09-07-2020, 01:11 PM
রোদে ভেজা তিলোত্তমা (#১৪)
এম টেক প্রায় শেষ হতে চললো, রিসার্চ করবো না চাকরি করব সেই নিয়ে একটু দোটানায় পড়লাম। একবার ছন্দার সাথে আলোচনা করেছিলাম, ছন্দা আমাকে বলেছিলো যে রিসার্চ করতে।
সেদিন ছন্দার অফিসের পরে আমরা ফ্লুরিসে বসে কেক আর চা খাচ্ছিলাম। ছন্দা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "কি নিয়ে রিসার্চ করবে কিছু ঠিক করলে?"
আমি তখন পর্যন্ত সেই রকম কিছু ভাবিনি কিন্তু বড় ইচ্ছে ছিলো থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, আমি সেটাই ওকে জানালাম। ছন্দা চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বললো, "এখানে না বিদেশে?"
আমি ওকে হেসে বললাম, "থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে করব এই টুকু জানি, এখানে না বিদেশে সেটা এখন ভাবিনি। তবে জি আর ই দেওয়ার ইচ্ছে আছে সেটা অনেক কঠিন ব্যাপার তারপরে দেখা যাবে।" কিছুক্ষণ থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মাসিমাকে আমাদের ব্যাপারে কিছু বললে কি?"
ছন্দা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিচকি হেসে বললো, "নিজেই নিজের বাড়িতে কিছু বলেনি আর আমাকে আগে বলতে বলছে। যাই হোক আমি মা'কে তোমার ব্যাপারে একটু খানি বলে রেখেছি, মা তোমাকে এই রবিবার বাড়িতে ডেকেছে।"
আমি হেসে বললাম, "বাপ রে একদম শাশুড়ির সামনে যেতে হবে? এযে বাঘের মুখে পড়ার চেয়েও সাঙ্ঘাতিক।"
আমার হাতের ওপরে চাঁটি মেরে বললো, "তুমি না একদম যাঃতা আমার মা মোটেই রাগি নয়। আর তোমাকে দেখে গলে যাবে দেখ। এম টেক করা জামাই তার ওপরে আবার রিসার্চ করবে সে তো বিশাল ব্যাপার।"
আমি ওর হাত চেপে প্রশ্ন করলাম, "তোমার অমত নেই তো?"
হাতের তালুতে চিমটি কেটে বললো কপট রাগ দেখিয়ে বললো, "হ্যাঁ খুব আছে, রবিবার যদি না আস তাহলে আর বিয়েই করবো না।"
সেই রবিবার দুপুরের আগেই আমি ছন্দার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। তার আগের রাতে আমার ঘুম হলো না, কি ভাবে কি কথা বলবো। এদিকে নিজের বাড়িতে কিছুই জানানো হয়নি, এমত অবস্থায় ছন্দার মায়ের সামনে কি বলবো। ওর বাড়িতে ঢোকার আগে আমার ঘাম ছুটে গেল, মনে হল বুকের ওপরে শক্তিশেল বিদ্ধ হয়েছে।
কলিং বেল বাজানোর আগে আমি বার কয়েক বড় বড় শ্বাস নিলাম। কলিং বেল বাজাতেই ছন্দা এসে দরজা খুলে দিল, প্রেম করার পরে সেই প্রথমবার ছন্দার বাড়িতে পা রাখলাম। ছোট দুটো কামরার ঘর আর একটা ছোট বসার ঘর, ছোট হলেও বেশ সুন্দর করে সাজানো। আমি ওকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার, চোখের ইশারায় আমাকে উত্তরে বললো যে সব ঠিক আছে শুধু আমি যেন ঠিক থাকি। কিছু পরে ছন্দার মা, যূথিকা দেবী ঘরে ঢুকলেন। আমি উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম। আমার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া। আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করে দিল, ছাগল কাটার আগে যেমন তাকে খাইয়ে পড়িয়ে পুজো করা হয় নিজেকে ঠিক তেমন মনে হল। আমি যদিও বেশি খেতে ভালোবাসি না তাও মাসিমা অনেক কিছু রান্না করেছিলেন।
খেতে বসে এটা খাও সেটা খাও আর ছন্দা মাসিমা কে বারন করে বলে, "আরে মা ওকে অত কিছু দিও না, ওকে শুধু ডাল ভাত আলু ভাজা দিও তাতেই খুশি। হ্যাঁ ইলিশটা আর মিষ্টিটা একটু ভালো খায়, তোমার খরচ বেঁচে যাবে।"
সেই কথা শুনে মাসিমা হেসে ফেললেন, "প্রথম বার এসেছে একটু খাবে না?"
