09-07-2020, 01:13 PM
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১৫)
বহুদিন পর সেদিন নবীন, দেবু আমি আর পচা একসাথে আড্ডা মারলাম। পচা চাকরি করে ফুলে গেছে, গুজরাটে গিয়ে এক গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে তার নাম সঞ্জনা। নবীন বেশ ভারিক্কি হয়ে গেছে, তবে আগে মদ খেত না এখন মাঝে মাঝেই মদ খায়। দেবু চাকরি পাওয়ার পরে বেশ খোশমেজাজে ছিলো। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে বসে চারজনে হুইস্কি গিললাম আর পুরানো দিনের কথা মনে করলাম। মন বড় বলছিলো যে যদি ছন্দা অনু আর শ্যামলী পাশে থাকত তাহলে আমাদের সেই পুরানো দিন এক বিকেলের জন্য ফিরে আসত। তিন মেয়ের মধ্যে শুধু অনু হয়ত আসতে পারতো, কারন ছন্দার সাথে আমার অনেকদিন কথাবার্তা নেই। এর মাঝে ওর অফিসে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার সাথে কথা বলেনি ঠিক করে, দূর থেকে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সি করে বেরিয়ে গেল, আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এই সব ঘটনা আর ওদের বললাম না। দেবু আমাকে বললো যে এবারে বিয়ে করতে চায়, নিজের বাড়িতে বলেছে এই ব্যাপারে, ওর মা এক কথায় রাজি, বি টেক করা সুন্দরী বৌমা কে হাত ছাড়া করতে চায়, ওর বাবা হ্যাঁ না কিছু বলেনি তবে রাজি হয়ে যেতে পারেন। ওদিকে অনু তখন কিছু বাড়িতে বলেনি, আমি যত বার বলি এই বারে বাড়িতে বলে দে, ওর কালোঘাম ছুটে যায় আর আমাকে ঠেলে দেয়। আমি নিজেও বাড়িতে ছন্দার ব্যাপারে কিছুই বলিনি, আগে লন্ডন থেকে ফিরি তারপরে বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম। নবীন কে জিজ্ঞেস করাতেই কথা এড়িয়ে গেল, ছন্দা ওর মনের কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো তাই আর ওকে বেশি ঘাঁটালাম না।
সন্ধে নাগাদ বাড়িতে পা রাখতেই ভিরমি খেলাম। আমাদের বৈঠকখানা লোকে লোকারণ্য, না না, বাইরের লোকজন নয় সবাই বাড়ির। কিন্তু দুই বাড়ির বাবা কাকা জ্যাঠা, মা জেঠিমা কাকিমা, ওদিকে দেখি বড়দি আর বড় জামাইবাবু, অনুর বড় পিসি পিসেমশায়, ওর মামা রা, এদিকে বড় মামা মামি আমার মামা মামি সব মিলে প্রায় জনা ত্রিশ জন। বৈঠকখানা ভরে সবাই বসে হাসাহাসি গল্পে মেতে। মামা পিসিদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম না হটাত করে এই বাড়িতে আবার কোন উতসব লাগতে চললো।
বড় জামাইবাবু মানে সমীরণদা আমাকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠলো, "ঐ যে পুটু এসে গেছে।"
আমি ত্রস্ত পায়ে বৈঠক খানায় ঢুকে সবার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে রইলাম। সমীরণদা আমার পাশে এসে বললো, "এই যে শালা তোমার বিয়ের কথা হচ্ছিল এখানে।"
ওই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, বলা নেই কওয়া নেই হটাত করে কেউ ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেয় নাকি? আমি অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিদ্ধার্থ জ্যাঠা মানে অনুর বাবা, আমাকে বললেন, "আমার পুরানো বন্ধু, অধিরের নাম শুনেছিস ত? ওর মেয়ে, বৈশাখী, ইংলিশে বি এ পড়ছে। ওর কথা ভেবেছি তোর জন্য।"
আমি বার কয়েক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম, "আমার বিয়ে মানে এখুনি, কেন?"
বাবা বললেন, "তুই লন্ডন চলে যাবি, অইখান থেকে যদি বিলিতি মেম ধরে আনিস সেই ভয়ে আগে ভাগেই তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো।"
বাবার কথা শুনে সবাই হেসে দিল আর আমার চক্ষু চড়ক গাছ। গলা শুকিয়ে গেছে, কান মাথা ভোঁভোঁ করছে, চোখের সামনে হটাত করে সব কিছু ঘুরতে শুরু করে দিল।
আমার ছোট কাকা বললেন, "তোদের দুইজনের একসাথে বিয়ে। মানে অনু আর তোর, অধির বাবুর একমাত্র ছেলে, অনিন্দ্য ডিভিসিতে ইঞ্জিনিয়ার। আমরা ভাবলাম এই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে যখন যাবে তখন ওই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে এই বাড়িতে আসুক।"
আমি ছাদের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, ছাদ খানা অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে আর একটু হলে আমাকে পিষে মেরে ফেলবে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে বললাম, "অনু জানে এই ব্যাপারে?"
