদেব ভ্রু কুচকে এগিয়ে এসে বলে, একী তোমার চোখে কি হল,এত লাল কেন?
— থাক আর ঢং করতে হবে না। ভেবেছেন এইসব বলে পার পাবেন? আর কবে বুদ্ধি হবে আপনার? সারারাত আপনার জন্য নার্সিং হোম খোলা থাকবে?
আচমকা মণ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলদেব বলল,একে বলতো?
নুসরত লজ্জা পায় বলে,কে আবার তোমার বিবি।
--আমার ফ্রেণ্ড ফিলজপফার আবার গাইড।
--কি হচ্ছে কি ছাড়ুন লজ্জা সরম বলে কিছু থাকল না।গুলনার নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন।
দেবকে নিয়ে রহিমা বেগমের কেবিনে নিয়ে আসেন গুলনার।নুসরত অন্যত্র চলে গেল।
দেব ঢুকতে মুমুতাজ বলে,ঐতো বলা মিঞা আসছে।
রহিমা বেগম তাকিয়ে হাসলেন। এতক্ষন কইছিলা বাজান?
— বাইরে,ভিতরে এত ভীড়– ।
— জয়নাল তুমারে চিনতে পারে নাই অথচ ঐ তুমারে পাঠাইছিল। নুসরতরে তো তুমি চিনতা– ।
— চিনতাম,জানতাম না উনি স্যরের মেয়ে।
— আমার সায়েদের লগে কেমুন লাগবো?
সায়েদ বাঁধা দিল,আম্মু ডাক্তার তোমারে কথা কইতে নিষেধ করল তুমি মানবা না?
— এতদিন চুপ কইরা ছিলাম বইলাই সেনা কাণ্ডটা ঘটলো।
সায়েদ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল,করো তুমি বক বক।
মুমতাজ মিটমিট করে হাসছিল। বলদেব জিজ্ঞেস করে,কি ভাবীজান আম্মু কি কয় আমারে তো বলেন নাই?
— তুমি তো তবসুমরে দেখছো। ভারী দেমাগ ছিল, ছ্যাকা দিয়া পলাইছে।
বলদেব চুপ করে থাকে,আবার সেই প্রেম। অরূপকে ছেড়ে রূপের প্রতি মোহ? নুসরত কিছু বলেনি তাকে,সে কি জানে না?
এ্যাণ্টিবাইওটিক দিয়ে এখন ভাল আছেন রহিমা বেগম। দিন চারেক পর ছেড়ে দেওয়া হবে। আব্বু বলেছেন ইসিজি রিপোর্ট ভুল ছিল। কাল আসা সম্ভব না,মামুনকে এগিয়ে দিতে বিমান বন্দরে যেতে হবে। মণ্টির খুব প্রিয় মামুন। সেও অপাকে খুব ভালবাসে।
গাড়িতে বসে বলদেব ভাবে যাক ভালয় ভালয় সব মিটলো।পুরান দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।আম্মু বলেছিল বলারে পেটে ধরেনি কিন্তু বুকে জায়গা দিয়েছে।বিধাতা কোন ধাতুতে মেয়েদের গড়েছে ভেবে দিশাহারা বোধ করে।
গুলনার জিজ্ঞেস করেন কি ভাবতেছেন?
--কিছু না। দেব হেসে বলল।
--আমারে কওয়া যায়না।
--জানো মণ্টি জাত ধর্ম উচ্চ নিম্ন বিত্ত নির্বিশেষে প্রত্যেক মেয়েদের মধ্যে একটা কুঠুরি থাকে,যেটা ছেলেদের থাকে না।
--সেটা আবার কি?
--সেখানে চাপা থাকে অন্য একটা সত্ত্বা যাকে বলা যায় মাতৃসত্ত্বা।না হলে জানা নাই চেনা নাই রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই আগে কখনো দেখেনি একটা চিঠি নিয়ে হাজির হয়েছিলাম।শুধু মা বলে ডেকেছি।সেদিন থেকে আম্মু আমাকে নিজের ছেলেদের থেকে আলাদাভাবে দেখেনি।
গুলনার অবাক হয়ে দেবকে দেখে।মেয়েদের মধ্যে এই সত্ত্বা যাদের চোখে পড়েনা তারা বিধাতার করুণার পাত্র। দেব কথা শেষ করে মাথাটা মণ্টির কোলে এলিয়ে দিল।গুলনার সামনে মুস্তাকের দিকে তাকিয়ে মাথাটা ঠেলে তুলে দিয়ে নীচু গলায় বললেন,কি হচ্ছে কি উঠেন আমি আপনার বিবি,আম্মু না।
গুলনার অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসেন।
এহসান মঞ্জিলে যখন গাড়ী থামল তখন সন্ধ্যে নেমেছে।
খাবার টেবিলে গল্প হল অনেক রাত অবধি। আম্মু মাঝে মাঝে কেদে ফেলছিলেন। ড.রিয়াজ চুপচাপ একেবারে নির্বিকার।
— ভাগ্যিস বিয়ার আগে আমি বিদেশ গেছিলাম। বিবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন ড.রিয়াজ।
— আমি আপনের কাছে কিছু শুনতে চাইনি। নাদিয়া বেগম বিরক্তির সঙ্গে বলেন।
মণ্টি আর মামুন চোখাচুখি করে হাসি বিনিময় করে। করিম কি বুঝলো কে জানে ফিক করে হেসে ফেলে। নাদিয়া বেগম ধমক দেয়,বলদের মত হাসিস ক্যান রে? দূর হ আমার চোখের সামনে থিকা।
করিমএ বেরিয়ে গেল। গুলনার দেবকে দেখেন,বলদ শুনে তার কোন ভাবান্তর হয় কিনা? কেননা মাঝে মধ্যে তিনিও দেবকে বলেন,বলদ। নাদিয়া বেগম পর মুহুর্ত্তে করিমকে ডাকেন, অ্যাই করিম কই গেলি?
— তুমি তারে বাইরে যাইতে কইচো। ড.রিয়াজ বলেন।
করিম ঢুকতে বলেন,চোখে দেখিস না,বলারে ভাত দে।
— আম্মু অরে আর ভাত দিবেন না। গুলনার বলেন।
ড রিয়াজ বললেন,মণ্টি মা তুমি আম্মুরে নিয়া সকাল সকাল যাইও।আ্মারে চেম্বার হইয়া যাইতে হবে।
আব্বুর মুখে মা-ডাক খচ করে মনে বাজে।আগেও অনেকবার শুনেছেন কিন্তু দেবের মুখে কথাগুলো শোনার পর বিষয়টা খেয়াল হল।নারীর মধ্যে মাতৃসত্ত্বা।আড়চোখে দেবকে দেখেন নিশ্চিন্তে খেয়ে চলেছে।আশপাশে কে আছে না আছে সেদিকে হুশ নেই।