আমিও মন রক্ষার্থে অনেক কিছু খেয়ে ফেললাম আর বললাম, "আপনার মেয়ে কি সত্যি রান্নাবান্না পারে না?"
মাসিমা হেসে বললেন ওকে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি তবে মাঝে মাঝে নিজে থেকে কিছু করতে চেষ্টা করে। আমি বললাম যেদিন ওর হাতের রান্না খেতে হবে সেদিন আমাকে হস্পিটাল যেতে হবে। ছন্দা ওর মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ ভেঙ্গিয়ে জানিয়ে দিল, যে পরে আমাকে দেখে নেবে।
খাওয়ার পরে মাসিমা আমাকে বাড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তরে বাবার নাম বললাম, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে সব কিছু জানালাম, আমি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, আমাদের বাড়ির সাথে অনুসুয়ার বাড়ির যোগাযোগ ইত্যাদি সব কিছু খুলে জানালাম।
সবকিছু শোনার পরে মাসিমা আমাকে বললেন, "শোন বাবা, আমরা পূর্ব বঙ্গের মানুষ।" আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে ছন্দা আমাকে ওর ইতিহাস আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছে। মাসিমা মেয়ের হাতখানি নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আমাকে বললেন, "আমার একটাই মেয়ে, বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলে আমার চেয়ে ওর বেশি কাছের ওর পড়াশুনা সবকিছু এই করেছে। অনেক কষ্টে একে আমি এই পর্যন্ত এনেছি বাকিটা ওর হাতে আর তোমার হাতে। আমার অমত নেই তবে তুমি নিজের বাড়িতে একবার এই বিষয়ে বিস্তারে কথা বল। তোমরা পশ্চিম বঙ্গের আদি বাসিন্দা তাঁর ওপরে ', পরিবার, কথা বলে দেখ তাদের কি মতামত।"
আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ছন্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে মাসিমার কথা শুনে ওর চোখ ছলছল করছে। আমি মাসিমার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, "আমি ঠিক সময়ে সব কিছু ঠিক করে দেব।"
এর মাঝে একদিন বউবাজার গিয়ে ওর জন্য একটা সোনার হার কিনলাম। সেই হার গলায় পরে খুব খুশি, আর আমার খুশি ওর ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে। হার কেনার সময়ে আমাকে বকা শুনতে হয়েছিলো, ছয় মাসের স্টাইপেন্ডের টাকা জমিয়ে ওকে ওই সোনার হার কিনে দিয়েছিলাম।
জানিনা কি করে কি ঠিক করব তবে সেদিন মাসিমার সামনে কথা দিয়ে এসেছিলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলাম কি করা যায়। ভাবতে ভাবতে সকালের দিকে পথ খুঁজে পেলাম, নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাতে হবে যে বাড়ির কেউ আমার কথা ফেলতে পারবে না। ঠিক করলাম যে এম টেক করার পরে জি আর ই দেব আর বিদেশ যাবো রিসার্চ করতে। জ্যাঠা বাবা সবাই একবার বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে, সেই চুড়ায় আমাকে পৌছাতেই হবে।
এরপরে একদিন আমি সবকিছু খুলে বললাম ছন্দাকে। আমার কথা শুনে ছন্দা বেঁকে বসল, কিছুতেই আমাকে বিদেশে ছাড়বে না। আমি নাকি বাইরে গেলে ওকে ভুলে যাবো। একদিকে আমার প্রেম আমার ভালোবাসা আর অন্যদিকে আমার পড়াশুনা। আমি ছন্দাকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না যে রিসার্চ সেরে আমি দেশে ফিরে আসব। ছন্দার এক কথা, আমি বিদেশে গিয়ে অইখানকার মেয়েদের দেখে ওকে ভুলে যাবো আর সেখানেই থেকে যাবো। ছন্দা আমার সাথে দেখা করা এমনকি কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিল।
একদিন বিকেলে ফ্লুরিসে বসে ওকে বললাম, "এই সব আমি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য করছি, সোনা। আমাকে সেই চুড়ায় পৌছাতেই হবে। তুমি সোজা পথে কোনোদিন ভাবতে চেষ্টা কর না তাই না?"
ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "তুমি দুই বছরের জন্য বাইরে চলে যাবে, কোন বড় একটা ইউনিভার্সিটি থেকে এম ফিল করার পরে কি কেউ দেশে ফিরে আসে? তুমিও আসবে না আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি।"
আমি ওর হাত ধরে কাতর মিনতি করে বললাম, "ছন্দা, তুমি আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে এই বুকে কোনোদিন ঠাঁই দিতে পারবো না।"
ছন্দা ধরা গলায় বললো, "তারমানে তুমি এই বলতে চাও যে বিয়ে করে আমি তোমার সাথে বিদেশ চলে যাবো?"
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, "যদি আমি বিদেশে থেকে যাই তাহলে সেটাই।"
ছন্দা মাথা দুলিয়ে বললো, "না সেটা কখনই সম্ভব নয় পার্থ, আমার ভাই এখন অনেক ছোট ওর পড়াশুনা আছে, মাকে দেখার আছে, আমি তোমার সাথে কখনই বিদেশ যেতে পারবো না।"
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি চাও আমি তাহলে কি করবো?"
ছন্দা চশমা খুলে আঁচলের খুট দিয়ে চোখ মুছে আমাকে অবাক করে বললো, "তুমি আমাকে ভুলে যাও, পার্থ!"
আমাকে কিছু বলার অবকাশ দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে আমার দেওয়া গলার হার দেখিয়ে বললো, "আমার কপাল খালি থাকবে তোমার জন্য, যদি তুমি ফিরে আস তাহলে এই কপালে সিঁদুর পড়িও, না হলে..... এটাই আমার সর্বস্ব এটাকে সম্বল করেই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।"
আমি স্থানুবত ওই খানে অনেকক্ষণ বসে রইলাম, বসে বসে আমার জেদ চেপে গেল আমি জি আর ই দেব আর বাইরে যাবো। আমি আলবাত ফিরে আসব আর ওকে দেখিয়ে দেব যে আমার ভালোবাসা ফেলনা নয়, মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম ওই ফ্লুরিসে বসে।
আমার ইচ্ছে ছিলো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, এম টেক শেষ করে আমি জি আর ই দিলাম আর সেই ছাড় পত্র পেয়েও গেলাম। আমার সাথে সাথে নবীন ও জি আর ই দিয়েছিলো, জার্মানির খুব নামকরা একটা ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করার ছাড় পত্র পেয়ে গেল।
দুই বছরে অনু শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছে তাই কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারল না আর না পারাটাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিলো যাতে ওর বাড়ি থেকে বিয়ের ব্যাপারে চাপ না দেয় আর ততদিনে যাতে দেবু একটা ভালো চাকরি পেয়ে যায়। এম টেক করার পরে কলেজের লেকচারার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল দেবু। দেবুর লেকচারার হওয়াতে অনু আহ্লাদে আটখানা এবারে ওদের বিয়ে করাতে বিশেষ অসুবিধে হবে না।
ছন্দার সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ কোন কথাবার্তা হল না, রোজ রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার বিনিদ্র রজনী কাটত, ভাবতাম আমি যে পথে যাচ্ছি সেটা ঠিক না ভুল, উত্তর হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার জি আর ই পাওয়ার খবর ছন্দাকে অনু দিয়েছিলো, ছন্দা তার উত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দেখে অনু বিস্মিত হয়েছিলো। আমি ওর বিস্ময় দূর করে ওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিলাম এবং এও বলেছিলাম যে ছন্দাকে আর কিছু যেন না বলে। আমি ওকে বলেছিলাম সব কিছু যেন সময়ের অপরেই ছেড়ে দেয়।
এম টেক প্রায় শেষ হতে চললো, রিসার্চ করবো না চাকরি করব সেই নিয়ে একটু দোটানায় পড়লাম। একবার ছন্দার সাথে আলোচনা করেছিলাম, ছন্দা আমাকে বলেছিলো যে রিসার্চ করতে।
সেদিন ছন্দার অফিসের পরে আমরা ফ্লুরিসে বসে কেক আর চা খাচ্ছিলাম। ছন্দা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "কি নিয়ে রিসার্চ করবে কিছু ঠিক করলে?"