আমার মা হেসে বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ জানে, ওর অমত নেই। তোর ঘরে মানুর সাথে বসে আছে।"
ওই কথা শুনে আমি কি বলব ভেবে পেলাম না, অনু কি করে মেনে নেয় এই কথা? ওর আর দেবুর প্রেম কি সত্যি পুতুল খেলা ছিলো? না হতে পারে না। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায় কি বলা যায় কোথা থেকে কথা শুরু করা যায়। অইদিকে দরজা দিয়ে ভাই বোন গুলো সব উঁকিঝুঁকি মারছে। একটু পরে দেখলাম ভাই বোনের ভিড়ের পেছনে অনু আর ছোড়দি। কেঁদে কেঁদে অনুর চোখ জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গেছে, ছোড়দিকে ওকে জড়িয়ে ধরে আমাকে ইশারা করলো ওই বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে আসতে। আমি মাথা নিচু করে বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে এলাম।
আমি বের হতেই ছোড়দি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গেল আর অনু ভেঙ্গে পড়লো, "আমি দেবু কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না, আমাকে অন্য কারুর সাথে বিয়ে দিলে আমি বিষ খেয়ে মরবো।"
আমি কি করবো কিছু বুঝে পাচ্ছি না, ছোড়দি আমাকে বকা দিয়ে বললো, "তুই কেন তোর কথা আমাকে জানাস নি? একসাথে দুই দিক কি করে সামলাই বল। শ্বশুর মশায় আর বাবা কাকে নিমতন্ন করবে, কি কি খাওয়ানো হবে সেইসব নিয়ে ফর্দ বানাতে বসে গেছে, বড় কাকা তো খুশিতে পাগল, রাঙ্গা কাকা বলছে....."
আমি ওকে থামিয়ে বললাম, "থাম দিকি, কে কি আটঘাট বাঁধছে সেই শোনার সময় নেই আমার কাছে।"
ছোড়দি রেগে গিয়ে আমাকে বললো, "তোমরা দুইজনে লুকিয়ে প্রেম করবে আর ম্যাও সামলাতে আমাকে ঠেলে দিবি?"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি করব, আমি ভাবলাম বড়দা আর তোর সময়ে কোন অসুবিধে হয়নি তাই আমাদের সময়ে হবে না। তা বিশুদা কোথায়?"
ছোড়দি বললো, "আমি তোর বড়দাকে ফোন করে দিয়েছি, হস্পিটাল থেকে বেড়িয়ে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। ওই সব ঠিক করে দেবে বলেছে, তুই শুধু এই এক ঘণ্টা ওদের কিছু একটা বলে ক্ষান্ত রাখ।"
এমন সময়ে অনুর মা আর আমার মা ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। তাঁদের বের হতে দেখেই ছোট ভাই বোন গুলো দূরে সরে গেল। আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অনুর কান্নার কারন, আমি একবার ছোড়দির দিকে তাকালাম একবার অনুর দিকে তাকালাম তারপরে চোখ বন্ধ করে বোমা ফাটিয়ে দিলাম, "এই বিয়ে হতে পারে না।"
সেই কথা শুনে অনুর মা হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কি বলছিস তুই? কেন বিয়ে হতে পারে না? তুই আর অনু কি....."
ছোড়দি তেড়ে উঠলো অনুর মায়ের দিকে, "কি যে বল না তুমি, বলার আগে একবার ভাববে না কি বলছো?"
আমার মা আমাকে প্রশ্ন করলেন, "তাহলে অনু ওই ভাবে কাদছে কেন আর তুই ওই ভাবে দাঁড়িয়ে কেন?"
আমি দেখলাম এবারে কিছু না বললে নয়, খাঁড়া একদম গলার কাছে নেমে এসেছে। আমার হয়ে ছোড়দি বললো, "ভেতরে চল কথা আছে।"
অনুর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল আমি পেছন পেছন গেলাম। সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে নিজের প্রেমের বক্তব্য রাখা খুব বড় ব্যাপার। ছোড়দি খানিকক্ষণ চুপ থেকে সবার দিকে তাকিয়ে বললো, "এই বৈশাখীর সাথে পুটুর আর অনিন্দ্যর সাথে অনুর বিয়ে অসম্ভব।"
সিদ্ধার্থ জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলেন, "কেন কি অসুবিধে? অনু আর পুটু কি পরস্পরকে....."
ছোড়দি আবার তেড়ে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল, শ্বশুর মশাইয়ের সামনে শান্ত কণ্ঠে বললো, "না ওইসব কিছু না। অনুর একজন কে পছন্দ হয়েছে আর পুটু একজন কে ভালোবাসে।"
সবার চাহনি দেখে মনে হল ঘরে বোমা ফেটেছে আর তারপরেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। এত চুপ যে বেড়াল চলে গেলে তার পায়ের শব্দ শোনা যেতে পারে। আমি নিজের বুকের ধুকপুকানি শুনতে পেলাম, হাতুড়ির মতন বারেবারে বাড়ি মারছে ফুসফুসে। বড় কারুর দিকে তাকাবার একটুও সাহস নেই, সবাই যেন আমাদের দিকে ক্ষুধার্ত বাঘের মতন তাকিয়ে, পারলে এখানেই খেয়ে ফেলবে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে উঁচু গলায় কথা বলা অথবা প্রেম ভালোবাসার কথা ব্যাক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো, কি করে কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু একটা বিহিত করতেই হবে।
বাবা আমার দিকে বাঘের মতন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, "কি ব্যাপার এইসব?"
আমি চোখ বন্ধ করে দেখলাম যে হাসি কান্না মিশিয়ে আমার সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে, মনের কথা না বললে আমার ভালোবাসা চিরদিনের মতন চলে যাবে। আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে সাহস জুগিয়ে নিজের কথা না বলে আগে অনুর ব্যাপারে বললাম, "অনু একজন কে ভালোবাসে, আমাদের কলেজের বন্ধু।"
সিধু জেঠা গম্ভীর কণ্ঠে অনুকে জিজ্ঞেস করলো, "কি নাম কি করে কোথায় থাকে?"
অনু ধরা গলায় আমতা আমতা করে কিছু একটা বললো কিন্তু কেউ শুনতে পেল না। ওর হয়ে ছোড়দি বললো, "ছেলের নাম দেবশিস রায়, একসাথে এরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। দেবাশিস ধানবাদ থেকে এম টেক করেছে, বর্তমানে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে লেকচারার।"
কথা শুনে মনে হল সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন, বাবা আমাকে জিজ্ঞস করলেন, ২আর তোর কি ব্যাপার?"
আমি বার কতক ঢোঁক গিলে কোন রকমে বললাম, "আগে অনুর ব্যাপারে বলি তারপরে আমার কথায় আসছি। আগে বল কি বলতে চাও তোমরা? দেবাশিস ভালো বাড়ির ছেলে। তোমাদের পছন্দ করা ছেলের চেয়েও বেশি ভালো, অনু কোন ভুল পথে যায়নি।"
সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন হুঙ্কার পাড়লেন, "প্রেম করেছে আর ভুল পথে যায়নি? কি সব আবোল তাবোল কথাবার্তা।"
ওই হুঙ্কার শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল, অনু ডুকরে কেঁদে উঠলো, "আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।"
দুই জ্যাঠা মিলে আমাদের দিকে প্রায় তেড়ে আসে, কিন্তু ছোড়দি মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লো আর আমাদের বাঁচিয়ে দিল। ছোড়দি মাঝে দাঁড়াতেই আমার জেঠু বললেন, "তোর ব্যাপার আলাদা, বিশুকে ছোট বেলা থেকে চিনি আর এখানে? কাউকেই চিনি না কাউকেই জানি না, কি বৃত্তান্ত কি ব্যাপার।"
আমি বললাম, "ঠিক আছে, আমি দেবাশিস কে ডেকে নিচ্ছি পরিচয় হয়ে যাবে।"
সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন শুধু মাত্র একটা শব্দ করলেন, "হুম"
বাবা গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, "ওর ব্যাপার বুঝলাম আর তোর কি ব্যাপার সেটা শুনি?"
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আর তখন আমার জেঠিমা আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ধীর পায়ে জেঠিমার কাছে যেতেই আমার কান ধরে টেনে বললেন, "তোর কি মধুছন্দাকে পছন্দ?"
আমি ওই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম, আমতা আমতা করে বললাম, "হ্যাঁ মানে তুমি কি করে জানলে?"
জেঠিমা কান টেনে লম্বা করে বললেন, "এমনি এমনি চুল সাদা হয়নি রে আমার পুটু। আকাশের বিয়েতে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘোল পাকিয়েছিস তোরা।"
বাবা আমাকে প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে দিলেন, "কি নাম মেয়ের, কি বৃত্তান্ত, বাবা কি করেন একটু শুনি।"
দেখলাম এবারে না বলে কোন উপায় নেই, হাড়ি ভাংতেই হবে, "না মানে আমার কলেজের বান্ধবী, মধুছন্দা সমাদ্দার। বর্তমানে পার্ক স্ট্রিটে একটা বড় রঙের কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবা নেই, মা এস এস কে এম হস্পিটালে নার্স।"
জ্যাঠা আঁতকে উঠলেন, "সমাদ্দার? মানে পূর্ব বঙ্গের? না না এই হতে পারে না, সমাদ্দার জাতে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট। তুই কি না শেষ পর্যন্ত আমাদের কুলের নাম ডুবাবি? আমরা ', পরিবার সেটা জেনে বুঝে তুই এই করলি?"
বাবা কাকা সবাই এক কথায় নারাজ, "পূর্ব বঙ্গের মেয়ে বাড়িতে আনা চলবে না তার ওপরে আমাদের চেয়ে নিচু জাতের।"
সেকালে হোক কি একালে হোক, এই বৈষম্য এখন আছে, সেই একটা ব্যাপারে কোলকাতা কেন সারা পৃথিবী আজও একত্র।
আমি দেখলাম আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এই সময়ে বুকের পাটা চুপসিয়ে গেলে হবে না, "অতীতে তোমাদের কুল যে ', ছিলো তাঁর কি প্রমান?"