আমি তখন পর্যন্ত সেই রকম কিছু ভাবিনি কিন্তু বড় ইচ্ছে ছিলো থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, আমি সেটাই ওকে জানালাম। ছন্দা চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে বললো, "এখানে না বিদেশে?"
আমি ওকে হেসে বললাম, "থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে করব এই টুকু জানি, এখানে না বিদেশে সেটা এখন ভাবিনি। তবে জি আর ই দেওয়ার ইচ্ছে আছে সেটা অনেক কঠিন ব্যাপার তারপরে দেখা যাবে।" কিছুক্ষণ থেমে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মাসিমাকে আমাদের ব্যাপারে কিছু বললে কি?"
ছন্দা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিচকি হেসে বললো, "নিজেই নিজের বাড়িতে কিছু বলেনি আর আমাকে আগে বলতে বলছে। যাই হোক আমি মা'কে তোমার ব্যাপারে একটু খানি বলে রেখেছি, মা তোমাকে এই রবিবার বাড়িতে ডেকেছে।"
আমি হেসে বললাম, "বাপ রে একদম শাশুড়ির সামনে যেতে হবে? এযে বাঘের মুখে পড়ার চেয়েও সাঙ্ঘাতিক।"
আমার হাতের ওপরে চাঁটি মেরে বললো, "তুমি না একদম যাঃতা আমার মা মোটেই রাগি নয়। আর তোমাকে দেখে গলে যাবে দেখ। এম টেক করা জামাই তার ওপরে আবার রিসার্চ করবে সে তো বিশাল ব্যাপার।"
আমি ওর হাত চেপে প্রশ্ন করলাম, "তোমার অমত নেই তো?"
হাতের তালুতে চিমটি কেটে বললো কপট রাগ দেখিয়ে বললো, "হ্যাঁ খুব আছে, রবিবার যদি না আস তাহলে আর বিয়েই করবো না।"
সেই রবিবার দুপুরের আগেই আমি ছন্দার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। তার আগের রাতে আমার ঘুম হলো না, কি ভাবে কি কথা বলবো। এদিকে নিজের বাড়িতে কিছুই জানানো হয়নি, এমত অবস্থায় ছন্দার মায়ের সামনে কি বলবো। ওর বাড়িতে ঢোকার আগে আমার ঘাম ছুটে গেল, মনে হল বুকের ওপরে শক্তিশেল বিদ্ধ হয়েছে।
কলিং বেল বাজানোর আগে আমি বার কয়েক বড় বড় শ্বাস নিলাম। কলিং বেল বাজাতেই ছন্দা এসে দরজা খুলে দিল, প্রেম করার পরে সেই প্রথমবার ছন্দার বাড়িতে পা রাখলাম। ছোট দুটো কামরার ঘর আর একটা ছোট বসার ঘর, ছোট হলেও বেশ সুন্দর করে সাজানো। আমি ওকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার, চোখের ইশারায় আমাকে উত্তরে বললো যে সব ঠিক আছে শুধু আমি যেন ঠিক থাকি। কিছু পরে ছন্দার মা, যূথিকা দেবী ঘরে ঢুকলেন। আমি উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম। আমার কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে দুপুরের খাওয়া দাওয়া। আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করে দিল, ছাগল কাটার আগে যেমন তাকে খাইয়ে পড়িয়ে পুজো করা হয় নিজেকে ঠিক তেমন মনে হল। আমি যদিও বেশি খেতে ভালোবাসি না তাও মাসিমা অনেক কিছু রান্না করেছিলেন।
খেতে বসে এটা খাও সেটা খাও আর ছন্দা মাসিমা কে বারন করে বলে, "আরে মা ওকে অত কিছু দিও না, ওকে শুধু ডাল ভাত আলু ভাজা দিও তাতেই খুশি। হ্যাঁ ইলিশটা আর মিষ্টিটা একটু ভালো খায়, তোমার খরচ বেঁচে যাবে।"
সেই কথা শুনে মাসিমা হেসে ফেললেন, "প্রথম বার এসেছে একটু খাবে না?"