জ্যাঠা বাবা প্রায় তেড়ে ওঠেন আমার ওপরে, "কি বলছিস তুই, আমরা চট্টোপাধ্যায় ',। সেই সুতানটির সময় থেকে এইখানে বাস আমাদের।"
হঠাৎ কি যে হয়ে গেল আর আমি বলে ফেললাম, "ছোট বেলায় বায়লজি টিচার আমাদের পড়িয়েছিলো যে আমরা সবাই নাকি বাঁদর গোস্টি থেকে উদ্ভুত। সেটা ঠিক না ভুল?"
অনেকেই আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন কিন্তু জ্যাঠা মশায় , সিধু জ্যাঠা বাবা তেড়ে উঠলেন, "বড় বাড় বেড়ে গেছিস, বাপ ঠাকুরদার নাম ডুবিয়ে দিলি শেষ পর্যন্ত।”
মানা না মানা, কথা কাটাকাটি আরও বেশ কিছুক্ষণ চলল এই ভাবে, জ্যাঠা বাবা কিছুতেই মানতে রাজি নয় ছন্দার ব্যাপারে। মা কাকিমা জেঠিমা এর মাঝে তর্ক জুড়ে দিলেন, বৈঠকখানা মাছের বাজারের মতন হয়ে গেল। অনু কান্না থামিয়ে চুপচাপ ছোড়দির হাত ধরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমিও সমান তালে বচসা করলাম বুঝাতে চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ ধরে যে এই জাতপাত নিয়ে কি হবে, কে পূর্ব বঙ্গের কে পশ্চিম বঙ্গের, কি হয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম যে যখন তিনি অপারেশান থিয়েটারে অপারেশান করেন তখন কি অন্য জাতের মানুষের রক্ত নীল রঙের দেখতে পান? আমি অনড় যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে ওই মধুছন্দাকেই করব নচেত আর কাউকে নয়। কথাবার্তা শুনে মনে হল দেবুর আর অনুর ব্যাপারে বিশেষ অসুবিধে হবে না। আমি বারেবারে দরজার দিকে তাকাই এবারে যদি বিশুদা এসে কিছু করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত আমার জেঠিমা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমি একটা কথা বলি, আগে এই দেবাসিশ কে ডাকা যাক তারপরে পুটুর ব্যাপারে কথা বলছি।"
অনু এক দৌড়ে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। জেঠিমা ওকে সান্তনা দিয়ে বললো, "আচ্ছা বাবা আগে তোর ওই দেবাসিশ কে দেখি আমরা তারপরে বাছ বিচার করবো।"
সিধু জ্যাঠা আমাকে বললেন, "দেবাসিশকে ডাক।"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, "এখুনি?"
বাবা বললেন, "হ্যাঁ এখুনি। আর তারপরে তোর বিচার হবে।"
জেঠিমা বাবাকে বললেন, "গগন, মধুছন্দাকে আমার পছন্দ, মানুর বিয়েতে, আকাশের বিয়েতে তোমরা সবাই ওকে দেখেছ। বি টেক করা চাকরি করা বৌমা, এর পরে আর কারুর কিছু কি বলার আছে?"
জেঠিমার ওই কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ কিছুপরে আমার মা হেসে সিধু জ্যাঠাকে বললেন, "তাহলে অধির কে একটা ফোন করে দিন, ওদের আসতে বারন করে দিন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে, ওদের নিজেদের পছন্দ অপছন্দ আছে। বিয়ের তারিখ একটু দেখে শুনে করতে হবে তাহলে। এই বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে আর ওই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা, ঢাক ঢোল একটু বেশি না বাজলে কি করে হবে।"
আমাদের বাড়ির কোন বিয়েতে ঢাক ঢোল কম বাজে না, এর মধ্যে তিন তিনখানা বিয়ে হয়ে গেছে, বড়দির বিয়ে, ছোড়দির সাথে বিশুদার বিয়ে আর একবছর আগেই মেজদার বিয়ে। এতক্ষণ বুকের মাঝে বেঁধে থাকা স্বস্তির শ্বাস বেড়িয়ে এলো, শেষ পর্যন্ত তাহলে সবার মতামত আছে, যাক তাহলে সব মিটমাট হয়ে গেল।
ঠিক সেই সময়ে বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে দুম করে বললে ফেললো, "না না অনুর বিয়ে হতেই পারে না। আমি সব বলছি আগে আমার কথা শোনা হোক....."
বড়দার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো আর ছোড়দি এক ধমক দিয়ে বললো, "তুমি থামো তো। শেষ পাতে শুক্তো দিয়ে আর মুখ মারতে হবে না। তোমার আশায় বসে থাকলে এদের এতোক্ষনে বিয়ে হয়ে যেত !
বহুদিন পর সেদিন নবীন, দেবু আমি আর পচা একসাথে আড্ডা মারলাম। পচা চাকরি করে ফুলে গেছে, গুজরাটে গিয়ে এক গুজরাটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে তার নাম সঞ্জনা। নবীন বেশ ভারিক্কি হয়ে গেছে, তবে আগে মদ খেত না এখন মাঝে মাঝেই মদ খায়। দেবু চাকরি পাওয়ার পরে বেশ খোশমেজাজে ছিলো। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে বসে চারজনে হুইস্কি গিললাম আর পুরানো দিনের কথা মনে করলাম। মন বড় বলছিলো যে যদি ছন্দা অনু আর শ্যামলী পাশে থাকত তাহলে আমাদের সেই পুরানো দিন এক বিকেলের জন্য ফিরে আসত। তিন মেয়ের মধ্যে শুধু অনু হয়ত আসতে পারতো, কারন ছন্দার সাথে আমার অনেকদিন কথাবার্তা নেই। এর মাঝে ওর অফিসে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার সাথে কথা বলেনি ঠিক করে, দূর থেকে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ট্যাক্সি করে বেরিয়ে গেল, আমি ওইখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। এই সব ঘটনা আর ওদের বললাম না। দেবু আমাকে বললো যে এবারে বিয়ে করতে চায়, নিজের বাড়িতে বলেছে এই ব্যাপারে, ওর মা এক কথায় রাজি, বি টেক করা সুন্দরী বৌমা কে হাত ছাড়া করতে চায়, ওর বাবা হ্যাঁ না কিছু বলেনি তবে রাজি হয়ে যেতে পারেন। ওদিকে অনু তখন কিছু বাড়িতে বলেনি, আমি যত বার বলি এই বারে বাড়িতে বলে দে, ওর কালোঘাম ছুটে যায় আর আমাকে ঠেলে দেয়। আমি নিজেও বাড়িতে ছন্দার ব্যাপারে কিছুই বলিনি, আগে লন্ডন থেকে ফিরি তারপরে বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম। নবীন কে জিজ্ঞেস করাতেই কথা এড়িয়ে গেল, ছন্দা ওর মনের কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলো তাই আর ওকে বেশি ঘাঁটালাম না।
সন্ধে নাগাদ বাড়িতে পা রাখতেই ভিরমি খেলাম। আমাদের বৈঠকখানা লোকে লোকারণ্য, না না, বাইরের লোকজন নয় সবাই বাড়ির। কিন্তু দুই বাড়ির বাবা কাকা জ্যাঠা, মা জেঠিমা কাকিমা, ওদিকে দেখি বড়দি আর বড় জামাইবাবু, অনুর বড় পিসি পিসেমশায়, ওর মামা রা, এদিকে বড় মামা মামি আমার মামা মামি সব মিলে প্রায় জনা ত্রিশ জন। বৈঠকখানা ভরে সবাই বসে হাসাহাসি গল্পে মেতে। মামা পিসিদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম না হটাত করে এই বাড়িতে আবার কোন উতসব লাগতে চললো।
বড় জামাইবাবু মানে সমীরণদা আমাকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠলো, "ঐ যে পুটু এসে গেছে।"
আমি ত্রস্ত পায়ে বৈঠক খানায় ঢুকে সবার দিকে জুলুজুলু চোখে তাকিয়ে রইলাম। সমীরণদা আমার পাশে এসে বললো, "এই যে শালা তোমার বিয়ের কথা হচ্ছিল এখানে।"
ওই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, বলা নেই কওয়া নেই হটাত করে কেউ ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেয় নাকি? আমি অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিদ্ধার্থ জ্যাঠা মানে অনুর বাবা, আমাকে বললেন, "আমার পুরানো বন্ধু, অধিরের নাম শুনেছিস ত? ওর মেয়ে, বৈশাখী, ইংলিশে বি এ পড়ছে। ওর কথা ভেবেছি তোর জন্য।"
আমি বার কয়েক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম, "আমার বিয়ে মানে এখুনি, কেন?"
বাবা বললেন, "তুই লন্ডন চলে যাবি, অইখান থেকে যদি বিলিতি মেম ধরে আনিস সেই ভয়ে আগে ভাগেই তোকে বিয়ে দিয়ে দেবো।"
বাবার কথা শুনে সবাই হেসে দিল আর আমার চক্ষু চড়ক গাছ। গলা শুকিয়ে গেছে, কান মাথা ভোঁভোঁ করছে, চোখের সামনে হটাত করে সব কিছু ঘুরতে শুরু করে দিল।
আমার ছোট কাকা বললেন, "তোদের দুইজনের একসাথে বিয়ে। মানে অনু আর তোর, অধির বাবুর একমাত্র ছেলে, অনিন্দ্য ডিভিসিতে ইঞ্জিনিয়ার। আমরা ভাবলাম এই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে যখন যাবে তখন ওই বাড়ি থেকে একটা মেয়ে এই বাড়িতে আসুক।"
আমি ছাদের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, ছাদ খানা অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে আর একটু হলে আমাকে পিষে মেরে ফেলবে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে বললাম, "অনু জানে এই ব্যাপারে?"