আমিও মন রক্ষার্থে অনেক কিছু খেয়ে ফেললাম আর বললাম, "আপনার মেয়ে কি সত্যি রান্নাবান্না পারে না?"
মাসিমা হেসে বললেন ওকে কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি তবে মাঝে মাঝে নিজে থেকে কিছু করতে চেষ্টা করে। আমি বললাম যেদিন ওর হাতের রান্না খেতে হবে সেদিন আমাকে হস্পিটাল যেতে হবে। ছন্দা ওর মায়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মুখ ভেঙ্গিয়ে জানিয়ে দিল, যে পরে আমাকে দেখে নেবে।
খাওয়ার পরে মাসিমা আমাকে বাড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তরে বাবার নাম বললাম, আমাদের বাড়ির ব্যাপারে আমাদের পরিবারের ব্যাপারে সব কিছু জানালাম, আমি যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, আমাদের বাড়ির সাথে অনুসুয়ার বাড়ির যোগাযোগ ইত্যাদি সব কিছু খুলে জানালাম।
সবকিছু শোনার পরে মাসিমা আমাকে বললেন, "শোন বাবা, আমরা পূর্ব বঙ্গের মানুষ।" আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম যে ছন্দা আমাকে ওর ইতিহাস আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছে। মাসিমা মেয়ের হাতখানি নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আমাকে বললেন, "আমার একটাই মেয়ে, বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলে আমার চেয়ে ওর বেশি কাছের ওর পড়াশুনা সবকিছু এই করেছে। অনেক কষ্টে একে আমি এই পর্যন্ত এনেছি বাকিটা ওর হাতে আর তোমার হাতে। আমার অমত নেই তবে তুমি নিজের বাড়িতে একবার এই বিষয়ে বিস্তারে কথা বল। তোমরা পশ্চিম বঙ্গের আদি বাসিন্দা তাঁর ওপরে ', পরিবার, কথা বলে দেখ তাদের কি মতামত।"
আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ছন্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে মাসিমার কথা শুনে ওর চোখ ছলছল করছে। আমি মাসিমার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, "আমি ঠিক সময়ে সব কিছু ঠিক করে দেব।"
এর মাঝে একদিন বউবাজার গিয়ে ওর জন্য একটা সোনার হার কিনলাম। সেই হার গলায় পরে খুব খুশি, আর আমার খুশি ওর ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখে। হার কেনার সময়ে আমাকে বকা শুনতে হয়েছিলো, ছয় মাসের স্টাইপেন্ডের টাকা জমিয়ে ওকে ওই সোনার হার কিনে দিয়েছিলাম।
জানিনা কি করে কি ঠিক করব তবে সেদিন মাসিমার সামনে কথা দিয়ে এসেছিলাম। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলাম কি করা যায়। ভাবতে ভাবতে সকালের দিকে পথ খুঁজে পেলাম, নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাতে হবে যে বাড়ির কেউ আমার কথা ফেলতে পারবে না। ঠিক করলাম যে এম টেক করার পরে জি আর ই দেব আর বিদেশ যাবো রিসার্চ করতে। জ্যাঠা বাবা সবাই একবার বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে, সেই চুড়ায় আমাকে পৌছাতেই হবে।
এরপরে একদিন আমি সবকিছু খুলে বললাম ছন্দাকে। আমার কথা শুনে ছন্দা বেঁকে বসল, কিছুতেই আমাকে বিদেশে ছাড়বে না। আমি নাকি বাইরে গেলে ওকে ভুলে যাবো। একদিকে আমার প্রেম আমার ভালোবাসা আর অন্যদিকে আমার পড়াশুনা। আমি ছন্দাকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না যে রিসার্চ সেরে আমি দেশে ফিরে আসব। ছন্দার এক কথা, আমি বিদেশে গিয়ে অইখানকার মেয়েদের দেখে ওকে ভুলে যাবো আর সেখানেই থেকে যাবো। ছন্দা আমার সাথে দেখা করা এমনকি কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিল।
একদিন বিকেলে ফ্লুরিসে বসে ওকে বললাম, "এই সব আমি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য করছি, সোনা। আমাকে সেই চুড়ায় পৌছাতেই হবে। তুমি সোজা পথে কোনোদিন ভাবতে চেষ্টা কর না তাই না?"
ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "তুমি দুই বছরের জন্য বাইরে চলে যাবে, কোন বড় একটা ইউনিভার্সিটি থেকে এম ফিল করার পরে কি কেউ দেশে ফিরে আসে? তুমিও আসবে না আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি।"
আমি ওর হাত ধরে কাতর মিনতি করে বললাম, "ছন্দা, তুমি আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে এই বুকে কোনোদিন ঠাঁই দিতে পারবো না।"
ছন্দা ধরা গলায় বললো, "তারমানে তুমি এই বলতে চাও যে বিয়ে করে আমি তোমার সাথে বিদেশ চলে যাবো?"
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, "যদি আমি বিদেশে থেকে যাই তাহলে সেটাই।"
ছন্দা মাথা দুলিয়ে বললো, "না সেটা কখনই সম্ভব নয় পার্থ, আমার ভাই এখন অনেক ছোট ওর পড়াশুনা আছে, মাকে দেখার আছে, আমি তোমার সাথে কখনই বিদেশ যেতে পারবো না।"
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি চাও আমি তাহলে কি করবো?"
ছন্দা চশমা খুলে আঁচলের খুট দিয়ে চোখ মুছে আমাকে অবাক করে বললো, "তুমি আমাকে ভুলে যাও, পার্থ!"
আমাকে কিছু বলার অবকাশ দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে আমার দেওয়া গলার হার দেখিয়ে বললো, "আমার কপাল খালি থাকবে তোমার জন্য, যদি তুমি ফিরে আস তাহলে এই কপালে সিঁদুর পড়িও, না হলে..... এটাই আমার সর্বস্ব এটাকে সম্বল করেই আমি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।"
আমি স্থানুবত ওই খানে অনেকক্ষণ বসে রইলাম, বসে বসে আমার জেদ চেপে গেল আমি জি আর ই দেব আর বাইরে যাবো। আমি আলবাত ফিরে আসব আর ওকে দেখিয়ে দেব যে আমার ভালোবাসা ফেলনা নয়, মিস মধুছন্দা সমাদ্দারকে মিসেস মধুছন্দা চট্টোপাধ্যায় করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম ওই ফ্লুরিসে বসে।
আমার ইচ্ছে ছিলো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে থার্মোডায়নামিক্স নিয়ে রিসার্চ করার, এম টেক শেষ করে আমি জি আর ই দিলাম আর সেই ছাড় পত্র পেয়েও গেলাম। আমার সাথে সাথে নবীন ও জি আর ই দিয়েছিলো, জার্মানির খুব নামকরা একটা ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করার ছাড় পত্র পেয়ে গেল।
দুই বছরে অনু শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছে তাই কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারল না আর না পারাটাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিলো যাতে ওর বাড়ি থেকে বিয়ের ব্যাপারে চাপ না দেয় আর ততদিনে যাতে দেবু একটা ভালো চাকরি পেয়ে যায়। এম টেক করার পরে কলেজের লেকচারার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেল দেবু। দেবুর লেকচারার হওয়াতে অনু আহ্লাদে আটখানা এবারে ওদের বিয়ে করাতে বিশেষ অসুবিধে হবে না।
ছন্দার সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ কোন কথাবার্তা হল না, রোজ রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার বিনিদ্র রজনী কাটত, ভাবতাম আমি যে পথে যাচ্ছি সেটা ঠিক না ভুল, উত্তর হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। আমার জি আর ই পাওয়ার খবর ছন্দাকে অনু দিয়েছিলো, ছন্দা তার উত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দেখে অনু বিস্মিত হয়েছিলো। আমি ওর বিস্ময় দূর করে ওকে সব ঘটনা খুলে বলেছিলাম এবং এও বলেছিলাম যে ছন্দাকে আর কিছু যেন না বলে। আমি ওকে বলেছিলাম সব কিছু যেন সময়ের অপরেই ছেড়ে দেয়।
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!