আমার মা হেসে বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ জানে, ওর অমত নেই। তোর ঘরে মানুর সাথে বসে আছে।"
ওই কথা শুনে আমি কি বলব ভেবে পেলাম না, অনু কি করে মেনে নেয় এই কথা? ওর আর দেবুর প্রেম কি সত্যি পুতুল খেলা ছিলো? না হতে পারে না। আমি চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায় কি বলা যায় কোথা থেকে কথা শুরু করা যায়। অইদিকে দরজা দিয়ে ভাই বোন গুলো সব উঁকিঝুঁকি মারছে। একটু পরে দেখলাম ভাই বোনের ভিড়ের পেছনে অনু আর ছোড়দি। কেঁদে কেঁদে অনুর চোখ জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গেছে, ছোড়দিকে ওকে জড়িয়ে ধরে আমাকে ইশারা করলো ওই বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে আসতে। আমি মাথা নিচু করে বৈঠকখানা থেকে বেড়িয়ে এলাম।
আমি বের হতেই ছোড়দি আমাকে একদিকে টেনে নিয়ে গেল আর অনু ভেঙ্গে পড়লো, "আমি দেবু কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না, আমাকে অন্য কারুর সাথে বিয়ে দিলে আমি বিষ খেয়ে মরবো।"
আমি কি করবো কিছু বুঝে পাচ্ছি না, ছোড়দি আমাকে বকা দিয়ে বললো, "তুই কেন তোর কথা আমাকে জানাস নি? একসাথে দুই দিক কি করে সামলাই বল। শ্বশুর মশায় আর বাবা কাকে নিমতন্ন করবে, কি কি খাওয়ানো হবে সেইসব নিয়ে ফর্দ বানাতে বসে গেছে, বড় কাকা তো খুশিতে পাগল, রাঙ্গা কাকা বলছে....."
আমি ওকে থামিয়ে বললাম, "থাম দিকি, কে কি আটঘাট বাঁধছে সেই শোনার সময় নেই আমার কাছে।"
ছোড়দি রেগে গিয়ে আমাকে বললো, "তোমরা দুইজনে লুকিয়ে প্রেম করবে আর ম্যাও সামলাতে আমাকে ঠেলে দিবি?"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি করব, আমি ভাবলাম বড়দা আর তোর সময়ে কোন অসুবিধে হয়নি তাই আমাদের সময়ে হবে না। তা বিশুদা কোথায়?"
ছোড়দি বললো, "আমি তোর বড়দাকে ফোন করে দিয়েছি, হস্পিটাল থেকে বেড়িয়ে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। ওই সব ঠিক করে দেবে বলেছে, তুই শুধু এই এক ঘণ্টা ওদের কিছু একটা বলে ক্ষান্ত রাখ।"
এমন সময়ে অনুর মা আর আমার মা ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। তাঁদের বের হতে দেখেই ছোট ভাই বোন গুলো দূরে সরে গেল। আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন অনুর কান্নার কারন, আমি একবার ছোড়দির দিকে তাকালাম একবার অনুর দিকে তাকালাম তারপরে চোখ বন্ধ করে বোমা ফাটিয়ে দিলাম, "এই বিয়ে হতে পারে না।"
সেই কথা শুনে অনুর মা হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কি বলছিস তুই? কেন বিয়ে হতে পারে না? তুই আর অনু কি....."
ছোড়দি তেড়ে উঠলো অনুর মায়ের দিকে, "কি যে বল না তুমি, বলার আগে একবার ভাববে না কি বলছো?"
আমার মা আমাকে প্রশ্ন করলেন, "তাহলে অনু ওই ভাবে কাদছে কেন আর তুই ওই ভাবে দাঁড়িয়ে কেন?"
আমি দেখলাম এবারে কিছু না বললে নয়, খাঁড়া একদম গলার কাছে নেমে এসেছে। আমার হয়ে ছোড়দি বললো, "ভেতরে চল কথা আছে।"
অনুর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল আমি পেছন পেছন গেলাম। সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে নিজের প্রেমের বক্তব্য রাখা খুব বড় ব্যাপার। ছোড়দি খানিকক্ষণ চুপ থেকে সবার দিকে তাকিয়ে বললো, "এই বৈশাখীর সাথে পুটুর আর অনিন্দ্যর সাথে অনুর বিয়ে অসম্ভব।"
সিদ্ধার্থ জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলেন, "কেন কি অসুবিধে? অনু আর পুটু কি পরস্পরকে....."
ছোড়দি আবার তেড়ে উঠলো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল, শ্বশুর মশাইয়ের সামনে শান্ত কণ্ঠে বললো, "না ওইসব কিছু না। অনুর একজন কে পছন্দ হয়েছে আর পুটু একজন কে ভালোবাসে।"
সবার চাহনি দেখে মনে হল ঘরে বোমা ফেটেছে আর তারপরেই সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। এত চুপ যে বেড়াল চলে গেলে তার পায়ের শব্দ শোনা যেতে পারে। আমি নিজের বুকের ধুকপুকানি শুনতে পেলাম, হাতুড়ির মতন বারেবারে বাড়ি মারছে ফুসফুসে। বড় কারুর দিকে তাকাবার একটুও সাহস নেই, সবাই যেন আমাদের দিকে ক্ষুধার্ত বাঘের মতন তাকিয়ে, পারলে এখানেই খেয়ে ফেলবে। সেই সময়ে বাবা জেঠার সামনে উঁচু গলায় কথা বলা অথবা প্রেম ভালোবাসার কথা ব্যাক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো, কি করে কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু একটা বিহিত করতেই হবে।
বাবা আমার দিকে বাঘের মতন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে গুরু গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, "কি ব্যাপার এইসব?"
আমি চোখ বন্ধ করে দেখলাম যে হাসি কান্না মিশিয়ে আমার সামনে ছন্দা দাঁড়িয়ে, মনের কথা না বললে আমার ভালোবাসা চিরদিনের মতন চলে যাবে। আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে সাহস জুগিয়ে নিজের কথা না বলে আগে অনুর ব্যাপারে বললাম, "অনু একজন কে ভালোবাসে, আমাদের কলেজের বন্ধু।"
সিধু জেঠা গম্ভীর কণ্ঠে অনুকে জিজ্ঞেস করলো, "কি নাম কি করে কোথায় থাকে?"
অনু ধরা গলায় আমতা আমতা করে কিছু একটা বললো কিন্তু কেউ শুনতে পেল না। ওর হয়ে ছোড়দি বললো, "ছেলের নাম দেবশিস রায়, একসাথে এরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। দেবাশিস ধানবাদ থেকে এম টেক করেছে, বর্তমানে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে লেকচারার।"
কথা শুনে মনে হল সবাই একটু নড়েচড়ে বসলেন, বাবা আমাকে জিজ্ঞস করলেন, ২আর তোর কি ব্যাপার?"
আমি বার কতক ঢোঁক গিলে কোন রকমে বললাম, "আগে অনুর ব্যাপারে বলি তারপরে আমার কথায় আসছি। আগে বল কি বলতে চাও তোমরা? দেবাশিস ভালো বাড়ির ছেলে। তোমাদের পছন্দ করা ছেলের চেয়েও বেশি ভালো, অনু কোন ভুল পথে যায়নি।"
সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন হুঙ্কার পাড়লেন, "প্রেম করেছে আর ভুল পথে যায়নি? কি সব আবোল তাবোল কথাবার্তা।"
ওই হুঙ্কার শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেল, অনু ডুকরে কেঁদে উঠলো, "আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।"
দুই জ্যাঠা মিলে আমাদের দিকে প্রায় তেড়ে আসে, কিন্তু ছোড়দি মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লো আর আমাদের বাঁচিয়ে দিল। ছোড়দি মাঝে দাঁড়াতেই আমার জেঠু বললেন, "তোর ব্যাপার আলাদা, বিশুকে ছোট বেলা থেকে চিনি আর এখানে? কাউকেই চিনি না কাউকেই জানি না, কি বৃত্তান্ত কি ব্যাপার।"
আমি বললাম, "ঠিক আছে, আমি দেবাশিস কে ডেকে নিচ্ছি পরিচয় হয়ে যাবে।"
সিধু জ্যাঠা বাঘের মতন শুধু মাত্র একটা শব্দ করলেন, "হুম"
বাবা গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, "ওর ব্যাপার বুঝলাম আর তোর কি ব্যাপার সেটা শুনি?"
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আর তখন আমার জেঠিমা আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ধীর পায়ে জেঠিমার কাছে যেতেই আমার কান ধরে টেনে বললেন, "তোর কি মধুছন্দাকে পছন্দ?"
আমি ওই কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম, আমতা আমতা করে বললাম, "হ্যাঁ মানে তুমি কি করে জানলে?"
জেঠিমা কান টেনে লম্বা করে বললেন, "এমনি এমনি চুল সাদা হয়নি রে আমার পুটু। আকাশের বিয়েতে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘোল পাকিয়েছিস তোরা।"
বাবা আমাকে প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে দিলেন, "কি নাম মেয়ের, কি বৃত্তান্ত, বাবা কি করেন একটু শুনি।"
দেখলাম এবারে না বলে কোন উপায় নেই, হাড়ি ভাংতেই হবে, "না মানে আমার কলেজের বান্ধবী, মধুছন্দা সমাদ্দার। বর্তমানে পার্ক স্ট্রিটে একটা বড় রঙের কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবা নেই, মা এস এস কে এম হস্পিটালে নার্স।"
জ্যাঠা আঁতকে উঠলেন, "সমাদ্দার? মানে পূর্ব বঙ্গের? না না এই হতে পারে না, সমাদ্দার জাতে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট। তুই কি না শেষ পর্যন্ত আমাদের কুলের নাম ডুবাবি? আমরা ', পরিবার সেটা জেনে বুঝে তুই এই করলি?"
বাবা কাকা সবাই এক কথায় নারাজ, "পূর্ব বঙ্গের মেয়ে বাড়িতে আনা চলবে না তার ওপরে আমাদের চেয়ে নিচু জাতের।"
সেকালে হোক কি একালে হোক, এই বৈষম্য এখন আছে, সেই একটা ব্যাপারে কোলকাতা কেন সারা পৃথিবী আজও একত্র।
আমি দেখলাম আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে এই সময়ে বুকের পাটা চুপসিয়ে গেলে হবে না, "অতীতে তোমাদের কুল যে ', ছিলো তাঁর কি প্রমান?"
জ্যাঠা বাবা প্রায় তেড়ে ওঠেন আমার ওপরে, "কি বলছিস তুই, আমরা চট্টোপাধ্যায় ',। সেই সুতানটির সময় থেকে এইখানে বাস আমাদের।"
হঠাৎ কি যে হয়ে গেল আর আমি বলে ফেললাম, "ছোট বেলায় বায়লজি টিচার আমাদের পড়িয়েছিলো যে আমরা সবাই নাকি বাঁদর গোস্টি থেকে উদ্ভুত। সেটা ঠিক না ভুল?"
অনেকেই আমার কথা শুনে হেসে ফেললেন কিন্তু জ্যাঠা মশায় , সিধু জ্যাঠা বাবা তেড়ে উঠলেন, "বড় বাড় বেড়ে গেছিস, বাপ ঠাকুরদার নাম ডুবিয়ে দিলি শেষ পর্যন্ত।”
মানা না মানা, কথা কাটাকাটি আরও বেশ কিছুক্ষণ চলল এই ভাবে, জ্যাঠা বাবা কিছুতেই মানতে রাজি নয় ছন্দার ব্যাপারে। মা কাকিমা জেঠিমা এর মাঝে তর্ক জুড়ে দিলেন, বৈঠকখানা মাছের বাজারের মতন হয়ে গেল। অনু কান্না থামিয়ে চুপচাপ ছোড়দির হাত ধরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমিও সমান তালে বচসা করলাম বুঝাতে চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ ধরে যে এই জাতপাত নিয়ে কি হবে, কে পূর্ব বঙ্গের কে পশ্চিম বঙ্গের, কি হয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম যে যখন তিনি অপারেশান থিয়েটারে অপারেশান করেন তখন কি অন্য জাতের মানুষের রক্ত নীল রঙের দেখতে পান? আমি অনড় যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে ওই মধুছন্দাকেই করব নচেত আর কাউকে নয়। কথাবার্তা শুনে মনে হল দেবুর আর অনুর ব্যাপারে বিশেষ অসুবিধে হবে না। আমি বারেবারে দরজার দিকে তাকাই এবারে যদি বিশুদা এসে কিছু করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত আমার জেঠিমা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমি একটা কথা বলি, আগে এই দেবাসিশ কে ডাকা যাক তারপরে পুটুর ব্যাপারে কথা বলছি।"
অনু এক দৌড়ে জেঠিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। জেঠিমা ওকে সান্তনা দিয়ে বললো, "আচ্ছা বাবা আগে তোর ওই দেবাসিশ কে দেখি আমরা তারপরে বাছ বিচার করবো।"
সিধু জ্যাঠা আমাকে বললেন, "দেবাসিশকে ডাক।"
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, "এখুনি?"
বাবা বললেন, "হ্যাঁ এখুনি। আর তারপরে তোর বিচার হবে।"
জেঠিমা বাবাকে বললেন, "গগন, মধুছন্দাকে আমার পছন্দ, মানুর বিয়েতে, আকাশের বিয়েতে তোমরা সবাই ওকে দেখেছ। বি টেক করা চাকরি করা বৌমা, এর পরে আর কারুর কিছু কি বলার আছে?"
জেঠিমার ওই কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপ কিছুপরে আমার মা হেসে সিধু জ্যাঠাকে বললেন, "তাহলে অধির কে একটা ফোন করে দিন, ওদের আসতে বারন করে দিন। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে, ওদের নিজেদের পছন্দ অপছন্দ আছে। বিয়ের তারিখ একটু দেখে শুনে করতে হবে তাহলে। এই বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে আর ওই বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা, ঢাক ঢোল একটু বেশি না বাজলে কি করে হবে।"
আমাদের বাড়ির কোন বিয়েতে ঢাক ঢোল কম বাজে না, এর মধ্যে তিন তিনখানা বিয়ে হয়ে গেছে, বড়দির বিয়ে, ছোড়দির সাথে বিশুদার বিয়ে আর একবছর আগেই মেজদার বিয়ে। এতক্ষণ বুকের মাঝে বেঁধে থাকা স্বস্তির শ্বাস বেড়িয়ে এলো, শেষ পর্যন্ত তাহলে সবার মতামত আছে, যাক তাহলে সব মিটমাট হয়ে গেল।
ঠিক সেই সময়ে বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে দুম করে বললে ফেললো, "না না অনুর বিয়ে হতেই পারে না। আমি সব বলছি আগে আমার কথা শোনা হোক....."
বড়দার কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো আর ছোড়দি এক ধমক দিয়ে বললো, "তুমি থামো তো। শেষ পাতে শুক্তো দিয়ে আর মুখ মারতে হবে না। তোমার আশায় বসে থাকলে এদের এতোক্ষনে বিয়ে হয়ে যেত !
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!